শেষপর্যন্ত অর্ক অলকাকে বলতে বাধ্য হল, মা ফিরে না আসা পর্যন্ত আপনি এই বাড়িতে এসে আমার সঙ্গে কথা বলবেন না।

কেন? চোখের কোণে তাকাল অলকা।

আপনি বুঝেও প্রশ্ন করছেন? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে অলকা যখন হাসল তখন তার পেছনে বস্তির বালক-বালিকারা কৌতূহলী হয়ে দাঁড়িয়ে। অলকা মাথা নাড়ল, আমি শুনেছি আপনি নাকি একসময় এই বস্তির সব পরিবারকে বাঁচাবার জন্যে একসঙ্গে রান্না খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। সিপিএম পার্টি সেটা পছন্দ করেনি বলে শেষপর্যন্ত প্ল্যান ভেস্তে যায়। আপনাকে পুলিশ ধরেছিল বলে বস্তির অনেক মানুষ থানায় গিয়ে আপনার মুক্তির জন্যে ধর্না দিয়েছিল। সেই আপনি বস্তির একজন বউয়ের সঙ্গে প্রকাশ্যে কথা বলতে এত ভয় পাচ্ছেন?

না। আমি ভয় পাইনি। মানুষের মুখ কিছু একটা বানিয়ে গল্প তৈরি করতে উসখুস করে। আপনার নামে বদনাম ছড়াক আমি চাই না।

আমার কথা ভেবে বলছেন না নিজের কথা ভাবছেন?

ঠিক আছে। এটা নিয়ে ঝগড়া করে তো কোনও লাভ নেই। আমি আপনার মেয়ের কথা মাকে বলেছিলাম কিন্তু ডেফিনিট কিছু শুনিনি। অতদূরে থেকে ওঁর পক্ষে কিছু করা বোধহয় সম্ভব নয়। আপনি আপনার হাজব্যান্ডকে স্কুলে যেতে বলুন। ডাইরেক্ট অ্যাপ্রোচে কাজ হলেও হতে পারে। অর্ক বলল।

অলকা বলল, আপনার যদি মেয়ে থাকত তা হলে আপনি যেতেন?

নিশ্চয়ই। তাই তো স্বাভাবিক। অর্ক বলল।

অলকা মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল। তারপর বলল, আপনাকে একটা কথা বলা হয়নি। ওকে ওর অফিস মালদায় বদলি করে দিয়েছে। ওখানেই আছে। তবে প্রতিমাসে আমাদের যা দিলে কোনও অসুবিধে হয় তা ও পাঠায়।

উনি আসেন না?

প্রথম দুই মাসে এসেছিল। গতমাসে আসেনি। আমার যে ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট আছে সেই ব্যাঙ্কের মালদা ব্রাঞ্চে টাকা জমা দিলে আমি সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যাই। এবার অর্কর দিকে সরাসরি তাকাল অলকা, আপনি আমার সঙ্গে স্কুল যাবেন?

আমি? অর্ক অবাক।

নতুন স্কুলে যেতে বলছি না। ওখানকার টিচাররা হয়তো আপনাকে চিনতে পারবেন। মেয়ে যে স্কুলে এতদিন পড়ছিল তার হেডমিস্ট্রেসের কাছে গিয়ে অনুরোধ করবেন? আমার মেয়েটার কথা ভেবে বলুন, প্লিজ।

এখন গিয়ে কোনও লাভ হবে বলে মনে হয় না। আমি সিপিএমের সঙ্গে যুক্ত নই। উনি পাত্তাই দেবেন না।

আমাকে একটু মিথ্যে বলতে হবে। আমার স্বামী সঙ্গে থাকেন না, মেয়েকে নিয়ে আমি একাই থাকি শুনলে হয় তো…। থেমে গেল অলকা।

স্কুলের নাম কী?

অলকা নাম বললে অর্ক বলল, ঠিক আছে। আপনার মেয়ের জন্যেই আমি যাব। তাতে যদি শান্তি পান–দুপুর আড়াইটে নাগাদ ওই স্কুলে আসুন।

.

স্কুলের হেডমিস্ট্রেস খুব ব্যস্ত বলে আধঘণ্টা বসিয়ে রাখলেন। অলকা আর অর্ক অপেক্ষাঘরে বসে ছিল। আধঘণ্টা পরে দুজন মধ্যবয়সি মানুষ হেডমিস্ট্রেসের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। হেডমিস্ট্রেস তাদের এগিয়ে দিতে এসেছিলেন এক ভদ্রলোক বললেন, আপনাকে আসতে হবে না ম্যাডাম। যা বললাম তা মনে রাখবেন।

এক মিনিট প্লিজ–! হেডমিস্ট্রেস রোগা, লম্বা, গালভাঙা। ঘুরে দাঁড়িয়ে অর্কদের দিকে তাকিয়ে মহিলা বললেন, সরি ভাই। আজ আমি খুব ব্যস্ত আছি। আপনারা ফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে আসবেন। ঠিক আছে?

তখনই মধ্যবয়স্কদের একজনের নজর পড়ল অর্কদের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, আরে! অর্ক না? তুই তো একইরকম রয়েছিস। ভদ্রলোক এগিয়ে এলে অর্ক উঠে দাঁড়াল, অপূর্ব না?

ইয়েস। সেই অপূর্ব, যে স্কুলে তোর বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল।

হাত মেলাল ওরা। হেডমিস্ট্রেস জিজ্ঞাসা করলেন, বহুদিন পরে দেখা হল?

বহুত দিন। ওর নাম অর্ক মিত্র। অন্যরকম রাজনীতি করতে গিয়ে এক বছর নষ্ট করেছিল স্কুলে। অন্যরকম বলতে নকশাল বা মাওবাদী ভেবে নেবেন না। ও বস্তির সব মানুষকে এককাট্টা করে অভাবের সঙ্গে লড়াই করতে চেয়েছিল। এই দেশে তা সম্ভব নয় বোঝার পর বসে গেছে। অথচ ও যদি আমাদের সঙ্গে সক্রিয় রাজনীতিতে আসত তা হলে কত ওপরে উঠে যেত। তা তুই এখানে কেন?

অর্ক বলল, একটা বাচ্চার পড়াশোনার ব্যাপারে কথা বলতে এসেছিলাম।

অপূর্ব হেডমিস্ট্রেসকে বলল, আপনি দশ মিনিট অর্কর সঙ্গে কথা বললে খুব অসুবিধে হবে কি? আমি চাই ও আমাদের সঙ্গে আসুক।

হেডমিস্ট্রেস মাথা নাড়ল, আসুন আপনি।

অলকা উঠে দাঁড়াল কথাটা শুনে। অপূর্ব তার দিকে তাকিয়ে হাসল, নমস্কার। অনেকদিন দেখা হয়নি অর্কর সঙ্গে তাই আপনার খবরও পাইনি।

অলকা হাতজোড় করল।

অপূর্ব চলে যাওয়ার আগে বলল, আমি সেই পৈতৃক বাড়িতেই আছি। আসিস একদিন ওঁকে সঙ্গে নিয়ে।

অর্ক প্রতিবাদ করার আগেই অপূর্ব সঙ্গীকে নিয়ে চলে গেল। হেডমিস্ট্রেসের ঘরে বসার পর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার বলুন। অলকার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার মেয়েকে নিয়ে সমস্যা হয়েছিল তাই না!

অলকা পুরো ঘটনাটা হেডমিস্ট্রেসকে মনে করিয়ে দিলে তিনি বললেন, কী অদ্ভুত ব্যাপার। অর্কবাবু, আমরা শুনেছিলাম আপনি প্রথমে কংগ্রেস করতেন এখন তৃণমূলে গিয়েছেন। আপনাদের এলাকার পার্টির লোকাল কমিটি থেকেও অন্যরকম কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু অপূর্ববাবু যা বললেন তাতে বুঝতে পারছি বিরাট ভুল হয়ে গেছে।

অর্ক মনস্থির করে নিল। এরা সবাই তাকে অলকার স্বামী বলে ধরে নিয়েছে। সেটা চালিয়ে গেলে হয়তো অলকার মেয়েটা এই স্কুলে ফিরে আসতে পারবে কিন্তু। সে মাথা নাড়ল, না, যা সত্যি তাই বলাই উচিত।

অর্ক বলল, ম্যাডাম, আমার নাম অর্ক মিত্র। ইনি অলকা, আমার প্রতিবেশী, মেয়েটা ওঁর মেয়ে। আমি বুঝতে পারছি না ভিন্ন রাজনৈতিক দল করার জন্যে আপনারা ওঁর স্বামীকে অপছন্দ করতে পারেন কিন্তু বাচ্চা মেয়েটি তো কোনও অন্যায় করেনি। ও কেন শাস্তি পেল।

আচ্ছা, উনি আপনার স্ত্রী নন?

আমি অবিবাহিত। হেডমিস্ট্রেসের ঠোঁটে হাসি ফুটল, আপনারা প্রতিবেশী?

অর্ক বলল, হ্যাঁ।

হেডমিস্ট্রেস বললেন, তা তিনি এলেন না কেন? মেয়েটির বাবা?

এবার অলকা কথা বলল, উনি আর আমাদের সঙ্গে থাকেন না।

সে কী? কেন?

জানি না। ট্রান্সফার নিয়ে মালদায় চলে গেছেন।

অদ্ভুত। কী দায়িত্ববোধ! ডিভোর্সের কথা ভাবছেন?

নিজের পায়ে দাঁড়াতে একটু সময় লাগবে, তারপর– অলকা বলল।

হেডমিস্ট্রেস একটু ভাবলেন, অর্কবাবু, ওঁর স্বামী লোকজনদের সঙ্গে নিয়ে আমাকে ঘেরাও করে অনৈতিক দাবি আদায় করা চেষ্টা করেছিল বলে গভর্নিং বডি এই স্টেপ নিয়েছে। কিন্তু লোকটার সঙ্গে এর যখন কোনও সম্পর্ক নেই। তখন বিষয়টা নতুন করে ভাবতে হবে। গভর্নিং বডিতে অপূর্ববাবু আছেন। ওঁর সঙ্গে আপনার যে সম্পর্ক দেখলাম তাতে মেয়েটিকে আবার নিয়ে নিতে অসুবিধে হবে বলে মনে হচ্ছে না। আপনার নাম কী?

অলকা।

আপনি কালই মেয়ের জন্যে দরখাস্ত দেবেন। তাতে লিখবেন মেয়ের বাবার সঙ্গে আপনার কোনও সম্পর্ক নেই। দেখুন গিয়ে, লোকটা মালদায় নতুন করে সংসার পেতেছে কিনা। এটা দরখাস্তে লিখবেন না। ওটা কাল পেলে বিকেলে গভর্নিং বডির সভায় অনুমোদন করিয়ে নেব। অর্কবাবু, আপনার সঙ্গে আলাপ করে ভাল লাগল। মাঝে মাঝে এলে আরও খুশি হব। হেডমিস্ট্রেস হাতজোড় করলেন।

বাইরে বেরিয়ে এসে অর্ক অলকাকে বলল, আপনার সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। সকালে এসে দরখাস্ত জমা দিয়ে যাবেন।

যদি হয় আপনার জন্যে হবে। অলকা বলল।

বেশ তো, একদিন খাইয়ে দেবেন।

কী খাবেন? যা চান তাই পাবেন। অলকা হাসল।

অর্ক কথা না বলে বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াল। অলকা বলল, হেডমিস্ট্রেস আপনাকে বললেন মাঝে মাঝে দেখা করলে খুশি হবেন। উনি কিন্তু সত্যিকারের ডিভোর্সি। বুঝে সুঝে যাবেন।

অর্ক হাসল। অলকা জিজ্ঞাসা করল, আপনার মোবাইলের নাম্বারটা বলবেন?

অর্ক তাকাল। অলকা হাসল, আপনার বাড়িতে যেতে নিষেধ করেছেন, খুব দরকার হলে ফোনে তো কথা বলতে পারি!

মাথা নেড়ে অর্ক নিজের নাম্বারটা জানাল। অলকা বলল, আমাকে একটু বউবাজারে যেতে হবে। বাস আসছে। অলকা এগিয়ে গেল। ওপরে উঠে হাত নাড়ল।

অলকাকে বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল অর্কর। বেশি হাসে, মনে হবে একটু গায়েপড়া, কিন্তু বোঝা যায়, এই ব্যাপারটা বানানো নয়। এটা ওর ভেতর থেকেই আপনিই তৈরি হয়। কিন্তু মেয়ের প্রয়োজনে স্বামী সম্পর্কে ও হেডমিস্ট্রেসকে যা বলল তা আগে বলেনি। চটজলদি ওখানে অভিনয় করল, না তাকে যা বলতে পারেনি সেই সত্যি কথাটা বলে ফেলল?

মাথা নাড়ল অর্ক, এসব ভেবে তার কী লাভ! মোবাইলটা জানান দিতে সে পকেট থেকে ওটা বের করে অন করল। দাদা, আমি শ্রীরাম বলছি।

অর্ক খুশি হল, বলুন রামজি। কী খবর?

খবর ভাল না। আমি এখন ধরমতলায়।

ধরমতলা মানে? আপনি তো বাসে চেপে–।

ফোনে সব বলা যাবে না। আপনি কি বাসায় আছেন? তা হলে আমি আপনার ওখানে যাচ্ছি। রামজি বলল।

আপনি ঠিক কোন জায়গায় আছেন?

একটা সিনেমা হলের সামনে। মেট্রো। মেট্রো হল।

ওখানেই থাকুন। আমি আসছি।

লাইন কেটে দিয়ে অর্ক তাকাল। এসপ্ল্যানেডে যাওয়ার বাস আসছে। দ্রুত উঠে পড়ল সে। খুব ভিড়। কোনওমতে দাঁড়াবার জায়গা পেতেই কানে কথা ভেসে এল। নন্দীগ্রামে ঢোকার সব রাস্তা কেটে দিয়েছে গ্রামের লোক। দূর মশাই! গ্রামের কৃষকরা এতটা অর্গানাইজড হতে পারে নাকি। পেছনে কোনও পার্টি কাজ করছে। আচ্ছা, এই যে কাগজে পড়লাম, কাউকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না, বেরুচ্ছে না, এরকম কদিন চলতে পারে? খাবারদাবার তো একসময় ফুরিয়ে যাবে। তখন? মরিয়া হয়ে করছে। অত্যাচার সহ্য করতে করতে পিঠ ঠেকে গিয়েছে দেওয়ালে, এখন বাঁচার জন্যে মরিয়া হয়ে গেছে মানুষ। যাই বলুন, ওদের হাতে আমস আছে নিশ্চয়ই। আপনি কি পাগল? গ্রামের সাধারণ মানুষ আর্মস কোথায় পাবে? যারা পায় তারা ওদের মদত দিচ্ছে। সবাইকে ছাপিয়ে একটা গলা সোচ্চার হল, মুশকিল কী জানেন, আপনারা কল্পনাও করতে পারছেন না, নন্দীগ্রাম একটা বিপ্লবের জন্ম দিচ্ছে।

অর্ক চোখ বন্ধ করল। তারপর চট করে তার পকেটে ঢোকা আঙুলগুলো ধরে বলল, এক সেকেন্ডের মধ্যে নেমে যাও। নইলে প্যাদানি খাবে।

বলমাত্র ছেলেটি ছিটকে চলে গেল বাসের পাদানিতে। তারপর বাসের গতি কমতেই লাফিয়ে নেমে গেল রাস্তায়। পাশের ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, কী হল?

অর্ক মাথা নাড়ল, কিছু না।

মেট্রো সিনেমার সামনে এখন পাতলা ভিড় কিন্তু সেখানে রামজিকে দেখতে পেল না অর্ক। লোকটা কলকাতার রাস্তাঘাট না চিনলেও নিজেই বলেছিল মেট্রো সিনেমার সামনে তখন ছিল। প্রায় মিনিট কুড়ি অপেক্ষা করার পর সে যখন ধর্মতলা স্ট্রিটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তখন রামজির গলা কানে এল, দাদা!

অর্ক মুখ ঘুরিয়ে দেখল, ফুটপাথের অর্ধেকটা জুড়ে স্টল বানিয়ে যে দোকান করে বসেছে হকাররা তার আড়াল থেকে মুখ বের করে ডাকছে রামজি। সে অবাক হয়ে এগিয়ে গেল, কী ব্যাপার?

পেছনে লোক লেগেছে। আপনি চট করে ট্যাক্সি ডেকে আনুন। রামজি বলল।

যেন রামজিকে দেখেনি এমন ভান করে রাস্তায় নেমে ডানদিকে তাকাতেই একটা খালি ট্যাক্সি দেখতে পেয়ে সেটা দাঁড় করাতেই প্রশ্ন শুনল, কোথায় যাবেন?

খুব রাগ হয়ে গেল। এই দিনদুপুরেও লোকটা নিজের পছন্দমতো জায়গায় যেতে চাইছে। সে পেছনের দরজা খুলে বসে পড়ে বলল, নরকে।

মাথা নাড়ল লোকটা, কোন রাস্তায় যাব, বলে দেবেন।

আপাতত একটু এগিয়ে বাঁদিকের ফুটপাত ঘেঁষে দাঁড়ান। লোক উঠবে!

ট্যাক্সি দাঁড়াতেই রামজি তিরের মতো ছুটে এসে পেছনে বসে পড়ল। অর্ক বলল, সোজা চলুন।

ট্যাক্সি ড্রাইভার গাড়ি চালু করলে রামজি পেছন ফিরে বারংবার দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলল। অর্ক জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার?

না। বুঝতে পারেনি।

কী ব্যাপার বলুন তো?

রামজি ট্যাক্সি ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে কঁধ নাচাল। আকাডেমির সামনে পৌঁছে ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে ভিক্টোরিয়ার বাগানে রামজিকে নিয়ে ঢুকে পড়ল অর্ক। রামজি চারপাশে তাকিয়ে বলল, এখানে ঢুকলেন? বহুত খিদে পেয়েছে। কোনও দোকানে গিয়ে বসলে ভাল হত।

অতএব রাস্তা পেরিয়ে রবীন্দ্রসদনের পেছনের ক্যান্টিনে পৌঁছাল ওরা। খাওয়া হলে অর্কই দাম দিল। রামজি বলল, আমার জন্যে আপনার খরচ হয়ে যাচ্ছে।

অর্ক কোনও কথা না বলে নন্দনের পেছনে একটা নির্জন বেঞ্চিতে গিয়ে বসল। এখনই নন্দন চত্বরে অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের জমায়েত শুরু হয়ে গিয়েছে। রামজি কথা বলা শুরু করল।

দিঘায় বাস থেকে নেমে সে শ্রীনিবাসকে ফোন করেছিল। কিন্তু ওর ফোন সুইচ অফ করা ছিল। খোঁজ নিয়ে জেনেছিল রামজি, তালসারিতে যাওয়ার কোনও সরাসরি বাস নেই। আধঘণ্টা দুরের ওড়িশা সীমান্তে গিয়ে অটো ধরে যেতে হয়। সে বাসে চেপে সেখানে গিয়ে শেয়ারের অটোতে উঠেছিল। সমুদ্রের ধারে পৌঁছে বারংবার ফোন করেও সে শ্রীনিবাসকে ধরতে পারেনি। অথচ তাকে রামপ্রকাশ বলেছে হলদিয়ায় না গিয়ে আপাতত শ্রীনিবাসের কাছে ওই তালসারিতে থাকতে। সমুদ্রের ধারে যেসব হোগলার ছাউনি দেওয়া দোকান আছে তাদের একজনকে সে জিজ্ঞাসা করেছিল, শ্রীনিবাসকে চেনে কিনা! শ্রীনিবাস কোথায় থাকে। এই জিজ্ঞাসা করেই বিপদে পড়েছিল সে। লোকটা অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আর একজনকে নিচু গলায় কিছু বলেছিল। সেই লোকটা তার সামনে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনি শ্রীনিবাসের কেউ হন?

না। পরিচিত। উত্তর দিয়েছিল রামজি।

কী দরকার?

তেমন কিছু নয়। এমনি দেখা করব? কোথায় থাকে সে?

ওকে তো এখন পাবেন না। আপনি কোথায় উঠেছেন?

আমি ভেবেছিলাম ওর বাড়িতেই উঠব। এখনও–।

কোনও চিন্তা নেই। আপনি এই দোকানে বসুন। আমরা শ্রীনিবাসকে ডেকে নিয়ে আসছি। তাকে একটা দোকানের সামনে বালিতে পোঁতা বেঞ্চিতে বসিয়ে লোকদুটো দ্রুত চলে যেতেই দোকানদার হাসল, যাকে ডাকতে গেল সে এখন জেলের ভাত খাচ্ছে। যাকে বলেছিল সে একটা বাচ্চা ছেলে, দোকানের কাজ করে।

সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ভাই আমার খুব পায়খানা পেয়েছে।

যান না, ওপাশে সমুদ্রের ধারে আড়াল দেখে বসে পড়ুন।

দোকানদার বলমাত্র সে আর দাঁড়ায়নি। ব্যাগটা নিতে গেলে দোকানদার বলল, ওটা রেখে যান। চুরি যাবে না।

বাধ্য হয়ে ব্যাগ রেখে সে সমুদ্রের ধারে ছুটে গিয়েছিল। তারপর ঝাউবনের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে মাইল খানেক এসে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়েছিল। যখন রাত নামল তখন ঝাউবন ছেড়ে সমুদ্রের বালির ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দিঘার দিকে চলে এসেছিল ভোরের একটু আগে।

দিঘা থেকে বাস ধরতে গিয়ে বুঝতে পারল তার পেছনে লোক লেগেছে। বাস যখন চলছে তখন একজন গায়ে পড়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কোথায় যাবেন? সে বলেছিল, খঙ্গপুর। লোকটা হেসে বলেছিল, ভুল বাসে উঠেছেন। সে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু মেছেদাতে বাস থেকে নেমে চা খাওয়ার জন্যে অন্য যাত্রীদের সঙ্গে মিশে গিয়ে সে আড়ালে চলে গিয়েছিল। সেখান থেকে আর একটা বাস ধরে কলকাতায় নামতেই দেখতে পেল একজন তোক তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখছে। সে হাঁটতে শুরু করলেই লোকটা পেছন পেছন হাঁটছিল। কিছুতেই যখন ওকে কাটাতে পারা যাচ্ছিল না তখন সে লোকটার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। তাই দেখে লোকটা দ্রুত রাস্তা পেরিয়ে উলটোদিকে চলে যায়। তারপর সে অর্ককে ফোন করে।

কাহিনি শুনে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, শ্রীনিবাসের কথা জিজ্ঞাসা করেছেন বলে পুলিশ আপনাকে সন্দেহ করেছে বলে যদি মনে করেন তা হলে কলকাতা অবধি খবর চলে আসতে পারে কি?

আমি জানি না। মাথা নেড়েছিল রামজি।

কিন্তু রামজি, আপনার সম্পর্কে আমাদের ওখানেও খুব কৌতূহল তৈরি হয়েছে। আমার মনে হয় আপনার উচিত হলদিয়ায় রামপ্রকাশকে ফোন করা।

অর্কর কথা শুনে মোবাইল বের করল রামজি।

.

৩২.

কিছুক্ষণ শোনার চেষ্টা করে রামজি মাথা নাড়ল, আউট অব রেঞ্জ বলছে। অর্ক চারপাশে তাকাল, নন্দন চত্বর এখন অল্পবয়সিদের দখলে। দেশের কোথায় কী হচ্ছে তা নিয়ে যদি কারও মাথা ব্যথা হয়ে থাকে তা হলে এখানে বসে তর্ক করেই সেটা দূর হয়ে যাবে। অবশ্য ওই বিষয়ের চেয়ে পরনিন্দা অথবা আত্মপ্রচারেই ব্যস্ত থাকবে এরা। কী অসাড়ে এদের সময় কেটে যায়। রামজি বেশ হতাশ গলায় বলল, কী করা যায় বলুন তো!

অর্ক বলল, যদি পুলিশ সন্দেহ করে থাকে, আপনাকে অনুসরণ করে ধর্মতলা পর্যন্ত পৌঁছে যায় তা হলে বলব, কলকাতায় থাকা আপনার পক্ষে আদৌ নিরাপদ নয়। আপনি হাজারিবাগে ফিরে যেতে পারেন না?

অসম্ভব, ওখানে যে কজনের নাম ওয়ান্টেড লিস্টে আছে তাদের দেখলে পাবলিকই ধরিয়ে দেবে। রামজি বলল।

এই কথাটাই কদিন ধরে আমার মাথায় পাক খাচ্ছে। অর্ক বলল।

কী কথা?

আপনারা যে কাজটা করতে চাইছেন তা যদি পাবলিক পছন্দ না করে তা হলে সেটা কার জন্য করছেন? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

রামজি মাথা নাড়ল, মানুষের একটা বড় শত্রু হল তার অভ্যস্ত জীবন। সেই জীবন ভাল বা মন্দ যাই হোক না কেন সে তার মধ্যেই নির্লিপ্ত হয়ে পড়ে থাকতেই পছন্দ করে। আমাদের বাইরে যেতে তার খুব স্বস্তি হয় না। তেতো ওষুধ অনেকেই খেতে চায় না স্বাদের কারণে। কিন্তু আমরা বোঝাতে চাইছি, তেতো ওষুধ শরীরের রোগ সারায়। এই বোঝাটা যখন পাবলিক বুঝবে তখন আর তারা ভুল করবে না, আমাদের পেছনে এসে দাঁড়াবে।

পাশে না বলে পেছনে বললেন কেন?

কারণ জনতার চরিত্র হবে নেতৃত্ব দেওয়া নয়, পেছনে থেকে সমর্থন করা। যাক গে, আমি এখন কী করব। তালসারির সোর্স জেলে, হলদিয়ার ফোন আউট অব রিচ। উঃ! রামজি চোখ বন্ধ করল।

আচমকা অর্কর মনে পড়ে গেল। সে বলল, আমি একটা জায়গার কথা বলতে পারি, সেখানে গেলে কেউ আপনাকে সন্দেহ বোধহয় করবে না।

কোথায়? চোখ খুলল রামজি।

বীরভূমে।

জায়গাটা কোথায়? আমি নাম শুনিনি।

বীরভূম একটা জেলার নাম। সেখানে একজন সন্ন্যাসিনীর আশ্রম আছে। ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমার এবারই আলাপ হয়েছে, জলপাইগুড়ি থেকে ট্রেনে আসার সময়। সন্ন্যাসিনী হলেও বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। যেতে বলেছিলেন ওঁর আশ্রমে। আমি আপনাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি কীভাবে যেতে হবে! অর্ক বলল।

কতটা সময় লাগবে যেতে? রামজি দ্বিধা নিয়ে জিজ্ঞাসা করল।

এখান থেকে বড়জোর ঘণ্টা পাঁচেক।

রামজি বলল, আমার সামনে কোনও বিকল্প নেই। আপনি যখন ভরসা দিচ্ছেন তখন নিশ্চয়ই যাব। কিন্তু সন্ন্যাসিনী নিশ্চয়ই হিন্দু?

তার মানে? অর্ক হাসল।

খ্রিস্টানদের মধ্যেও সন্ন্যাসিনী রয়েছেন।

না না। ইনি হিন্দু। খ্রিস্টান সন্ন্যাসিনী হলে তো গির্জায় থাকতেন, আশ্রম তৈরি করতেন না। অর্ক বলল।

বুঝতে পারছি না, ম্যানেজ করতে পারব কিনা। রামজি বলল।

সমস্যা কী?

আমি তো হিন্দু ধর্মের অনেক কিছুই জানি না।

আমিও জানি নাকি? ঘুম থেকে উঠে আবার ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত কোনও ধর্মাচরণ কখনও করিনি। অর্ক বলল।

কিন্তু আপনি দেখেছেন আর আপনার রক্তেও নিশ্চয়ই কিছুটা আছে।

আপনার নেই কেন?

দাদা, আমি খ্রিস্টান। রামজি বলল।

হকচকিয়ে গেল অর্ক, কী বলছেন? আপনার নাম তো রামজি?

ঠিকই। আমাদের পূর্বপুরুষদের পাদরিরা খ্রিস্টান করে দিয়ে গিয়েছিল। গরিব মানুষগুলো কিছু পাওয়ার লোভে ধর্মান্তরিত হয়। কিন্তু তারা হিন্দু নাম ত্যাগ করেনি। এখন অনেক খ্রিস্টান ওখানে আছে যারা চার্চে যায় না, ছেলেমেয়ে হলে হিন্দু-খ্রিস্টান মিশিয়ে নাম রাখে। রামজি বলল।

অদ্ভুত ব্যাপার।

সেইজন্যই আমার অস্বস্তি হচ্ছে। আমি খ্রিস্টান জানলে ওঁরা যদি আশ্রমে থাকতে না দেন? রামজি বলল, একটা অনুরোধ করব। আপনি আমাকে নিয়ে ওখানে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ফিরে আসুন। তাতে আমার থাকাটা সহজ হবে।

কিন্তু আমার চাকরি? যা ছুটি নিয়েছিলাম তা আজই শেষ হয়ে যাচ্ছে। অস্বস্তিতে পড়ল অর্ক।

আমি আপনাকে সমস্যায় ফেলছি। কিন্তু অপরিচিত জায়গায় একা যেতে সাহস পাচ্ছি না। আপনি সঙ্গে থাকলে ভয় থাকবে না। রামজি আচমকা অর্কর হাত ধরল।

.

রাত্রে খাটে বসে মাধবীলতা আর অনিমেষ কথা বলছিল। একটু আগে মিস্টার রায়ের ফোন এসেছে। তিনি জানিয়েছেন ছোটমার সঙ্গে সম্পত্তি হস্তান্তরের সব কাগজপত্র তৈরি হয়ে গিয়েছে। সামনের শুক্রবারে ওঁকে নিয়ে কোর্টে গেলেই সমস্য মিটে যাবে। খবরটা পেয়ে ওরা খুশি হয়েছিল।

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, এবার কী করবে?

যা ভেবেছিলাম তাই করা উচিত।

তোমার কি মনে হচ্ছে বাড়ি বিক্রি করতে কোনও অসুবিধে হবে না?

সেটা স্বপ্নেন্দু দত্ত সামলাবেন। আমি আর ভাবতে পারছি না।

ঠিক তখনই বাইরে থেকে গলা ভেসে এল, অনিমেষবাবু, ও অনিমেষবাবু?

মাধবীলতা বলল, কেউ তোমাকে ডাকছে।

এত রাত্রে। ঘড়ির দিকে তাকাল অনিমেষ, রাত নটা।

ডাকটা আবার ভেসে এল।

অনিমেষ উঠল। ক্রাচ বগলে নিয়ে বারান্দায় আসতেই সে ভাড়াটে নিবারণবাবুর গলা শুনতে পেল, অনিমেষবাবু, ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি? এখানে কাউন্সিলার সাহেব এসেছেন।

সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় কণ্ঠ বলে উঠল, সাহেব টাহেব বলছেন কেন? বলুন, ভোম্বল এসেছে।

অনিমেষ বারান্দার শেষ প্রান্তের দরজা খুলে বাইরে আসতেই দেখতে পেল ওদের। নিবারণবাবু তো আছেনই, রয়েছেন কাউন্সিলার এবং আরও তিনজন তরুণ। সে জিজ্ঞাসা করল, বলুন?

কাউন্সিলার বললেন, এত রাত্রে আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত। কিন্তু এদের অনুরোধে না এসেও পারলাম না।

আমি জেগেই ছিলাম। কী হয়েছে?

আর বলবেন না, এদের ক্লাবের চারজন ছেলেকে পুলিশ অন্যায়ভাবে তুলে নিয়ে গিয়ে মারধর করেছে। জবাবে কেস সাজিয়েছে ওদের বিরুদ্ধে। ভদ্র ঘরের ছেলে ওরা। বাবা-মা কান্নাকাটি করছে খুব। বেশ বিমর্ষমুখে কাউন্সিলার খবরটা দিলেন।

অনিমেষ বলল, কিন্তু এ ব্যাপারে আমি কী করতে পারি?

না না, আপনাকে আমার সত্যি কিছু বলার নেই। ব্যাপারটা হল, যে চারটে ছেলেকে পুলিশ ধরেছে তারা ক্লাবের নেতা। আর ওই চারজনই আপনার আর নিবারণবাবুর সমস্যা মেটাতে এ বাড়িতে এসেছিল। কাউন্সিলার তরুণদের দিকে তাকালেন, কী, তাই তো?

ছেলেগুলো নীরবে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

আমি ব্যাপারটা বুঝতেই পারছি না। নিবারণবাবুর সঙ্গে আমার তো কোনও সমস্যা হয়নি। উনি যা চেয়েছেন তা আমি মেনে নিয়েছি। অনিমেষ নিবারণবাবুর দিকে তাকাল, কী নিবারণবাবু?

নিবারণবাবু এমনভাবে মাথা নাড়লেন তাতে হ্যাঁ বা না বোঝা গেল না।

কাউন্সিলার বললেন, দেখুন, আগেও বলেছি, পার্টির নির্দেশ আছে ভাড়াটে বাড়িওয়ালার সমস্যার মধ্যে না যেতে। তাই আমি আসিনি। কিন্তু–।

ওঁকে থামিয়ে দিল অনিমেষ, আবার বলছি, আমাদের সমস্যা ছিল না।

ওহো! আমি একটু অন্যভাবে বলি। আপনারা বাড়ি বিক্রি করে চলে যাবেন, এখানে থাকবেন না শুনে পাড়ার ক্লাব আপনাদের কাছে কিছু ডোনেশন চেয়েছিল। আপনারা দিতে রাজি হননি। খুব স্বাভাবিক। তা শুনে অল্পবয়সি ছেলেরা উত্তেজিত হয়ে কিছু কথা বলেছিল। এখনও ম্যাচিওরিটি আসেনি। প্র্যাকটিক্যাল সেন্সের তো অভাব হবেই। কয়েক মাসের মধ্যে এই কাজটা ছাড়া ওদের বিরুদ্ধে বলার মতো কোনও ঘটনা ঘটেনি। কাউন্সিলার অমায়িক হাসি হাসলেন।

দেখুন, ওদের কথা আমি নৃপেনদা এবং আপনাকে জানিয়েছিলাম। তারপর আর ওদের সঙ্গে কোনও ঝগড়া হয়নি। আপনার কি মনে হচ্ছে আমি পুলিশের কাছে ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছি? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

আমি কেন ভাবব? আপনার তো পুলিশের ওপর আস্থা থাকার কারণ নেই। ওরা যেভাবে আপনার পা ভেঙেছে, অত্যাচার করেছে তা তো আমরা জানি। কিন্তু এই ছেলেদের মনে হচ্ছে আপনি হয়তো রেগে গিয়ে নালিশ করলেও করতে পারেন। আমি অবশ্য বলেছি উনি এমন ভুল করতে পারেন না। পাড়ায় বাস করে কেউ পাড়ার ছেলেদের জেলে পাঠাবে? কাউন্সিলার বললেন।

অনিমেষ বলল, দেখুন, আমি যদি অভিযোগ জানাই, যার ভিত্তিতে পুলিশ ওদের ধরেছে তা হলে সেটা থানায় ডায়েরিতে রেকর্ড করা থাকবে। আপনি ওদের বলুন সেরকম কিছু ওখানে আছে কিনা?

মাথা নাড়লেন কাউন্সিলার, ঠিক এই কথাই ওদের বলেছিলাম। ওরা গিয়েছিল। না, আপনি কোনও ডায়রি করেননি।

তার পরেও আপনি ওদের নিয়ে এখানে এসেছেন? এখন কাউকে খুন বা রেপ করলে থানা ডায়েরি নিতে চায় না যদি দেখে অভিযুক্তের পেছনে আপনাদের পার্টি আছে। হাজার হাজার অভিযোগ পুলিশ ধামাচাপা দিয়েছে। আমি গিয়ে পুলিশকে বললাম আর পুলিশ সেটা নথিভুক্ত না করে ছেলেগুলোকে তুলে নিয়ে মারধর করল, এ কথা কোনও শিশু বিশ্বাস করবে? আমি কে? অনিমেষ বেশ উত্তেজিত হল।

কাউন্সিলার হাত নাড়লেন, আমি তো তাজ্জব হয়ে গেছি।

ওসিকে জিজ্ঞাসা করুন।

ডেকে পাঠিয়েছিলাম। অতীব ভালমানুষ। হাতজোড় করে বললেন, উনি কিছুই জানেন না। একদম অন্ধকারে আছেন।

উনি কি আমার কথা বলেছেন?

না। আপনাকে চেনেন না।

তা হলে? কাউন্সিলার ছেলেদের দিকে তাকালেন, শুনলে তো? তখনই বলেছিলাম অনিমেষবাবু এমন কাজ করতেই পারেন না? কী করে হল?

অনিমেষ বলল, আমিও অবাক হচ্ছি। পুলিশের কোন অফিসার এতটা সাহস দেখালেন? কোনও পুলিশ এসেছিল?

সন্ধেবেলায় ঘটেছে ঘটনাটা, খোঁজ পেয়ে যাব।

তারপরেই ভদ্রলোককে আপনারা সুন্দরবনে বদলি করবেন।

দেখুন, অন্যায় করলে শাস্তি পেতেই হবে। তবে যেই করুক, এসপি সাহেবকে না জানিয়ে করতে পারবে না।

ছেলেগুলোকে রেখেছে কোথায়? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

একটি তরুণ নিচুগলায় জবাব দিল, জানি না। মারতে মারতে পুলিশ গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়েছে ওদের।

অনিমেষ মাথা নাড়ল, আমাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করবেন?

কাউন্সিলার বললেন, বুঝতে পারছি আপনি এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। এরা আপনাকে ভুল বুঝেছে। একটা অনুরোধ করব?

বলুন। অনিমেষ তাকাল।

আপনি এই পাড়াতেই ছেলেবেলায় ছিলেন। এখনও আছেন। আর পাড়ার ছেলেরা বিপদে পড়েছে। মানছি, ওরা আপনার সঙ্গে একটু ঝামেলা করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ওরা ছেলেমানুষ বলে ক্ষমা করে দিন। হ্যাঁ, যা বলছিলাম, আপনি যদি আমাদের সঙ্গে এসপি সাহেবের বাংলোতে একবার যান তা হলে খুব ভাল হয়। কাউন্সিলার বললেন।

অনিমেষ অবাক হল, আমি গিয়ে কী করব?

দেখুন, পুলিশ যখন কাজটা করেছে আর ওসিকে না জানিয়ে করা হয়েছে। তখন ওপরতলা থেকে নির্দেশ এসেছে। সেই নির্দেশটি এসপি অবশ্যই জানেন। আপনি যদি এসপিকে অনুরোধ করেন ছেলেদের ছেড়ে দেওয়ার জন্যে তা হলে পাড়ায় সবাই খুব খুশি হবে। কাউন্সিলার বললেন।

আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। অনিমেষ বলল।

কেন?

এসপি কেন, কোনও ডিআইজি, আইজির সাহস হবে না পার্টির বিরুদ্ধে কাজ করার। কলকাতার কোনও মন্ত্রী ফোন করলে এসপি সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দেবেন ছেলেগুলোকে। অনিমেষ বলল।

ঘড়ি দেখলেন কাউন্সিলার, নাঃ, আজ অনেক রাত হয়ে গেছে। আমি আর একবার নৃপেনদার সঙ্গে কথা বলি। উনি কলকাতায় আছেন। যদি ওখান থেকেই কাজ হয়ে যায় তো ভাল নইলে কাল একবার দয়া করে যাবেন আমাদের সঙ্গে। এত রাত্রে আপনাকে বিরক্ত করলাম, কিছু মনে করবেন না। চলি নমস্কার। ছেলেগুলোকে নিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন কাউন্সিলার।

নিবারণবাবু এতক্ষণ চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলেন, ওঁরা গেট পেরিয়ে চলে যেতেই উৎফুল্ল হলেন, ওঃ আমার খুব আনন্দ হচ্ছে।

কেন?

এদের জমানায় পুলিশ এদেরকেই ধরে মেরেছে, তুলে নিয়ে গিয়েছে। এটা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না। কী হল বলুন তো? নিবারণবাবু গলা নামালেন, আপনি কি মুখ্যমন্ত্রীকে চিনতেন?

মানে?

একমাত্র মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দিলে ওপরতলার পুলিশ এই কাজ করতে পারে। চেনাজানা ছাড়া মুখ্যমন্ত্রী এই নির্দেশ দেবেন কেন?

অনিমেষ হাসল, নিবারণবাবু, অনেক রাত হয়ে গেছে। যান খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে পড়ুন। আসছি।

দরজা বন্ধ করে ফিরে দাঁড়াতেই মাধবীলতাকে দেখতে পেল অনিমেষ। সে জিজ্ঞাসা করল, সব শুনলে?

বিশ্বাস হচ্ছে না। মাধবীলতা নিচু স্বরে বলল।

এখনও এদেশে ব্যতিক্রমী মানুষ আছেন। অনিমেষ ঘরের দিকে এগোেল।

খাটে বসে মাধবীলতা বলল, ওরা তোমাকেই সন্দেহ করেছে।

হ্যাঁ। কিন্তু প্রকাশ পায়নি।

এর পরে কী হবে?

আমার মনে হয়, ভালমতো শিক্ষা দিয়ে ওদের ছেড়ে দেওয়া হবে।

শিক্ষা পেলে যদি এরা শোধরায়।

এর পরে ওই ক্লাবের ছেলেরা চুপচাপ থাকবে?

কিন্তু তুমি কি এসপির কাছে ওদের সঙ্গে যাবে?

এটা কাউন্সিলারের চালাকি। না, আমার পক্ষে যাওয়া অসম্ভব।

হ্যাঁ। যেয়ো না। গেলে ভদ্রলোক অবাক হয়ে যাবেন।

এসপি যে এতটা সাহসী হবেন ভাবতে পারিনি। সেদিন মনে হয়েছিল এসে কোনও লাভ হল না। সত্যি মানুষ চেনা সহজ নয়। কিন্তু লতা, আমার উচিত ফোন করে ওঁকে ধন্যবাদ জানানো। অনিমেষ বলল, মিস্টার রায়ের কাছে নম্বরটা পেতে পারি।

কাল সকালে কোরো। যাই খাবারের ব্যবস্থা করি।

ছোটমা খেয়েছেন?

আগে তো রাত্রে খেতেন না। এখন আটটা নাগাদ দই মুড়ি খাচ্ছেন। হয়তো শুয়ে পড়েছেন। মাধবীলতা উঠেই দাঁড়িয়ে গেল, আচ্ছা। অর্ক তো আর ফোন করল না।

দরকার নেই তাই করেনি। অনিমেষ বলল।

মাধবীলতা মোবাইল তুলে নাম্বার ডায়াল করল। বস্তুটাকে কানে চেপে শুনল, আউট অব রেঞ্জ। অবাক হয়ে বলল, গেল কোথায়? বলছে আউট অব রেঞ্জ।

সত্যি কথাই তো বলছে। কাল সকালে কোরো। অনিমেষ বলতেই দরজায় শব্দ হল। ফোন নামিয়ে মাধবীলতা ছোটমাকে দেখতে পেয়ে বলল, আসুন? কী ব্যাপার, আপনি এখনও ঘুমোননি?

না। কিছুতেই ঘুম আসছিল না। ছোটমা হাসলেন।

আপনি কিছু বলবেন? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

হ্যাঁ। অনেকদিন পরে, ঠিক কতদিন তা নিজেই জানি না, ওই আশ্রমে সারাদিন থেকে আমার খুব ভাল লেগেছে। দিদিরা আমাকে অনেক বার বলেছেন ওখানে যাওয়ার জন্য। আমি মাঝে মাঝে যেতে পারি না?

কেন পারবেন না? নিশ্চয়ই পারবেন। মাধবীলতা বলল।

আর তারপর যদি মনে হয় ওঁদের সঙ্গে থেকে গেলে ভাল থাকব, তা হলে? ছোটমা এবার অনিমেষের দিকে তাকালেন।

.

৩৩.

রাত দশটায় ট্রেন শিয়ালদহ থেকে ছেড়ে বোলপুরে পৌঁছোয় মধ্যরাতে। ওই ট্রেনের অসংরক্ষিত কামরায় রামজিকে নিয়ে উঠেছিল অর্ক। আশ্চর্য ব্যাপার, সংরক্ষিত কামরার কোনও সিট যখন খালি নেই, টিটির পেছনে যাত্রীরা ঘুরছে করুণা পাওয়ার জন্যে তখন ওই অসংরক্ষিত কামরায় পা ছড়িয়ে বসা গেছে। মাঝখানে বর্ধমান, তার পরেই বোলপুর। এই ট্রেনে যাত্রীরা সচরাচর বোলপুরে যায় না। যারা ওঠার তারা উঠে গেলে ট্রেন যখন স্টেশন ছেড়ে চলে গেল তখন প্লাটফর্ম শুনশান।

রামজি বলল, এত রাত্রে তো কোথাও যাওয়া যাবে না।

ওয়েটিংরুমে চলুন। ভোর অবধি থাকতে হবে। অর্ক হাঁটল।

ওখানে গেলে পুলিশের নজরে পড়ব না তো?

আচ্ছা, পুলিশ কি আপনার ছবি ছাপিয়ে হুলিয়া জারি করেছে যে বোলপুরের রেল পুলিশ দেখলেই চিনতে পারবে?

না না। মাথা নাড়ল রামজি।

ওয়েটিং রুমের চেয়ারগুলো দখল করে যাত্রীরা ঘুমোচ্ছে। মাটিতেও কয়েকজন শুয়ে। ওরা তাদের পাশেই বসে পড়ল। ঝিমুনি আসছিল। ধুলোটে মেঝের ওপর শোওয়া সম্ভব হচ্ছিল না, এই সময় দুজন লোক ঘরে ঢুকল। তারা চারপাশে তাকিয়ে দেখল। একজন বলল, দূর শালা, হাউজফুল।

ওই লোকটা দুটো চেয়ার দখল করে আছে? বসার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না, ব্যাটা পা রেখেছে একটাতে, তোল ওকে। দ্বিতীয়জন বলল।

না, কাউকে ডিস্টার্ব করবি না। ফালতু গোলমাল হবে। এই মেঝের ওপর বসে পড়া যাক। প্রথমজন মেঝেতেই বসে একটা সিগারেট বের করল বুকপকেট থেকে, আগুন দে।

দেশলাই দিয়ে দ্বিতীয়জন বলল, দুটো টান দিয়ে।

ধোঁয়া ছেড়ে প্রথমজন বলল, লক্ষ্মণদা নোটিশ দিয়ে দিয়েছে। সব শালাদের জমি অধিগ্রহণ করা হবে। দেখবি, দুদিনেই সব বেলুন চুপসে যাবে।

দেখো দাদা, কোথায় কী হচ্ছে তা নিয়ে আমি মোটেই মাথা ঘামাচ্ছি না। আমার দাদার চাকরিটা দরকার। বিন্টুদা বলেছে ওটা হয়ে যাবে। পার্টি থেকে নাম পাঠিয়েছে। তা বিদা যখন বলল তোমার সঙ্গে নন্দীগ্রামে যেতে তখন

বলতে পারলাম না। না গেলে যদি দাদার চাকরি কেঁচে যায়? দ্বিতীয়জন বলল।

এটাই মুশকিল। তোরা কেউ পার্টির কথা ভাবিস না। শুধু পার্টিকে ভাঙিয়ে হাতিয়ে নেওয়ার ধান্দা। নে– প্রথমজন দ্বিতীয়জনকে সিগারেট এগিয়ে দিল। সেটা নিয়ে লম্বা টান দিয়ে দ্বিতীয়জন বলল, কিছু মনে কোরো না, নিজের পেট ভরে গেলে উপদেশ দেওয়া যায়। এই যে তোমার বাইক, দোতলা বাড়ি, তোমার দাদার প্রোমোটারি বিজনেস, এসব তো আকাশ থেকে পড়েনি। সিগারেট ফেরত দিল দ্বিতীয়জন।

প্রথমজন হাসল, তোর কথা শুনে একটুও রাগলাম না। পার্টি করছিস মাত্র দুবছর। লেগে থাকলে তোরও হবে। এই যে আজ যারা বীরভূম থেকে নন্দীগ্রামে যাচ্ছে তাদের সবাই তো ওই আশা নিয়ে যাচ্ছে, একদিন তাদেরও হবে।

দাদা, অনেকে বলছিল, খুব মারপিট হতে পারে। সত্যি?

দূর! বন্দুকের সামনে কে আসতে সাহস করবে? আমাদের সঙ্গে তো পুলিশ আছে। সব শালাকে লাশ বানিয়ে দেবে। প্রথমজন সিগারেট নেভাল।

ওখানকার গাঁয়ের লোক নাকি রাস্তা কেটে পুলিশের গাড়িকে ঢুকতে দিচ্ছে না। মেয়েরাও শুনলাম এককাট্টা হয়েছে? দ্বিতীয়জন একটু নার্ভাস।

পেপারে পড়েছিস নিশ্চয়ই। তুই এতদিনে জানলি না যে পেপার খবর তৈরি করে, পাবলিককে খ্যাপাতে হলে তৈরি খবর চাই। প্রথমজন মোবাইলে সময় দেখল, তিনটে নাগাদ স্টেশনের বাইরে যেতে হবে। বাস আসবে।

কতক্ষণ লাগবে?

যতক্ষণ লাগুক তোর তাতে কী? সেই সন্ধে থেকে বীরভূম জেলার ক্যাডারদের তুলে নিয়ে বাসে করে নন্দীগ্রামে। ওঠ। প্রথমজন উঠে দাঁড়াল।

কোথায় যাবে?

চল, দেখি, ঠেকটা এখনও ভোলা আছে কি না।

বলমাত্র হাসিমুখে উঠে দাঁড়াল দ্বিতীয়জন। ওরা ওয়েটিং রুম থেকে বেরিয়ে গেলে অর্ক রামজির দিকে তাকাল। রামজির চোখ বন্ধ। ওইসব সংলাপ ওর কানে ঢুকেছে বলে মনে হয় না। ঢুকলেও মানে বোঝা সম্ভব নয়।

কিন্তু এই ছেলেদের নন্দীগ্রামে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কেন? সেখানে ভূমি সংরক্ষণ সমিতির সঙ্গে সিপিএমের লড়াই চলছে। সিপিএমকে তাড়িয়ে গ্রামের মানুষ এখন দলবদ্ধভাবে প্রশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। রাস্তা কেটে দিয়েছে যাতে পুলিশের গাড়ি ঢুকতে না পারে। বলা হচ্ছে, ওইসব গ্রামগুলোতে প্রশাসনিক কাজকর্ম একদম বন্ধ হয়ে গেছে। চরম দুরাবস্থায় পড়া সত্ত্বেও মানুষ তাদের পৈতৃক জমি ছাড়তে রাজি নয়। তৃণমূল পার্টি তাদের সাহস জোগাচ্ছে। এই ঘটনাগুলো তো খবরের কাগজের দৌলতে সবাই জানে। কিন্তু এই যে বীরভূমের মতো জেলা থেকে নিচুতলার কর্মীদের বাসে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ওখানে, এই খবর এখনও প্রকাশিত নয়। বোঝাই যাচ্ছে ওখানকার শক্তিহীন দলের শক্তি বাড়াতেই এই ব্যবস্থা। যারা যাচ্ছে তারা অবশ্যই কিছু পাওয়ার আশায় বাড়ি ছাড়ছে। এই দেশের রাজনীতি মানেই পাওয়ার আশায় হাঁটা।

ভোর চারটে নাগাদ রামজিকে ডেকে বাইরে বেরিয়ে এল অর্ক। এখনও পৃথিবীতে অন্ধকার চেপে আছে। কিন্তু এর মধ্যেই লোকজন জেগে উঠেছে, রিকশায় যাত্রীরা স্টেশনে আসছে। একটু হাঁটতেই সদ্য খোলা চায়ের দোকান থেকে ওরা চা কিনে খেয়ে জেনে নিল বাস টার্মিনাস কত দূরে।

খানিকটা যেতেই রামজির মোবাইলে রিং শুরু হল। রামজি দ্রুত সেটা বড় করে দেখে নিয়ে চাপা গলায় বলল, রামপ্রসাদ। তারপর দেহাতি হিন্দিতে কথা বলে যেতে লাগল। একটু দূরে দাঁড়িয়ে কিছু কিছু শব্দ বুঝতে পারল অর্ক। ফোন বন্ধ করে কাছে এসে রামজি বলল, রামপ্রসাদ ফোন করেছিল। রামগঙ্গা জায়গাটা কোথায়?

কোন রামগঙ্গা?

সুন্দরবনের কাছে। বলল, নদীর একদিকে রামগঙ্গা, অন্যদিকে পাথর, পাথর, –যাঃ ভুলে গেলাম নামটা। রামজি বলল।

পাথরপ্রতিমা?

হ্যাঁ, হ্যাঁ।

কলকাতা থেকে ঘণ্টা চারেক লাগবে যেতে? কেন?

ঠিক চারদিনের মাথায় ওই রামগঙ্গায় যেতে হবে আমাকে। রামজি বলল, কীভাবে যাব তা দয়া করে বলে দেবেন।

এর জন্যে দয়া করার কী আছে? কিন্তু চারদিনের জন্য আশ্রমে যাবেন, এখানকার কোনও হোটেলে থাকবেন? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

আমার কাছে তো বেশি টাকা নেই। আর হোটেলে উঠলে তো মানুষের নজর পড়বে। রামজি বলল।

কথাটা ঠিক।

.

বাসে উঠে জায়গা পেয়ে গিয়েছিল ওরা। অর্ক সেই ছেলেদের কথা ভাবছিল যারা আজ নন্দীগ্রামে চলে গিয়েছে, আবার তার পাশে বসে আছে যে সে কদিন পরে সুন্দরবনে যাবে। এই যে রামজিকে সে সাহায্য করছে তা কি শুধু যে লোকটি ওকে পাঠিয়েছে তার কথা ভেবে? এই যে এতদিন রামজির সঙ্গে তার যেসব কথা হয়েছে তাতে তার মনেও কি একই ভাবনা জন্ম নেয়নি? কিন্তু ভাবনা জন্ম নেওয়া এক কথা, আর সেই ভাবনাকে বাস্তব করতে ঝাঁপিয়ে পড়া আর এক কথা। সেটা করতে গেলে মানসিক প্রস্তুতির দরকার। যারা নন্দীগ্রামে গিয়েছে তাদের আসল লক্ষ্য নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করা। চাকরি, টাকা, ক্ষমতা হাতে পাওয়া। কিন্তু এই রামজি এবং তার মতো ছেলেরা পশ্চিমবাংলার বাইরে থেকে যে অনিশ্চয়তায় ঝাঁপিয়ে পড়ছে তাদের তো এখান থেকে কিছু পাওয়ার নেই।

বাবার কথা সে মায়ের কাছে ছেলেবেলায় কিছু কিছু শুনেছে। ওই আন্দোলন যাকে নকশাল আন্দোলন বলা হত, তার উদ্দেশ্য ছিল বন্দুকের মাধ্যমে শ্রেণিহীন সমাজ তৈরি করা। ভারতীয় সংবিধান বা গণতন্ত্রকে তারা নাকি সোনার পাথরবাটি বলে মনে করত। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতা গ্রাস করে বড়লোক হয় আর গরিব আরও নিঃস্ব হয়ে যায়। নকশাল আন্দোলন এর উলটো পথে দেশকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু তাদের না ছিল সংগঠন, না অস্ত্রবল না উপযুক্ত নেতা। ফলে সেই আন্দোলনকে চুরমার করে দিতে সরকারের বেশি সময় লাগেনি।

বাবার দিকে তাকিয়ে অর্কের অনেকবার মনে হয়েছে এই মানুষটা যে আবেগ নিয়ে সব ছেড়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, জেল খেটেছিল, পুলিশ যাকে পঙ্গু করে দিয়েছে সে আজ কী অসহায় হয়ে বেঁচে আছে। সেই আবেগের কথা ভুলেও বোধহয় আর ভাবে না। আগুন যতক্ষণ দাউদাউ করে জ্বলে ততক্ষণ তার চেহারায় যে অহংকার তা ছাই হয়ে যাওয়ার পর খুঁজতে চাওয়া বোকামি।

কিন্তু রামজির সঙ্গে কথা বলে অর্ক বুঝেছে ওদের সংগঠন এখন বেশ মজবুত। ভারতবর্ষের কয়েকটি প্রদেশে ওরা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে। সব কথা রামজি খোলাখুলি না বললেও অর্কর অনুমান ও কয়েকমাস ট্রেনিং নিয়ে এসেছে। দলের ওপরতলার সঙ্গে ওর কোনও যোগাযোগ নেই, ওই রামপ্রকাশের সঙ্গেই তাকে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই যে সে কলকাতায় এসে অর্কর সঙ্গে আছে, অর্কর সাহায্য পাচ্ছে তা দল অবশ্যই জেনে গেছে।

তরুণ বয়সে বস্তির মানুষকে নিয়ে কমিউন তৈরি করতে চেয়েছিল অর্ক। সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক সেই কমিউনে বস্তির মানুষদের একত্রিত করে দুবেলা ক্ষুধা থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিল। ব্যাপারটা যখন ভাল দিকে এগোচ্ছিল তখনই তার ওপর আঘাত নেমে আসে কারণ সে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হতে চায়নি। কমিউনের ভোটগুলো ওদের ব্যালট বাক্সে চালান করতে রাজি হয়নি। এতটা কাল ক্ষোভের ঘোলা জল একটু একটু করে বাড়তে বাড়তে মনের ভেতর পাক খেয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সে এখনও বুঝতে পারছিল না কোন পথে সে হাঁটবে। অথবা হাঁটাটা দরকার, না বসে। থেকে দেখে যাওয়াটাই স্বস্তির?

.

বাস থেমে নেমেই ওরা নদী দেখতে পেল। এর মধ্যে অন্ধকার সরে গেছে, নবীন সূর্য আকাশে স্পষ্ট। হালকা রোদে পৃথিবী ঝলমল। জায়গাটার একেবারেই বীরভূমি নাম। একজনকে জিজ্ঞাসা করতে আশ্রমের সন্ধান জানা গেল।

গ্রামের প্রান্তে নদীর ধারে সন্ন্যাসিনীর আশ্রম। এমন কিছু বড়সড় নয় কিন্তু একটি মন্দির এবং অনেকগুলো টিনের চালাঘর রয়েছে। বাখারির বেড়া দেওয়া আশ্রমের গেট পেরিয়ে ভেতরে পা দিতেই দুজন শিষ্য কৌতূহলী চোখে তাকাল। অর্ক দুই হাত জোড়া করে বলল, নমস্কার।

জয় গুরুমা। আসুন। আপনাদের পরিচয়? একজন শিষ্য জানতে চাইলেন।

দেওয়ার মতো পরিচয় কিছু নেই। আমরা কলকাতা থেকে আসছি। অর্ক বলল।

এইসময় আর একজন প্রবীণ শিষ্য ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে অর্কর দিকে তাকিয়ে বললেন, মহাশয়কে মনে হচ্ছে কোথাও দেখেছি। নামটা…?

আমার নাম অর্ক, ওর নাম রামজি।

বাঃ! কী সৌভাগ্য। এই প্রভাতে সূর্যদেব এবং ভগবান শ্রীরামের নামধারীরা আমাদের আশ্রমে পদার্পণ করেছেন, কিন্তু কোথায় দেখেছি?

আপনি বোধহয় ট্রেনে দেখেছেন। নর্থ বেঙ্গল থেকে ফিরছিলাম।

ও তাই তো। বয়স মানুষের স্মৃতিকে দুর্বল করে দেয়। তা হলে আপনি এলেন। গুরুমা আমাকে আপনার কথা বলেছিলেন। আমাদের বলেছেন, দ্যাখ ও ঠিক আসবে। গুরুমায়ের কথা বৃথা হয় না। তারপর অন্য দুজনকে বললেন, তোমরা ওঁদের সাত নম্বর ঘরে নিয়ে যাও। হাতমুখ ধুয়ে একটু জলযোগ করুন। তারপর গুরুমার আদেশ হলে দর্শন করতে যাবেন।

.

টিনের চাল, ইটের দেওয়াল, মেঝেতে ইট পাতা, দুটো তক্তপোশে বিছানা। হাতমুখ ধুয়ে রুটি তরকারি খেয়ে শুয়ে পড়ল রামজি। বলল, খুব ঘুম পাচ্ছে।

অর্ক কথা বলতে গিয়ে শুনল ঘণ্টা বাজছে। আর তার পরেই শুরু হয়ে গেল প্রার্থনাসংগীত। যারা গাইছে তাদের সবাই পুরুষ, কোনও নারীকণ্ঠ নেই। ঘরের দরজায় তরুণ শিষ্যদের একজন এসে দাঁড়াল, আপনারা নিশ্চয়ই ক্লান্ত হয়ে এসেছেন তাই এখন প্রার্থনায় যেতে হবে না। বিশ্রাম করুন। বেলায় গুরুমা দর্শন দেবেন।

অর্ক মাথা নাড়লে তরুণ চলে গেল।

দরজা ভেজিয়ে অর্ক বলল, ভদ্রমহিলা বেশ বাস্তববোধসম্পন্ন।

কী বললেন? রামজি পাশ ফিরল।

হিন্দিতে বাক্যটির অর্থ বুঝিয়ে দিল অর্ক।

কিন্তু এটা তো একেবারে ধর্মস্থান। আশ্রম শুনে ভেবেছিলাম হয়তো অনাথ আশ্রম অথবা বৃদ্ধাশ্রম। রামজি শ্বাস ফেলল।

আমাদের তো কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। অর্ক শুয়ে পড়ল।

আপনার হচ্ছে না? কিন্তু যদি ওরা জানতে পারে আমি হিন্দুনই তা হলে? তখন কী করবে ওরা জানি না।

কেন এসব ভাবছেন?বরং ভাবুন, এখানে আপনি একদম নিরাপদ। পুলিশ কল্পনাও করতে পারবে না যে আপনি এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। এইসব আশ্রমে পুলিশ কখনওই আসে না। তা ছাড়া, মনে হচ্ছে এই গুরুমায়ের বেশ ভাল নামডাক আছে। আপনি আরামে থাকবেন। অর্ক বলল।

বুঝলাম। কিন্তু আমি তো কখনও হিন্দুদের প্রেয়ার করিনি।

আপনার কি ধারণা আমি করেছি?

করেননি?

না। আমার মতো লক্ষ লক্ষ জন্মসূত্রে হিন্দু মন্দিরে যায় না। সকাল বিকেল পুজো করে না। এমনকী বেশিরভাগ বাড়িতে ঠাকুরঘরও নেই। আর আজকের অধিকাংশ তরুণ-তরুণী এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। যারা পুজোর সঙ্গে যুক্ত হয় তারা বিনোদনের মজা পেতে চায়। অতএব, আমি যা করব আপনি তাই অনুসরণ করবেন। হেসে ফেলল অর্ক, একটা গান আপনি শোনেননি, তাতে বলা হয়েছে কৃষ্ণ এবং খ্রিস্ট একই। চোখ বন্ধ করে আপনি ভাববেন যিশুখ্রিস্টকে স্মরণ করছেন।

.

বেলা সাড়ে দশটায় যখন ডাক পড়ল তখন রামজি মড়ার মতো ঘুমোচ্ছ। বেলগাছিয়ার বাড়ি থেকে বেরিয়ে তালসারি ছুঁয়ে আবার কলকাতা হয়ে এখানে আসা পর্যন্ত যে টেনশনে ছিল তাতে এখন এই ঘুম খুব স্বাভাবিক। ওকে না তুলে অর্ক তরুণ শিষ্যটিকে একাই অনুসরণ করল।

মন্দিরটি বেশ সুন্দর। ছোট কিন্তু সাজানো। মায়ের মূর্তিটিও বেশ। মুখের আদলে স্নেহ জড়ানন। শিষ্য প্রণাম করায় অর্ক হাতজোড় করল। শিষ্য বলল, আপনি নিশ্চয়ই জানেন না আমাদের মা খুব জাগ্রত।

আপনি কি গুরুমায়ের কথা বলছেন? অর্ক জিজ্ঞাসা করল। দ্রুত মাথা নাড়ল শিষ্য, তিনি তো বেঁচেই আছেন, তা ছাড়া তাকে আমরা গুরুমা বলে সম্বোধন করি। মা বলি এই দেবীকে। বহু বছর আগে স্বপ্নাদেশ পেয়ে মাটির দশহাত নীচ থেকে এই দেবীমূর্তিকে তুলে আনা হয়েছে। আগে রোজ খুব ভিড় হত বলে গুরুমায়ের নির্দেশে শুধু শনি এবং মঙ্গলবারে সাধারণ ভক্তদের এখানে আসতে দেওয়া হয়। চলুন।

.

৩৪.

মন্দিরের সামনে কোলাপসিবল গেট ছাড়াও দেবীমূর্তির দুপাশে আর একটি দরজা আছে যা সম্ভবত মন্দির বন্ধ করার সময় টেনে দেওয়া হয়। অর্থাৎ এই দেবীমূর্তির সুরক্ষার ব্যাপারে আশ্রম কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত সতর্ক। অর্কর মনে হল মূর্তিটি নিশ্চয়ই খুব মূল্যবান।

মন্দিরের পেছনে একটি সুন্দর একতলা বাড়ি যার পাশেই অজয় নদী। নদীর জল এখন বেশ কম। চর দেখা যাচ্ছে, ওরা বাড়িটির সামনে যেতেই একজন বেশ বৃদ্ধ শিষ্য এগিয়ে এলেন, আসুন। আপনার সঙ্গী এলেন না?

না। ওর শরীর বেশ দুর্বল। ঘুমোচ্ছে বলে নিয়ে এলাম না।

সে কী? কী হয়েছে? বৃদ্ধ উদ্বিগ্ন হলেন।

না না। একটু বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।

ও। মায়ের আশীর্বাদে নিশ্চয়ই উনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবেন। আপনি আসুন। গুরুমা আপনার জন্যে অপেক্ষায় আছেন। বৃদ্ধ শিষ্য কথাগুলো বলমাত্র তরুণ শিষ্য ফিরে গেল।

ঘরের পরদা সরিয়ে বৃদ্ধ শিষ্য বললেন, ভেতরে যান।

ভেতরে ঢুকেই সন্ন্যাসিনীকে দেখতে পেল না অর্ক। ছিমছাম এই ঘরটিতে আসবাবের বাহুল্য নেই। তখনই মহিলা কণ্ঠ ভেসে এল, কই, এদিকে এসো, আমি বারান্দায়।

ওপাশের দরজা দিয়ে বারান্দায় পা রাখতেই সন্ন্যাসিনীকে দেখতে পেল অর্ক। বারান্দার ওপাশে ফুলের বাগান, তারপরেই নদীর জল। সন্ন্যাসিনী বসে আছেন একটা বেতের মোড়ায়। ট্রেনে যে পোশাকে সে ওঁকে দেখেছিল পরনে সেই একই পোশাক। হেসে বললেন, ওই মোড়া টেনে নিয়ে বসো।

অর্ক বসতে বসতে ভাবল প্রণাম করা ঠিক হবে কিনা। সে দুই হাত জোড় করে বলল, নমস্কার।

তা তো বুঝলাম, তবে আমি ভেবেছিলাম অনেক আগেই তোমার দেখা পাব। আমাকে বেশ অপেক্ষায় রাখলে তুমি।

সন্ন্যাসিনী হাসলেন। হাসলে ওঁকে খুব সুন্দর দেখায়।

আপনি কী কারণে এটা ভেবেছিলেন?

তোমার চোখ দেখে। মা মানুষকে চোখ দিয়েছেন পৃথিবীকে দেখার জন্যে। মানুষ তো নিজের চোখ দেখতে পায় না। তুমি বলতে পারো, তা কেন, আয়নায় তো দিব্যি দেখা যায়। কিন্তু আয়নায় মানুষ নিজের মুখ দেখে, কজন আর শুধু চোখের দিকে তাকিয়ে দেখে। কিন্তু সেই চোখ দেখলে আমি তার মনের খবর পেয়ে যাই। তোমার চোখ দেখে বুঝেছিলাম, তুমি আসবেই। আসবে। হাসলেন সন্ন্যাসিনী।

অর্ক অবাক হয়ে শুনছিল। একটু চুপ করে থেকে সন্ন্যাসিনী জিজ্ঞাসা করলেন, এই দ্যাখো, কী ভাবছ তুমি?

আপনিই বলুন। আমার চোখ দেখে বলুন কী ভাবছি। অর্ক বলল।

বলছি। তুমি ভাবছ এ কোথায় এসে পড়লাম। এরকম কথা তো কখনও শুনিনি। বলতে বলতে সন্ন্যাসিনী বললেন, তোমার নামটা ভুলে গেছি।

আমি কি আপনাকে নাম বলেছিলাম? মনে পড়ছে না। তারপরেই দুষ্টুমি করতে চাইল অর্ক, আচ্ছা, নামে কী এসে যায়!

তা ঠিক। আমরা অবশ্য গৃহপালিত পশুদের একটা নাম দিই, কিন্তু তাদের চেহারা বেশ বড়সড়। হাঁস মুরগির কেউ নাম রাখে না। এখন বলো, তোমার এখানে আগমনের উদ্দেশ্য কী? সন্ন্যাসিনী বড় চোখে তাকালেন।

আমাদের কদিন একটু নির্জনে থাকার ইচ্ছে হল। আপনি বলেছিলেন নদীর ধারে আশ্রম। এখানে আসতে বলেছিলেন। তাই চলে এলাম।

বেশ করেছ। তুমি কি ঠাকুর দেবতা মানো?

না মানলে এখানে থাকতে দেবেন না?

ওমা! এ কথা কখন বললাম?

বলেননি। আমি জিজ্ঞাসা করছি।

দেখো, তুমি যদি না মানো তা হলে সেটা তোমার ব্যাপার। কিন্তু তুমি যদি আমার ওপর ওই না মানাটাকে চাপিয়ে দিতে চাও তা হলে অবশ্যই তোমাকে সঙ্গ ত্যাগ করতে বলব।

মাথা নাড়ল অর্ক, ঠাকুর দেবতা নিয়ে কখনওই মাথা ঘামাইনি।

জোর করে মাথা ঘামাবে কেন? আচ্ছা, এই যে তুমি বসে আছ, একটু চেষ্টা করো তো, বসে বসে মাথায় ঘাম আনতে পারো কিনা?

অসম্ভব।

তা হলে ঠাকুর দেবতাদের নিয়ে ওই চেষ্টা করাও নিরর্থক। যখন মন চাইবে তখন আপনি ইচ্ছে করবে। তখন মাথা কেন, তোমার অস্তিত্ব জাগ্রত হবে। মন না চাইলে নির্লিপ্ত থাকাই তো ভাল।

আমরা এখানে দিন তিনেক থাকতে চাই। অর্ক বলল।

এ কী? এত অল্প দিন? কথা বলে আমার তো সুখই হবে না। বলেই সন্ন্যাসিনী হাসলেন, অবশ্য অল্পেই সন্তুষ্ট হওয়া ভাল। প্রসাদ কণিকাতেই যথেষ্ট।

আপনি খুব সুন্দর কথা বলেন। আমি খুব অবাক হয়েছি যখন এখানে এসেই একজন বয়স্ক মানুষ বললেন, আপনি তাকে বলেছেন আমি এখানে আসবই। অর্ক বলল, স্বীকার করছি আপনি ঠিক অনুমান করেছিলেন।

সন্ন্যাসিনী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি সংসার ধর্ম পালন করছ না, না?

আমি বিবাহিত নই।

তোমার মা, বাবা?

আছেন। মা শিক্ষিকা ছিলেন।

বাবা?

একটু চুপ করে শেষ পর্যন্ত বলল অর্ক, বাবা নকশাল রাজনীতি করতেন। পুলিশের অত্যাচারে পঙ্গু হয়ে যান। মুক্তি পাওয়ার পর তাই কাজকর্ম করতে পারেননি।

কী নাম তোমার বাবার?

অনিমেষ মিত্র।

তুমি কী করো? একটু চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করলেন সন্ন্যাসিনী।

আমি একটা চাকরি করছি।

আর?

আর কিছু না।

আমার মনে হচ্ছে তুমি সত্য বলছ না। যাক গে, তোমাকে এখানকার প্রার্থনায় যোগ দিতে হবে না। ওই নদীটাকে ঘুরে ঘুরে দেখো। খুব ভাল লাগবে। ভোরের আগের অন্ধকার আর সূর্য ডোবার পরের অন্ধকারের মধ্যে কোথাও মিল আছে কি না খুঁজতে চেষ্টা করো। তবে আশ্রম থেকে বেরিয়ে ওই বাসস্ট্যান্ডের দিকে না যাওয়াই ভাল। মানুষ অকারণে কৌতূহলী হয়। এসো। সন্ন্যাসিনী উঠে দাঁড়ালেন।

ঘরে ফিরে তক্তপোশে শুয়েও ঘুম আসছিল না অর্কর। পাশের তক্তপোশে রামজি নাক ডাকছে মৃদু। কাল গোটা রাত জেগে থেকে শরীর ঘুম চাইছে কিন্তু পাচ্ছে না। সন্ন্যাসিনী বারংবার চোখের সামনে চলে আসছেন। এরকম মহিলাকে সে কখনও দেখেনি। কথা শুনলে মনে হবে উনি বেশ শিক্ষিত। ওঁর প্রতিটি কথাই অসাধারণ। কিন্তু মহিলা কী করে অনুমান করলেন সে এখানে আসবেই। সাধু সন্ন্যাসিনীদের কী সব শক্তি থাকে বলে সে শুনেছে কিন্তু কোনওদিন বিশ্বাস করেনি। এখন মনে হচ্ছে এটাও কোনও শক্তির ব্যাপার নয়। ওঁর মনে হয়েছে সে এখানে এলে ভাল হয়। সঙ্গে সঙ্গে ভেবেছেন ব্যাপারটা সত্যি হবে আর সেই ভাবনার কথা অন্যদের বলেছেন। কিন্তু সে এখানে এলে উনি কেন খুশি হবেন? ট্রেনে অত অল্পসময়ের আলাপে তো এরকম ভাবনা আসার কথা নয়। ঘুম আসছিল না, তারপরেই মনে পড়ল, অনিমেষ মিত্রের নাম শুনে একটু চুপ করে ছিলেন, সে যে শুধু চাকরি করে এটাও বিশ্বাস করেননি। করেননি বলে সতর্ক করেছেন যেন তারা বাসস্ট্যান্ডের দিকে না যায়। নদীর ধারে ঘুরতে বলেছেন, অন্ধকার দেখতে বলেছেন। এসব তো বলতে হয় তাই বলা। কিন্তু উনি নিশ্চয়ই অনুমান করেছেন ওরা এখানে আড়াল খুঁজতে এসেছে। রামজির ব্যাপারে একটুও উৎসাহ দেখালেন না। এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার। মানুষের কৌতূহলী চোখ এড়াতে যিনি সতর্ক করে দিয়েছেন তিনি নিশ্চয়ই ভেবেছেন জানাজানি হলে তারা বিপদে পড়বে। সেটা জেনেও কেন তাদের আশ্রয় দিলেন? অর্ক ব্যাখ্যা পাচ্ছিল না।

নদীতে জল কোথাও কোমরের ওপরে, কোথাও হাঁটু ছোঁওয়া। তরুণ শিষ্য বলল, আপনারা ইচ্ছে করলে নদীতেই স্নান করতে পারেন। না হলে ওই যে ইঁদারা আছে ওখানেও সেরে নিতে পারবেন। স্নান সেরে আমাদের খাওয়ার ঘরে চলে আসুন। মধ্যাহ্নভোজনের সময় হয়ে গিয়েছে।

নদীর জল খুব ধীরে বয়ে যাচ্ছে। মাঝখানে বালির চরে কয়েকটা শকুন বসে আছে দেখে ওরা ইঁদারায় স্নান করে নিল। পোশাক বদলে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, অনেকক্ষণ তো ঘুমালেন, এখন কেমন লাগছে?

ভাল। ওঃ, ঘুমটার দরকার ছিল। আচ্ছা, এই আশ্রমের প্রধানের সঙ্গে কখন দেখা করতে হবে? আমার খুব নার্ভাস লাগছে। রামজি বলল।

ওঁর সঙ্গে দেখা করে এসেছি। আপনাকে যেতে হবে না।

যাক! আর পরীক্ষা দিতে হবে না।

খাওয়ার ঘরটিতে কোনও দেওয়াল নেই। টেবিলের পাশে বেঞ্চি পাতা। বাঁশের ওপর টিনের চাল। খেতে বসলে গায়ে বাতাস লাগে। ওরা যেতেই তরুণ শিষ্যটি বসার ব্যবস্থা করে দিল। আরও জনা আষ্টেক শিষ্য তখন দুপুরের খাবার খেতে ব্যস্ত।

খাবার এল। কলাপাতায় ভাত ডাল ভাজা তরকারি আর চাটনি। গুরুমায়ের কাছে যে বৃদ্ধ শিষ্যকে দেখেছিল অর্ক তিনি এসে সামনে দাঁড়ালেন। বললেন, খুব সামান্য ব্যবস্থা। আজ বৃহস্পতিবার তাই আমিষ গ্রহণ করি না। আপনাদের হয়তো খেতে অসুবিধে হবে।

অর্ক বলল, এ নিয়ে ভাববেন না। খেয়ে তৃপ্তি পেলে নিরামিষই অমৃত।

বাঃ। ভাল বলেছেন। একটা কথা, আমরা সাধারণ মানুষ। গুরুমা যা। পারেন আমরা তা কীভাবে পারব। যাঁর সঙ্গে কথা বলছি তাঁর নাম না জানা থাকলে অস্বস্তি হয়। আমার নাম যুধিষ্ঠির।

ভাত খেতে খেতে অর্ক বলল, আমি অর্ক মিত্র।

এরকম নাম আগে শুনিনি। সূর্য তো আকছার, কিন্তু অর্ক আমার কাছে নতুন। আর ওঁর নাম?

ওর নাম রামজি। অর্ক বলল, ও অবাঙালি।

বাঃ, স্বয়ং রামজি আমাদের এখানে অন্নগ্রহণ করছেন। কী সৌভাগ্য। গুরুমাকে সংবাদটা দিতে হবে। রামজিভাই, আপনার খেতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো? খানা কি আচ্ছা হ্যায়?

রামজি হেসে ফেলল, বহুৎ আচ্ছা।

বৃদ্ধ শিষ্য খুশি হয়ে চলে গেলে অর্ক খেয়াল করল অন্যরা খেতে খেতে তাদের লক্ষ করছে। গায়ে পড়ে কথা বললে কথা বাড়বে বলে মুখ নামিয়ে খেয়ে নিল অর্ক। রান্না খুবই সুস্বাদু। তরকারিটা তো অসাধারণ। খাওয়া শেষ করে হাত মুখ ধুয়ে ওরা ঘরে চলে এল। এখন পেটে খাবার যেতে শরীর শিথিল লাগছিল।

অর্ক জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি আবার ঘুমাবেন? না না। আপনি ঘুমিয়ে নিন। আমি একটু চারপাশ ঘুরে দেখে আসি। এদিকে নিশ্চয়ই কাছাকাছি থানা নেই। রামজি বলল।

অর্ক মাথা নাড়ল, না, একা কোথাও যাবেন না। গুরুমাও চান না আমরা কোনও বিপদে পড়ি। শুয়ে পড়ুন। বিকেলে নদীর ধারে যাব।

.

কাল রাত্রে কথা এগোয়নি। ছোটমার দিকে তাকিয়ে অনিমেষ বলেছিল, তোমার যা ইচ্ছে তাই হবে। আমার কোনও আপত্তি নেই।

শোনার পর ছোটমা নিজের ঘরে চলে গিয়েছিলেন।

কিন্তু সকালে চা খেতে খেতে মাধবীলতা কথাটা তুলল, তুমি বললে উনি বৃদ্ধাশ্রমে গেলে তোমার আপত্তি নেই। আমার কিন্তু ভাল লাগছে না।

কেন? অনিমেষ চায়ের কাপ নামাল।

এতদিন একা ছিলেন, আমরা এসে বাড়ি বিক্রি করে ওঁকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিলাম। মানুষ তো বলবে আমরা ঘাড় থেকে বোঝা নামালাম।

মাধবীলতার গলার স্বরে অনেকটাই হতাশা।

কোন মানুষ কী বলছে তা নিয়ে তুমি আজ ভাবছ লতা? এতদিন তো দেখেছি যেটা ভাল বলে মনে করো তা করতে, কারও কথা গ্রাহ্য করো না। তুমি এ কথা কেন ভাবছ না, এতদিন এই বাড়িতে একা থেকে উনি প্রায় পাথর হয়ে গিয়েছিলেন। গতকাল দেবেশের ওখানে গিয়ে সারাদিন কাটিয়ে ওঁর মন থেকে অনেক চাপ সরে গিয়েছে। ওঁর কথাবার্তাও বদলে গিয়েছে অনেকটাই। মাঝে মাঝে ওঁদের কাছে গিয়ে যদি ওঁর মনে হয় ওখানে পাকাপাকি থাকলে উনি ভাল থাকবেন তা হলে সেটাই মেনে নেওয়া উচিত। অনিমেষ বলল। এর বিকল্প কি কিছু আছে?

হ্যাঁ, আছে।

বলো।

বাড়ি বিক্রির টাকায় ওঁর নামে একটা ফ্ল্যাট কিনে আমরা তিনজনই সেখানে থাকতে পারি। আমি সঙ্গে থাকলে উনি ভাল থাকবেন।

ফ্ল্যাটটা কোথায় নেওয়া হবে?

উনি যেখানে গিয়ে থাকতে চাইবেন।

তারপর? উনি চলে গেলে? ফ্ল্যাটটা তো আমাদের হয়ে যাবে। আমি চাই না তারপরে ওটা অর্কর হাতে যাক।

শুধু অর্কর হাতে যাবে বলে তুমি রাজি হচ্ছ না?

না। আসল কারণটা তুমি জানো। এই বাড়ি বিক্রির টাকায় কেনা ফ্ল্যাটে আমি থাকতে পারি না। কারণ এই বাড়ির কাছে আমার যা ঋণ তা আমি শোধ করিনি। শোধ করার সময়ও চলে গেছে।

তা হলে আমার কিছু বলার নেই। মাধবীলতা উঠে দাঁড়াল।

বাড়ি বিক্রি করার পর সেই টাকার কী হবে?

ভাবতে হবে। বিক্রির পরে ব্যাঙ্কে ছোটমার নামেই তো থাকবে।

দরজা পর্যন্ত চলে গিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াল মাধবীলতা, আর একটা কথা। দেবেশবাবুরও তো বয়স হয়েছে। যদি ওঁর কিছু হয়ে যায় তা হলে অতগুলো মানুষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন?

অনিমেষ তাকাল। এই প্রশ্নের জবাব তার জানা নেই।

মাধবীলতা বেরিয়ে গেল, উত্তরের অপেক্ষা না করে।

.

বেলা নটা নাগাদ মিস্টার রায়ের সহকারী ফোন করে জানালেন, আজ ঠিক বারোটা নাগাদ কোর্টে চলে আসুন আপনার মাকে নিয়ে।

আজ? অনিমেষ অবাক।

হ্যাঁ। আজই তো শুক্রবার। কোর্ট কোথায় তা জানেন তো?

আগে তো আমাদের বাড়ি থেকে ডি এমের বাড়ির দিকে গিয়ে নদীর ধারেই ছিল। অনিমেষ বলল।

ছিল। এখন নেই। এখন নবাববাড়িতে। আপনাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে করলা নদী পেরিয়ে সমাজপাড়ায় এসে এল আই সি বিল্ডিং থেকে ডানদিকে এগোলেই বাঁদিকে নবাববাড়ি দেখতে পাবেন। মিস্টার রায়ের নাম বললেই যে কেউ ওঁর চেম্বার দেখিয়ে দেবে। ফোন রেখে দিল ছেলেটি।

ভাগ্যিস নিবারণবাবু সাহায্য করলেন তাই দু-দুটো রিকশা পাওয়া গেল। ছোটমা যে এত সহজে যেতে রাজি হয়ে যাবেন তা মাধবীলতাও ভাবেনি। দরজায় তালা দিয়ে সেজেগুজে ওরা নবাববাড়িতে পৌঁছে গেল। এবার অনিমেষ একা রিকশায়। কোর্ট চত্বরে রিকশা থেকে নামতে একটু অসুবিধা হল তার। রিকশাওয়ালা সাহায্যের হাত বাড়াবার কথা ভাবেনি। অনিমেষের সমস্যা দেখে এক ভদ্রলোক দ্রুত এগিয়ে এলেন, আমার কাঁধে হাত রাখুন।

সোজা হয়ে নেমে অনিমেষ বলল, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

আরে না না–। ভদ্রলোক থেমে গেলেন, খুব চেনা লাগছে, কী নাম বলুন তো ভাই?

অনিমেষ মিত্র।

আরে তাই। কতদিন পরে দেখা হল। তোমার এই অবস্থা কেন?

হয়ে গেল। অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, আপনি?

আমি অজিত। একসঙ্গে জেলা স্কুলে পড়তাম। চাকরি করেছি এতকাল। আইন পাশ করা ছিল। এখন রিটায়ার করার পর বাড়িতে না বসে থেকে কোর্টে আসা যাওয়া করি। তুমি এখানে?

অজিতকে মনে পড়ে গেল অনিমেষের। খুব পাকা কথা বলত সে সময়। অজিতের চাপে অনিমেষকে বলতেই হল মিস্টার রায়ের কাছে কী উদ্দেশ্যে ওরা এসেছে। শোনার পর অজিত ওদের নিয়ে গেল মিস্টার রায়ের চেম্বারে। তিনি বা তার সহকারী তখন চেম্বারে নেই। অন্য কেসে সওয়াল করতে গেছেন। ওদের চেম্বারে বসিয়ে অজিত বলল, তোমাদের ব্যাপারটা যেখানে হবে সেখানে গিয়ে সবুজ আলো জ্বেলে আসি।

মানে?

এদের তো বত্রিশ মাসে বছর। কাজটা যাতে আজকেই হয়ে যায় তার জন্যে একটু তৈলমর্দন করতে হবে। তোমার মামলায় তো আমি ওদের পকেটে কিছু দিতে রাজি নই। অজিত চলে গিয়েছিল।

.

বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ মিস্টার রায় বললেন, এবার আপনারা যেতে পারেন। বাকি ফর্মালিটিগুলো আমরাই সামলে নেব। সামনের সপ্তাহে কাগজপত্র পেয়ে যাবেন।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কত টাকা দিতে হবে?

ওই তো, আপনাকে আগে যেমন বলেছিলাম তাই দেবেন। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। সোমবারের মধ্যে দিলেই হবে। মিস্টার রায় বললেন।

এ কথা ঠিক, অজিতের উদ্যোগে অনেক কাজ সহজ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বেরোনোর অনেক আগে থেকেই তার দেখা পাওয়া যায়নি। অজিতকে ধন্যবাদ দেওয়া দরকার ছিল, হল না।

রিকশায় অনিমেষ উঠে বসলে মাধবীলতা পাশে এসে বলল, শোনো, আমাদের খুব খিদে পেয়েছে। চলো না, কোথাও খেয়ে বাড়ি যাই।

কোথায় খাবে?

বা রে! আমি কী জানি। এটা তো তোমার জায়গা।

কী খাবে?

নোনতা বা মিষ্টি। নিশ্চয়ই চপ কাটলেট নয়।

অনিমেষ ফাঁপরে পড়ল, দীর্ঘ সময়ে নিশ্চয়ই জলপাইগুড়ির খাবারের দোকানগুলো বদলে গিয়েছে। হঠাৎ মনে পড়ল, নবাববাড়ির সামনেই কাঁঠালতলার মিষ্টির দোকান তাদের বাল্যকালে খুব বিখ্যাত ছিল। আর-একটা দোকান ছিল রূপশ্রী সিনেমার সামনে, গন্ধেশ্বরী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। কিন্তু ওইসব দোকান এখনও রয়েছে কি না তা তার জানা নেই। সে রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করতেই জানতে পারল কাঁঠালতলার দোকান এখনও রয়েছে। সেখানেই যেতে বলল অনিমেষ। রিকশাওয়ালাকে বেশি ভাড়া দেবে বলে আশ্বস্ত করে ওরা কাঁঠালতলায় গিয়ে দেখল দোকান বন্ধ রয়েছে। অনিমেষ রিকশায় বসেই মাধবীলতাকে বলল, তোমরা বাড়ি চলে যাও, আমি নোতা মিষ্টি কিনে নিয়ে আসছি।

বা রে। মাধবীলতা বলল, আমরা দোকানে বসে খেতে চাই। উনি কোনওদিন ওইভাবে খাননি।

শেষপর্যন্ত দিনবাজারে একটা দোকান পাওয়া গেল। শালপাতায় রাধাবল্লভী এবং ছোলার ডালের পর রসগোল্লা খাওয়া হল। মাধবীলতা বলল, তোমরা বোতলের জল বিক্রি করো?

হ্যাঁ মা। ছেলেটি বোতল নিয়ে এল।

ছোটমা জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কী জল?

এই জল খেলে পেট খারাপ হবে না। মাধবীলতা বলল।

ওরা তো কলের জল দিচ্ছে। আমরাও তো বাড়িতে তাই খাই।

মাধবীলতা ফাঁপরে পড়ল। বলল, ওরা জল জমিয়ে রেখেছে, তাই থেকে দিচ্ছে। তাই একটু সাবধান হওয়া ভাল।

তা হলে থাক। বাড়িতে গিয়েই খাব। তা ছাড়া– হাসলেন ছোটমা।

তা ছাড়া মানে? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

এই প্রথম রাধাবল্লভী খেলাম তো। জিভে স্বাদটা খানিকক্ষণ থাক না। ছোটমা উঠে দাঁড়ালেন।

.

৩৫.

এখনও বাইরে কড়া রোদ, অর্ক রামজির দিকে তাকাল। রামজি তার তক্তপোশে বসে আছে অন্যমনস্ক হয়ে। কী ভাবছে তা জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে হল না।

ছেলেটাকে তার ভাল লেগেছে। আশ্চর্য ব্যাপার, এতদিন একসঙ্গে থেকেও রামজি তার অনেক কথাই বলতে চায়নি, অর্কও যেচে জিজ্ঞাসা করেনি।

অর্ক এখন বলল, না, রোদ কমলে অজয়ের ধারে যাব, এখন থাক। ঠিক তখনই সেই তরুণ শিষ্য দরজায় এসে দাঁড়াল, আপনি কি বিশ্রামে আছেন?

এখানে তো আর কিছু করার নেই। কী ব্যাপার ভাই? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

যদি বিশ্রামে না থাকেন তা হলে গুরুমা একবার যেতে বললেন।

অবশ্যই। উঠে দাঁড়াল অর্ক, চলুন।

যাওয়ার আগে সে রামজির দিকে তাকাল। রামজি মাথা নাড়ল।

মন্দিরের সামনে বসে কয়েকজন শিষ্য ধ্যান করছেন। অর্ক জিজ্ঞাসা করল, এই সময়ে ধ্যান? একটু আগেই তো দুপুরের খাওয়া শেষ হল।

ধ্যানের তো সময় অসময় নেই। তরুণ শিষ্য পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল, গুরুমা বলেন যখনই ইচ্ছে হবে তখনই সময়। কিন্তু যাঁদের দেখছেন তারা মধ্যাহ্নভোজন করেন না। সকালে সামান্য জলযোগ করে সন্ধেবেলায় রাতের আহার সারেন।

অর্ক অবাক হল, মুসলমান বন্ধুরা তো রোজার সময় এই নিয়ম মেনে চলেন, তবে তারা সকালে না, ভোরের আগেই যা খাওয়ার খেয়ে নেন। অর্ক বলল।

গুরুমা বলেন, মাঝে মাঝে ঈশ্বরের আরাধনায় শরীর অভুক্ত রাখলে কোনও ক্ষতি হয় না, স্বাস্থ্যের উপকার হয়। তরুণ শিষ্য বলল।

বাঃ, আপনি দেখছি চমৎকার জ্ঞান লাভ করেছেন।

না না। আমি অতি সামান্য। গুরুমার কৃপা পেলে ধন্য হয়ে যাব। সেই বৃদ্ধ শিষ্য অপেক্ষা করছিলেন। হেসে বললেন, ওকে বিশ্রাম থেকে টেনে নিয়ে আসেননি তো?

অর্ক বলল, না না। আমি তো বসেই ছিলাম।

আসুন আমার কক্ষে। বৃদ্ধ শিষ্য পেছন ফিরতেই তরুণ শিষ্য যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে চলে গেল। অর্ক বুঝতে পারল এই আশ্রমে ডিসিপ্লিন মেনে চলে সবাই।

ভেতরের বারান্দার কাছে গিয়ে বৃদ্ধ শিষ্য বললেন, গুরুমা ওই বাগানে অপেক্ষা করছেন, যান।

অর্থাৎ এখন তার ওই পর্যন্ত যাওয়ার অধিকার তা তিনি জানেন।

অর্ক এগিয়ে বারান্দায় দাঁড়াতেই শুনতে পেল, এই যে এসে গেছ।

অর্ক দেখল বাড়ির পূর্বদিকের বাগানে এখন ছায়া পড়েছে। সেই ছায়ায় চেয়ার পেতে বসে আছেন গুরুমা এবং একজন মহিলা। কিন্তু মহিলাকে দেখে শিষ্যা বা সন্ন্যাসিনী বলে মনে হল না। একটু রোগা কিন্তু যথেষ্ট ফরসা এবং টানটান শরীর। অর্ক হেসে বলল, এখানে আসার পর সবসময় হুশে আছি যাতে আপনি ডাকলেই চলে আসতে পারি।

ও মা? তাই। বেশ বলল, মানুষ কেন পৃথিবীতে আসে?

অর্ক বলল, মার্জনা করবেন যদি ধৃষ্টতা দেখাই। মানুষ তো নিজের ইচ্ছেয় পৃথিবীতে আসে না।

গুরুমা কিছুক্ষণ তাকালেন, তারপর বললেন, বসো।

অর্ক নিঃশব্দে তৃতীয় চেয়ারে বসল।

গুরুমা জিজ্ঞাসা করলেন, একসময় মানুষের জীবন ফুরিয়ে যায়। এই আসা-যাওয়া কী কারণে? অন্য প্রাণীদের সঙ্গে তফাত কোথায়?

অর্ক বলল, তফাত একটাই, মানুষ দাগ রেখে যেতে পারে, অন্য প্রাণী পারে না।

জোরে হেসে উঠলেন গুরুমা, বাঃ। খুব ভাল। তুমি দেখছি পড়াশোনা করেছ।

কিছুই পড়িনি। মায়ের কাছে ওঁর লেখা বই ছিল, তাই অর্ক বলল।

এবার গুরুমা মহিলার দিকে তাকালেন, এই মেয়ে, তুমি যাকে দেখতে চেয়েছিলে সে এই।

মহিলা তার দিকে তাকাতেই অর্ক হাত জোড় করল, আমি অর্ক মিত্র।

আমি কুন্তী সেন। নমস্কার। হাত জোড় করলেন মহিলা। তারপর একটু থেমে বললেন, আপনার নামটা সচরাচর শোনা যায় না। কিন্তু আমি আগে শুনেছিলাম বাবার মুখে। তাই আপনাকে দেখার কৌতূহল হল। অবশ্য বাবা যে অর্কের কথা বলেছিলেন তিনি অন্য কেউ হওয়াই স্বাভাবিক।

গুরুমা হাসলেন, নাম শুনে ব্যস্ত হয়ে উঠল মেয়ে, বলল দেখতে চাই। কুন্তী জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি কলকাতায় থাকেন?

হ্যাঁ। আপনি?

আমি এখন ব্যান্ডেলে থাকি, স্কুলে পড়াই।

আপনার বাবা–।

কলেজে পড়াতেন। অবসর নিয়েছিলেন। ছবছর আগে মারা গিয়েছেন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। বাবার এক সহযোগীর ছেলের নাম অর্ক।

হতেই পারে। আমি একজন আইএএস অফিসারের নাম কাগজে পড়েছি যাঁর নাম অর্কপ্রভ দেব। তিনি অবশ্য আমার বাবার বয়সি ছিলেন।

আপনার বাবা কী করতেন?

অর্ক একটু চুপ করে বলল, কিছু না। কিছু করার ক্ষমতা তার নেই।

বুঝলাম না।

একাত্তরের আন্দোলনে ধরা পড়ার পর পুলিশ তাঁকে পঙ্গু করে দিয়েছিল। অনেকদিন জেলে থাকার পর বেরিয়ে এসেও হাঁটতে পারেননি। এখন অবশ্য ক্রাচ নিয়ে হাঁটেন। অর্ক গুরুমায়ের দিকে তাকাল, আপনার এখানে সবাই। এত শৃঙ্খলা মেনে চলেন যা বাইরে বেশি দেখা যায় না।

তাই বুঝি। গুরুমা হাসলেন, ওরা সবাই খুব ভাল। কতবার এখানে পুলিশ এসে দেখতে চেয়েছে ওদের মধ্যে কেউ ছদ্মবেশে লুকিয়ে আছে। কিনা। না পেয়ে খুব হতাশ হয়েছে। জেলাশাসক এসে অবশ্য দুঃখ প্রকাশ করে গিয়েছেন।

ছদ্মবেশে কারা লুকিয়ে আছে বলে ওরা ভেবেছিল?

ওই যারা মনে করে যেভাবে দেশ চলছে সেভাবে চললে গরিব মানুষরা আরও গরিব হবে। তাই তারা উগ্র পথ ধরেছে। গুরুমা বললেন, আমি বলি শরীরে যদি টিউমার তৈরি হয় তা হলে ছুরি চালিয়ে সেটা বাদ দিলেই তো সেরে যাবে না, আবার একটা জায়গায় সেটা মুখ তুলবে। অসুখটা সারাতে ঠিকঠাক ওষুধ দিতে হবে শরীরে। ভেতর থেকে রোগটাকে নির্মূল না করলে রোগ সারে?

অর্ক মুগ্ধ হল কথাটা শুনে। কিন্তু ভেতর থেকে নির্মূল করার জন্যে যে ওষুধ দরকার তা কি প্রশাসনের কাছে আছে? সে কিছু বলল না।

আপনারা কি বহুদিন কলকাতায় আছেন? কুন্তী জিজ্ঞাসা করল। কিছু মনে করবেন না, আপনি বললেন আপনার বাবা একাত্তরের আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। আমার বাবাও এম এ পরীক্ষা দিয়ে সেই আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। বছর খানেক জেলেও ছিলেন। পরে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পরে উনি সরকারি কলেজে চাকরি পান।

কোন জেলে ছিলেন?

বহরমপুরে।

কী নাম ওঁর?

অবনী সেন। কুন্তী বললেন, সিপিএম থেকে ওঁকে প্রস্তাব দিয়েছিল দলের হয়ে কাজ করতে কিন্তু উনি রাজি হননি।

অর্ক গুরুমায়ের দিকে তাকাল, আচ্ছা, আপনি তো আমাদের সম্পর্কে কিছুই না জেনে আশ্রয় দিয়েছেন। পুলিশ যদি এখন এসে আমাদের ধরে

আপনার কৈফিয়ত চায় তা হলে কী বলবেন?

পুলিশের মুখোমুখি যদি হতে না চাও তা হলে আমার বিশ্বাস তোমরা আমাকে অপদস্থ করবে না। ওই অজয় নদের ওপারের জঙ্গলে স্বচ্ছন্দে চলে যেতে পারবে। তবে পুলিশ চলে যাওয়ার পর যদি এখানে তোমরা ফিরে আসো তখন তোমাদের থাকতে দেওয়ার ব্যাপারে আমাকে ভাবতে হবে। সকালে তোমাকে বলেছিলাম অজয়ের ধারে ঘুরে দেখে আসতে। ইচ্ছে হলে দেখে এসো। গুরুমা উঠলেন, এবার আমাকে তৈরি হতে হবে। তোমরা আসতে পারো। কুন্তী, তুমি আজই ফিরে যেতে চাইছ?

হ্যাঁ। বোলপুরে এক বান্ধবীর বাড়িতে রাত্রে থাকব।

দ্যাখো। যদি মনে করো, এখানেও থাকতে পারো। আমার এই এখানে। গুরুমা সামনের ঘরটি আঙুল তুলে দেখিয়ে ভেতরে চলে গেলেন।

রোদ মরে আসছে। অর্ক বলল, আচ্ছা, চলি।

কুন্তী বললেন, একটু দাঁড়ান, আপনার বাবার নাম কি অনিমেষ?

হ্যাঁ। আপনার বাবা তা হলে আমার বাবাকে চিনতেন?

নিশ্চয়ই। বাবার কাছে আপনার মায়ের কথাও শুনেছি। প্রচুর স্যাক্রিফাইস করেছেন মহিলা। কুন্তী বললেন।

অর্ক কিছু বলল না।

আর তা হলে আপনিই সেই অর্ক। কুন্তী হাসলেন।

পৃথিবী খুব ছোট জায়গা।

তাই তো দেখছি। পনেরো-ষোলো বছরে শোনা গল্পটা আজ আপনাকে দেখে নতুন করে মনে পড়ছে। খুব ভাল লাগছে।

অর্ক তাকাল, আপনি কি গুরুমায়ের শিষ্যা?

আমি? বুকে আঙুল রেখে মাথা নাড়লেন কুন্তী, প্রথাগত দীক্ষা নিয়ে শিষ্যা আমি হইনি। কোনও কোনও মানুষ যখন কথা বলেন তখন শুনলে ভেতরটা পরিষ্কার হয়ে যায়। এক অর্থে তিনি নিশ্চয়ই গুরু হয়ে যান। এরকম গুরু আমার কয়েকজন আছেন। তাদের আমি চোখেও দেখিনি।

যেমন?

রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, কার্ল মার্কস।

সে কী? ওই দুজনের পাশে কার্ল মার্কস?

কেন নয়? আপনি দাস ক্যাপিটাল পড়েছেন?

না।

আলোচনা থাকায় একবার এই আশ্রমে চাই না। কিন্তু

তা হলে এই আলোচনা থাক। কুন্তী বললেন, আমি মাঝে মাঝে বোলপুরে আসি। যখনই আসি তখনই একবার এই আশ্রমে এসে গুরুমায়ের সঙ্গে দেখা করে যাই। ওঁর অতীত আমি জানি না, জানতেও চাই না। কিন্তু এলে ভাল লাগে।

অর্ক বলল, আচ্ছা। তা হলে এখন চলি।

আপনি কি প্রার্থনাতে যোগ দিচ্ছেন?

প্রার্থনা?

মন্দিরের সামনে সবাই একত্রিত হন। পুজো শুরুর আগে গুরুমাকে সামনে রেখে কিছুক্ষণ ধ্যান করেন। তারপর গুরুমা উপদেশ দেওয়ার পর নিজের হাতে মায়ের পুজো করেন। ওই পুরো ব্যাপারটাকেই এখানে প্রার্থনা বলা হয়।

না। আমি এখন অজয় নদের চরে যেতে চাই। গুরুমা আমাকে বেশ কয়েকবার ওখানে যাওয়ার কথা বলেছেন। আচ্ছা, এলাম।

অর্ক ঘর পেরিয়ে বাইরে আসতেই বৃদ্ধ শিষ্যকে দেখতে পেল। ইতিমধ্যে তার পোশাকের পরিবর্তন হয়েছে। গেরুয়া পাঞ্জাবি এবং লুঙ্গিতে তাকে ঈশ্বরভক্ত বলেই মনে হচ্ছিল। বললেন, প্রার্থনার পর এখানে চা এবং সামান্য জলযোগের ব্যবস্থা করা হয়। দূর থেকেই ঘণ্টার ধ্বনি শুনতে পাবেন। অন্য সময় এক-দুবার বাজলেও সে সময় পরপর সাতবার বাজবে।

মাথা নেড়ে এগিয়ে যেতেই অর্ক তরুণ শিষ্যকে দেখতে পেল। বেচারা সম্ভবত তখন থেকে এখানেই অপেক্ষা করছিল। দুবার ঘণ্টাধ্বনি হতে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, এখনই প্রার্থনা আরম্ভ হবে?

হ্যাঁ, সবাই মন্দিরে পৌঁছে গিয়েছেন। অতিথিরাও অংশ নিতে পারেন। আপনি কি সেখানে যাবেন না ঘরে ফিরবেন?

ঘরেই ফিরব।

অর্ককে পৌঁছে দিয়ে তরুণ শিষ্য দ্রুত চলে গেল প্রার্থনায় যোগ দিতে। এই যে ছেলেটি তাকে একটা সীমা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিল এবং আবার ফিরিয়ে আনল, এটা নিশ্চয়ই স্ব-ইচ্ছায় করেনি। তা হলে কি আশ্রমের মধ্যে বহিরাগতদের চলাফেরা এঁরা নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান? এখানকার শেষ কথা যখন গুরুমাই বলেন তখন নির্দেশটা তারই। কেন?

রামজিকে ঘুম থেকে তুলল অর্ক। বলল, চলুন নদীর চরে যাব।

এখন রামজি অনেকটা চাঙ্গা। বাইরে বেরিয়ে এসে বলল, ঘুমটা দরকার ছিল।

অর্ক রসিকতা করল, যে কাজে এসেছেন তাতে কি এভাবে ঘুমোনোর সুযোগ পাবেন? এখান থেকেই তো ছুটতে হবে সুন্দরবনে।

হাঁটতে হাঁটতে রামজি বলল, যতদূর জানি সেখানে তো খাল আর তারপর সমুদ্র। কুমির আর বাঘ আছে প্রচুর। মুশকিল হল আমি সাঁতার জানি না।

জেনেও কোনও লাভ হত না। সুন্দরবনের নদী বা খালে সাঁতরানো যায় না।

অর্ক নদীর ধারে এসে দাঁড়াল। যতই অজয়কে নদ বলা হোক অন্যমনস্ক মন নদীই বলে চেনে। এদেশের যাবতীয় নদীর নাম স্ত্রীলিঙ্গের পরিচায়ক, পুরুষ নাম হলেই নদ হয়ে যায়। কোনও মানে হয় না।

ওরা চরে নামল। রুপোলি বালির ওপর দিয়ে বিকেলের বাতাস বইছে, খানিকটা হাঁটার পর জলের ধারা। কোথাও হাঁটুর ওপরে কোথাও গোড়ালি ডোবা। ওরা জায়গা বেছে নিয়ে জল পেরিয়ে আবার বালির চরে আসতেই খানিকটা দূরে দুটো শেয়াল তাদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অর্ক হেসে ফেলল।

হাসছেন কেন? রামজি জিজ্ঞাসা করল।

জলপাইগুড়িতে আমার ঠাকুমার পোষা শেয়াল আছে।

শেয়াল পোষ মানে?

তাই তো দেখে এলাম। বলতে বলতে অর্ক দেখতে পেল আশ্রমের দিক থেকে কেউ একজন দুহাতে জিনিস নিয়ে দৌড়ে এদিকে আসছে। চিৎকার করছে লোকটা। আর একটু কাছে আসতেই চিনতে পারল অর্ক, সেই তরুণ শিষ্য হাঁপাতে হাঁপাতে আসছে, দুহাতে ওদের দুজনের ব্যাগ। জল পেরিয়ে এসে সে একটু দম নিয়ে বলল, আপনারা তাড়াতাড়ি ওই জঙ্গলের ভেতর চলে যান।

কেন?

খবর এসেছে পুলিশ আবার সার্চ করতে আসছে। ছেলেটি শ্বাস ফেলছিল দ্রুত, ওই জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দুই মাইল গেলে বর্ধমানের রাস্তা পেয়ে যাবেন, পুলিশ চলে গেলে কুন্তীদিদি ওই রাস্তায় গাড়ি নিয়ে যাবেন। আমি চলি। পুলিশ আসার আগেই আশ্রমে ফিরতে হবে। তরুণ শিষ্য যেভাবে এসেছিল সেইভাবে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করল, যদিও এখন গতি অনেক কম।

দ্রুত বালির চর ভেঙে ওরা জঙ্গলে ঢুকে গেল। তারপর ঘুরে দেখল ছেলেটি তখনও ওপারে পৌঁছায়নি। রামজি জিজ্ঞাসা করল, পুলিশ কী করে আমাদের কথা জানতে পারল? তার মানে ওদের চর আমাদের সঙ্গে সঙ্গে কলকাতা থেকে এখানে এসেছে?

না। তা হতে পারে না। আশ্রমের কেউ নিশ্চয়ই পুলিশকে জানিয়েছে। কিংবা আমরা আশ্রমে ঢোকার আগে লোকাল লোক যারা দেখেছিল তাদের মধ্যে পুলিশের ইনফর্মার ছিল। আবার দেখুন, পুলিশের কেউ আশ্রমে খবরটা পৌঁছে দিয়েছে বলে ছেলেটা দৌড়ে এল। চলুন, হাঁটা যাক। পুলিশ আমাদের ওখানে না পেলে নিশ্চয়ই নদীর এপাশে আসবে। অর্ক হাঁটতে শুরু করল।

আর একটু পরে তো সব অন্ধকারে ঢেকে যাবে, কোথায় খুঁজবে ওরা? রামজি হাসল, অন্ধকার ঘন হওয়ার আগেই আমরা যতটা পারি এগিয়ে যাই।

এই জঙ্গল ঘন নয়। মাঝে মাঝে কিছু বড় গাছ থাকলেও বেশিরভাগ জায়গায় ঝোঁপ এবং লতানো গাছের জঙ্গল। অবশ্য একটা পায়ে চলা পথ। পেয়ে ওদের হাঁটতে সুবিধে হচ্ছিল।

কিন্তু সেই সমস্ত চরাচর অন্ধকারে ডুবে গেল, শিয়ালগুলো ডেকে উঠল সমস্বরে, সন্ধ্যাতারা লাফিয়ে উঠল আকাশের কোনায় অমনি ওরা দাঁড়িয়ে গেল। অর্ক জিজ্ঞাসা করল, আপনার কাছে কি টর্চ আছে?

না। পায়ে হাঁটি, চলুন।

কিন্তু এই পায়ে হাঁটা পথ যে বর্ধমানের রাস্তার দিকে যাচ্ছে তার নিশ্চয়তা কী?

তা ঠিক। তা হলে এক কাজ করি। এখানেই রাতটা কাটিয়ে ভোরের জন্যে অপেক্ষা করি। রামজি বলল।

সেটা ঠিক হবে না। দিনের আলোয় জঙ্গল থেকে বের হলে যে কেউ সন্দেহ করবে। চলুন। অর্ক এগোল। মাঝে মাঝেই ঝোঁপের পাতায় শরীরে। জ্বলুনি ধরছিল। রাত দশটা নাগাদ ওরা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে অজয় নদের পাশ দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পরে দূরে গুমগুম আওয়াজ শুনে তাকিয়ে দেখল একটা সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন চলে যাচ্ছে।

কাছে এলে ওরা পাশাপাশি গাড়ি চলার সেতুটাকে দেখতে পেয়ে রাস্তার ওপর উঠে গাছের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল। অর্ক বলল, এই দিকটা দিয়ে গেলে বর্ধমানে পৌঁছোনো যাবে।

কতটা দূর? রামজি জিজ্ঞাসা করল।

বোলপুর অনেক কাছে। গেলে ঝুঁকি নিতে হবে।

রামজি তাকাল। বোলপুরের দিক থেকে একটা বড় গাড়ি আসছে। তার হেডলাইটের আলো বেশ তীব্র। রামজি দ্রুত রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাত নাড়তে লাগল ওটাকে থামার জন্যে। গতি কমাচ্ছে না দেখে বাধ্য হয়ে সরে এল সে।

অর্ক বলল, কেউ থামবে না ডাকাতির ভয়ে।

তা হলে?

যা হওয়ার তা হবে। চলুন বোলপুরের দিকেই হাঁটি।

ওরা মিনিট পনেরো হাঁটার পর রাস্তার ধারে একটা গাড়িকে হেডলাইট জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। সামনের সিটে একজন ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা বসে। অর্করা শুনল, হঠাৎ গাড়িটার স্টার্ট বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ভদ্রলোক গাড়ির মেকানিজম জানেন না। সঙ্গে সঙ্গে রামজি বনেট তুলে পরীক্ষা শুরু করলে অর্ক বলল, গাড়ি ঠিক হয়ে গেলে আমাদের বর্ধমান পর্যন্ত লিট দেবেন?

ভদ্রলোক উত্তর দেওয়ার আগেই ভদ্রমহিলা বললেন, নিশ্চয়ই দেব।

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার