রামজির কৃতিত্বে গাড়ির ইঞ্জিন প্রাণ ফিরে পেলে ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা ঠিক কোথায় যেতে চাইছেন?

অর্ক বলল, আমরা কলকাতায় যাব, আপনারা যদি বর্ধমানে নামিয়ে দেন! ভদ্রমহিলা বললেন, উঠে পড়ুন। ওরা পেছনের দরজা খুলে উঠে বসার পর ভদ্রলোক গাড়ি চালু করলেন। অর্ক লক্ষ করছিল, এতক্ষণ ভদ্রলোক কোনও কথা বলেননি, ভদ্রমহিলাই যা বলার বলছেন।

গাড়ি চলছিল অন্ধকার চিরে। রামজি একটা বড় শ্বাস ফেলল। ওটা যে স্বস্তির শ্বাস তা বুঝতে অসুবিধে হল না। ভদ্রমহিলা অন্ধকার গাড়িতেই মুখ ঘোরালেন, আপনারা ওরকম জায়গায় কী করছিলেন?

পাশেই তো অজয় নদ। ওখানে সুন্দর একটা বাংলো আছে, বেড়াতে এসেছিলাম। একটু আগে ওর বাড়ি থেকে ফোন এল, কারও অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। কার হয়েছে জানার আগেই লাইন কেটে গেল। তারপর কিছুতেই আর যোগাযোগ করা গেল না। তাই তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এসেছি, যা পাব তাতেই কলকাতায় ফিরতে চাই। চটজলদিতে মিথ্যে বলল অর্ক। এ ছাড়া আর কিছু মাথায় আসেনি।

ভদ্রমহিলা বললেন, আশা করি দুর্ঘটনায় খারাপ কিছু ঘটেনি। আপনারা এলে হয়তো সারারাত ওই জায়গায় বসে থাকতাম আমরা। কিন্তু বর্ধমানে যাবেন বলছেন কেন?

কাছাকাছি বলে। ওখান থেকে ট্রেন ধরব।

আপনারা বর্ধমানে যেতে চাইলে নামিয়ে দিতেই পারি। কিন্তু আমরা শহরে ঢুকে বাইপাস ধরতাম, আমরা যাব নরেন্দ্রপুর। ভদ্রমহিলা বললেন।

বাঃ। খুব ভাল। আপনাদের তো কলকাতা দিয়েই যেতে হবে।

হ্যাঁ। বিদ্যাসাগর সেতু দিয়ে ঢুকব। ভদ্রমহিলা এবার সামনে ফিরে সিডি অন করলেন। দেবব্রত বিশ্বাসের গলায় গান বেজে উঠল।

অর্ক ভেবে নিল, কলকাতায় পৌঁছোতে মধ্যরাত হয়ে যাবে। তখন রামজিকে সঙ্গে নিয়ে বেলগাছিয়ায় যাওয়া ঠিক হবে না। ঈশ্বরপুকুর লেনের বাসিন্দাদের কেউ না কেউ ফুটপাতে জেগে থাকে। অথচ অত রাতে ওকে শহরের রাস্তায় ছেড়ে দেওয়াও যাবে না। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করবেই। অর্ক ভেবে পাচ্ছিল না কোথায় ওকে রাখা যায়। তার পাশে বসে আছে রামজি একদম নিশ্চিন্ত হয়ে। এরকম ছেলে কী করে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসে তা বোঝা মুশকিল।

ভদ্রমহিলা বললেন, আজকের খবর শুনেছেন?

না।

সে কী! ভয়ংকর খবর। নন্দীগ্রামে পুলিশ গুলি চালিয়েছে। গ্রামবাসীরাও পালটা লড়াই করেছে। গুলি চলেছে দুপক্ষ থেকে। শুনলাম হতাহত প্রচুর। বামফ্রন্ট এত বড় ভুল কী করে করল জানি না। ভদ্রমহিলা মাথা নাড়লেন।

গ্রামবাসীরাও গুলি চালিয়েছে? অর্ক অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করল।

সিপিএম বলছে তৃণমূলের সঙ্গে মাওবাদীরা হাত মিলিয়েছে। সেইসব মাওবাদীরাই গুলি চালিয়েছে। সত্যি মিথ্যে জানি না, কিন্তু গ্রামের মানুষ তাদের জমি হাতছাড়া করবে না বলে যে আন্দোলন করেছে তাদের ওপর সরকার কেন গুলি চালাবার অর্ডার দেবে? ছিঃ।

আড়চোখে রামজিকে দেখল। কথাগুলো রামজির কাছে এখন আর অবোধ্য নয়। অর্কর মনে হল নন্দীগ্রাম বামফ্রন্টের একটা টার্নিং পয়েন্ট হয়ে যাবে। যে-কোনও ক্ষমতা তা রাজনৈতিক হোক, ব্যবসায়িক হোক বা শারীরিক, তার একটা চূড়ান্ত সীমা থাকে। সেই সীমায় ওঠার পর পতন শুরু হলে আর আটকানো যায় না।

রাত একটা নাগাদ বিদ্যাসাগর সেতুর টোলট্যাক্স দিয়ে গাড়ি কলকাতায় ঢুকল। ভদ্রলোক কোনও কথা বলেননি এই সময়ের মধ্যে। ভদ্রমহিলাও অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ গান শুনে গেছেন। একবার জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় নামবেন আপনারা?

আপনারা কি গড়িয়া হয়ে নরেন্দ্রপুর যাবেন? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

হ্যাঁ।

তা হলে গড়িয়াতেই নামিয়ে দিন।

ওমা! আপনারা ওখানেই থাকেন?

আমি নই। এর বাড়ি।

উনি তো গাড়িতে ওঠার পর কথাই বললেন না।

মন খারাপ, ভয় পেয়ে গেছে।

গড়িয়ার মোড়ে গাড়ি থামলে ওরা নেমে পড়ল। ভদ্রমহিলাকে ধন্যবাদ দিয়ে অর্ক ভদ্রলোকের কাছে গিয়ে বলল, আপনার সঙ্গে আলাপ হল না।

কী দরকার? ওঁর সঙ্গে তো কথা বললেন। ভদ্রলোক গিয়ার টানলেন।

আপনার পরিচয়টা–।

ভদ্রমহিলা হাসলেন, উনি একজন আইপিএস অফিসার।

গাড়ি বেরিয়ে গেলে রামজির মুখ থেকে ছিটকে এল, বাঁচ গিয়া।

একজন আইপিএস অফিসার আমাদের লিস্ট দিলেন। বাঃ। দারুণ ব্যাপার। অর্ক বলল, এখন এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে জেলে যেতে হবে।

রামজি জিজ্ঞাসা করল, এখানে কোনও রেলওয়ে স্টেশন নেই?

অর্ক চিন্তা করল। গড়িয়াতে একটা রেলের স্টেশন আছে। কিন্তু সেটা কোথায় তা তার জানা নেই। রাস্তায় কোনও লোক নেই যে জিজ্ঞাসা করে জানা যাবে। সে একটা বন্ধ দোকানের শেডের নীচে রামজিকে নিয়ে চলে এল। বলল, কোনও উপায় নেই। এখানেই বসে পড়ুন। সামনে লরিটা থাকায় রাস্তা থেকে চট করে কেউ দেখতে পাবে না।

ওরা ধুলো ভরতি ফুটপাতে বাবু হয়ে বসে পড়ল। রামজি বলল, রাস্তায় কত ধাবা ভোলা ছিল, ওরা গাড়ি থামাল না।

খিদে পেলে কিছু করার নেই।

এই সময় রামজির মোবাইল বেজে উঠলে সে তাড়াতাড়ি শব্দটাকে থামিয়ে কানে চাপল, হ্যালো। তারপর ওপাশের কথা শোনার পর আচ্ছা বলে মোবাইল অফ করে জিজ্ঞাসা করল, এখান থেকে খঙ্গাপুরে কী করে যাব?

এই তো যাচ্ছিলেন সুন্দরবনে। চেঞ্জ হয়ে গেল? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

রামজি বলল, সেখানে যে জন্যে যাওয়ার কথা ছিল সেই কাজটা শেষ হয়ে গিয়েছে। তাই খড়গপুরে যেতে বলল।

কোনও ঠিকানা বলেছে?

হ্যাঁ। স্টেশনের বাইরে গিয়ে লালকেবিন চায়ের দোকানে গিয়ে বাসুদেব নামের একজনকে খোঁজ করলেই কোথায় যেতে হবে বলে দেবে। কথাগুলো বলেই রামজি এই রে বলে চুপ করে গেল। অর্ক জিজ্ঞাসা করল, কী হল?

এইসব কথা গুপ্ত রাখতে আমাদের শেখানো হয়েছিল। সরল গলায় বলল রামজি।

বাঃ, চমৎকার! আমি আপনাকে বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে পাড়ার লোকদের মনে সন্দেহ তৈরি করলাম, আপনার বিপদ বুঝে এখানে ওখানে নিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নিলাম অথচ আপনি আমাকেই একথা বললেন? ঝাঁঝিয়ে উঠল অর্ক।

না না। ভুল বুঝবেন না। আমার মাথা কাজ করছে না।

আমি একটা কথা বলব, শুনবেন?

বলুন।

আপনি হাজারিবাগে ফিরে যান।

ফিরে যাব?

হ্যাঁ। গিয়ে আগে যা করতেন তাই করুন। আপনার পক্ষে এই আগুনস্রোতে ভাসা বোধহয় সম্ভব নয়। আপনার মনের গঠন সেরকম নয়।

রামজি কথা বলল না কিছুক্ষণ। মাঝে মাঝে কিছু গাড়ি হেডলাইট জ্বেলে ছুটে যাচ্ছে দুপাশে। তাদের মধ্যে পুলিশের গাড়ি থাকা খুবই স্বাভাবিক। রামজি বলল, আপনি সেইসব মানুষদের দেখেছেন যারা কেন বেঁচে আছে। তা নিজেরাই জানে না। জঙ্গল থেকে পাতা কুড়িয়ে এনে যারা বিক্রি করে শুধু ভাত খেয়ে বেঁচে থাকবে বলে, তাদের দেখেছেন? আরও কিছু মানুষ এই ভারতবর্ষে আছে যারা বহুকাল ভাতের গন্ধ পায়নি, তাদের দেখেছেন?

দেখিনি, তবে জেনেছি। অর্ক বলল।

কিছুই জানা যায় না যতক্ষণ নিজের চোখে না দেখছেন। মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া থেকে শুরু করে বিহারের কিছুটা আর ঝাড়খণ্ডের অনেকটা অঞ্চল জুড়ে এদের বাস। কোনও সরকার এদের জন্যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। এদের জন্যে টাকা বরাদ্দ হলে সেটা রাজনৈতিক নেতা আর প্রশাসন নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিয়েছে বছরের পর বছর। গ্রামে জল নেই। এক কলসি জল আনতে তিন ক্রোশ হাঁটতে হয়। এতদিন ওরা জানত এটাই জীবন। এইভাবেই বেঁচে থেকে মরে যেতে হবে। কিন্তু এখন ওরা বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছে যে অন্যভাবে বেঁচে থাকা যায়। তার জন্যে মাথা নিচু করে মেনে না নিয়ে অধিকার কেড়ে নিতে হবে। রামজি মাথা নাড়ল, একটাই তো জীবন। অলসভাবে নিজের জন্যে এই জীবনটা কাটিয়ে দিতে আমি চাই না। ওই মানুষগুলোর জন্যে কাজ করতে চাই। আমার মনের ইচ্ছা আপনার কাছে যাই মনে হোক আমি ঠিক এই কাজটা করে যেতে পারব। আপনাকে অনেক বিরক্ত করেছি। কোন বাসে উঠলে আমি এখান থেকে খড়গপুরে যেতে পারব সেটা বলে দিন।

অর্ক শ্বাস ফেলল, এখান থেকে খঙ্গপুরে যেতে হলে আপনাকে প্রথমে হাওড়া স্টেশনে যেতে হবে। সেখান থেকে ট্রেন ধরে খড়গপুর। ট্রেনে ঘণ্টা আড়াই বোধহয় লাগে। কিন্তু হাওড়া স্টেশনে যাওয়ার ঝুঁকি কি আপনি নেবেন?

আর কোনও উপায় আছে?

ময়দান থেকে খঙ্গপুরের বাস পেতে পারেন।

রামজি একটু ভাবল। তারপর বলল, ভোর-ভোর স্টেশন পৌঁছেলে মনে হয় ঝুঁকি তেমন থাকবে না। আমাকে তো খড়গপুর স্টেশনের বাইরেই যেতে হবে।

আলো ফোঁটার আগেই বাস চলাচল শুরু হয়ে গেল। গড়িয়া-হাওড়া মিনিবাসে উঠল ওরা। রামজি টিকিট কাটল হাওড়ার, অর্ক ধর্মতলার। নামবার

আগে অর্ক বলল, সাবধানে থাকবেন।

আপনিও। হাতে হাত রাখল রামজি, ভুলে যাবেন না।

.

তালা খুলে উঠোনে ঢুকে আঁতকে উঠল অর্ক। উঠোন, বারান্দা এত নোংরা হয়ে আছে যে এই সময় মা যদি আসত তা হলে কুরুক্ষেত্র হয়ে যেত। জামা প্যান্ট ছেড়ে পাজামা পরে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে সব পরিষ্কার করল অর্ক। করতে করতে মনে পড়ল গলি দিয়ে আসার সময় বুড়িটাকে দেখতে পায়নি আজ। এরকম তো সাধারণত হয় না। এই সময় বাইরের দরজায় শব্দ হতে সে এগিয়ে গিয়ে সেটা খুলল, বিশ্বজিৎ দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি উঠোনে ঢুকে জিজ্ঞাসা করল, কোথায় ছিলেন দাদা?

এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলাম। কেন? অর্ক অবাক।

আপনার বাড়িতে যিনি ছিলেন তিনি কি মাওবাদী?

তার মানে?

মনে হচ্ছে সুরেনদা থানায় কথাটা জানিয়েছে। রোজ দুবার পুলিশ এসেছে আপনার খোঁজ করতে। আপনি তো কোনও রাজনীতি করতেন না। আপনাকে ফাঁসিয়ে সুরেনদার কী লাভ হবে জানি না। আমরা শিগগিরই ক্ষমতায় আসব। তখন সুরেনদাদের কী হাল করব দেখবেন। বিশ্বজিৎ বলল।

বামফ্রন্টকে হারিয়ে আপনারা ক্ষমতায় আসবেন?

ওদের মৃত্যুঘণ্টা বেজে গেছে। নন্দীগ্রামে গুলি চালিয়ে মানুষ মেরেছে। বাংলার প্রতিটি নির্যাতিত মানুষ দিদিকে সমর্থন করছে। বিশ্বজিৎ বলল, আমার মনে হয় আপনার থানায় যাওয়া দরকার। পুলিশ কেন খোঁজ করছে

তা প্রশ্ন করুন। আপনি যদি চান তা হলে আমি সঙ্গে যেতে পারি।

আপনি?

বিশ্বজিৎ হাসল, কদিন আগে সুরেনদা আর তার লালপার্টি ছাড়া পুলিশ কাউকে পাত্তা দিত না। আমাদের সঙ্গে তো চাকরবাকরের চেয়ে খারাপ ব্যবহার করত। এখন হেসে কথা বলছে, অনেকটা পিঁপড়ের মতো।

বুঝলাম না।

আকাশে মেঘ জমার আগে দেখবেন পিঁপড়েরা মাঝে মাঝে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যে লাইন বেঁধে বেরিয়ে পড়ে। ওরা ঠিক টের পায় বৃষ্টি আসছে। গ্রামের মানুষ ওদের দেখে আকাশের দিকে তাকায়। এই পুলিশগুলো ঠিক পিঁপড়েদের মতো। ক্ষমতা বদলের গন্ধ আগাম টের পায়।

বেশ। কখন যাবেন বলুন?

ঘড়ি দেখল বিশ্বজিৎ। হাসল, এখন তো বড়বাবুর ঘুম ভাঙেনি। বেলা এগারোটা নাগাদ চলুন। কিন্তু আপনি নিশ্চিত তো লোকটা মাওবাদী নয়?

আমি এখনও ঠিক জানি না কে মাওবাদী, কে নয়। অর্ক বলল।

একদম ঠিক। দিদির কথা শোনেননি? বিশ্বজিৎ জিজ্ঞাসা করল।

কোন কথাটা?

পশ্চিমবাংলায় মাওবাদী বলে কেউ নেই। সিপিএমই মাওবাদী সেজে ভয় দেখাচ্ছে। তবু শিয়োর হওয়ার জন্যে জিজ্ঞাসা করলাম।

বিশ্বজিৎ, আপনাকে আমি কতটুকু চিনি? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

একই এলাকায় থাকি। আগে কংগ্রেস করতাম। দেখলাম কংগ্রেসের কোনও ভবিষ্যৎ নেই। তার চেয়ে দিদি তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি করে মানুষের পাশে প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের জন্যে কাজ করতে হলে দিদির নেতৃত্ব চাই। তাই আমি তৃণমূলে এসেছি। এটা তো আপনার অজানা থাকা উচিত নয়। বিশ্বজিৎ বলল।

নিশ্চয়ই। তবে এসব তো শোনা কথা। গোপনে গোপনে আপনি তো মাওবাদী কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন। আমি জানব কী করে?

এটা কী বললেন আপনি? বিশ্বজিৎ উত্তেজিত, আপনি আমার সততা সম্পর্কে সন্দেহ করছেন?

মোটেই না। আমি বলতে চাইছি, যিনি আমার কাছে ছিলেন তিনি যদি মাওবাদী হন তা হলে সেটা আমাকে জানাননি। আমি জানব কী করে? তা ছাড়া, আপনি এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? পশ্চিমবাংলায় যখন কোনও মাওবাদী নেই তখন আপনার পক্ষে তো সেটা হওয়া সম্ভব নয়। অর্ক হাসল।

ও, তাই বলুন। এটা রসিকতা। সিপিএম এখন যাকে ফাঁসাতে চায় তার ওপর মাওবাদী তকমা লাগিয়ে দিচ্ছে। কী রাজত্বে আছি, বলুন? বিশ্বজিৎ আবার ঘড়ি দেখল, ঠিক আছে সাড়ে এগারোটার সময় আমি থানায় পৌঁছে যাব। লেট করবেন না প্লিজ, চলি।

সারারাত টেনশনে না ঘুমিয়ে শরীরে আর জুত ছিল না। কোনওমতে চা বিস্কুট খেয়ে শুয়ে পড়ল অর্ক। তখনই তার মনে হল অনেকদিন বাবা-মায়ের খবর নেওয়া হয়নি। সে মোবাইল তুলে নাম্বার টিপল, আউট অব রিচ। পরপর দুবার একই কথা কানে এল। ওটা রেখে বালিশে মাথা রাখল অর্ক।

.

ছোটমায়ের নামে মহীতোষ মিত্রের সম্পত্তি আইনসম্মতভাবে করে দিলেন মিস্টার রায়। বললেন, অনিমেষবাবু, আপনার বাবার শেষ ইচ্ছে পূর্ণ করতে পেরে খুব ভাল লাগছে। কাগজপত্র কিছুদিনের মধ্যেই পেয়ে যাবেন আপনার মা।

এতদিন জানা ছিল খারাপ খবর বাতাসের আগে ওড়ে কিন্তু আজ দেখা গেল ভাল খবরও খোঁড়া নয়। স্বপ্নেন্দু দত্ত চলে এলেন এক হাঁড়ি রসগোল্লা নিয়ে। সেটা মাধবীলতার হাতে দিয়ে বললেন, খবরটা পেয়ে যে কী আনন্দ হল বোঝাতে পারব না। শেষ ভাল যার সব ভাল…।

এখনও কি শেষ ভাল বলার সময় এসেছে? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

আর বাকি রইল কী? স্বপ্নেন্দু জিজ্ঞাসা করলেন।

পার্টিকে কীভাবে ম্যানেজ করবেন?

ম্যানেজ তো হয়েই গেছে। আপনি কোনও খবর রাখেন না?

কী ব্যাপারে?

পুলিশের হাতে ধোলাই খেয়ে এই পাড়ার ক্লাব বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সেই ছেলেগুলোকে তাদের বাপ-মা অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছে। কানাঘুষোয় শুনলাম ওপর থেকে নির্দেশ এসেছে, আপনার বাড়ির ব্যাপারে কেউ যেন নাক না গলায়। শুনলাম মুখ্যমন্ত্রী নাকি আপনার সহপাঠী ছিলেন? স্বপ্নেন্দু গদগদ গলায় বললেন।

সমসাময়িক ছিলেন।

ইস। আপনি ওঁকে ব্যাপারটা জানালে এত ঝামেলাই হত না।

আপনি কী করে ভাবলেন যে উনি আমাকে দেখা করার অনুমতি দিতেন? তা ছাড়া ওঁর কাছে গিয়ে কিছু চাইতে হলে অনেক আগেই চাইতে পারতাম।

মাধবীলতা বলল, তাই যদি বলো, তুমি তো জেলা কমিটির সম্পাদকের কাছে গিয়ে সাহায্য চেয়েছিলে?

দুটো এক কথা হল না। জেলার লোক হিসেবে জেলা কমিটির সম্পাদকের কাছে যাওয়ার অধিকার আমার আছে। সমসাময়িক একজন সিপিএম নেতার কাছে নিজের প্রয়োজনে যাব ভাবতেই পারি না। অনিমেষ বলল।

তা হলে এবার আমরা কাজটা সেরে ফেলি? স্বপ্নেন্দু বললেন।

হ্যাঁ, মাধবীলতা বলল, আপনি কাগজপত্র তৈরি করুন।

স্বপ্নেন্দু চলে গেলে মাধবীলতা বলল, ছোটমায়ের সঙ্গে আর একবার কথা বলা দরকার। গতকাল ওখান থেকে ফিরে খুব খুশিখুশি দেখেছিলাম। ওঁর কী ইচ্ছে তা জিজ্ঞাসা করো।

তুমিই করো। অনিমেষ বলল।

মাধবীলতা ছোটমায়ের ঘরে গিয়ে অবাক হল। আলমারি থেকে একটার পর একটা রঙিন শাড়ি বের করছেন ছোটমা। মাধবীলতাকে দেখে তিনি বললেন, অনেক শাড়ি, কখনও পরিনি। পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। ঠিক করলাম আশ্রমে দিয়ে দেব। ওখানকার অনেকেই তো রঙিন শাড়ি পরেন।

আশ্রমটাকে আপনার মনে হচ্ছে ভাল লেগেছে।

খুউব। ছোটমা মাথা নাড়লেন।

আমরা চলে গেলে ওখানে গিয়ে থাকতে চান?

আমাকে কি দেবেশবাবু থাকতে দেবেন?

কথা বলব।

দ্যাখো।

মাধবীলতার মুখে কথাগুলো শুনে দেবেশকে ফোন করল অনিমেষ। বলল, খুব তাড়াতাড়ি যেন দেবেশ এই বাড়িতে আসে। খুব দরকার।

.

৩৭.

এখন না দুপুর না বিকেল। রোদের তাপ বেশ কম। একটা কাক তখন থেকে তারস্বরে চেঁচিয়ে যাচ্ছে বাগানের ডুমুর গাছের উঁচু ডালে বসে। মাঝে মাঝেই এই ডাল থেকে ওই ডালে ব্যস্ত পায়ে নামছে সে, স্থির থাকছে না যেমন, তেমনই তার চিৎকার বন্ধ হচ্ছে না। কেবলই মাথা ঘুরিয়ে নীচের দিকে কিছু খুঁজে যাচ্ছে। জানলা দিয়ে কাকটাকে দেখতে দেখতে অনিমেষ বলল, সাপটা বেরিয়েছে।

এতক্ষণ চুপচাপ ছিল দেবেশ, অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, সাপটা মানে?

এই বাগানে দীর্ঘদিন ধরে সাপ বাস করে। ছোটমা দাবি করেন ওটা তার পোষা সাপ। রোজ কিছু না কিছু খেতে দেন ওটাকে। আজ বোধহয় সাপ খাবার খুঁজতে ওপাশে গেছে তাই দেখে কাকের এই ডাকাডাকি। অনিমেষ বলল।

অদ্ভুত। দেবেশ বলল, তোর বড় পিসিমা তো শেয়াল পুষতেন বলে শুনেছিলাম। যাকগে–।

মাধবীলতা খানিকটা তফাতে বসে ছিল, প্রসঙ্গে ফিরে আসতে চেয়ে বলল, এই হল ব্যাপার। আপনার কথা কিছু বললেন না। দেবেশ মাথা নাড়ল, উনি আমাদের ওখানে থাকবেন এটা তো আনন্দের কথা। আবাসিকরা সবাই খুব পছন্দ করেছেন ওঁকে। এই যে তোমাদের ছাড়াই একা গেলেন। মনে হল খুব খুশি হয়েছেন। কিন্তু–।

কপালে ভাঁজ ফেলে তাকাল মাধবীলতা।

দেবেশ বলল, দেখুন, আমার ইচ্ছে ছিল কারও কাছ থেকে একটা টাকাও না নিয়ে বয়স্ক নিরাশ্রয় মানুষগুলোকে আগলে রাখব। কিন্তু সাধ সাধ্যের কাছে হার মানল। এখন যারা আছেন তারা যে যেমন পারেন তা থাকা খাওয়ার জন্যে দেন। বাকিটা চাষবাস, গোরুর দুধ আর পুকুরের মাছ থেকে যখন কুলিয়ে উঠতে পারি না তখন শহরের অর্থবানদের কাছে হাত পাততে হয়। কিন্তু একজনের কাছ থেকে ঠিক ততটুকুই নেওয়া হয়, যতটুকুতে তার খরচ মেটানো যায়। কারও কাছ থেকে অনেক টাকা নিয়ে সেই টাকায় অন্যদের অভাব মেটানোর কথা আমি কল্পনাও করি না। কারণ যারা উপকৃত হবে তারা এক ধরনের হীনমন্যতায় আক্রান্ত হবে। ভাববে ওই একজন বেশি টাকা দিচ্ছে বলে তার দয়ায় আমি বেঁচে আছি। আমাদের আবাসিকদের মধ্যে কোনও বিভাজন চাই না। তাই আপনাদের প্রস্তাব আমার পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর অনিমেষ বলল, খুব যুক্তিসংগত কথা।

মাধবীলতা বলল, তা হলে কী হবে?

এই সময় ছোটমার গলা কানে এল। তারস্বরে ধমকাচ্ছেন, অ্যাই মুখপোড়া, কানের পরদা ছিঁড়ে যাবে তোর জন্যে? ওখানে ঘাসে ঘাসে ঘুরছে তাতে তোর কী? তুই ডালে ডালে উড়ে বেড়া না। শয়তান কাক।

দেবেশ হাসল, উনি বাড়ি বিক্রি বাবদ যে টাকা পেয়েছেন তা ব্যাঙ্কেই থাক। ওই টাকা থেকে যে মাসিক ইন্টারেস্ট পাবেন তার কিছুটা নিজের খরচের জন্যে আশ্রমকে দিলেই ওঁর কর্তব্য শেষ হয়ে যাবে।

অনিমেষ বলল, কিন্তু দেবেশ, ওঁর বয়স হয়েছে, শরীরও সুস্থ নয়। উনি যখন থাকবেন না তখন টাকাটার কী হবে?

দেবেশ শব্দ করে হেসে উঠল, আচ্ছা, এ ব্যাপারে আমি কী বলব? ওঁর টাকা কীভাবে খরচ করবে তা তোমাদের ব্যাপার।

মাধবীলতা বলল, আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি। শোনো, আমি বলি কী, এক-এক করে এগোনো যাক। ছোটমা আশ্রমে যান। আপাতত ছয় মাসের জন্যে যে টাকা আশ্রমকে দিতে হবে তা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে দেওয়া যাক। ওখানে থাকতে থাকতে ওঁর মনে যদি কোনও ইচ্ছে জন্মায় তখন সেইভাবে তা পূর্ণ করা যাবে।

অনিমেষ মাথা নাড়ল সম্মতিতে, তারপর দেবেশের দিকে তাকিয়ে বলল, দেবেশ, পৃথিবীর অনেক কিছু পালটাল। ইউরোপ থেকে কমিউনিস্টরা মুছে গেল, চিনের সেই বিখ্যাত কমিউনিজম চেহারা বদলে ফেলল। এদেশের মেয়েদের পোশাক এবং চালচলনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটল। আমরা মানুষ হয়েছিলাম যেসব তথ্য জেনে তা আজ একটানে নস্যাৎ হয়ে যাচ্ছে। অথচ তুই একই থেকে গেলি।

কীরকম? দেবেশ হাসল।

তোকে গ্র্যাজুয়েশনের পরে বি সি ঘোষ টোকলাইতে টি-ম্যানেজার ট্রেনিং কোর্সে পাঠাবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তোর মায়ের খুব ইচ্ছে ছিল। ওই কোর্স করলেই চায়ের বাগানে লোভনীয় চাকরি পেতিস। প্রথমে অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার, পরে ম্যানেজার। অথচ তুই যেতে চাইলি না। অনিমেষ বলল।

তুই এসব কথা জানলি কী করে?

অজিতের কাছে সেসময় শুনেছিলাম। অনিমেষ বলল।

চাইনি, কারণ সে সময়েও চাকরিটা ক্রীতদাসের ছিল। ব্রিটিশরা ওই চাকরিতে সেইসব ভারতীয়দের চাইত যারা আত্মীয়স্বজন যদি কম রোজগার করে তা হলে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না। মা যদি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা হন তা হলে তাঁর সঙ্গে ম্যানেজার ছেলে দেখা করতে পারবে না। তার সমাজ হবে অন্যান্য ম্যানেজারদের নিয়ে। স্বাধীনতার দেড় দশকেও এই ব্যবস্থাটা বদলায়নি বলে আমার পক্ষে চাকরিটা নেওয়া সম্ভব হয়নি। আচ্ছা, একবার ছোটমায়ের সঙ্গে কথা বলব। দেবেশ বলল।

মাধবীলতা উঠে বাইরে চলে গেল।

অনিমেষ হাসল, সেটা বুঝলাম। আজ তুই ছোটমায়ের বাড়ি বিক্রির টাকা নিতে রাজি হলি না। কেন? লোভ বেড়ে যেতে পারে, এই ভয়ে?

দেবেশ মাথা নাড়ল, হয়তো তাই। বেশ আছি ভাই। বেশ আছি, খাই দাই, ডুগডুগি বাজাই। ঢাক ঢোল নিয়ে কী করব? চল, আমারই উচিত ওঁর কাছে যাওয়া। দেবেশ উঠে দাঁড়াল।

কিন্তু তখনই মাধবীলতার সঙ্গে এসে দাঁড়ালেন ছোটমা, ওমা। আপনি?

আমি যে এসেছি তা আপনি জানতেন না দেখছি।

বা রে, জানলে আগে এসে দেখা করে যেতাম না? বসুন।

এই মরেছে। আপনাকে আগেও বলেছি, অনিমেষ আর আমি স্কুলে একসঙ্গে পড়তাম। আমাকে আপনি বললে খুব অস্বস্তি হয়। প্লিজ আপনি বলবেন না। দেবেশ হাসল, আপনাকে নিয়ে কথা হচ্ছিল। এই বাড়ি আপনাকে এতকাল আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিল। এখন সেই বন্ধন থেকে। আপনি মুক্ত হয়ে গেছেন। আশ্রমের সবাই চাইছে আপনি আমাদের সঙ্গে থাকুন। আমার মনে হয় আপনারও আপত্তি নেই, তাই না?

না নেই। খুব খুশি হব থাকতে পারলে। দ্যাখো তো, এরা আমার জন্যে নিজের সংসার ফেলে কতকাল এখানে আটকে আছে। আমার একদম ভাল লাগে না। ছোটমা কথাগুলো বলতে বলতে মাধবীলতার কনুই ধরলেন।

অনিমেষ বলল, যিনি কিনলেন, স্বপ্নেন্দু দত্ত, তিনি অবশ্য বলেছেন মাস তিনেকের মধ্যে বাড়ি ছাড়তে হবে না। তারপরে বাড়ি না পেলে উনি একটা ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করে দেবেন। আমার মনে হয় তার দরকার হবে না।

এখনও তো মাস দুয়েক হাতে আছে? দেবেশ তাকাল।

হ্যাঁ।

ভাড়াটের ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেছে?

হ্যাঁ। নিবারণবাবুকে ছোটমা চেক কেটে দিয়েছেন। উনি শিল্পসমিতি পাড়ায় বাড়ি ভাড়া পেয়ে গেছেন। আজই বোধহয় সেখানে চলে যাবেন। মাধবীলতা বলল।

বাঃ। তা হলে তো আর সমস্যা নেই।

ছোটমা বললেন, একটা কথা বলব? না, একটা নয়, দুটো কথা।

দেবেশ অবাক হল, বেশ তো।

ছোটমা বললেন, নিবারণবাবুকে দেওয়ার পরেও ব্যাঙ্কে যে টাকা আমার নামে আছে তা আমি এখনও স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। ওই টাকার কথা ভাবলেই আমার কেমন ভয়ভয় করে।

বুঝলাম। হাসল দেবেশ।

ওই টাকা যদি আশ্রমের ফান্ডে নিয়ে নাও তা হলে আমি বেঁচে যাই। যার পেটে ভাত জুটত না তার সামনে পোলাও বিরিয়ানি ধরে রাখলে কী হয় তা তোমরা বুঝতে পারবে না। ছোটমা বললেন।

এ ব্যাপারে অনিমেষের সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে। দেবেশ বলল, টাকাটা কি ব্যাঙ্কে শুধু আপনার নামেই আছে?

মাধবীলতা বলল, না, মিস্টার রায়, মানে এই বাড়ির যিনি উকিল, তিনি ইনসিস্ট করলেন টাকাটা জয়েন্ট নামে রাখতে। ফলে ওঁর সঙ্গে আমার নাম রাখতে হল। আমি যেন উড়ে এসে জুড়ে বসলাম।

এ কী কথা? ছোটমা প্রতিবাদ করলেন, তুমি এই বাড়ির বউ না? আর তা যদি বলল, জুড়ে বসেছি তো আমি। যাঁর সম্পত্তি তার ছেলে নাতি থাকা সত্ত্বেও আমাকে ওজন বইতে হচ্ছে। আমি তো বাইরের মানুষ।

দেবেশ বলল, প্রথমটা শুনলাম, দ্বিতীয়টা?

ছোটমা মাধবীলতার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললেন, আমার সঙ্গে যদি আর একজন যায় তা হলে কি তোমাদের খুব অসুবিধা হবে?

আর একজন? দেবেশ অবাক হল।

খুব ভাল মেয়ে। আশ্রমের সব কাজ করবে। ওর থাকা খাওয়ার জন্যে যে খরচ হবে তার জন্যে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। ছোটমা বললেন।

কার কথা বলছেন? দেবেশ অনিমেষের দিকে তাকাল।

অনিমেষ ঠাওর করতে পারছিল না। ঠিক তখনই বাইরের বাগান থেকে নিবারণবাবুর গলা ভেসে এল, অনিমেষবাবু, ও অনিমেষবাবু।

মাধবীলতা বলল, নিবারণবাবু, বোধহয় চলে যাচ্ছেন।

ক্রাচ টেনে নিয়ে মেঝেতে নামল অনিমেষ। ওর পেছনে ঘরের সবাই বাইরে বেরিয়ে এল। নিবারণবাবু বারান্দায় উঠে এসে হাতজোড় করলেন, বহু বছর আপনাদের আশ্রয়ে ছিলাম। কৃতজ্ঞতার ভাষা নেই। আর আপনি সাহায্য না করলে তো আমি শিল্পসমিতি পাড়ার সুন্দর বাড়িটায় যাওয়ার সুযোগই পেতাম না।

এসব কী বলছেন। আপনাদের জিনিসপত্র?

সকালে একদফা পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। বাকিটা এখন লরিতে তুলে দিয়েছি। আপনারা যদি একবার ওই বাড়িতে পায়ের ধুলো দেন তা হলে খুব খুশি হব। সোনাউল্লা স্কুল ছাড়িয়ে শিল্পসমিতি পাড়ায় ঢুকে বাঁ দিকের গলি। ওখানে গিয়ে কল্যাণ শিকদারের নাম বললে যে কেউ দেখিয়ে দেবে। ওঁর পাশের বাড়ি।

নিবারণবাবু এবার ছোটমায়ের দিকে তাকালেন, সুখে দুঃখে বহু বছর একসঙ্গে কাটিয়ে গিয়েছি। আমার ব্যবহার যদি আপনাকে কখনও কষ্ট দিয়ে থাকে তা হলে তার জন্যে ক্ষমা চাইছি।

ছোটমা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।

মাধবীলতা বলল, আপনার বাড়ির সবাই কি চলে গিয়েছেন?

হ্যাঁ। একজন ছাড়া। নিবারণবাবু হাসলেন।

মানে?

আপনি তো ওকে দেখেছেন। স্বামীর মৃত্যুর পর আমার বাড়ির মানুষ। হয়েই এতদিন ছিল। এখানে জায়গা প্রচুর ছিল, কোনও অসুবিধে হয়নি। নতুন বাড়িতে ওর থাকা নিয়ে সমস্যা হচ্ছিল। আপনার শাশুড়ি ওকে খুব স্নেহ করেন। উনি ওকে আশ্বাস দিয়েছেন একটা ব্যবস্থা করে দেওয়ার। কেউ যদি ভাল থাকে তা হলে আমি আপত্তি করব কেন? আচ্ছা, চলি। জানলাগুলো বন্ধ করে দিয়েছি, দরজা খোলা আছে। একবার যদি দেখে নেন। নিবারণবাবু বললেন।

ঠিক আছে। আপনি যেতে পারেন। অনিমেষ বলল।

নিবারণবাবু বেরিয়ে গেলে দেবেশ জিজ্ঞাসা করল, কার কথা বললেন?

ওঁর এক ভাইয়ের স্ত্রী। মাধবীলতা বলল।

আশ্চর্য? যেখানে যাচ্ছেন সেখানে তার জায়গা হল না?

জায়গা আদায় করে নেওয়ার ক্ষমতা মেয়েটির নেই, তাই হল না। মাধবীলতা বলল, আমি যাই, একবার জেনে আসি।

মাধবীলতা চলে গেলে দেবেশ জিজ্ঞাসা করল, আপনার কবে থেকে আশ্রমে গিয়ে থাকার ইচ্ছে?

যে দিন বলবে। ছোটমা জবাব দিলেন।

তা হলে আপনাকে একটা দায়িত্ব নিতে হবে।

কীরকম?

আশ্রমের গোরু, হাঁস, মুরগি দেখার জন্যে তোক আছে। কিন্তু সে সামলে উঠতে পারছে না। আপনি যদি ওর মাথার ওপরে থেকে দেখাশোনা করেন তা হলে আমাকে আর ওদের জন্যে চিন্তা করতে হয় না। আপনি তো পশুপাখিদের ভালবাসেন।

অনিমেষ হেসে ফেলল। তাই দেখে ছোটমা জিজ্ঞাসা করলেন, হাসির কী হল?

সাপকে পশুর পর্যায়ে ফেলা যায় কিনা বুঝতে পারছি না।

ছোটমা ঈষৎ রেগে গেলেন, মানুষও তো মাঝে মাঝে পশুর মতো আচরণ করে তা হলে সাপকে পশু বলতে দোষ কী? এই যে নিবারণবাবু, ইনি কি মানুষ না পশু?

দেবেশ বলল, একদম ঠিক কথা। তা হলে পরশু চলে আসুন। আপনার জিনিসপত্র যদি বেশি থাকে তা হলে আমি দোমহনী থেকে একটা ম্যাটাডোর পাঠিয়ে দেব। সকাল সকাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওখানেই লুচি তরকারি খাবেন।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, প্রতি মাসে কত দিতে হবে বললি না তো।

কেউ তো পালিয়ে যাচ্ছে না। আগে উনি আশ্রমে আসুন, সড়গড় হন, তারপর ও নিয়ে ভাবা যাবে। হ্যাঁ তোরা কি এই বাড়িতে কিছুদিন থাকছিস?

না। এখন তো রিজার্ভেশন পাওয়াটাই সমস্যা। পেলেই কলকাতায় ফিরে যাব। অনিমেষ বলল, তার আগে স্বপ্নেন্দুবাবুকে জানাতে হবে।

আমি বলি কী, আমাদের ওখানে দুদিন থেকে তারপর কলকাতায় যাস। দেবেশ বলল, খারাপ লাগবে না। আমাদের অতিথিগৃহ খুব আরামদায়ক হয়তো নয় কিন্তু বাসযোগ্য। মাসিমার সঙ্গেই চলে আয় তোরা। যাচ্ছি রে।

এক মিনিট দাঁড়া। মাধবীলতাকে ডাকছি।

কিন্তু ডাকতে হল না। মাধবীলতা শীর্ণা বউটির হাত ধরে ভাড়াটেদের দিক থেকে বারান্দায় উঠে এসে বলল, এদেশের মেয়েদের নাকি পরিবর্তন হয়েছে। ছাই হয়েছে। গিয়ে দেখি খালি ঘরের মেঝেতে বসে হাঁটুতে মুখ রেখে ইনি কাঁদছেন।

ছোটমা বললেন, এখন তো তুমি স্বাধীন। স্বাধীনতা পেলে কি কেউ কাঁদে?

প্রশ্নটা শোনামাত্র বউটি ছুটে গেল ছোটমার দিকে। দুহাতে তাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল। ছোটমা বললেন, আরে আরে কী হল? তুমি এতদিন জলে পড়ে ছিলে এখন ডাঙায় উঠছ। ইনি অনির বন্ধু দেবেশবাবু। ওঁকে তোমার কথা বলেছি। তুমি আমার সঙ্গে আশ্রমে গিয়ে থাকবে। আমাকে যে ঘর দেবে সেখানেই তুমি শোবে। গিয়ে দেখবে তোমার মন একদম ভাল হয়ে গেছে? আর কাঁদতে হবে না।

দেবেশ বলল, হ্যাঁ। আমাদের ওখানে সব কিছু আছে শুধু কান্না বাদ।

দেবেশ চলে গেল।

অনিমেষ বলল, আমি ওকে যত দেখছি তত অবাক হচ্ছি।

মাধবীলতা বলল, যারা বিপ্লবের কথা বলে, মানুষ খুন করে, যারা সমাজ ব্যবস্থা বদলাতে চায় তারা তাদের রক্তাক্ত হাত ধুয়ে ফেললেও তাতে রক্তের গন্ধ থেকেই যায়। অথচ দেবেশবাবুর মতো কিছু মানুষ নীরবে যে কাজ করে চলেছেন তা কোনও অংশে বিপ্লবের চেয়ে কম নয়। আমার তো ইচ্ছে করছে ওদের ওখানে কয়েকদিন থাকতে।

অনিমেষ হাসল, এই প্রস্তাবটাই দিয়ে গেল দেবেশ। দেখি, কলকাতার ট্রেনের টিকিট কবে পাওয়া যায়!

স্বপ্নেন্দু দত্ত দায়িত্ব নিলেন। আগের দিন জানতে পারলে তিনি রেলের বড় কর্তাকে বলে দার্জিলিং মেলের ভি আই পি কোটার টিকিট করে দিতে পারবেন। এ নিয়ে যেন অনিমেষ কোনও দুশ্চিন্তা না করে। শুনে মাধবীলতা হেসেছিল, এই দেশে দুধরনের মানুষ ভাগ্যবান। এক, যাঁদের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের, বিশেষ করে সরকারে যে দল আছে তাদের কর্তাদের যোগাযোগ আছে। তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ ডায়রি নেবে না, নিলেও চোখ বন্ধ করে থাকবে। তারাই কোটায় ফ্ল্যাট-জমি পাবে। পাড়ার মানুষ ভয় পাবে তাদের। বেশ আছে এরা।

অনিমেষ মাথা নেড়েছিল, দ্বিতীয়টা?

যাদের প্রচুর টাকা আছে তাদের সঙ্গে প্রশাসনের খুব সুসম্পর্ক। তুমি আমি যদি রেলের কারও কাছে টিকিট চাইতে যাই তা হলে তিনি দেখাই করবেন না। কিন্তু স্বপ্নেন্দু দত্ত সুপারিশ করলে স্বচ্ছন্দে অনেক লোকের মাথা ডিঙিয়ে কলকাতায় যেতে পারব। আগে সমস্ত জনসাধারণের মাত্র এক ভাগ সুবিধে ভোগ করত, দশটা পরিবার দেশ চালাত। এখন রাজনীতি এবং কালো টাকার কল্যাণে শতকরা পাঁচভাগ মানুষ ক্ষমতা উপভোগ করে, বাকি পঁচানব্বই ভাগ মানুষ অসহায়; আশায় আশায় শুধু ভোট দিয়ে যায়। মাধবীলতা বলল, এসব নিয়ে আমি ভাবতে চাই না, তবু ভাবনাটা চলে আসে।

সকালে ম্যাটাডোর চলে এসেছিল। স্বপ্নেন্দু দত্তের লোক এসে শুধু বাড়ির মালিকানা বুঝে নেয়নি, ছোটমার যাবতীয় সম্পত্তি ম্যাটাডোরে তুলে দিয়েছিল। অবশ্য ওদের সঙ্গে হাত লাগিয়েছিল লছমন এবং তার ছেলে। বাবা।

মালপত্র ম্যাটাডোরে ভোলা হয়ে গেলে সেই ট্যাক্সিটা চলে এল। দেবেশ ড্রাইভারকে খবর দিয়েছিল। মালপত্র রাখার পর ম্যাটাডোরে জায়গা যদি না হয় সেইজন্যে। ছোটমা তার ঠাকুরদের সযত্নে পুটুলিতে বেঁধে নিয়ে বারান্দায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার পাশে সেই বউটি। ছোটমা যত মুখ ঘোরাচ্ছেন তত তার চোখ উপচে জল নামছিল। ছোটমা বললেন, এই বাগান কেটে পরিষ্কার করে ফেলবে ওরা। শেয়াল সাপগুলোকে নিশ্চয়ই মেরে ফেলবে। সেই কতকাল আগে আমি চা-বাগানের বাড়ি ছেড়ে এখানে এসেছিলাম। তখন ওরা, ওই গাছগুলো যেমন ছিল, তেমনই রাখতে পেরেছিলাম। শুধু আমার শরীরটা বুড়ি হয়ে গেল।

অনিমেষকে দেখা গেল, একটু এগিয়ে এসে ডাকল, চলুন, আপনারা। চোখে বারংবার আঁচল চাপতে চাপতে বারান্দা থেকে নেমে গলির মুখে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসলেন ছোটমা। পাশে বউটি। মাধবীলতা ওপাশের দরজা খুলে বসতেই লছমনের ছেলে বাবা চিৎকার করে কেঁদে উঠল। ছোটমা দুহাতে নিজের কান চেপে ধরলেন। মাধবীলতা ড্রাইভার ছেলেটিকে বলল, একটু হর্ন দাও তো। কোথায় গেল।

অনিমেষ অপলক বাড়িটাকে দেখছিল। স্বৰ্গছেঁড়া চা-বাগানের বাড়ি ছেড়ে সে ঠাকুরদা-বড়পিসিমার সঙ্গে চলে এসেছিল এখানে। চোখের ওপর এই বাড়ি তৈরি হতে দেখেছিল। আজ সেই বাড়িটাকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে চিরকালের জন্যে। আজ থেকে তার আর কোনও বাড়ি নেই। এই সময় ট্যাক্সির হর্ন সজোরে কানে ধাক্কা মারল অনিমেষের।

.

৩৮.

বিশ্বজিৎ দাঁড়িয়ে ছিল, সঙ্গে একজন দাড়িওয়ালা যুবক। অর্ককে দেখে হাত তুলল। কাছে এলে সে বলল, ইনি আমাদের পার্টির একজন যুবনেতা। ওঁকে আপনার কথা বলেছি।

খানিকটা দূরেই থানা। সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে যুবক বলল, আঃ, বিশু কারও সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হলে নাম বলতে হয়। নমস্কার দাদা, আমি প্রতুল রায়। একটা কথা বলুন, যে মানুষটিকে নিয়ে পুলিশকে চিন্তিত করা হয়েছে তাকে আপনি কি দীর্ঘদিন চেনেন?

না। আমার পরিচিত এক ভদ্রলোক ঝাড়খণ্ড থেকে ওকে পাঠিয়েছিলেন, অনুরোধ করেছিলেন কয়েকদিনের জন্যে আশ্রয় দেওয়ার জন্যে। ও কলকাতার কিছুই চেনে না।

নিজের বিপদ ডেকে এনেছেন আপনি। পুলিশ মনে করে ঝাড়খণ্ডি মানেই মাওবাদী।

প্রতুলের কথা শুনে হেসে ফেলল অর্ক।

আপনি হাসছেন? প্রতুল বিরক্ত।

বাবার কাছে শুনেছি, নকশাল আন্দোলনের সময় পশ্চিমবাংলার বাইরের মানুষ ভাবত বাঙালি মানেই নকশাল। অর্ক বলল।

হুম। দেখুন, আমরা মা-মাটি-মানুষের জন্যে সংগ্রাম করছি। বামফ্রন্ট মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। নন্দীগ্রাম ওদের মুখোশ খুলে দিয়েছে। গরিব মানুষদের জমি সামান্য টাকার লোভ দেখিয়ে কিনে বুর্জোয়া টাটাদের হাতে তুলে দিয়েছে। আমরা এর বিরুদ্ধে লড়াই করবই। মুশকিল হল ওদের এবারে মানুষ এখনও ভুল বুঝছেন। জঙ্গলমহলে ওদের হার্মাদ বাহিনী ছড়িয়ে দিয়ে প্রচার করছে তারাই নাকি মাওবাদী। অথচ মানুষ জানে না মাওবাদীদের সাপ্লাই দেওয়া হয় আলিমুদ্দিন স্ট্রিট থেকে। প্রতুল পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে সযত্নে ধরাল, শুনলাম আপনার বাবা নকশাল ছিলেন। তার মানে তিনি চূড়ান্তভাবে সিপিএম বিরোধী। জেল খেটে বেরিয়ে অনেক নকশাল রাতারাতি সিপিএম হয়ে গিয়েছিলেন, আপনার বাবা হননি। আপনার অল্পবয়সে আপনি মানুষদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সিপিএমের চাপে সরে আসতে বাধ্য হন। আপনাদের ওপর ওদের রাগ থাকা স্বাভাবিক। তাই আপনার বাড়িতে একজন মাওবাদী আশ্রয় নিয়েছে বললে ওরা এক ঢিলে দুটো পাখি মারতে পারবে। এক, আপনাকে জেলে ঢোকাতে পারবে, দুই, পাবলিককে আরও ভয় পাইয়ে দিতে পারবে। তাই এই কারণে ওদের মুখোশ খুলতে আমরা আপনাকে সাহায্য করব। আপনি বিশুর সঙ্গে থানায় যান। তবে একটা অনুরোধ, আমাকে যা বললেন তা ওখানে বলবেন না।

আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। অর্কর কপালে ভাঁজ পড়ল।

আপনি যাকে আশ্রয় দিয়েছেন তিনি যে ঝাড়খণ্ড থেকে এসেছেন এবং তাকে আপনি চেনেন না, আর একজনের সুপারিশে রাজি হয়েছেন, এ কথা পুলিশকে জানানোর কোনও দরকার নেই। শুনলেই এখন যদি ধোয়া হয়ে থাকে তা হলে তা দাউদাউ আগুন হয়ে যাবে। বুঝতে পারলেন? প্রতুল রায় বলল।

তা হলে কী বলব?

বলবেন আপনার পূর্ব পরিচিত। নর্থ বেঙ্গলে থাকেন। প্রতুল বলল। বিশ্বজিৎ মাথা নাড়ল, নর্থ বেঙ্গল বলাই ভাল। আপনাদের বাড়ি তো ওখানেই।

প্রতুল বলল, আমরা আপনার সঙ্গে আছি। আশা করব সুরেন মাইতিদের সঙ্গে লড়াইয়ে আপনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন। বিশু, তোমরা যাও। কী হল তা বেরিয়ে এসে আমাকে জানিয়ো।

.

অর্ক আর বিশ্বজিৎ থানায় ঢুকল। যে সাব-ইন্সপেক্টার দরজার ওপাশে টেবিলে ঝুঁকে কিছু লিখছিলেন, মুখ তুলে বললেন, আরে! বিশুবাবু যে। কী ব্যাপার?

বড়বাবু কোথায়?

সাব-ইন্সপেক্টার দুটো হাত মাথার ওপরে তুলে শরীর একটু মুচড়ে বললেন, বিশ্রাম করছেন। এই সরকার যদি চলে যায় তা হলে তো বিশ্রামের সুযোগ পাওয়া যাবে না।

বিশ্বজিৎ বলল, তার মানে, তখন আপনাদের কাজ করতে হবে? নিঃশব্দে ভুঁড়ি কাঁপিয়ে হাসলেন সাব-ইন্সপেক্টার, এখনই তো আপনারা বলছেন আমাদের নাকে দড়ি লাগিয়ে হামাগুড়ি দেওয়াবেন। যাক গে, একটা সত্যি কথা বলি, তিরিশ বছর চাকরি হয়ে গেল, এমন জাঁদরেল মহিলা কখনও দেখিনি। একদম একা দেশটাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছেন। তা কী ব্যাপার, বলুন।

বড়বাবু এঁকে দেখা করতে বলেছেন। বিশ্বজিৎ বলল।

অর্কর দিকে তাকিয়ে সাব-ইন্সপেক্টার বললেন, চিনলাম না।

অর্ক হাসল, চেনার মতো কোনও পরিচয় নেই। আমি অর্ক মিত্র।

কপালে ভাঁজ পড়ল সাব-ইন্সপেক্টারের, ঈশ্বরপুকুর লেন?

হ্যাঁ। অর্ক মাথা নাড়ল।

হয়ে গেল। কোথায় পালিয়ে গিয়ে গা-ঢাকা দেবেন, না নিজেই চলে এসেছেন খাঁচায় ঢুকতে! সুরেন মাইতি তো বলে গেল আপনি ডেঞ্জারাস লোক। সাব ইন্সপেক্টার একজন সেপাইকে ডাকল, দেখো তো, বড়বাবু কী করছেন।

চা খাচ্ছেন।

অ উঠে দাঁড়ালেন সাব-ইন্সপেক্টার, আসুন।

বন্ধ দরজা ঠেলে সাব-ইন্সপেক্টার ভেতরে ঢুকে গেলে বিশু নিচু গলায় বলল, শুনলেন তো, সুরেন মাইতি কী চিজ। বলুন।

ঘরের ভেতরে ঢুকে ওরা দেখল ঘরোয়া পোশাকে বড়বাবু বসে চা খাচ্ছেন। তাঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে সাব-ইন্সপেক্টার কিছু বললেন। সেটা শুনে মুখ তুললেন বড়বাবু। অর্ক জিজ্ঞাসা করল, আসতে পারি?

ঘরে ঢোকার পরে এ কথা জিজ্ঞাসা করার কোনও মানে নেই। আসুন। বসুন।

সাব-ইন্সপেক্টার বললেন, উনি বিশ্বজিৎবাবু। তৃণমূল নেতা। ইনি অর্ক মিত্র।

বড়বাবু বিশ্বজিতের দিকে তাকালেন, বলুন, আপনার কী সমস্যা?

বিশ্বজিৎ মাথা নাড়ল, আমি অর্কদার সঙ্গে এসেছি।

অ্যা? চমৎকার। কিন্তু আমি ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই। ও। আমি তা হলে বাইরে অপেক্ষা করছি।

আপনার ইচ্ছে।

এটা আমার ব্যক্তিগত ইচ্ছে নয়। অর্কদা, আপনি কথা বলুন। বিশ্বজিৎ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে সাব-ইন্সপেক্টার ওকে অনুসরণ করছিলেন কিন্তু বড়বাবু তাকে থামালেন, এঁকে আমার কাছে নিয়ে আসার আগে সার্চ করেছেন?

না স্যার!

কী আশ্চর্য! আপনার যে কেন প্রমোশন হচ্ছে না তার কারণ জানতে চেয়েছিলেন না?

বড়বাবুর ধমক খেয়ে সাব-ইন্সপেক্টার এগিয়ে এসে অর্কর শরীর, পকেট খুঁজে দেখে হাসলেন, না স্যার, কিছুই নেই। সিগারেটের প্যাকেটও নেই।

যান। বড়বাবু বলমাত্র সাব-ইন্সপেক্টার বেরিয়ে গেলেন।

বড়বাবু বললেন, আপনি বসুন।

অর্ক টেবিলের উলটো দিকের চেয়ারে বসল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বড়বাবু বললেন, আপনি মাওবাদীদের ঘনিষ্ঠ, তাদের আশ্রয় দিয়েছেন বলে আপনার এলাকার বামপন্থী নেতা আমাদের জানিয়েছেন। কাজটা কতদিন ধরে করছেন?

আমি জ্ঞানত এরকম কাজ কখনও করিনি।

কলকাতায় মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মাওবাদী সমর্থকের সংখ্যা প্রচুর। এরকম কার কার সঙ্গে আপনার সরাসরি যোগাযোগ আছে?

আমি তাদের কাউকেই চিনি না।

যে লোকটিকে আপনি আশ্রয় দিয়েছেন তার নাম কী?

রাম, রামচন্দ্র। ইচ্ছে করে রামজি বলল না অর্ক।

রামচন্দ্র। টাইটেল কী?

রামচন্দ্র রায়।

কতদিন চেনেন ওকে?

অনেকদিন।

ওর বাড়ি কোথায়? কোত্থেকে এসেছিল?

শিলিগুড়ি। এখানে ওর পরিচিত কেউ নেই বলে থাকতে চেয়েছিল।

আপনি কী করেন?

চাকরি।

তৃণমূলে ঢোকার আগে কী করতেন?

আমি তৃণমূলে ঢুকিনি। কোনও দলেরই সমর্থক ছিলাম না।

তা হলে ওই তৃণমূল নেতা আপনার সঙ্গে কেন এলেন?

আমরা একই পাড়ায় থাকি।

বড়বাবু সোজা হয়ে বসলেন, আপনার বাড়িতে কে কে আছেন?

মা এবং বাবা।

তাঁরা রামচন্দ্রকে দেখেছেন?

না। তারা এখন জলপাইগুড়ির বাড়িতে আছেন।

বড়বাবু হাসলেন, চমৎকার। সুযোগটা কাজে লাগিয়েছেন। কলকাতায় রামচন্দ্র কী কাজে এসেছিলেন?

আমি জানি না, জিজ্ঞাসা করিনি।

একজন লোক আপনার বাড়িতে এসে থাকছে, কেন এসেছে, কী কাজ করতে এসেছে তা জানার আগ্রহ আপনার নেই? মিথ্যে বলছেন। বড়বাবু ঠোঁট মোচড়ালেন।

অর্ক একটু ভাবল, আপনাকে সুরেন মাইতি বলেছে যে ও মাওবাদী?

আরও বেশি বলেছে। আচ্ছা, এই রামচন্দ্র এখন কোথায়?

ও চলে গেছে। এর বেশি কিছু জানি না।

কিন্তু জানি না বললে তো চলবে না। জানতেই হবে।

মানে? অর্ক অবাক হল।

আপনাকে আমি চারদিন সময় দিচ্ছি। এই সময়ের মধ্যে ওই সো কলড রামচন্দ্রকে খুঁজে বের করে আমাকে জানাতে হবে।

আশ্চর্য! আমি কোথায় খুঁজব?

সেটা আপনার সমস্যা। মাথা দোলালেন বড়বাবু।

আপনি অযথা আমার ওপর চাপ তৈরি করছেন। একটু গলা তুলল অর্ক।

এখনও করিনি। আমার কথা না শুনলে সেটা করব।

মানে?

আমি আপনার সঙ্গে এতক্ষণ ভদ্রভাবে কথা বলেছি কারণ এটা আমার স্বভাব। কিন্তু আপনি যদি সমানে মিথ্যে বলে যান, আমাদের কোনও সাহায্য না করেন তা হলে যেটা স্বাভাবিক তাই করা হবে। অর্কবাবু, আপনি আপনার বাড়িতে যাকে আশ্রয় দিয়েছেন তার সম্পর্কে কোনও খবর রাখেন না বললেন, কোনও বাচ্চা ছেলেও এ কথা বিশ্বাস করবে না। আপনি যদি চারদিনের মধ্যে তার খবর আমাকে না দেন, তা হলে আমি ধরে নেব আপনিও একজন মাওবাদী। আপনি দেশের শত্রু। আপনি জঙ্গলমহলে গিয়ে অস্ত্র ধরেননি বটে কিন্তু শহরে থেকে তাদের মদত দিচ্ছেন। আপনাকে নিয়ে এসে ওষুধ প্রয়োগ করলেই মিথ্যের বদলে সত্যি কথাগুলো বলতে শুরু করবেন। আপনার দল বলছে পশ্চিমবাংলায় মাওবাদী বলে কিছু নেই। তা হলে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সিপিএমের কর্মীদের খুন করছে কারা? এখন আপনার ওপর নির্ভর করছে আপনি কী চান। বড়বাবু টেবিলে রাখা বেল বাজালেন।

একজন সেপাই ঘরে ঢুকলে বড়বাবু বললেন, ওই তৃণমূলি নেতা কি আছেন?

হ্যাঁ স্যার।

ডাকো তাকে।

সেপাই গিয়ে খবর দিলে বিশ্বজিৎ ঘরে ঢুকল। বড়বাবু বললেন, আপনার পাড়ার লোক মনে করছে ইনি মাওবাদীদের আশ্রয় দিয়েছেন। আমি এঁকে অনুরোধ করেছি লোকটার হদিশ আমাকে দিতে। ঠিক আছে, যেতে পারেন।

বিশ্বজিৎ কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু বড়বাবু হাত নাড়লেন, না, কিছু বলতে হবে না। আপনি সঙ্গে এসেছেন বলে ওকে আজই অ্যারেস্ট না করে একটা সুযোগ দিলাম। আসুন আপনারা।

কোনও কথা না বলে বিশ্বজিৎ অর্ককে নিয়ে বেরিয়ে এল। বাইরে এসে সে জিজ্ঞাসা করল, লোকটা এখন কোথায় বলুন তো?

অর্ক মাথা নাড়ল, যেমন এসেছিল তেমনই চলে গেছে। বিশ্বজিৎ সন্দেহের চোখে অর্ককে দেখল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, আপনাকে আমরা সাহায্য করতে চাইছি কেন জানেন? আপনি তৃণমূল দূরের কথা, কখনও কংগ্রেসই করেননি। কিন্তু আমাদের শত্রু যখন আপনার সঙ্গে শত্রুতা করছে তখন আপনাকে মিত্র ভাবাই যেতে পারে। যাক গে, চারদিনের মধ্যে লোকটার খবর বড়বাবুকে দিয়ে যাবেন।

আমি খুব বিপদে পড়লাম বিশ্বজিৎ।

বিশ্বজিৎ তাকাল। এবার দৃষ্টি নরম। বলল, আপনি আমাদের পার্টি অফিসে আসুন।

কেন?

আমাদের সঙ্গে যোগ দিলে হয়তো আপনার বিপদ কেটে যেতে পারে। বিশ্বজিৎ বলল, আচ্ছা অর্কদা, আমি এখন যাচ্ছি। বিকেলে পার্টির অফিসে থাকব।

বিশ্বজিৎ চলে গেলে অর্ক চুপচাপ হাঁটতে লাগল। রাস্তায় নোকজন বেড়ে গেছে। সে পেছন দিকে তাকাতেই একজোড়া বুটজুতো দাঁড়িয়ে গেল। এখনও পাঞ্জাবি এবং ধুতির নীচে বুটজুতো পরার অভ্যেস যারা ছাড়তে পারেনি তাদের চিনতে অসুবিধে হয় না। লোকটা কি তাকে অনুসরণ করছে?

অর্ক খানিকটা হেঁটে ফুটপাথ বদল করলে দেখা গেল লোকটাও রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ির জন্যে দাঁড়িয়ে গেছে। সন্দেহ সত্যি হতেই অর্ক উলটোদিক থেকে আসা একটা বাসে উঠে পড়ল। বাসটা লাল আলোয় দাঁড়িয়েছিল। ওঠামাত্র আলো বদলাতে বাস যখন চলতে শুরু করল তখনও লোকটা পৌঁছোতে পারেনি। বড়বাবু তাকে চোখের আড়ালে রাখতে চাইছেন না। এটা আর একটা চাপ তৈরি করল।

শ্যামবাজারের মোড়ে বাস থেকে নেমে কিছু একটা করার জন্যে এক প্যাকেট সিগারেট আর দেশলাই কিনল অর্ক। সিগারেট সে খায় না, কখনও শখ হলে একটা যদি খায় তা হলে তাকে খাওয়া বলে না। আজ সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া টানার পর আচমকা বেশ ভাল লাগল। পাঁচ মাথার মোড়ের ফুটপাত ঘেঁষা রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে সে ভাবার চেষ্টা করল, কী করা উচিত।

এ কথা সত্যি, ঠিক কোন জায়গায় এখন রামজি আছে তা সে জানে না। রামজি যে সূত্র তাকে দিয়ে গিয়েছিল সেটা পুলিশকে জানালে ওরা নিশ্চয়ই একটা হদিশ পেয়ে যাবে। কিন্তু–।

মাথা নাড়ল অর্ক। রামজি তাকে বলেনি, অন্তত খোলাখুলি বলেনি ও কেন পশ্চিমবঙ্গে এসেছে। ও মাওবাদী স্কোয়াডের সদস্য কি না তাও জানায়নি। অর্ক অনুমান করেছে। যারা সশস্ত্র বিপ্লবের স্বপ্ন দেখছে রামজি তাদের সঙ্গে আছে। কিন্তু সেই অনুমানের ওপর নির্ভর করে ছেলেটার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা কি উচিত কাজ হবে? আবার এমনও তো হতে পারে রামজির দেওয়া সূত্রগুলিকে জানিয়ে দিলে যদি পুলিশ ওকে খুঁজে না পায় তা হলে নির্ঘাত ধরে নেবে সে ওদের ভুল পথে ঠেলে দিয়েছে। তখন যা হবে তা কল্পনাও করতে পারছে না সে।

মোবাইল বেজে উঠতেই সেটা পকেট থেকে বের করে সামনে ধরতেই মা শব্দটা দেখতে পেল অর্ক। বোতাম টিপে সে বলল, বলো।

তুই কোথায়? মাধবীলতার গলা।

শ্যামবাজার।

অফিসে যাসনি?

যাওয়া হয়নি। কেন?

বাড়ি পরিষ্কার আছে তো?

তোমরা কি আসছ?

হ্যাঁ। আজ টিকিটের জন্যে চেষ্টা করা হবে। ভি আই পি কোটায় বোধহয় পাওয়া যাবে।

ভি আই পি কোটায়? অর্কর গলায় বিস্ময়।

যাওয়ার আগে ফোন করব। খোলা রাখিস।

বাড়ির কী ব্যবস্থা হল?

যা হয়েছে তার চেয়ে ভাল এই মুহূর্তে হতে পারত না। রাখি।

ফোনটা কেটে দিল মাধবীলতা। মন খারাপ হয়ে গেল অর্কর। মাধবীলতা তার সঙ্গে যে গলায় কথা বলল তাতে বিন্দুমাত্র আন্তরিকতা নেই। তাকে মা এখন দূরের মানুষ বলে ভেবে নিয়েছে। বাবার এই ব্যাপারে ভূমিকা থাকলেও মা তাতে প্রভাবিত হওয়ার মহিলা নয়। ওরা কাল বা পরশু এখানে ফিরে এলে নিশ্চয়ই সুরেন মাইতির লোকজন সাতকাহন করে সব শোনাবে। রামজিকে নিয়ে মায়ের প্রচুর ঔৎসুক্য ছিল, খানিকটা সন্দেহও। এখানকার কথা শোনার পর সেটা মায়ের কাছে নির্ভুল বলে মনে হবে। স্বামীর জন্যে যে মহিলা সারা জীবন স্যাক্রিফাইস করে এলেন, ছেলের জন্যে সেটাই তিনি মেনে নেবেন না।

তা হলে তার কী করা উচিত?

এই যে মশাই, আপনি এতদিন কোথায় ছিলেন?

অর্ক মুখ ঘুরিয়ে দেখল অলকা খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে।

ও, আপনি?

আপনাকে খবরটা দেওয়া হয়নি। মেয়ে আবার স্কুলে যাচ্ছে।

বাঃ। ভাল খবর।

কিন্তু আপনার সম্পর্কে যেটা শোনা যাচ্ছে তা কি সত্যি?

কী শুনছেন তাই তো জানি না।

আপনি নাকি ভয়ংকর মাওবাদীকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তার কাছে এ কে ফর্টি সেভেন রাইফেল ছিল। পুলিশ আপনাকে খুঁজছে।

হেসে ফেলল অর্ক। মুখে কিছু বলল না।

অলকা হাসার চেষ্টা করল, আপনাকে হয়তো বিরক্ত করলাম। চলি।

ওর চলে যাওয়ার ভঙ্গি দেখে অর্কর মনে হল, যেতে পেরে ও যেন বেঁচে গেল। সেই গায়ে-পড়া আত্নাদি ভাবটা একদম উধাও হয়ে গিয়েছে।

দেখতে দেখতে প্রবল চাপ অনুভব করল অর্ক। সে কোনও অন্যায় করেনি, কোনও দেশবিরোধী কাজ করেনি। তা হলে তার ব্যক্তি-স্বাধীনতা থাকবে না কেন?

.

৩৯.

দেবেশ গিয়েছে নিউ জলপাইগুড়িতে, ফিরবে দুপুরের পরে। অনিমেষ আশ্রমের বাগানে চেয়ার পেতে বসে ছিল। মাথার ওপর বেশ বড়সড় কাঁঠাল গাছ থাকায় রোদ নামছিল না নীচে। এখন আকাশ জুড়ে শুধু নীল আর নীল। কালচে দুরের কথা সাদা মেঘের টুকরোগুলোও সেখানে ভাসছে না। এই আকাশ কলকাতায় দেখা যায় না। এখানে সে অনেক কিছু পাচ্ছে যা কলকাতায় পাওয়া যায় না। জোরে শ্বাস নিলে বুক ভরে শান্তি নামে। এই মাটি গাছগুলোকে বন্ধু বলে মনে হয়। কান খাড়া করলেও শুধু পাখির গলা। আর হাওয়ার শব্দ দুই কানে মোলায়েম আরাম ছড়িয়ে দেয় যা কলকাতায় মাথা খুঁড়লেও পাওয়া যাবে না। সেখানে শুধু মানুষের তৈরি উৎকট শব্দ সারাক্ষণ কানের পরদাকে বিব্রত করে রাখে। ঈশ্বরপুকুর লেনের বেকার ছোঁড়াগুলো অকারণেই শব্দ তৈরি করে উল্লসিত হয়।

একেবারে দুহাত দূরে কাঠবিড়ালিটাকে দেখতে পেল অনিমেষ। কাঁঠাল গাছ থেকে নেমে এসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। পেছনের দুটো পায়ের ওপর ভর করে সোজা দাঁড়িয়ে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকে দেখছে। বেশ মজা লাগল অনিমেষের। ঠিক তখনই পেছন থেকে আর একটা কাঠবিড়ালি তীব্র স্বরে ডেকে উঠল। পঁড়িয়ে থাকা কাঠবিড়ালি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখল একবার কিন্তু নড়ল না, এবার পেছনের কাঠবেড়ালি দৌড়ে এসে যেভাবে সঙ্গীকে ধাক্কা দিয়েই ফিরে গেল তাতে না হেসে পারল না অনিমেষ। ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে যেতে কোনওমতে নিজেকে সামলে সঙ্গীকে অনুসরণ করল সে, ওরা কি স্বামী স্ত্রী? অথবা প্রেমিক প্রেমিকা? এবার অনিমেষ লক্ষ করল শুধু ওরা দুজন নয়, এই বাগানে প্রচুর কাঠবিড়ালি ঘুরে বেড়াচ্ছে।

অনি।

নিজের নামটা কানে যেতেই অনিমেষ মুখ ফিরিয়ে ছোটমাকে দেখতে পেল। পরনে সাদা শাড়ি কিন্তু তাতে নীলের আলপনা রয়েছে। অনিমেষ ক্রাচ নিয়ে ওঠার চেষ্টা করছিল কিন্তু ছোটমা হাত নাড়লেন, না না, উঠতে হবে না। তোমরা কি আজই চলে যাচ্ছ?

দেবেশ গিয়েছে এনজেপিতে। যদি টিকিট পায় তা হলে–। কথা শেষ করল না অনিমেষ।

তুমি তো শ্ৰাদ্ধশান্তিতে বিশ্বাস করো না, তাই না? ছোটমা জিজ্ঞাসা করলেন।

অনিমেষ হাসল, মুখে কোনও কথা বলল না।

আসলে তোমার বাবা, বড়পিসিমা, ঠাকুরদা চলে গেছেন অনেককাল আগে। আমার আয়ু আর কতদিন তা জানি না। তুমি মানো না জেনেও বউমার সঙ্গে কথা বলেছি। বউমা রাজি হয়েছে। তুমি তাকে বাধা দিয়ে না।

কী ব্যাপারে রাজি হয়েছে মাধবীলতা?

গয়ায় গিয়ে শ্রাদ্ধের কাজ করতে।

অ্যাঁ? মাধবীলতা আপনাকে বলেছে এ কথা?

হ্যাঁ। আমি তাকে বলেছি একেবারে চারজনের কাজ যেন করে সে।

হকচকিয়ে গেল অনিমেষ, চারজন? ওঁরা তো তিনজন। চতুর্থজন কে?

ছোটমা হাসলেন, আমি।

কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে অনিমেষ বলল, এই কাজটা করতে মাধবীলতা রাজি হয়েছে?

ছোটমা বললেন, প্রথমে হয়নি। আমি অনেক বলার পরে নিমরাজি হয়েছে। তোমাকে নিশ্চয়ই বলবে। তুমি নিজে ইচ্ছুক না হলেও ওকে বাধা দিয়ো না।

অনিমেষ মাথা নাড়ল, আমি বুঝতে পারছি না এসব কী হচ্ছে!

পৃথিবীতে অনেক কিছুই হয় যা মানুষ বুঝতে পারে না। ছোটমা বললেন।

আচ্ছা সেই কবে দাদু-বড়পিসিমা চলে গিয়েছেন। বাবা গত হয়েছেন বহু বছর হয়ে গেল। আত্মা আছে কি না তার কোনও প্রমাণ মানুষ পায়নি। শুধু কল্পনা করে তার অস্তিত্ব প্রচার করেছে। তর্কের খাতিরে যদি ওই কল্পনা করি তা হলে এত বছরে তাদের একটা গতি হয়ে গিয়েছে। গয়ায় গিয়ে শ্রাদ্ধ করা হয়নি বলে তারা পৃথিবীতে বন্দি হয়ে নিশ্চয়ই নেই।

তুমি কী করে বুঝছ যে তাদের আত্মা মুক্তি পেয়েছে?

আমি কোথাও পড়িনি, কারও মুখে শুনিনি বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্রের আত্মার মুক্তির জন্যে গয়ায় গিয়ে শ্রাদ্ধ করা হয়েছে। তা যদি না করা হয়ে থাকে তা হলে হেসে ফেলল অনিমেষ, কী উদ্ভট কথা।

ছোটমা গম্ভীর হলেন, অনি, তোমার কাছে এসব উদ্ভট বলে মনে হতে পারে কিন্তু আমার কাছে নয়। তা ছাড়া এতদিন তো এসব আমার মাথায় আসেনি। আজ এল। যে বাড়িতে তোমার দাদুর মনপ্রাণ পড়ে ছিল, যেখানে তোমার বড় পিসিমা, বাবা অনেককাল থেকেছেন সেই বাড়ি চিরকালের জন্যে ছেড়ে চলে এলাম। আজ বাদে কাল প্রোমোটার বাড়িটাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে নিজের মতো চার-পাঁচতলা বাড়ি তুলবে। তখন সেই বাড়িতে তোমার পূর্বপুরুষের কোনও স্মৃতিচিহ্ন থাকবে না। তুমি ভাবো তো, তোমার দাদু বেঁচে থাকলে, যত অভাব হোক, নিজের হাতে তৈরি বাড়িটাকে বিক্রি করতেন? মানুষ যদি কাউকে বা কিছুকে খুব ভালবাসে তা হলে তার চলে যাওয়ার পরে সেই ভালবাসাটা মিথ্যে হয়ে যায় না। তুমি বিশ্বাস করো না, কিন্তু আমি করি। ওই জমিতে নতুন বাড়ি তৈরি হওয়ার আগেই ওঁদের আত্মার শান্তি হওয়া উচিত। ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, গয়ায় শ্রাদ্ধ করলেই সেটা সম্ভব হয়। আমি পথঘাট চিনি না, শরীরও ভাল না, তা না হলে নিজেই যেতাম। মাধবীলতা বিচক্ষণ মেয়ে। আমার কথা ওর পছন্দ না হলেও মেনে নিয়েছে কারণ ও আমাকে হতাশ করতে চায়নি।

তা হলে তো হয়েই গেল। কিন্তু তোমার নাম জুড়লে কেন?

এবার হাসলেন ছোটমা, শখ হল।

শখ?

এই যে তোমরা এসে আমার কত উপকার করে যাচ্ছ, আবার কবে আসবে তা তো জানি না। ভেবে দেখো, কত বছর পরে এলে। আমি চলে গেলে নিশ্চয়ই খবর পাবে কিন্তু তখন তো আমি থাকব না। তাই জানতেও পারব না আমার শ্রাদ্ধ কেউ করল কি না? মাধবীলতা করে দিলে নিশ্চিন্ত হয়ে থাকতে পারব। মরার পর আর এই পৃথিবীর মুখ দেখতে হবে না। ছোট মায়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই চিৎকার ভেসে এল, নতুন দিদা, নতুন দিদা!

ছোটমা ব্যস্ত হয়ে বাগানের মধ্যে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, কী?

এই সময় ছেলেটাকে দেখতে পেল অনিমেষ। উত্তেজিত ভঙ্গিতে ছেলেটি দুদিকে দুটো হাত ছড়িয়ে বলল, ইয়া বড়া সাপ। মুরগির বাচ্চাদের খেতে ছুটে আসছিল। দেখতে পেয়ে আমি মাটিতে লাঠির বাড়ি মারতে ভয় পেয়ে পুকুরের জলে নেমে গেছে। কিন্তু ব্যাটা আবার আসবে। কী হবে?

চল, দেখি গিয়ে। মুরগির বাচ্চারা এখন কোথায়?

পুকুরের পাশেই মায়ের সঙ্গে ঘুরছে।

ওদের ওখান থেকে সরাতে হবে। চল, চল!

ছোটমা যে গতিতে ছেলেটির সঙ্গে অদৃশ্য হলেন তাতে অনিমেষের মনেই হল না ওঁর শরীর ভাল নয়। ক্রাচ টেনে নিয়ে অনিমেষ উঠল। ওরা যেদিকে গিয়েছে সেই দিকে কিছুটা হাঁটতেই পুকুর চোখে পড়ল। ছোটমা খানিকটা ঝুঁকে তু তু করে ডাকছেন যাদের সেই মুরগি-মা এবং তার ছানারা খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে সন্দিগ্ধ চোখে তাকাচ্ছে। ছোটমা ছেলেটাকে কিছু বলতেই সে ছুটে আশ্রমের পেছন দিকে চলে গেল।

অনিমেষ কাছে পৌঁছে জিজ্ঞাসা করল, এরকম মুরগিছানা কত আছে?

আছে, তবে তারা একটু বড় হয়ে গেছে। বিপদ বুঝলে পালাতে পারে। এরা একেবারেই শিশু। জ্ঞানগম্যি হয়নি এখনও। বলেই ছোটমা চেঁচালেন, না, ওদিকে নয়। খুব বকব ওদিকে গেলে।

মুরগিছানাগুলো জলের দিকে যাচ্ছিল, ধমক শুনে থমকাল। সঙ্গে সঙ্গে মুরগি-মা ডেকে উঠতেই ওরা ফিরে গেল তার কাছে।

অনিমেষ পুকুরের দিকে তাকাল। ওখানে নাকি প্রচুর মাছ বড় হচ্ছে। কিন্তু সাপ থাকলে তারা কি আর বড় হতে পারবে? হঠাৎ চোখে পড়ল পাড় থেকে খানিকটা দূরে জলের ওপর একটা মাথা যেন উঁচু হয়ে আছে। অনিমেষ উত্তেজিত হল, সাপ।

ছোটমা তাকালেন। তারপর হেসে বললেন, যা ভেবেছিলাম, ঠিক তাই।

তার মানে?

ওটা জলঢোঁড়া। বিষ নেই কিন্তু খুব বদমাশ। ছোটমা একটা নুড়ি তুলে ছুঁড়ে মারতেই মাথাটা জলের তলায় চলে গেল। এই সময় ছেলেটা একটা প্যাকেট নিয়ে এসে ছোটমায়ের হাতে দিল। তিনি একটু একটু করে চাল ছড়িয়ে মা-মুরগি এবং তার ছানাদের আশ্রমের পেছনে নিয়ে গেলেন।

দৃশ্যটি দেখতে খুব ভাল লাগল অনিমেষের। এবারে জলপাইগুড়ির বাড়িতে এসে অনেকদিন থেকে ছোটমাকে যেরকম দেখেছিল তার সঙ্গে এই ছোটমার কোনও মিল নেই, যেন নতুন জন্ম হয়ে গেছে ওঁর। অনিমেষের খেয়াল হল, নিবারণবাবুর বাড়ির বউটি সেই যে এখানে এসেছে তারপর থেকে তাকে আর দেখতে পায়নি সে। নিশ্চয়ই সে মনের মতো কাজ পেয়ে গেছে। ছোটমা তাকে নিয়ে অবশ্যই ভাল থাকবেন। এই সময় সাপটাকে দেখতে পেল অনিমেষ। একটু ওপাশের পুকুরের জল থেকে ওপরে উঠে আসছে ধীরে ধীরে। তার লক্ষ্য যে আশ্রমের পেছন দিক সেটা বুঝতে অসুবিধে হল না। ছোটমা বললেন ওই সাপ নির্বিষ। কিন্তু বেশ মোটা এবং অনেকটাই লম্বা। ও যে মুরগির বাচ্চাদের লোভ এখনও ছাড়েনি তা আশ্রমের পেছন দিকে যাওয়ার চেষ্টাতেই বোঝা যাচ্ছে, অনিমেষের মাথা গরম হয়ে গেল। সে যতটা সম্ভব দ্রুত ক্রাচ নিয়ে চলে গেল সাপের কাছে। সাপটা নির্বিকার। হয়ে এগোচ্ছিল। অনিমেষকে আসতে দেখে মুখ ফিরিয়ে হাঁ করল। কিছু না ভেবেই অনিমেষ মাথার কিছুটা নীচে ক্রাচের লোহা বাঁধানো নীচের অংশটি যতটা জোরে সম্ভব চেপে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে সাপটা শরীর দুমড়ে লেজটাকে ওপরে এনে ক্রাচটাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করল। অনিমেষ কিছুতেই ক্ৰাচটাকে সাপের শরীর থেকে সরাচ্ছিল না। কিন্তু সে বুঝতে পারছিল এভাবে বেশিক্ষণ চেপে ধরে থাকতে সে পারবে না। সাপের লেজের টানে ওটা যে-কোনও মুহূর্তেই উঠে আসতে পারে। অনিমেষ চিৎকার করল। দুবার চিৎকার করতেই ওপাশের বাগানে কাজ করা কয়েকজন বৃদ্ধ দ্রুত চলে এসে দৃশ্যটা দেখতে পেলেন। তারপর তাদের সম্মিলিত চেষ্টায় সাপটাকে বেঁধে ফেললেন। একজন জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার কিছু হয়নি তো?

না। তবে আপনারা না এলে হয়তো হত।

আপনি খুব ঝুঁকি নিয়েছিলেন। এটা ঠিক করেননি।

হঠাৎ মনে হল মুরগির বাচ্চাগুলো সাপটা খেয়ে নেবে। মনে হওয়ামাত্র এগিয়ে এসেছিলাম। অনিমেষ হাসল।

হাসছেন যে? একজন জিজ্ঞাসা করল।

আমাদের চারপাশে এরকম কত সাপ প্রতিদিন হাঁ করে বসে আছে দুর্বল মানুষদের গিলে ফেলতে, দেখেও মুখ ঘুরিয়ে থাকি। এগিয়ে গিয়ে আটকাবার চেষ্টা করি না। অনিমেষ বলল।

.

অনিমেষ তার ক্রাচের সাহায্যে একটা মোটা লম্বা সাপ ধরেছে এই খবরটা আশ্রমের সবাই জেনে গেল। তাদের সবাই একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা আহত সাপটাকে দেখে গেল। অনিমেষ লক্ষ করল মাধবীলতা এদের সঙ্গে সাপ দেখতে আসেনি।

সে ফিরে গেল আশ্রমের ভেতরে। সবাই তাকে জিজ্ঞাসা করতে লাগল কীভাবে সে সাপটাকে আটকাল? উত্তর দিতে দিতে জেরবার হয়ে গেল সে। শেষ পর্যন্ত অব্যাহতি পেতেই আশ্রমের পেছনে চলে এল। সেখানে বড় বড় তারের খাঁচায় হাঁস এবং মুরগিদের সংসার। ছোটমা ছেলেটির সঙ্গে তাদের পরিচর‍্যা করছেন। তাকে দেখে বললেন, সাপটাকে মেরে ফেললে?

মরেনি। বেঁধে রাখা হয়েছে। একটু আহত হয়েছে।

কোনও দরকার ছিল? ছোটমা জিজ্ঞাসা করলেন।

অবাক হল অনিমেষ। কী বলছ? ওটা তো এদিকে আসছিল মুরগির বাচ্চাদের খাওয়ার জন্যে।

খেতে আসছিল মানেই খাওয়া নয়। আমরা যদি এদের ঠিকঠাক আগলে রাখি তা হলে সাপ খাবে কী করে? ওটাও তো একটা প্রাণী। ওকেও তো বাঁচতে হবে। এই, চল। ছোটমা ছেলেটিকে নিয়ে চলে গেলেন। অনিমেষের খেয়াল হল দেবেশ এখনও ফোন করেনি। যে সময়ে সে আশ্রম থেকে বের হয়েছে তাতে অনেক আগেই এনজেপি স্টেশনে পৌঁছে যাওয়া উচিত। ফোন করেনি মানে ধরে নেওয়া যেতে পারে আজকের কোনও ট্রেনে টিকিট পায়নি। টিকিট না পাওয়া মানে এখানেই থাকতে হবে।

থাকতে তার খারাপ লাগছে না। বহুদূরের হাইওয়ে দিয়ে ছুটে যাওয়া বাসের ঈষৎ আওয়াজ ছাড়া কোনও যান্ত্রিক শব্দ এখানে শোনা যায় না। পাখির ডাক, হাওয়ার শব্দ আর মাঝে মাঝে আশ্রমে পালিত গোরু ছাগলের ডাক এখানকার নির্জনতাকে সমৃদ্ধ করে। এই গাছগাছালি, পুকুরে জলের শিশু ঢেউ দেখতে দেখতে দিন চমৎকার কেটে যায়। এইরকম পরিবেশে সে। স্বর্গভেঁড়াতেও থাকেনি।

স্বৰ্গছেঁড়া এখান থেকে বড়জোর পঁচিশ মাইল দূরে। বাসে প্রায় এক ঘণ্টা লাগত সে সময়ে। শৈশব-বাল্যকালের সেই জায়গাটার এত কাছে এসেও যাওয়া হল না। অনিমেষ হাসল, মানুষের জীবনে না শব্দটি বারংবার ফিরে ফিরে আসে। একটু তৃপ্তির সঙ্গে অনেকটা অতৃপ্তি চাকার মতো ঘোরে।

গতকাল এখানে আসার পরে মাধবীলতার সঙ্গে দেখা হয়নি। এই আশ্রমে। মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা আলাদা। অনিমেষ শুয়েছিল দেবেশের ঘরে। কাল দুবেলা খাওয়ার সময় বয়স্করা পরিবেশন করেছিলেন, মাধবীলতা ছিল রান্নাঘরে। অর্থাৎ অনিমেষকে না দেখেই একটা দিন বেশ কাটিয়ে দিল মাধবীলতা।

তুমি এখানে? শুনলাম একটা সাপকে ধরতে সাহায্য করেছ? বলতে বলতে মাধবীলতা সামনে এসে দাঁড়াল।

তুমি তো দেখতে গেলে না।

জখম হওয়া প্রাণীকে দেখতে আমার খারাপ লাগবে। স্নানঘরে জল তুলে দিয়েছি, চান সেরে নাও। মাধবীলতা বলল।

অনেক ধন্যবাদ।

আরে। এভাবে কথা বলছ কেন?

কারণ তুমি এখন আমার সঙ্গে কথা না বলেই সিদ্ধান্ত নিতে পারো। আমার মতের বিরুদ্ধে যেতে তোমার এখন কোনও আপত্তি নেই।

বুঝতে পারলাম। মাধবীলতা হাসল, সারা জীবন তুমি যা বলেছ, যাতে তোমার খারাপ না লাগে সেইমতো কাজ করে এসেছি। অনেক সময় পছন্দ না হলেও সেটা তোমাকে জানাইনি। কিন্তু একটা সময় তো মনে হয়, আমিও একজন মানুষ, নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী কিছু কাজ করি। তোমার পরিবারের পাশে তুমি কখনও দাঁড়াওনি, অবশ্য সেই ক্ষমতা শরীরের জন্যে তোমার ছিল না। আমিও তোমাকে অনুসরণ করে গেছি। ওই বাড়িটাকে এতকাল বুক দিয়ে যিনি আগলে রেখেছিলেন, তিনি যদি আমাকে একটা অনুরোধ করেন তা হলে তা আমি পছন্দ না করলেও শুধু তার শান্তির জন্যে করতে চাই। কাউকে তৃপ্তি দিয়ে নিজেকে সংকুচিত করতে আমার আপত্তি নেই। তুমি স্বামীর ভূমিকা নিয়ে আমাকে নিষেধ করবে বলেই আমি তোমাকে জানাইনি।

বাঃ। চমৎকার। এখন থেকে আমরা যে যার মতো ভাবব?

আমি সে কথা একবারও বলিনি। ভাবতে পারো কিন্তু দোহাই খেয়োখেয়ি কোরো না। কলকাতায় ফিরে গিয়ে আমি দুরাতের জন্যে গয়া থেকে ঘুরে আসব।

তিনজন মৃত মানুষ আর একজন জীবিত মানুষের আত্মার শান্তির জন্যে।

ওহো। তাই তো। একদম ভুলে গিয়েছিলাম। মাধবীলতা বলল।

তুমি তো কিছুই ভোলো না।

হ্যাঁ। ভুলে গিয়েছিলাম। তোমার মুখ থেকে শুনেছিলাম। তুমি যখন কলেজ হস্টেলে ছিলে তখন একদিন তোমার দাদু সরিৎশেখর মজুমদার আচমকা উপস্থিত হয়েছিলেন। তার মাথা কামানো ছিল এবং বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তোমার কি এখনও সে কথা মনে আছে? মাধবীলতা তাকাল।

হ্যাঁ, মনে আছে।

তা হলে তিনজন মৃত মানুষের শ্রাদ্ধের কথা বলছ কেন? তোমার দাদু। তো বেঁচে থাকতেই নিজের শ্রাদ্ধ গয়ায় গিয়ে করে এসেছিলেন, তাই না? তা হলে তার পুত্রবধূ হয়ে ছোটমার একই ইচ্ছে হলে তোমার কোনও মন্তব্য করা উচিত নয়। দুজন মৃত এবং একজন জীবিত মানুষ, যারা তোমার পরিবারের তাদের জন্যে আমি যেতেই পারি। মাধবীলতা হেসে চলে যাচ্ছিল কিন্তু অনিমেষ বলল, হিসেবে ভুল হল। আমার মাকে বাদ দিচ্ছ কেন?

তোমার মায়ের কথা ছোটমা আমাকে বলেননি। আমি তো নিজে কাজটা করতে যাচ্ছি না। উনি যাঁদের কথা বলেছেন, শুধু তাদের কাজ করব। মাধবীলতা বলল, যাও, স্নান করে নাও।

শোনো, আমি কদিন এখানে থেকে যেতে চাই।

হঠাৎ?

এই আশ্রমে এসে আমার ভাল লাগছে, তাই।

ভাল তো আমারও লাগছে। রিটায়ার করার পর যে হাঁপিয়ে পড়া জীবনযাপন করছিলাম এখানে এসে মনে হচ্ছে মুক্তি পাচ্ছি। তুমি দেবেশবাবুর সঙ্গে কথা বলো না, ছোটমায়ের মতো আমরাও যদি এখানে থেকে যাই।

আমি কদিন থাকতে চেয়েছি। সারা জীবন নয়। তুমি যদি সারা জীবন থাকতে চাও তা হলে দেবেশ এলে কথা বলল।

তুমি কলকাতায় আর আমি এখানে। পারবে? মাধবীলতা তাকাল।

মানুষ পারে না এমন কোনও কাজ নেই। অনিমেষ বলল।

অনিমেষ। অনিমেষ। ডাকতে ডাকতে দেবেশ চলে এল সামনে, বলল, তোরা দুজন এখানে? তৈরি হয়ে নে। তিস্তাতোর্সায় তোদের টিকিট পেয়েছি। এই কাছেই জলপাইগুড়ি রোড স্টেশন থেকে ট্রেনে তুলে দেব। কিন্তু বেশি সময় নেই। আমি মোবাইলে তোদের কিছুতেই ধরতে পারিনি। এক ঘণ্টার মধ্যে রেডি হয়ে নে। দেবেশ যেমন এসেছিল তেমন চলে গেল।

মাধবীলতা হাসল, দেবেশকে বললে না তো আরও কদিন এখানে থাকতে চাও। অনিমেষ কথা না বলে দ্রুত সামনে থেকে সরে গেলে মাধবীলতা মোবাইল বের করে অর্কর নাম্বার টিপল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে শুনতে পেল, আউট অফ রিচ।

.

৪০.

ঈশ্বরপুকুর লেনে ঢোকার মুখেই সুরেন মাইতির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কয়েকজন অল্পবয়সি ছেলেকে উত্তেজিত হয়ে কিছু বোঝাচ্ছে। শ্রোতাদের একজন ইশারায় অর্কর কথা বলতেই সুরেন মাইতি ঘুরে দাঁড়াল। একেবারে মুখোমুখি বলে অর্ক ঠোঁটে এক চিলতে হাসি এনে গলির ভেতর ঢুকতে যাচ্ছিল কিন্তু সুরেন মাইতি শূন্যে হাত তুলেছে দেখে তাকে থামতে হল। সে গলা তুলে জিজ্ঞাসা করল, কিছু বলবেন?

শ্রোতাদের কিছু বলে সুরেন মাইতি এগিয়ে এল, বাড়িতে ফিরছেন নিশ্চয়ই, চলুন, হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি।

অর্ক বুঝতে পারল তার সঙ্গে আলাদা কথা বলার জন্যেই সুরেন মাইতি দল ছেড়ে চলে এল। কয়েক পা হেঁটে সুরেন মাইতি জিজ্ঞাসা করল, বড়বাবুকে কেমন লাগল?

বড়বাবু? অবাক হল অক।

দূর মশাই। থানার ওসিকে যে বড়বাবু বলা হয় তা জানেন না?

ও। আপনি তা হলে জেনে গেছেন ব্যাপারটা!

জেনে গেছি মানে? এই যে আপনি লকআপে না ঢুকে বাড়ি ফিরছেন তার জন্যে এই লোকটার সামান্য অবদান আছে। একজন মাওবাদীকে সাহায্য করার অপরাধে দশ বছর ভেতরে ঢুকিয়ে রাখতে পারত। যেহেতু আপনার বাবা মুখ্যমন্ত্রীর সহপাঠী ছিলেন, নকশাল হয়ে জেল খেটেও বন্দি মুক্তির সুযোগ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে কোনও রাজনীতি দলে যোগ দেননি, আপনাকে সেসব করতে দেখিনি বলে আমি বড়বাবুকে অনুরোধ করেছিলাম একটা সুযোগ আপনাকে দিতে। হাসিমুখে মাথা নাড়ল সুরেন মাইতি।

অর্ক কোনও কথা বলল না। খানিকটা হাঁটার পর সুরেন মাইতি আবার কথা বলল, আপনি যাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন সে নন্দীগ্রামে গিয়ে আমাদের কজন কমরেডকে গুলি করে মেরেছে তার হিসেব রাখেন?

অর্ক হেসে ফেলল, এই তথ্য আপনি কোথায় পেলেন?

লোকটা যেদিন ঈশ্বরপুকুর থেকে উধাও হয়েছিল তার পরের দিন থেকেই। নন্দীগ্রামে মাওবাদীরা ঢুকেছিল সুন্দরবন দিয়ে। দেখুন, আপনারা কি ভাবেন আমরা মূর্খের স্বর্গে বাস করি? যারা জমি নিয়ে আন্দোলন করছিল তারা আধুনিক বন্দুক চালানো শিখে গেল? কোথায় পেল ওইসব অস্ত্র? যারা এই কাজ করেছে তাদের আড়াল করতে তৃণমূলের নেত্রী ঘোষণা করে দিলেন, পশ্চিমবঙ্গে কোনও মাওবাদী নেই। উত্তেজিত হল সুরেন মাইতি।

যারা কৃষকদের হয়ে লড়াই করেছিল তারা কি ধরা পড়েছে?

কী করে ধরা পড়বে? তার আগেই তাদের সরিয়ে দেবার ব্যবস্থা হয়েছে। যাক গে, আপনি আমাকে বলুন, লোকটা এখন কোথায়?

বিশ্বাস করুন, আমি জানি না।

হু! শেষ প্রশ্ন, আপনি কি তৃণমূলে জয়েন করেছেন?

সুরেন মাইতির প্রশ্ন শুনে অর্ক একটু ভেবে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, আপনি বলুন তো, তৃণমূলের রাজনীতি কোন তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে আছে?

কাঁধ নাচাল সুরেন মাইতি, কেন? ওই মা-মাটি-মানুষকে টুপি পরানো।

অর্কর গলার স্বর শক্ত হল, সুরেনবাবু, আপনি কোনও মতবাদকে শ্রদ্ধা নাও করতে পারেন কিন্তু তাকে ব্যঙ্গ করার কোনও অধিকার আপনার নেই।

দূর মশাই। ব্যঙ্গ করার মতো কেউ কিছু করলে তাকে পুজো করব? কোনও মতবাদ নেই, আদর্শ নেই, শুধু সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দিয়ে পাবলিককে খেপিয়ে তুলছেন মহিলা, স্বপ্ন দেখছেন পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী হলে সবাইকে স্বর্গে নিয়ে যাবেন? পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম কখনও হয়েছে? সুরেন মাইতি জিজ্ঞাসা করল।

পৃথিবীর ইতিহাসে কি এমন উদাহরণ আর একটা খুঁজে পাবেন যেখানে একজন সাধারণ মহিলা একা যে আন্দোলন গড়ে তুলছেন তাতে ভয়ংকর শক্তিশালী বামফ্রন্ট সরকারের মতো আদর্শবাদী সরকার ভয়ে কাঁপছেন? একজন একদম একা, তাঁর পাশে যারা গিয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের অধিকাংশের কোনও পরিচিতি নেই, নেত্রী যা বলছেন তাই তাদের কাছে বেদমন্ত্র, সেই একা মহিলাকে আপনারা যখন ভয় পাচ্ছেন তখন বুঝতেই হবে আপনারা টের পাচ্ছেন জনসমর্থন কার সঙ্গে আছে। অর্ক বেশ স্পষ্ট কথাগুলো বলল।

অর্থাৎ আপনি স্বীকার করলেন যে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন।

আমি সেটা একবারও বলিনি।

আর কী বাকি রাখলেন বলতে? বিশ্বজিৎকে সঙ্গে নিয়ে থানায় গিয়েছিলেন যাতে বড়বাবুকে একটু চমকানো যায়। শুনে রাখুন বামফ্রন্ট তিন দশকের ওপর যেমন ক্ষমতায় আছে তেমনি আগামী তিন দশকও থাকবে। প্রায় হুংকার দিল সুরেন মাইতি, শুনুন অর্কবাবু, আপনার সঙ্গে আমরা সহযোগিতা করতে চাইছি। ওই মাওবাদী লোকটি কোথায় আছে তা আমাদের জানিয়ে দিন। ওকে ধরে যদি জেরা করা যায় তা হলে নন্দীগ্রামের নেপথ্য কাহিনি আমরা মানুষকে জানাতে পারব। আমি সন্ধেবেলায় আবার আপনার কাছে আসব। চলি।

.

বাড়িতে ফিরে খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল অর্ক। তার মনে হচ্ছিল সাঁড়াশির দুটো শক্ত হাত তার দিকে এগিয়ে আসছে। একটা পুলিশ অন্যটা সুরেন মাইতির দল। এরা তার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলবেই।

এতদিন যে জীবন সে যাপন করেছে তা যেন ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। চাকরিতে জয়েন করার তারিখ চলে গিয়েছে বেশ কয়েকদিন হল। চাকরিটা চলে গেলে নতুন সমস্যা যোগ হবে। অর্ক অফিসে ফোন করল। তাদের ইনচার্জ ভদ্রলোক ফোন পেয়েই খেপে গেলেন, কী ভাবছেন আপনি? এটা কি আপনার মামার বাড়ি? যখন ইচ্ছে ছুটি নেবেন, যেদিন জয়েন করার কথা সেদিন হাওয়া হয়ে থাকবেন, আবার মর্জিমতো ফোন করবেন, এটা কর্তৃপক্ষ মেনে নেবে বলে ভাবলেন কী করে?

আমি বুঝতে পারছি কাজটা ঠিক হয়নি। কিন্তু আচমকা এমন সমস্যায় জড়িয়ে গিয়েছিলাম যে যোগাযোগ করতে পারিনি। অর্ক বলল।

কী সমস্যা? চুরিচামারি না খুন করেছেন? মানে?

না হলে পুলিশ এসে আপনার সম্পর্কে খোঁজ খবর করবে কেন?

অবাক হয়ে গেল অর্ক, পুলিশ এসেছিল আমার খোঁজে?

হ্যাঁ। আপনার চরিত্র কীরকম, মন দিয়ে কাজ করেন কিনা, কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত তা জিজ্ঞাসা করছিল। আমরা যতটুকু জানি তা বলেছি, যা জানি না তা বলিনি। খোঁজ করার কারণ হিসেবে বলেছে রুটিন চেক আপ।

এসব কেন হল বুঝতে পারছি না। অর্ক বলল।

আমরাও বুঝতে পারছি না। দেখুন, আপনি আমাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন আছেন, কাজের ব্যাপারে আপনার বিরুদ্ধে কোনও কমপ্লেন নেই, তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেহেতু আপনার প্রচুর ছুটি পাওনা আছে তাই টানা এক মাস ছুটিতে আপনি থাকুন, কালকের মধ্যেই এই ছুটির জন্যে আবেদন করবেন, সেই ছুটির শেষে যদি জয়েন না করেন তখন, বুঝতেই পারছেন, ব্যবস্থা না নিয়ে কোনও উপায় থাকবে না। ফোন রেখে দিলেন ভদ্রলোক।

তৎক্ষণাৎ ছুটির জন্যে আবেদনপত্র লিখে ফেলল অর্ক। দরজায় তালা ঝুলিয়ে ঈশ্বরপুকুর লেনের মুখের পোস্ট অফিস থেকে একটা খাম কিনে তাতে ঠিকানা লিখে সেটা পোস্ট বক্সে ফেলে দিল।

খুব খিদে পাচ্ছে এখন। অর্ক চারপাশে তাকাল। এই এলাকার রেস্টুরেন্টে সব খাবার পাওয়া যায় কিন্তু সেগুলো বড় একঘেয়ে। অর্কর ইচ্ছে হল ধর্মতলায় গিয়ে মাটন চাপ আর তন্দুরি রুটি খাওয়ার। বহুকাল এসব খাওয়া হয়নি। সে দেখল ডিপো থেকে একটা ট্রাম বেরুবার উদ্যোগ নিচ্ছে। ট্রামগুলো ওখান থেকে মুখ বের করে এক মিনিট থমকে থাকে। এসপ্ল্যানেড লেখা দেখে সে দৌড়ে ট্রামে উঠতেই কন্ডাক্টার বললেন, ভাড়া ফেরত দিতে পারব না কিন্তু।

এরকম সংলাপ কখনও শোনেনি অর্ক। জিজ্ঞাসা করল, কী বললেন?

কলেজ স্ট্রিট থেকে মিছিল বেরুবার কথা আছে। সেখানে গাড়ি পৌঁছাবার আগেই যদি মিছিল বের হয় তা হলে কতক্ষণ দাঁড়াতে হবে জানি না। সে সময় অনেকে ভাড়ার টাকা ফেরত চায় বলে আগাম জানিয়ে দিলাম।

কীসের মিছিল? সিটে বসে থাকা একটি যুবক বলল, আপনি আজকের কাগজ নিশ্চয়ই দেখেননি। নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলি চালানোর প্রতিবাদে কলেজ স্ট্রিট থেকে মিছিল যাবে ধর্মতলা পর্যন্ত।

তৃণমূলের মিছিল? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

তা বলতে পারব না। বিদ্বজ্জনেরা ডাক দিয়েছেন। ওই নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে সাধারণ মানুষকে মিছিলে যোগ দিতে বলেছেন। লাক ভাল থাকলে মিছিল বের হওয়ার আগেই কলেজ স্কোয়ার পেরিয়ে যেতে পারব। যুবকটি বলল।

ট্রাম চলছে। যেই কোনও স্টপে থামছে অমনি উঠে আসা যাত্রীদের একই কথা শোনাচ্ছেন কন্ডাক্টার। অর্ক লক্ষ করল এর ফলে কেউ আর টিকিট কাটছে না, যার গন্তব্য কলেজ স্ট্রিটের আগে সে-ও টিকিট না কেটে নেমে যাচ্ছে।

মহাত্মা গাঁধী রোডের মোড়ে ট্রাম দাঁড়িয়ে গেল। সামনের রাস্তায় অচল গাড়ির জটলা। ওপাশ থেকেও গাড়ি আসছে না। সেই যুবকটি হঠাৎ বলে উঠল, মার গাড়িয়েছে, বলে নেমে গেল টিকিট না কেটেই। শব্দ দুটোর অর্থ বোধগম্য হল না অর্কর। ঈশ্বরপুকুর লেনের রকবাজরা যে সমস্ত শব্দ উচ্চারণ করত তা এখন বস্তির মেয়েরাও রপ্ত করে ফেলেছে। বাবার কাছে শুনেছে সে একসময় শালা শব্দটা বড়দের সামনে বললে প্রচণ্ড মার খেতে হত। কথাটা শুনে এখনকার ছেলেমেয়েরা হাসবে, কিন্তু ওই যুবকটি যা বলে গেল তা সে কখনও শোনেনি।

ফুটপাত ধরে খানিকটা এগিয়ে যেতেই প্রচুর মানুষের ভিড় চোখে পড়ল। উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে মাইকে একজন জানাচ্ছিলেন, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের প্রতিবাদ মিছিল পথে নামবে। আমরা যারা গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করতে চাই, শোষকের রক্তচক্ষুকে ভয় পাই না, আমরা যারা সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে চাই তাদের সম্মিলিত প্রতিবাদ এই মিছিল। পশ্চিমবঙ্গের প্রথম শ্রেণির যত শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী এই মিছিলে অংশগ্রহণ করবেন, যিনি এর আগে কখনও মিছিলে যোগ দেননি তিনিও বামফ্রন্ট সরকারের ঘৃণ্য আচরণের প্রতি ধিক্কার জানাতে রাস্তায় পা রাখছেন। আমি আপনাদের কাছে আবেদন করছি, অত্যন্ত সুশৃঙ্খল এবং শান্তিপূর্ণভাবে এই মিছিলে অংশগ্রহণ করুন।

ভিড় ঠেলে খানিকটা এগোতেই বিখ্যাত মানুষগুলোকে দেখতে পেল অর্ক। এঁরা দীর্ঘদিন ধরে ছবি আঁকছেন, অভিনয় করছেন, লেখালেখি করে মানুষের ভালবাসা পেয়েছেন। এঁদের কেউই কোনও রাজনৈতিক দলের হয়ে প্রচারে নামেননি। এই মানুষগুলো আজ নেমে এসেছেন প্রতিবাদে সামিল হতে। অর্ক লক্ষ করল এখানে কোনও দলের পতাকা নেই। এমনকী তৃণমূলেরও নেই। সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক এমন প্রতিবাদ মিছিল এর আগে কখনও হয়েছে কিনা তা প্রাচীনরা বলতে পারবেন কিন্তু অর্ক মনে করতে পারল না।

মিছিল শুরু হল। একটা লম্বা ফেস্টুনের পেছনে বাংলার বিখ্যাত ব্যক্তিরা, তারপরে গ্রুপ থিয়েটার, লিটল ম্যাগাজিনের কর্মীরা, তারপরে সাধারণ মানুষ। অর্ক অবাক হয়ে সেই মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে দেখল রাস্তার পাশের বাড়িগুলোর বারান্দায় যেসব মানুষ উৎসুক হয়ে মিছিল দেখার জন্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাদের অনেকেই নেমে এসে মিছিলে যোগ দিচ্ছেন। ফলে মিছিলের আয়তন ক্রমশ বেড়ে চলেছে।

কোনও স্লোগান নেই, কলেজ স্ট্রিট বোধহয় এতবড় নীরব ধিক্কার মিছিল আগে দেখেনি। হাঁটতে হাঁটতে অর্কর মনে পড়ল রামজিকে। রামজির যাওয়ার কথা ছিল সুন্দরবনে। সেখান থেকে কোথায় যেতে হবে তা ওকে বলা হয়নি। সুন্দরবন থেকে নৌকো করে নন্দীগ্রামের কাছাকাছি কোনও জায়গায় পৌঁছানো যায়?যদি যায় তাহলে রামজিকি পুলিশের সঙ্গে লড়াইয়ে সামিল হত? পুলিশের ধারণা সে ওই কাজটা করেছে, কিন্তু অর্ক নিশ্চিত জানে নন্দীগ্রামের যুদ্ধের সময় রামজি তার সঙ্গে ছিল। গুরুমায়ের আশ্রম থেকে বেরিয়ে হাইওয়েতে এসে তারা প্রথম শুনতে পেয়েছিল নন্দীগ্রামে পুলিশ গুলি চালিয়েছে। খারাপ হওয়া গাড়িতে বসে আই পি এস ভদ্রলোকের স্ত্রী কথাটা বলেছিলেন। অতএব রামজি নন্দীগ্রামের সঙ্গে কোনওভাবেই জড়িত নয়।

মিছিল বউবাজারের মোড় পেরিয়ে যাচ্ছে যখন তখন গলাটা কানে এল, আরে! আপনি? কেমন আছেন?

মুখ ফিরিয়ে অবাক হল অর্ক। কুন্তী সেন। গুরুমায়ের আশ্রমে ওঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সে বলল, ভাল। আপনি–?

সকালে কাগজে খবরটা দেখে চলে এলাম। গাড়ি আনিনি। হাওড়ায় এসে সোজা এখানে। নন্দীগ্রামে কী কাণ্ড হল বলুন তো? হাঁটতে হাঁটতে পাশে চলে এলেন কুন্তী সেন, আমি ভাবতেই পারি না, কোনও কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় থাকতে থাকতে এরকম বুর্জোয়াদের মতো কাজ করতে পারে।

অর্ক কিছু বলল না। গত কয়েকদিনের খবরের কাগজ, টিভির সঙ্গে তার কোনও সংশ্রব ছিল না। এ বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী কী বলেছেন তাও তার জানা নেই। কিন্তু যাই বলুন না কেন এই বিষয়ে তিনি তার দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারেন না।

কিছুটা হাঁটার পর অর্ক জিজ্ঞাসা করল, মিছিলের খবর জেনে আপনি সেই ব্যান্ডেল থেকে চলে এলেন?

সেই ব্যান্ডেল মানে? এখান থেকে গড়িয়াতে যেতে যে সময় লাগে তার থেকে কম সময় ব্যান্ডেলে যেতে লাগবে। এলাম কেননা, মনে হয়েছিল এই প্রতিবাদের মিছিলে আমারও অংশ নেওয়া উচিত। কুন্তী সেন বললেন।

কয়েকদিন আমি খবরের কাগজ পড়ার সুযোগ পাইনি। তাই–।

বাইরে বাইরে ঘুরছিলেন?

হ্যাঁ।

সেদিন গুরুমায়ের আশ্রমে পুলিশ এসেছিল, জানেন?

অনুমান করছি।

তাদের কাছে খবর ছিল বাইরে থেকে দুজন মানুষ নাকি ওখানে আশ্রয় নিয়েছে। গুরুমা তাদের অনুমতি দিলে তারা তল্লাশি চালায় কিন্তু কোনও বাইরের লোককে না পেয়ে চলে যায়।

ওরা কী করে খবর পেল?

তা বলতে পারব না। কিন্তু আপনাদের কেন চলে যেতে হল?

অর্ক একটু ভাবল, তারপর বলল, আমার সঙ্গে যে ছিল তার কাজকর্ম সম্পর্কে আমি স্পষ্ট কিছু জানি না। ছেলেটিকে ভাল লেগেছিল, বুঝেছিলাম সে পুলিশকে এড়িয়ে চলতে চায়। আমার অনুমান গুরুমাও তাই বুঝেছিলেন। আশ্রমে যাওয়ার পরই বলেছিলেন নদীর ধারটা ঘুরে দেখে আসতে। সত্যি কথা হল, আমার সঙ্গীর জন্যেই পুলিশ আসার আগে তড়িঘড়ি চলে আসি।

আপনার সঙ্গী কি মাওবাদী?

বিশ্বাস করুন, আমি জানি না। তবে পুলিশ থেকে শুরু করে সিপিএম এবং তৃণমূলের পাড়ার নেতাদের তাই ধারণা। আমাকে প্রচণ্ড চাপে রেখেছে ওরা।

কুন্তী কিছুক্ষণ কথা না বলে হাঁটলেন। মিছিলে আরও মানুষ যোগ দিয়েছেন এর মধ্যে। কুন্তী বললেন, আমাকে বলা হয়েছিল আপনারা হাইওয়েতে অপেক্ষা করবেন। আমার কথা ছিল বোলপুরে এক বান্ধবীর বাড়িতে ওই রাতে থেকে যাওয়ার, কিন্তু তা না করে গাড়ি নিয়ে বর্ধমানের দিকে অনেকটা গিয়েও না দেখা পেয়ে বোলপুরে ফিরে গিয়েছিলাম।

ও। আমরা বোধহয় তার আগেই লিফ্ট পেয়ে গিয়েছিলাম।

সেই দুপুরের পর অর্কর মনে হল পশ্চিমবাংলার মানুষ আর বামফ্রন্টের সঙ্গে নেই। স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষ ধিক্কার জানাচ্ছে। তাতে তার স্থির বিশ্বাস হল নন্দীগ্রামেই বামফ্রন্টের তেত্রিশ বছরের শরীর কবরে যাওয়ার জন্যে কফিন তৈরি করে ফেলল। কথাটা কুন্তীকে বলতেই কুন্তী হাসলেন, যত দিন এগোবে তত বামফ্রন্টের নেতারা উদ্ধত হবেন, তত মাথা গরম করে অসংলগ্ন কথা বলবেন। আমরা-ওরার বিভাজন তৈরি করবেন। বিরোধী মানুষের শরীর উধাও হয়ে যাবে পথের কাঁটা সরাবার কারণে। অথচ, বিশ্বাস করুন, সেই ছাত্রাবস্থা থেকে আমি কল্পনা করে এসেছি, কমিউনিজমই মানুষকে সুস্থ জীবনযাপন করতে সাহায্য করতে পারে, কমিউনিজমই সাম্যবাদের আঁতুড়ঘর। বাবার কাছে শুনেছিলাম তারা যখন নকশাল আন্দোলনের পরিকল্পনা করেছিলেন তখন এদেশের কেউ ভাবতেই পারত না কমিউনিস্ট সরকার আসবে। পরে যখন এল তখন মানুষ স্বপ্ন দেখতে চাইল, কিন্তু কোথায় গেল সব? ক্ষমতা মানুষকে উন্মাদ করে দেয়, এখন সেই আমিই চাইছি, পরিবর্তন হোক।

মিছিলের শেষে নিউ মার্কেটের পাশে একটি রেস্টুরেন্টে মাটন চাপ আর তন্দুরি রুটির অর্ডার দিয়ে ওরা কথা বলছিল। অর্ক হাসল, পরিবর্তন তো চাই, কিন্তু পরিবর্তিত সরকার কোন দলের হবে?

দেখবেন, সেটা মানুষই ঠিক করে দেবে।

ভোটবাক্সে?

তা ছাড়া তো মানুষের আর কোনও অস্ত্র নেই।

কিন্তু সেটার জন্যে উপযুক্ত দল চাই। বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে কংগ্রেসকে

মানুষ উপযুক্ত দল বলে এই মুহূর্তে ভাবতে পারে না। তার চেয়ে এই অল্প সময়ে তৃণমূল নেত্রী মানুষের সপক্ষে কথা বলে অনেকটা এগিয়ে আছে।

আমি কোনও মন্তব্য করব না। কুন্তী বললেন, মানুষই ঠিক করবে।

ধরুন, আপনি ঠিক বলছেন। পশ্চিমবাংলার মানুষ তৃণমূল নেত্রীর ওপর আস্থা রেখে বামফ্রন্টকে সরিয়ে দিল। একটি মানুষ তার বিশ্বাস ভাবনা নিয়ে যে দল তৈরি করেছেন সেই দল ক্ষমতায় এলে কি আপনি নিশ্চিত যে পরিবর্তন চাইছেন তা সম্ভব হবে? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

ভবিষ্যৎ এর উত্তর দেবে। কুন্তী বলামাত্র খাবার এসে গেল।

অর্ক হাসল, কিছু বলল না। কুন্তী খাবারের প্লেট টেনে নিয়ে বললেন, এত মশলা দেওয়া খাবার, হজম করতে পারব তো?

অর্ক বলল, আগামীকাল উত্তরটা দেবে।

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার