মৌষলকাল – উপন্যাস সমরেশ মজুমদার

কাছাকাছি কোথাও বৃষ্টি হয়েছে, বাতাসে তার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। সকাল থেকেই আকাশ কাদাটে মেঘ মেখে ঝিম ধরে আছে, গাছের পাতাগুলো মুখ নিচু করে, বাতাস পেলেই দুপাশে দুলছে, যে-কোনও মুহূর্তেই বৃষ্টি নামবে কিন্তু বৃষ্টির দেখা পাওয়া যাচ্ছিল না। ঈশ্বরপুকুর লেনের এই বস্তির সকালটাও বেশ চুপচাপ। মাধবীলতা কয়েকদিন আগে বলেছিল, সারা বছর ধরে যদি এইরকম থমথমে বৃষ্টি না ঝরা মেঘ, চারদিক ছায়া ঘনিয়ে থাকত তা হলে শান্তিতে কাটানো যেত!

অনিমেষ অবাক হয়েছিল, তুমি রোদ্র চাও না?

না। মাথা নেড়েছিল মাধবীলতা।

সে কী!

রোদ উঠতেই এই বস্তির মানুষগুলো পালটে যায়। সারাক্ষণ চিৎকার, ঝগড়া, অশ্লীল কথার বন্যা বয়ে যায়। যত দিন যাচ্ছে তত লক্ষ করছি, ওসব বলার সময় কেউ মা-বোন-দিদির উপস্থিতি কেয়ার করে না। কিন্তু রোদ না উঠলে, আকাশে মেঘ থাকলে এদের চরিত্র বদলে যায়। তখন কেউ চেঁচামেচি, ঝগড়া করে না। মাধবীলতা বলেছিল।

জানালার পাশের তক্তপোশে শুয়ে আকাশ দেখতে দেখতে মাধবীলতার কথাগুলো ভাবছিল অনিমেষ। কথাটা প্রায় সত্যি। অন্তত আজকের সকালে তো বটেই। এই সময় বস্তির কোথাও চিৎকার নেই। অথচ কাল রাত্রেও মনে হয়েছিল রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে। বস্তির ওদিকের ঘরগুলোতে ইলেকট্রিকের কানেকশন দেয় সুরেন মাইতি। প্রতি পয়েন্টের জন্যে মাসে তিরিশ টাকা নেয়। ওর সঙ্গে ইলেকট্রিক কোম্পানির নাকি খুব ভাব আছে। তাই রাস্তার পেছনের লাইন থেকে হুক করে বিদ্যুৎ নিতে কোনও সমস্যায় পড়তে হয় না। সেই বিদ্যুৎ ওদিকের ঘরে ঘরে বিক্রি করে মোটা টাকা আয় করে প্রতি মাসে। ঈশ্বরপুকুর লেনের বামফ্রন্টের অন্যতম নেতা হল সুরেন মাইতি। কথাবার্তা চালচলন দেখে মনে হয় ও এই এলাকার মুখ্যমন্ত্রী। কখনও সখনও সুরেন মাইতি তার কাছে আসে। দরজায় দাঁড়িয়ে বলে, খুব খারাপ লাগে দাদা, আপনি এভাবে বসে গেলেন! সেদিন পার্টি অফিসে আপনার কথা বলছিলেন মিনিস্টার। ভুল রাজনীতি করে নিজের যে সর্বনাশ করেছিলেন তা শুধরে নেওয়ার প্রস্তাব নাকি দেওয়া হয়েছিল। আপনি রাজি হননি। এখন বলুন, কী লাভ হল তাতে?

অনিমেষ গম্ভীর গলায় বলেছিল, ভাবতে হবে।

ভাবুন। হেসে চলে গিয়েছিল সুরেন মাইতি।

আর একদিন দরজায় এসে পান চিবোতে চিবোতে বলেছিল, আজ বিকেলে লোকাল পার্টি অফিসে মিনিস্টার আসছেন। আপনাকে চা খেতে ডেকেছেন। যাবেন তো?

দেখি।

এতে দেখার কী আছে? কজনকে মিনিস্টার চা খেতে ডাকে বলুন?

পায়ে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে।

দেখুন।

লোকটাকে একদম পছন্দ না হলেও নিজেকে চেপে রাখে অনিমেষ। আগে হলে মুখের ওপর সত্যি কথা বলে দিত। তাতে লোকটার কী প্রতিক্রিয়া হত তা নিয়ে মাথা ঘামাত না। বয়স এবং অর্থাভাব মানুষকে দুর্বল করে। এই সত্যিটা মেনে না নিয়ে কোনও উপায় নেই। গত রাত্রে ঝামেলাটা চরমে উঠেছিল। বস্তির দুটি ঘরের বাসিন্দা বিদ্যুতের দাম দিতে পারেনি বলে সুরেন মাইতির লোক কানেকশন কাটতে গিয়েছিল। যাদের ঘর তারা বাধা দিয়েছিল। লোকটা পার্টি অফিসে গিয়ে সুরেন মাইতিকে ব্যাপারটা জানায়। রাত এগারোটা নাগাদ দশজনের দলটা বস্তিতে ঢোকে। বেছে বেছে তারা ওই দুটি ঘরের বাসিন্দাদের বাইরে টেনে বের করে বেধড়ক মারে। ঘরের ভেতর যা ছিল তা আর আস্ত রাখেনি। বস্তির অন্য বাসিন্দারা এগিয়ে গিয়েছিল কিন্তু বাধা দিতে পারেনি। চারজনের হাতে অস্ত্র ছিল। অবাধ্য হওয়ার জন্যে শিক্ষা দিয়ে কয়েকটা বোমা ফাটিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ওরা চলে গিয়েছিল রেললাইনের দিকে। তার মিনিট দশেকের মধ্যে ছুটে এসেছিল সুরেন মাইতি সদলে। এসে নাটক করল। চেঁচিয়ে ভর্ৎসনা করল ভিড় করে আসা জনতাকে। বাইরের কিছু গুন্ডা এসে বস্তিতে হামলা করে গেল আর সবাই কী করে মুখ বুজে সেটা সহ্য করল সুরেন মাইতি ভেবে পাচ্ছে না। যে দুটি ঘরের বাসিন্দারা আঘাত পেয়েছিল তাদের চিকিৎসার জন্যে ডাক্তার ডাকিয়ে আনল সে। এই ভূমিকা দেখে জনতা ধীরে ধীরে পাতলা হয়ে গেল।

জানলা দিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে হাসল অনিমেষ। সেই কবে থেকে একই খেলা চলে আসছে। মাঝে মাঝে তার মনে হত এই বস্তি, পার্টির নিচুতলার নেতাদের কীর্তিকাহিনি নিশ্চয়ই কেন্দ্রীয় নেতাদের কানে পৌঁছোয় না। যাদের সঙ্গে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়েছে তাদের অনেকেই তো হয় কেন্দ্রীয় নেতা নয় মন্ত্রী। কিন্তু ক্রমশ ধারণা বদলে যাচ্ছে তার। আর যাই হোক নেতারা মূর্খ বা বধির নয়। এতদিনে খবরগুলো তাদের অজানা থাকতে পারে না।

দরজায় শব্দ হল। তারপরই প্রশ্ন, এখনও শুয়ে আছ?

অনিমেষ চোখ ফেরাল। মাধবীলতা দাঁড়িয়ে আছে। হাতে বাজারের ব্যাগ।

অনিমেষ উঠে বসল, কী করব! এরকম ওয়েদারে কিছুই তো ভাল লাগে না।

ছেলে উঠেছে? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

বোধহয় না। সাড়া পাইনি।

কাল কখন ফিরেছে জানো?

না।

পৌনে একটায়। কিছু খেল না, বলল ঘুম পাচ্ছে।

অনিমেষ কিছু বলল না। তক্তপোশ থেকে নামতে নামতে দেখল মাধবীলতা বাজারের ব্যাগ হাতে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। সে চোখ বন্ধ করল। ধীরে ধীরে তার মাথার চুলের সব কালো মুছে গেছে। আজকাল দাড়ি কামাতেও ইচ্ছে হয় না কিন্তু মাধবীলতার তাড়ায় একদিন অন্তর কামাতে হয়। কিন্তু সে গোঁফ রেখেছে, কঁচাপাকা গোঁফ। আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজেকে অপরিচিত মনে হয়। মাধবীলতা পালটে গিয়েছে অনেক। শরীর খুবই শীর্ণ হয়েছে, মুখের আদল বদলে গিয়েছে। চুলে সাদা ছোপ থাকলেও তা আগের মতন কোমরের নীচে থমকে আছে। এখন সে হাঁটে খুব শ্লথ গতিতে। অনিমেষের সন্দেহ হয় মাধবীলতা পুরোপুরি সুস্থ নয়। ওকে অনেকবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছে সে, কিন্তু মাধবীলতার এক কথা, আমার কিছুই হয়নি। খামোক ডাক্তারকে পয়সা দিতে কেন যাব? অথবা, শরীর থাকলেই অসুখ থাকবে, যে অসুখ ঘুমিয়ে আছে, কোনও ঝামেলা করছে না, খুঁচিয়ে তাকে জাগাবার কোনও মানে আছে?

অনিমেষ ক্রাচ বগলে নিয়ে ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে চিলতে উঠোনে নামল। এই বস্তির সেরা এলাকা এটা। প্রথমে যে বারোয়ারি বাড়ির ছোট্ট ঘরে ছিল ওরা তা থেকে একসময় সরে এসে এই বাড়িতে থাকছে কয়েক বছর আগে থেকে। দুটো ঘর, একচিলতে উঠোন, রান্নাঘর, আলাদা কল-পায়খানা। বস্তির মালিকের বদান্যতায় অনেক কম ভাড়ায় পেয়ে গেছে অর্ক। ফলে অন্যদের সঙ্গে একটা ব্যবধান তৈরি হয়েছে। একটু আড়াল, যার কারণে স্বচ্ছন্দে থাকা যায়। কলের জলে মুখ ধুয়ে, প্রাকৃতিক কাজ শেষ করে সে ছেলের ঘরের সামনে দাঁড়াল। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।

রান্নাঘর থেকে মাধবীলতার গলা ভেসে এল, ওকে ডেকো না!

কটা বাজে এখন? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

যাই বাজুক। সারাদিন পরিশ্রম করে অত রাত্রে এসেছে, ঘুমোতে দাও।

চা করবে নাকি?

একটু দেরি হবে।

তা হলে আমি কালীবাবুর দোকান থেকে ঘুরে আসি।

যাও, কিন্তু কোনও মন্তব্য কোরো না।

কীসের মন্তব্য?

কাল রাত্রে সুরেন মাইতিরা যা করেছে তা নিয়ে নিশ্চয়ই এখন ওখানে কথা হচ্ছে। সেসব কথার মধ্যে তোমার যাওয়ার দরকার নেই।

মাধবীলতা বলল।

অনিমেষ হাসল, মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করছ?

আশ্চর্য! আমি কিছুই করি না। কোনওদিন কিছু করেছি? ওখানে পাঁচজনের সামনে যা বলবে তা রিলে তো হবেই, তার সঙ্গে অনেক রং মিশে নানান জায়গায় পৌঁছে যাবে। তাই তোমাকে সাবধান করলাম। স্বাধীনতা হরণ করার আমি কে? মাধবীলতার গলায় বিরক্তি স্পষ্ট। ঘর থেকে পাঁচটা টাকা নিয়ে উঠোনের খোলা দরজা দিয়ে গলিতে পা বাড়াল অনিমেষ। দুধারে একতলা টিনের চালাওয়ালা বাড়ি, উনুনের ধোঁয়া, বাচ্চাদের বসে থাকার মধ্যে দিয়ে বস্তির সামনে চলে এল অনিমেষ। কালীবাবুর চায়ের দোকানে এখন একদম ভিড় নেই। এরকম তো হওয়ার কথা নয়। রোজ সকাল দশটা পর্যন্ত ভিড় উপচে পড়ে। খবরের কাগজ পড়া নিয়ে কাড়াকাড়ি হয়। এখন যে দুজন বসে আছে তাদের বিলক্ষণ চেনে অনিমেষ। দুজনই বাড়ির দালাল। কাগজ মুখে নিয়ে বসে আছে।

বেঞ্চিতে বসে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, আজ খদ্দেরদের দেখা নেই কেন?

কালীবাবু নেই, তার পুত্রবধূ এখন দোকান চালায়। বলল, কী জানি!

চা পাওয়া যাবে?

দিচ্ছি!

অনিমেষ চুপ করে গেল। কালীবাবুর পুত্রবধূর বয়স বেশি নয়। স্বামী কাঠের কাজ যতটা না করে তার চেয়ে বেশি চোলাই খেয়ে পড়ে থাকে। ফলে বউটির কথাবার্তায় অদ্ভুত নিরাসক্তি এসে গেছে। চেঁচিয়ে বলল, চায়ের দাম বাড়ছে।

কত?

তিন টাকা। আপনি তো বাজারে যান না, মাসি যায়। মাসিকে জিজ্ঞাসা করলে জানবেন জিনিসপত্রের দাম কীরকম বেড়ে গেছে। আমি তো চায়ের সঙ্গে চামড়ার গুঁড়ো মেশাতে পারব না। নিন। এক গ্লাস চা এগিয়ে ধরল বউটা।

উঠে গিয়ে সেটা নিতেই একজন দালাল কাগজ এগিয়ে ধরল।

পড়বেন?

অনিমেষ মাথা নাড়ল, না

সে কী!

কী হবে পড়ে? সেই একই খবর। খুন, জখম, রাহাজানি আর মিথ্যে কথার ফুলঝুরি। সাত দিন আগের কাগজকে তারিখ বদলে আজকের বলে চালালে কোনও তফাত পাব না। চায়ে চুমুক দিল অনিমেষ। চিনি কম। চাইতে গিয়ে থমকে গেল সে। বাড়িতে চা বানালে মাধবীলতা তত এর চেয়ে কম চিনি দেয়। বলে, চায়ের চিনি রক্তে জমুক তা নিশ্চয়ই চাও না।

চায়ে চুমুক দিতে দিতে নিজের মনে হাসল অনিমেষ। ষাট পেরিয়ে গেলেও শুধু পা ছাড়া এই শরীরের আর কোথাও রোগ ঢুকেছে বলে মনে হয় না। বাবা বা দাদুর রক্তে সুগার ছিল বলে ছেলেবেলায় সে শোনেনি। ওটা উত্তরাধিকারসূত্রে আসে অথবা টেনশনের কারণে তৈরি হয়। এখন সে যে জীবনযাপন করে তাতে টেনশনের কণামাত্র নেই। তবে খবরের কাগজ পড়লে মনখারাপ হয়ে যায়। একটু-আধটু রাগও হয়, কিন্তু সেটাকে নিশ্চয়ই টেনশন বলে না।

দুটো ছেলে চায়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল। একজন কালীবাবুর পুত্রবধুকে বলল, জলদি, দুটো চা ছাড়ো।

পাঁচটা টাকা বের করো। দিচ্ছি। কাল থেকে ছয় নেব।

দ্বিতীয়জন হাসল, পাগল নাকি!

পুত্রবধূ বলল, মানে?

বেলগাছিয়াতে কেউ আমাদের কাছে চায়ের দাম নেয় না।

যারা নেয় না তাদের কাছে যাও। আমার দোকানে সুরেনদা পর্যন্ত চা কিনে খায়।

সুরেনদা চা কিনে খায়? হি হি হাসল প্রথমজন, আমাদের চমকিয়ো বউদি।

পুত্রবধু এতক্ষণ বসে ছিল, এবার উঠে দাঁড়াল, আমি চমকাচ্ছি? ডাকব সুরেনদাকে?

সঙ্গে সঙ্গে চুপসে গেল ছেলে দুটো। প্রথমজন দ্বিতীয়জনকে বলল, ফোট। দ্বিতীয়জন বলল, না। বউদির হাতের চা খেয়ে যাব।

পকেট থেকে খুচরো বের করে গুনে সামনের পাটাতনে রাখল, দিন বউদি।

অনিমেষ ওদের দেখছিল। কী দ্রুত নিজেদের বদলে ফেলতে পারে। চায়ের গ্লাস নিয়ে ওরা খানিকটা দূরে সরে যেতেই সে কালীবাবুর পুত্রবধূকে বলল, তোমার বেশ সাহস আছে।

সাহস না থাকলে এই কাকগুলো ঠুকরে শেষ করে দেবে কাকা। বউটি বলল।

কাকা! আজকাল কাকা শুনলে ভাল লাগে। বেশিরভাগ সময় হয় দাদু নয় জেঠু শুনতে হয়, তার তুলনায় কাকা শুনলে নিজেকে কমবয়সি বলে মনে হয়।

এইসময় মহেন্দ্র ঘটককে দেখা গেল। একসময় অভিজাত পরিবার বলে এই পাড়ার লোক ওঁদের খুব সম্মান করত। এখনও সাতসকালেও আদ্দির পাঞ্জাবি আর ধুতি পরে বের হন। হাতে দামি লাঠি থাকে। ওঁর বাবা তো

বটেই উনিও এককালে কংগ্রেসি ছিলেন। ইন্দিরা গাঁধীর মৃত্যুর পর রাজনীতি ছেড়ে দিলেও মুখ খুললেই ইতিহাস বলেন। সেইসঙ্গে খিস্তিখেউড় করতে দ্বিধা করেন না। দোকানের সামনে এসে একবার তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এই যে অনিমেষবাবু, কাল রাত্রে নাকি সুরেনের লোক দাঁত উপড়ে দিয়ে গেছে?

অনিমেষ মাথা নাড়ল, যখন সবই জানেন, তখন প্রশ্ন করছেন কেন?

কনফার্ম করার জন্য প্রশ্ন করছি। আপনার গায়ে বিছুটি লাগছে কেন?

কালীবাবুর পুত্রবধূ গলা তুলল, দাদু, আমার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে এসব বলবেন না।

কেন? এই রাস্তাটা তোমার কাকার নাকি! শোনো হে, তোমার শ্বশুরমশাই, আমাদের কালীপ্রসাদ, জীবনে কখনও আমাকে না বলেনি। এসেছিলাম ভাল করতে–! হ্যাঃ। এইজন্যে বলে কখনও কারও ভাল কোরো না। লাঠির ওপর ভর দিয়ে বৃদ্ধ মহেন্দ্র ঘটক চলে গেলেন ট্রামরাস্তার দিকে।

বাড়ির দালালদের একজন মন্তব্য করল, আজ কী হল? বুড়োর মুখে খিস্তি শুনলাম না।

চায়ের দাম দিয়ে ক্রাচ নিয়ে উঠে দাঁড়াল অনিমেষ। ঠিক তখনই বস্তিতে ঢুকতে গিয়ে সাইকেল থেকে নেমে পড়ল খবরের কাগজের হকার শ্যামল। এগিয়ে এসে বলল, জেঠু, আপনার একটা চিঠি ভুল করে আমাদের ঘরে দিয়ে গেছে। একটু দাঁড়ান, নিয়ে আসছি।

মিনিট তিনেকের মধ্যে শ্যামল খামটা নিয়ে এসে অনিমেষের হাতে দিল।

কবে পেয়েছিলে এটা? খামটা দেখতে দেখতে প্রশ্ন করল অনিমেষ।

গতকাল রাত্রে চিঠির বাক্সে পড়ে থাকতে দেখেছিলাম। আমাদের ওদিকের বস্তিতে তো একটাই চিঠির বাক্স। ভুল করে ওখানেই ফেলে গেছে। পিয়ন। রাত হয়ে গিয়েছিল বলে আপনাকে আর বিরক্ত করিনি।

শ্যামল দেরির কারণ ব্যাখ্যা করল।

অনেক ধন্যবাদ ভাই। অন্য কেউ হলে হয়তো এটা পাওয়াই যেত না।

অনিমেষ হাসলে শ্যামল আবার বস্তির ভেতর ঢুকে গেল। খামটা দেখল অনিমেষ। তার নাম-ঠিকানা লেখা। গোটা গোটা অক্ষরে। বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না, মহিলার হাতের লেখা। পোস্ট অফিসের স্ট্যাম্প দেখতে গিয়ে হতাশ হল। কলকাতারটা স্পষ্ট কিন্তু অন্য স্ট্যাম্প একদম ঝাপসা, কোথায় পোস্ট হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। খাম ছিঁড়ে চিঠি বের করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়তে বাধল অনিমেষের, ওটা আপাতত পকেটে ঢুকিয়ে রাখল। কিন্তু কে তাকে চিঠি দিল? সে মনে করতে পারছিল না শেষবার কবে তার নামে চিঠি এসেছে! শুধু তার নামে কেন, মাধবীলতা স্কুল থেকে অবসর নেওয়ার পরে কিছু কাগজপত্র ডাকে এসেছিল। এ ছাড়া ওকেও চিঠি লেখার কেউ পৃথিবীতে আছে বলে মনে হয় না। আর অর্ক! ওর পকেটের মোবাইল কথা বলা এবং চিঠি লেখার দুটো কাজই করে দেয়। খাম পোস্টকার্ডের দরকার পড়ে না।

.

০২.

বাড়ির দিকে এগোচ্ছিল অনিমেষ, পেছন থেকে একটি ছেলে জেঠু জেঠু বলে ডাকতে ডাকতে ছুটে এল। অনিমেষ ঘুরে দাঁড়ালে ছেলেটি বলল, আপনাকে একটু দাঁড়াতে বলল।

কে?

সুরেনদা।

অনিমেষ মুখ তুলে তাকাতেই দূরে দাঁড়ানো সুরেন মাইতিকে দেখতে পেল। তিনজন লোকের সঙ্গে কথা বলছে। সে তাকালে হাত নেড়ে থামতে বলল। কথা শেষ করে এগিয়ে এল সুরেন মাইতি, গুড মর্নিং। চা খেতে এসেছিলেন?

হ্যাঁ।

কাল রাত্রের ঘটনা শুনেছেন?

হ্যাঁ।

কী শুনেছেন? থামল সুরেন মাইতি।

ওপাশের দুটো ঘরে ভাঙচুর হয়েছিল। এইটুকু।

তা হলে এর বেশি কিছু শোনেননি! কিন্তু আমি শুনেছি। আমি নাকি ইলেকট্রিকের ভাড়া না পেয়ে ক্যাডার দিয়ে ওদের ঘরে হামলা করেছি, ওদের মেরেছি। আমি একটা কথা বুঝতে পারি না, এরা আমাকে কী ভাবে? আমি উজবুক? যে ডালে বসে আছি সেই ডাল কাটব? যাদের সঙ্গে থাকি, যাদের ভোটে আমার দল পাওয়ারে আছে তাদের ঘর ভাঙব? আরে, মুখের ওপর কিছু বলবে না কিন্তু ব্যালটে যখন ছাপ মারবে তখন তো আমি সামনে থাকব না। দুজনের ঘর ভাঙলে দুহাজার ভোট আমাদের বিরুদ্ধে যাবে। জেনেশুনে এই বোকামিটা আমি করব? বলুন? সুরেন মাইতি জিজ্ঞাসা করল।

করা উচিত নয়।

একশোবার। খবর পেয়েই পার্টির মিটিং ছেড়ে আমি দৌড়ে এসেছিলাম। আমিই যদি ওটা করতাম তা হলে কি আসতাম? আপনি বলুন!

আপনার কথায় যুক্তি আছে। অনিমেষ ফিরে যাওয়ার জন্যে পাশ ফিরতেই সুরেন মাইতি বলল, এখন কথা হচ্ছে, হামলা যখন হয়েছে, তখন

কারা সেটা করল?

একটু অবাক হল অনিমেষ। সে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। সুরেন মাইতি মাথা নাড়লেন, কাল রাত থেকে চেষ্টা করছি কারা কাজটা করল তা জানতে। আজ একটু আগে খবরটা পেলাম।

কী খবর?

হরিনাথ আর ক্ষিতিশ, ওই দুঘরে যারা থাকে, রোজ মালগাড়ির টানা মাল ক্যারি করে পৌঁছে দিত আড়তে। তার জন্যে দুজনে পার ট্রিপ দুশো করে পেত। কদিন থেকে নাকি ওরা ক্যারি করার সময় খানিকটা মাল সরিয়ে অন্যদের বিক্রি করে দিত। সেটা ধরতে পেরে ওয়াগন ব্রেকাররা যার কাছে খাটে, সে নোক পাঠিয়ে কাণ্ডটা করেছে। সুরেন মাইতি হাসল।

সে কী!

বুঝুন কাণ্ড। এলাকায় থেকে যাদের ভাল ভাবি তারা বাইরে গিয়ে এই কাণ্ড করছে তা বুঝব কী করে? কাল যে এখানে খুন হয়ে যায়নি তাই ওদের ভাগ্য। সুরেন মাইতি বলল, আমি কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাতে চাইনি। কার মেয়ে আয়ার কাজ করতে যাওয়ার নাম করে শরীর বেচে পয়সা কামাচ্ছে তাতে আমার কী? যতক্ষণ না সেই সমস্যা সে এলাকায় টেনে আনছে ততক্ষণ আমার মুখ বন্ধ থাকবে। ঠিক কি না? সুরেন মাইতি জিজ্ঞাসা করল।

মাথা নাড়ল অনিমেষ, তার আর ওখানে দাঁড়াতে ইচ্ছে করছিল না। সে বুঝতে পারছিল লোকটা সমানে মিথ্যে বলে যাচ্ছে কিন্তু সেটা বললে বোকামি করা হবে। এতদিনে অনেক দেখার পর এই সত্যিটাকে মানতে বাধ্য হচ্ছে সে।

দূরে গাড়ির আওয়াজ হতে সুরেন মাইতি বলল, এসে গেছে।

কে?

পুলিশ। আমিই খবরটা দিয়েছি। যারা মার খেয়েছে তারা থানায় যায়নি কেন, আমিই পুলিশকে বলেছি এসে তদন্ত করতে। সুরেন মাইতির কথা শেষ হতেই গাড়িটা এসে দাঁড়াল। আজকাল পুলিশের গাড়ি দূর থেকে দেখলে চেনা যায় না। সেই জিপগুলোকে বোধহয় আর ব্যবহার করা হয় না।

একটা আধুনিক গাড়ি থেকে নেমে এলেন যে ভদ্রলোক তার পরনে পুলিশের ইউনিফর্ম নেই। হাতজোড় করে বললেন, সুপ্রভাত সুরেনবাবু। ঘটনাটা কোথায় ঘটেছিল?

ওই ওপাশের গলির ভেতর।

হরিনাথ এবং ক্ষিতিশকে এখন পাওয়া যাবে?

হ্যাঁ। মনে হয় ওরা ঘরেই আছে। সুরেন মাইতি অনিমেষকে দেখাল, চেনেন?

মাথা নাড়লেন দুপাশে ভদ্রলোক।

সুরেন মাইতি বললেন, ইনি অনিমেষ মিত্র। এককালে বিখ্যাত নকশাল নেতা ছিলেন। আমাদের মন্ত্রীদের অনেকেই ওঁর বন্ধু ছিলেন তার আগে। দাদা, উনি থানার বড়বাবু।

নকশাল? এখনও ওসব করেন নাকি?

ওই আন্দোলন এখনও আছে নাকি? অনিমেষ না জিজ্ঞেস করে পারল না।

চেহারা বদলেছে, রং পালটেছে। তারা এখন মাওবাদী হয়েছে।

আমি ঠিক জানি না। আপনার পূর্বসূরিরা আমার এই পা-কে অকেজো করে দেওয়ার পর আর ওইসব নিয়ে ভাবার আগ্রহ চলে গেছে। অনিমেষ বলল।

সুরেন মাইতি বললেন, দাদাকে তো ছোট্টবেলা থেকে দেখছি, রাজনীতি থেকে সাত হাত দূরে থাকতেন। এলাকার বাইরে খুব কম যান। একসময় তো আমাদের পার্টিতে ছিলেন, তাই কতবার বলেছি, পার্টি অফিসে আসুন, আসেননি। মন্ত্রী খবর দিলেও যান না। থাকগে, চলুন স্যার, আপনাকে ঘটনাস্থলে নিয়ে যাচ্ছি।

ওরা এগিয়ে গেলে অনিমেষ দেখল একটু একটু করে মানুষ বেরিয়ে আসছে বস্তির ভেতর থেকে। কিন্তু কারও মুখে কথা নেই। ওরা ওপাশের গলিতে ঢুকতেই ভিড় পেছন পেছন চলল।

সুরেন মাইতি বুদ্ধিমান লোক। নিজের মুখোশটাকে মুখ প্রমাণ করতে থানার বড়বাবুকে ডেকে নিয়ে এসেছে। বড়বাবু নিশ্চয়ই খুব জেরা করবেন হরিনাথ আর ক্ষিতিশকে। চোরাই মালের ক্যারিয়ার হওয়ার জন্যে খুব ধমকাবেন। হয়তো এও বলবেন, সুরেন মাইতির অনুরোধে এবার ছেড়ে দিচ্ছেন ওদের। কাজটা যে ওয়াগন ব্রেকাররা করিয়েছে তাতে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এইসব বলে যখন তিনি চলে যাবেন, তখন গোটা বস্তির লোক সুরেন মাইতির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবে।

কাকা, ব্যাপারটা কিছু বুঝলেন?

অনিমেষ তাকাল। ছেলেটির নাম বিশ্বজিৎ। বি. এ. পাশ করে টিউশনি করে সারাদিন। সন্ধ্যায় কংগ্রেসের পার্টি অফিসে গিয়ে বসে। মাঝে মাঝে আসে তার কাছে। গাঁধী এবং মার্কসের মধ্যে তুলনা করে কথা বলে। বেশ সিরিয়াস ধরনের ছেলে।

এখন আর আমি কিছু বুঝতে চাই না বিশ্বজিৎ। হাসল অনিমেষ।

এটা কী বলছেন? আপনি অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে নেই। ভারতীয় নাগরিক হিসেবে আপনারও তো একটা ভূমিকা আছে।

অনিমেষ জবাব দিল না। এখনও রোদ ওঠেনি। সে আকাশের দিকে তাকাল।

জানি, আপনি ভোট দেন না। গত লোকসভা নির্বাচনে ৫৪ শতাংশ ভোট পড়েছিল। তার মানে হল, ৪৬ শতাংশ ভোট পড়েনি। অঙ্কটা বিশাল। কিন্তু ওই ভোট না দেওয়া মানুষগুলোও কিন্তু ভারতের নাগরিক। বিশ্বজিৎ গম্ভীর গলায় বলল।

তুমি কী বলতে চাইছ?

সুরেন মাইতি একজন চুনোপুঁটি নেতা। কিন্তু দেখুন, তার কাছেও পুলিশ কীরকম বিক্রি হয়ে গেছে। ও যা ভাববে পুলিশ তাই বলবে।

তোমার মতো সবাই তো দেখছে, ভাবছে। তা হলে বামবিরোধীরা ভোট পায় না কেন?

সত্যি কথা বলব?

অনিমেষ তাকাল।

বিরোধী দলকে কেউ বিশ্বাস করে না। আমাদের একজন নেতা নেই যার ওপর মানুষ আস্থা রাখতে পারে। থাকলে ওই ৪৬ শতাংশ মানুষের অর্ধেক ভোট বাক্সে পড়ত। ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যেত শাসকরা। আচ্ছা, চলি।

বিশ্বজিৎ যেভাবে এসেছিল সেভাবেই চলে গেল।

ধীরে ধীরে বাড়িতে ফিরে এল অনিমেষ। উঠোনে পা রাখতেই দেখল অর্ক বাইরে যাওয়ার পোশাকে বেরিয়ে আসছে ওর ঘর থেকে।

বেরুচ্ছিস নাকি? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

হ্যাঁ। অর্ক বলল, একটু দেরি হয়ে গেছে। ওপাশ থেকে মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, কখন ফিরবি? দুপুরে একবার ঘুরে যাব। অর্ক উঠোনের দরজার দিকে এগিয়ে গেল।

ওপাশের বস্তিতে সুরেন মাইতি থানার বড়বাবুকে নিয়ে ঢুকেছে। ওদিকে যাস না। অনিমেষ কথাগুলো বললে অর্ক কাধ নাচিয়ে বেরিয়ে গেল। বারান্দার চেয়ারে বসল অনিমেষ। একদম বদলে গিয়েছে ছেলেটা। এই বস্তির কারও সঙ্গে মেলে না, কথা বলে যতটা সম্ভব না বললে না, ততটাই।

চা খেয়েছ? মাধবীলতার গলা ভেসে এল রান্নাঘর থেকে।

হ্যাঁ। কাল থেকে চায়ের দাম বাড়ছে। অনিমেষ বলল।

অনেক আগেই বাড়ানো উচিত ছিল। বাজারে গেলে বুঝতে পারতে জিনিসপত্রের দাম কোথায় পৌঁছেছে। আমাদের না হয় ছেলের রোজগার আছে। স্কুল থেকে পাওয়া টাকার ইন্টারেস্ট আছে কিন্তু ভেবে দ্যাখো তো, যাদের মাসিক রোজগার পাঁচ-ছয় হাজার তারা কী করে সংসার চালাচ্ছে। বলতে বলতে গরম রুটি আর আলু-পেঁয়াজের চচ্চড়ি প্লেটে নিয়ে বেরিয়ে এল মাধবীলতা, নাও।

অনিমেষ প্লেটটা ধরে বলল, তোমারটা?

কাল থেকে ঢেকুর উঠছে। আমি মুড়িজল খাব।

আমাকেও তাই দিতে পারতে। এসব করার দরকার ছিল না।

মাধবীলতা হেসে ফেলল, বাব্বাঃ। এত প্রেম! তা হলে তুমিও ঢেকুর তোলো, শুনি।

বললেই ঢেকুর তোলা যায় নাকি! এত করে বলছি, চলো ডাক্তারের কাছে যাই।

প্লিজ আর উপদেশ দিয়ো না।

তোমার মুড়িজল নিয়ে এসো এখানে।

মাধবীলতা তাকাল। তারপর চলে গেল রান্নাঘরে। অনিমেষ অপেক্ষা করছিল। ওকে এক বাটি জলে মুড়ি ডুবিয়ে আনতে দেখে রুটিতে হাত দিল। পাশের চেয়ারে বসে চামচে মুড়ি তুলে মুখে দিয়ে মাধবীলতা বলল, এটা খেতে তো আমার ভালই লাগে।

খবরের কাগজ দেয়নি? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

দিয়েছিল। অর্ক ঘরে রেখে গেছে। আনব?

না। থাক। পরে পড়ব। তারপর সে সুরেন মাইতির সঙ্গে যা কথা হয়েছিল তা মাধবীলতাকে বলল। সব শুনে মাধবীলতা বলল, এইটেই তো স্বাভাবিক।

স্বাভাবিক?

নয়তো কী? তুমি যদি তখন পড়তে পড়তে পার্টি ছেড়ে না-দিতে তা হলে নিশ্চয়ই এখন মন্ত্রী হতে হলে তুমি আরও বড়মাপের মিথ্যাচার করতে।

সেটাও স্বাভাবিক হত।

আমিও করতাম! অনিমেষ অবাক হয়ে তাকাল।

শেয়ালদের দলে বাঘ যেমন থাকে না বেড়ালও থাকতে পারে না। মাধবীলতা বলল, তুমি সুরেন মাইতিকে মনের কথা বলে ফেলোনি তো?

হাসল অনিমেষ, নাঃ! আমি এখন অনেক বুদ্ধিমান হয়েছি।

হলে ভাল। অনেক লড়াই করার পর এখন স্বস্তিতে আছি। অর্ক বলত, চলো, কলকাতার কাছাকাছি অল্প দামে ফ্ল্যাট ভাড়া করে চলে যাই। কিন্তু এই বাড়িতে আসার পর আমার ফ্ল্যাটে যেতে ইচ্ছে করে না। এই উঠোন, রান্নাঘর, একদম আলাদা থাকতেই ভাল লাগে। বেশ মফসসল মফস্সল বলে মনে হয়। মাধবীলতা বলল।

সবই ঠিক আছে। কিন্তু ছেলেটার কথা ভাবো।

ভেবে যখন সুরাহা করতে পারব না তখন মাথা ঘামিয়ে কী লাভ?

ওরা এভাবেই আলাদা থাকবে? তার চেয়ে কোর্টে গিয়ে সম্পর্ক ছিন্ন করলে অনেক ভাল হত। মেয়ে ডিভোর্স দেবে না তাই ছেলেও ওই পথে হটবে না। অদ্ভুত।

এই সময় কয়েক ফোঁটা জল আকাশ থেকে নেমে এল উঠোনে, ঘরের চালে। মাধবীলতা বলল, শেষ পর্যন্ত বৃষ্টি নামল।

কোথায় বৃষ্টি! দ্যাখো, আর জল পড়ছে না। খাওয়া শেষ করে হাত ধুতে উঠতে গিয়ে মনে পড়ল তারা বলল, আমার পকেট থেকে খামটা বের করো তো।

কী খাম?

জানি না, শ্যামলদের লেটার বক্সে পিয়ন রেখে গিয়েছিল। খুলে দ্যাখো কে পাঠিয়েছে।

মাধবীলতা মুড়ির জল খেয়ে নীচে বাটি রেখে অনিমেষের পকেট থেকে খামটা বের করল। উলটে পালটে দেখে বলল, কালই তো এসেছে।

হাত ধুতে ধুতে অনিমেষ বলল, মেয়েলি হাতের লেখা, দ্যাখো।

মাধবীলতা খামের মুখ ছিঁড়ে সাদা কাগজটা বের করে চোখ রাখল। পড়ে নিয়ে অনিমেষের দিকে তাকাল।

কাছে এসে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কে লিখেছে?

ছোটমা।

অ্যাঁ। ছোটমা? কী লিখেছেন?

পড়ো।

তুমিই পড়ো।

মাধবীলতা পড়ল। স্নেহের অনিমেষ, স্নেহের মাধবীলতা। দীর্ঘকাল তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। বড়দিদির কাজের সময় তোমরা এসেছিলে, ফিরে গিয়ে পৌঁছানোর সংবাদ দেওয়ার পর আর কোনও চিঠি লেখোনি। এতকাল এই বাড়ি ভূতের মতো আগলে রেখেছিলাম। ধীরে ধীরে বাড়িটির অবস্থা খারাপ হচ্ছে। আমার অবস্থাও করুণ। লোকজন এসে ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে এই বাড়ি বিক্রি করে দেওয়ার জন্যে। জানি না এই চিঠি তোমরা পাবে কিনা। যদি পাও তা হলে কি একবার এখানে আসতে পারবে? তোমরা এবং অর্ক আমার আশীর্বাদ জেনো। ইতি, ছোটমা।

অনিমেষ বিড়বিড় করল, আমি জানতাম এই দিনটা একদিন আসবে।

মাধবীলতা কাগজটা ভাঁজ করে খামে ঢুকিয়ে বলল, সত্যি তো, আমাদের খুব অন্যায় হয়ে গিয়েছে। ভাড়াটের দেওয়া টাকায় বেশ চলে যাবে বলেছিলেন, তাই বিশ্বাস করেছিলাম, কিন্তু ওঁরও তো বয়স হচ্ছে।

অনিমেষ বলল, দাদু এবং পিসিমা চলে যাওয়ার পর ওই বাড়ির কথা আর ভাবিনি, টানও চলে গিয়েছিল। তা ছাড়া, আমরা গিয়েই বা কী করতে পারি।

যেতে লিখেছেন– মাধবীলতা থেমে গেল।

লিখে দাও, উনি যেন বাড়িটা বিক্রি করে দেন। আমাদের আপত্তি নেই।

সেটা চাইলে তো নিজেই করতে পারেন। আমাদের চিঠি লিখবেন কেন?

কিন্তু আমরা ওখানে গিয়ে কী করব?

হয়তো কিছুই করব না। কিন্তু একদিন যোগাযোগ না রেখে যে অন্যায় করেছি তার প্রায়শ্চিত্ত তো কিছুটা করা হবে। মাধবীলতা উঠল, আমার মনে হয় তোমার যাওয়া উচিত। যদি টিকিট পাও তা হলে আজই চলে যাও।

আমি? একা?

তুমি তো একাই স্বৰ্গছেঁড়া থেকে কলকাতায় এসেছিলে?

তখন আমি তরুণ। আর এখন? তুমি যাবে না কেন?

আমি গেলে ছেলের কী হবে? ওর খাওয়া দাওয়া–।

আশ্চর্য! একটা মাঝবয়সি ছেলের জন্যে তোমাকে থেকে যেতে হবে? না, তুমি সঙ্গে না গেলে আমি যাব না। অনিমেষ মাথা নাড়ল।

এই সময় ভেতরের ঘরে মোবাইল বেজে উঠল। মাধবীলতা দ্রুত ঘরে ঢুকে সেটাকে তুলে নিয়ে অন করল, হ্যালো। বল। দুপুরে আসতে পারবি না? কেন? ও। ঠিক আছে। আর হ্যাঁ, তুই দুটো ট্রেনের টিকিট কেটে আনতে পারবি? জলপাইগুড়ির, সঙ্গে টাকা আছে! জোগাড় করে নে, কাল দিয়ে দিবি। হ্যাঁ, কালকের টিকিট। রাখছি।

বাইরে বেরিয়ে মাধবীলতা বলল, ছেলে ফোন করেছিল।

তোমার কথায় সেটা বুঝলাম। কিন্তু তুমি কালই টিকিট কাটতে বললে কেন?

ওই চিঠি পড়ার পরে দেরি করার কোনও যুক্তি আছে?

যাওয়ার আগে তো কিছু কাজ থাকে। অর্ক আসুক, ওর সঙ্গে কথা বলা তো দরকার। টাকাপয়সার ব্যাপারটাও তো আছে। অনিমেষ বলল।

তোমাকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। মেঝে থেকে প্লেট বাটি তুলে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল মাধবীলতা।

এই সময় উঠোনের দরজায় শব্দ হল। বাসনগুলো নামিয়ে রেখে মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, কে? ভেতরে এসো।

মেয়েটি ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে উঠোনে কয়েক পা এগোল, মাসিমা আর পারছি না। মনে হচ্ছে আত্মহত্যা করি। ভগবান! ঠোঁট কামড়াল মেয়েটি।

আবার কী হল? মাধবীলতা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে।

আমাকে শেষ না করে ও ছাড়বে না।

তোকে এর আগেও বলেছি সুজাতা, থানায় যা। ওর বিরুদ্ধে ডায়েরি কর।

গিয়েছিলাম। ডায়েরি নেয়নি। মেয়েটি কেঁদে ফেলল।

কেন?

আমরা স্বামী-স্ত্রী নই শুনে এমন হাসাহাসি করল যে পালিয়ে এসেছিলাম। ব্যঙ্গ করছিল, যার সঙ্গে ঘর ছেড়েছ এখন সে-ই তোমার শত্রু হয়ে গেল! জিজ্ঞাসা করল, কী করো তুমি? বললাম, কারখানায় কাজ করি। বিশ্বাসই করল না। সুজাতা বলল, আমি কী করব?

এখন ও কী চাইছে?

রোজ সন্ধ্যায় আমার ঘরে এসে মদ গিলবে আর সমানে খিস্তি করে যাবে। কিছু বললেই চেঁচাবে। তারপর জোর করে দশ টাকা নিয়ে চলে যাবে। ওর পকেটে অনেক টাকা থাকলেও দশ টাকা ওর চাই-ই। আমি কারখানা থেকে রোজ ষাট টাকা পাই। তাতে ঘর ভাড়া দিয়ে খেতেই সব ফুরিয়ে যায়। তার ওপর এই অত্যাচার সহ্য করতে পারছি না।

সুজাতা কথা শেষ করতেই অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, আজ কাজে যাওনি?

না। আজ কারখানা বন্ধ। মালিক হাসপাতালে ভরতি হয়েছে কাল। সুজাতা বলল।

বন্ধ কারখানা যদি না খোলে–? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

আমি জানি না কী হবে। দুহাতে মুখ ঢাকল সুজাতা।

এখন একটা কথা বল তো। মুখ থেকে হাত সরা–!

কয়েক সেকেন্ড সময় নিল সুজাতা। আঙুল দিয়ে জল মুছল।

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, তুই কি এখনও লোকটাকে ভালবাসিস?

দ্রুত মাথা নাড়ল সুজাতা, না। একদম না।

ঠিক আছে এখন যা। বিকেল বিকেল এখানে চলে আসিস ঘরে তালা দিয়ে। আশপাশের লোকজন যেন না জানতে পারে তুই এখানে এসেছিস। যা।

সুজাতা মাথা নেড়ে চলে গেল।

অনিমেষ বলল, একদিন লুকিয়ে রেখে তুমি ওর কী উপকার করবে? এইসব মেয়েরা কেন যে ঘর ছাড়ার আগে ভালবাসার মানুষটাকে চিনতে পারে না।

মাধবীলতা হেসে ফেলল। অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, হাসছ যে? মাধবীলতা বলল, সবাই তো ভবিষ্যৎ দেখতে পায় না।

.

০৩.

বিকেল বিকেল চলে এল সুজাতা। মাধবীলতা তখন সুটকেসের সামনে বসে।

অনিমেষ বলেছে দিন সাতেক ওখানে থাকবে। সেই হিসেবে জামাকাপড় নিতে গিয়ে দেখল বছরে একবার, পুজোর সময় ছাড়া জামাকাপড় কেনা

না হওয়ায় ভালর সংখ্যা বেশ কম। এই কয় বছরে অনিমেষ বস্তির বাইরে একদম যায় না। তাই ভাল পোশাকের প্রয়োজন হয় না ওর। মাধবীলতার অবশ্য কয়েকটা ভাল শাড়ি জামা আছে। হঠাৎ খেয়াল হল, অর্কর জামা তো অনিমেষের গায়ে খুব একটা বেমানান হবে না, মনে হওয়াতে স্বস্তি এল।

দরজায় সুজাতাকে দেখে মাধবীলতা বলল, ও, এসো।

সুটকেস গোছাচ্ছেন? সুজাতা জিজ্ঞাসা করল।

হ্যাঁ, কাল আমরা জলপাইগুড়িতে যাচ্ছি।

সে কী। চমকে উঠল সুজাতা।

অবাক হয়ে তাকাল মাধবীলতা।

আমি আজ সারাদিন ভাবছিলাম আপনাকে পাশে পেলে ওর বিরুদ্ধে। লড়াই করতে পারব।

লড়াই করতে হলে অন্যের সাহায্য ছাড়া করা যায় না?

আমি আর পারছি না। নিজের ওপর এক ফোঁটা ভরসা নেই আমার।

ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল সুজাতা। তারপর আঁচলে চোখ ঢাকল।

বসো। ওই মোড়াটা টেনে নাও। মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, কীভাবে আলাপ হয়?

কয়েক সেকেন্ড সময় নিল সুজাতা। তারপর বলল, আমাদের স্কুলের টিচার।

তোমার থেকে কত বড়?

বারো-তেরো বছর।

একটু পরিষ্কার করে বলো তো!

পড়ানোর সময় দেখতাম অন্য মেয়েদের দিকে না তাকিয়ে আমার দিকে বেশি তাকাতেন। এই নিয়ে আমাকে ওরা খ্যাপাত। বলত স্যার তোর প্রেমে পড়ে গেছেন। আমি বিশ্বাস করতাম না। আমি তো মোটেই সুন্দরী নই। গায়ের রং শ্যামলা। ক্লাস টেনে আমার বাবা মারা যান। আমাদের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। দাদা তখন বি. এ. পড়ে। অনেক চেষ্টার পর বাবার অফিসে দাদার একটা চাকরি হওয়ায় আমরা উপবাস থেকে বেঁচে গেলাম। চাকরি পাওয়ার পর দাদা পালটে গেল। ও যা বলবে তা আমাদের শুনতে হত। স্কুল ফাইনালে আমার রেজাল্ট খারাপ হয়নি। পড়া বন্ধ করে বাড়ির কাজ করাতে চাইল মা। কিন্তু আমি রাজি হলাম না। টিউশানির টাকায় পড়তে চাইলাম। সেই সময়ে এই মাস্টারমশাই আমাকে খুব সাহায্য করতে লাগলেন। আমাকে আলাদা করে পড়তে সাহায্য করতেন। ফাইনাল পরীক্ষার পর দাদা আমার বিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠল। মা-ও ওকে সমর্থন করল। কিন্তু আমি কলেজে ভরতি হয়ে আরও পড়তে চাইছিলাম। দাদা তার বিরুদ্ধে। এইসময় মাস্টারমশাই আমাকে বাড়ি থেকে বের করে হাওড়ায় একটা ঘর ভাড়া করে রাখলেন। মা-দাদা দুজনেই জানিয়ে দিল যে তারা আর আমার মুখ দর্শন করবে না। সুজাতা চোখ বন্ধ করল।

তারপর? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

আমি কলেজে ভরতি হলাম। নিজে রান্না করে খেয়ে কলেজে যাই। দুবেলা ছেলেমেয়ে পড়াই। তাতেও কুলায় না। মাস্টারমশাই সাহায্য করেন। কখন যে তাঁর প্রেমে পড়ে গেলাম জানি না। তিনি আমার সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর মতো ব্যবহার করতে লাগলেন কিন্তু কখনওই রাতে থাকতেন না। যেখানে থাকতাম সেই অঞ্চলটা বিহারি শ্রমিকদের এলাকা বলে কেউ ওঁর আসা যাওয়া নিয়ে আপত্তি করত না। কিছুদিন পরে আমি তাকে বিয়ের কথা বললাম। শুনেই খুব রেগে গেলেন। বললেন, আমাদের দুজনের বয়েসের অনেক পার্থক্য, বিয়ে করলে লোকে হাসাহাসি করবে। অথবা, আমাকে বিয়ে করলে ওঁর মা-ভাই-বোন প্রচণ্ড দুঃখ পাবে। ঝগড়া শুরু হয়ে যেত উনি এলেই। তখন, এক বিকেলে তিনি মদের বোতল নিয়ে এলেন। ঘরে বসে অনেকটা মদ খেয়ে গায়ের জোরে সাধ মিটিয়ে চলে গেলেন। আমার খুব ঘেন্না করতে লাগল এবং এটাই চালু হয়ে গেল। আমি ওঁর টাকা নেওয়া বন্ধ করলাম। আধপেটা খেয়ে থাকতাম। ছেলেবেলা থেকে আমার লেখালেখির শখ ছিল। তখন সময় কাটাতে যা মনে আসে তা লিখতাম। ওর বিরুদ্ধেও কত কথা লিখেছি। একদিন সেই লেখা হাতে পেয়ে আমাকে খুব মারলেন মদ খাওয়ার পরে।

তার পরদিন তিনি এলেন না। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তারপরে অনেকদিন তার দেখা পেলাম না। আমার হাতে তখন একটা টাকাও নেই। টিউশনিগুলো কী কারণে জানি না হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল। আমার পাশের ঘরে একজন বয়স্ক বিহারি মুসলমান থাকতেন। তাকে চাচা বলতাম। তার স্ত্রীকে চাচি। চাচি আমার অবস্থা বুঝতে পেরে চাচাকে বললেন কিছু একটা করতে। চাচা আমাকে নিয়ে গেলেন একটা কারখানায়। সেখানে তিনি কাজ করেন। চাচার অনুরোধ সত্ত্বেও মালিক প্রথমে রাজি হচ্ছিল

চাকরি দিতে। শেষ পর্যন্ত অন্য একটা কারখানায় চাচা আমাকে কাজ পাইয়ে দিলেন। মাল বইতে হত, ঝাড় দিতে হত। প্রতিদিন দশ ঘণ্টা কাজ করলে ষাট টাকা পাওয়া যেত। না করলে টাকা পাওয়া যেত না। মাসে পনেরোশো টাকার মতো হত। ঘরভাড়া দিয়ে দুবেলা খেতে পারতাম। কিন্তু অতবড় কারখানায় আমি একমাত্র মেয়ে, কর্মচারীদের বেশিরভাগই বিহারি। খুব অসুবিধে হত। আমার সঙ্গে অশ্লীল কথা বলার চেষ্টা করত। মালিককে বললে শুনতে হত, এই জন্যেই আমি মেয়েমানুষ রাখতে চাইনি। কাজ ছেড়ে দাও।

একমাস কাজ করে ছেড়ে দিলাম। একজন শ্রমিক আমাকে কুপ্রস্তাব দিয়েছিল। তখন আর একটা কারখানায় কাজ খুঁজে নিলাম। এই সময় মাস্টারমশাই উদয় হলেন। বললেন, বাড়ির চাপে বিয়ে করতে হল বলে এতকাল আসতে পারিনি। এখন থেকে আসব।

আমি চিৎকার করলে পাশের ঘরের চাচা-চাচি থেকে অন্যান্যরা ছুটে এলেন। তাঁরা মাস্টারমশাইকে শাসালেন, আমার ওপর অত্যাচার করলে ভবিষ্যতে ছেড়ে দেবেন না। মাস্টারমশাই আমাকে হুমকি দিয়ে চলে গেলেও পরের দিন ফিরে এসে জানালেন, আর আমি তোমাকে কিছু বলব না, শুধু বসে বসে কাজ করে চলে যাব।

আমি আর পারলাম না। যে কারখানায় কাজ করতাম সেখানকার একজন এই বস্তির ঘরের খবরটা দিল। আমি পালিয়ে এলাম এখানে। কিন্তু শনি আমাকে ছাড়ল না। ঠিক এই ঠিকানার খোঁজ পেয়ে গেল। তার নাকি বউয়ের চেয়ে আমাকে বেশি ভাল লাগে। কারখানার বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে এসব কথা শোনায় আমাকে। সুজাতা চুপ করল।

আজ এখানে আসবে বলেছে? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

হ্যাঁ।

তুমি বসো। মাধবীলতা উঠে পড়ল। পাশের ঘরের চেয়ারে বসে অনিমেষ তখন কিছুর হিসেব লিখছিল, মাধবীলতা ঘরে ঢুকে বলল, এখন সুরেন মাইতিকে পাওয়া যাবে?

সে কী? তাকে কী দরকার? মুখ তুলল অনিমেষ।

সুজাতাকে যন্ত্রণা দিতে একটা লোক এখানে আসবে। লোকটা যাতে আর না আসে তার ব্যবস্থা করতে হবে। সুরেন মাইতি সেটা পারবে। মাধবীলতা বলল।

মাথা নাড়ল অনিমেষ, তুমি আমাকে সুরেন মাইতির সাহায্য চাইতে বোলো না।

অনিমেষের মুখের দিকে তাকিয়ে মাধবীলতা হেসে ফেলল।

আমি কি হাস্যকর কিছু বললাম? অনিমেষ বিরক্ত হল।

তুমি এখনও মৌলবাদী রয়ে গেছ।

আমি? মৌলবাদী? অবাক হয়ে গেল অনিমেষ।

নয়তো কী? ধর্ম এবং রাজনীতি নিয়ে যারা গোঁড়ামি করে তাদেরই তো মৌলবাদী বলা হয়, তাই না? সেই কবে কমিউনিজমের মন্দিরে ঢুকেছিলে, বেরুনো দূরের কথা, দরজা জানলাগুলো খুলতে চাইছ না। এদিকে পৃথিবীর আবহাওয়া কত বদলে গিয়েছে তা জেনেও চোখ খুলছ না। আবার দ্যাখো, এই তুমি রোজগার করতে পারছ না এই আক্ষেপে রেসের পেনসিলার হতে চেয়েছিলে। তখন ওই কাজটাকে সর্বহারার শ্রম বলে ভেবেছিলে। মাধবীলতা ধীরে ধীরে বলল।

এত কথা বলছ কেন?

সুরেন মাইতিকে তুমি সহ্য করতে পারছ না। কমিউনিস্ট পার্টির নীচতলার এক নেতা হয়ে সে ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। যে কারণে তুমি বা তোমরা পার্টি ছেড়ে দিয়েছিলে বহু বছর আগে। অথচ সেই সুরেন মাইতির সঙ্গে দেখা হতে তোমাকে পাঁচ মিনিট ক্রাচ হাতে দাঁড়িয়ে কথা শুনতে হয়। উত্তর দাও। তাকে এড়িয়ে চলে আসতে পারো না। কিন্তু একটা ভাল কাজের জন্যেও সুরেন মাইতিকে অনুরোধ করতে গেলে তোমার মনে থেকে যাওয়া কমিউনিজমের অভিমান বড় হয়ে ওঠে। মাধবীলতা বলল, থাক, তোমাকে বলতে হবে না। আমিই যাব।

অনিমেষ বলল, আমি বুঝতে পারছি না, এসব ঝামেলায় না গিয়ে মেয়েটাকে আমাদের কাছেই থাকতে বলল। লোকটা এসে দরজা বন্ধ দেখে নিশ্চয়ই দাঁড়িয়ে থাকবে না।

আজ থাকবে না, কাল কী করবে সুজাতা? পরশু? মাধবীলতা বলল, ভালবাসার জন্য অনেক মাশুল দিয়েছে মেয়েটা। তুমি কখনও ভেবেছ, একটা মোটামুটি শিক্ষিত মেয়ে দুটো ভাতের জন্যে কারখানায় চাকরি করছে? কী চাকরি? না, মাথায় করে মাল বইছে আর তার চারপাশের পুরুষ শ্রমিকগুলো সারাক্ষণ লোভী চোখে ওর শরীর গিলছে। আমি আসছি।

চুলে চিরুনি বোলাতে গিয়ে বিরক্ত হল মাধবীলতা। তার চুলে এখনও অনিমেষের মতো সাদা ছড়িয়ে পড়েনি বটে কিন্তু অনেক পাতলা হয়ে গিয়েছে। আয়নার সামনে এসে নিজের মাথার দিকে তাকালেই মন বিরক্ত হয়।

উঠোনের দরজা টেনে দিয়ে মাধবীলতা দ্রুত গলি দিয়ে হেঁটে বস্তির বাইরে বেরিয়ে এল। যখন প্রথম এই বস্তিতে এসেছিল, তখন যারা সদ্য জন্মেছিল তাদের চেহারা এখন প্রৌঢ়ের হয়ে গিয়েছে। যারা এখন তরুণ অথবা যুবক, পাড়ার রকগুলো যাদের দখলে, তারা কোনও কারণ ছাড়াই তাকে কিছুটা সমীহ করে। খিস্তি খেউড় করার সময় তাকে দেখলে চুপ করে যায়। অবশ্য অর্কও একটা কারণ হতে পারে। অর্কর পরিকল্পনায় যে এই বস্তিতে কমিউনিটি কিচেন করার চেষ্টা হয়েছিল তা বাবা মায়ের মুখে ওরা শুনেছে। এই বস্তির মানুষের জন্যে কাজ করতে গিয়ে অর্ক পুলিশের আক্রোশের শিকার হয়েছিল, তিনমাস পরে ছাড়া পেয়েছিল, এই ঘটনাগুলো ওদের জানা। ওদের একজন

এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, মাসিমা, কাউকে খুঁজছেন?

ছেলেটিকে দেখল মাধবীলতা। পা থেকে মাথা পর্যন্ত অসভ্যতা মাখানো। সাত-আটটা পকেট জিনসে, হাঁটুর কাছে সযত্নে ছিঁড়েছে, গায়ে ডোরাকাটা গেঞ্জি।

মাধবীলতা বলল, হ্যাঁ। তোমরা কি এখানে অনেকক্ষণ আছ?

হ্যাঁ। সেই দুপুর থেকে।

সুরেনবাবুকে দেখেছ?

সুরেনদা এইমাত্র বাসায় ঢুকল। ডেকে দেব? ছেলেটি জিজ্ঞাসা করল।

যদি ওর কোনও অসুবিধে না থাকে!

আপনি আসুন–! ছেলেটি এগিয়ে গেল।

বস্তির একপাশে সুরেন মাইতিদের টালির বাড়ি ছিল আশি সাল পর্যন্ত। ওঁর বাবা এই অঞ্চলের কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় কর্মী হওয়ার পর সেই বাড়ি ভেঙে ছাদ ঢালাই করে একতলা বানিয়েছিলেন। বাবার মৃত্যুর পরে সুরেন মাইতি দোতলা করেছে। বাড়িতে ঢোকার পথ বস্তির দিক থেকে সরিয়ে রাস্তার দিকে করেছে।

রাত্রে ঘুমাতে যাওয়ার সময় ছাড়া সুরেন মাইতি কখনও একা থাকে না। ওর নীচের ঘরে এখন জনা তিনেক লোক।

ছেলেটি দরজার বাইরে থেকে ডাকল, সুরেনকাকা, একবার আসবেন?

কে? কে ডাকে? ভেতর থেকে গলা ভেসে এল, আবার কে ডাকছিস?

এবার দরজায় যে দাঁড়াল তাকে কখনও দ্যাখেনি মাধবীলতা। কিন্তু সে লক্ষ করল ছেলেটা বেশ নুয়ে পড়ল। আমি না, উনি, সুরেনকাকার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।

কে আপনি? লোকটা প্রশ্ন করেই জানিয়ে দিল, উনি এখন ব্যস্ত আছেন।

অর্কদার মা। ছেলেটি জবাব দিল।

আই বাপ। ভেতর থেকে গলা ভেসে এল, সর, সর, একটু দাঁড়ান বউদি।

লোকটি দরজা থেকে ভেতরে চলে যেতে ছেলেটি বলল, এ সুরেনকাকার বডিগার্ড। সবসময় যন্ত্র রাখে সঙ্গে। নতুন এসেছে।

সুরেন মাইতি বেরিয়ে এল, আচ্ছা, আপনি কেন এলেন? ডেকে পাঠালে আমি নিজেই চলে যেতাম। ভেতরে গিয়ে বসবেন?

না, তার দরকার নেই। আপনার কাছে একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছি।

অনুরোধ কেন বলছেন? অ্যাই, ছোঁড়া ভাগ এখান থেকে, শুধু পঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা গেলা। যা! ছেলেটিকে সুরেন মাইতি ধমকাতেই সে দ্রুত সরে গেল।

হ্যাঁ, বলুন। দুটো হাত জোড়া করে মুখের সামনে তুলল সুরেন মাইতি।

সুজাতা নামের একটি মেয়ে আমাদের গলিতে থাকে, আপনি নিশ্চয়ই জানেন।

আমি তো বউদি, মেয়েদের নাম বললে বুঝতে পারব না, বাবা বা স্বামীর নাম কী?

ও একাই থাকে। কারখানায় চাকরি করে।

ও হ্যাঁ। বাঙালি মেয়ে যে এত স্ট্রাগল করতে পারে আগে জানতাম না। শুনেছি, বেশ ভদ্র মেয়ে, কারও দিকে মুখ তুলে তাকায় না। মাথা নাড়ল সুরেন মাইতি।

ভুল শোনেননি।

এনি প্রবলেম?

হ্যাঁ। ওকে বিয়ে করবে বলে যে লোকটা বাড়ি থেকে বের করে এনেছিল, এনে পথে বসিয়েছে, ও এখন তার হাত থেকে বাঁচতে চায়। কিন্তু লোকটা খোঁজ করে এখানে এসে হাজির হয়েছে। ওর ঘরে বসে মদ খাবে, ওর ওপর অত্যাচার করবে, মেয়েটা আর সহ্য করতে পারছে না। আপনি যদি ব্যাপারটা দেখেন– মাধবীলতা বলল।

নিঃশব্দে কেঁপে কেঁপে হাসল সুরেন মাইতি। ভালবাসা হল ক্যান্সারের চেয়েও মারাত্মক অসুখ। ক্যান্সার হয়, লোক মারা যায়। ভালবাসা না মেরে সারা জীবন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্ত বার করে যায়। বুঝলেন বউদি, এইজন্যে আমি ভালবাসা থেকে দশ হাত দূরে থাকি। সুরেন মাইতি কথা বলার সময়েও যেন নিঃশব্দে হাসছিল।

কিন্তু সুজাতার ব্যাপারটা–। মাধবীলতার গলার স্বর বদলে গেল।

কোনও চিন্তা করবেন না। কখন আসবে লোফারটা।

সন্ধেবেলায়।

বেশি দেরি নেই। মেয়েটাকে বলবেন, লোফারটা এলে ঘরে যেন বসতে দেয়। কিন্তু যেই মদের বোতল খুলবে অমনি যেন খুব জোরে চিৎকার শুরু করে। ব্যস, তার পরের কাজটা আমার ছেলেরা করে দেবে। গম্ভীর হল সুরেন মাইতি।

প্রস্তাবটা একদম পছন্দ হল না মাধবীলতার। এ যেন ছাগলটাকে টোপ সাজিয়ে বাঘ মারা। সুরেন মাইতি কথা শেষ করতে চাইল, ঠিক আছে?

সুজাতা এত ভয় পেয়ে গেছে যে লোকটাকে ঘরে ঢোকানো দূরের কথা, মুখোমুখি হতে চাইছে না। মাধবীলতা বলল।

তা বললে কী করে হবে? লোকটাকে তো মদের বোতল সমেত হাতেনাতে ধরতে হবে। উইদাউট ব্লু-তে অ্যাকশন নেওয়া যায় না। সুরেন মাইতি বলল।

ঠিক আছে, ওকে বলে দেখছি। মাধবীলতা বলল, আপনার সময় নষ্ট করলাম।

না না ঠিক আছে। দেখুন কী হয়। সুরেন মাইতি বলল।

গলিতে ঢোকার মুখে দাঁড়িয়ে ছিল ওরা। যে ছেলেটি মাধবীলতাকে সুরেন মাইতির কাছে নিয়ে গিয়েছিল, সে এবং তার পাশে বিশ্বজিৎ। ছেলেটি বলল, মাসিমা বিশ্বজিৎদাকে চেনেন তো?

মাধবীলতা মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

আপনার সঙ্গে কথা হয় না, কিন্তু ছেলেবেলা থেকেই তো দেখে আসছি।

হয়েছে? বিশ্বজিৎ বেশ ভদ্র গলায় জিজ্ঞাসা করল।

না। হল না।

কিছু যদি মনে করেন তা হলে ব্যাপারটা কী জানতে পারি?

একটু ইতস্তত করছিল মাধবীলতা। ততক্ষণে বস্তির পাঁচ-ছয়জন মহিলা কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছেন। শেষ পর্যন্ত সুজাতার সমস্যাটা বিশ্বজিৎকে বলল মাধবীলতা। সুরেন মাইতির প্রস্তাবটাও বাদ দিল না।

বিশ্বজিৎ মাথা নাড়ল, মহিলাকে তো রোজ দেখি। খুব নরম টাইপের মনে হয়। উনি এখন কোথায়?

আমাদের বাড়িতে।

ওখানেই থাকুন এই সন্ধেটা। আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরে যান।

কী করবে তোমরা?

আমরা কিছুই করব না। যা করবেন মা-বোনেরাই করবেন। বলে এতক্ষণ যাঁরা শুনছিলেন তাঁদের দিকে তাকাল সে। আপনারা তো সব শুনলেন।

একজন মহিলা বললেন, এসব কথা তো আমরা জানতামই না। ওকে বলুন, আমরা ওর সঙ্গে আছি।

ওর কথা শুনে অন্য মেয়েরাও মাথা নাড়তে লাগলেন।

বাড়িতে ফিরে এল মাধবীলতা। অনিমেষ বসে ছিল বারান্দায়। মাধবীলতাকে দেখে বলল, তুমি চলে যাওয়ার পর থেকে মেয়েটা কেঁদে চলেছে, জিজ্ঞাসা করলে জবাব দিচ্ছে না।

.

০৪.

মাধবীলতা সুজাতার সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে?

সুজাতা মাথা নাড়ল। সে কথা বলতে চাইছে না দেখে মাধবীলতা অনিমেষকে ইশারা করল ঘরের ভেতরে চলে যেতে। মেয়েটার দিকে একবার তাকিয়ে ঘরে ঢুকে গেল অনিমেষ। মাধবীলতা বলল, এবার তুমি আমায় বলতে পারো। অর্কের বাবা এখানে নেই।

আমার ভয় লাগছে। কাঁপা গলায় বলল সুজাতা।

কীসের ভয়? মাধবীলতার কপালে ভাঁজ পড়ল।

যদি লোকজন এমন মার মারে যে ও মরে যায় বা পঙ্গু হয়ে যায়!

অবাক হয়ে গেল মাধবীলতা। যে জন্তুটা জীবন নরক করে দিচ্ছে, তার চূড়ান্ত ক্ষতি করতে চাইছে না মেয়েটা? খুব রাগ হয়ে গেল মাধবীলতার, বিরক্ত হয়ে বলল, তখন এসে ওইভাবে বললে কেন? আমার কী দরকার ছিল সুরেন মাইতির কাছে যাওয়ার?

আমি যে ওকে ভয় পাচ্ছি। আমি চাই না ও এখানে আসুক।

অথচ তুমি এও চাইছ লোকটাকে যেন বেশি মারধর করা না হয়।

মাথা নিচু করল সুজাতা, আসলে, উনি তো একসময় আমার অনেক উপকার করেছিলেন, সেসব মনে পড়লে–।

বেশ। তুমি গলিতে গিয়ে দ্যাখো বিশ্বজিৎকে পাও কি না? ওই যে ছেলেটা কংগ্রেস করে, ও-ই উদ্যোগ নিচ্ছে। যদি ওকে না পাও তা হলে ওই গলির মহিলাদের গিয়ে বলো তুমি চাও না ওই লোকটাকে কিছু করা হোক।

মাধবীলতা উঠে যাচ্ছিল, সুজাতা তার হাত ধরল, আপনি আমাকে বুঝতে পারছেন না।

আমার ন্যাকামি পছন্দ হয় না।

আমি ন্যাকামি করছি না, সুজাতা বলল।

যাও, বাইরে গিয়ে কথা বলো ওদের সঙ্গে।

সুজাতা গেল না। বারান্দায় বসে রইল।

ঈশ্বরপুকুর লেনের দৈনন্দিন জীবনে সেদিন অন্যরকম ঘটনা ঘটল। বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার কয়েক বছর পর থেকে ধীরে ধীরে পার্টির নব্য নেতারা সমস্ত ক্ষমতা হাতে নিয়ে ফেলেছিলেন। তাঁরা যা বলবেন, সেটাই শেষ কথা, তার জন্য জেলা কমিটির অনুমোদনও দরকার নেই। বামবিরোধী দলগুলো মাঝে মাঝে গলা খুললেও বেশির ভাগ সময় তাদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যেত না। ঈশ্বরপুকুর লেনে সুরেন মাইতিই শেষ কথা। মাসের এই সময়টা তাকে খুব ব্যস্ত থাকতে হয়। পাশের বেলগাছিয়ায় রেললাইনের কর্মবীরদের সঙ্গে হিসেব মিলিয়ে নেওয়া থেকে অর্থ আসছে এমন সব লাইনগুলোর তদারকি করতে হয় মাসের এই সময়।

সুরেন মাইতি যখন খবরটা পেল তখন রাত সাড়ে নটা। প্রথমে বিশ্বাসই করেনি সে। ঈশ্বরপুকুর লেনের বস্তির মহিলারা নাকি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে একটা লোককে আড়ংঘোলাই দিয়েছে। লোকটা মারা যায়নি কিন্তু প্রচণ্ড আহত হয়ে আর জি করে ভরতি হয়েছে। সুরেন মাইতির প্রথম প্রশ্ন ছিল, এটা কে অর্গানাইজ করল? আমাকে না জানিয়ে আমাদের কেউ কি করেছে?

একজন কমরেড জানালেন, না সুরেনদা। আমাদের কেউ লিড করেনি।

বুঝতে পেরেছি। ওই অর্কর মা-ই মেয়েদের খেপিয়েছে। ওর স্বামী নকশাল হওয়ায় চিরকালের জন্য পঙ্গু হয়ে পড়ে আছে, তাও হুঁশ হল না। আমরা যদি রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি না দিতাম তা হলে এখনও জেলে পচে মরত। সুরেন মাইতি ফোঁস ফোঁস করতে লাগলেন।

না দাদা। অর্কদার মাকে ধারেকাছে দেখা যায়নি।

একজন জানাল।

চালাক মেয়েছেলে। সামনে না এসে আড়াল থেকে মেয়েদের খেপিয়েছে।

সুরেন মাইতি নির্দেশ দিল, ওকে নয়, ল্যাংড়াটাকে ডেকে নিয়ে আয়।

.

এখনও উত্তেজনা ছড়িয়ে আছে ঈশ্বরপুকুর লেনে। জটলাগুলোতে এই নিয়ে আলোচনা চলছে। মেয়েরা যে ওই ঘরের সামনে অপেক্ষা করবে এবং লোকটা আসামাত্র প্রশ্ন শুরু করবে, এরকম দৃশ্য আগে এলাকার মানুষ দেখেছে। শুধু তাই নয়, মাধবীলতাদের বাড়ি থেকে সুজাতাকে ডেকে এনে মেয়েরা লোকটার সামনে জানতে চেয়েছিল ঠিক কী করেছে সে। লোকটাকে দেখামাত্র সুজাতার সব মন খারাপ উধাও হয়ে গিয়েছিল। যা সত্যি তাই বলেছিল সে। মিনিট পাঁচেক মার খাওয়ার পর লোকটা ধরাশায়ী হয়। পাড়ার ছেলেরা একটা ট্যাক্সি ডেকে আর জি করে পাঠিয়ে দেয়। মেয়েরাই বলেছিল আজকের রাত্রে সুজাতার নিজের ঘরে থাকা ঠিক হবে না। ওপাশের এক প্রৌঢ়া তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন হাত ধরে।

হঠাৎ উত্তেজনা মানুষের শেষ আড়াল যখন একবার ভেঙে ফেলে তখন সে আরও সাহসী হয়ে ওঠে। ওই লোকটা সুজাতার ঘরে বসে নাকি মদ্যপান করত। এ কথা প্রচার হতেই সবার মুখে একটা কথা ফিরতে লাগল, ঘরে বসে বস্তির কোনও পুরুষের মদ খাওয়া তো চলবেই না, নেশা করে টলতে টলতে কেউ যদি বাড়ি ফিরে আসে তা হলে তাকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। কথাটা চাউর হলে অনেক বয়স্ক থেকে তরুণের মুখ কালো হয়ে গেল। একজন প্রৌঢ় বললে, কত দেখলাম, আজকের বাঘ কাল মিনি বেড়াল হয়ে যাবে, দেখো।

মাধবীলতা খুশি হয়েছিল। লোকটিকে মেয়েরা শাস্তি দিয়েছে বলে শুধু নয়, সুজাতা তার কান্না ভুলে সত্যি কথা বলতে পেরেছে বলে। অনিমেষের সঙ্গে কথা বলছিল সে। এই সময় একজন কমরেড খবর নিয়ে এল, মেসোমশাই, সুরেনদা আপনাকে একবার দেখা করতে বললেন।

কেন? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

জানি না। এখনই চলুন।

মাধবীলতা বলল, এত রাত্রে ডাকলেই যেতে হবে নাকি? কাল সকালে যেয়ো। ভাই, সুরেনবাবুকে একটু বলবে–।

মাধবীলতাকে থামাল অনিমেষ, না, ঘুরেই আসি। চলো।

কমরেড যে অনিমেষকে সুরেন মাইতির বাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছে, ছড়িয়ে থাকা জটলা করা মানুষগুলো দেখল, কিন্তু কিছু বলল না।

সুরেন মাইতির বাইরের ঘরে তখন কয়েকজন মানুষ। তার দেহরক্ষীও রয়েছে। অনিমেষ দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার? এত রাত্রে তলব করেছেন।

সুরেন মাইতি হাসল, আমারই যাওয়া উচিত ছিল। এত ঝামেলা, এই এরা তো যে যাঁর সমস্যা নিয়ে বসে আছেন–।

বলুন।

আজ বস্তিতে মেয়েরা যে কাণ্ড করেছে তা কি জানেন?

এখানেই যখন থাকি, না জেনে উপায় কী!

বটে। যে লোকটাকে এরা আড়ংধালাই দিয়েছে, সে গুরুতর আহত। পুলিশ গিয়েছিল ওর কাছে কী ঘটেছিল তা জানতে। হাসল সুরেন মাইতি, লোকটার জ্ঞান পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছে পুলিশ।

এসব কথা আমাকে বলছেন কেন? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

পুলিশ মার্ডার চার্জ আনলে আমি অবাক হব না। এখানে খবর হল, আপনার স্ত্রীর কাছে মেয়েটি আশ্রয় নিয়েছিল। আপনার স্ত্রী যে আমার কাছে এসে লোকটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন, সেটাই তো সত্যি। আমি বলেছিলাম, লোকটা যে লম্পট তার প্রমাণ চাই। কিন্তু আপনার স্ত্রী অধৈর্য হয়ে বস্তির মেয়েদের এমন খেপিয়ে দিলেন, এবং নিজে সামনে না এসে নির্বোধ মহিলাদের এগিয়ে দিলেন, সেটা ঠিক করেননি। লোকটির বয়ান পেয়ে গেলেই পুলিশ আপনার স্ত্রীকে গ্রেফতার করবে। অনিমেষবাবু, আপনি নকশাল আন্দোলন করতেন, জেলে গিয়েছিলেন, মানুষের সম্মান আপনি পেয়েছেন। কিন্তু একজনকে খুন করার ষড়যন্ত্রের জন্যে আপনার স্ত্রী যদি জেলে যান–ছি ছি ছি! মুখ মুছলেন সুরেন মাইতি।

এইভাবে মামলাটাকে সাজানো হবে? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

পুলিশকে আপনি আমার চেয়ে ভাল চেনেন। ওরা যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। লোকে বলে, আমাদের দলের মন্ত্রীরা আপনার নাকি সহপাঠী ছিলেন। যান, কথা বলুন, তারা যদি সাহায্য করে আপনাকে!

আর কী বিকল্প আছে? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

সুরেন মাইতি বলল, লোকটা যদি আজ রাত্রে হাসপাতালের বিছানায় মরে যায় তা হলে পুলিশ ওর কাছে কোনও বয়ান পাবে না। কারও বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিতেও পারবে না। কিন্তু ঘটনাটা একটু খরচসাপেক্ষ এবং ঝুঁকিও নিতে হবে। তার চেয়ে আপনি আমার সঙ্গে থাকুন। একসঙ্গে কাজ করলে দুজনেরই উপকার হবে।

এইসময় একটি ছেলে এসে দাঁড়াল দরজায়, দাদা খবর পেয়েছি।

বল।

ব্যাপারটা বিশ্বজিতের মাথা থেকে এসেছে। যারা লোকটাকে আজ মেরেছে তাদের তিনজন যে কংগ্রেসকে ভোট দেয় তা আমি জানি। ছেলেটা বলল।

চোখ বড় হয়ে গেল সুরেন মাইতির, সে কী রে! কেঁচো ফণা তুলেছে? ঠিক আছে। এখন চুপ করে থাক। আমরা যেন কিছু জানিই না। এক সপ্তাহ কেরোসিনের ব্ল্যাক বন্ধ। মানুষ যেন ঠিকঠাক তেল পায়। মনে থাকবে?

একদম বন্ধ? পাশের ছেলেটার গলা সরু হল।

একদম। এই মুহূর্তে কিছুদিন মানুষের আস্থা পাওয়ার মতো কাজ করতে হবে। যাক গে, অনিমেষদা, আপনাকে মিছিমিছি কষ্ট দিলাম। বউদিকে বলবেন কোনও চিন্তা না করতে। মার্ডার চার্জটায় ওই বিশ্বজিৎই পড়বে। যান। এই, কেউ দাদাকে এগিয়ে দিয়ে আয়।

অনিমেষ বলল, না না, আমি নিজেই যেতে পারব। ঠিক আছে।

.

অনিমেষ এবং মাধবীলতা বসেছিল মুখোমুখি। অনিমেষ বলল, যত দিন যাচ্ছে তত এরা মানুষের শত্রু হয়ে উঠছে। কিন্তু এই শ্বাসরুদ্ধ পরিবেশ থেকে তো বের হওয়ার উপায় নেই।

মাধবীলতা বলল, তোমার মনে আছে, সাতষট্টি সালের নির্বাচনের আগে পশ্চিমবাংলার কেউ ভাবতেই পারত না কংগ্রেস ক্ষমতা থেকে চলে যাবে?

অনিমেষ মাথা নাড়ল, কিছুটা ঠিক। ততদিনে একটা প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল আমাদের, আন্দোলনের ভাবনা তো ওই সময়েই।

তোমার ভাবনাটা সঠিক নয়। বামপন্থী দলকে যুক্তফ্রন্ট করতে হয়েছিল কেন? কারণ তারা জানত মানুষ তাদের ওপর আস্থাবান নয়। প্রফুল্ল ঘোষ বা অজয় মুখোপাধ্যায়কে সামনে রাখতে হয়েছিল। অজয়বাবুকে দেখেই মানুষ ভোট দিল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। কিন্তু তবু যুক্তফ্রন্ট সরকার টিকতে পারল না। তারপর আর একবার চেষ্টা হয়েছিল, সেটাও টিকল না। জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল বলেই কংগ্রেস ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছিল।

মাধবীলতা বলল, বামফ্রন্ট জিতেছিল মানুষের নেগেটিভ ভোট পেয়ে। প্রথম কয়েক বছর তো মানুষ বেশ ভালই ছিল। এখন মানুষ হাঁসফাঁস করছে। অথচ কাকে ভোট দেবে তা বুঝতে পারছে না।

দ্যাখো জলের চাপ বেড়ে গেলে সে নিজেই পাহাড়ের ফাটল খুঁজে নেয়। আমি তাই ও নিয়ে ভাবি না। অনিমেষের কথা শেষ হওয়ামাত্র উঠোনের দরজায় শব্দ হল। মাধবীলতা সঙ্গে সঙ্গে উঠে গেল সেটা খুলতে।

অর্ক মায়ের পাশ দিয়ে উঠোনে পা রেখে অনিমেষের দিকে একবার তাকিয়ে মায়ের উদ্দেশে বলল, খেতে দাও, খুব খিদে পেয়েছে।

দুপুরে কিছু খাসনি? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

খেয়েছি। অর্ক ঢুকে গেল তার ঘরে।

দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলবে তারও সময় নেই। এখন খাওয়া শেষ করেই বিছানায় পড়ে মড়ার মতো ঘুমাবে। অনিমেষ বিড়বিড় করল।

মাধবীলতা কথা না বাড়িয়ে রান্নাঘরে গেল। গ্যাস জ্বালিয়ে খাবার গরম করতে লাগল। হাতমুখ ধুয়ে পাজামা গেঞ্জি পরে অর্ক রান্নাঘরে এল, কই দাও।

কী ওটা?

তোমাদের ট্রেনের টিকিট।

সেকী! তুই যাবি না?

ছুটি পাব না। প্রচণ্ড চাপ। খামটা একটা কৌটোর ওপর রেখে দিয়ে হাত বাড়াল অর্ক, থালাটা দাও, দাঁড়িয়েই খেয়ে নিচ্ছি।

এত তাড়া কেন? পিঁড়ি এগিয়ে দিল মাধবীলতা, বসে খা।

পিঁড়ির ওপর বাবু হয়ে বসল অর্ক, বসে হাসল, এখন কলকাতা শহরে আর কোনও বাড়িতে পিঁড়িতে বসে খাওয়ার রেওয়াজ আছে কি না জানি না।

আছে কি নেই জানি না, আমার তো পিঁড়িতে বসে খেতে বেশ ভাল লাগে, মাধবীলতা হাসল, কিন্তু কাল ছুটি না পেলে দুদিন বাদে ছুটির জন্য বল।

বলব। তবে লাভ হবে বলে মনে হয় না। আমি ভুল করেছিলাম, পার কেস একটা টাকা নিতাম, কোনও কোনও সময় কেস না এলে চিন্তায় পড়তাম তাই ওরা যখন চাকরির অফার দিল তখন লুফে নিয়েছিলাম। তারপরেই চাপ বাড়তে লাগল। পার কেস যে টাকা পেতাম তা এখন নিলে মাইনের দ্বিগুণ হয়ে যেত! খাওয়া শুরু করল অর্ক।

বেশি লোভ করে কী দরকার। যা পাচ্ছিস তা থেকেও তো কিছু জমে যাচ্ছে।

বাবা খেয়েছে? বসে আছে কেন? শুয়ে পড়তে বলল।

ঘুম পেলে নিজেই শুতে যাবে। মাধবীলতা বলল, আজ এখানে কী হয়েছে শুনেছিস? তুই তো আবার কারও সঙ্গে কথা বলিস না।

শ্যামবাজারের মোড়ে বিশ্বজিতের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল।

ও। ছেলেটা বেশ ভাল। সুরেন মাইতি যখন জালিয়াতি করছিল তখন ওই ছেলেটাই বস্তির মেয়েদের ব্যাপারটা জানায়।

মা, এইসব ব্যাপারে একদম ইন্টারেস্টেড নই। মাধবীলতা ছেলের দিকে তাকাল, কোনও মেয়ে বিপদে পড়লে আমি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারব না।

খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়াল অর্ক, সেটা তোমার ব্যাপার। আমি অনুরোধ করব ওই খাম থেকে টিকিট বের করে কখন ট্রেন ছাড়ছে তা দেখে রাখো।

অর্ক কলতলা থেকে বেরুতে না বেরুতে মাধবীলতার গলা শুনতে পেল, সে কী রে, কাল দুপুরবেলায় ট্রেন? আমি ভেবেছিলাম, রাতের ট্রেনের টিকিট হবে।

অর্ক ঘুরে দাঁড়াল, টিকিট কাউন্টারের বাবুরা কম্পিউটার দেখে বলেছেন ওসব ট্রেনে কোনও জায়গা খালি নেই। তাই তিস্তা তোর্সায় কাটলাম। তখন বাড়ি ফেরার সময় শিয়ালদা স্টেশনের পাশ দিয়ে আসার সময় কৌতূহল হল। গিয়ে দেখলাম, অর্ডিনারি স্লিপারের অর্ধেক আর এসি থ্রি টায়ারের ওয়ান থার্ড খালি পড়ে আছে। রহস্যের সমাধান ফেলুদাও পারবে না।

রাতের সব কাজ শেষ করে শুতে এসে মাধবীলতা দেখল অনিমেষ ঘুমে কাদা হয়ে রয়েছে। ওপাশের ঘরে অর্কও নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছে।

আজ ওষুধ খেতে ভুলে গেছে সে। আজকাল ওষুধ না খেলে ঘুম আসে না। মাঝরাত্রে কাল দুপুরের জন্যে সুটকেস গোছাতে লাগল মাধবীলতা।

.

০৫.

শিয়ালদা থেকে ট্রেন ছাড়ল দশ মিনিট দেরিতে। এসি থ্রি-টায়ারের টিকিট কেটেছে অর্ক। একটা কুপেতে ছয়জন। অনিমেষের উলটোদিকে একজন খাটো চেহারার হাসিহাসি মুখ ভদ্রলোক স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে এসেছিলেন। যেচে আলাপ করলেন তিনি।

কিছু মনে করবেন না, আপনাকে ওটা নিশ্চয়ই জন্ম থেকে বহন করতে হচ্ছে না?

হেসে ফেলল অনিমেষ, না।

গাড়ি ধাক্কা মেরেছিল তো? উঃ কলকাতায় দিন দিন গাড়ির সংখ্যা বেড়েই চলেছে, কিন্তু রাস্তা তো বাড়ছে না। আমি বলি কমছে। হকাররা দখল করে নিয়েছে যে। ভদ্রলোক এবার হাত জোড় করলেন, আমার নাম ভারতচন্দ্র দত্ত। এনি কোয়েশ্চেন?

নো। সুন্দর নাম।

এই মধ্যযুগীয় নামটা আমার পিতামহ নির্বাচন করেছিলেন। এই নাম যার সে মাস্টারি ছাড়া আর কী করতে পারে বলুন? স্কুলে দুপুরটা কেটেছে, সকাল বিকেল সন্ধে প্রাইভেট টিউশনি। রোজগার খারাপ করিনি। দুটো মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। এটি থার্ড। ভারতচন্দ্র চোখের ইশারায় মেয়েকে দেখালেন।

মেয়ে সঙ্গে সঙ্গে মায়ের হাত আঁকড়ে ধরল।

মা বললেন, তোমার মুশকিল কী জানো, কেউ শুনতে চাইছে কি চাইছে জানার আগেই ব্যক্তিগত কথা বলতে আরম্ভ করা।

মাস্টারি করার অভ্যেস। হাসলেন ভারতচন্দ্র, টিকিট কবে কেটেছেন?

মাধবীলতা জবাব দিল, ছেলে কেটে দিয়েছে।

বুদ্ধিমান ছেলে।

অনিমেষ হাসল, কীসে বুঝলেন?

এসি থ্রি-টায়ারে টিকিট করেছে। টু-টায়ারে করেনি।

বেশি ভাড়া দিতে হল না, তাই?

দূর! এসি টু-তে একটা কুপেতে চারজন। ট্রেন ছাড়লেই দুজন মদ্যপান শুরু করেন। পরদা টানা থাকে। একবার আমি আর আমার ওয়াইফ এসি টু টায়ারে যাচ্ছিলাম, কী বলব মশাই, ছেলের বয়সি ছোঁড়াগুলো, বোতলে বাড়ি থেকেই জলে সাদা মদ মিশিয়ে নিয়ে এসেছে দেখলে ধরতে পারবেন না, ভাববেন জল খাচ্ছে, আমাকেই অফার করেছিল। ভারতচন্দ্র বললেন।

স্বাদ নিলেন? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

নো, জীবনে খাইনি তো! তবে আই ওয়াজ টেম্পটেড। তারপর থেকে আর এসি টু টায়ারে যাই না। ওই যাঃ, আপনার নামই জানা হল না।

অনিমেষ মিত্র।

ছেলে কী করে?

হেলথ অ্যান্ড কেয়ারে চাকরি করে।

ম্যারেড? আপনার ছেলে যখন, তখন–। ভারতচন্দ্র শেষ করলেন না। মাধবীলতা বলল, দ্যাখো তো চা পাওয়া যায় কিনা?

এই চা খাবে? অনিমেষ উঠে দাঁড়াল।

ভাল চা কোথায় পাবে?

দেখি।

দরজা টেনে বাইরে এসে স্বস্তি পেল অনিমেষ। ভাগ্যিস মাধবীলতা কথা ঘুরিয়ে দিল! এই লোকটার সঙ্গে কাল ভোর পর্যন্ত থাকতে হবে।

মিনিট খানেক বাদে ফিরে এসে অনিমেষ দেখল কামরায় বসেই মাধবীলতা একটা চা-ওয়ালাকে পাকড়েছে।

তুমি খাবে?

না অনিমেষ জানলার পাশের খালি জায়গাটায় বসল।

আপনারা? ভারতচন্দ্রের স্ত্রী বললেন, আপনি নিন, আমরা নিচ্ছি।

আমার তো নেওয়া হয়ে গিয়েছে–।

ভদ্রমহিলা স্বামীকে বললেন, এই যে শুনছ–।

আমি আবার কী শুনব! উনি অফার করছেন, তুমি অ্যাকসেপ্ট করবে কি না সেটা তুমি ঠিক করবে। দাও ভাই, আমাকে এক কাপ দাও।

ভদ্রমহিলা এবং তাদের মেয়ে চা খেল না। দুটোর দাম দিয়ে দিল মাধবীলতা। ছেলেটা প্রথমে ছটাকা কাপ চেয়েছিল। তারপর কী মনে হতে বলল, ঠিক আছে, পাঁচ করেই দিন। বাইরে বেরোলে বুঝতে পারা যায় জিনিসপত্রের দাম আর কোনও সীমায় আটকে থাকছে না।

ট্রেনটা চলছিল মাঠ পেরিয়ে। মাঠে এখন শস্য নেই। ঘষা কাঁচের মধ্যে দিয়ে যে ছবিটা দেখা যাচ্ছে তা অনেকটাই অস্পষ্ট। এই যে মাঠ, গ্রাম, পঞ্চায়েত এগুলোর সঙ্গে বামফ্রন্ট একসময় আন্তরিকভাবে জড়িয়ে ছিল।

থাকলে এতগুলো বছর ধরে ওরা ক্ষমতায় থাকতে পারত না। এখন একটা শতাব্দীর শেষ আর একটার শুরু। ক্ষমতায় আসার পর বামফ্রন্ট চার চারটে নির্বাচনের মুখোমুখি হয়েছে। বিরোধীরা বলেছেন গত দুটো নির্বাচনে বামফ্রন্টের ক্যাডাররা গায়ের জোরে ভোট করেছে। তা হলে স্বীকার করতে হয় প্রথম দুটো নির্বাচন, ওই দশ বছর বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে মানুষের আজকের অভিযোগ তৈরি হয়নি। তা ছাড়া গত দুই নির্বাচনে যদি ক্যাডাররা গায়ের জোরে ভোট দিয়ে থাকে, অন্যকে ভোট না দিতে দেয়, তা হলে তার সংখ্যা কত? খুব বেশি হলে পনেরো থেকে কুড়ি ভাগ। ওইভাবে ভোট না করলেও বামফ্রন্ট স্বচ্ছন্দে জিতে যেত। একটা সময় আসবে যখন গালাগালি দিতে গিয়ে মানুষ বামফ্রন্টের সাতাত্তর সালের সরকারকেও কাঠগড়ায় তুলবে। খারাপ অনুভূতি খুব দ্রুত ভাবার স্মৃতিকে নষ্ট করে দেয়। এসব নিয়ে ভাবার কোনও মানে নেই জেনেও ভাবনাগুলো আপনি চলে আসে। সংসদীয় রাজনীতিকে এখন না মেনে উপায় নেই। কিন্তু ভারতবর্ষে কোনও নাগরিক ভোট না দিয়ে, রাজনীতি থেকে দুরে সরে গিয়ে দিব্যি থাকতে পারে। হঠাৎ কানে এল, এই যে স্যার, চলবে?

মুখ ফিরিয়ে তাকাল অনিমেষ। ভারতচন্দ্র তার সামনে একটি স্টিলের বাটি ধরে আছে, যাতে কয়েকটা পাটিসাপটা পড়ে আছে। ভারতচন্দ্রের হাসি আরও বিস্তৃত হল। অসময়ের পাটিসাপটা বলে অবহেলা করবেন না, নেবেন?

অনিমেষ অস্বস্তি নিয়ে মাধবীলতার দিকে তাকাল। মাধবীলতা বলল, ওঁর মিষ্টি খাওয়া বারণ।

ও হো। তা হলে বেঁচে থাকার অর্ধেক আনন্দ থেকেই আপনি বঞ্চিত!

যা বলেছেন।

বাটির ঢাকনা বন্ধ করে স্ত্রীর হাতে তুলে দিলেন ভদ্রলোক।

কিছুক্ষণ ট্রেনের দুলুনি উপভোগ করার পর ভারতচন্দ্র জিজ্ঞাসা করলেন, ছেলের সঙ্গে তো কথাবার্তা হল না, সঙ্গে মোবাইল নেই?

আছে, ভুল করে সুটকেসে রেখেছিলাম। ওখানে গিয়ে বের করব।

কী দরকার? নাম্বারটা বলুন। আমার মেয়ে আবার মোবাইলের ব্যাপারটা ভাল বোঝে। হারে, নাম্বারটা ধরে দে তো? ভারতচন্দ্র মেয়েকে বললেন।

মাধবীলতা হাত নাড়ল, না না। তোমাকে একটুও কষ্ট করতে হবে না। এখন আমার ছেলের কাজের সময়। এখন ও কিছুতেই ফোন ধরবে না।

সিরিয়াস টাইপ? ভাল ভাল। আপনারা পৌঁছাবেন ভোরবেলায়?

হ্যাঁ।

জলপাইগুড়ি থেকে আলিপুরদুয়ার এমন কোনও দূরত্ব নয়। চলে আসুন বেড়াতে বেড়াতে। কী বলে?

মহিলা হাসিমুখে মাথা নাড়লেন।

অনিমেষ চোখ বন্ধ করল। যারা অকারণে বেশি কথা বলে, অপরিচিতর সঙ্গে কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘনিষ্ঠজনের মতো ব্যবহার শুরু করে তারা হয় সোজা সরল অথবা ভয়ংকর ধান্দাবাজ হয়। এরকম আচরণ করার সময় নিশ্চয়ই টের পায় না যে পাশের মানুষ তাকে সন্দেহ করতে শুরু করেছে। যেহেতু এঁর সঙ্গে স্ত্রী ও কন্যা আছেন সন্দেহটা একটা জায়গা অবধি গিয়ে আটকে যাবে।

এই সময় মাধবীলতা বলল, এসি কামরায় আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। জানলা খোলা যাচ্ছে না। বাইরের পৃথিবীটা দ্যাখো এর মধ্যেই ঝাপসা হয়ে গেল।

গায়ে ধুলোবালি লাগছে না, সেটা ভাবো। অনিমেষ বলল।

ট্রেনটা চলছে দুলতে দুলতে। সন্ধ্যার অন্ধকারে কামরায় আলোগুলো তেমন উজ্জ্বল নয়। ভারতচন্দ্রবাবু হঠাৎ নিঃশব্দে উঠে গেলেন কামরার বাইরের টয়লেটের দিকে। মিনিট পাঁচেক পরে অনিমেষের নজরে পড়ল ভদ্রলোক দূরে দাঁড়িয়ে হাতের ইশারায় তাকে ডাকছেন। আসছি বলে ক্রাচ নিয়ে অনিমেষ উঠে দাঁড়াতে ভদ্রলোক চোখের আড়ালে চলে গেলেন। শক্ত দরজা ঠেলে বাইরে আসতেই ভারতচন্দ্র বললেন, এই দেখুন, এখানে নোটিশ টাঙিয়েছে, ধূপমান করলে এত টাকা ফাইন দিতে হবে।

ঠিক কথা।

মানছি। প্রশ্ন হচ্ছে একবার ধূমপান করলে যে অপরাধ তিনবার করলেও তো তাই। ফাইন কি তিনগুণ হয়ে যাবে? সমস্যায় আছেন ভদ্রলোক।

বোধহয় একবার দিলেই হবে।

গুড। ওখানে ধূমপানের কথা লেখা হয়েছে। কী ধরনের ধূম? বিড়ি, সিগারেট, চুরুট। গাঁজা খাওয়াও তো ধূমপান।

এটার ব্যাখ্যা আমি দিতে পারব না। অনিমেষ বলল।

এটা ধাঁধা না পাবলিক নোটিশ, আপনিই বলুন?

এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন কেন? বিরক্ত হল অনিমেষ। সামনে পিছনে তাকিয়ে নিল ভারতচন্দ্র, আপনাকে সত্যি কথাই বলি। এই যে অফিসের পর বাড়ি এসে যখন বাথরুমে ঢুকি তখন কিছুতেই পটি হতে চায় না। ওটা না হলে শরীর ফুলতে থাকে, আরাম করে শোওয়া যায় না। তখন সবে অফিসে ঢুকেছি। এক সহকর্মী বলল, ও কিছু নয়। একটু নেশার ছোঁয়া লাগালে পটি পেট ছেড়ে বেরুবার পথ পাবে না। ব্যস, অভ্যেস হয়ে গেল। সিগারেট থেকে সিকি ইঞ্চি তামাক বের করে সেই জায়গায় গাঁজা পুরে দিই। কয়েকটা টানেই তো পুড়ে যায়–! কিন্তু–

এখানে খেলে জেল হতে পারে।

সর্বনাশ! জেলের কথা অবশ্য এখানে লেখা নেই।

ড্রাই ড্রাগের মধ্যে পড়ে। গম্ভীর গলায় বলল অনিমেষ।

কী যে বলেন। সর্বত্র পাওয়া যায়। আমি আর পারছি না। এই বাথরুমের ভেতরে ঢুকে থাকি। আপনি একটু দাঁড়ান এখানে। কেউ ঢুকতে চাইলে বলবেন লোক আছে। প্লিজ!

ভেতর থেকে ছিটকিনি তুলে দিলেই তো হয়? অনিমেষ বলল।

অ। তা হলে তো ঘনঘন ধাক্কাবে। ভদ্রলোক সুট করে টয়লেটের দরজার ফাঁক গলে ভেতরে চলে গিয়ে ওটা বন্ধ করে দিলেন। একটা লোক গোটা দিনে কোনও নেশা করে না শুধু বিকেলের পর সিকি ইঞ্চি গাঁজা খায়। ভাবা যায়?

তিনি কোথায়? পেছন থেকে ভেসে আসা মহিলার কণ্ঠে মুখ ফেরাল অনিমেষ। ভারতচন্দ্রবাবুর স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছেন। বাধ্য হয়ে ইশারায় টয়লেটটা দেখিয়ে দিল অনিমেষ। ভদ্রমহিলা দরজার গায়ে পৌঁছে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, আপনি যেতে পারেন।

খুশি হল অনিমেষ চলে আসতে পেরে। এসে দেখল, মাধবীলতা একটা বই পড়ছে।

ভারতচন্দ্রবাবুর মেয়ে চোখ বন্ধ করে গাড়ির তালে ঢুলছে।

সে মেয়েটিকে বলল, বসে কেন, শুয়ে পড়ো তুমি।

মেয়েটা মাথা নেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। ওদিকের সব বাথরুম বন্ধ?

না। যেতে পারো।

মেয়েটি চোখের আড়ালে যেতেই অনিমেষ ঘটনাটা ঝটপট মাধবীলতাকে জানাল। চোখ বড় করল মাধবীলতা, সে কী! দেখে বোঝাই যায় না।

প্রত্যেক মানুষের হয়তো এরকম নিজস্ব ব্যাপার থাকে।

তোমার কী আছে?

অনিমেষ হকচকিয়ে গেল। তারপর বলল, যা তোমার নেই।

সেটা কী?

ভেবে বের করো। জীবনের সব প্রশ্নের উত্তর লিখে কেউ একটা মানেবই আজ অবধি করতে পারেনি। কথা বলতে বলতে অনিমেষ দেখল ভারতচন্দ্রবাবু ভিতরে ঢুকে তাকে ইশারা করছেন কাছে যাওয়ার জন্য। বাধ্য হল অনিমেষ। ভারতচন্দ্র বললেন, একশো টাকা ফাইন নিত বুক ফুলিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতি দেখে দেখে খেয়ে নিতাম। ভয় পেয়ে মশাই আর একটা সিগারেট যখ গেল। ডাবল লোকশান!

সে কী, কে নিল?

গৃহকত্রী। মাঝে মাঝে কয়েকবার শখ করে এই সময় তাকে দু-তিনটে টান দিতে দিয়েছি কলকাতায়। সন্দেহ করে ঠিক চলে গিয়েছে বাথরুমে। আমারটা শেষ করে ফেলেছিলাম, আর একটা বের করে দিতে হল।

ভারতচন্দ্র খুব বিরক্ত।

একটা সিগারেটের ওইটুকু গাঁজার দাম একশো টাকা!

উঃ মাথা নাড়লেন ভারতচন্দ্র। যেখানে সেখানে ও জিনিস পাওয়া যায় না। টাকা ফেললে তো লাভ হবে না, আর একশো কেন তার বেশিও রাখা যেতে পারে। বেঞ্চিতে বসে গজগজ করতে লাগলেন ভারতচন্দ্র।

ভদ্রমহিলা ফিরে এলেন, মুখে লালচে ভাব।

.

ভোর সাড়ে চারটের সময় ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। অনিমেষ নিশ্চয়ই ভাবল মাধবীলতা মাঝখানে। ওপরেরটা খালি, পাশেরটার নীচে বাবা, মাঝখানে মা, ওপরে মেয়ে। ট্রেন তখন নিউ জলপাইগুড়ি ছেড়েছে। অনিমেষ উঠল। আবার বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে নীরবে মাধবীলতাকে তুলল, আর বড়জোর পঁচিশ মিনিট। ওদের ঘুমাতে দাও।

পুরো ট্রেন ঘুমাচ্ছিল। কিন্তু বাণীনগর স্টেশন থেকে আচমকা ব্যস্ততা ছড়াল কামরায়। দেখা গেল জলপাইগুড়ি শহরে নামার লোক অনেক রয়েছে। অনিমেষ দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল। ভোরের ঠান্ডা বাতাসের ছোঁয়া পেয়ে হঠাৎ, এত বছর পরেও তার শরীরে অদ্ভুত এক অনুভূতি হল। সমস্ত আকাশ, রোদ এখনও গায়ে না পাওয়া গাছেরা, ভেজা ঘাস যেন বলতে লাগল, আহা কী ভাল, কী ভাল।

চোখের সামনে চায়ের বাগান, ধানখেত, দূরের হাইওয়ে যেটা ময়নাগুড়ি, ধূপগুড়ি, স্বর্গছেঁড়া হয়ে ডুয়ার্সে চলে গিয়েছে যে রাস্তায় সে যাতায়াত করেছে কতবার তা হিসেবে নেই, যেন বুকের গভীর গভীরতর অংশ থেকে আচমকা বেরিয়ে এসে ওইখানে শান্ত হয়ে শুয়ে আছে। মাধবীলতা পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। অনিমেষ বলল, দেবী চৌধুরানির মন্দিরটা এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।

একদিন রিকশায় চেপে দেখে যাব।

ট্রেন থামল। জলপাইগুড়ি রোড স্টেশন। কুলিরা একটু হতাশ হল। ওরা বেশ ভারী হওয়া সত্ত্বেও মালপত্র বয়ে নিয়ে এল রিকশা পর্যন্ত।

কোথায় যাবেন বাবু?

হাকিমপাড়া। টাউন ক্লাব মাঠের কাছে।

উঠুন।

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার