ছেলেটিকে ঢুকতে দেখে বড়বাহাদুর খুব অবাক হল। পাহাড়ে যারা রাজনীতি শুরু করেছিল তাদের সে জানে। সেইসব নেতাদের অনেকেই এখন বসে গেছেন। যারা এখনও ক্ষমতায় আছে তাদের চলাফেরা আগের মতো নেই। কিন্তু পরে যারা যোগ দিয়েছে তাদের চালচলন বড় বেশি উগ্র। কথাবার্তায় ভদ্রতা বেশ কম। এই ছেলেটিকে সে দেখেছে অনেকবার। সিনেমা স্টারের মতো হাঁটে, বাইক চালায়। বড়বাহাদুর জিজ্ঞাসা করল, কাকে চাই?

ডক্টর কোথায়?

ডাকদার সাহেব কাল সারারাত জেগে ছিলেন। এখন একটু বিশ্রাম নিচ্ছেন।

ডাকো ওকে, কথা আছে। ছেলেটা পা নাচাল।

আপনি পরে আসলে ভাল হয়।

কোনটা ভাল তা আমি তোমার কাছে শিখব নাকি। আমাকে তুমি চেন না? যা বলছি তাই করো। ছেলেটার গলা চড়ায় উঠল।

বড়বাহাদুর মাথা নাড়ল, আপনি পরে আসুন।

ছেলেটা ভাবতেই পারেনি একজন নেপালি দারোয়ান তার সঙ্গে এই ব্যবহার করবে। সে চিৎকার করে শাসাতে লাগল, তোমাদের মতো দেশদ্রোহীদের জন্যে আমাদের এই অবস্থা। পাহাড়ের লোক হয়ে তুমি বাঙালিবাবুর পা চাটছ। কিন্তু এই করে যদি ভাব পার পেয়ে যাবে তাহলে ভুল ভাবছ। এই এলাকা এখন আমার! ঝামেলা করলে লাশ ফেলে দেব আমি।

বড়বাহাদুরও উত্তেজিত হয়ে পড়ল। সেইসময় ছোটবাহাদুর এসে তাকে সামলাবার চেষ্টা করল। বড়বাহাদুরকে জড়িয়ে ধরে সরিয়ে নিতে চাইছিল সে। ঠিক তখনই ডাক্তার নেমে এলেন। দৃশ্যটা দেখে শান্ত গলায় প্রশ্ন করলেন, কে তুমি? কী হয়েছে?

ছেলেটা ঘুরে দাঁড়াল, পিচ করে থুতু ফেলল, এই লোকটাকে ছাড়িয়ে দিন।

আমি আমার প্রশ্নের উত্তর পাইনি। ডাক্তারের গলা গম্ভীর।

আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছিলাম। এই লোকটা আমাকে অপমান করেছে, এ শালার এমন হিম্মত যে আমাকে–।

এক মিনিট। তুমি তোমার বাবার বয়সী মানুষকে যে ভাষায় গালাগালি করছ তাতে তোমার সঙ্গে এর ব্যাপারে কথা বলার প্রবৃত্তি আমার নেই। তুমি এখানে কী জন্যে এসেছ তা বলতে পারো। ডাক্তার নিজেকে সংযত রাখছিলেন।

ছেলেটা মাথা নাচাল। স্থির চোখে একবার দেখল ডাক্তারকে। তারপর বলল, আপনার এই হাসপাতালে কজন নেপালি পেশেন্ট আছে?

আমার কাছে পেশেন্ট হল একজন মানুষ। নেপালি বাঙালি বলে কিছু নেই।

ফালতু কথা। আপনি কোনও নেপালি পেশেন্টকে ভর্তি করেন না। গত রাতে তিনজন পেশেন্ট এসেছিল আপনি ভর্তি না করে শহরের হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কথাটা ঠিক, না মিথ্যে?

তুমি কে?

ছোটবাহাদুর পরিচয়টা দিল। পার্বত্য জাতীয় পার্টির তরুণ তুর্কী নেতা। এই এলাকার দায়িত্ব ওর ওপর দেওয়া হয়েছে। ছেলেটা সেটা উপেক্ষা করে বলল, জবাব দিন।

আমার এখানে বিশেষ একটি অসুখে আক্রান্ত পেশেন্টদের চিকিৎসা করা হয়। অন্য অসুখের জন্যে হাসপাতাল রয়েছে। আর এটা হাসপাতাল নয়।

তাই নাকি? তাহলে বাইরে সেটা লিখে দেননি কেন?

তুমি মনে হচ্ছে নতুন এসেছ এখানে। তোমার নেতাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলো। তাঁরা আমাকে এবং নিরাময়কে জানেন। ওঁরাই তোমাকে ঠিক খবর দেবেন।

আপনি আমাকে নেতা দেখাচ্ছেন!

তুমি গায়ে পড়ে ঝগড়া করছ। আর কিছু বলার আছে তোমার?

হ্যাঁ। আপনার এখানে থাকে একটা ছেলে পাহাড়ের বাচ্চাদের বিভ্রান্ত করছে!

বিভ্রান্ত করছে?

হা। তাদের ভুল গান শেখাচ্ছে। আপনারা এতদিন আমাদের দারোয়ান আর কুক বানিয়ে রেখেছিলেন। ওই যে ওই লোকটা, ও কি নিজেকে মানুষ ভাবে? আপনারাই ভাবতে দেননি এতকাল। এখন পাহাড়ের মানুষ জেগে উঠেছে। তারা প্রতিবাদ করতে শিখেছে। এখন আপনি ওই ছেলেটাকে দিয়ে বাচ্চাদের ব্রেনওয়াশ করাচ্ছেন। কিন্তু এটা চলবে না। ছেলেটাকে ওর বাপ মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিন।

ডাক্তার হেসে ফেললেন, ছেলেটা কী গান শেখাচ্ছিল?

বাঙালিদের প্রশংসা করা গান। ও গান এখানে চলবে না।

তুমি কী করে ভাবলে বলা মাত্রই আমি ছেলেটাকে ওর বাড়িতে পাঠিয়ে দেব।

আপনাকে পাঠাতে হবে। একটু আগে শুনলাম, পাহাড়ি বাচ্চারা ওই গানের সুর গুনগুন করে গাইছে। এটা হতে দেব না। ছেলেটি দৃঢ় গলায় বলল।

ডাক্তার এবার হাসলেন, বাঃ। একবার শুনেই তোমার গানের সুর মনে আছে। তাহলে সুরটা বেশ ভাল তাই না? তোমার নাম কী হে?

ছেলেটা ছোটবাহাদূরের দিকে তাকাল, অ্যাই, আমার নাম জানা আছে?

ছোটবাহাদুর বলল, ওর নাম সামু।

আজকাল তোমাদের নামও কত বদলে যাচ্ছে। তা ভাই সামু, পাহাড়ে যখন প্রথম আগুন লেগেছিল তখনও কেউ আমাকে তাদের শত্রু বলে মনে করেনি। আমার এই নিরাময়ের কথা বোধহয় ঘিসিং সাহেবও জানেন। আমি যে পাহাড়ি মানুষদের শত্রু নই এটা নতুন করে কাউকে বলতে হয় না। মনে হচ্ছে তুমি ভুল বুঝেছ। এখন আমি খুব টায়ার্ড, পরে একদিন এসো, কথা বলব।

ছেলেটি কিছু বলতে যাচ্ছিল ঠিক তখনই মিস্টার ব্রাউনকে দেখা গেল গেট পেরিয়ে নিরাময়ে ঢুকতে। কাছে এসে মিস্টার ব্রাউন জিজ্ঞাসা করলেন, আমি খুব চিন্তায় আছি ডাক্তার, সায়ন এখন কেমন আছে?

অনেক ভাল মিস্টার ব্রাউন। তবে দুদিন ওকে ঘরেই রেস্ট নিতে হবে।

ও। যিশু ওকে রক্ষা করুন। হঠাৎ কেন ব্লিডিং হল?

একটু অস্বাভাবিক ব্যাপার। মানসিক উত্তেজনা থেকে রক্তে প্রতিক্রিয়া হয়েছে। ওর মতো ভাবপ্রবণ ছেলের মানসিক উত্তেজনা সবসময় হতে পারে। আর তা হলে যদি রক্তপাত হয় তাহলে সামলানো মুশকিল হবে। সামু, তুমি যার সম্পর্কে অভিযোগ করতে এসেছিলে মিস্টার ব্রাউন তার সম্পর্কে কথা বলছেন।

মিস্টার ব্রাউন অবাক হয়ে সামুকে দেখলেন, কী ব্যাপার। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। সায়নের বিরুদ্ধে তুমি অভিযোগ করতে এসেছ?

সামু মিস্টার ব্রাউনকে জবাব না দিয়ে ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করল, ওই ছেলেটার ব্লিডিং হয়েছে?

হ্যাঁ। ও যে অসুখে আক্রান্ত তাতে রক্ত বেশি তরল হয়ে গেলেই কান-নাক দিয়ে বেরিয়ে আসে। সেই সময় ওদের টাটকা রক্ত দিতে হয়। তুমি শুনলে অবাক হবে কাল রাত্রে ওর প্রাণ বাঁচিয়েছে যে ছেলেটি সে একজন নেপালি। প্রয়োজনে আমাকে রক্ত দিয়ে সাহায্য করবে এমন অনেকেই এখানে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তুমি নতুন এসেছ, এসব কথা তাই জানো না। মিস্টার ব্রাউন, সামুকে আপনি চেনেন? ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন।

মিস্টার ব্রাউন বললেন, দেখেছি। মোটরবাইকে করে যাওয়া আসা করে, তাই তো?

সামু মিস্টার ব্রাউনের দিকে তাকাল। এই বৃদ্ধ নেপালি ভদ্রলোকের উপস্থিতি সে যে পছন্দ করছে না তা তার চাহনিতে বোঝা গেল। কিন্তু আর কোনও কথা না বলে সে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল। একটু বাদেই তার মোটরবাইকের আওয়াজ শোনা গেল।

মিস্টার ব্রাউন জিজ্ঞাসা করলেন, আমি বুঝতে পারছি না, ছেলেটি কী চায়?

ডাক্তার বললেন, অল্প বয়স, হাতে দায়িত্ব পেয়ে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারছে না। সব সরষের মধ্যেই ভূত দেখছে। ওকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, এরকম উঠতি নেতা সর্বত্র ছড়িয়ে আছে।

নেতা! ছেলেটি এখানকার নেতা?

হ্যাঁ। ওর ওপর দল এই এলাকার দায়িত্ব দিয়েছে।

তা দিক। কিন্তু সায়নের কোন অন্যায় ও খুঁজে বের করল?

সায়ন বাচ্চাদের নিয়ে গান গায়। ধনধান্যপুষ্পভরা গানটা ওরা গাইছিল। বহুবছর আগে লেখা দেশাত্মবোধক গানটির সুর এবং কথা খুব সুন্দর। ছেলেটির আপত্তি ওই গান গাওয়া চলবে না, কারণ তাতে নেপালিদের কথা লেখা নেই। ও আমাকে বলল সায়নকে তার বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে কারণ ওর জন্যে এখানকার বাচ্চাদের ক্ষতি হচ্ছে। ডাক্তার কথা বলতে বলতে কোনও রকমে হাই চাপলেন।

মিস্টার ব্রাউন বললেন, ডক্টর, আপনার বিশ্রামের দরকার। আপনি যান, রেস্ট নিন। তারপর তিনি গেটের দিকে হাঁটতে লাগলেন।

আজকের দিনটা তেমন ঝকঝকে না হলেও বৃষ্টি নেই। আর নেই বলেই এরকম দিনে কাজ করতে আগ্রহ বাড়ে সবার। নিরাময়ের গেট থেকে বেরিয়ে নীচের দিকে নামতে লাগলেন মিস্টার ব্রাউন। অত্যন্ত বিরক্ত দেখাচ্ছিল তাঁকে। আজ তাঁর চলার ধরনও বদলে গিয়েছে। বেশ জোরেই হাঁটছিলেন তিনি। শেষ বাঁক ঘোরার সময় পেছন থেকে সিমির গলা শুনতে পেলেন মিস্টার ব্রাউন। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পেলেন টাইট প্যান্ট আর জ্যাকেট পরে সিমি দৌড়োতে দৌড়োতে নামছে। মিস্টার ব্রাউন একটু অপেক্ষা করতেই মেয়েটা পাশে চলে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ওঃ, তুমি কানে এত কম শোন! তখন থেকে ডাকছি অথচ। এত জোরে হেঁটে কোথায় যাচ্ছ?

মিস্টার ব্রাউন গম্ভীর গলায় বললেন, শহরে।

বাব্বা! এত জোরে হাঁটছ যে তোমাকে বুড়ো বলে মনেই হচ্ছিল না। ভালই হল, আমিও শহরে যাচ্ছি, গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে।

মিস্টার ব্রাউন চুপচাপ নীচের রাস্তায় নেমে এলেন। এই রাস্তাটা শিলিগুড়ি থেকে উঠে সোজা দার্জিলিং চলে গিয়েছে। এটাই একমাত্র পথ। সেই কবে ব্রিটিশরা পাহাড় কেটে যে পথ বানিয়েছিল তার কোনও পরিবর্তন নেই। পঞ্চাশ বছর আগে এই পথে সারা দিনে হয়তো পঞ্চাশটা গাড়ি ওপরে উঠত। এখন কয়েক হাজার যাওয়া-আসা করছে। অথচ রাস্তা চওড়া হয়নি, বিকল্প রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে না। একটা বড় পাথর ওপর থেকে গড়িয়ে পড়লেই ঘণ্টার পর ঘন্টা হাজার গাড়ি দাঁড়িয়ে যায়। ভারত স্বাধীন হলেও কেউ এদিকে নজর দেয়নি। কংগ্রেস আমলে যা ছিল, বামফ্রন্টের আমলেও তাই রয়ে গিয়েছে। সুভাষ ঘিসিং ক্ষমতা পাওয়ার পর রাস্তাটার গর্ত কমেছে, কোথাও কোথাও সামান্য বাড়াবার চেষ্টা হচ্ছে মাত্র। কিন্তু এখনই যদি দ্বিতীয় রাস্তা তৈরি না হয় তাহলে বিপর্যয় আসতে বাধ্য। মিস্টার ব্রাউন হাঁটতে হাঁটতে এইসব ভাবছিলেন। দুপাশ দিয়ে গাড়ি যাওয়া আসা করছে। সেগুলোকে যেতে দেওয়ার জন্যে প্রায়ই সরে দাঁড়াতে হচ্ছিল। সেদিন ম্যাথুজদের বড় ভাই বলছিল, কলকাতার গঙ্গার ওপর দ্বিতীয় ব্রিজ তৈরি হয়ে গেছে। খুব সুন্দর করেছে নাকি। তৃতীয়টি বানাবার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এসব শুনলে মনেই হবে পাহাড় উপেক্ষিত। ম্যাথুজ বলছিল, ওরা এখানে কয়েকদিনের জন্যে ভোগ করতে আসে কিন্তু আমাদের কাছে এখানে থাকা মানে জীবনযাপন করা। রাগ হওয়া অস্বাভাবিক কি!

না কিছুই অস্বাভাবিক নয়। এই যে পাহাড়ে আন্দোলনের পর ছোট মাপের ক্ষমতা পেয়েও পাহাড়িদের তেমন উপকার হল না, এটাও অস্বাভাবিক নয়। এরা বলছে পুরো ক্ষমতা চাই নইলে কোনও কাজ করা যাবে না, আর একদল বলছে পুরো ক্ষমতা দিলে সারা দেশ ভেঙে টুকরো টুকরো হবে।

তোমার কী হয়েছে? অনেকক্ষণ পরে সিমি প্রশ্নটা করল।

মিস্টার ব্রাউন মাথা নেড়ে নিঃশব্দে জানালেন তাঁর কিছু হয়নি।

নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। তুমি এতক্ষণ চুপচাপ থাকো না।

এবার একটু সহজ হওয়ার চেষ্টা করলেন মিস্টার ব্রাউন, আমি যে বয়সে পৌঁছেছি সেই বয়সে মানুষের কিছুই হয় না। নৌকো কিংবা ভেলা পায়ের তলায় নেই, কাঠ আঁকড়ে ধরে স্রোতের টানে ভেসে চলার জীবন এখন। এই ডুবছি, এই ভাসছি, এখন কি আর কোনও কিছু হয়?

মোটেই না। তুমি তাহলে মদ খেতে আনন্দ পাও কেন? টিভির মেয়েগুলোকে দুচোখ দিয়ে গেলো কেন? ম্যাথুজের দোকান থেকে মাংস কিনে আরাম করে খাও কেন? কারণ ওসব তোমার ভাল লাগে। আর ভাল লাগলেই খারাপ লাগা থাকে। তোমার নিশ্চয়ই কোনও কিছু খুব খারাপ লেগেছে। সিমি বলল।

মিস্টার ব্রাউন মুখ তুললেন। কিছু বলার আগেই তাঁর চোখে পড়ল বাড়িটার বারান্দায়, সিঁড়িতে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। বাড়ির ওপাশে সশব্দে পড়ছে ঝোরার জল। একটু বৃষ্টি হলেই ঝোরার শব্দ খুব বেড়ে যায়। তাঁর মনে পড়ল মিস্টার রায়ের কথা। বাড়িটা ওঁর। আশ্চর্য ব্যাপার! দিন দিন তাঁর হচ্ছে কী। ফাদারের কাছে খবরটা শোনার পর ভেবেছিলেন ওবাড়ি যাবেন কিন্তু ভাবনাটা কখন মাথা থেকে চলে গেল? এ রকম তো তাঁর কখনও হয় না। পরিচিত কোনও মানুষকে যিশু কাছে টেনে নিয়েছেন খবর পেলেই তাঁর মৃতদেহকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আসতে তিনি অভ্যস্ত। অবশ্য গন্তব্যস্থল যদি তাঁর পক্ষে দুর্গম বা দূরের না হয়। মিস্টার রায়ের বাড়িতে আসতে তো তাঁর অসুবিধে হওয়ার কথা নয়, অথচ বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন তিনি। নিজের ওপর বেদম রাগ হচ্ছিল মিস্টার ব্রাউনের।

ও কী? তুমি ও বাড়িতে যাচ্ছ কেন? সিমি হাত ধরল।

মিস্টার রায়ের বাড়িতে এত মানুষ কখনও দেখেছ?

উনি মারা গিয়েছেন বলে সবাই এসেছে। আজ কবর দেওয়া হবে।

কোনও মানুষকে যখন যিশু আশ্রয় দেন তখন তার শরীরকে মাটির নীচে পৌঁছে দিতে সঙ্গী হতে হয়।

কিন্তু তুমি যে বললে শহরে যাবে।

নিশ্চয়ই যাব। আজকাল আমার মাথা একটুও কাজ করে না। মিস্টার রায়ের কথা একদম ভুলে গিয়েছিলাম।

তুমি ওখানে গেলে শহরে যেতে পারবে না।

না। তুমি এখানে দাঁড়াও, আমি খোঁজখবর নিয়ে এসে বলছি। মিস্টার ব্রাউন বাড়ির দিকে এগোলেন। সিমি দেখল বাড়িটার সামনে লোকগুলো খুব শোক শোক মুখ করে দাঁড়িয়ে নেই। কেউ কেউ সিগারেট খাচ্ছে, হাসছে, গল্প করছে। এই তল্লাটে ওই একটাই বাড়ি, দুপাশে পাহাড় আর জঙ্গল। বাড়ির নীচ দিয়ে ট্রেন লাইন চলে গিয়েছে, রেল লাইন আর পিচের রাস্তায় গলাগলি। রাস্তার এপাশে রেলিং-এর ওপারেই বিরাট খাদ, খাদের তলা থেকে ঢালু জমি নদী পেরিয়ে চা বাগানে ঢুকে পড়েছে। বেশিরভাগ সময় ওইসব জায়গা কুয়াশায় ঢাকা থাকে। সিমি মুখ ঘুরিয়ে খাদের দিকে তাকাল। এবং সঙ্গে সঙ্গে তার কান্না পেল। দুজনকে সে আজ পর্যন্ত আটটা চিঠি লিখেছে কিন্তু একটারও জবাব আসেনি। এই দুজনেই তাকে বলেছিল, তোমায় ছাড়া আমি বাঁচব না তখন বিশ্বাস হয়নি, দুজনের কাউকেই সে বিশ্বাস করেনি। দুজনেই বলত, আমাদের মধ্যে একজনকে তুমি বেছে নাও, যে তোমাকে পাবে না সে চুপচাপ সরে যাবে। কিন্তু মুশকিল হয়েছিল তার পক্ষে, কাউকেই সে বাছতে পারেনি। সে কখনও একজনের সঙ্গে সিনেমায় যায়নি, যখন গিয়েছে দুজনই সঙ্গে থেকেছে। সন্ধের মুখে পাহাড়ের কোণে একজনের সঙ্গে দেখা করেনি। অথচ সেটা করার জন্যে কত কাকুতি মিনতি ছিল। হ্যাঁ, আলাদা দেখা হয়েছে এই রাস্তায়, নিরাময়ের সামনে। তারপর ওরা দুজনেই যখন বিদেশে চলে গেল তখন বলেছিল, যেতে ইচ্ছে করছে না তোমাকে ছেড়ে। গিয়ে একটু গুছিয়ে নিয়েই তোমাকে চিঠি লিখব। তখন মন ঠিক করে চলে এসো। ওখানে পৌঁছেই দুজনে আলাদা করে চিঠি দিয়েছিল। দুটো ঠিকানা আলাদা। সেই প্রথম আর সেই শেষ। তারপর থেকে সে চিঠি দিয়ে চলেছে অথচ উত্তর নেই। না, এখনও সে মন স্থির করতে পারেনি। পারেনি বলেই ভেবে রেখেছে যে তাকে প্রথম চিঠি দেবে তাকেই সে ভবিষ্যতে সঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করবে। অথচ কতদিন হয়ে গেল। এখন সবাই চাপ দিচ্ছে বিয়ের জন্যে। বাড়ির লোকজন তো বটেই, শহরের আর এখানকার ছেলেগুলো দিনরাত ফুসুর ফুসুর প্রেমের কথা বলছে। অথচ সে মাথা ঠিক রেখে অপেক্ষাই করে যাচ্ছে। সে খোঁজ নিয়ে দেখেছে শুধু তাকে না, ওরা নিজের বাপ-মাকেও চিঠি লেখে না। হ্যাঁ, এইটে তাকে বেশ স্বস্তি দিয়েছে। মনে হয়েছে, চিঠি না দেওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে। দু চোখ উপচে জল গড়িয়ে এল গালে। খাদের তলা থেকে কুয়াশারা দল বেঁধে ওপরে উঠে আসতে লাগল। বুকের ভেতরটা টনটন করতে লাগল তার। যদি টাকা থাকত, কেউ যদি তাকে অন্তত প্লেন ভাড়ার টাকাটা দিত তাহলে তিন দিনের জন্যে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে আসত, এখনও তার জন্যে ওদের ইচ্ছে আছে কিনা। এইসময় হর্ন বাজল পেছনে। ঝটপট চোখের জল মুছে উদাস চোখে সে তাকাতেই দেখতে পেল সোনাদার ট্যাক্সি ড্রাইভার প্রাণকুমার ট্যাক্সিতে বসে হাসছে, কোথায় যাওয়া হচ্ছে? শহরে?

সিমি ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল।

উঠে এসো। আমিও শহরে যাচ্ছি। তোমাকে আর হাঁটতে হবে না।

সিমি মাথা নাড়ল, না। তুমি চলে যাও।

কেন? আমি কি খারাপ লোক? প্রাণকুমার জিজ্ঞাসা করল।

আমার সঙ্গে লোক আছেন।

লোক! প্রাণকুমার চারপাশে তাকিয়ে নিয়ে হাসল, কথাটা কি ঠিক হল?

উনি ওই বাড়িতে গিয়েছেন।

ও। তা আমার গাড়ি তো খালিই যাচ্ছে। তোমরা দুজনেই যেতে পারো।

উনি কখন আসবেন আমি জানি না। তোমার দেরি হয়ে যাবে।

প্রাণকুমার কথা না বলে গাড়ি থেকে নেমে রেলিং-এর কাছে চলে এসে বলল, তুমি একটু রোগা হয়ে গিয়েছ।

সিমির খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। প্রাণকুমার তার সঙ্গে দেখা হলেই কথা বলে কিন্তু যারা তাকে প্রেম নিবেদন করে তাদের দলে ওকে ফেলা যাবে না। কিন্তু মুখে প্রেমের কথা না বললেও ব্যবহারে ও ওইরকম একটা কিছু বোঝায়। সেটা বুঝেও কিছু বলা যায় না। প্রাণকুমারের কথার জবাব না দিয়ে সিমি আবার খাদের দিকে তাকাল। নীচের কুয়াশারা এখন অনেক ওপরে উঠে এসেছে।

তুমি এখন কোনও কাজ করছ?

না।

কাজ করার ইচ্ছে আছে?

সিমি তাকাল। প্রাণকুমার বলল, শহরে একটা গার্লস হোস্টেল খুলছি আমরা। বাড়ি নেওয়া হয়ে গিয়েছে। মোট ছটা ঘর। এখানকার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে কলকাতা দিল্লির বাচ্চাগুলো ভর্তি হয়। অনেকেই হোস্টেল পায় না। কিছুদিন কষ্ট করে আবার পালিয়ে যায়। ভাল হোস্টেলের খুব ডিম্যান্ড এখানে।

গার্লস হোস্টেল?

হ্যাঁ। তবে জুনিয়ার গার্লস। সিনিয়ার মেয়েদের সামলানো খুব ঝামেলার ব্যাপার। প্রাণকুমার হাসল। সহজ হাসি।

তুমি ড্রাইভারি ছেড়ে দিয়ে হোস্টেল চালাবে?

না। আমাদের এক বুড়ো মামা আছে। সে বাজারহাট করবে। কিন্তু বাচ্চাদের দেখাশোনা, পড়ানোর ব্যবস্থা, আর সব কাজের জন্যে একজন মহিলা দরকার। তুমি যদি কাজটা কর তাহলে দাদাদের বলে দেখতে পারি। প্রাণকুমার বলল।

এতক্ষণ নিজেকে নির্লিপ্ত রাখার চেষ্টা করছিল সিমি। কিন্তু এরকম একটা প্রস্তাব শুনে মনে হল কাজটা পেলে তার খুব উপকার হয়। শুধু টাকা নয়, সময় কেটে যাবে তার। তবু, এত লোক থাকতে তাকে কেন প্রস্তাব দিচ্ছে প্রাণকুমার!

সে হাসল। এইভাবে দেখা না হলে তুমি কি আমাকে প্রস্তাব দিতে?

না। দিতাম না। সত্যি বলতে কি, দাদা চেয়েছিল কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে বাচ্চাদের ব্যাপারে ট্রেনিং আছে এমন কাউকে অ্যাপয়ন্টমেন্ট দিতে। কিন্তু তারা যে টাকা চাইবে সেটার কথাও ভাবতে হচ্ছিল। তোমার সঙ্গে দেখা না হলে অন্য কাউকে বলতাম। শোনো, আমরা খাওয়া থাকা ছাড়া মাসে দেড় হাজারের বেশি এখন দেব না।

থাকা মানে?

বাঃ। অতগুলো বাচ্চা ওখানে কার ভরসায় থাকবে!

তার মানে চবিবশ ঘটা থাকতে হবে?

প্রায় তাই। তবে ওরা স্কুলে গেলে তুমি ছুটি পাবে।

শনিবার রবিবার নেই?

না। কিন্তু বছরে বেশ কয়েকমাস টানা ছুটি পাচ্ছ ওদের স্কুল বন্ধ থাকলে। সেটা কোনও চাকরিতে পাবে না।

ঠিক ওই সময় সিমি মিস্টার ব্রাউনকে দেখল রাস্তা পার হচ্ছেন। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে প্রাণকুমার তাকাল। মিস্টার ব্রাউন কাছে এসে বললেন, ওরা এখনও অপেক্ষা করবে। চলো, আমরা শহর থেকে ঘুরে আসি।

প্রাণকুমার বলল, নমস্কার। আমার নাম প্রাণকুমার। সিমিকে আমি চিনি। আমিও শহরে যাচ্ছি, আপনারা আমার গাড়িতে যেতে পারেন।

মিস্টার ব্রাউন সিমির দিকে তাকালেন। সিমি কোনও কথা বলল না।

মিস্টার ব্রাউন জিজ্ঞাসা করলেন, কী হে? আমরা কি গাড়িতে যাব?

সিমি একটু দ্বিধা নিয়ে গাড়ির দিকে এগোল।

সিমি পেছনে বসল, মিস্টার ব্রাউন প্রাণকুমারের পাশে। মিস্টার ব্রাউন বললেন, শহরে যেতে এখনও কষ্ট হয় না। ঢালু রাস্তায় প্রায় গড়িয়েই চলে যাই। কষ্ট হয় ফেরার সময়। পা যেন আর শরীরের ওজন টানতে পারে না।

আপনারা কখন ফিরবেন?

পেছন থেকে সিমি বলল, দেরি হবে।

গাড়ি যাচ্ছিল গড়িয়ে গড়িয়ে। মাঝে মাঝেই ইঞ্জিন বন্ধ করে দিচ্ছিল প্রাণকুমার। বাঁক ঘুরতে ঘুরতে একসময় শহর এসে গেল। এখনও ডান দিকে খাদ বাঁ দিকে ঘরবাড়ি। খাদের শেষে চা বাগানের দিকে পথ নেমে গেছে। হঠাৎ গাড়ি দাঁড় করিয়ে প্রাণকুমার আঙুল তুলে দেখাল, ওই বাড়িটা।

বাঁ দিকের পাহাড়ের দুটো ধাপ নিয়ে যে বাড়িটা দাঁড়িয়ে তাতে মিস্ত্রিরা কাজ করছে। মিস্টার ব্রাউন জিজ্ঞাসা করলেন, এটা মিস্টার লামার বাড়ি না?

ছিল। আমরা কিনে নিয়েছি। এই বাড়িতেই হোস্টেল করব।

হেস্টেল!

হ্যাঁ। বাচ্চা মেয়েদের জন্যে।

তুমি কোথায় থাকো?

সোনাদায়।

ওখান থেকে এসে হোস্টেল দেখাশোনা করবে?

না-না। লোকজন থাকবে। ওদের কেয়ারটেকার হওয়ার চাকরিটা সিমিকে অফার করেছি। ও না হ্যাঁ কিছুই বলছে না। প্রাণকুমার হাসল।

তাই নাকি? মিস্টার ব্রাউন খুশি হলেন, এ তো খুব ভাল খবর। সিমিকে খুব মানাবে। কবে থেকে শুরু করছ?

মাসখানেকের মধ্যেই।

তা এখন বোর্ডার পাবে?

পাব। স্কুলগুলোতে নোটিস টাঙিয়ে দিয়েছি। তা ছাড়া বাজারের ভার্মার দোকানে বলেছি। ওর দোকানে তো সব গার্জেনরা আসে বাচ্চাদের জিনিসপত্র কিনতে। ও বলেছে এখনই বারোটা স্টুডেন্ট দেবে।

বাঃ। তা সিমি মাইনে পাবে কত?

এখন পনেরোশো। প্লাস খাওয়া থাকা।

গ্র্যান্ড ব্যাপার। একটু আগে আমার মন খুব খারাপ ছিল, এই খবর শোনার পর এখন বেশ ভাল লাগছে।

সিমি বলল, আমরা তাহলে এখানে নেমে যাই?

না-না। চলো বাজারের সামনে পৌঁছে দিয়ে আসছি। প্রাণকুমার গাড়ি চালু করল। বাজারের হই হল্লা, বাসস্ট্যান্ডের ভিড় কাটিয়ে একটু ফাঁকা জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে বলল, আমি ওই বাড়িতে কিছুক্ষণ থাকব। ফেরার সময় যদি আমার গাড়ি দেখতে পান তাহলে আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।

মিস্টার ব্রাউন মাথা নেড়ে গাড়ি থেকে নামলেন। সিমি দরজা খুলতেই প্রাণকুমার বলল, আমি আবার পরশুদিন এই সময়ে ওই বাড়িতে আসব। তোমার সিদ্ধান্তটা সেদিনই জানাতে হবে নইলে অন্য লোক খুঁজতে দেরি হয়ে যাবে।

সামান্য মাথা নেড়ে সিমি মিস্টার ব্রাউনের সঙ্গে হাঁটতে লাগল। একটু এগিয়ে গিয়ে মিস্টার ব্রাউন জিজ্ঞাসা করলো, কী ব্যাপার। ছেলেটা কি খারাপ?

না তো! সিমি জবাব দিল।

তাহলে তোমার মতো চুলবুলে মেয়ে এমন বোবা হয়ে যাবে কেন?

সিমি হাসল। মিস্টার ব্রাউন বললেন, এমন ভাল চাকরি পাওয়া খুব ভাগ্যের ব্যাপার।

দেখি। ভাবছি।

ভাববার কী আছে?

এত লোক থাকতে আমাকে ও চাকরি দিচ্ছে কেন? আমার তো কোনও অভিজ্ঞতা নেই। হঠাৎ রাস্তায় দেখা হয়ে যেতেই চাকরি দিতে চাইল।

সব কাজ তো মানুষ ভেবেচিন্তে করে না। হয়তো তোমাকে ওর ভাল লাগে।

আমি তো ওইটাই চাই না।

বাঃ। কারও তোমাকে ভাল লাগা মানে এই নয় যে তাকেও তোমার ভাল লাগতে হবে। ঠিক আছে, কোথায় যাবে তুমি?

কাজ আছে।

আমি পার্টির অফিসে যাচ্ছি। ঠিক একঘণ্টা পরে এখানে চলে এসো। ওই ভার্মার দোকানের সামনে যে আগে আসবে অপেক্ষা করবে। কথাগুলো বলে মিস্টার ব্রাউন চলে গেলেন। সিমি দাঁড়িয়ে থাকল একটু। তারপর উল্টোদিকে পা বাড়াতেই একটা মোটর সাইকেল একেবারে খাদের পাশে চলে এসে বলল, হাই।

সিমি বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কী চাই?

সে কী! ভগবান তোমাকে বলেনি আমি কী চাই?

সরে যাও। নইলে এমন মার খাওয়াব যে আর বাইক চালাতে হবে না।

চালাব না। অনেকেই তো চালায় না। ছেলেটা হাসল।

সিমি একটু পিছিয়ে রাস্তা পার হল হনহনিয়ে। তার মেজাজ একদম খিঁচড়ে গিয়েছিল। এদের বাড় দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। মুশকিল হল, এরা কোনও অশ্লীল শব্দ বলে না, গায়ে হাত দেয় না। তা করলে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেত। নালিশ করলে বলবে আমি কিছুই করিনি। এখানকার মহিলা সমিতি খুব শক্তিশালী। কিছু না করলে তারা ব্যবস্থা নেবে কী করে!

সরু সিঁড়ি দিয়ে ওপরের রাস্তায় চলে এল সিমি। সামনেই পোস্ট অফিস। চিঠির সন্ধানে প্রায়ই যেতে যেতে এখন বেশ সঙ্কোচ হয় তার। ওরা নিশ্চয়ই তাকে খুব ফালতু ভাবে। এতদিন ধরে মেয়েটা চিঠি চিঠি করে হেদিয়ে মরছে অথচ যার চিঠি আসার কথা সে একটা শব্দও লিখছে না। এখন তাই পিওনদের ঘরে যায় না। টেলিফোনের কাউন্টারে গিয়ে লাইন দেয়। যতক্ষণ সুযোগ না আসে লক্ষ করে চেনা পিওনকে দেখতে পাওয়া যায় কিনা। যদি সামনে কেউ না থাকে রিসিভার তুলে দার্জিলিং-এ সুভাষ ঘিসিং-এর নাম্বার ঘোরায়। এই নাম্বার সবসময় এনগেজড থাকে বলে ভরসা। অপেক্ষা করার ভান করে পরের লোককে লাইন ছেড়ে দেয়। আজ এসব করতে হল না। পোস্ট অফিসের সামনেই পিওনের সঙ্গে দেখা। লোকটা একগাল হেসে বলল, না, আজও আপনার চিঠি আসেনি।

সিমি কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলল, আমি চিঠির জন্যে আসিনি।

লোকটা একটু চুপসে গিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। বড় বড় পা ফেলে পোস্ট অফিসে ঢুকে পড়ল সিমি। তারপরই শরীর কেমন অসাড় হয়ে গেল। আজ আর ফোন করার দরকার নেই।

সিমি!

ডাক শুনে পেছন ফিরতেই সে মিসেস অ্যান্টনিকে দেখতে পেল। সাদা শাড়ি সাদা জামা, হাতে ব্যাগ নিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। সে এগিয়ে যেতে মিসেস অ্যান্টনি বললেন, কাল কুমারের চিঠি এসেছে।

সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে উঠল সিমি। চোখের সামনে কুমারের ঝকঝকে মুখটা ভেসে উঠল। কুমারের একটা গজদাঁত আছে। ও বলত, আমেরিকায় গিয়ে অপারেশন করিয়ে দাঁতটাকে ঠিক করে নেবে। কিন্তু এতে আপত্তি ছিল সিমির। তাই শুনে পাভেল বলত, ইস; আমার কেন গজদাঁত হল না। শেষপর্যন্ত কুমারের চিঠি এসেছে। একমুখ হাসি নিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, বাঃ। কেমন আছে ওরা?

ওরা? পাভেলের কথা কিছু লেখেনি।

ও। বুক কাঁপছিল সিমির।

এই চিঠি না লিখলেই ও ভাল করত। কাল সারারাত আমার ঘুম হয়নি। আজ মনে হল, মিথ্যে ওর জন্যে ভাবছি। যে কখনও ফিরে আসতে চায় না সে কী করবে তা নিয়ে কেন আমি ভাবব? মিসেস অ্যান্টনির গলায় একটুও আবেগ নেই।

কী হয়েছে ওর?

মিসেস অ্যান্টনি সিমির মুখের দিকে তাকালেন। তারপর ব্যাগ খুলে একটা সুন্দর এয়ারোগ্রাম বের করে এগিয়ে দিলেন, তুমি পড়তে পারো।

খামের ওপর নাম দেখে সিমি বলল, এ আপনার চিঠি।

তা হোক। আমিই তো পড়তে বলছি।

ভাঁজ খুলল সিমি। ইংরেজিতে লেখা। মা, আশাকরি তুমি ভাল আছ। আমি এখানে এসে পায়ের তলায় মাটি খুঁজতে এত ব্যস্ত ছিলাম যে যোগাযোগ রাখতে পারিনি। অনেক কষ্ট করার পর শিকাগোতে ট্যাক্সি চালাবার অনুমতি পেয়েছি। এতে রোজ একশো ডলারের মতো আয় হয়। একটা ছোট ফ্ল্যাটও নিয়েছি। মুশকিল হল, ট্যুরিস্ট ভিসায় কানাডা হয়ে এখানে আসার জন্যে আমার কাছে আমেরিকায় থাকার বৈধ কাগজ ছিল না। এখানকার বিভিন্ন স্টেটের নিয়ম আলাদা বলে আমার বিরুদ্ধে কেস চললেও জামিনে আছি এবং কাজ করার পারমিট পেয়েছি। কিন্তু কেসে হেরে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

আমি দেশে ফিরে যেতে চাই না। দেশ আমাকে কিছু দেয়নি। আমার পাসপোর্ট অনুযায়ী আমি একজন ভারতীয়। অথচ নিজেকে ভারতীয় মনে করার কোনও কারণ দেখতে পাইনি। বারংবার আন্দোলন এবং ধর্মঘট করে যে ক্ষমতা আদায় করা হয়েছে তা নেহাতই সান্ত্বনা পুরস্কার। তাতে পাহাড়িদের অভাব ঘুচবে না, সম্মানও বাড়বে না। আমি আমেরিকাতেই থাকতে চাই। এখানে থাকার এবং নাগরিকত্ব পাওয়ার একমাত্র উপায় কোনও আমেরিকান মেয়েকে বিয়ে করা। ভালবেসে কোনও আমেরিকান মেয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেয়নি। কিন্তু ডলার দিলে এদেশে কাগুজে বউ পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে অনেক কড়াকড়ি হওয়ায় সেইসব বউরা দিন পনেরো স্বামীর ঘর করতেও রাজি হয়েছে। এর জন্যে অবশ্য অনেক ডলার খরচ হবে। তা হোক। আজ আমি বিয়ে করছি। তোমার বউমার নাম মার্থা। অবশ্য নাগরিকত্ব পাওয়ার পরই সে আমাকে ডিভোর্স করবে। এদেশে এইসব ব্যাপারে কেউ আক্ষেপ করে না। আমি দেশে যাব আমেরিকান নাগরিক হিসেবে। মার্থার দাবি মিটিয়ে আমার হাতে এখনই ডলার থাকছে না। কিন্তু এই পর্ব চুকে গেলে আমি তোমাকে টাকা পাঠাব। মনে রেখো, আমি যদি মাসে দুশো ডলার পাঠাই তাহলে তোমার কাছে সেটা সাত হাজার দুশো টাকা হয়ে যাবে।

আমার জন্যে চিন্তা কোরো না। আমি ভাল আছি। কুমার।

নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল সিমির। তার হাত কাঁপছিল। মিসেস অ্যান্টনি তার হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে নিলেন। সেটাকে ভাঁজ করে ব্যাগে রেখে আর একটা কাগজ বের করলেন, আমি আজ ওকে যে চিঠি পোস্ট করেছি এটা তার কপি। এটাও পড়ে দ্যাখো।

সিমির মাথা কাজ করছিল না। আর কিছু পড়ার আগ্রহও তার ছিল না। তবু নিতে হল। কুমার। তোমার চিঠির উত্তর লেখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু দুটো কথা বলার জন্যে লিখতে বাধ্য হচ্ছি। আমি যে দেশে জন্মেছি, বড় হয়েছি, মারা যাব, তার নাম ভারতবর্ষ। আমাদের সবার সমস্যা আছে কিন্তু ভারতবর্ষের বিরাটত্বকে অপমান করার কথা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। এখানে যে আন্দোলন হয়েছে তাতে কখনও বলা হয়নি ভারতবর্ষ থেকে বেরিয়ে যাওয়া হবে। তোমার সেকথা মনে হয় না যখন, তখন আমেরিকান হয়েও এদেশে আসার অধিকার তোমার নেই। আর এতদিন পর্যন্ত আমি এক টাকাকে এক টাকাই মনে করে এসেছি। যেভাবেই হোক সেই টাকা জোগাড় করে বেঁচে আছি। ডলারের স্বপ্ন দেখার বাসনা আমার নেই। তোমার পাঠানো ডলার গ্রহণ করার আগে আমার যেন মৃত্যু হয় এই প্রার্থনা করছি। মিসেস সি. অ্যান্টনি।

সিমি কেঁদে ফেলল।

মিসেস এ্যান্টনি জিজ্ঞাসা করলেন, কাঁদছ কেন?

আপনি এই চিঠি লিখলেন? চোখের জল মোছার চেষ্টা করল সিমি।

কাগজটা ফেরত নিয়ে মিসেস অ্যান্টনি বললেন, আমি কখনও কোনও আপস করিনি সিমি। আমার স্বামী চলে যাওয়ার পর বেশ অর্থাভাবে আছি। ওকে চিঠিটা লিখতে যে খরচ হল সেটাও এখন আমার পক্ষে বিলাসিতা। এতদিন আশায় ছিলাম ছেলে আমার পাশে এসে দাঁড়াবে। এখন অমন ছেলেকে জন্ম দিয়েছিলাম বলে লজ্জায় মরে যাচ্ছি। এই চিঠি না লিখলে আমি আরও ছোট হয়ে যেতাম। সেটা আরও লজ্জার।

সিমি মিসেস অ্যান্টনির হাত ধরল, আপনি খুব ভাল!

মিসেস অ্যান্টনি মাথা নাড়লেন, তুমি কি এখন খুব ব্যস্ত?

না। কেন?

তাহলে একসঙ্গে বাড়ির দিকে যেতাম।

সিমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। দুজনে পোস্ট অফিস থেকে বেরিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করল। মিসেস অ্যান্টনির চিঠিটা সিমিকে এমন আচ্ছন্ন করেছিল যে সে অন্য কিছু ভাবতেই পারছিল না। যে কুমারের জন্যে তার এতকালের প্রতীক্ষা তা ভেঙে চুরমার হয়ে গেলেও সেই আঘাতটা যেন তেমন করে এখন বাজছে না। কেবলই মনে হচ্ছে কত শক্ত মন হলে মিসেস অ্যান্টনির মতো ওই চিঠি লেখা যায়! হঠাৎ নিজেকে খুব বোকা বলে মনে হতে লাগল তার। কার জন্যে সে এতকাল অপেক্ষা করেছে। যে মাকে ওই চিঠি লিখতে পারে, নাগরিক হতে চাওয়ার লোভে যে টাকা দিয়ে বিদেশিনীকে মিথ্যে বিয়ে করতে পারে, তার জন্যে! পরক্ষণেই মনে হল সে তো শুধু কুমারের চিঠির জন্যে অপেক্ষা করেনি। পাভেলও ছিল। ওদের দুজনের কাউকেই তো সে ভালবাসার কথা বলেনি। সত্যি কি ও কাউকে ভালবেসেছিল? যে শুনবে সে জানতে চাইবে ভাল না বাসলে কেন রোজ চিঠির সন্ধানে এত দূরে আসত? জবাবটা নিজেরই জানা নেই। দুজনকে কি একসঙ্গে ভালবাসা যায়? সে যদি কুমার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত আগে নিয়ে পাভেলকে বাতিল করত তাহলে আজ কোথায় দাঁড়াত? আর পাভেল? সে-ও তো আমেরিকায় গিয়েছে, তারও ভূমিকা এই একই হতে পারে! পুরুষদের কাছে হৃদয় নিয়ে কোনও আকাঙ্ক্ষা একমাত্র নির্বোধ মেয়েরাই করে থাকে।

তুমি খুব কষ্ট পেলে, না? মিসেস অ্যান্টনি নিচু গলায় বললেন। সিমি একবার তাকিয়েই মুখ নামিয়ে নিল।

আমি জানতাম তুমি পাভেলের সঙ্গে জড়িয়ে গেছ। কিন্তু পাভেলের মা বলেছেন তুমি কুমারের জন্যে অপেক্ষা করছ।

আমি কারও জন্যে অপেক্ষা করছি না।

খুশি হলাম। কিন্তু কুমারের চিঠি পড়ার সময় তোমার মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল, হাত কাঁপছিল। শোন, অপেক্ষা তার জন্যে করা উচিত যে মর্যাদা দেবে। মুশকিল হল, কে যে দেবে কে দেবে না তা বোঝা খুব দুরূহ।

ওরা বাজারের কাছে চলে আসতেই সিমি দেখতে পেল প্রাণকুমার বাড়ি তৈরির সরঞ্জামের দোকানে ঢুকছে। সঙ্গে সঙ্গে সে দাঁড়িয়ে গেল।

মিসেস অ্যান্টনি জিজ্ঞাসা করলেন, কী হল?

আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?

নিশ্চয়ই। বলো।

আপনি চাকরি করবেন?

চাকরি? হেসে উঠলেন মিসেস অ্যান্টনি, আমাকে কে চাকরি দেবে? আমার কি চাকরি করা বয়স বা যোগ্যতা আছে?

আছে। আপনি এখনও শক্ত আছেন।

তাই? কী চাকরি?

আমার পরিচিত একজন বাচ্চা মেয়েদের জন্যে হোস্টেল খুলছে। তাদের দেখাশোনার জনে কেয়ারটেকার দরকার। খাওয়া থাকা আর দেড় হাজার টাকা মাইনে দেবে এখন।

থাকতে হবে?

হ্যাঁ। কিন্তু স্কুলের তো অনেক ছুটি, তখন ছুটি পাওয়া যাবে।

মিসেস অ্যান্টনির মুখে নরম আলো ছড়ানো, কিন্তু আমাকে কি পছন্দ হবে?

নিশ্চয়ই হবে।

তাহলে খুব ভাল হয়। এখন সময় কাটতে চায় না, খুব একা লাগে।

আপনি আমার সঙ্গে আসুন।

রাস্তা পেরিয়ে দোকানটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই প্রাণকুমার বাইরে বেরিয়ে এল। সিমিকে দে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, আরে! কী ব্যাপার।

এঁর নাম মিসেস অ্যান্টনি। আমার খুব পরিচিত।

প্রাণকুমার নমস্কার করতে মিসেস অ্যান্টনিও হাত জোড় করলেন।

তুমি কেয়ারটেকার খুঁজছিলে, উনি কাজটা খুব ভাল করতে পারবেন।

প্রাণকুমার বেশ অবাক হয়ে সিমির দিকে তাকাল। তারপর মিসেস অ্যান্টনিকে জিজ্ঞাসা করল বাচ্চাদের ব্যাপারে আপনার কোনও অভিজ্ঞতা আছে?

মা হিসেবে যতটুকু থাকা উচিত ততটুকু আছে।

কিন্তু ওদের পড়ানো–!

আমার ছেলেকেও আমিই পড়িয়েছি।

বেশ। সিমি যখন বলছে তখন আমার আপত্তি নেই। আপনি কালই সোনাদায় আসুন। সোনাদা বাজারে আমার নাম বললে যে কেউ বাড়ি দেখিয়ে দেবে। থ্যাঙ্ক ইউ সিমি। প্রাণকুমার চলে গেল।

মিসেস অ্যান্টনি বললেন, তোমাকে কী বলে ধন্যবাদ জানাব জানি না। কিন্তু ওর নাম কী?

সিমি বলল, প্রাণকুমার। কিন্তু একটা ভুল হয়ে গিয়েছে। আমি এখনই বাড়ি যেতে পারছি না আমাকে একজনের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে।

.

০৮.

ঘরভর্তি বিভিন্ন বয়সের মানুষ হাসিঠাট্টায় সময় কাটাচ্ছে। মিস্টার ব্রাউনকে ওরা যে চেয়ার দিয়েছিল সেটি অনেকক্ষণ দখল করে রেখেছেন বলে মনে হচ্ছিল তাঁর। দলের সেক্রেটারি এখন পার্টি অফিসে আসেননি বলে তাঁকে জানানো হয়েছে। ঘরের বাইরেও বেশ কিছু লোক সম্ভবত তাঁরই সাক্ষাৎপ্রার্থী। তাদের কার কী প্রয়োজন তা জেনে নিয়ে উঠতি নেতারা আশ্বাস দিয়ে কাজটা করিয়ে দেবে বলে। একই ভাবে তাঁর কাছেও এসেছিল একজন। তিনি স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, কোনও ব্যক্তিগত প্রয়োজনে আমি এখানে আসিনি। আমার যা বলার তা সেক্রেটারি ছাড়া কাউকে বলা যাবে না।

এদের অনেকেই তাঁকে চেনে। তাঁর তল্লাটের বয়স্ক মানুষই শুধু নয়, সেখানকার সাধারণ মানুষ তাঁকে ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে, এ খবরও তাদের জানা। তাই চেয়ার বরাদ্দ হয়েছিল তাঁর ভাগ্যে। কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে। সিমিকে তিনি বলেছেন অপেক্ষা করতে। সেই সময়টাও এসে যাচ্ছে। অথচ কথা না বলে এত দূরে এসে তিনি ফিরে যান কী করে! অবশ্য এখান থেকে বেরিয়ে সিমিকে বলে আসা যায় বাড়িতে ফিরে যেতে কিন্তু সেই ফাঁকে যদি সেক্রেটারি পার্টি অফিস ছুঁয়ে বেরিয়ে যান? খুব অস্বস্তিতে পড়েছিলেন মিস্টার ব্রাউন।

এখানে যেসব আলোচনা চলছে তা শুনতেও তাঁর ভাল লাগছে না। পাহাড়ি নয় এমন বাড়ির মালিকরা যারা দীর্ঘদিন এখানে থাকে না, বছরের বেশির ভাগ সময় যাদের বাড়ি তালাবন্দী থাকে তার তালিকা তৈরি হয়েছে। প্রথমে ওই সব বাড়ির মালিকদের বলা হবে বিক্রি করে দিতে। বাড়ির বয়স এবং অঞ্চল বুঝে দাম ঠিক করে দেবে পার্টি। যারা বিক্রি করতে রাজি হবেন না তাঁদের সম্পর্কে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে তা পরে ঠিক করা হবে। তবে প্রথম পদক্ষেপ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই নিতে চাইছে পার্টি। মিস্টার ব্রাউন অবাক হয়ে শুনলেন ইতিমধ্যে এই সব মাঝারি নেতারা কে কোন বাড়ি নেবে তা ঠিক করে ফেলেছেন। যে বাড়ির দাম তিন লাখ টাকার কম নয় তার জন্যে তিরিশ হাজার টাকা দিতে এক নেতা রাজি নন। তাঁদের পাড়ায় যেতে মিস্টার মুখার্জির যে পুড়ে যাওয়া বাড়িটি রয়েছে, আন্দোলনের সময় যাকে বাঁচাতে একটি নেপালি ছেলে জীবন দিয়েছিল সেই বাড়িটির দাম ঠিক হয়েছে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। যে নেবে বলে ঠিক করেছে তার যুক্তি হল ওটা বাসস্ট্যান্ড থেকে অনেক দূরে, বাড়ির জানলা দরজা পুড়ে গিয়েছে। সব কিছু নতুন করে লাগাতে হবে, রং করতে হবে, প্রচুর খরচ হবে। পাঁচ হাজার টাকা যে দেওয়া হবে তাই অনেক বেশি।

হঠাৎ মিস্টার ব্রাউনের মনে পড়ল ঝোরার এপাশে, শহরের শেষে যে সুন্দর বাড়িটি সবার চোখে পড়ে, যেখানে দার্জিলিং থেকে বড় বড় নেতারা মালিক এলেই আমন্ত্রিত হন তিনি রাজস্থানের মানুষ। বছরে দুবার দশ দিনের জন্যে আসেন। কিছুক্ষণ উশখুশ করে মিস্টার ব্রাউন বললেন, আমি একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে পারি?

সব কটি মুখ একসঙ্গে তাঁর দিকে ফিরল। মিস্টার ব্রাউন জিজ্ঞাসা করলেন, আমাদের পাহাড়ে যাওয়ার সময় যে ঝোরা পড়ে তার আগে একটা সুন্দর বাড়ি সারা বছর তালাবন্দী থাকে। বাড়ির মালিক রাজস্থানের লোক। ওই বাড়ির দাম কি ঠিক হয়েছে?

মিস্টার ব্রাউন দেখলেন ঘরের সবাই এ বার যেদিকে তাকাল সেখানে দুজন দ্বিতীয় সারির নেতা বসে আছেন। তাঁদের একজন জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি আগরওয়ালা সাহেবের বাড়ির কথা জিজ্ঞাসা করছেন? না, ওটাকে চিহ্নিত করা হয়নি।

কেন?

কারণ ওটা খালি বাড়ি নয়। আগরওয়ালা সাহেব নিজে না পারলেও তাঁর পরিবারের লোকজন প্রতি মাসেই ওই বাড়িতে এসে থাকেন।

কথাটা সম্ভবত ঠিক নয়। সম্ভবত কেন, নিশ্চয়ই নয়।

এর বেশি আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। আমাদের নেতারা অনেক ভেবেচিন্তে কোন বাড়ি তালিকায় থাকবে সেটা ঠিক করেছেন।

তাহলে নেতাদের আমার প্রস্তাবের কথা বলুন। ওই বাড়ির জন্যে চল্লিশ হাজার দিতে পারি। প্রত্যেকে যা দিচ্ছেন তার চেয়ে আমি নিশ্চয়ই কম দিচ্ছি না।

মিস্টার ব্রাউনের কথা শেষ হওয়ামাত্র অনেকেই হো হো করে হাসতে লাগল। দ্বিতীয় জন এবার উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে উঠে টেবিল ঠুকতে লাগলেন, স্টপ স্টপ। এটা পার্টি অফিস। চায়ের দোকান না। আর শুনুন মশাই, কোন বাড়ি তালিকায় থাকবে কোনটা থাকবে না সেই কৈফিয়ত আপনাকে আমরা দিতে বাধ্য নই।

কেন? খুব শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলেন ব্রাউন।

লোকটা উত্তেজিত ছিল কিন্তু এমন প্রশ্ন আশা করেনি। তার ঠোঁট কাঁপতে লাগল। তখন প্রথম জন বলল, প্রত্যেক দলের মতো আমাদেরও নিজস্ব নিয়ম আছে।

কিন্তু আমি কি দলের বাইরে। প্রতি মাসে নিয়মিত চাঁদা দিই।

ঠিক সেই সময় দলবল নিয়ে জিপ থেকে নেমে এলেন সেক্রেটারি। দরজায় দাঁড়িয়ে বিরক্ত গলায় বললেন, আজ দেখছি খুব ভিড়। তারপর ঘরের ভেতর মানুষের করে দেওয়া রাস্তায় হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। মিস্টার ব্রাউন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, সেক্রেটারি সাহেব!

ভদ্রলোক মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন, ওয়েল! মিস্টার ব্রাউন! কেমন আছেন?

আমি সবসময় ভাল থাকি।

তাহলে এখানে?

এখানে এলে বুঝতে হবে মানুষটি খারাপ আছে?

নট দ্যাট। প্রয়োজন ছাড়া কেউ কি অত দূর থেকে এখানে আসে!

আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।

ব্যক্তিগত? সেক্রেটারি প্রশ্ন করা মাত্র দ্বিতীয় নেতাটি বলে উঠলেন, আমাদের খালিবাড়ি স্কিমে যে আগরওয়ালা সাহেবের বাড়ি পড়ছে না এটা উনি মানতে চাইছেন না। চল্লিশ হাজার টাকা অফার দিয়েছেন।

সেক্রেটারির মুখ-চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল, আপনি বাড়ি কিনতে এসেছেন!

মিস্টার ব্রাউন মাথা নাড়লেন, না। সে জন্যে আসিনি। আমার আপনার সঙ্গে অন্য কথা আছে। আর সেটা ব্যক্তিগত নয়।

এদের সামনে বলতে অসুবিধে হবে?

আমার হবে না। আপনার হবে কি না জানি না।

সেক্রেটারির চোখ আরও ছোট হল, ঠিক আছে, ভেতরে আসুন।

মিস্টার ব্রাউন এগোলেন। সেক্রেটারিকে অনুসরণ করে যাওয়ার সময় লক্ষ করলেন প্রতিটি চোখ বিস্মিত হয়ে তাঁকে দেখছে। পাশের দরজা দিয়ে চমৎকার সাজানো কাচের বড় বড় জানলায় ঘেরা ঘরটিতে ঢুকেই চারপাশে নীল পাহাড় চোখে পড়ল। দূরের কাঞ্চনজঙ্ঘা এখন সাদা, তার চারপাশে সাদা মেঘের জঙ্গল। কাঁচ ঢাকা বড় টেবিলের ওপাশে গদিওয়ালা ঘোরানো চেয়ারে বসে সেক্রেটারি বললেন, বসুন।

এপাশের চেয়ার টেনে বসলেন মিস্টার ব্রাউন। একটু ভাবলেন, কীভাবে শুরু করবেন।

সেক্রেটারি বললেন, বলুন।

মিস্টার ব্রাউন বললেন, দেখুন, আমার অনেক বয়স হয়ে গিয়েছে। এই পাহাড়েই আমার জন্ম, এখানেই মরতে চাই। পাহাড়ের মানুষদের আন্দোলনে আমি শরীরের কারণে অংশ নিতে পারিনি বটে কিন্তু আন্দোলনের মূল কারণকে আমি শ্রদ্ধা করি।

সেক্রেটারি একটা কলম তুলে নিলেন, মূল কারণ বলতে–?

পাহাড়ের মানুষ বঞ্চিত।

আপনার সমস্যাটা কী? অনেকেই অপেক্ষা করছেন বুঝতেই পারছেন।

আমার বাড়ির পাশে নিরাময় নামে একটি নার্সিংহোম আছে। ওকে ঠিক নার্সিংহোম বলা যায় কিনা তা আমি জানি না। রক্তে হেমোগ্লোবিন কমে গিয়ে যে মারাত্মক অসুখ হয় তার চিকিৎসা করা হয় ওখানে। যারা ওখানে থাকে তাদের বয়স খুবই কম। আমি–।

আমি ব্যাপারটা জানি। ওখানকার ডাক্তারকে আমরা শ্রদ্ধা করি।

ওই নিরাময়ের একটি ছেলে, ছেলেটি বাঙালি, কথা বললেই মনে হয় যিশুর আশীর্বাদ ওর সঙ্গে আছে। এ রকম প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা ছেলেকে তিনি কেন ওই রোগ দিলেন এই ধন্দ আমার আছে। এই ছেলেটি যেহেতু বাঙালি তাই সে বাংলা গান গায়। আমাদের ওখানকার পাহাড়ি ছেলেমেয়েরা ওকে ভালবাসে। ও যা গায় তাতে ছেলেরা গলা মেলাতে চেষ্টা করে। এটা কি অপরাধ?

এখন পর্যন্ত সেটা মনে হচ্ছে না। তারপর?

আমাদের এলাকায় আপনার দলের ভারপ্রাপ্ত একটা ছেলে নতুন এসেছে। সে এবং তার সঙ্গীরা বাইকে চেপে যাওয়াআসা করে। ছেলেটি স্থানীয় নয় বলে তাকে আমি চিনি না, সে-ও আমাকে জানে না। সায়নের গান শুনে তার মনে হয়েছে সে পাহাড়ি ছেলেমেয়ের মন বিষাক্ত করে তুলছে। সঙ্গে সঙ্গে সে ডাক্তারকে নির্দেশ দিয়েছে সায়নকে তার বাবা-মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিতে।

আচ্ছা! কী গান সে শুনেছে?

আমি ঠিক ডিটেলসে জানি না। তবে দেশাত্মবোধক গান বলে মনে হয়।

কোন দেশের দেশাত্মবোধক গান?

একটি ভারতীয় ছেলে কোন দেশের দেশাত্মবোধক গান গাইতে পারে?

সেক্রেটারি বোতাম টিপলেন। একটি ছেলে এসে দাঁড়াল। সেক্রেটারি তাকে বললেন, গুরুংকে ডেকে আনো। জলদি।

ছেলেটি বেরিয়ে গেল। মিস্টার ব্রাউন বললেন, ওই রোগে যারা আক্রান্ত তাদের জীবন যে কোনও মুহূর্তে শেষ হয়ে যেতে পারে। ডাক্তার চেষ্টা করছেন একটা স্থিতাবস্থায় নিয়ে আসতে। আপনার নেতার চাপে যদি সায়নকে চলে যেতে হয় তার আয়ু আর কতদিন থাকবে তা যিশুই জানেন।

আপনি কি জানেন লিডারের নির্দেশে ওই ডাক্তারকে আমরা সাহায্য করেছি।

না, আমি জানি না।

ওঁর পেশেন্টদের বাঁচাতে নাকি ফ্রেশ ব্লাড দরকার হয়। আমরা ছেলেমেয়ে পাঠিয়ে একটা প্যানেল করে দিয়েছি। যখন যে গ্রুপের রক্ত দরকার পড়বে ওঁর তা পেতে অসুবিধে হবে না। সেক্রেটারি এমন ভঙ্গিতে হাসলেন যেন পৃথিবীর শেষ উপকারটা তিনি করে ফেলেছেন।

ইয়েস বস। দরজা ঠেলে ঢুকল ছেলেটি।

টিভিতে হিন্দি সিনেমা দ্যাখেন মিস্টার ব্রাউন। অমরীশ পুরীর সাকরেদরা এই ভঙ্গিতে হুকুমের জন্যে এসে দাঁড়ায়। মিস্টার ব্রাউনকে দেখে অবাক হল ছেলেটি।

এঁকে চেন। সেক্রেটারি জানতে চাইলেন।

আজ সকালে দেখেছি।

ও। ইনি আমাদের ওয়েল উইশার। এঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখলে তোমার কাজ করতে সুবিধে হবে। হ্যাঁ, নিরাময় নিয়ে তোমার কী প্রব্লেম হয়েছিল?

ওটা একটা গোলমেলে জায়গা।

কারণ।

ওখানকার একটা ছেলে এমন একটা ইন্ডিয়ান গান পাহাড়ি বাচ্চাদের শেখাচ্ছে যা আমাদের নীতির বিরুদ্ধে যাচ্ছে। বাচ্চাদের ব্রেন ওয়াশড হয়ে যাবে।

কী রকম?

গানটায় শুধু প্লেন বেঙ্গলের বর্ণনা আর সেটাই নাকি বেস্ট কান্ট্রি।

সেক্রেটারি মিস্টার ব্রাউনের দিকে তাকালেন।

মিস্টার ব্রাউন হাসলেন, আমরা কোন দেশে আছি?

মানে? সেক্রেটারির মঙ্গোলিয়ান চোখ প্রায় বন্ধ।

এটা তো ইন্ডিয়া। আমরা তো ইন্ডিয়ার মধ্যে থেকেই ভালভাবে বাঁচতে চাই। লিডার তো সেই কথা বলেছেন। তাই না? মিস্টার ব্রাউন বললেন, অথচ এই ছেলেটি গানটাকে ইন্ডিয়ান গান বলল কেন বুঝতে পারছি না।

ছেলেটি এবার গলা চড়াল, আপনার লজ্জা করছে না, পাহাড়ি হিসেবে যে গানে পাহাড়ের মানুষের কথা নেই সেটাকে সাপোর্ট করছেন?

তাহলে আমাদের জাতীয়সঙ্গীত গাওয়াই উচিত নয়। ওখানে এই দার্জিলিং-এর পাহাড়িদের কথা একবারও বলা হয়নি। অথচ আমাদের লিডার ওই গান চলাকালীন মাথা নিচু করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। আপনারাও তাই করেন, করেন না? কিছু মনে করবেন না, সরষের মধ্যে যারা ভূত দেখতে চায় তাদের হাতে ক্ষমতা গেলে সেই গল্পের বানরের হাতে মাছি মারতে তলোয়ার তুলে দেবার মতো অবস্থা হবে। আমাদের পাহাড়ে এখন অনেক কাজ। সে সব ফেলে দিয়ে একটা যুবক মোটরবাইকে চেপে ডাক্তারকে শাসাচ্ছে লিউকোমিয়া পেশেন্টকে বাড়িতে ফেরত পাঠাবার জন্যে, এর চেয়ে লজ্জাজনক ঘটনা আর কী হতে পারে।

ছেলেটি বলল, আপনি ভুল কমপ্লেন করছেন। ছেলেটি ওই রকম অসুস্থ জানার পর আমি আর কিছু না বলে ফিরে এসেছি।

সঙ্গে সঙ্গে সেক্রেটারি বললেন, তাই নাকি! তা হলে সব মিটে গিয়েছে। আপনি খামোকা এই ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে এত দূরে এলেন মিস্টার ব্রাউন। যাক, এরপর কিছু হলে তুমি মিস্টার ব্রাউনের সঙ্গে কথা বলে নেবে।

ছেলেটি জিজ্ঞাসা করল, আপনার বাড়ির ওপরে যে কসাইখানা আছে সেটা বন্ধ কেন?

আমার বাড়ি তুমি চেন?

হ্যাঁ। আমি খোঁজ নিয়েছি।

হুঁ। বন্ধ কেন আমি কী করে বলব?

লোকটা পার্টি ফান্ডে কোনও ডোনেশন দিচ্ছে না অথচ ভাল কামাই করছে। ওকে ওয়ার্নিং দেবার পরই ও দোকান বন্ধ করে দিল।

ম্যাথুজ তো শহরেই ঘুরে বেড়ায়, ওকে জিজ্ঞাসা করতে পারো। মিস্টার ব্রাউন উঠলেন, অনেক ধন্যবাদ সেক্রেটারি সাহেব। আমি কদিন বাদে দার্জিলিং-এ যাব। তখন যদি লিডারের সঙ্গে দেখা হয় তা হলে তাঁকে বলব আপনি খুব সহযোগিতা করেছেন।

সঙ্গে সঙ্গে সেক্রেটারি উঠে দাঁড়ালেন, এনি প্রব্লেম, আপনাকে আসতে হবে না। জাস্ট একটা ফোন করবেন। আরে, আরে, আপনাকে চা অফার করা হয়নি।

আমি এই সময় চা খাই না। এগারোটা বেজে গেলেই আমার দারু দরকার।

মিস্টার ব্রাউনের কথায় হো হো করে হাসলেন সেক্রেটারি, সেটার ব্যবস্থাও হতে পারে। আপনি সামনের বারে চলে যান, আমার গেস্ট।

ওখানে তো আমার জিনিস পাওয়া যাবে না। আমারটা ঘরে তৈরি হয়।

সে কী! বাইরে গেলে কী করেন।

এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ালেন মিস্টার ব্রাউন। তারপর বললেন, চাকরি থেকে অবসর নেবার পর তো একবারই বাইরে গিয়েছিলাম। সেবার আমার স্ত্রী সঙ্গে ছিল। এয়ারপোর্টে ওরা সার্চ করে পাঁচটা বোতল বের করল। ওটা নিয়ে যাওয়া নাকি বেআইনি। বিলিতি মদ নিয়ে গেলে ওদের আপত্তি নেই, ঘরের জিনিস নেওয়া চলবে না। আমার অসুবিধে হবে বলে স্ত্রী নিয়েছিলেন সঙ্গে।

তো কী করলেন?

কী আর করব। চারদিন ছিলাম। এক ফোঁটা মদ খাইনি। আচ্ছা, গুডবাই। যিশু আপনাদের মঙ্গল করুন। মিস্টার ব্রাউন বেরিয়ে এলেন। এতক্ষণ কথা বলে তাঁর মনের জ্বালা সামান্য জুড়োলেও তিনি বুঝতে পারছিলেন না ওরা তাঁর কথা ঠিক কতটা বুঝতে পেরেছে। এই সময় অফিসের সামনে একটা জিপ এসে থামল। সেখানে একটি ছেলে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। সঙ্গীরা চেঁচাতে চেঁচাতে ভেতরে ঢুকল, লামার দলের লোকজন মেরেছে। সেক্রেটারি কোথায়?

মিস্টার ব্রাউন এগিয়ে চললেন। যে উদ্দেশ্য নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়েছিল সেটা এখন কতটা অটুট আছে? পাহাড়িরা আজ তিনটে দলে বিভক্ত। এর ওপর কংগ্রেস আর সি পি এম তো রয়েছেই! কিন্তু যারা ক্ষমতায় রয়েছে তারা যদি ঠিক পথে চলে তা হলে সেই রক্ত ঝরানো আন্দোলনের মূল্য থাকবে না।

মিস্টার ব্রাউন ওদের দেখতে পেলেন। সিমি বলল, ওঃ, আমরা ভাবছিলাম চলে যাব।

সেটাই ঠিক হত। আমি যে তোমাদের খবর দেব সেই সুযোগ পাচ্ছিলাম না। মিস্টার ব্রাউন মাথা নাড়লেন, কেমন আছেন মিসেস অ্যান্টনি?

মিসেস অ্যান্টনি বলল, ভাল। আপনি?

আমি তো কখনও খারাপ থাকি না, তবে আজ–। ছেড়ে দিন ও কথা। আপনারা কি বাড়ির দিকে ফিরবেন? তা হলে হাঁটা শুরু করা যেতে পারে।

তিনজনে শহরের ব্যস্ত এলাকা ছাড়িয়ে এলে মিস্টার ব্রাউন জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার ছেলের খবর পেয়েছেন?

হ্যাঁ। মিসেস অ্যান্টনি নিচু গলায় বললেন।

মিস্টার ব্রাউন উচ্ছ্বসিত হলেন, বাঃ, খুব ভাল।

ও আমেরিকায় থাকবে বলে সেখানকার একটি মেয়েকে বিয়ে করছে।

সে কী! থমকে তাকালেন মিস্টার ব্রাউন সিমির দিকে। সিমি মুখ ফিরিয়ে নিল। বুকের ভেতরটা হঠাৎ ফাঁকা হয়ে গেল মিস্টার ব্রাউনের।

মিসেস অ্যান্টনি বললেন, ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে কে কী রকম হবে তা আগে থেকে আন্দাজ করা যায় না। আমি মা হিসেবে নিশ্চয়ই ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু দীর্ঘদিন ও দূরে চলে যাওয়াতে আমার একটা উপকার হয়েছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, মানুষ বড় হলে সে তার নিজের মতো চলতে শুরু করে। আপনি ওর শৈশব বাল্যকালে যা শিখিয়েছেন সেই পথই যে ধরবে এমন কোনও কথা নেই। জীবজন্তুদের বাচ্চারা নিজের খাবার খুঁজে নিতে শিখলেই মায়ের সঙ্গ ত্যাগ করে। ঈশ্বর মানুষকে কষ্ট দেবার জন্যে তাদের মনে স্নেহ ছড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে বড় হয়ে সন্তান অন্য পথে গেলে মানুষ কষ্ট পায়। কিন্তু ওকে ছেড়ে থাকতে থাকতে আমার মন নির্লিপ্ত হতে শিখেছে। তাই ও এখন কী করছে না করছে তাতে আমার কিছু এসে যায় না।

মিস্টার ব্রাউন কিছু বললেন না। তাঁর সন্তানরা যে যেখানেই থাকুক নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। ওরা টাকাও পাঠাতে চায়। যখন আসে অনেক কিছু নিয়ে আসে। কিন্তু তিনি একা থাকতেই ভালবাসেন। ওরা যে যার মতো দাঁড়িয়ে গিয়েছে এতেই তিনি খুশি। কিন্তু মিসেস অ্যান্টনির কথাগুলো তাঁর মনে ধরল। ভাগ্য তাঁকে ওই অভিজ্ঞতার সামনে দাঁড় করায়নি, করালে তাঁকেও একই কথা বলতে হত। কিন্তু সিমির কী হবে? এই মেয়েটা তো একদম ভেঙে পড়বে!

ওঁরা চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ মিসেস অ্যান্টনি বললেন, সিমি, আমার মনে হচ্ছে কাজটা তোমারই করা উচিত।

সিমি বলল, এ আবার কী! কথা হয়ে গেল–!

আমার তো বয়স হয়েছে। যেমন করে হোক ঠিক চলে যাবে। তোমার সামনে এখন অনেক জীবন, তোমারই কাজটা দরকার। মিসেস অ্যান্টনি বললেন।

আপনি শুরু করুন। যদি ভাল না লাগে তখন দেখা যাবে। সিমি বলল।

মিস্টার ব্রাউন খুব অবাক হয়ে গেলেন। নিজে চাকরি না করে সিমি মিসেস অ্যান্টনিকে ওটা করতে বলছে? মেয়েটির প্রতি শ্রদ্ধা হল তাঁর। মুখে কিছু বললেন না।

রাস্তাটা চড়াই। মিস্টার ব্রাউন একটানা উঠতে পারেন না। মাঝে মাঝেই থামতে হচ্ছিল তাঁকে। ওরাও ওঁর সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ছিল। পেছনে পাহাড়, সামনে গাছ। খাদ থেকে উঠে আসা গাছগুলো বেশ ঝাঁকড়া। রাস্তাটা সারাক্ষণ ছায়া মেলে রয়েছে। মিসেস অ্যান্টনি জিজ্ঞাসা করলেন, অনেক দিন থেকে ভাবছিলাম আপনাকে একটা প্রশ্ন করব। এই একা থাকতে আপনার অসুবিধে হয় না?

মিস্টার ব্রাউন হাসলেন, আমি তো একা থাকি না।

সে কী! আপনার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর–!

হ্যাঁ, স্ত্রী মারা যাওয়ার পর কিছুদিন খুব নিঃসঙ্গ লাগছিল। এখন এলাকার সমস্ত মানুষ আমার সঙ্গে আছে। এই যে মেয়েটা, এ দুবেলা আমার কাছে আসে, খাবার দিয়ে যায়। দিন ভর সময়টা যে কীভাবে কেটে যায় আমি টেরই পাই না। তারপর টিভি আছে। আর সেই সঙ্গে আছেন যিশু। তার কথা ভাবতে শুরু করলে একাকিত্ব ধারে কাছে ঘেঁষতে পারে না। আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একটি ছেলে, তার নাম সায়ন। হাসলেন মিস্টার ব্রাউন।

সায়ন? সে কে? মিসেস অ্যান্টনি কৌতূহলী হলেন।

আমার বাড়ির নীচে নিরাময় বলে যে স্যানেটারিয়াম আছে ও সেখানে থাকে। খুবই অসুস্থ। কিন্তু ওর কাছাকাছি এলেই আপনি বুঝতে পারবেন যিশুর আশীর্বাদ ও পেয়েছে। অদ্ভুত আনন্দ বুকে ছড়িয়ে পড়ে।

তাই! খুব অবাক হলেন মিসেস অ্যান্টনি।

হ্যাঁ। অতএব আমার একা থাকার সুযোগই নেই।

অসুখ-বিসুখ হলে?

ওসব এখন হবে না। যখন হবে তখন বিছানা থেকে সোজা কফিনে চড়ে মাটির তলায় চলে যাব। হো হো করে হাসলেন মিস্টার ব্রাউন যেন খুব মজার কথা বললেন। তার পরই জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার কী অবস্থা?

আবার হাঁটা শুরু করলেন মিসেস অ্যান্টনি। বললেন, আমার কথা নাই বা শুনলেন!

ঝোরার পাশে এসে বিদায় নিলেন মিসেস অ্যান্টনি। এখান থেকে তাঁকে ডান দিক দিয়ে ওপরে উঠতে হবে। যাওয়ার আগে সিমির হাত ধরে অনেক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গেলেন। আবার চলতে শুরু করলে মিস্টার ব্রাউন বললেন, যিশু তোমাকে আশীর্বাদ করছেন।

দরকার নেই আমার ওই আশীর্বাদে, যা চোখে দেখা যায় না, অনুভবও করা যায় না। যিশু যিশু তারাই করে যাদের জীবন থেকে কিছু পাওয়ার থাকে না। বেশ রাগত গলায় বলল সিমি। বলে গাছের দিকে মুখ ঘুরিয়ে হাঁটতে লাগল।

কিন্তু তুমি তো যিশুকে ভালবাস। ঠিক কি না?

ভালবাসি আমি অনেক কিছু। যাদের ভালবাসি সব সময় তাদের মাথায় করে রাখতে হবে! আর যে মানুষটাকে মেরে ফেলা হয়েছে প্রায় দু হাজার বছর আগে তাঁর কাজকে আমি শ্রদ্ধা করি, তাঁর উপদেশ আমার ভাল লাগে। কিন্তু তিনি এখন কোত্থেকে এসে আমার আশীর্বাদ করবেন! সিমি রীতিমতো চিৎকার করল।

তোমার মন বিক্ষিপ্ত, তাই এ কথা বলছ! মিস্টার ব্রাউন বললেন।

সিমি বলল, হ্যাঁ, আমার মন বিক্ষিপ্ত। নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে আমার। কিন্তু যে কথাগুলো বললাম তা কি মিথ্যে? যুক্তি দিয়ে বোঝান!

মিস্টার ব্রাউন একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্যে দাঁড়ালেন। বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, তুমি যা বলছ তা যে সত্যি নয় সেটা তোমার অজানা নয়। যাদের তোমার পছন্দ ছিল তারা কতদিন আগে আমেরিকায় চলে গিয়েছে, যোগাযোগ রাখছে না জেনেও তুমি তাদের অস্তিত্ব অনুভব করোনি! তাদের কথা ভেবে তুমি অন্য কোনও ছেলেকে দূরে সরিয়ে দাওনি? তাদের একজনের মা ক্রমশ নিজেকে নিরাসক্ত করে ফেলেছেন কিন্তু তুমি কি পেরেছিলে? পারোনি।

আশ্চর্য! দুটো এক ব্যাপার হল? ওরা জলজ্যান্ত বেঁচে আছে।

তোমার মনে হচ্ছিল তারা বেঁচে আছে। এমন তো হতে পারত ওরা মারা গিয়েছিল, এখানে খবর পৌঁছোয়নি। সে ক্ষেত্রে ওরা তোমার কাছে বেঁচে থাকত এবং ওদের কথা ভেবে তুমি নিজের জীবনযাপন এইভাবেই নিয়ন্ত্রণ করে যেতে। যিশুর শরীরের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু তিনি তো শরীরসর্বস্ব মানুষ নন। তিনি পরম করুণাময়ের সন্তান। মানুষের হৃদয়ে আলো জ্বালিয়ে দিতেই করুণাময় তাঁকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। তাঁর শরীর চলে গেলেও তাঁর সেই কাজটা কিন্তু থেমে যায়নি। তুমি যখনই তাঁর উপদেশ পড়বে তখনই মনে হবে তিনি তোমাকে স্পর্শ করে আছেন। আর এই মনে হওয়াটা তোমাকে উদ্দীপ্ত করবে, তোমাকে কাজ করতে উৎসাহিত করবে। আমি যখন যিশুর সামনে বসি তখন নিজেকে একটুও একা লাগে না। কোনও ভাল কাজ করলেই মনে হয় তাঁর দেখানো পথে হাঁটছি। এটা কি তাঁর আশীর্বাদ নয়? সন্দেহ করে নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করার চেয়ে তাঁর কাছে নিজেকে নিবেদন করে দ্যাখো, মন শান্তি পাবে। মিস্টার ব্রাউন বললেন।

তাহলে তো আমার এখন চার্চে চলে যাওয়া উচিত।

দুর পাগলি! চার্চে গিয়ে তাঁকে খুঁজতে হবে কেন? আমাদের চারপাশেই তো তিনি ছড়িয়ে আছেন। তোমার নিজের যা কাজ তা করো। তোমার জীবনে যা কিছু পেতে বাকি আছে তা সংগ্রহ কর। কিন্তু অসৎ হোয়ো না। তাই বলছিলাম, এই যে তুমি মিসেস অ্যান্টনিকে তাঁর একাকিত্ব দূর করার সুযোগ দিলে এতে শুধু তাঁর উপকার হল না, তুমি নিজেই উন্নত হলে।

সিমি চলে গেলে মিস্টার ব্রাউন ধীরে ধীরে উঠে এসে নিরাময়ের সামনে দাঁড়ালেন। দেখলেন ম্যাথুজ বেরিয়ে আসছে। এখন দুপুর। এই সময় নিরাময়ে ঢোকা উচিত নয়। ম্যাথুজ তাঁকে দেখে জিজ্ঞাসা করল, শহরে গিয়েছিলেন?

হ্যঁ। তোমার খবর কী? দাড়ি কামাওনি কেন?

ম্যাথুজ তার খোঁচা দাড়ি জন্মানো মুখে হাসল, খবর পেলাম সায়ন খুব অসুস্থ। কিন্তু ছোটবাহাদুর বলল ও এখন ঘুমোচ্ছে। দেখা হল না।

ছেলেটাকে মনে হচ্ছে তোমার ভাল লেগেছে! মিস্টার ব্রাউন আবার হাঁটা শুরু করলেন। ম্যাথুজ বলল, হা, খুব শান্ত ছেলে।

বাড়ির সামনে যেতেই ভুটো দুবার ডেকে চুপ করে গেল। তার দিকে হাত বাড়াতেই সে ছুটে এল। একটু আদর করলেন তাকে। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার মতলবটা কী বলো তো? আমাদের মাংস না খাইয়ে কতদিন রাখবে?

ম্যাথুজ হাসল কিন্তু কোনও জবাব না দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

মিস্টার ব্রাউন দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন। অনেকক্ষণ বাইরে এবং সঙ্গে মহিলা থাকায় তাঁর অসুবিধে হচ্ছিল। এখন তাড়াতাড়ি টয়লেটে গেলেন। আজ বেশ দেরি হয়ে গেছে। লাঞ্চের আগে তাঁর যে কোটা সেটা শেষ করা যাবে না। ফলে রাত্রে একটু বেশি খাওয়া হয়ে যাবে। হাতমুখ ধুয়ে তিনি বাইরের ঘরে এসে দেখলেন ম্যাথুজ বসে আছে। হঠাৎ তাঁর বেশ ভাল লাগল। ম্যাথুজ খেতে চাইলে তাঁকে রাত্রে বেশি খেতে হবে না।

মিস্টার ব্রাউন বললেন, এক মিনিট, প্লিজ। তারপর যিশুর ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। এই ঘরে সবসময় একটা হালকা আলো জ্বলে। কয়েক সেকেন্ড যিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে তিনি ফিরে এসে সকালে দিয়ে যাওয়া ক্যান বের করলেন, সঙ্গে দুটো গ্লাস, এসো, একটু খাওয়া যাক।

ম্যাথুজের আপত্তি ছিল না। বাদামের প্যাকেট থেকে খানিকটা প্লেটে ঢেলে ওঁরা খাওয়া আরম্ভ করলেন। একটা চুমুক দিয়ে মিস্টার ব্রাউন ম্যাথুজের দিকে ভাল করে তাকালেন। বেশ কয়েকদিন দাড়ি কামায়নি। ছেলেটা ভাল। বেশিদূর পড়াশুনা করেনি ওর ভাইদের মতো। কিন্তু ব্যবহার বেশ ভাল, নিজে মাংস বিক্রির ব্যবসা করে রোজগারও ভাল করে। ওর হঠাৎ কী হল!

তিনটে চুমুক নিঃশব্দে দিয়ে ম্যাথুজ বলল, তখন আপনি প্রশ্ন করছিলেন না? আমি ভাবছি মাংস বিক্রির ব্যবসাটা ছেড়ে দেব।

সেকী! তা হলে এই পাহাড়ের মানুষদের মাংস জোগাবে কে?

কেউ না কেউ শুরু করে দেবে। ম্যাথুজ চতুর্থ চুমুক দিল।

ওহে, তুমি মিছিমিছি ওদের ওপর বিরক্ত হচ্ছ!

কাদের ওপর?

আমি শুনেছি। পার্টি থেকে তোমার কাছে চাঁদা চেয়েছে। নিশ্চয়ই মোটা টাকা চেয়েছে। আরে এসব সমস্যা তো কথা বললে মিটে যাবে। ঠিক আছে, তুমি যা দিতে পারবে বলো, আমি ওদের তাই নিতে রাজি করাব। মিস্টার ব্রাউন সস্নেহে বললেন। ছেলেটা হেরে সরে যাক তা কখনও হয়!

ম্যাথুজ হাসল, না আঙ্কল। চাঁদা দেবার ভয়ে আমি ব্যবসা বন্ধ করছি না।

তাহলে!

আমার আর ভাল লাগছে না। এই যে গোরুগুলোকে নেপাল থেকে কিনে আনি, আসার পথে ওরা আমার কথা শোনে। এত দূরে আসার সময় ওদের সঙ্গে একটা ভাবও তৈরি হয়ে যায়। সেই গোরুগুলো এখানে দেখে সবাই খুশি হয় খাবার এসেছে বলে। ওদের খুন করতে প্রতিবারই আমার খুব কষ্ট হয়। ওদের শরীর থেকে মাংসের টুকরো কেটে বিক্রি করতে করতে কেবলই ওর চাহনি মনে পড়ে যায়। নিজেকে খুব ঘেন্না করতে আরম্ভ করেছি আমি। জেসাস নিশ্চয়ই আমাকে ক্ষমা করবেন না। আবার চুমুক দিল সে।

মিস্টার ব্রাউন মাথা নাড়লেন, গোরুর মাংস মানুষের খাদ্য। মাছ ডিম মুরগি খাসি যেমন এও তেমন। পাহাড়ের মানুষরা খুব গরিব। ওদের পক্ষে মাছ মুরগি খাসি খাওয়া রোজ সম্ভব নয়। বিফ বিক্রি করে তুমি ওদের উপকার করছ। মানুষের উপকার যে করে তার প্রতি যিশু সবসময় সদয় হন। তোমার সেন্টিমেন্টকে আমি শ্রদ্ধা করছি। কিন্তু তুমি কোনও পাপ কাজ করছ না। চিয়ার আপ মাই বয়।

মাথা নাড়ল ম্যাথুজ, তা ছাড়া–!

ইয়েস!

আমার এই প্রফেশন তো সবার পছন্দ নয়।

কে কী পছন্দ করছে তা নিয়ে তুমি কেন মাথাব্যথা করবে?

এই সময় বাইরে দরজায় শব্দ হল। ওটা খোলাই ছিল। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল সিমি, তার হাতে একটা টিফিন ক্যারিয়ারের বাটি। ঢুকেই এক মুহূর্ত দাঁড়াল, বাঃ বাঃ। এর মধ্যেই সঙ্গী জুটে গেছে? অ্যাদ্দিন একা খাওয়া হচ্ছিল, তাতে বোধহয় মন ভরছিল না। এরপর তো এই বাড়ি বিনিপয়সার ভাটিখানা হয়ে যাবে।

ঠক করে বাটিটা টেবিলে রেখে সিমি দুমদুম পা ফেলে বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ভুটো ছুটে এল ভেতরে। টেবিলের দিকে মুখ করে বসে লেজ নাড়তে লাগল।

মিস্টার ব্রাউন দেখলেন ম্যাথুজ কুঁকড়ে বসে আছে। তিনি হাসলেন, আরে ওর কথায় কিছু মনে করো না। ওর মনে কোনও ময়লা নেই। হয়তো কোনও কারণে রেগে ছিল সেটা এখানে প্রকাশ করে গেল ওইভাবে  

ম্যাথুজ বলল, আমি, মানে, আমি ঠিক–!

হাত নেড়ে চুপ করতে বললেন মিস্টার ব্রাউন। তারপর কৌটোর ঢাকনা খুলে ঘ্রাণ নিলেন, আঃ। দারুণ। মাটন।

একটা টুকরো তুলে চেয়ার ছেড়ে উঠে ভুটোর প্লেটে দিয়ে এলেন তিনি, খাও। এরকম চাট না হলে খাওয়া কি জমে!

না না। আপনার কম পড়ে যাবে। ম্যাথুজ বলল।

বাটির ওপর আবার ঝুঁকলেন মিস্টার ব্রাউন, কী ব্যাপার! রোজ যা দেয় আজ দেখছি তার ডাবল দিয়েছে। তুমি যে আমার সঙ্গে এসেছ তা কি ও লক্ষ করেছিল? যাক গে। একটুও কম পড়বে না। চালাও।

খুব সঙ্কোচের সঙ্গে চামচ দিয়ে একটা টুকরো তুলে নিল ম্যাথুজ। চমৎকার রান্না হয়েছে। সে দেখল ভুটো মাংস খেয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল।

মাংস চিবোত চিবোতে মিস্টার ব্রাউন বললেন, এই যে আমরা মাংস খাচ্ছি সেটাও তো একটা প্রাণীর। তাকে মেরে কাটা হয়েছে। আমাদের কি খেতে খুব খারাপ লাগছে? লাগছে না। তা হলে অন্যের পছন্দ নিয়ে তুমি মাথা ঘামাচ্ছ কেন? অবশ্য বিশেষ কেউ যদি হয়, সেরকম কেউ এসেছে নাকি হে!

দাড়ি থাকা সত্ত্বেও মুখের রং বদলানো লক্ষ করলেন মিস্টার ব্রাউন। ম্যাথুজ বলল, না, কেউ আসেনি, তবে–!

আরে খুলেই বলো না।

আপনি কাউকে বলবেন না, কথা দিন। তা হলে আমি খুব লজ্জায় পড়ে যাব। আপনাকে বাবার মতো শ্রদ্ধা করি, কিছুদিন থেকেই মনে হচ্ছিল কথাটা আপনাকে বলা দরকার। কিন্তু অন্য কেউ জানলে–! ম্যাথুজ থেমে গেল।

কেউ জানবে না। তুমি নিশ্চিন্তে বলতে পারো।

ম্যাথুজ গ্লাস শেষ করল, না, আজ থাক, আমি উঠি।

আরে! উঠবে মানে? তুমি এখন চলে গেলে আমার মেজাজ নষ্ট হয়ে যাবে। মাত্র এক গ্লাস খেয়েছ। আর একটা খাও। মাংসও তো পড়ে আছে।

ম্যাথুজ নতুন গ্লাস নিল।

একটু সময় নিয়ে মিস্টার ব্রাউন জিজ্ঞাসা করলেন, কে অপছন্দ করছে? আমি চিনি?

হ্যাঁ। সিমি আমাকে পছন্দ করে না আমি মাংস বিক্রি করি বলে।

একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন মিস্টার ব্রাউন। যে মেয়েটি তার দুই প্রেমিকের জন্যে এতকাল পথ চেয়ে বসেছিল। সে ম্যাথুজের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে পারে এ তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। এবার তাঁর রাগ হল। তিনি গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, সিমির সঙ্গে তোমার প্রেম কতদিনের?

আঁতকে উঠল ম্যাথুজ, না, না, ওসব কিছু হয়নি।

খুব অবাক হলেন মিস্টার ব্রাউন, তার মানে!

আমার সঙ্গে ওর ওসব কোনও কথাই হয়নি!

তোমার সঙ্গে ঘুরতে, বেড়াতে যায়নি?

না।

তাহলে? তুমি কী বলতে চাইছ বুঝতে পারছি না।

মাথা নিচু করল ম্যাথুজ, আমার ওকে ভাল লাগে। অনেকবার ভেবেছি কথাটা ওকে বলব, কিন্তু বলতে পারিনি। আমি জানি ওর দুজন বন্ধু ছিল। তারা এখন আমেরিকায় আছে। ও তাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। কিন্তু অপেক্ষা করার তো একটা সীমা আছে। ও কখনও আমার দোকানে মাংস কিনতে আসে না। ওর বাড়ির অন্যদের পাঠায়। বিকেলে যখন দোকান বন্ধ রাখি তখন দেখা হলে একটু-আধটু কথা বলে। কয়েকদিন আগে ভাবলাম সাহস করে ওকে বলেই ফেলি। দেখা হতে ওই ছোট দেওয়ালের ওপর বসতে বললাম। ও জিজ্ঞাসা করল, কেন? আমি বললাম, এমনই, গল্প করব। ও বলল, অসম্ভব। তোমার শরীর থেকে গোরুর গন্ধ বের হবে, আমি সহ্য করতে পারব না। ব্যাপারটা ভাবুন! ও চলে গেলে আমার খুব কষ্ট হল। আমার যাকে ভাল লাগে সে এই কাজটা পছন্দ করে না। মনটা খুব ভেঙে পড়ছিল। তারপরই কথাটা শুনলাম!

কী কথা?

তিন দিন আগে বিকেলে নিরাময়ের সামনে দিয়ে আসছিলাম। ওখানকার তিন-চারজন ছেলের সঙ্গে সায়ন দাঁড়িয়েছিল। ছেলেটাকে আমার খুব ভাল লাগে। ও একবার আমাকে বলেছিল কীভাবে গোরু কিনে আনি সঙ্গে গিয়ে দেখতে চায়। সে কথা বলতেই ও মাথা নাড়ল। বলল, আচ্ছা ম্যাথুজ আঙ্কল, তুমি তো খুব ভাল মানুষ। তুমি অন্য কাজ করতে পারো না! আমি অবাক। জিজ্ঞাসা করলাম, কেন? সে বলল, অত বড় প্রাণীকে মারতে হলে খুব নির্মম হতে হয়। আমি আর কথা বলিনি। তারপর থেকে কথাটা আমার মাথায় ঢুকে গেল। আমি কি নির্মম? আমার কি হৃদয় বলে কিছু নেই? যার হৃদয় নেই তাকে কোনও মেয়ে পছন্দ করবে কেন?

মিস্টার ব্রাউন মাথা নাড়লেন। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ম্যাথুজ!

ম্যাথুজ এই পরিবর্তন দেখে অবাক হন, ইয়েস আঙ্কল!

তুমি ব্যবসাটা ছেড়ে দাও। অদ্ভুত গলায় বললেন মিস্টার ব্রাউন।

আপনি একটু আগে অন্য কথা বলছিলেন!

হুঁ। কিন্তু এখন বলছি ছেড়ে দাও। ঠিকই, তুমি না করলে আর কেউ ব্যবসাটা করবে। মানুষের অভাব থাকবে না। তুমি ট্যাক্সি চালাও, মিনিবাসের পারমিট বের করার চেষ্টা করে। কিছু না পারলে বাড়ি ভাড়া করে স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্যে হোস্টেল চালু করো। কিন্তু ওই ব্যবসায় আর ফিরে যেও না।

থ্যাঙ্ক ইউ আঙ্কল। ম্যাথুজ উঠে দাঁড়াল, কিন্তু এই কথাগুলো আপনি সিমিকে বলবেন না। প্লিজ। ম্যাথুজ মিস্টার ব্রাউনের হাত ধরল।

ওঃ, নো। তুমি নিশ্চিত থাকো। কিন্তু আমি তোমাকে একটা কথা বলব।

বলুন।

নতুন ব্যবসা শুরু করে যখনই দেখবে আর একজনের দায়িত্ব নিতে সক্ষম হয়েছ তখনই তুমি সিমিকে অ্যাপ্রোচ করবে। এখন ওর ভাল বন্ধুর দরকার।

কিন্তু ওর বন্ধুরা তো আছে!

যে পাথর পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ে সে আর পাহাড়ের চূড়ায় ফিরে আসে না। এ নিয়ে তুমি ভেবো না। তোমার কাজ তুমি করে যাও।

ম্যাথুজ চলে গেল। মিস্টার ব্রাউন উঠলেন না। অন্যমনস্ক হয়ে তিনি নতুন গ্লাস ভর্তি করতেই কুঁই কুঁই শব্দ শুনতে পেলেন। মুখ তুলে দেখলেন, ভুটো একা নয়, সে তার বান্ধবীকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। কুকুরটি খুব ভিতু চোখে একবার তাকে আর একবার ভুটোর বীরদর্পে লেজ নাড়া দেখছে। চোখাচোখি হতে ভুটো অদ্ভুত আওয়াজ করল। তারপর ছুটে গিয়ে নিজের প্লেট টেনে নিয়ে এল সামনে। মিস্টার ব্রাউন আর এক টুকরো মাংস ঝুঁকে পড়ে প্লেটে রাখতেই ভুটো তার বান্ধবীর দিকে ঘুরে দাঁড়াল। বান্ধবী খুব ভয়ে ভয়ে প্রায় ছোঁ মারার ভঙ্গিতে মাংসের টুকরো মুখে তুলে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে যেতে ভুটো তাকে অনুসরণ করল।

গ্লাস শেষ করার পর মিস্টার ব্রাউন উঠে যিশুর ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। যিশুর মুখের দিকে তাকাতে তাকাতে আচমকা সায়নের মুখ মনে পড়ে গেল তাঁর। যিশুকে যখন পেরেকে পুতে ক্ৰশে আটকে রাখা হয়েছিল তখন তাঁর শরীরের সমস্ত রক্ত ঝরে পড়েছিল মাটিতে। প্রবল বেদনা সত্ত্বেও তাঁর মুখের আলো নিবে যায়নি। কিন্তু নীরক্ত যিশুর শরীর পরবর্তীকালে পৃথিবীর মানুষের শ্রদ্ধা ভালবাসায় ভরে গিয়েছিল। সায়নের শরীরে রক্ত নেই। রক্ত জমলেই তা দ্রুত তরল হয়ে বেরিয়ে আসছে। অথচ ওই ছেলেটি কী সহজে ম্যাথুজকে বলল, খুন করতে গেলে মানুষকে নির্মম হতে হয়। এই কথাটা তাঁর মনে একবারও আসেনি। তিনি শুধু প্রয়োজনের কথাই ভেবেছেন। ওই ছেলের মধ্যে যিশুর আশীর্বাদ প্রবলভাবে আছে। চোখ বন্ধ করলেন মিস্টার ব্রাউন। তারপর প্রার্থনার ভঙ্গিতে বললেন, ওঁকে তুমি দীর্ঘজীবন দাও। তুমি ইচ্ছে করলে সব কিছু সম্ভব। তোমার পৃথিবীতে ওকে বড় প্রয়োজন।

এই সময় দরজায় শব্দ হল। মিস্টার ব্রাউন চোখ মুছে দরজায় গেলেন। জোসেফ দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা খুব ভাল কাঠের মিস্ত্রি। জোসেফ বলল, মিস্টার রায়ের ফিউনারাল প্রসেশন আসছে। ফাদার আপনাকে খবর দিতে বললেন।

সঙ্গে সঙ্গে খেয়াল হল। শহর থেকে ফেরার সময় ভাবনাটা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি ভেতরে গিয়ে পোশাক পাল্টে বেরিয়ে এলেন। জোসেফ তখনও দাঁড়িয়েছিল। জিজ্ঞাসা করলেন, ওরা কত দূরে?

নীচ থেকে উঠে আসছে।

মিস্টার ব্রাউন জোসেফের সঙ্গে নীচে নেমে এসে নিরাময়ের সামনে দাঁড়াতেই মিছিলটাকে দেখতে পেলেন। কফিন নিয়ে ধীরে ধীরে উঠে আসছে। শব্দহীন ওই মিছিলের প্রথমে ফাদার আসছেন। কফিনটাকে দেখা যাচ্ছে। শুধু মিছিলের মানুষেরা নয়, সমস্ত পৃথিবী, এমনকী পাহাড় পর্যন্ত কী নিঃসঙ্গ হয়ে রয়েছে! মাথা নিচু করে অপেক্ষায় ছিলেন মিস্টার ব্রাউন। মিছিল সামনে আসতেই তিনি যোগ দিতে এগিয়ে যেতে যেতে দেখলেন নিরাময়ের গেট, ওপরের জানলায় উৎসুক মুখের ভিড়। হঠাৎ তিনি আকুল হয়ে সেই মুখ খুঁজতে লাগলেন। না, সায়ন নেই দর্শকের দলে। ধীরে ধীরে মিছিলটা নিরাময় পেরিয়ে গেল। মাথা নিচু করে হাঁটতে হাঁটতে মিস্টার ব্রাউনের খুব কষ্ট হল। মিস্টার রায়ের জন্যে।

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার