তখন সবে ভোরের রোদ উঠেছে। জলপাইগুড়ি শহর থেকে এই রোড স্টেশনটা বেশ দূরে, রাস্তাও নির্জন। একটা হাইওয়ে পেরিয়ে রাজবাড়ির রাস্তা ধরল রিকশাওয়ালা। প্যাডেল ঘোরাতে ঘোরাতে জিজ্ঞাসা করল লাস্ট কবে এসেছেন?

রিকশাওয়ালার প্রশ্ন শুনে হেসে ফেলল মাধবীলতা। বলল উনি এখানেই জন্মেছেন।

অনিমেষ মাথা নাড়ল, ঠিক এই শহরে নয়। এখান থেকে অন্তত পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার দূরের চা-বাগানে। আপনি কতদিন সাইকেল রিকশা চালাচ্ছেন?

রিকশাওয়ালা প্যাডেল ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, তিরিশ বছর হয়ে গেল বাবু।

অনিমেষ মনে করার চেষ্টা করল। ওই সময়ের অনেক আগে থেকেই তার সঙ্গে জলপাইগুড়ির সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। তখন হাকিমপাড়ায় রিকশাচালকদের ঠেক ছিল। সারাদিন রিকশা চালিয়ে মালিককে ভাড়া দিয়ে তারা কাঠের আগুনে রুটি সেঁকত। দৃশ্যটি মনে পড়ে যাওয়াতে সে খুব সরল গলায় জিজ্ঞাসা করল, হাকিমপাড়ায় থাকো নাকি?

সঙ্গে সঙ্গে ব্রেক চাপল লোকটি, আপনি জানলেন কী করে? ওর এই অবাক হওয়াটা আরও বিস্মিত করল অনিমেষকে। সে লোকটার প্রৌঢ় মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তোমার বাবাও কি রিকশা চালাত?

হ্যাঁ। দ্রুত মাথা নাড়ল লোকটা।

ওর নাম কি দশরথ?

আরেব্বাস। আপনি আমার বাবাকে চেনেন? বাবু, আমি দশরথের ছেলে। লছমন। বাবা মরে গেছে তিন বছর হয়ে গেল।

এখানেই?

হ্যাঁ বাবু। আমাদের তো দেশ বলে কিছু নেই। সমস্তিপুরে যা খেতিজমি ছিল তা বাবা বিক্রি করে দিয়ে এসে বলেছিল, এখন থেকে এই জলপাইগুড়িই আমাদের জায়গা। আমার বাবাকে আপনার মনে আছে বাবু? লছমনের মুখটা হঠাৎ অন্যরকম দেখাচ্ছিল।

হ্যাঁ। আবছা লাগছিল। তোমাকে দেখার পর স্পষ্ট হল। চলো।

আবার রিকশা চলতে শুরু করল। এখনও পথে মানুষের ভিড় তৈরি হয়নি। অবশ্য রাজবাড়ির এই অঞ্চলটাকে শহরের ভিতর বলা যায় না।

বাঁ দিকে রাজবাড়ির দিঘি। অনিমেষ বলল, বাঁ দিকের পথটা ধরে এগিয়ে গেলে তরুদার বাড়ি পড়বে।

তরুদা কে?

ওঃ। তরু রায়। জলপাইগুড়ির সুরের রাজা। কত ছাত্রছাত্রী তৈরি করেছেন তার হিসেব নেই। খুব গুণী মানুষ।

তুমি গান বাজনার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলে নাকি?

তখন আমাদের যা বয়স তাতে যা টানত তাতেই আগ্রহী হয়ে যেতাম।

ক্রমশ রিকশা চলে এল দিনবাজার পুলের কাছে। মাঝে মাঝে করলা নদী দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু পুলের দিকে বাঁক না নিয়ে হাসপাতালের পাশ দিয়ে যেতে যেতে অনিমেষকে রিকশাওয়ালা জিজ্ঞাসা করল, হাকিমপাড়ায় কোন বাড়িতে যাবেন বাবু?

আর একটু এগিয়ে বাঁ দিকের জেলাস্কুলের রাস্তা ধরে। বলতে বলতে দুপাশের বাড়ি, করলা নদী, গাছগাছালি দুচোখ ভরে গিলছিল অনিমেষ। সেটা খেয়াল হতেই হাসি পেয়ে গেল তার। অনেক বদলে গেছে সেই চেনা পৃথিবীটা, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এতগুলো বছর, দিনের পর দিন কলকাতায়। থাকার সময় তো এদের কথা একবারও মনে আসেনি। কেউ যেন দুহাত তুলে আড়াল করে রেখেছিল এই চেনাপথ, বাড়ি, নদী। আজ এদের সামনে এসে আবেগে ভাসার কোনও যুক্তি নেই।

মিলছে না? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

অনিমেষ মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। বয়সের ছাপ মাধবীলতার গলায়, মুখে। হাঁটুর ওপর পড়ে থাকা হাতটা তুলে নিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, এই হাওয়া কি তিরিশ বছর আগের মতো একই রয়ে গেছে?

অস্বস্তি কাটাতে হাত সরিয়ে নিল মাধবীলতা। আশ্চর্য। এক থাকতে পারে নাকি!

তা হলে আর জিজ্ঞাসা করলে কেন মিলছে কি না?

মাধবীলতা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল।

বহু বছর আগে সে একবার জলপাইগুড়িতে এসেছিল অনিমেষের সঙ্গে। নিজের জন্য যতটা নয়, অর্কর জন্যে মনে হয়েছিল, আসাটা জরুরি ছিল। এখন সে কিছুই চিনতে পারছে না, কারণ তখন মনে রাখার মতো করে দেখে রাখেনি।

ডানদিকে চলল। অনিমেষ বলল।

রিকশাওয়ালা একটা গলির মধ্যে খানিকটা গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি দাদুর বাড়িতে যাবেন?

দাদুর বাড়ি? অনিমেষ অবাক।

ওই বাড়ি। এখন মাসিমা ছাড়া আর কেউ থাকে না। দেখুন না, বাড়ির কী চেহারা হয়েছে। প্লাস্টার খসে গেছে, জঙ্গল তৈরি হয়েছে বাড়ির ভেতর। লোকে বলে সন্ধে নামলেই ভূতপ্রেত এখানে ঘুরে বেড়ায়।

ওপাশে ভাড়াটে ছিল না?

ও, হ্যাঁ, তারা এখনও আছে। উলটোদিক দিয়ে যাওয়া আসা করে। তারা এদিকে আসে না। মাসিমার তো ওই ভাড়ার টাকায় চলে। রিকশাওয়ালা বলল।

আমাকে একটু ধরো, নামব।

প্রথম অনিমেষ নেমে ক্রাচ ধরতে মাধবীলতা নেমে এল, কত দিতে হবে?

রিকশাওয়ালা অনিমেষের দিকে তাকাল, আপনি দাদুর কে হন বাবু?

তুমি আমার বাবাকে দাদু বলছ কি না জানি না, তবে আমি এখানে আমার ঠাকুরদার সঙ্গে থাকতাম। তাকেই দাদু বলতাম। অনিমেষ বলল।

রিকশাওয়ালাই জোর করে সুটকেস আর ব্যাগ নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকল। ভেতরটা দেখে মনে হচ্ছিল এখানে মানুষ থাকে না। আগাছায় ছেয়ে গিয়েছে চারধার। দালানবাড়ির যে ঘরটিকে ঠাকুরঘর হিসেবে ব্যবহার করা হত সেই ঘরের দরজা খোলা। রিকশাওয়ালা তার সামনে পৌঁছে হাঁকল, মাসিমা, ও মাসিমা।

অ্যাঁ? মাসিমা। তোর মা কে তা আমি জানিই না, তোর মাসিমা হতে যাব কোন দুঃখে? ভাগ, ভাগ এখান থেকে। ঘরের ভেতর থেকে কর্কশ কণ্ঠস্বর ভেসে এল। রিকশাওয়ালা মালপত্র নামিয়ে বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি দশরথের ছেলে লছমন।

অ। কী হয়েছে?

একবার তো বাইরে এসে দেখুন, কে এসেছেন? দাদুর নাতি! উত্তরটা প্রশ্নের সঙ্গে দিয়ে দিল রিকশাওয়ালা। অনিমেষ এবং মাধবীলতা তখন লম্বা বারান্দার মাঝখানে দাঁড়িয়ে। ঠাকুরঘর থেকে যিনি বেরিয়ে এলেন তাঁর চেহারা দেখে হতভম্ব অনিমেষ। এত শীর্ণ মানুষ হয়? ছোটমা দরজায় একটা হাত রেখে পঁড়িয়ে।

মাধবীলতা এগিয়ে গেল, আমরা পরশু আপনার চিঠি পেয়েছি। এ কী চেহারা হয়েছে আপনার?

ছোটমা হাসল, কেন? আমি তো ভালই আছি। তুমি কেমন আছ?

মাধবীলতা তাকাল। চারটে চোখ একসঙ্গে পরস্পরকে দেখল।

ছোটমা বলল, আসতে পারো ভেবে নিয়ে ওই পাশের ঘরটা পরিষ্কার করে রেখেছি। রাত জেগে এসেছ। যাও, হাতমুখ ধুয়ে জামাকাপড় বদলে নাও। মাধবীলতা ইঙ্গিতটা বুঝতে পারল। তবু একটু ঝুঁকতেই ছোটমা বলল, ও ঘর থেকে ঘুরে এসে আগে তোমার পিসশাশুড়ি, নিজের শাশুড়িকে নমস্কার করো, তারপর কথা শেষ হল না। মাধবীলতা বারান্দা দিয়ে হেঁটে ওপাশের দরজাটা খুলল। তারপর ব্যাগ নিয়ে ভেতরে চলে গেল। এতক্ষণ অনিমেষ চুপচাপ দেখছিল। হঠাৎ সংবিৎ ফিরতে সে রিকশাওয়ালার দিকে তাকাল। লছমন, কত দিতে হবে?

কী বলব বাবু! যা ইচ্ছে তাই দিন। লছমন মাথা নাড়ল।

দ্যাখো, আমি বহুবছর সাইকেল রিকশায় উঠিনি। এখন কীরকম ভাড়া তা জানি না।

অনিমেষের কথা শেষ হতেই ছোটমার গলা শুনতে পেল, কোত্থেকে আসছিস লছমন?

রোড স্টেশন থেকে মাসিমা। লছমন বলল, যা দেওয়ার দিন।

ওখান থেকে তো অনেক ভাড়া। তিরিশ-চল্লিশ তো হবেই। ছোটমা বলল।

অনিমেষ পকেট থেকে চারটে দশ টাকার নোট বের করে এগিয়ে ধরল। লছমন মাথা নাড়ল, না, না, পাবলিকের কাছ থেকে যা নিই তা আপনার কাছে নেব কেন? আপনি তিরিশ দিন।

আমি তো তোমার কাছে পাবলিক ছিলাম। কেউ কাউকে চিনতে পারিনি। রাখো।

টাকাটা নিল লছমন। তারপর সুটকেসটা তুলে মাধবীলতা যে দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকেছিল তার সামনে রেখে ছোটমায়ের দিকে কয়েক পা এগোল, মাসিমা, বাবাকে কি দেখা করতে বলব?

ভাল হয়।

লছমন ঘাড় নেড়ে নীচে নেমে গেল। একদা যা ছিল ফুলের বাগান তা এখন বুনো ঝোঁপের জঙ্গল। তাকে আর দেখা গেল না।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ভাড়াটে নেই?

আছে। আছে বলেই এখনও দাঁড়িয়ে আছি। ছোটমা বলল।

বাড়ির অবস্থা থেকে সব বুঝতে পারছি। এতদিন জানাওনি কেন?

ছোটমা বোধহয় না হেসে পারল না। বলল, এতদিন মৃত্যুভয় হয়নি, তাই–। বলে ভেতরে চলে গেল।

মৃত্যুভয়? আচমকা অনিমেষের মনে হল শব্দটার মধ্যে সত্যতা আছে। এই বাড়িতে আজ ঢোকামাত্র একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। অপরিচিত গন্ধ অনুভব করছিল। এই গন্ধ যে মৃত্যুর গন্ধ তা বুঝে নিথর হল সে। এই বাড়ি তৈরি করেছিলেন সরিশেখর মিত্র। তখন অনিমেষের শৈশব। তিনি চলে গিয়েছেন। এই বাড়ির ছাদে এক বন্যা-বৃষ্টির রাত্রে অনিমেষের মা মাধুরী পা পিছলে পড়ে গিয়ে মারা গিয়েছেন অসহায়ভাবে। আর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে অনিমেষের ভাই অথবা বোন পৃথিবীতে আসত। এখানেই চলে গিয়েছেন বড়পিসিমা যার স্পর্শ সর্বত্র ছড়ানো ছিল। স্বৰ্গছেঁড়া থেকে অবসর নিয়ে এসে বাবা এই বাড়িতেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। এই যে এতগুলো মানুষ, কেউ মাত্র পঞ্চাশ বছর আগেও ভাবতে পারেননি তাঁরা এখান থেকেই বিদায় নেবেন। পঞ্চাশ বছর পরে কেউ পৃথিবীতে থাকবেন না। আজ তাদের মৃত্যুর গন্ধ যদি এই বাড়ি জুড়ে ছড়িয়ে থাকে তা হলে সেটা কি অস্বাভাবিক?

অনিমেষ তাকাল। বুনো ঝোঁপের আড়ালে ওটা কী ঝুলছে? ফল? সে ধীরে ধীরে ক্রাচ নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে এগিয়ে গেল। কাছে যেতেই হেসে ফেলল অনিমেষ। সেই পেয়ারা গাছটা। আগের মতো বড় নেই। ঝড় বাদলে ডাল ভেঙেছে হয়তো। ঝোঁপের আড়ালে পড়ে গেছে। সেই কোন শীতের মধ্যরাত চোখের সামনে ফিরে এল। দাদু-পিসিমাকে লুকিয়ে রূপশ্রীতে উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা দেখতে গিয়েছিল নাইট শো-তে। যাওয়ার আগে দরজার মাঝখানে কাগজ গুঁজে গিয়েছিল যাতে বন্ধ দেখায়। রাতটা ছিল কনকনে শীতের। বারোটার পর পেছনের তারের বাউন্ডারি ডিঙিয়ে এই পেয়ারা গাছের নীচে এসে ধড় থেকে যেন প্রাণ উড়ে গিয়েছিল। দরজা হাট করে খোলা, ভেতরটা অন্ধকার, অর্থাৎ সে ধরা পড়ে গিয়েছে। ওই অন্ধকার ঘরের ভেতরে দাদু নিশ্চয়ই লাঠি হাতে তার জন্যে অপেক্ষা করছেন। পা বাড়াতে সাহস হয়নি তার। শিশিরে ভিজে চুপসে থাকা পেয়ারা গাছের পাতা থেকে টুপটাপ জল ঝরে পড়ছিল মাথায়, কাঁধে। সেই ঠান্ডা সহ্য করা যখন সম্ভব হল না তখন সে মরিয়া হয়ে এগিয়ে গিয়েছিল। কী অবাক কাণ্ড!

ঘরে কেউ ছিল না। ভাঁজ করা কাগজটা পড়ে ছিল দরজার নীচে মেঝের ওপর। তাড়াতাড়ি নিঃশব্দে দরজা বন্ধ করে লেপের তলায় ঢোকা সত্ত্বেও শরীর থেকে ঠান্ডাটা যাচ্ছিল না।

প্রিয় সিনেমার একটি দৃশ্য যেন আবার নতুন করে দেখতে পেল অনিমেষ। তারপর সংবিৎ ফিরতেই কোনওরকমে ডাল থেকে পেয়ারাটা টেনে ছিঁড়ে নিল। আঃ। অনিমেষের মনে হল, এরকম একটা শব্দ শুনল সে। ডালটা ততক্ষণে নড়েচড়ে আবার স্থির হয়ে যাচ্ছে। অনিমেষ ফিসফিস করে বলল, সরি।

মাধবীলতা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসেছিল শাড়ি জামা বদলে। ঘরে ঢুকতেই অনিমেষকে দেখতে পেল, মুগ্ধ হয়ে পেয়ারাটাকে দেখছে।

সাতসকালে পেয়ারা খাবে নাকি? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

এই পেয়ারা খাওয়ার জন্য নয়।

তা হলে ছিড়লে কেন?

ভুল করেছি। উত্তরটা শুনে মাধবীলতা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। তারপর চুলে চিরুনি বুলিয়ে বলল, অর্ককে একটা ফোন করে দিয়ে।

ঠিক আছে।

আর শোনো, এখানে কি খুব লোডশেডিং হয়?

জানি না। কেন?

একটা আলোও জ্বলছে না। আমি ওঁর কাছে যাচ্ছি। তুমি বাথরুম সেরে নাও।

মাধবীলতা বেরিয়ে গেলে অনিমেষ ঘরটাকে দেখল। স্কুলের শেষ ধাপে তো বটেই, কলকাতার কলেজের ছুটিতে ফিরে এসে এই ঘরেই থেকেছে সে। কিন্তু তখন এই বড় পালঙ্কটা ছিল না। আলমারিগুলোও না। বাড়ির সব জিনিসপত্রও যেন এই ঘরে ঠেসে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।

মাধবীলতা এবং ছোটমা কথা বলছিল। দাঁত মেজে, পরিষ্কার পাজামা পাঞ্জাবি পরে অনিমেষ দরজায় দাঁড়াতেই ছোটমা বলল, ওকে মোড়াটা দাও।

এখানে বসবে? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

ছোটমা হাসল, বা রে। এখানে না বসলে কথা বলব কী করে?

মাধবীলতা একটা মোড়া বের করে দরজার সামনে রেখে বলল, তোমরা কথা বলো, আমি চা করে নিয়ে আসি। শোনো, উনি রোজ চা খান না, আমরা আসলেও আসতে পারি ভেবে চায়ের পাতা আনিয়ে রেখেছেন।

আনিয়ে? রেখেছেন কানে লাগল অনিমেষের।

যদ্দিন তোমার বাবা বেঁচে ছিলেন তদ্দিন চা-বাগান থেকে বিনা পয়সায় বছরে দুবার চা আনত। এখন খেতে হলে কিনে খেতে হয়। ছোটমা বলল।

ভাবা যায়? অনিমেষের মনে পড়ল, বড়পিসিমা বাগান থেকে আসা চা পাড়ার লোকদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন।

মাধবীলতা যেতে গিয়ে থমকাল, যায়! ভাবা যায়।

তুমি বুঝতে পারো না, অনিমেষ মাথা নাড়ল।

খুব পারছি। এই যে একটু আগে তুমি গাছ থেকে একটা পেয়ারা ছিঁড়ে মুগ্ধ হয়ে ঘরে ঢুকলে, কলকাতা হলে ওটা করতে পারতে? পারতে না। কিন্তু কখনওই বলতে না, ভাবা যায়! বদলে যাওয়া সময়কে সহজভাবে নেওয়াই ভাল। মাধবীলতা চলে গেল।

মোড়ায় বসল অনিমেষ। তাকে ভাল করে দেখল ছোটমা। বয়সে অনিমেষের সঙ্গে তার বিরাট পার্থক্য নেই। অনিমেষ বলল, বলো।

তোমাদের কি এখনও কলকাতায় থাকা দরকার?

দরকার কিনা তা জানি না, অভ্যেসে আছি।

একসময় তো এখানে থাকতেই অভ্যস্ত ছিলে।

কী ব্যাপার যদি একটু বুঝিয়ে বলল।

আমি এই ভূতের বাড়ির বোঝা বইতে পারছি না। ছোটমা মুখ নামাল।

বিক্রি করে দাও।

হেসে ফেলল ছোটমা, ভাল বললে! কিন্তু কেউ কিনতে চায় না, পেতে চায়।

মানে?

আমার শরীর খারাপ। ডাক্তার বলেছিল রোগটাকে নিয়েই থাকতে হবে। তা পাড়ার কয়েকজনকে বলেছিলাম বাড়ি বিক্রি করার কথা। একজন বলল, যেমন আছেন তেমন থাকুন। আপনার খাওয়া থাকা চিকিৎসার সব দায়িত্ব। আমার। বিক্রি করার কী দরকার, আপনি আমাকে অনেককাল চেনেন। তাই গিফ্ট করে দিন। ছোটমা মুখ তুলল, পাড়ার কাউন্সিলার এসেছিল খবরটা শুনতে পেয়ে। বলল, তার সঙ্গে কথা না বলে কাউকে যেন লিখে না দিই। অনিমেষের মনে হল সে কোনও অজপাড়াগাঁয়ে বসে আছে, জলপাইগুড়ি শহরে নয়।

.

০৭.

এত আগাছা, এত লতানো জঙ্গল কতদিন ধরে প্রশ্রয় পেয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। অনিমেষ সেই গাছগাছালির মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছিল। তার মনে পড়ল, বাল্যকালে এই বাড়ির বাগানে শেয়াল আসত। তখন বাগান ছিল খুব পরিষ্কার, দাদুর যত্নে তৈরি। তবু বড়পিসিমা সেই সাতসকাল অথবা ভর সন্ধ্যায় রান্নাঘরের ওপাশে দাঁড়িয়ে শিবা শিবা বলে চেঁচিয়ে ডাকতেন, অমনি তিস্তার দিকের মাঠ থেকে ছুটে আসত দুটো শেয়াল। বড়পিসিমার রেখে দেওয়া এঁটোকাটা গপগপ করে খেয়ে এই বাগানে বসে ল্যাজ নাড়ত। দেখে কুকুরের সঙ্গে তাদের আচরণের তেমন পার্থক্য বোঝা যেত না। পরের দিকে দুটোর বদলে একটা শেয়াল আসত পিসিমার ডাক শুনে। তখন তিস্তা নদী আর এই বাড়ির মাঝখানে যে পি ডব্লু ডি-র মাঠ ছিল তার অর্ধেকটাই বুনো ঝোপে ঢাকা। দিনের বেলায় সাহস করে সেখানে গিয়ে শেয়ালের গর্ত দেখে এসেছিল অনিমেষ। যেই তিস্তার জল বাড়ত, বাঁধ তৈরির আগের সেইসব দিনে শেয়ালেরা তুমুল চিৎকার করত। বড়পিসিমা বলত, আহা রে! গর্তে বোধহয় নদীর জল ঢুকে গেছে।

আজ এত বছর পরে এই জঙ্গলের বাগানে দাঁড়িয়ে অনিমেষের মনে হল, এখানে শেয়ালদের আস্তানা থাকা অস্বাভাবিক নয়। ঠিক তখনই সে সাপটাকে দেখতে পেল। কুচকুচে কালো মোটা সাপ, অন্তত সাত-আট ফুট লম্বা, জিভ বের করতে করতে এই গাছের ডাল থেকে আর এক গাছের ডালে নিশ্চিন্তে চলে যাচ্ছে। সরে এল অনিমেষ। ছোটমা এদের সঙ্গে এখানে বাস করছে!

বারান্দার এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিল মাধবীলতা, ইশারায় কাছে যেতে বলল। ক্ৰাচটা এখন শুধু পায়ের বিকল্প নয়, অস্ত্রের প্রয়োজনও মেটাচ্ছে। একটা বিছেকে ক্রাচ দিয়ে মেরে ফেলে অনিমেষ মাধবীলতার কাছে গিয়ে বলল, ভয়ানক ব্যাপার। আজই এই জঙ্গল পরিষ্কার করানো দরকার।

কেন? মাধবীলতা সামনে তাকাল।

ভয়ংকর বিষধর সাপ ঘুরে বেড়াচ্ছে।

কী করে বুঝলে বিষধর? তুমি কি সাপ চেনো?

দেখে তো মনে হল–!

তা হলে তোমার ছোটমা বলতেন। উনি তো সাপ যদি থাকে তা হলে তাদের চরিত্র ভাল করে জানেন। যাক গে, মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি খুব টায়ার্ড?

না। কেন? অনিমেষ অবাক হল।

একটু বাজারে যাওয়া দরকার। আমি তো এখানকার কিছুই চিনি না, অবশ্য একটা রিকশা নিয়ে যেতে পারতাম, কিন্তু তোমার ছোটমা সেটা কীভাবে নেবেন তা বুঝতে পারছি না।

মাধবীলতা বলল।

আমিই যাচ্ছি। কী আনতে হবে বলো।

মাধবীলতা একটা কাগজ এগিয়ে দিল, লিস্ট রেডি, তোমার কাছে যা আছে তাতে হয়ে যাবে।

আমার পকেটে টাকা আর হিসেব তুমি রাখছ। একটা কথা, তখন থেকে শুনছি, ওঁর কথা বলতে গেলে তুমি বলছ, তোমার ছোটমা, কেন?

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

হেসে ফেলল মাধবীলতা। বা রে! উনি তো তোমারই ছোটমা। তাই?

তোমার কে হন?

কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল মাধবীলতা। তারপর হাসল, ঠিক আছে, আমারও উনি ছোটমা। হয়েছে? যাও। বেশ বেলা হয়ে গেছে। এখন এখানে বাজার খোলা থাকে কি না তা জানি না।

কিন্তু ছোটমা বললেন আমরা আসব ভেবে–

তার পরেও তো দরকার হতে পারে। লিস্টটা দেখলেই বুঝতে পারবে। কিন্তু বাজার করতে হলে একটা ব্যাগ দরকার হবে। মাধবীলতা পরামর্শ দিল, ওটা বাজার থেকে কিনে নিয়ো।

একটু বাদে অনিমেষ বাড়ির উলটোদিক দিয়ে বেরিয়ে এল। এদিক দিয়ে অল্প হাঁটলেই বড় রাস্তায় পড়া যাবে। ওখান থেকে রিকশা নিলে কয়েক মিনিট বাজার। এ পাশের সেই লোহার গেটটা এখনও রয়েছে।

কে? কী চাই?

গলা কানে যেতেই অনিমেষ পেছন ফিরে তাকাল। একজন বৃদ্ধ, পরনে লুঙ্গি এবং গেঞ্জি, হাতে খুরপি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

অনিমেষ হাসল, আমি এই বাড়িতেই এসেছি, কাউকে চাই না।

বুঝতে পারলাম না।

বলছি। আপনি নিশ্চয়ই এদিকটায় ভাড়া নিয়ে আছেন?

হ্যাঁ।

যাঁকে আপনি ভাড়া দেন তিনি সম্পর্কে আমার মা হন। গেট খুলে বাইরে পা বাড়াতে বাড়াতে অনিমেষ লক্ষ করল বৃদ্ধের মুখের চেহারাটা বদলে গিয়েছে।

টাউন ক্লাবের মোড়ে গিয়ে দাঁড়াতেই অনিমেষের মনে হল জলপাইগুড়ি শহরের অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। একের পর এক যেভাবে রিকশা, সাইকেল, গাড়ি ছুটে যাচ্ছে তাতে স্পষ্ট, শহরের ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। বাল্যকাল থেকে দেখে এসেছে, এই অঞ্চলে শহরের মানুষ আসত দুটো কারণে। টাউন ক্লাব মাঠে খেলা খেলতে অথবা জেলা স্কুলে বাচ্চাদের পৌঁছাতে। শহরের দোকানপাট, ব্যাবসাবাণিজ্য, সব ওদিকে। এদিকটায় দিনভর ঘুঘু ডাকত। অথচ এখন একটাও খালি রিকশা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। একের পর এক সওয়ারি নিয়ে তারা ছুটে যাচ্ছে। অনিমেষ চারপাশে তাকাল। একটা চায়ের দোকানও সাজিয়েছে এখানে। যতদূর মনে পড়ছে, এখানে একটা কয়লার দোকান ছিল। সে এগিয়ে গিয়ে মাটিতে পোঁতা বেঞ্চিতে বসে বলল, চা পাওয়া যাবে?

যাবে। একটু দেরি হবে, জল ফুটছে।

ঠিক আছে। অনিমেষ চারপাশে তাকাল। রাস্তার দুপাশের বাড়িগুলোর চেহারা প্রায় একইরকম রয়ে গেছে। শুধু সেই সময়ের মানুষগুলো এখন নেই। ওপাশের বেঞ্চিতে বসে একজন খবরের কাগজ পড়ছিল, সেটাকে ভাঁজ করে রেখে চলে গেল। যে ছেলেটি চা দিতে এল তাকে ইশারায় কাগজটা দিতে বলল অনিমেষ। ছেলেটি কাগজটা দিলে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, এটা কখন আসে?

সকাল সকাল। চায়ের দোকানদার জবাব দিল, কলকাতার কাগজ আসে দুপুর বেলায়। সেরকম কাগজ করতে পারেনি কিন্তু খবরটা তো আগে জানা যায়।

মাথা নাড়ল অনিমেষ। প্রথম পাতায় নজর বোলাতেই খবরটা পড়ল সে, ঝাড়গ্রামের কাছে পুলিশ-উগ্রপন্থী সংঘর্ষ, মৃত দুই? কিছুকাল ধরে এই ধরনের সংঘর্ষের খবর কাগজে পাওয়া যাচ্ছে। মূলত, মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া জেলার গ্রামগুলোতে যেসব উগ্রপন্থী পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িত তাদের ইতিমধ্যে মাওবাদী বলা হচ্ছে। কেন মাওবাদী? ভারতবর্ষে তো মাওবাদ কখনওই তত্ত্ব হিসেবে গৃহীত হয়নি। তারা যখন আন্দোলনের কথা ভেবেছিল তখন মাও সে তুং-এর চিন্তাধারা অবশ্যই উদ্বুদ্ধ করেছিল। কেউ কেউ উচ্ছ্বাসের আধিক্যে স্লোগান তুলেছিল, চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান। একটু অস্বস্তি হত তখন, এখন ব্যাপারটাকে শুধু বোকামি বললে কম বলা হয়, অশিক্ষিত ভাবনা বলাই ঠিক হবে। তারপর তো বহুবছর চলে গেল। হঠাৎ মাও সে তুং-এর নামে নিজেদের চিহ্নিত করে যারা আত্মপ্রকাশ করল তারা ঠিক কারা?

চা ঠান্ডা হয়ে গেল যে!

চা-ওয়ালা বেরিয়ে এসেছে দোকানের ভেতর থেকে। চায়ের কাপ তুলে নিল অনিমেষ, ওহো।

কাগজের প্রথম পাতা পড়েই অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন দেখলাম?

না, না। আপনার দোকান কত দিনের?

আর দোকান! এটাকে দোকান বলে লজ্জা দিচ্ছেন কেন? লোকটি বিড়ি ধরাল।

হাসপাতালের সামনে কুড়ি বছর দোকান করেছি। হঠাৎ সরকারের মনে হল বেআইনি দোকান হঠানো দরকার। বেছে বেছে তুলে দিল কয়েকজনকে। আমাকেও।

বেছে বেছে মানে?

লাল পার্টির বাইরের লোকদের ওখানে আর রাখেনি।

আপনি লাল পার্টি করেন না?

আমি কোনও পার্টিই করি না। অবশ্য এখানে যেসব পার্টি আছে তাদের কারও রং গাঢ় লাল, কারও ফিকে লাল। বাকিরা সব ইলেকশনের আগে উঁকি মারে। বিড়ি নিভিয়ে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলল চা-ওয়ালা, আপনাকে আগে দেখিনি।

অনেক বছর পরে এলাম।

আগে আসতেন?

হ্যাঁ। চায়ের দাম কত?

একটা টাকা দিন।

বেশ কম দাম তো!

তা-ই দিতে চায় না কেউ কেউ। চায়ের দাম দিয়ে উঠে দাঁড়াল অনিমেষ, খালি রিকশা পাওয়া দেখছি খুবই মুশকিল।

এই সময়টায়। অফিস কাছারির সময় তো। যাবেন কোথায়?

বাজারে। খোলা আছে নিশ্চয়ই।

মাছ ছাড়া সব দিন রাত খোলা থাকে। একটু দাঁড়ান, রিকশা পেয়ে যাবেন।

অনিমেষের খেয়াল হল। সে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, বাগান পরিষ্কার করার লোক কোথায় পাওয়া যাবে বলুন তো!

বাগান মানে?

বাড়ির ভেতর বাগানটা জায়গায় জায়গায় আগাছা জমে জমে জঙ্গল হয়ে গিয়েছে। কেউ না থাকলে যা হয়।

কোন বাড়ি বলুন, পাঠিয়ে দেব।

অনিমেষ বাড়িটার হদিশ জানাতেই চা-ওয়ালা মাথা নাড়ল, বুঝতে পেরেছি। একজন বৃদ্ধা থাকেন বোধহয়। আপনি ওঁর কে হন?

আত্মীয়।

অ। শুনেছি বড্ড মুখ ওঁর। ধারে কাছে কাউকে দেখলেই গালিগালাজ করেন। এসব শোনা কথা। ঠিক আছে, আপনি তো আছেন, পাঠিয়ে দেব। এই রিকশা। চিৎকার করে খালি রিকশা থামাল চা-ওয়ালা।

রিকশায় বসে ছোটমায়ের কথা ভাবল সে। বোঝাই যাচ্ছে এখানে খুব ভালভাবে ওঁকে গ্রহণ করছে না প্রতিবেশীরা। কোনও মানুষ যখন একা থাকতে বাধ্য হন তখন কীভাবে থাকবেন তা তিনিই ঠিক করবেন। বাইরে থেকে এসে উপদেশ দেওয়ার কোনও মানে হয় না।

আশ্চর্য ব্যাপার। এত বেলাতেও মাধবীলতার লিস্টের সবকটা জিনিসই পেয়ে গেল অনিমেষ। নতুন ব্যাগে সেগুলো বইতে অসুবিধে হচ্ছিল। লিস্টে মাছ ছিল না। ডিম ছিল। সেগুলোকে সাবধানে ব্যাগে রাখতে হয়েছে।

বাজার থেকে বেরিয়ে রিকশার জন্যে দাঁড়াতেই একটা সাইকেল তার সামনে দিয়ে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে গেল। সাইকেল চালাচ্ছেন একজন বৃদ্ধ। বুক অবধি সাদা দাড়ি, মাথায় টাক, সরু চশমা। পরনে ঢোলা প্যান্ট আর শার্ট।

সাইকেল থেকে নেমে একটু পিছিয়ে এলেন বৃদ্ধ। তারপর অনিমেষের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে নিচু গলায় বললেন, এরকম মিল হয়?

অনিমেষ বুঝতে পারছিল না ভদ্রলোক কী ভাবছেন। ব্যাগটা আর বইতে না পেরে মাটিতে রাখল সে। তারপর জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি কারও সঙ্গে আমার মিল খুঁজে পাচ্ছেন?

হ্যাঁ। তাকে শেষ দেখেছিলাম প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে। তখন তার দুটো পা ঠিকঠাক ছিল। কানে এসেছিল, পুলিশ সে দুটোকে খুব ভালবেসেছে। তারও পরে শুনেছিলাম, সে মরে গেছে। কিন্তু মুখের গড়নে মিল পাচ্ছি। মাথা নাড়লেন বৃদ্ধ, নামটা জানতে পারি কি?

অনিমেষ মিত্র।

যাঃ শালা! বৃদ্ধের মুখটা বালকের হয়ে গেল। হকচকিয়ে গেল অনিমেষ, বুঝলাম না। ততক্ষণে সাইকেল দাঁড় করিয়ে বৃদ্ধ হাত বাড়ালেন, ব্যাগটা দে।

আমি এখনও চিনতে পারছি না।

চিনবি কী করে? মাথায় টাক, দাড়ির আড়ালে মুখ।

নামটা তো এক আছে।

না। সেটাও পালটেছে। গাঁয়ের লোক ডাকে পাগলা মাস্টার। অথচ আমি কোনওদিন স্কুলে পড়াইনি। হাসলেন বৃদ্ধ, তোর বড়পিসিমা কি আছেন?

না বিস্ময় বাড়ছিল অনিমেষের।

তোর বড়পিসিমার স্বামীর নাম মনে আছে?

সঙ্গে সঙ্গে নামটা ছিটকে উঠে এল গলায়, দেবেশ?

একদম চেনা যাচ্ছে না, না?

একদম না।

কবে এসেছিস?

আজই। উঃ, কী পালটে গিয়েছে তোর চেহারা।

এই তো জীবন! তোদের বাড়িতেই উঠেছিস তো?

হ্যাঁ।

তা হলে যাব তোদের বাড়িতে। তোকেও নিয়ে যাব আমার গাঁয়ে। এইসময় রিকশাটা কাছে এসে দাঁড়াল। অনিমেষ দেখল রিকশাওয়ালা নেমে এসে তার ব্যাগটাকে নিয়ে বলল, বাড়িতে যাবেন তো?

দেবেশ বলল, এ কী! তুমি ওকে চেনো?

লছমন মাথা নাড়ল, হ্যাঁ বাবু।

দ্যাখো কাণ্ড। দেবেশ আবার সাইকেলে উঠল, বিকেলে যাব।

আসিস।

সাইকেল চোখের আড়ালে চলে গেলে রিকশায় উঠল অনিমেষ। লছমন বলল, আপনি কেন বাজারে এলেন? মাসিমার বাজার তো আমি করে দিই।

এটা মাসিমার বাজার নয় ভাই।

রিকশা চলতে শুরু করল। করলা নদী পেরিয়ে যেতে না যেতেই অনিমেষ সেই দৃশ্যটা দেখতে পেল। বিকেলে, খেলার মাঠ থেকে বন্ধুদের নিয়ে আসত সে। দাদু তখন হাঁটতে বেরিয়ে গেছেন। বড়পিসিমা তাদের সবাইকে বসতে বলে নাডু খাওয়াত। তার মুখে নাম শুনে পিসিমা অদ্ভুত চোখে তাকিয়েছিল প্রথম দিন। তারপর থেকে দেবেশ গেলেই অন্যদের থেকে বেশি খাবার পেত। দেবেশ খেতে না চাইলে বড়পিসিমা খুব অনুরোধ করত। পরে অনিমেষ জানতে পেরেছিল এগারোতে বিয়ে হওয়া বড়পিসিমা বিধবা হয়েছিল সাড়ে এগারোতে। তারপর থেকে বাপের বাড়িতে। সেই ছয় মাসের স্বামীর নাম ছিল দেবেশ। অনিমেষের ক্লাস সেভেনের বন্ধু দেবেশকে কেন অন্য চোখে দেখেছেন তা তখন বুঝতে পারত না। দেবেশও জেনে গিয়েছিল।

এখন বড়পিসিমার জন্যে বুকের ভেতরটা যেন নড়ে উঠল অনিমেষের।

.

০৮.

লছমনই ব্যাগটাকে রান্নাঘরে পৌঁছে দিল। মাধবীলতা দাঁড়িয়ে ছিল ছোটমার পাশে। হেসে বলল, বাপ রে! আমরা ভাবছিলাম বাজার নিয়ে আসতে সন্ধে হয়ে যাবে।

হজম করল অনিমেষ, তারপর লছমনকে বলল, দুটো লোক চাই লছমন। এই বাগানের যত আগাছা, ফালতু জঙ্গল পরিষ্কার করে দেবে। জোগাড় করে দেবে?

লছমন হাসল, কোনও অসুবিধা নেই। কত করে দেবেন?

আমি তো এখানকার রেট জানি না। অনিমেষ বলল।

ছোটমার আপত্তি, কী দরকার এসব করার? যদি বাড়িটা বিক্রি করে দিতে পারো তা হলে যে কিনবে চিন্তাটা তার হবে।

অনিমেষ বলল, বিক্রি করতে চাই বললে তো কেউ সঙ্গে সঙ্গে কিনবে না। এক বছরও লেগে যেতে পারে। তদ্দিন ওরা এখানে থাকবে?

কারা থাকবে? মাধবীলতা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল।

সাপ। অনিমেষ বলল।

ছোটমা প্রতিবাদ করলেন, আছে তো কী হয়েছে? বহুদিন ধরেই আছে, কিন্তু কখনও কাউকে কামড়ায়নি। আমাকে দেখলেই ওরা সামনে থেকে সরে যায়।

ওরা সবাইকে এত সম্মান করবে তা ভাবার কোনও কারণ নেই। অনিমেষ মাথা নাড়তেই মাধবীলতা ছোটমার দিকে ফিরল, আপনি আপত্তি করবেন না, সাপের চেহারা মনে এলেই আমার শরীর কীরকম ঝিমঝিম করে ওঠে।

ছোটমা বললেন, ঠিক আছে। লছমন, আমার ফুলগাছগুলো যেন না মরে।

অনিমেষ অবাক হল, ছোটমা বাড়ি বিক্রি করে দিতে চাইছেন অথচ ফুলগাছের ওপর তার মায়া যাচ্ছে না। বিক্রি হওয়ার পর গাছগুলো তো নাও থাকতে পারে। কিন্তু সে মুখে কিছু বলল না। কী হবে আঘাত করে।

লছমন বলল, আড়াইশো টাকা দেবেন, বাগান সাফ করে দেব।

দরাদরি করল না অনিমেষ, তা হলে কাল সকালেই পাঠিয়ে দাও।

লছমন মাথা নেড়ে চলে গেল।

.

দুপুরের খাওয়া মন্দ হয়নি। মাধবীলতাই বেঁধেছিল। কলকাতাতেও ওই রাঁধে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, এখানে রান্নার অন্যরকম স্বাদ পেল সে। অবশ্য এটা জলের কারণে হতে পারে। জল স্বাদ বদলে দেয়। কথাটা মাধবীলতাকে বলতে সে চোখ বড় করল, সত্যি, আমার রান্না তোমার ভাল লেগেছে। আমি তো রাঁধতেই জানি না। শেখার সুযোগ পাইনি। আজ তোমার ছোটমা যেভাবে রাঁধতে বলেছেন সেইভাবে বেঁধেছি। কিন্তু তোমার পছন্দ হয়েছে কেন জানো?

অনিমেষ তাকাল।

তুমি এই বাড়িতে বসে খেয়েছ। এখানে তোমার বহু বছর কেটেছে। খেতে বসে সেই পরিবেশটা তোমার মনে হয়তো তৈরি হয়েছে। তা ছাড়া যেসব মশলা দিয়ে তোমার ছেলেবেলায় এই বাড়িতে রান্না হত আজ খেতে গিয়ে তার গন্ধ পেয়েছ, এর মধ্যে আমার কোনও কৃতিত্ব নেই। মাধবীলতা বিছানার ওপাশে শুয়ে পড়ল। আমি ভাবছি এই ভদ্রমহিলার কথা। একা একা এতগুলো বছর এত বড় বাড়িতে কী করে বাস করছেন। জানো, ওঁর মধ্যে অদ্ভুত একটা নিরাসক্তি এসে গিয়েছে। কীরকম উদাস উদাস।

অনিমেষ কিছু বলল না।

যেদিন বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে গিয়েছিলেন, সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিল সে। বরযাত্রীদের পেছন পেছন অনেকটা হেঁটেছিল বালক

অনিমেষ। মা মাধুরীর মৃত্যুশোক সে কিছুতেই ভুলতে পারেনি। মৃত্যুপথযাত্রী মায়ের শরীর থেকে বেরিয়ে আসা রক্ত তার হাতে লেগে গিয়েছিল। চিতায় আগুন দেওয়ার সময় তা শুকিয়ে কালো হয়ে গিয়েছিল। তাই বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীকে বড়পিসিমা যতই ছোটমা বলতে বলুক, মন থেকে মা বলতে খুব কষ্ট হয়েছিল। কলকাতায় পড়তে যাওয়া পর্যন্ত সে ওই মহিলাকে এড়িয়ে গিয়েছিল। তখন স্বর্গছেঁড়া চা-বাগানে বাবার কাছে যেতেই ইচ্ছে করত না। তারপর যখন বাবা মদ্যপান শুরু করল, দাদুর কাছে খবরটা এল, তখন স্বৰ্গছেঁড়ায় গিয়ে ছোটমাকে দেখে প্রথমবার হোঁচট খেয়েছিল সে। ওই বাড়িতে কীরকম ন্যাতার মতো পড়ে থাকতেন অল্পবয়সি মহিলা।

আজ মনে হচ্ছে, বাবাকে বিয়ে করে ছোটমা এই জীবনে কিছুই পাননি। না সন্তান, না সম্মান। এই বাড়ির একটি কাজের লোক হয়েই বেঁচে থাকলেন এতদিন। বাবা অবসর নিয়ে জলপাইগুড়িতে চলে আসার পর হয়তো বড়পিসিমা ওঁকে কিছুটা স্নেহ দিয়েছিলেন, কিন্তু তারও তো দেওয়ার ক্ষমতা প্রায় নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। অনিমেষ যেমন তাকে কখনওই মা হিসেবে মেনে নিতে পারেনি, তাকেও তিনি ছেলে বলে ভাবতে পারেননি, ভাবার সুযোগই পাননি। তা ছাড়া দুজনের বয়সের ব্যবধানও তো তেমন বেশি নয়। প্রশ্ন হল, বাবা এবং বড়পিসিমা মারা যাওয়ার পরে ছোটমা যখন একা হয়ে গেলেন, যখন সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পেলেন তখন কেন এই বাড়িতে আটকে থাকলেন? কথাটা পরদিন সকালে চা খাওয়ার সময় ছোটমাকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করল অনিমেষ। প্রশ্নটা শুনে হাসলেন ছোটমা। মহিলা তেমন সুন্দরী ছিলেন না কখনও, এখন শরীর অতিরিক্ত শীর্ণ হয়ে গেছে, মুখের সর্বত্র তারই ছাপ। কিন্তু ঠোঁট এবং চিবুকে অপূর্ব মিষ্টিভাব এখনও ফুটে ওঠে যখন এইরকম হাসেন।

ছোটমা বললেন, কী করতে পারতাম আমি?

অনিমেষ বলল, এতবড় বাড়ি পাহারা না দিয়ে তখনই বিক্রি করে একটা ছোট ফ্ল্যাট কিনে নিয়ে থাকা যেত।

বা রে! এটা কি আমার বাড়ি যে বিক্রি করব?

তা হলে কার বাড়ি?

ছোটমা মাধবীলতার দিকে তাকালেন, কার সঙ্গে ঘর করছ? একটুও বাস্তব বুদ্ধি নেই। সরিৎশেখর মিত্রের ছেলে মহীতোষ মিত্র। দুজনেই আজ নেই। তাদের একমাত্র বংশধর অনিমেষ মিত্র থাকতে এই বাড়ির মালিকানা আর কে পাবে? আমি তো যক্ষের মতো এসব পাহারা দিয়ে যাচ্ছি।

মাধবীলতা মাথা নাড়ল, কিন্তু আইন বলছে, মহীতোষ মিত্রের স্ত্রী হিসেবে আপনার এই বাড়ির ওপর অর্ধেক অধিকার আছে।

অধিকার! মাথা নাড়লেন ছোটমা, কী জানি!

অনিমেষ বলল, এতদিনে নিশ্চয়ই বোঝা গেছে, এই বাড়ি সম্পর্কে কোনও আগ্রহ আমার নেই। এর সঙ্গে যে স্মৃতি জড়িয়ে আছে সেটা একদম আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তিলতিল করে যা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, যাকে রক্ষা করার ক্ষমতা নেই, তাকে আগলে রেখে কী লাভ।

বেশ তো, যখন এসেই গেছ, যা ভাল বোঝো তাই করো। ছোটমা বললেন।

.

একটু বাদে লছমন চলে এল। সঙ্গে একটি তরুণ যার হাতে লম্বা দা, কাটারি, ঝুড়ি। অনিমেষ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ও একা এই জঙ্গল কাটবে?

লছমন হাসল, না বাবু, আমরা দুজনে মিলে জঙ্গল সাফা করব।

সেকী! তুমি আজ রিকশা চালাবে না?

নাঃ। এখান থেকে কামাই হয়ে গেলে তো লোকসান নেই।

ভাল লাগল অনিমেষের। টাকা রোজগার করার সুযোগ পেলে এই শ্রমিকেরা সেটা হাতছাড়া করতে চায় না।

ওরা কাজ শুরু করে দিল। অনিমেষ লছমনকে মনে করিয়ে দিল সাপের কথা। কোনও গাছ কাটার আগে তরুণটি একটি লম্বা লাঠি দিয়ে ডালপালা জোরে নাড়াচ্ছিল। তারপর নিশ্চিত হয়ে দা অথবা কাটারি চালাচ্ছিল। অনিমেষ বারান্দায় এলে মাধবীলতা বলল, আমি আজ বাজারে যাব।

তুমি?

খুব অবাক হয়েছ মনে হচ্ছে।

তুমি তো এখানকার কিছুই চেনো না।

চিনে নেব।

কাল যা এনেছি তা নিশ্চয়ই শেষ হয়ে যায়নি!

না। একটু ভাল চাল আর মাছ নিয়ে আসব।মাধবীলতা বলল, টিপিক্যাল পুরুষদের মতো কথা বোলো না তো! হঠাৎ লছমনরা চেঁচামেচি শুরু করল। অনিমেষ এবং মাধবীলতা বাগানে নেমে আসতেই লছমন গলা তুলে বলল, বাবু, এখানে শেয়ালের বাচ্চা আছে। দুটো। মা-টা পালিয়ে গেল।

কোনওরকমে জায়গাটায় পৌঁছে ওরা দেখতে পেল একটা গর্তের মধ্যে দুটো শেয়ালছানা শুয়ে আছে। একজন ওঠার চেষ্টা করেও পারল না।

অনিমেষ বলল, কাণ্ড দেখো! ছোটমায়ের এই বাগানে শেয়ালও সংসার করছে।

এইসময় ছোটমায়ের গলা শোনা গেল, কী হয়েছে ওখানে?

লছমন জবাব দিল, এখানে শেয়ালের বাচ্চা আছে।

ওমা। তাই শেয়ালটা ঘুরঘুর করছে কয়েকদিন। কিন্তু ওখানে ওদের থাকতে দে। বড়দিদি ওদের খুব ভালবাসত। ছোটমা জানিয়ে দিলেন।

মাধবীলতা লছমনকে বলল, তোমরা অন্যদিকের জঙ্গল পরিষ্কার করো। এখন এদিকে আর হাত দিয়ো না। ওরা যেমন আছে, তেমনই থাক।

অনিমেষ বলল তেমনই থাক মানে? এ বাড়িতে শেয়ালের বাসা থাকবে?

মাথা নাড়ল মাধবীলতা, থাকবে না। মা শেয়ালটা নিশ্চয়ই দুর থেকে লক্ষ রাখছে। সুযোগ পেলেই সে বাচ্চাদের এখান থেকে নিয়ে যাবে। বলল।

মাধবীলতা বাজারে চলে গেল। অনিমেষ তাকে বারংবার বলে দিল যে টাউন ক্লাবের মোড় থেকে যেন রিকশা নেয়।

কিছুক্ষণের মধ্যে পরপর দুটো সাপ মারল লছমনের সঙ্গে আসা তরুণ। ছোটমা বললেন, দুটোই শঙ্খচুড়। ছোবল মারলে বাঁচার সম্ভাবনা কম।

অনিমেষ বলল, এদের সঙ্গে বাস করা সহজ ব্যাপার নয়।

ছোটমা মাথা নাড়লেন, অথচ এরা কখনওই আমাকে কামড়ায়নি।

সাপের ওপর এত আস্থা রাখা বোধহয় ঠিক নয়।

কার ওপর আস্থা রাখব? মানুষের ওপর? মানুষ তো সাপের চেয়েও ভয়ংকর। সাপ ভয়ে ছোবল মারে, আত্মরক্ষার জন্যে। মানুষ ছোবল মারে আনন্দ পেতে, মজা লুঠতে। দশ বছর একা থেকে কত কী তো দেখলাম। কথাগুলো বলে ছোটমা চলে গেলেন তার ঘরে।

আধঘণ্টা বাদে কেউ বাইরে থেকে চিৎকার করল। অনিমেষ! অনিমেষ?

ডাক শুনে কাজ ফেলে লছমন এগিয়ে গেল ওপাশের গলিতে। তারপরই তাকে দেখা গেল দেবেশকে সঙ্গে নিয়ে ফিরতে। দেবেশের হাতে সাইকেল।

অনিমেষ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল, বলল, আয়। আমার কেবলই দেরি হয়ে যায়। কাল আসার কথা ছিল, আজ এলাম। বারান্দায় দুটো চেয়ার রাখা ছিল, তার একটায় বসল দেবেশ। অন্যটায় অনিমেষ।

দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে দেবেশ জিজ্ঞাসা করল, কদ্দিন পরে এলি?

বহু বছর পরে।

একাই?

না। মাধবীলতাও এসেছে।

কই, ডাক, আলাপ করি।

বাড়িতে নেই। বাজারে গিয়েছে।

বাজারে? তোর বউ বাজারে গেছে?

কেউ যদি গিয়ে খুশি হয় তো যাক না।

জলপাইগুড়িতে এখন কোনও কোনও মহিলা বাজারে যান বিকেল বেলায়। এইসময় কাউকে তো যেতে দেখিনি। তোর ছেলেমেয়ে কজন?

একজন। তোর কী খবর?

এসেছি একা। যাব একা। পৃথিবীর কোনও মেয়ে আমাকে বিয়ে করতে চায়নি, তাই করা হয়নি। তুই যখন স্বর্গভেঁড়া থেকে আসতিস তখন দোমহনি নামে একটা জায়গা পড়ত, মনে আছে?

দোমহনি নয়, ময়নাগুড়ি থেকে বার্নিশঘাটে চলে আসতাম। তবে দোমহনি কোথায় তা আমি জানি।

তার কাছেই আমার আস্তানা। দশজন বুড়োবুড়িকে নিয়ে। দেবেশ বলল।

বুঝলাম না।

দশ বিঘে জমি বহুদিন আগে খুব অল্পদামে পেয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে চালাঘর বানিয়ে আছি আমরা। যেসব মানুষের রোজগার নেই, খাবার দেওয়ার কেউ নেই, মরার পর মুখে আগুন দেওয়ার মতো কোনও আত্মীয় স্বজন নেই, তারা আমার সঙ্গে থাকে। বছর দশেক হয়ে গেল। এর মধ্যে চারজন চলে গেল, তাদের জায়গায় নতুন চারজনকে এনেছি। মনে হচ্ছে। ওদের মধ্যে দুজনের যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। দেবেশ বলল।

এই দশজনের থাকা-খাওয়ার খরচ তুই চালাচ্ছিস? অনিমেষ অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করল।

থাকার খরচ তো নেই। খাওয়ার খরচ–। হাসল দেবেশ, আয় না। একদিন। নিজের চোখে দেখে আসবি।

যাব। খুব ইন্টারেস্টিং বলে মনে হচ্ছে।

ভাই। আমি তো একা বিপ্লব, সমাজসেবা কিছুই করতে পারব না। জীবনভর কোনও রাজনীতিতে বিশ্বাস করতে পারিনি। শুনেছি তুই বিপ্লব করতে গিয়েছিলি, জেলে ছিলি। নিজের একটা পা তার জন্যে সেলামি দিতে হয়েছে, আমার সে সব করার ক্ষমতা বা সাহস ছিল না। আমি একটা কথা বুঝেছি। সেই বোঝার কাজটা করে বেশ শান্তি পাই। যাদের নিয়ে করি তারা পরের দিনের স্বপ্ন দেখে, যা আগে দেখত না। কবে যাবি বল? দেবেশ জিজ্ঞাসা করল।

এই তো এলাম। একটা বড় কাজ করতে হবে। সেটা আগে করি।

কী কাজ?

এই বাড়িতে আমার ছোটমা একা থাকেন। ওঁর পক্ষে আর থাকা সম্ভব হচ্ছে না। তাই বাড়িটাকে বিক্রি করতে হবে।

ছোটমা– আমার দ্বিতীয় মা। দাদু,বাবা, বড়পিসিমা চলে গেছেন। উনি আছেন।

তাই বাগান পরিষ্কার করাচ্ছিস?

প্রশ্নটা শুনে হেসে ফেলল অনিমেষ। না না। সাপখোপ জন্মাচ্ছে, শেয়াল বাচ্চা দিয়েছে ওখানে, তাই। ভাবছি এখানকার কাগজে বিজ্ঞাপন দেব।

তুই এক কাজ কর, কদমতলার মোড়ে একটা স্টেশনারি দোকান আছে। দোকানের মালিক জগদীশবাবু। সবাই চেনে। লোকটা বাড়ি কেনা-বেচার দালালি করে। ওর কাছে যা। ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

তোর চেনা?

আগে চিনতাম। অনেক বছর যোগাযোগ নেই।

এই সময় অনিমেষ দেখল ছোটমা তার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ইশারায় তাকে ডাকছেন। সে ক্রাচ নিয়ে এগিয়ে যেতেই ছোটমা বললেন, চা করেছি। সঙ্গে কি থিন অ্যারারুট বিস্কুট দেব।

ক্রাচ সামলে দুটো কাপ হাতে নেওয়া সম্ভব নয়। অনিমেষ ডাকল, দেবেশ, এদিকে আয়। দেবেশ উঠে এলে বলল, এর নাম দেবেশ। আমরা সহপাঠী ছিলাম।

মাথা নেড়ে ছোটমা ভেতর থেকে দুটো চায়ের কাপ নিয়ে এলেন।

অনিমেষ লক্ষ করল, একদিকে চিড় লাগা-কাপটা তাকে দিলেন ছোটমা।

বিস্কুট লাগবে? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

না না। মাথা নাড়ল দেবেশ, আমি চা খাই না। কিন্তু উনি নিজের হাতে দিলেন বলে আজ খাব।

অনিমেষ লক্ষ করল ছোটমায়ের মুখে তৃপ্তির ছাপ ফুটে উঠল।

.

০৯.

দেবেশের তাড়া ছিল। সে নিজের টেলিফোন নাম্বার লিখে দিল অনিমেষকে। বারংবার অনুরোধ করল একটা ফোন করে ওর ওখানে যাওয়ার জন্যে।

ওকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য টাউন ক্লাবের মোড় অবধি হেঁটে গেল অনিমেষ।

সাইকেলে চেপে দেবেশ চলে যাওয়ার পর অনিমেষ একটু চিন্তায় পড়ল। এতক্ষণে মাধবীলতার ফিরে আসার কথা। সে বাজারের রাস্তার দিকে তাকাল। এমনও হতে পারে, এই সময় রিকশা পাওয়া যাচ্ছে না। মাধবীলতা এসে গেলে দেবেশের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়া যেত। হঠাৎ খেয়াল হল, দেবেশ তাকে ওর ওখানে যেতে বলেছে কিন্তু মাধবীলতাকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেনি। কেন?

খুব চেনা চেনা লাগছে! এক বৃদ্ধ লাঠি হাতে পাশে এসে দাঁড়ালেন।

অনিমেষ তাকাল। স্মৃতি ঝাপসা।

কবে আসা হয়েছে? বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন। গতকাল।

যাঁরা ছিলেন তারা একজনকে রেখে চলে গিয়েছেন। বাড়িটার কী দশা হয়েছে! মহীতোষবাবু যখন বেঁচে ছিলেন তখন ভাবতেই পারতেন না এরকম হবে!

আপনাকে ঠিক–!

কয়েকবার দেখেছি। মহীতোষবাবুর বাবা যখন বেঁচে ছিলেন। অবসর নিয়ে এখানে এসে সময় কাটাতে আমাদের সঙ্গে তাস খেলতেন। তখন তার সঙ্গে আমার একটু ঘনিষ্ঠতা হয়। বন্ধুত্ব বলা বোধহয় ঠিক হবে না। বৃদ্ধ বললেন।

ও।

ছেলে নকশাল হয়ে জীবন নষ্ট করেছে, খুব আপশোস করতেন তিনি। যখন শরীরটা অকেজো হয়ে গেল তখন কলকাতায় পড়ে না থেকে এখানে চলে এলে ভাল হত না? মানুষটা শান্তি পেতেন। বাড়িটার হাল এমন হত না!

অনিমেষের মনে হল বৃদ্ধ অনধিকারচর্চা করছেন কিন্তু সেটা বলতে ইচ্ছে করল না। সে হাসল, আপনি কোন বাড়িতে থাকেন?

জেলা স্কুলের দিকে যেতে ডানদিকে ব্যানার্জিদের বাড়ি ছিল, মনে আছে?

হ্যাঁ। অরুণ ব্যানার্জি। দারুণ ক্রিকেট, হকি খেলতেন।

হ্যাঁ। অরুণ তো কবেই মারা গিয়েছে। ওই বাড়ির পাশেই আমার বাড়ি।

মন্টুদের বাড়ি?

হ্যাঁ। মন্টু আমার ছোটভাই। দুবছর আগে মেয়ের বিয়ে দিল ডিসি অফিস থেকে রিটায়ার করে। গত বছর ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেল।

মন্টুর মুখটা ঝাপসা মনে হল। ফণীন্দ্রদেব স্কুলে পড়ত। খুব ভাল ছেলে ছিল না। অনিমেষ দেখতে পেল মাধবীলতা আসছে। রিকশার পাদানিতে বাজারের ব্যাগ। তাকে দেখে রিকশা দাঁড় করাল মাধবীলতা।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, এত দেরি হল?

মাধবীলতা হাসল, পরে বলব। তুমি এখানে?

কথা খুঁজে না পেয়ে কাঁধ নাচাল অনিমেষ।

বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন, ইনি?

আমার স্ত্রী।

ও! বুঝলাম। আচ্ছা, চলি। যাওয়ার আগে বলি, সৎ মা হলেও তিনি তো মা। তার জন্যেও তো মাঝে মাঝে এখানে এসে থাকা দরকার। বৃদ্ধ লাঠি নিয়ে চলে গেলেন।

রিকশায় বসে শুনছিল মাধবীলতা, জিজ্ঞাসা করল, কে ইনি?

বাবার পরিচিত।

তুমি কি এখন বাড়িতে ফিরবে?

মেজাজটা বিগড়ে দিয়েছিলেন বৃদ্ধ। অনিমেষ বলল, না, তুমি যাও, আমি একটু ঘুরে আসছি।

সঙ্গে টাকা এনেছ?

খেয়াল হল। দেবেশের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সে বাড়িতে যে পাঞ্জাবি পরে ছিল তাই পরেই বেরিয়ে এসেছে। পকেটে কিছু নেই।

ওঃ। তাই তো! অনিমেষ মাধবীলতার দিকে তাকাল।

ততক্ষণে মাধবীলতা পার্স খুলে দুটো দশ টাকার নোট বের করে রিকশাওয়ালাকে বলল, ওকে দিয়ে এসো তো!

৬৭

নোট দুটো হাতে নিয়ে অনিমেষ বলল, থ্যাঙ্ক ইউ।

কথা না বাড়িয়ে মাধবীলতা রিকশাওয়ালাকে বলল, চলো।

.

মিনিট পনেরো পরে অনিমেষ কদমতলায় রিকশা থেকে নামল। সামনেই চৌধুরী মেডিকেল স্টোর্স। রামদার এই দোকানে এককালে দিনের পর দিন আড্ডা মেরে গিয়েছে সে। অত্যন্ত সুদর্শন পুরুষ রামদা, রাম চৌধুরী। কথা বলার ভঙ্গি ছিল বেশ মিষ্টি। রামদা কি বেঁচে আছেন? দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল অনিমেষ। দুজন কর্মচারীকে নিয়ে একজন যুবক দোকান সামলাচ্ছে। তারই ফাঁকে তাকে দেখতে পেয়ে যুবক জিজ্ঞাসা করল, কী ওষুধ নেবেন?

ওষুধ নয়। আমি বাহান্ন বছর বাদে এসেছি। এটা তো রাম চৌধুরীর দোকান?

হ্যাঁ। উনি আমার বাবা। যুবক হাসল।

উনি?

খুব অসুস্থ, শরীর ভাল থাকলে মাঝে মাঝে দোকানে আসেন। বলেই যুবক চোখ ছোট করল। আপনি কিছু মনে করবেন না ভুল হলে, আপনি কি অনিমেষ কাকু?

হ্যাঁ, ভাই। অনিমেষ জবাব দিল।

আরে। আসুন আসুন, ভেতরে আসুন। বলতে বলতে যুবক বেরিয়ে এসে অনিমেষের হাত ধরল।

না না। এখন তোমাদের কাজের সময়।

ছাড়ুন তো, ছেলেবেলায় আপনাকে দেখেছি এখানে বাবার সঙ্গে গল্প করতে। বাবা আপনার কথা খুব বলেন। এই, ভাল করে চা নিয়ে এসো তো! কর্মচারীকে আদেশ দিয়ে টেলিফোনের নাম্বার ঘোরাতে লাগল যুবক।

আহা! আবার চা কেন?

ওপাশ থেকে সাড়া পেয়ে যুবক বলল, বাবা, অনিমেষ কাকা এইমাত্র দোকানে এসেছেন। হ্যাঁ, হ্যাঁ, তিনিই। তুমি পারবে? ঠিক আছে। সাবধানে এসো। হাঃ হ্যাঁ। চা বলে দিয়েছি।

যুবক রিসিভার নামিয়ে হাসল, বাবা আসছেন। দেখুন, আপনার নাম শুনেই উনি জিজ্ঞাসা করলেন, চা দিতে বলেছি কিনা!

উনি যখন অসুস্থ তখন আসার কী দরকার ছিল?

জানি না। আপনার নাম শুনেই বাবা বোধহয় অসুস্থতা ভুলে গেলেন।

তোমার নাম কী?

ছেলেটি জবাব দেওয়ার আগেই চা এসে গেল। তাই পরিবেশন করতে করতে খদ্দের সামলাতে হল। চায়ের কাপ মুখে তুলে অনিমেষ দেখল চিনি নেই বললেই চলে। মাধবীলতা আজকাল চায়ে চিনি তো কমই, দুধও দিতে চায় না। এরকম চা একদম পছন্দ নয় অনিমেষের। চা খেতে খেতে অনিমেষ ছেলেটির দোকানদারি দেখছিল। চল্লিশ বছর আগে সে যখন এই দোকানে এসে বসত, তখন রামদা ওইভাবে দোকান সামলাতেন। খদ্দের না থাকলে সামনের চেয়ারে এসে বলতেন, বলেন? আবার চা বলি?

সেসময় এই দোকানে বসে সে অনেক ওষুধের নাম শিখে গিয়েছিল। লক্ষ করেছিল, খদ্দেরদের অনেকেই যেমন ডাক্তারের লেখা প্রেসক্রিপশন নিয়ে দোকানে ওষুধ কিনতে আসে, তেমনি ডাক্তারের কাছে না গিয়ে সোজা দোকানে এসে কেউ কেউ বলেন তাঁর অসুবিধের কথা। সেটা খুব গুরুতর না হলে দোকান থেকেই ওষুধ দিয়ে দেওয়া হয়।

চা শেষ হলে রিকশাটা এসে দাঁড়াল দোকানের সামনে। রিকশাওয়ালা হাত ধরে অতিবৃদ্ধ যে মানুষটিকে নামাল তাকে রামদা বলে চেনা মুশকিল। রিকশার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে স্থবির পা ফেলে কোনওমতে দোকানে ঢুকলেন বৃদ্ধ। অনিমেষ উঠে দাঁড়াল। যুবক ইতিমধ্যে ছুটে এসেছে, কোনও কষ্ট হয়নি তো?

হাত নেড়ে না বললেন বৃদ্ধ। তারপর অনিমেষের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললেন, আর কোনওদিন দেখা পাব ভাবিনি। বলেন, কেমন আছেন?

আছি। আপনি?

কিছুক্ষণ বাঁচি, দিনের বাকি সময়টায় মরে থাকি। বসুন। বৃদ্ধ বসলেন।

চেয়ারে বসে অনিমেষ বলল, বুঝলাম না।

হাসলেন বৃদ্ধ। আজকাল শুধু ঘুম পায়। জেগে থাকি আর কতটুকু। একদিকে ভাল। ঘুমাতে ঘুমাতে চলে যাব। আমি তো আর এই দোকানে আসতে পারি না। নিজে নিজে রিকশায় ওঠা-নামাই করতে পারি না। ওঃ, কতদিন পরে আপনাকে দোকানে দেখছি। কবে এসেছেন? কতদিন থাকবেন?

কাল এসেছি। কবে যাব জানি না। টিকিট কাটা হয়নি।

উদ্দেশ্য আছে কিছু?

ছিল না, আসার পর হয়েছে। আমার দ্বিতীয় মা বাড়িতে একা থাকেন। তিনি আর পারছেন না। বাড়ি বিক্রি করে দিতে বলছেন। বাড়িটাও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মোটামুটি দাম পেলে বাড়িটা বিক্রি করে দিতে চাই। অনিমেষ বলল।

অনিমেষবাবু, এখন চাই বললেই তা করা যায় না। আপনি তো বিপ্লব করতে চেয়েছিলেন, পেরেছেন? এখন বাড়ি করা যেমন কঠিন ব্যাপার, বিক্রিও তেমনি। এই, চা দিয়েছিস?

অনিমেষ হাত তুলল, দোকানে ঢোকামাত্র চা বলে দিয়েছিল আপনার ছেলে।

রামদা হাসলেন, ও, কতদিন পর!

অনিমেষ লক্ষ করল কথাগুলো বলার পরেই যেন ঝিমিয়ে গেলেন রামদা। তার চোখ বন্ধ হল, মাথা একটু সামনে ঝুঁকল। ওঁর কিছু হয়ে যেতে পারে এই ভয় পেয়ে সে হাত বাড়িয়ে বৃদ্ধের হাত স্পর্শ করতেই তিনি আবার আগের মতো সোজা হয়ে বসলেন, হ্যাঁ, কী যেন বলছিলেন? ওহো, বাড়ি বিক্রি করবেন। কিছু ভেবেছেন?

ভেবেছিলাম কাগজে বিজ্ঞাপন দেব। কিন্তু কাল অনেকদিন পরে এক সহপাঠীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তার মুখে শুনলাম এই কদমতলায় জগদীশবাবু নামে এক ভদ্রলোক আছেন যিনি বাড়ি কেনাবেচার ব্যাপারে সাহায্য করেন। ভাবছি তার সঙ্গে কথা বলব।

জগু? খুব ভাল। ওর অনেকদিনের মনোহারি দোকান থাকলেও বাড়ির দালালিও করে। রামদা বললেন।

অনেকদিন মানে? ষাট-পঁয়ষট্টি সালেও ছিল?

না না। তার কিছু পরে। আপনি দেখেছেন বলে মনে হয় না। কিন্তু শুনেছি ওর ব্যবহার ভাল, কেউ ওকে ঠকানোর অপবাদ দেয়নি। কথাগুলো বলে রামদা ছেলেকে বললেন, দ্যাখ তো, জগু দোকানে আছে কি না, থাকলে একবার আসতে বল।

যুবক একজন কর্মচারীকে পাঠাল জগদীশবাবুর সন্ধানে।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, তোমার নামটা জানা হল না ভাই।

সুদীপ। যুবক বলল।

রামদা বললেন, পুরো নাম বলতে হয়।

সুদীপ চৌধুরী, বলে যুবক আর একজন খদ্দেরকে ওষুধ দিতে গেল।

আপনার ছেলেটি বেশ ভদ্র, চটপটে।

লেট ম্যারেজ আমার। ঠিক সময়ে বিয়ে হলে ওই বয়সের নাতি হওয়াই উচিত ছিল। চোখ বন্ধ করলেন বৃদ্ধ, বুঝলেন, এখন চোখ বন্ধ করে থাকতেই ভাল লাগে। কেন জানেন? চোখ বন্ধ করলে সারাজীবনে যত ঘটনা ঘটেছিল তা সিনেমার মতো দেখতে পাই। তখন তো প্রায়ই রূপশ্রী নয় আলোছায়াতে নাইট শো দেখতে যেতাম। যেসব শিল্পীরা অভিনয় করতেন তাঁদের প্রায় সবাই চলে গেছেন। এই যে শহর, বীরেন ঘোষ, এস পি রায়, চারু সান্যাল কী দারুণ জীবন্ত মানুষ ছিলেন। আজ তারা নেই। কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই তাদের দেখতে পাই। কেন পাই?

রামদা হাসিহাসি মুখ করে তাকালেন।

আপনার মুখেই শুনি! অনিমেষ বলল।

কারণ এখন আমার চোখে আগামীকালের কোনও স্বপ্ন নেই। আগামী বছর দূরের কথা, আগামী সপ্তাহে কোথাও যাব, কিছু করব, তা ভাবতেই পারি না। তাই যেদিন চলে গিয়েছে তার স্মৃতিতে ডুবে থাকি। বৃদ্ধের কথা শেষ হতেই সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, আর একটু চা বলি কাকা?

অনিমেষ মাথা নেড়ে না বলল।

সুদীপ বলল, বহুদিন পরে বাবাকে এত কথা বলতে শুনছি। বাড়িতে তো কথাই বলতে চান না আজকাল। আপনাকে দেখে–!

রামদা হাসলেন, ওর নাম যেই তুই টেলিফোনে বললি অমনি আমি পুরনো দিনে চলে গেলাম। বুকের ভেতর কেমন করে উঠল। আমার তখন পঁচিশ কি ছাব্বিশ, উনি এসে ভেতরে বসতেন, চা খেতেন, সিগারেট খেতে হলে পেছনের স্টোর রুমে যেতেন। তখন ওঁর কত বয়স, ষোলো কি সতেরো।

অনিমেষ প্রতিবাদ করল, না রামদা, অত কম বয়সে সিগারেট খেতাম না। খেলে বন্ধুদের সঙ্গে তিস্তার চরে, কাশবনের মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে একটা সিগারেট চারজন মিলে টানতাম।

আহা সতেরো না হোক, কুড়ি। খেতেন তো!

সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, তখনও কি ধূমপানের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল? দোকানে বসে খাওয়া যাবে না তাই স্টোর রুমে যেতেন?

দূর! এখানে বসে খাবেন কী করে? মামা কাকা জ্যাঠারা আসছেন ওষুধ কিনতে। তারা দেখতে পাবেন না? তখন বড়দের সামনে সিগারেট খাওয়ার কথা ভাবা যেত না। যদিও আমি ওঁর চেয়ে বয়সে বড় কিন্তু আপত্তি করিনি। বৃদ্ধ হাসলেন।

এই শহরে আপনার অনেক আত্মীয় বুঝি?

অনিমেষ মাথা নাড়ল, একমাত্র ঠাকুরদা ছাড়া এই শহরে আমার কোনও বয়স্ক আত্মীয় ছিলেন না। কিন্তু তখন যে-কোনও বয়স্ক মানুষকে আমরা মামা-কাকা-জ্যাঠা বলেই ভাবতাম। তাদের সামনে সিগারেট খেতাম না।

আপনি দোকানে এসেছেন শুনে খুব ভাল লাগল দাদা। বলতে বলতে এক প্রৌঢ় এসে ভেতরে ঢুকলেন। ভদ্রলোকের পরনে হ্যান্ডলুমের পাঞ্জাবি এবং ধুতি, মুখে দুদিন না কামানো দাড়ি।

এসো জগু। বসো। মন চাইলেও শরীর নড়ে না ভাই। এই ইনি এসেছেন। শুনে কোনওরকমে শরীরটাকে বয়ে নিয়ে এলাম। রামদা বললেন।

বলুন, কী ব্যাপার? জগদীশবাবু বললেন।

আমার নাম অনিমেষ মিত্র। হাকিমপাড়ার বাঁধের কাছে বাড়ি। কলকাতায় থাকি। ওই বাড়িতে যারা থাকতেন তারা একে একে চলে গেছেন, একজন ছাড়া। তাই বাড়িটাকে বিক্রি করে দিতে চাই। অনিমেষ বলল।

কোন বাড়িটা বলুন তো? জগদীশবাবু চোখ বন্ধ করলেন।

অনিমেষ বাড়ির লোকেশন বুঝিয়ে দিতে চোখ খুললেন ভদ্রলোক, বেশ বড় বাড়ি। আপনার ঠাকুরদা কি সরিশেখর মিত্র?

হ্যাঁ।

তাকে ছেলেবেলায় দেখেছি। কিন্তু বাড়ি বিক্রি করার আগে আপনাকে কয়েকটা সমস্যার সমাধান করে নিতে হবে।

বলুন।

দাদার সামনে বলতে খারাপ লাগছে। কিন্তু এখন যা নিয়ম তা না মেনে উপায় কী! প্রথমে আপনাকে আপনার পাড়ার সিপিএমের কাউন্সিলারের কাছে গিয়ে তাকে তুষ্ট করে অনুমতি নিতে হবে। আপনাদের পাড়ায় সিপিএমের ছেলেদের যে ক্লাব আছে তাদের সঙ্গে কথা বলুন। ওদের আপত্তি না থাকলে আমি সাতদিনে বাড়ি বিক্রি করে দিতে পারব। জগদীশবাবু হাত কচলাচ্ছিলেন কথা বলতে বলতে।

.

১০.

অনিমেষ রামদার দিকে তাকাল। আবার চোখ বন্ধ হয়ে গেছে বৃদ্ধের। সে জগদীশবাবুকে বলল, এখন এখানে এই নিয়ম চলছে?

এখানে? ও দাদা, শুনছেন? গলা তুললেন জগদীশবাবু।

চোখ খুললেন রামদা, সব কানে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ দেখে ভাববেন না যে কান ঘুমাচ্ছে। ওই আপনাদের কলকাতাকে বাদ দিলে গোটা বাংলায় নাকি এই নিয়ম এখন চালু হয়েছে।

জগদীশবাবু বললেন, নাকি নয়। এটাই ঘটনা!

আমি যদি আমার বাড়ি নিজের ইচ্ছেমতো বিক্রি করতে চাই ওরা কী করতে পারে?

বিক্রি করবেন কার কাছে? কেউ কিনবে না।

কেন?

আগে অনুমতি নিলে আপনাকে যতটা প্রণামী দিতে হত তা না দিলে যিনি কিনবেন তাকে ওই প্রণামী দিতে হবে। তা আপনার করা অন্যায়ের শাস্তি তিনি ভোগ করবেন কেন বলুন? জগদীশবাবু জানবেন।

এটা তো ভয়ংকর ব্যাপার। কলকাতায় বসে আমরা তো এসব খবর পাই না। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ওরা কেড়ে নিয়েছে?

কিছু মনে করবেন না, আপনার কথা শুনে অল্পবয়সে পড়া একটা গল্পের কথা মনে হল। নাম ভুলে গিয়েছি। সেই যে একটা লোক ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম যখন ভাঙল তখন বহু বছর কেটে গিয়েছে। লোকটা কিছুই চিনতে পারছে না। তাই জিজ্ঞাসা করছি, এতদিন কি আপনি ঘুমাচ্ছিলেন? জগদীশবাবু জিজ্ঞাসা করলেন।

হ্যাঁ, আমার জানা উচিত ছিল। পাড়ায় ওদের দাদাগিরি দেখেছি। ভেবেছি ক্ষমতায় দীর্ঘদিন থাকলে যেসব অন্যায় অভ্যেস তৈরি হয়ে যায় এটাও তেমনি। মার্কসবাদ আমার পড়া আছে। এখন মার্কসবাদীরা যা করছে তা জানলে উনি কবরেও কেঁপে উঠতেন। কিন্তু ক্ষমতা হাতে থাকায় ওরা এই পর্যায়ে চলে যাবে তা কল্পনা করিনি। আচ্ছা, মানুষ, পাড়ার মানুষ এক হয়ে আপত্তি করলে তো ওরা এত সাহস পেত না। অনিমেষ তাকাল।

মানুষ? কখনও দেখেছেন জল ঢালুর দিকে না গড়িয়ে ওপরে উঠছে? দুটো কারণে মানুষ মুখ খুলবে না। এক, ভয়ে। প্রতিবাদ করলে পাড়াছাড়া হতে হবে। মারধর তো বটেই, প্রাণও যেতে পারে। দুই, লোভ। প্রতিবাদ না করলে ছিটেফোঁটা হলেও চাইলে কিছু পাওয়া যেতে পারে। জগদীশবাবু ঘড়ি দেখলেন, এবার আমাকে উঠতে হবে।

পুলিশও কি ঘুমিয়ে আছে?

অন্ধদের দেশে গেলে চোখ খুলে হাঁটতে খুব খারাপ লাগবে আপনার। তখন চোখে ব্যান্ডেজ বেঁধে নিলে বেশ স্বচ্ছন্দ বোধ করবেন। পুলিশের তাই অবস্থা। উঠে দাঁড়ালেন জগদীশবাবু, সরকারকে চটিয়ে তো দেশে থাকা যায় না। আপনার পাড়ার কাউন্সিলারের সঙ্গে আলাপ আছে?

তিনি কে, কী নাম, কিছুই জানি না। অনিমেষ গম্ভীর হল।

হরু সেন, এই নামেই সবাই চেনে। ভাল নাম, হরেন্দ্রনাথ সেন। চিনতে পারছেন?

একটু ভাবল অনিমেষ। না, স্মৃতিতেও ওই নামের কেউ উঁকি দিচ্ছে না।

চোখ খুললেন রামদা, আঃ জগু, তখন থেকে কেবলই এক কথা বলে যাচ্ছ! তোমার সঙ্গে তো লোকটার পরিচয় আছে। তুমিই অনিমেষবাবুকে সঙ্গে নিয়ে যাও। দেরি করার দরকার নেই। আজ বিকেলেই যাও।

জগদীশ হাসল, ঠিক আছে, আপনি বলছেন যখন, তখন যাব। তারপর অনিমেষের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার বাড়ি থেকে মিনিট পাঁচেকের দূরত্ব। আমি সন্ধে ছটা নাগাদ আপনাকে ডেকে নেব। তার আগে তো ওকে পাওয়া যাবে না। চলি। জগদীশবাবু বেরিয়ে গেলেন।

রামদা মাথা নাড়লেন, এখন যে পুজোর যা মন্ত্র না আউড়ে উপায় নেই। কথা বলে দরাদরি করা ছাড়া তো কোনও উপায় নেই।

.

রিকশায় চেপে বাড়ি ফিরছিল অনিমেষ। বেশ বেলা হয়ে গিয়েছে। রাস্তায় লোকজন এখন কম। রূপশ্রী সিনেমাহলের সামনে দিয়ে আসার সময় মনে হল, এখন কোনও ছবি দেখানো হচ্ছে না। গেট বন্ধ, কী ব্যাপার কে জানে! বাঁ দিকে রুচি বোর্ডিং-এর গলি, ডানদিকে যোগমায়া কালীবাড়ি। চোখ বন্ধ করলেও সে এইসব রাস্তার ম্যাপ এঁকে দিতে পারে।

রামদার শরীরের অবস্থা দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। রিকশায় ওঠার আগে রামদা হাত ধরে বলেছিলেন, যে কটা দিন এখানে আছেন, একটু খোঁজখবর নেবেন। এরপরে তো আর দেখা হবে না।

অন্য কেউ হলে প্রতিবাদকরত অনিমেষ, আজ পারেনি। মানুষটার অর্ধেকটা যেন পৃথিবীতে নেই। স্মৃতিগুলো যেন আচমকা নিজেদের মধ্যে মারপিট শুরু করে দিল। থানার সামনে রিকশা দাঁড় করিয়ে অনিমেষ রিকশাওয়ালাকে বলল, ওই দোকান থেকে সিগারেট কিনে এনে দেবে ভাই?

কী সিগারেট?

ফিল্টার উইলস। বলেই খেয়াল হল, প্যাকেট নয়, তুমি একটা নিয়ে এসো, সঙ্গে দেশলাই। টাকা নিয়ে চলে গেল রিকশাওয়ালা। বেশ কিছুদিন সে সিগারেট খাওয়া বন্ধ করেছে। বলা যেতে পারে মাধবীলতা তাকে বাধ্য করেছে। একেবারে পুঁদে গোয়েন্দার মতো পেছনে লেগে থাকত, টিকটিক করত। শেষে ধুত্তোরি বলে খাওয়া বন্ধ করেছিল সে। আজ যদি প্যাকেট নিয়ে বাড়িতে ফেরে তা হলে আর রক্ষা থাকবে না। কিন্তু অনিমেষের মনে হচ্ছিল, এসবের থেকে বেরিয়ে আসতে তার সিগারেট খাওয়া প্রয়োজন। এটা মাধবীলতা বুঝবে না। রিকশাওয়ালা সিগারেট, দেশলাই এবং ফিরতি পয়সা ফেরত দিল। সিগারেট ধরিয়ে দেশলাইটা রিকশাওয়ালাকে দিয়ে দিল সে, এটা তুমিই রাখো। আর হ্যাঁ, যতটা পারো আস্তে রিকশা চালাও।

বাবু আস্তে চালালে আমার রোজগার কমে যাবে। পুষিয়ে দেবেন তো?

রিকশাওয়ালার কথা শুনে হাঁ হয়ে গেল অনিমেষ। সদ্য টানা ধোঁয়া গলায় আটকে গেল। খক খক করে কাশতে কাশতে অনিমেষ ইশারা করল জোরে চালাতে।

.

দুপুরের খাওয়ার সময় ছোটমা ছিলেন না। প্রশ্ন করতে মাধবীলতা তথ্য দিল, উনি এখনও পুজোর ঘরে।

সেকী! খাবেন না?

বললেন, তোমরা খেয়ে নাও।

পিসিমার পথে হাঁটছেন নাকি! তিনি দুপুরের খাবার খেতেন বিকেল সাড়ে তিনটের সময়। ফলে অ্যাসিড হত, বলতেন অম্বল হয়ে গেছে। তাই রাত্রে একটু মুড়ি ছাড়া কিছু খাওয়ার ইচ্ছে হত না। অনিমেষ বলল।

এত রোগা কেন হয়ে যাচ্ছেন তা তো বোঝাই যাচ্ছে। মাধবীলতা গম্ভীর।

পয়সা বাঁচানোর জন্যে এটা করছেন না তো?

মাধবীলতা মাথা নাড়ল, জানি না। এ কথা তো জিজ্ঞাসা করা যায় না।

একটা কিছু করা দরকার।

পথ তো একটাই। এই বাড়ি বিক্রি করে ওঁকে একটা ভাল জায়গায় রাখার ব্যবস্থা করা। তোমাকে সেটাই করতে হবে। মাধবীলতা বলল।

অসম্ভব। জোর গলায় বলল অনিমেষ।

তার মানে? মাধবীলতা অবাক।

অনিমেষ জগদীশবাবুর বলা কথাগুলো মাধবীলতাকে জানাল। বলল, আমার পক্ষে বেআইনি কাজ করা সম্ভব নয়।

বেআইনি মানে?

আমার বাড়ি আমি বিক্রি করতে পারব না। তার জন্যে সিপিএমের কাউন্সিলারের অনুমতি নিতে হবে। তাদের ক্যাডারদের ক্লাবে গিয়ে হাতজোড় করতে হবে। কেন? আমার বাড়ি তো তাদের সম্পত্তি নয়। অনিমেষ উত্তেজিত।

ওদের কাছে না গিয়ে সরাসরি বিক্রি করার চেষ্টা করো।

শুনলাম কেউ কিনতে চাইবে না। সবাই জানতে চাইবে অনুমতি নিয়েছি কিনা। আমরা যখন রাজনীতি করতাম তখন কোনও বামপন্থী পার্টি এসব করার কথা চিন্তাও করত না। এমন ভয়ংকর পরিবর্তন মানুষ বেশিদিন মেনে নিতে পারে না।

মাধবীলতা বলল, একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না। এখন কি কলকাতার জন্যে এক নিয়ম আর বাকি পশ্চিমবঙ্গে অন্য নিয়ম চলছে। এই তো, আমার সঙ্গে কাজ করতেন শীলাদি, বাগবাজারের বাড়ি বিক্রি করে ছেলের কাছে থাকতে দিল্লি চলে গেলেন। কই, তাকে তো কারও কাছে অনুমতি নিতে হয়নি। তুমি যা শুনেছ তা সত্যি নাও হতে পারে। তোমাদের এই পাড়ায় যিনি কাউন্সিলার তাঁকে চেনো?

না। লোকটা কে তাই জানি না।

একবার যাও না ওঁর কাছে।

কোনও দরকার নেই। থাক পড়ে বাড়ি। ছোটমাকে রাজি করাও কলকাতায় গিয়ে আমাদের সঙ্গে থাকতে। অনিমেষ বলল।

আশ্চর্য! আমাদের তো দুটো ঘর। উনি কোথায় থাকবেন? ওঁর ঠাকুর কোন ঘরে থাকবেন? অন্তত চার ঘরের ফ্ল্যাট দরকার। কত ভাড়া জানো?

বিকেল চারটে নাগাদ লছমনের গলা শোনা গেল, বাবু!

শুয়ে ছিল অনিমেষ। ক্র্যাচ নিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এলে লছমন বলল, একবার দেখে নিন বাবু। যদি বলেন নীচের ঘাসগুলো কাল এসে তুলে দিয়ে যেতে পারি।

অনিমেষ বাগানটার দিকে তাকাল। একমাথা ঝাকড়া চুলের কোনও মানুষকে কদমছাঁট দিলে যেমন দেখাবে বাগানটাকে তেমনই দেখাচ্ছে। বুনো ঝোঁপ পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে, কিছু গাছের বাড়তি ডাল কেটে ফেলেছে লছমন। ওদিকে যে দুটো নারকোল গাছ প্রায় আড়ালে পড়ে গিয়েছিল তারাও অনেক নারকোল নিয়ে দৃশ্যমান। সুপুরি গাছগুলো এখন ছিমছাম।

ফুলের গাছগুলো কেটে ফেলোনি তো?

না বাবু। মাসিমা মেরে ফেলবেন। লছমন হাসল।

বাগানে নেমে এল অনিমেষ। এত অল্পসময়ে এই দুজন যে কাজ করেছে তা সত্যি প্রশংসনীয়। নীচের ঘাসগুলো তুলে ফেললে দেখতে হয়তো ভাল লাগবে কিন্তু বৃষ্টি পড়লেই কাদা হয়ে যাবে।

লছমন বলল, শেয়ালটা বাচ্চাদের সরিয়ে নিয়ে ওই ওধারে গেছে।

যেদিকটা হাত দিয়ে লছমন দেখাল সেদিকটা বাড়ির পিছন দিকে। বেশ ঝোঁপ রয়েছে।

অনিমেষ বলল, বাঃ, ভাল হয়েছে।

কিন্তু দেখবেন, রাত্রে ও বাচ্চাদের এখানে নিয়ে আসবে।

কী করে বুঝলে?

মাসিমা যে সন্ধের সময় ওকে খেতে দেয়।

বড়পিসিমার কথা মনে পড়ে গেল। একজন চলে গিয়েছেন, অন্যজন তার অভ্যেসগুলো রপ্ত করেছেন।

লছমন এগিয়ে গিয়েছিল তারের বেড়ার কাছে, বাবু, দেখুন।

অনিমেষ কাছে পৌঁছে দেখতে পেল গোটা চারেক কালো রঙের বড় সাপ, সঙ্গে অনেকগুলো বাচ্চার মৃত শরীর পড়ে আছে। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কী করে ওদের মারলে?

আমি মারিনি, ও মেরেছে। দুরে দাঁড়ানো তরুণকে দেখাল।

বাব্বা! দারুণ সাহস তো, এসব খুব বিষধর সাপ। খুব ঝুঁকি নিয়েছে ও। কামড়ালে বাঁচানো খুব কষ্টকর হত। অনিমেষ বলল।

লছমন হাসল, ও এর আগেও সাপ মেরেছে। বাগানে আর সাপ নেই। আপনারা নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন।

হঠাৎ অনিমেষের মনে হল লছমন বলতে পারে। সে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা লছমন, তোমাদের এই পাড়ার কাউন্সিলার কে জানো?

হ্যাঁ। ভোম্বলবাবু।

কোথায় থাকেন?

জেলা স্কুলের পেছনের রাস্তায়।

ভোম্বল তো কারও ভাল নাম হতে পারে না। আসল নাম কী?

তা জানি না। ছেলেবেলা থেকে শুনেই লোকে ওঁকে ওই নামে ডাকে। টাউন ক্লাবে ফুটবল খেলতেন ওঁর দাদা। তার নাম ছিল কমল।

কমল? অনিমেষের মনে পড়ল সে যখন স্কুলে পড়ত তখন টাউন ক্লাবে ব্যাক খেলত কমল নামে এক তরুণ যার বাড়ি ছিল সেনপাড়ায়।

লছমন বলল, বাবু, কাজ তো হয়ে গেছে, যদি আমাদের ছেড়ে দেন।

দাঁড়াও।

মাধবীলতার কাছ থেকে টাকা এনে লছমনকে দিল অনিমেষ। তারপর বলল, তুমি যদি আজ রিকশা বের করে তা হলে একবার এসো তো!

আপনি কোথাও যাবেন?

হ্যাঁ। ওই ভোম্বলবাবুর কাছে যেতে হবে।

ঠিক আছে। আমি পনেরো মিনিটের মধ্যে নিয়ে আসছি। সঙ্গে নিয়ে আসা সরঞ্জাম নিয়ে লছমন আর তরুণ চলে গেল।

মাধবীলতা দাঁড়িয়ে ছিল বারান্দায়। ছোটমা বেরিয়ে এলেন। মুখে আঁচল চাপা। অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে?

কিছু না। আঁচল না সরিয়ে বললেন ছোটমা, মাঝে মাঝে দাঁতে ব্যথা হয়।

ডাক্তার কী বলছে?

দূর! ছোটমা আবার তার ঘরে চলে গেলেন।

অনিমেষ মাধবীলতাকে বলল, বোঝো!

মাধবীলতা কথা ঘোরাল, তুমি তা হলে কাউন্সিলারের কাছে যাচ্ছ। মাথা ঠান্ডা রেখে কথা বলবে। যদি চাও তা হলে আমি সঙ্গে যেতে পারি।

না, আমি একাই যাই। গিয়ে শুনি কী বলেন তিনি!

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার