চওড়া বিশাল রাজপথের গায়ে দুটো বাঘের মূর্তি রায়বাড়ির যে পূর্বপুরুষ গেটের দুপাশে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি হয়তো বাঘ এবং গোরুকে এক ঘাটে জল খাওয়াতেন। এখন সেই বাঘ দুটোর পাথরের শরীরে নানান গর্ত, লেজ খসে গিয়েছে অনেকদিন। নাক বোঁচা হয়ে গেলেও উদ্ধত ভাবটি যায়নি। গেট পেরিয়ে মাটির রাস্তা। দুপাশে গাছগাছালি, একটা ডোবা যেখানে ধোপারা কাপড় কাচে। রাস্তার দিকটায় একটা বাউন্ডারি দেওয়াল এখনও খাড়া আছে বটে কিন্তু উল্টো দিকে কিছু নেই। এখানে ওখানে ছড়িয়ে থাকা আটখানা স্ট্যাচু, আম কাঁঠাল গাছের পর রায়বাড়ি। রায়বাড়ির ছাদ থেকে পাড়ার যে অংশ দেখা যায় তা গলির ভেতর দিকটায়। সেখানে দোকানপাট রকের আড্ডা মাস্তানি সবই আছে। সেখানে উত্তেজনা চরমে উঠলে তা চলকে চলে আসে এ বাড়ির মাঠে। লিকলিকে রোগা তালপাতার সেপাই নব্বুই বছরের পাঁড়েজি তার যৌবনের লাঠি হাতে সমানে চেঁচাতে থাকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে। কয়েক দশক ধরেই লোকটাকে কেউ পাত্তা দেয় না। কিন্তু কানাঘুষোয় সবাই শুনেছে ওই পাঁড়েজি নাকি যৌবনে লাঠি হাতে আটখানা ডাকাতের লাশ ফেলে দিয়েছিল। হয়তো ওই কারণেই বিরক্ত হলেও তারা পাল্টা ঢিল ছোড়ে না।

রায়বাড়ির সংলগ্ন ছোট্ট ঘরটিতে পাঁড়েজি পড়ে আছে সত্তর বছর। পনেরো বছরে বউ মরে গেলে মনে এত শোক জমেছিল যে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেনি। ফলে এখন উত্তরপ্রদেশের কোথায় তার আত্মীয়স্বজন বেঁচে আছে সে খবর তার জানা নেই। এখনও লোকে এ বাড়ির রাতদিনের পাহারাদার হিসেবে তাকেই ভেবে নেয়। ভাবনাটা পাঁড়েজিরও, নইলে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে আচমকা চিৎকার করে ওঠে, অ্যাই কৌন হ্যায়?

এই নিয়ে হেনা হেসে খুন হয়ে যায় যেন। নন্দিনীর বারান্দায় এলে পাঁড়েজিকে দেখা যায়। ঘাসের ওপর পা ছড়িয়ে বসে লাঠিতে তেল মাখাচ্ছে।

হেনা জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা, লোকটা এখনও লাঠিতে তেল মাখায় কেন?

তোর মাথায় ভাঙবে বলে। নন্দিনী হাসলেন।

আমার না মানুষটাকে অদ্ভুত লাগে। রাত দুপুরে যখন ওর গলা পাই, অ্যাই কৌন হ্যায় তখন প্রশ্নটা যেন আমার বুকে বিঁধে যায়। আমি কে? কী অসাধারণ।

তুই এই করে সায়নটারও বারোটা বাজিয়েছিস। রাম বললেই রামায়ণ ভাবতে বসে যায়। অথচ তোর ওই বিবেকবাবু কোনও মাইনে পায় না, তা জানিস?

মাইনে পায় না? তাহলে ওর চলে কী করে?

এ ও যা পারে খেতে দেয়। আমার এখান থেকে আটখানা রুটি যায়, ডাল তরকারি বাঁধা। শুনেছি সদানন্দ হাতখরচের টাকা দেয়।

কী আশ্চর্য। তাহলে এখানে পড়ে আছে কেন?

কোথায় যাবে? কে আছে ওর? এই বাড়িটার মতো অবস্থা। যতক্ষণ এখানে আছে ততক্ষণ অহঙ্কারে আছে। কেউ মুখের ওপর অশ্রদ্ধা করে কিছু বলবে না। ওই বয়সে ওটুকু আর কোথায় গেলে পাবে ও? নন্দিনী বললেন।

এইসময় একটা মোটরবাইকের আওয়াজ হল। কুড়ি-একুশ বছরের মোটামুটি স্বাস্থ্যবান তরুণ বাইক থেকে নামতেই পাঁড়েজি এগিয়ে গেল তার কাছে। ছেলেটি জিজ্ঞাসা করল, আবার কী হল? মালের টাকা তো দিয়ে দিয়েছি।

টাকা নিয়েছি বলে ডিউটি করব না এটা কী করে ভাবলে সদাবাবু। বড়মার হুকুম, আজ রাত দশটার পর বাড়িতে কোথাও আলো জ্বলবে না। পুরুষমানুষরা কেউ বাড়ির ভেতর যাবে না। তুমি জান না, জানিয়ে দিলাম। পাঁড়েজি বলল।

হঠাৎ? কেসটা কী?

আমি কী করে বলব।

তুমি হচ্ছ বাস্তুঘুঘু। না, ঠিক হল না, বাড়িতে পুরনো সাপ থাকলে তাকে বাস্তুসাপ বলে। তুমি তার চেয়ে বেশি। সব তোমার নখদর্পণে। এর আগে কতবার এরকম হুকুম শুনেছ। মনে করে বলো?

মনের তলায় বহু ফুটো হয়ে গিয়েছে সদুবাবু। যা রাখি সব ফুটো দিয়ে বেরিয়ে যায়। বড়মা দুঃখ পাবে এমন কাজ কোরো না, হ্যাঁ?

এবার হেনা শব্দ করে না হেসে পারল না।

নন্দিনী ধমক দিল, অ্যাই, কী করছিস?

হাসির শব্দ শুনে ওপরে তাকাল সদানন্দ। মুখ খুলতে গিয়েও সামলে নিল। এ বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে এত দূরত্বে দাঁড়িয়ে কথা বলার চল নেই। সে ভেতরে ঢুকে পড়ল। কিন্তু পাঁড়েজি সেই হাসির আওয়াজ কানে যাওয়া পর্যন্ত কপালে আরও ভাঁজ ফেলে একরাশ বিরক্তি চোখে নিয়ে তাকিয়ে আছে এদিকে। হেনা দেখতে দেখতে বলল, দ্যাখো দ্যাখো, যেন এ বাড়ির শ্বশুরমশাই। গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল।

ওভাবে বলিস না। এ বাড়ি ওর প্রাণ। সায়নের যখন প্রথম রক্ত বের হল নাক কান দিয়ে স্কুলের মাঠ থেকে ওই তো ওকে কোলে তুলে নিয়ে এসেছিল। অল্পবয়সে এ বাড়ির যা রীতিনীতি দেখে এসেছে তাই অনুসরণ করার কথা ভাবে।

দরজায় শব্দ হল। হেনা যাচ্ছিল, নন্দিনী বাধা দিলেন, তুই বোস। কে এল আবার?

দরজা খুলতেই সদানন্দকে দেখা গেল, বিরক্ত করলাম?

ওমা, মা মাসির কাছে গেলে বিরক্ত করা হয় বুঝি?

ব্যাপারটা হচ্ছে, সায়নের চিঠি পেয়েছেন?

হ্যাঁ, ভাল আছে।

আমি ওদিকে যাচ্ছি। আমাকে ঠিকানা দিলে গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করে আসতে পারি। পরশু রওনা হব। যদি কিছু দেওয়ার থাকে তো দিতে পারেন।

খুব ভাল কথা। ভেতরে আসবে না?

না। একটা ভাঙা অ্যাম্বাসাডারের খবর এনেছে বাদল, এখনই যেতে হবে।

ও, তুমি নাকি গাড়ির ব্যবসা ভাল করছ?

কী করব? পেটে বিদ্যে নেই যে ভাল চাকরি পাব। আচ্ছা, চলি। সদানন্দ চলে গেল। দরজা বন্ধ করে নন্দিনী বললেন, এ বাড়ির ছেলে বলে ওকে মনে হয় না।

ঠিক বলেছ। আতুসিপনা একদম নেই। এই চলো, সদানন্দ যাচ্ছে, ওর সঙ্গে গিয়ে সায়নকে দেখে আসি। কতদিন দেখা হয়নি! হেনা নন্দিনীকে জড়িয়ে ধরল।

নন্দিনী হেনার মুখ দেখলেন, তুই ছেলেটাকে খুব ভালবাসিস?

হেনা বলল, দুর! তুমি ওর মা, তোমার মতো ভালবাসতে পারি আমি?

নন্দিনী বললেন, যেদিন ডাক্তার বললেন ওর লিউকোমিয়া হয়েছে সেদিন সমস্ত পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল, কী এমন পাপ করেছি যার ফলে ছেলেটাকে ভগবান এমন শাস্তি দিলেন! তিন দিন রাতে একফোঁটা ঘুমোইনি। হঠাৎ কে যেন বলল, তুই যদি বলিস ওকে ভালবাসিস না তা হলে ও উঠে দাঁড়াবে! তখন ভোরবেলা। আমি ঘুমোইনি কিন্তু জেগেও কি ছিলাম! সোজা ঠাকুরদালানে ছুটে গেলাম। তখন তোরা কেউ ঘুম থেকে উঠিসনি। মায়ের মুখের দিকে তাকালাম। স্পষ্ট মনে হল, কথাটায় যেন মায়ের সায় আছে। খুব রাগ হয়ে গেল। বললাম, বেশ, তোমার মতো ভালবাসি না।

হেনা বলল, ঠিক তিন দিন বাদে ডাক্তারবাবু বলল আপাতত বিপদ কেটে গেছে। মনে পড়ছে, তাই তো। আসলে কী জানো, ওর মধ্যে এমন কিছু আছে যা আমি কারও মধ্যে দেখতে পাইনি। ওকে দেখলেই মন ভাল হয়ে যায়।

তুই চলে যা সদানন্দের সঙ্গে।

পাগল!

কেন?

সঙ্গে সঙ্গে শাশুড়ি ঝাঁপিয়ে পড়বে। তিরিশ বছরের বেশি বড় শ্বশুরের সঙ্গে যে সম্পর্ক ভেবে নিয়ে ছুরি শানাচ্ছে সে এমন সুযোগ পেলে দু হাত তুলে নাচবে। ওই সুযোগ দেব কেন! এখন চলো তো!

কোথায়?

ও তরফে। ঊর্মিলার সঙ্গে কথা বলব। ওই ব্যাপারটার প্রতিবাদ করতে হবে না!

ওঃ। ঠিক আছে, তোরা কথা বলে ঠিক করে আমাকে জানা–।

কেন? তোমার এখন কী এমন রাজকার্য আছে?

সোয়েটারটা কালকের মধ্যে শেষ করতে হবে না? সদানন্দ যাচ্ছে–!

ওহহ, তাই তো। আমি হাত লাগাব?

না। তুই পরে একটা মাফলার বুনে দিস।

হেনার চোখে আলো ঝিলিক দিল। সে দরজা খুলে ভেজিয়ে দিয়ে বাইরে পা বাড়াল। ঊর্মিলার সঙ্গে তার ভাল বনে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মত পাল্টে সে নিজেদের দরজার দিকে এগোল। এই বিশাল বাড়ির দোতলার ভেতরে সাপের মতো পথ চলে গেছে।

শাঁখ বাজছে। সন্ধ্যারতি শুরু হয়ে গেছে মন্দিরে। দরজা ভেজানো ছিল। সেটা ঠেলে ভেতরে পা দিতেই হেনা দেখল শ্বশুরমশাই দাবা সাজিয়ে বসে আছেন। তাকে দেখে বললেন, আমার একটা সমস্যা, বুঝলে বউমা। ছেলেবেলায় দাবা শিখেছিলাম ইন্ডিয়ান স্টাইলে। তা বেশিদুর তো পড়াশুনা করিনি, ইংরেজিটাও ভাল বুঝি না। তাই দাবার বই দেখে চাল শেখা আজও হল না।

শ্বশুরমশাইয়ের কথার মধ্যেই শাশুড়ি এসে দাঁড়ালেন। লম্বা স্বাস্থ্যবতী পঞ্চাশ পার হওয়া মহিলার শরীর গহনার জন্যে বিখ্যাত হওয়া উচিত। বাঁ কোমরে আঙুল রেখে সেই হাতের কনুই দ্বিতীয় হাতে ধরে বললেন, রাজ্যজয় হল?

শ্বশুরমশাই চোখ ওপরে তুলে স্ত্রীকে দেখে বললেন, অ্যাঁ?

তোমাকে কিছু বলিনি তো! তুমি কেন গায়ে মাখছ? আজকাল দেখি আমি কথা বললেই তোমার গায়ে লাগছে। শাশুড়ি চোখ ঘোরালেন, যাকে বলছি সে-ও তো শুনছে।

এত সহজে রাজ্যজয় কি করা যায় মা! হেনা হাসার চেষ্টা করল।

কোথায় যাওয়া হয়েছিল সেটাও জানা যাবে না?

এ বাড়ির বাইরে তো যাইনি।

শ্বশুর বললেন, পোশাক দেখে বুঝতে পারছ না, বউমা বাইরে যায়নি!

তুমি থামবে! আমাদের সময়ে এই ঘরের চৌকাঠ পার হলেই বাইরে বলা হত। এর সংসার ওর সংসারে ঘুরঘুর করে দাসীবাঁদিরা, বাড়ির বউ নয়। বুঝলে?

আপনি এইভাবে কথা বলছেন কেন! সায়নের খবর নিতে গিয়েছিলাম। অত বড় অসুখ নিয়ে ছেলেটা পাহাড়ে একা রয়েছে। ওর মা বাবার কথাও ভাবুন! ওর খরচ চালিয়ে কোনওমতে বেঁচে আছে ওরা। ওদের কাছে যাওয়া আপনার চোখে অন্যায়।

ন্যায়-অন্যায়ের বিধান দেওয়ার আমি কে? সেখানে ছেলেটার বাপ ছিল না?

না।

কে জানে! আমি তো আর দেখতে যাইনি।

মা, একটা কথা বলব?

ঢং করে প্রশ্ন করার কী আছে?

আপনি এই অকারণে সন্দেহ করা বন্ধ করুন। এটা খুব খারাপ। আচ্ছা, আপনিই ভাবুন, সায়নের মা যেখানে বসে আছেন সেখানে ওর বাবা থাকলে কী এমন পাপ কাজ আমি করতে পারতাম।

পুরুষমানুষকে আমি মরে গেলেও বিশ্বাস করব? পাগল।

আপনার ছেলেও কিন্তু পুরুষমানুষ!

বউমা! যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা!

হেনা হাসল, লাগল তো! আপনার কথায় অন্য মানুষের মনেও ঠিক একই রকম লাগে মা। একটু বুঝুন। ভেতরে চলে গেল হেনা।

ঝি-এর মুখে খবর শুনে চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়তে লাগল ঊর্মিলা। তারপর সোজা পাশের ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসে গম্ভীর মুখে আকাশ দেখতে থাকা কমলেন্দুকে বলল, এই যে, খুব তো তখন স্ত্রীর পত্র ছিঁড়েছিলাম বলে কথা বন্ধ করে গম্ভীর হয়ে আছ। তোমার লজ্জা লাগে না? মনে হয় না প্রতিবাদ করা উচিত?

কমলেন্দু বিরক্ত চোখে তাকাল।

ঊর্মিলা জিজ্ঞাসা করল, আজ রাত্রে দশটা বত্রিশ থেকে চল্লিশ এ বাড়ির সব আলো নেভানো থাকবে। তুমি কি জানো?

কমলেন্দু প্রশ্ন না করে পারল না, কেন?

প্রশ্ন তো আমি তোমাকে করছি।

ও। হয়তো, কে আদেশ দিয়েছে?

এ বাড়ির কাঁঠালি কলা, তোমাদের বড়মা।

ও। তাই বলো! নিশ্চয়ই পুজোআর্চা কিছু আছে। পাঁজি দেখলেই জানতে পারবে।

তোমার সঙ্গে কথা বলে কোনও লাভ নেই। আমিই যাচ্ছি।

কোথায়?

আগে টুপুরদের ওখানে, তারপর প্রয়োজন হলে তাঁর কাছে।

কিন্তু কী হয়েছে, বলবে তো?

ঊর্মিলা উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে এল। টুপুরদের বাড়িতে যেতে হলে তার পক্ষে ছাদ ঘুরে যাওয়াই সহজ। যদিও মূল গেট থেকে দুটো সিঁড়ি দুদিক দিয়ে ওপরে উঠেছে, যে যার এলাকায় ঢুকে পড়তে পারে সেখান দিয়ে।

সন্ধে নেমে গেলে কোনও বাড়ির বউ-ঝি আর ছাদে থাকে না। খোলা চুলে তো নয়ই, যৌবন এলে রাত নামলে ছাদে যাওয়া নিষেধ। সৌদামিনী একদিন গল্প করেছিলেন টুপুরকে, অনেক বদ আত্মা আছে যারা রাত নামলেই বাড়ির ছাদে পা ঝুলিয়ে বসে থাকে। আর মেয়েমানুষ একলা দেখলেই তার ভেতরে ঢুকে পড়ে। ভাঁড়ার ঘরের জানলায় দাঁড়িয়ে টুপুর দেখল ছাদ ডিঙিয়ে দ্রুত পায়ে কেউ আসছে। এই সময় ছাদে কারও থাকার কথা নয়। তাহলে সৌদামিনীর বলা সেই দুষ্ট আত্মা নাকি! গল্পটা সে শুনিয়েছিল সায়নদাকে। সায়নদা গম্ভীর হয়ে বলেছিল, তুমি একটি হাঁদা। মানুষ যখন বেঁচে থাকে তখন তার আত্মা বদ অথবা ভাল হয়। মরে গেলে আত্মাও মরে যায়। তোর ঠাকুমা রাক্ষস খোক্ষসের মতো গল্প শুনিয়েছে। কিন্তু ওসব বলার কয়েক দিনের মধ্যে শোনা গেল সায়নদার নাক আর কান দিয়ে রক্ত বেরিয়েছিল, অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। খুব খারাপ অসুখ। সৌদামিনী বলেছিলেন, নিশ্চয়ই কেউ ভর করেছে। যাচিয়ে নিক।

ওপাশের দরজায় শব্দ হতে সাহস হল। আত্মারা কখনও শব্দ করে ঘরে ঢোকে না। সে এদিকের জানলা থেকে জিজ্ঞাসা করল, কে? কে ওখানে?

এবার ছায়াটা স্পষ্ট হল। ছাদের এপাশে চলে এসে ঊর্মিলা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, তুই এখানে কী করছিস?

টুপুর হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল ঊর্মিলাকে, ও, তাহলে তুমিই।

আমি মানে।

তুমি মানো না, এসময় ছাদে দুষ্ট আত্মারা ঘুরে বেড়ায়।

ও, তুই বুঝি তাদের এমনি করে যাচাই করিস? খোল দরজা।

আমি কেন ছুঁলাম তা তুমি জানো না! টুপুর হাসল।

কেন?

তোমাকে এখন চান করতে হবে।

ওঃ। যা বলছি তাই কর। দরজা খোল।

কী করে খুলব? আমাকে তো ওরা বন্দী করে রেখে দিয়েছে সেই বিকেল থেকে। পাঁচটা আরশুলা মেরেছি, জানো?

তোর তো সাহস খুব। দুষ্টুমি করেছিলি খুব?

না গো। কী করেছি সেটাই বুঝলাম না ভাল করে। আমার শরীর খুব খারাপ করছিল তবু শুনল না। জোর করে এখানে ঢুকিয়ে দিয়েছে। ঠাকুমা নিজে হাত দেয়নি চান করতে হবে বলে, মাকে দিয়ে করিয়েছে। ঠাকুমাকেও ছুঁয়ে দেব।

ঊর্মিলা জানলা থেকে সরে এসে ছাদের দিকের দরজায় আবার শব্দ করতে সমরেন্দ্রনাথের গলা পাওয়া গেল, কে? কে?

আমি ঊর্মিলা?

দরজা খুলে সমরেন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি? এদিকে, এ সময়ে?

বউদিদি কোথায়?

কৃষ্ণা সেই মুহূর্তে ঘরে ঢুকে ঊর্মিলাকে দেখে হেসে ফেললেন, আরে তুমি? একী কাণ্ড! বর ছাড়ল? এসো এসো।

তুমি তোমার মেয়েকে আটকে রেখেছ বউদি? এক পা না এগিয়ে প্রশ্ন করতেই ঊর্মিলা দেখল কৃষ্ণার মুখ নীল হয়ে গেল।

ছিঃ বউদি, ছিঃ।

আমাকে ছিঃ বলে লাভ নেই ঊর্মিলা। এ বাড়িতে আমার গুরুজনরা আছেন।

তুমি তাঁদের বোঝাতে পারনি?

কী বোঝাব? চাঁদ সুর্যের কথা জেনেও ঘরে ঘরে যখন গ্রহণের দিন ধোওয়া মোছা, কুলকাঁটা দেওয়া হয় তখন কাদের বোঝাতে পারি আমি! সে ক্ষমতা আমার কোথায়? টুপুরকে ছেড়ে রাখলে সে এ-ঘর ও-ঘর করবে, সব কিছু ছুঁয়ে ফেলবে আর সেসব জিনিস নাকি রসাতলে যাবে। তার চেয়ে ও ভেতরে থাকলে যদি পৃথিবীটা অক্ষত থাকে তা হলে ওর ভেতরে থাকাই উচিত। একটানা বলে গেলেন কৃষ্ণা। শেষ দিকে আঁচলের কোণা ঠোঁটে উঠে গেল।

ঊর্মিলা সমরেন্দ্রনাথের দিকে তাকাল, আপনার বক্তব্যটা শুনতে পারি কি?

এসব মেয়েলি ব্যাপারে আমার কোনও বক্তব্য থাকা উচিত নয়।

বাঃ। এটা তো এসকেপিস্টের মতো কথা বলছেন।

দেখুন ভাই, যদি আলোচনা করতেই হয় কমলেন্দুকে পাঠান। এ ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কথা বলা আমার পক্ষে বেশ ডেলিকেট হয়ে যাচ্ছে। সমরেন্দ্রনাথ স্ত্রীর দিকে তাকালেন, রায়বাড়ির ইতিহাসে কেউ এ বিষয় নিয়ে কখনও কথা তুলেছে বলে শুনিনি। আমি মাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

সমরেন্দ্র ভেতরে চলে গেলে ঊর্মিলা বলল, তুমি কিছু মনে কোরো না বউদি, মেয়ে হিসেবে মেনে নিতে পারলাম না বলে চলে এসেছি।

ঠিকই করেছ। বোসো, কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে।

আমি একটু অশ্বত্থামা নামের কাউকে সামনে রাখব।

তার মানে।

এই সময় সৌদামিনী ঘরে এলেন, ওমা, তুমি! কোন দিক দিয়ে এলে? সদর দিয়ে তো আসনি। এলে টের পেতাম।

আমি ছাদ ঘুরে এসেছি জেঠিমা।

সে কি! কাজটা ভাল করনি। দাঁড়াও। সৌদামিনী এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, পরিষ্কার আছ তো?

একদম।

তোমার মাথায় মন্ত্র জপে দিচ্ছি। বাঁ হাতের কড়ে আঙুল ঊর্মিলার কপালে সামান্য ছুঁয়ে বিড়বিড় করে গেলেন সৌদামিনী কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, আর কক্ষনও এ কাজ করবে না। হ্যাঁ, খোকা বলছিল, তোমার নাকি কী কথা আছে?

আপনি আমার এমন ক্ষতি করলেন কেন?

ক্ষতি! আমি!

হ্যাঁ। আজ রাত দশটা বত্রিশ থেকে চল্লিশ এ বাড়ির সব আলো নিভিয়ে দেওয়ার হুকুম হয়েছে। নিশ্চয়ই আপনার আবেদনে হয়েছে। ওই সময়ে আমার এক খুব ছেলেবেলার বান্ধবীকে টিভিতে দেখাবে। আলো নেবালে তাকে দেখতে পাব না। এটা ক্ষতি নয়! কত বছর ওকে দেখিনি?

আমি কী করব বলো! উনি নিশ্চয়ই পাঁজিতে ওই সময় পেয়েছেন। আমি তো তাঁকে বলিনি সাড়ে দশটার পর আয়োজন করুন। তা ছাড়া উনি এ বাড়ির সব আলো নিবিয়ে দিতে বলেছেন। সাউন্ড কমিয়ে টিভি চালালে তিনি নিশ্চয়ই আপত্তি করবেন না যদি ভল্যুম কমানো থাকে। সৌদামিনী হাসল, আইন যেমন আছে, তেমন তার ফাঁকও আছে। যাও, রাত কোরো না, এবার সামনের দরজা দিয়ে যাওয়াই ভাল।

আমার তো আসল কথাই বলা হল না।

আবার কী কথা!

কিছু মনে করবেন না জেঠিমা, আপনি আমার মায়ের চেয়ে বড়। কিন্তু আমিও মেয়ে, বিবাহিতা, তাই আপনার খারাপ লাগলেও, আমার লাগবে না। কারণ আমার কাছে এটা কোনও অপরাধ নয়, একটা নিয়ম মাত্র। যেমন করে গাছ বড় হলে ফুল হয়, ফল হয়, আবার কারও শুধুই ফুল, ফল হয় না, প্রকৃতি যে নিয়ম বেঁধে দেয় সেই বাঁধা নিয়মের একটা। আপনার কবে প্রথম পিরিয়ড হয়ছিল। ঠিক কত বছর বয়সে?

সৌদামিনীর মুখ লাল হয়ে গেল। প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে তিনি বললেন, তোমার তো সাহস কম নয়! এ প্রশ্ন আমাকে করছ।

আমি অন্যায় কোনও প্রশ্ন করিনি।

আমার বলতে ঘেন্না লাগছে।

তখন আপনাকে কী ব্যবহার করতে বলা হয়েছিল?

তার মানে।

শাড়ির পাড় বা ছেঁড়া কাপড় ভাঁজ করে, তাই তো?

হ্যাঁ। তাই নিয়ম ছিল।

নিয়ম না, হাতের কাছে অন্য কোনও আবিষ্কার ছিল না। ফলে মা মাসিরা কাচা কাপড় ভাঁজ করে ব্যবহার করতেন। ব্যাপারটা আদৌ স্বাস্থ্যসম্মত ছিল না। ওই আব্রু ভেদ করে বাইরের জামাকাপড়ে রক্ত লেগে যাওয়া অস্বাভাবিক ছিল না। সেটা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু বলেই তখন নিয়ম ছিল আতুর কয়েকদিন মেয়েরা ঘরের বাইরে যাবে না। পুরুষের চোখের আড়ালে থাকবে। শরীর ঠাণ্ডা রাখতে মাছ, মাংস, ডিম অথবা মশলা দেওয়া রান্না খাবে না। একেবারে বিধবা করে রাখা হত সেকালে। তাই তো?

সেটাই শোভন ছিল।

তখন। তখনকার সময় নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। আপনি নিশ্চয়ই টিভি দ্যাখেন। প্রকাশ্যে স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিজ্ঞাপন দেখছেন তো? আধুনিক ন্যাপকিন ব্যবহার করলে আর পাঁচটা দিনের থেকে কোনও পার্থক্য তৈরি হয় না। আজ মেয়েরা অফিসে চাকরি করছে, প্লেন চালাচ্ছে। তাদেরও পিরিয়ড হয়। জেঠিমা, এইসব একটু চিন্তা করুন। ওই বাচ্চা মেয়েটাকে একটা নোংরা ঘরে বন্ধ করে আপনি ওকে কোন শিক্ষা দিচ্ছেন? কদিন বাদেই স্কুলে ও এ বিষয়ে যা পড়বে, তার পরে আপনাকে শ্রদ্ধা করতে পারবে?

বইয়ে অনেক কিছু লেখা থাকে। পাঁচ স্বামী নিয়ম মেনে এক স্ত্রীকে ভোগ করল। বাস্তবে তা কি সম্ভব? কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছি না এ বাড়ির বউ হয়ে আসার পর তোমার শাশুড়ি কিছুই শেখায়নি। সে না হয় বেশিদিন ঘর করতে পারেনি তোমার সঙ্গে, কিন্তু কমলেন্দু তো ভালমানুষ।

আপারা আজ বড়মার কাছে যাচ্ছেন কেন?

এটা নিয়ম। সৌদামিনী জোরের সঙ্গে বললেন, এ বাড়ির নিয়ম।

আপনারা যান। আপনার বউমাকে নিয়ে যান। ওই বাচ্চাটাকে নিয়ে না গেলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হবে?

এ ব্যাপারে তোমার সঙ্গে কথা বলব না।

তা হলে আমি আজই বড়মার সঙ্গে দেখা করব।

ঊর্মিলা উঠে দাঁড়াতেই কৃষ্ণা সভয়ে বলে উঠলেন, না। যেও না।

না বউদি। ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা বলা দরকার।

ঠিক তখনই টুপুরের চিৎকার ভেসে এল, মরে গেছি, মরে গেছি। উঃ, আঃ। আমাকে বাঁচাও, বাঁচাও।

কৃষ্ণা চমকে তাকালেন। ঊর্মিলা জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে?

সৌদামিনী বললেন, দ্যাখো তো বউমা। বিছে-টিছে বের হল কিনা?

কৃষ্ণা দ্রুত ওপাশের দরজা খুলে ফেলল, কী হয়েছে? এই টুপুর?

ঊর্মিলা জোরে ডাকল, টুপুর।

কোনও সাড়া এল না।

সৌদামিনী এবার ব্যস্ত হলেন। এগিয়ে গিয়ে বললেন, সরো বউমা, কী করছে ও? শুয়ে আছে নাকি?

কৃষ্ণা ঘরে ঢুকে গিয়েছিলেন। কিন্তু তখনই টুপুর বেরিয়ে এসে খপ করে সৌদামিনীকে জড়িয়ে ধরে বলল, এবার তোমাকে চান করতে হবে।

সঙ্গে সঙ্গে চিলচিৎকার শুরু করলেন সৌদামিনী। তিনি শুন্যে হাত ছুঁড়ে চলেছেন। আর খিলখিল করে হেসে চলেছে টুপুর। ঊর্মিলা আর না দাঁড়িয়ে দরজা পেরিয়ে ছাদে যেতেই কৃষ্ণার গলা পেল, কী হচ্ছে কী? বদমাস মেয়ে? চড় মারার শব্দ কানে এল। টুপুর একটাও শব্দ করল না।

ঊর্মিলা শুন্য ছাদে একা হেঁটে চলেছিল। মাথার ওপর আকাশজুড়ে কয়েক লক্ষ তারা। লক্ষ না কোটি! কিন্তু মাঝে মাঝে, এই যেমন এই সময়, কয়েক শো বলেও মনে হচ্ছে না। সে মুখ তুলে সেই তারাদের দেখতে দেখতে হাঁটছিল। আজ তারায় তারায় জ্বলুক বাতি, আঁধার সরিয়ে দাও/ অন্ধকারের দুয়ার খুলে আলোয় ভুবন ভরিয়ে দাও। গানের কথাটা এই রকম নয় কি? হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়েছিলেন? এ ভুবন কবে কোন আলো এসে ভরাবে কে জানে, তবে ঊর্মিলার মনে হল, মেয়েদের সবচেয়ে বড় শত্রু মেয়েরাই।

.

রাত নটা নাগাদ আতরবালা এসে জানিয়েছিল ঊর্মিলা দেখা করতে চায়। ইজিচেয়ারে শোওয়া অবস্থায় বড়মা বললেন, কে আতর, ঊর্মিলা কে?

কমলেন্দুর স্ত্রী। বিয়ের কিছুদিন পরে তার শাশুড়ি মারা যায়। শাশুড়ি ছিলেন সত্যভামা, অমলেন্দুর স্ত্রী।

অ। কী চায় সে?

বলছে ব্যক্তিগত।

কাল আসতে বল। আজ আমার মন স্থির নেই।

বলে দিয়েছি।

অ। সে চলে গিয়েছে?

না গিয়ে উপায় কী?

আচ্ছা! আমি যদি বলতাম, যা, নিয়ে আয়।

এ হুকুম হত না।

কেন?

তা হলে এত বছর সেবা করা বৃথা বলে মনে হত।

বড়মা মাথা নেড়ে হাসলেন, নাতবউকে পাঠিয়ে দে।

সে ঘুমোচ্ছে।

এই অসময়ে ঘুমোচ্ছ কেন?

আচ্ছা। যার স্বামী আমেরিকায় বসে আছে তার কি সময় অসময় জ্ঞান আছে? আমি একটা কথা বলতে পারি?

বল।

ওকে ওর স্বামীর কাছে পাঠিয়ে দাও।

কেন?

ওরা সুখী হবে।

তা হলে নাতি আর কখনও ফিরবে না।

সে এমনিতেও ফিরবে না। মাঝখান থেকে কচি বউটা মরবে। সে ওখানে মেমসাহেব বিয়ে করে বসলে কিছু করা যাবে?

একটা দীর্ঘশ্বাস বের হল বড়মার বুকের খাঁচা থেকে। একটু সময় নিয়ে বললেন, নাতবউ যেতে চায়?

মুখে বলে না। মনে বলে।

মনে যে বলে তা তুই বুঝলি কী করে?

আহা, বোশেখের বিকেলে পশ্চিমে মেঘ জমলে কী হয় আর শরতের আকাশে মেঘ জমলে কী হবে তা জানতে শিক্ষে লাগে নাকি?

হুম্। হয়তো ঠিক বলেছিস। কিন্তু নাতবউকে আমার সামনে এসে বলতে বল যে সে তার স্বামীর কাছে যেতে চায়।

একথা এ বাড়ির বউ হয়ে কখনও বলতে পারে?

কেন! পারবে না কেন।

বাড়ির রেওয়াজ আছে?

অঃ। দেখি ভেবে দেখি। সে চলে গেলে নাতি আর এমুখো হবে না। তখন আমাকে দেখার জন্যে তুই একা থাকলি। তোরও তো বয়স হয়েছে। কিছু হয়ে গেলে আমি কার কাছে থাকব, কী নিয়ে থাকব, এসব কথা চিন্তা করতে হবে। চট করে এক কথায় ডেকে বলে দেওয়া যায়, চলে যাও! বড়মা একটু চুপ করলেন, কটা বাজল?

প্রায় দশটা।

অ্যাঁ। এখনও চুপ করে আছিস, তৈরি করে দে আমাকে। ঠাকুরদালানে যেতে হবে খেয়াল নেই! শুধু আজেবাজে কথা।

এখনও অনেক দেরি আছে।

চুপ কর। যা বলছি তা না করে মুখে মুখে তর্ক! বৃদ্ধা রেগে গেলেন। ঠিক দশটা নাগাদ বড়মা তৈরি। লাল বেনারসী শাড়ি পরনে, পাকা চুলের নুড়ির সঙ্গে পেছনের আঁচল ক্লিপ দিয়ে আটকে দেওয়ায় বেশ ঘোমটা ঘোমটা ভাব এসেছে। পায়ে কোনও চটি নেই কারণ তিনি ঠাকুরদালানে যাচ্ছেন। আতরবালার এক হাতে বড় মোমদান অন্য হাতে পুজোর জিনিসপত্র। মোমদানের বাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। আতরবালা বলল, তুমি আমাকে ধরে নামার সময় নামো, ওপরে ওঠার সময় আমি তোমাকে ধরব।

ঠিক আছে। নামতে আমি পারব। শরীরটা একটু ভারী হয়ে গেছে বলে–! হ্যাঁ রে ঘণ্টা দিয়েছিস? কানে এল না তো কিছু?

সাড়ে দশটায় বাজবে। নিশ্চয়ই এখনও বাজেনি সাড়ে দশটা। পাঁড়েজিকে সেই কখন খবর দিয়েছি। আতরবালা দরজার দিকে এগোল।

আ মলো যা! এই বুড়িকে নিয়ে যে কী করি! তুই পাঁড়েকে খবর দিয়েছিস? সে ব্যাটা তো এখন আফিং খেয়ে ঘুমায়। দ্যাখ, সারাবাড়ি জুড়ে আলো জ্বলছে, টিভি রেডিও চলছে। এই মচ্ছব চললে আমি নামব না। বড়মা পাশ ফিরে দাঁড়ালেন।

আতরবালা বলল, আশ্চর্য। সাড়ে দশটার আগেই সবাই আলো নিভিয়ে ভূতের মতো বসে থাকবে! তোমার কপাল ভাল, এরা বলে তোমার কথা শোনে, অন্য বাড়ির মানুষ হলে কানেই তুলত না।

বের করে দিতাম এ বাড়ি থেকে গলাধাক্কা দিয়ে। ভাল হয়েছে, আলাদা হয়ে আছ, এ বাড়ির শরিক কিন্তু মালিক নও। মায়ের আদেশ অমান্য করলে এ বাড়িতে থাকা চলবে না। বড়মার কথা শেষ হওয়ামাত্র বাড়ি কাঁপিয়ে ঘন্টা বাজতে লাগল। সেইসঙ্গে পাঁড়েজির সরু গলার চিৎকার, বাতি বন্দ কর। শান্ত হো যাও। সব কামরেমে রহ।

আতরবালা বলল, চলো। আমাকে ধরে ধরে নামবে।

এবার বড়মা কিছু বললেন না। সমস্ত আলো টুপটুপ করে নিভে গেল। শুধু আলো নয়, টিভি পর্যন্ত বন্ধ করে দিল প্রতিটি পরিবার। সেই নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে আতরবালার হাতের মোমবাতির আলোয় পথ চিনে নামছিল বড়মা। দূর থেকে দুজনকে একই দেহ মনে হচ্ছিল। যেন লাল পদার মাঝখানে সাদা লাইন। আতরবালা এখন থান পরেছে। ধর্মীয় অনুষ্ঠান হলেই ইদানীং সে থান পরা শুরু করেছে।

ওপাশের সিঁড়ি বেয়ে আগে আগে নামছিলেন সৌদামিনী। তাঁর হাতে লণ্ঠন। হাঁটতে হাঁটতে বলছিলেন, শক্ত হাতে ছুঁড়িটাকে ধরে রাখো বউমা। আবার বলে বোসো না তোমার হাত ছাড়িয়ে সে পালিয়েছে। পেছনে আছে তো?

কৃষ্ণা বললেন, হ্যাঁ।

আরও পেছনে থেকে টুপুর জিজ্ঞাসা করল, এত রাত্রে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ তোমরা? উঃ, আমার একটুও ভাল লাগছে না, ঘুম পাচ্ছে।

সৌদামিনী বললেন, রাত বারোটা পর্যন্ত অন্য দিন বকবক করার সময় ঘুম কোথায় যায়?

এখন খিদে পেয়েছে!

অ্যাই চুপ। চুপচাপ নাম। কৃষ্ণা ধমক দিল।

আমার মনে হচ্ছে তোমরা আমাকে বলি দিতে নিয়ে যাচ্ছ!

দুটো আলো প্রায় একই সময়ে দুদিক থেকে নীচের তলায় এসে পৌঁছোল। সৌদামিনী ইশারায় কৃষ্ণাকে দাঁড়াতে বলে এগিয়ে গেলেন। লণ্ঠন মেঝের ওপর রেখে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন বড়মাকে, আমরা এসেছি।

আঃ। ঠাকুরদালানে এসে আমাকে প্রণাম করছ কেন? এখানে মা-ই সব। ওঁকে প্রণাম করলেই সব করা হয়ে গেল। মেয়েকে ঠিকঠাক রেখেছিলে তো?

হ্যাঁ। খবর শোনামাত্র ভাঁড়ারঘরে বন্দী করে রেখেছিলাম।

বন্দী করতে হল কেন? ঘরের এককোণে বসতে বললেই তো হত।

আজ্ঞে, বড্ড তেজ, জেদি।

এই তো তেজ ভাঙার দিন শুরু হল। শরীর যত বড় হবে বুঝতে শিখবে কী থেকে কী হয়। নিয়ে এসো তাকে। আতরবালাকে ইঙ্গিত করে ধীরে ধীরে দালানে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল মন্দিরের সিঁড়ি ভাঙতে লাগলেন বড়মা। আজ এটুকু নামতেই হাঁটুর ব্যথা জানান দিচ্ছে। নাতবউ-এর বাপ ডাক্তার। বিনি পয়সায় যে সব ওষুধ পায় তাই তাঁকে পাঠিয়ে দেয়। আজ মনে হচ্ছে তাতে জল মেশানো থাকে নিশ্চয়ই।

মায়ের মূর্তির সামনে পেতলের পিলসুজে মোটা সলতে পুড়ে শেষ হয়ে এসেছে। আর একটু বাদেই দপ দপ করতে করতে নিভে যাবে। কিন্তু আতরবালার হাতের মোমের আলোয় মায়ের মুখ ঝকমকিয়ে উঠল। এ মূর্তি ব্যাঘ্রবাহিনী। ভয়ঙ্কর প্রাণীটিকে বশ করে পরম উদাসীন মুখে তাকিয়ে আছেন কোন সুদূরে। বাঘটি পড়ে আছে তাঁর পায়ের তলায়, যুদ্ধ করার সময় অজান্তে চুল খুলে লুটিয়ে আছে বুকেপিঠে। যুদ্ধে জয় আসামাত্র এসে যায় নিদারুণ উদাসীনতা। পাশ ফেরানো মুখ। সেই মুখে এখন মোমবাতির আলো পড়েছে।

বড়মা দু হাত জোড় করলেন, মা, মাগো, আর কতদিন এভাবে পড়ে থাকব মা?

মা মায়ের মতো রইলেন।

বড়মা এবার পেছন ফিরলেন, কই, সে কোথায়?

সৌদামিনী বলল, যাও বউমা, ওকে নিয়ে যাও।

টুপুর বলল, না, আমি যাব না। আগে বলো, কী করবে?

বড়মা ধমক দিলেন, এই যে, তুমি ওর মা? ওকে নিয়ে এখানে আসতে পারছ না। এই সময়ের মধ্যে না হলে মেয়ে নষ্ট হয়ে যাবে, বুঝতে পারছ না?

সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড নাড়া খেয়ে কৃষ্ণা মেয়েকে টানতে টানতে বড়মায়ের পাশে এনে দাঁড় করালেন। বড়মা ধমকে উঠলেন, অ্যাই, তুই কাঁদছিস কেন?

তাঁর গলার স্বরে এমন কিছু ছিল যে টুপুর থমকে গেল।

বড়মা বললেন, সাষ্টাঙ্গে প্রণাম কর মাকে।

ব্যাঘ্রবাহিনীকে প্রণাম করতে খুব ভাল লাগে টুপুরের। সে চট করে রাজি হয়ে গেল। তাকে প্রণাম করতে দেখে খুশি হয়ে বড়মা বললেন, মা, এই পৃথিবীতে আর একটি শরীর আজ নারী হয়েছে। এখন থেকে তার মনের পাপ শরীরের রক্ত হয়ে প্রতি মাসে বের হবে। এসব তোমারই করা মা। কিন্তু এই প্রথম দিনে সেই রক্ত নিয়ে ও তোমার কাছে এসেছে, তুমি ওর পবিত্রতা রক্ষা করো।

প্রণাম করলেন তিনি। ওপাশে দাঁড়ানো সৌদামিনী আর কৃষ্ণাও, তাঁর অনুসরণ করল। বড়মা বললেন, অ্যাই ছুঁড়ি, পারবি? পারবি মায়ের পায়ের সিঁদুর নিজের মুখে মাখতে?

টুপুর মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

তা হলে ওঠ। আর সময় নেই। মেখে বল, মা আমাকে রক্ষা করো।

টুপুর উঠল। দ্রুত বেদির পাশে চলে এসে মায়ের পায়ের সিঁদুর তুলতে গিয়েও মত পাল্টে জিজ্ঞাসা করল, কপাল থেকে নেব? কপালের সিঁদুর ভাল।

না, যা বলছি তাই কর।

টুপুর পা থেকে সিঁদুর তুলে নিজের গালে সামান্য লাগিয়ে মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর মায়ের গালেও সিঁদুর হাত লেপে দিল।

ওপাশে সৌদামিনী চিৎকার করে উঠলেন, ছুঁয়ে দিল, মাকে ছুঁয়ে দিল।

টুপুর তীব্র প্রতিবাদ করল, বাঃ পা ছুঁলে ছোঁয়া হয় না? আমি দেখছিলাম, কে বেশি লম্বা, মা না আমি। বাঘের ওপর উঠলে মা বেশি লম্বা, তাই না?

.

০৬.

ডাক্তার আঙ্কল ইনজেকশন দিয়ে খুব যত্নের সঙ্গে তুলোয় রক্ত তুলে নিচ্ছিলেন নাক এবং কান থেকে। সায়ন চুপচাপ শুয়েছিল উঁচু খাটে। এই সময়ে যা যা তাদের প্রয়োজন হয় তা এই ঘরে রয়েছে। সেগুলো চেয়ে দেখছিল সায়ন। সে সব কিছু স্বাভাবিকভাবে দেখতে পাচ্ছে, শুনতে পাচ্ছেও। শুধু শরীরের ভেতর ঢেউ-এর মতো একটা অনুভূতি তাকে খুব বিব্রত করছিল। ঢেউটা ওপরে উঠেই আবার নীচে নেমে যাচ্ছে। এবং তখনই কয়েক মুহূর্তের জন্যে মনে হচ্ছে সে তলিয়ে যাচ্ছে। একরাশ অন্ধকার ডালপালা মেলে হাঁ করে তাকে গিলতে ছুটে আসছে কিন্তু গিলতে পারছে না। ঢেউটা আবার তাকে তুলে নিয়ে আসছে ওপরে যেখানে হালকা নীল আলো বিছানো। কে যেন গান গাইছে। কে গাইছে, কী গান, সে বুঝতে পারছে না।

.

বড়বাহাদূরের গলা পেল যেন, এসে গিয়েছে সাব।

বাঃ। কী যেন নাম ওর?

পদমকুমার।

নিয়ে এসো ওকে। জলদি।

একটু পরেই সায়ন শুনতে পেল ডাক্তার আঙ্কলের গলা, তোমার নাম পদমকুমার?

জি।

তুমি জানো, কেন এখানে তোমাকে ডেকে আনা হয়েছে?

জি।

তোমাকে কি কেউ জোর করে ধরে এনেছে?

না তো।

তা হলে?

ওই ভাই-এর জান বাঁচাতে এসেছি।

তুমি জান বাঁচাবে?

আমি কী করে পারব? আমার খুন ওর শরীরে গেলে জান বেঁচে যাবে।

তুমি আগে ওকে দেখেছ?

জি।

কোথায়?

এখানেই। আমার ছোটা ভাই ওর কাছে গানা শিখেছে।

পদমকুমারের মুখ সায়ন দেখতে পাচ্ছিল না। ডাক্তার আঙ্কল ওকে বসতে বললেন, তুমি এর আগে কবে শেষবার রক্ত দিয়েছ?

আমি কখনও দিইনি।

এই যে আমরা যখন তোমাদের ডেকে ব্লাড গ্রুপ পরীক্ষা করিয়েছিলাম তখন তোমাদের ভয় হয়নি? ডাক্তার আঙ্কল সম্ভবত কাজ করতে করতে কথা বলছেন।

না। ট্যাক্সি ড্রাইভারের লাইসেন্স পেতে হলে গ্রুপ বলতে হয়। আপনি বিনা পয়সায় করিয়ে দিচ্ছেন।

তুমি ট্যাক্সি চালাতে চাও?

হ্যাঁ।

লাইসেন্স পেয়ে গেছ?

নাঃ। দু হাজার টাকা ঘুষ চায়। কোথায় পাব?

ঠিক আছে। আমি দেখব যাতে তোমাকে ঘুষ দিতে না হয়। প্র্যাকটিস করছ?

জি।

দ্যাখো, পদমকুমার, তোমার কি একটুও লাগল?

না।

শরীর খারাপ করছে?

না।

এই দ্যাখো, এই বোতলে তোমার রক্ত নিয়েছি। একটু পরে ওই রক্ত এই ভাই-এর শরীরে আস্তে আস্তে ঢুকিয়ে দেব। তোমার রক্তে ও আবার শক্তি ফিরে পাবে। মনে রেখো, তুমি এই ভাইকে আজ নতুন করে জীবন দিলে। আর হ্যাঁ, তুমি যাবে না। তোমাকে খাবার দেওয়া হবে। একটু বিশ্রাম করে খেয়ে তবে যাবে। ডাক্তার আঙ্কল ফ্রিজ খুলে রক্তের বোতলটা উল্টো করে রেখে দিলেন। ঘড়ি দেখলেন। তারপর সায়নের কাছে এসে বললেন, খুব কষ্ট হচ্ছে?

সায়নের মুখ সাদা হয়ে গিয়েছিল, হাসি বিবর্ণ। সে মাথা নেড়ে না বলল।

ডাক্তার আঙ্কল বললেন, তুমি তো অন্য সবার চেয়ে বেশি ইনটেলিজেন্ট। তাই বলি, অত ভাব কেন? এত টেনশন হলে শরীর কি বইতে পারে!

আমি তো কিছুই ভাবিনি।

তা হলে?

মন্ত্রীরা চুরির অপরাধে ধরা পড়েছে, এই খবরটা পড়েই মনে হল মানুষ কাকে ভোট দেয়? কেন ভোট দেবে? আর তখনই এসব শুরু হয়ে গেল।

মুশকিল। ডাক্তার আঙ্কলকে মাথা নাড়তে দেখল সায়ন। হঠাৎ তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, সায়ন, তুমি গান শুনবে?

গান?

হ্যাঁ।

না। আচ্ছা, আমি কখনও সমুদ্র দেখিনি। আমাকে সমুদ্র দেখাবেন? নিশ্চয়। ও হো, তোমাকে বলা হয়নি, আমি ঠিক করেছি, সামনের শীতে তোমাদের সবাইকে নিয়ে কোনও সমুদ্রের ধারে গিয়ে এক মাস থেকে আসব। কেমন?

খুব ভাল হয়। শীত কবে আসবে?

ডাক্তার কিছু বলার আগে বড়বাহাদুর দরজায় দাঁড়াল, সাব!

ডাক্তার তাকালেন। বড়বাহাদুর বলল, ও নিতে চাইছে না।

সে কী!

হ্যাঁ। বলছে দরকার নেই। ওমলেট মিষ্টি খেয়েছে। দুধ খায়নি।

ওকে ডেকে দাও।

বড়বাহাদুর বেরিয়ে গিয়ে ফিরে এল পদমকুমারকে নিয়ে। ডাক্তার তার কাছে গিয়ে বললেন, তোমার যে রক্ত শরীর থেকে বেরিয়েছে তা বের হলে শরীরের কোনও ক্ষতি হয় না। কিন্তু তুমি যে উপকার করলে তার জন্য টাকা দেওয়া নিয়ম। তুমি টাকাটা নিচ্ছ না কেন?

পদমকুমার মাথা নাড়ল, নেহি।

কেন?

আমি খুন বিক্রি করব না।

বিক্রি! তুমি ভাবছ কেন বিক্রি করছ?

এই খুন আমাকে আমার মা দিয়েছিল। এটা তো আমি তৈরি করিনি। যদি এর থেকে কিছু দিলে ওই ভাই বেঁচে যায় তা হলে আমার মা খুশি হবে।

তোমার মা কোথায় আছেন? বাড়িতে?

জি।

ডাক্তারের বুক নিঃশেষ করে বাতাস বেরিয়ে এল। তিনি বললেন, একটু দাঁড়াও। তিনি ফ্রিজের দরজা খুলে বোতলটা দেখলেন। তিনি যা চাইছেন প্রায় সেই চেহারা নিয়েছে বোতল। মুখের দিকটায় ঘন লালচে রক্তাংশ, ওপরের দিকে সাদাটে। বোতলটা নিয়ে এসে ডাক্তার বললেন, দ্যাখো পদমকুমার, তোমার শরীর থেকে নেওয়া রক্ত কী রকম দু ভাগ হয়ে গিয়েছে। এই বোতলের রক্ত ওর শরীরে দেওয়া হবে। তুমি লক্ষ রাখো। ডাক্তার বোতলটি স্ট্যান্ডে লাগিয়ে পাইপ ঠিকঠাক করে তার শেষ অংশ সায়নের হাতের বিশেষ শিরায় সুচের মাধ্যমে ঢুকিয়ে দিলেন। তারপর পদমকুমারকে কাছে ডেকে কাঁধে হাত রেখে সায়নকে বললেন, সায়ন, লুক অ্যাট হিম। ওর নাম পদমকুমার। ও তোমাকে ওর রক্ত দিয়েছে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করার জন্যে। কেন দিয়েছে জানো! তুমি ভাল হলে ওর মা খুশি হবেন। তাই, তুমি সুস্থ হলেই ওর মায়ের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে প্রণাম করে আসবে। বুঝলে।

সায়ন মাথা নাড়ল। তারপর যে হাতে নল নেই সেই হাত বাড়িয়ে দিল সে পদমকুমারের দিকে। পদমকুমার দু হাতে তার হাত জড়িয়ে ধরল, ডরো মত ভাই। যিতনা খুন লাগেগা হামলোগ দেগা। তুমকো জিনা পড়েগা।

কেন? সায়ন চোখ বড় করার চেষ্টা করল।

তুম বহুৎ আচ্ছা গানা গাতে হো।

সায়ন চোখ বন্ধ করল। পদমকুমার নেপালি। ওই ছেলেগুলোও নেপালি। তা হলে এরা আলাদা কথা বলছে কেন? পদমকুমার বলেছে যত রক্ত দরকার ওরা দেবে। ও তাকে ভাই বলেছে। আঃ। সায়ন জ্ঞান হারাল।

পদমকুমার মাথা নিচু করে নিরাময় থেকে বেরিয়ে এল। রক্ত দেওয়া নিয়ে অনেকে অনেক কথা তাকে বলেছে। এই নিরাময়ের সমস্ত পেশেন্ট বাঙালি। বাঙালি পেশেন্টের জান বাঁচাতে নেপালিরা রক্ত দেবে কেন? এই বাঙালি কারা? জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জাতভাই। ঠিক। কিন্তু মা বলে অন্য কথা। যে ছেলে তোর ভাইকে অত সুন্দর গান শেখায় সে বাঙালি না নেপালি তা নিয়ে মাথা ঘামাবি না। ও মা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি–একথা যে বলে সে তার ভাই। মায়ের কথা মেনে নিয়েছে পদমকুমার। এখন তার মন প্রফুল্ল। মনে হচ্ছিল জীবনে এই প্রথমবার সে কোনও ভাল কাজ করে ঘরে ফিরছে।

যিশু কা বড়াই।

পদমকুমার চমকে তাকাল। অন্ধকার হয়ে গেছে চারপাশ। কিন্তু সামনের বাড়ির বারান্দায় আলো জ্বলছে। তার দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন মিস্টার ব্রাউন। হেসে আবার বললেন, যিশু কা বড়াই। কোত্থেকে আসছ?

পদমকুমার বলল, নিরাময় থেকে।

কেন?

ওখানে একজন খুব অসুস্থ। রক্ত বের হচ্ছে। তাকে রক্ত দিতে হয়েছে। আমার রক্তের সঙ্গে তার রক্তের মিল থাকায় আমি গিয়েছিলাম।

কে? কী নাম তার?

সায়ন।

কী বললে! ব্রাউন চমকে উঠলেন, আবার বলো।

সায়ন। বড়বাহাদুর তাই বলল। আমার ভাইও তাই বলেছে।

ব্রাউন আর দাঁড়ালেন না। তাঁর বাড়ির দরজা খোলা রইল। কুকুরটা দু পা এগিয়ে আবার পেছনে ফিরে গেল।

পদমকুমার জিজ্ঞাসা করল, দাজু, কোথায় যাচ্ছেন?

নিরাময়ে। তুমি যাকে রক্ত দিয়ে এলে সে সাধারণ ছেলে নয়।

তার মানে!

সে ঈশ্বরের অংশ। তুমি না জেনে আজ যে কাজটা করে এলে তার জন্যে মানুষ চিরকাল তোমাকে মনে রাখবে। যিশু তোমার মঙ্গল করবেন। কিন্তু প্রার্থনা করো ওই ছেলেটা যেন আজ রাত্রে ভাল হয়ে যায়।

ব্রাউন নিরাময়ের সামনে এসে দাঁড়ালেন। নিরাময় নিঃশব্দ। তিনি আকাশের দিকে তাকালেন। একটিও তারা নেই। কোনও আলো নেই আকাশে। এখন বেশ ঠাণ্ডা চারপাশে। তাড়াহুড়োয় তিনি মাথার টুপি এবং মাফলার নিয়ে আসতে পারেননি। কিন্তু এখন তার শীতবোধ ছিল না। পূর্ব দিকে মুখ করে নিরাময়ের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি স্থির হয়ে প্রার্থনা করছিলেন। যিশু, আমি বিশ্বাস করি তুমি আমাদের সঙ্গে আছ। তোমার ইচ্ছায় প্রকৃতি চেহারা পাল্টায়, মানুষের জীবনলীলা সংঘটিত হয়। তা হলে ওই ছেলেটি এত কষ্ট পাবে কেন? কেন সে নীরোগ জীবনের অধিকার পাবে না? এই নিরাময়ের নামকরণ মিথ্যে করতে নিশ্চয়ই তুমি উদ্যোগ নেবে না। তুমি আলো না দেখালে যখন পৃথিবী অন্ধকার তখন আমি তোমার কাছে প্রার্থনা করছি, দয়া করো। দয়া করে ওকে সুস্থ করে তোলে।

মিনিট পাঁচেক প্রার্থনার পর মন যখন সামান্য হালকা হল তখন গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। গেট বন্ধ হয়ে গেছে কিন্তু তালা পড়েনি। তাঁকে দেখে বড়বাহাদুর এগিয়ে এল, নমস্তে। সাহেবের সঙ্গে দেখা করবেন?

হ্যাঁ।

কিন্তু সাহেব এখন পেশেন্টের সামনে থেকে উঠে আসবেন না।

আমি জানি। আমি বাইরে অপেক্ষা করব।

বড়বাহাদুর গেট খুলে দিলে ব্রাউন ধীরে ধীরে প্যাসেজ দিয়ে হেঁটে এলেন। বড়বাহাদুর তাঁকে দেখিয়ে দিল কোন ঘরে ডাক্তার রয়েছেন। দরজা বন্ধ কিন্তু একটুও কাউকে বিব্রত না করে ব্রাউন ঘরের বাইরে রাখা বেঞ্চিতে বসলেন। এখন মাথার ওপর ছাদ, তিনদিক ঢাকা বলে শীত কম লাগছিল। ব্রাউন চোখ বন্ধ করলেন। অবিকল সেই নাক, সেই চোখ। ভোরের আকাশ সুন্দর করে যে আলো এসে থেমেছিল এই নিরাময়ের ওপর তা কি তার স্বপ্ন ছিল! শুধু স্বপ্ন! বন্ধ চোখের পাতায় এখন যিশুখ্রিস্ট তাঁর যাবতীয় সৌম্য-লাবণ্য নিয়ে উপস্থিত। যে চাহনিতে শুধু ভালবাসা মেশানো ক্ষমার উদারতা, যে ঠোঁটের কোণে প্রশ্রয়ের মৃদু ইঙ্গিত সেই যিশুখ্রিস্টকে মহানন্দে দেখতে লাগলেন ব্রাউন। এ দেখা, এই দেখতে পাওয়া তাঁকে এক অনির্বচনীয় সুখের উদ্যানে নিয়ে যায়। তিনি বাস্তব ভুলে যান, নিজের অস্তিত্বের কথাও মনে থাকে না।

কী ব্যাপার, মিস্টার ব্রাউন। এই অসময়ে। কারও কি শরীর খারাপ? ডাক্তার খুব কাছে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেও ব্রাউনের মনে হল তিনি অস্পষ্ট শুনছেন। চোখের সামনে যে ছবি এতক্ষণে নির্মিত হয়েছিল তা ভেঙেচুরে উধাও। ব্রাউনের খুব কষ্ট হচ্ছিল। ডাক্তার আবার ডাকলেন, মিস্টার ব্রাউন।

এবার পলকেই সব স্বচ্ছ। ব্রাউন বললেন, সরি, আমি–।

ঘুমিয়ে পড়েছিলেন?

নট অ্যাট অল। ছেলেটি কেমন আছে?

আপনি কি সায়নের কথা জিজ্ঞাসা করছেন?

হ্যাঁ। শুনলাম সে খুব অসুস্থ। রক্তপাত হচ্ছে? রক্ত দেওয়া হয়েছে।

হ্যাঁ। ঠিকই শুনেছেন।

কেমন আছে সে।

সম্ভবত ভাল। ঘুমোচ্ছে এখন।

ডাক্তারের মনে পড়ল, আচ্ছা, আপনি তো ভোরবেলায় এসে ওর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন, তাই না?

ইয়েস ডক্টর।

কেন?

সেভাবে কোনও কারণ আমি বলতে পারব না। কখনও কখনও কোনও মানুষ আমাকে টানে। এখন ও যেমন টানছে। ও সুস্থ হয়ে যাবে ডক্টর?

ও এমন একটা অসুখের শিকার যার বিরুদ্ধে লড়াই করে বলা যায় না যে, জিতবই। আমাদের সাধ্য খুব কম কিন্তু লড়াই থেকে সরে আসব না।

ওঃ, ডক্টর। আপনি কোনও ডেফিনিট প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন না!

দেওয়া যায় না মিস্টার ব্রাউন। আপনি জাহাজে ছিলেন, কাছাকাছি একটা উপমা দিলে হয়তো বুঝতে পারবেন। ধরুন বন্দর থেকে মাইল দশেক দূরে কোনও কিছুর সঙ্গে ধাক্কা লাগায় জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হল। যখন জানা গেল জাহাজ ডুবে যাবেই তখন ক্যাপ্টেন সব যাত্রীকে লাইফজ্যাকেট পরিয়ে নৌকায় নামিয়ে দেন। কিন্তু যখন ক্যাপ্টেন বোঝেন জাহাজ ডুববেই কিন্তু একটু সময় পাওয়া যেতে পারে তখন তিনি চেষ্টা করেন দ্রুত তীরের দিকে চলে আসতে। যদি তীরে পৌঁছোবার পর জাহাজ ডোবে তাতে তাঁর বিরাট সান্ত্বনা থাকে। লিউকোমিয়ার একটা ধরনের পেশেন্ট ওই জাহাজের মতো যার আর কোনও আশা নেই, আর এক ধরনের সঙ্গে তীরের দিকে ছুটে আসা জাহাজের মিল আছে। আমরা এখন দ্বিতীয়টায় রয়েছি।

বুঝতে পারছি। এতক্ষণ আপনি বিজ্ঞানের কথা বললেন। কিন্তু বিজ্ঞান যেখানে থেমে যায় সেখানে এক অদৃশ্য শক্তি থাকে, শুধু হৃদয় থাকলে অনুভব করা যায়। এই অদৃশ্য শক্তি যদি কৃপা করে তা হলে অসম্ভবও হ্যাঁ হয়ে যায়। ডক্টর, আমি একবার ছেলেটিকে দেখতে পারি? ব্রাউন তাকালেন।

নিশ্চয়ই। ভেতরে যান। তবে আপনি নিশ্চয়ই ওর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করবেন না।

ব্রাউন ম্লান হেসে মাথা নাড়লেন। তারপর এগিয়ে গিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে সেটাকে বন্ধ করলেন। সামনেই উঁচু খাটের ওপর সায়ন ঘুমোচ্ছ। এখন ওর হাতে কোনও নল লাগানো নেই। ব্রাউন ধীরে ধীরে সায়নের সামনে এস দাঁড়ালেন। ঘুমের মধ্যে ওর ঠোঁট কেপে উঠল। সেই নাক, সেই ঠোঁট। কিন্তু নাকের নীচে ও কী! কীসের দাগ। ব্রাউন ঝুঁকলেন এবং বুঝতে পারলেন ইতিমধ্যে দু তিন ফোঁটা রক্ত শরীর থেকে বেরিয়ে এসে নাকের তলায় জমা হয়েছে, গাঢ় হয়েছে এবং শক্ত হতে চলেছে। তাঁর শরীরে পেরেক পোঁতা হয়েছিল। অঝোর ধারায় রক্ত ঝরেছিল। এক সময় তিনি নীরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। এই ছেলেটার গালের মতো সাদা। নাকি তার মতো এই ছেলেটির গাল। ব্রাউন ভাবলেন ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে এসে রক্তচিহ্ন দেখাবেন। কিন্তু সেই সময় সায়নের ঠোঁটে অপূর্ব এক হাসি চমকে উঠল। উঠেই স্থির হয়ে রইল। এই দৃশ্যটি দেখে ব্রাউন আর নড়লেন না। সামনের টুল টেনে বসে চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করতে লাগলেন। এখন তিনি প্রার্থনার ব্যাপারে সুশৃঙ্খল হতে চাইলেন। বাইবেলের যেসব লাইন তাঁর মনে আছে ব্রাউন সেগুলো আবৃত্তি করতে লাগলেন। দেখা গেল যা মনে ছিল অথচ মনে নেই বলে মনে হয়েছিল সেগুলোও চমৎকার উঠে আসছে। বাইবেল শেষ হয়ে গেলে তিনি নিজের মত করে প্রার্থনা করতে লাগলেন।

ডাক্তার নিঃশব্দে ঘরে এসে দৃশ্যটা দেখলেন। সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি তরুণের জন্যে বৃদ্ধ খ্রিষ্টান নেপালি ভদ্রলোক এরকম প্রার্থনা যে করতে পারেন তা তাঁর কল্পনাতেও ছিল না। তাঁর মনে হল এবার মিস্টার ব্রাউনকে বিশ্রাম করতে বলা উচিত। তিনি এগিয়ে গিয়ে ব্রাউনের কাঁধে আলতো হাত রাখতেই প্রার্থনা থেমে গেল। ব্রাউন চোখ খুললেন, ইয়েস ডক্টর।

এবার আপনি বাড়ি যান। বিশ্রাম করুন।

আমি এখানে থাকি আপনি চাইছেন না?

নট অ্যাট অল। আপনি অনেকক্ষণ প্রার্থনা করেছেন। এবার আপনার বিশ্রামের প্রয়োজন। বড়বাহাদুরকে বলছি আপনাকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে।

আপনি আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন ডক্টর!

কী বলছেন! আমি আপনার স্বাস্থ্যের কথা ভেবে বললাম।

অনেক ধন্যবাদ। আমি বেশ ভাল আছি। ব্রাউন হাসলেন, ডক্টর ওর নাকের নীচ থেকে রক্ত মুছিয়ে দেওয়া দরকার।

ডাক্তার দ্রুত এগিয়ে এলেন। সাবধানি আঙুলে তুলে নিয়ে রক্ত পরিষ্কার করলেন তিনি। তারপর কানের দিকে চোখ নিয়ে গেলেন। না, সেখানে রক্তপাত হয়নি। হাত পরিষ্কার করে এসে ডাক্তার বলেন, ঠিক আছে, আপনার যতক্ষণ ইচ্ছে এখানে থাকুন। আপনার জন্যে একটা ইজিচেয়ারের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। যখন মনে হবে ফিরে যাবেন তখন বড়বাহাদুরকে ডেকে বলবেন।

ধন্যবাদ। ডক্টর আর ওকে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হবে না?

মনে হচ্ছে আজ রাত্রে হবে না।

যিশু আমার প্রার্থনা শুনেছেন।

এখন তো ও ভাল আছে। আসুন বাইরে বসে একটু কফি খাওয়া যাক।

ধন্যবাদ ডক্টর। আমি এখানেই থাকতে চাই।

ইজিচেয়ার এল। ডাক্তার চলে গেলে আরাম করে বসলেন ব্রাউন। হঠাৎ মনে হল তার আচরণ আদৌ স্বাভাবিক নয়। এই ছেলেটি নিরাময়ে এসেছে নিশ্চয়ই বেশ কয়েক মাস। তাঁর বাড়ি থেকে নিরাময় আদৌ দূরে নয়। অথচ এতদিন তিনি ওকে লক্ষ করেননি। হঠাৎ আলাপ, একটু ভাল লাগা আর তারপর এই স্বপ্ন দেখা, এক লহমায় তাঁর দেখার চোখ পাল্টে দিল! মাথা নাড়লেন ব্রাউন। যখন হয় তখন কি এভাবেই হয়? সারাজীবন যে যিশুকে ডাকল না হঠাৎ একটি সাধারণ ঘটনা তাকে এমন পাল্টে দিল যে সে চার্চের কাজে মনপ্রাণ দিয়ে দিল।

ব্রাউন যেখানে বসেছিলেন সেখান থেকে সায়নের শরীরের একটা পাশ দেখা যাচ্ছে, মুখ চোখ নয়। অতএব তিনি উঠলেন। গলা পর্যন্ত কম্বল টানা রয়েছে। ঘুমোচ্ছ ছেলেটা। ব্রাউন বললেন ফিসফিস করে, তুমি ভাল হয়ে যাবে মাই বয়। যিশু তোমার সঙ্গে আছেন। এত নিচুস্বরে কথাগুলো বললেন যে নিজের কানেই ভাল করে শুনতে পেলেন না। ঠিক তখনই ধীরে ধীরে চোখ মেল সায়ন। ব্রাউনের মনে হল, যেই তিনি বললেন আলো জ্বলুক সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠল আলো।

সায়ন মুখ ফেরাল। তার মুখে ধীরে ধীরে হাসি ফুটল, মিস্টার ব্রাউন!

ইয়েস মাই বয়। কথা বোলো না।

আপনি ভাল আছেন মিস্টার ব্রাউন?

চমকে উঠলেন ব্রাউন। এ কীরকম প্রশ্ন? যে মানুষের জীবনীশক্তি একটু একটু করে কমে আসার কথা সে অন্যের কুশল জিজ্ঞাসা করছে। ব্রাউন মাথা নাড়লেন, ইয়েস মাই বয়, আমি ভাল আছি। তোমার এখন ঘুমোনো উচিত।

আমি তো ঘুমোচ্ছি, এখন কটা বাজে?

রাত হয়েছে।

আপনি কেন এখনও জেগে আছেন? চোখ বন্ধ করল সায়ন।

আপনি কেন জেগে আছেন। আমি কেন জেগে আছি? আপন মনে প্রশ্নটি উচ্চারণ করলেন তিনি। সায়ন আবার ঘুমিয়ে পড়ল। হঠাৎ কী হল, ব্রাউন নিজেকে সামলাতে পারলেন না। গলা থেকে রুপোর চেনে লাগানো ক্রশটা খুলে অতি সন্তর্পণে সায়নের মাথায় ছুঁইয়ে দিয়ে বুকের ওপর রেখে দিলেন। এখন মাথা গলিয়ে পরাতে গেলে ছেলেটার ঘুম ভেঙে যাবে।

হঠাৎ তার মনে হল, আর কোনও ভয় নেই। দীর্ঘকাল পরে সন্তান বাড়ি ফিরে এলে যেমন তার সম্পর্কে সব ভাবনা দূর হয়ে যায় তেমনি ওই হার সায়নের গলায় পরিয়ে দিয়ে অদ্ভুত রকমের নিশ্চিন্ত হয়ে গেলেন তিনি। যেন আর কোনও সমস্যা নেই। ব্রাউন হেলতে দুলতে বেরুতেই বড়বাহাদুর তাকে সেলাম করল। ব্রাউন তার হাত ধরে বললেন, যিশু তোমার মঙ্গল করবেন।

কথাটা ব্রাউন খুব বলেন কিন্তু এই মুহূর্তে বড়বাহাদুর ওটা আশা করেনি। সে কিছু বলার আগেই ঠাণ্ডায় একটা সোয়েটার পরা ব্রাউন প্যাসেজ পেরিয়ে গেট খুলে রাস্তায় নামতেই অন্ধকারে কুঁই কুঁই শব্দ শুনতে পেলেন। ব্রাউন দাঁড়িয়ে পড়লেন, ভুটো! ভুটো নাকি? সঙ্গে সঙ্গে গায়ে রোমশ স্পর্শ পেয়ে তিনি হেসে ফেললেন। কুকুরটা এবার সামনে হাঁটছে বুঝতে পেরে বললেন, তুই আমাকে জব্দ করলি ভুটো, কী করে ভালবাসতে হয়, ভালাবাসা কাকে বলে তা তুই আমাকে শিখিয়ে দিলি। মনে হয়, যিশু তোকে আমার চেয়ে বেশি পছন্দ করেন।

.

পাহাড়ে উত্তাপ ছড়াচ্ছিল।

ঘিসিং সাহেব কলকাতায় গিয়েছিলেন। বামফ্রন্ট সরকারের সঙ্গে তাঁর আলোচনায় কোনও ফল পাওয়া গেল না। ঘিসিং স্পষ্ট ঘোষণা করলেন, তিনি দিল্লির সঙ্গে সরাসরি কথা বলবেন। এই ইস্যু নিয়ে পাহাড় উত্তাল। আচমকা ধর্মঘট ডাকা হল। সমতলের কোনও গাড়ি ওপরে উঠবে না, ওপর থেকে নামবে না। মিছিল বেরিয়ে পড়ল পাহাড়ি পথগুলোতে। আজ সকালে সেইরকম মিছিল উঠে আসছিল নিরাময়ের সামনে দিয়ে। গোটা ষাটেক মানুষ জ্যোতিবাবুর মুণ্ডপাত করতে করতে হাত ছুড়ছিল আকাশে।

সকালে সায়নকে তার ঘরে চলে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন ডক্টর। এখন দু-তিন দিন তার বাইরে যাওয়া চলবে না। ঘরের মধ্যেই হাঁটাচলা করতে পারবে। মিছিলের চিৎকার শুনে সে জানলার কাছে গেল। এখন জানলাও খোলা যাবে না। চট করে ঠাণ্ডা লেগে যাবে। সে দেখতে পেল প্রতিটি মানুষ দৃঢ় গলায় প্রতিবাদ জানাচ্ছে। বাঙালি শোষক দূর হটো। চোখ কপালে উঠল সায়নের। বাঙালি যে শোষক শ্রেণীর মধ্যে পড়ে তা আজকের আগে তার জানা ছিল না।

মিছিলটা চলে যাওয়ার পর সে চিঠি লিখতে বসল। প্রথম চিঠি মাকে। তোমার চিঠি গতকাল পেয়ে গেছি। পেয়ে গেছি লিখলাম এই কারণে যে এই চিঠির জন্যে হা-পিত্যেশ করে বসে থাকি। আমার জন্যে তুমি একটুও চিন্তা করবে না। আমি খুব তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে উঠছি। গতকাল একটু রক্ত পড়েছিল কিন্তু খুব দ্রুত ঠিক হয়ে গেছে। কাল খুব মজা হয়েছে। কেউ একজন আমার গলায় ক্রশ লাগানো রুপোর চেন পরিয়ে দিয়েছেন। আমার মনে হচ্ছে মিস্টার ব্রাউন এসেছিলেন। তিনি আমাকে খুব ভালবাসেন। আমি তোমাকে ভালবাসি বলেই কি সবাই আমায় ভালবাসে? আমি একটু ভাল হলেই তোমার কাছে চলে যাব। অবশ্য তার আগে তুমি যদি আমার কাছে আসো তা হলে দুজনে মিলে কুয়াশা, কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখব, পাহাড়ি পথে হাঁটব? আসবে মা? বাপিকে আমার ভালবাসা দিও। আর তুমি? তুমি আমাকে নাও। সায়ন।

হঠাৎ সমস্ত শরীর থরথরিয়ে কেঁপে উঠল। পা থেকে মাথা পর্যন্ত একটা আবেগের ঢেউ পাক খাওয়া শুরু করতেই সায়ন সোজা হয়ে দাঁড়াল। না। কিছুতেই না। ডাক্তার আঙ্কল বারংবার বলেছেন, এক ফোঁটা চোখের জল ফেলবে না। সে আবার চেয়ারে বসে চিঠির শেষে লিখল, পুনশ্চ। মা গো, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব? আমার রুমমেট নির্মাল্যকে ওর বাবা ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন চিকিৎসার খরচ চালাতে পারবেন না বলে। তোমাদের এমনই কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?

এটুকু নতুন করে লিখে সায়ন আবিষ্কার করল সেই আবেগটা আর শরীরে নেই। চিঠিটা ভাঁজ করে খামে পুরল সে। এই খাম মা তাকে কিনে দিয়েছিলেন। হঠাৎ তার চোখের সামনে পুরো রায় বাড়িটা ভেসে উঠল। ওই বিশাল বাড়ির এর সঙ্গে ওর তেমন কোনও সুসম্পর্ক নেই। কিন্তু খুব ছেলেবেলা থেকে সায়ন সবার অন্দরে চলে যেত। হঠাৎ টুপুরের মুখ ধরা পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে সে কাগজ নিয়ে লিখতে বসল।

দুষ্টু টুপুর। না, হল না, মিষ্টি টুপুর। ধ্যাত তার চেয়ে বলি স্নেহের টুপুর। দ্যাখ না, এবার আমাকে তোর গুরুজন বলে মনে হচ্ছে কি না। এখানে আসার পর তোকে কোনও চিঠি দিইনি। আসার আগে তোকে বলেছিলাম অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বুড়ো আংলা, ক্ষীরের পুতুল পড়ে ফেলবি। লীলা মজুমদারের পদি পিসির বর্মি বাক্স, সুকুমার রায়ের বইটা যেন মুখস্থ হয়ে যায়। নিশ্চয়ই কিস্যু করিসনি। তবে যখের ধন হাতে পেলে না শেষ করে ছাড়বি না, তা জানি। যদি ওই বইগুলো পড়া হয়ে থাকে তা হলে তোকে, দুটো বই পড়ার অনুমতি দিচ্ছি। একটা হল বিভূতিভূষণের চাঁদের পাহাড় অন্যটা নীহাররঞ্জন গুপ্তের কালো ভ্রমর। প্রথমটা বুঝবি বলে মনে হয় না। আর দ্বিতীয়টা যদি কোনও মতে বুঝে ফেলিস তা হলে মুখপুড়ি পথের পাঁচালি পড়িস। আম আঁটির ভেঁপু নয়।

আমি যেখানে আছি তার সামনে সারাদিন কুয়াশা খেলা করে। এখানে কখনও গরম পড়ে না, ঘাম হয় না। দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘা স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হ্যাঁ রে টুপুর, তুই বড় হয়ে কী হবি জিজ্ঞাসা করাতে একদিন বলেছিলি মানুষ হবি। রায়বাড়িতে যারা মেয়ে হয়ে জন্মায় তারা তো মেয়েমানুষ হয়ে মরে যায়। তোর উত্তর শুনে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। খোঁজ নিয়ে দ্যাখ, আমাদের বাড়ির অত জ্ঞাতিগুষ্টির মধ্যে কোনও মেয়ে গ্রাজুয়েট নয়। যে সব বউ এসেছে অন্য বাড়ি থেকে তারাও কলেজে ঢোকেনি। তবু হেনা কাকিমাকে আমার খুব ভাল লাগে, ঊর্মিলা কাকিমাকেও। তুই যদি সত্যি মানুষ হতে চাস তা হলে এদের সঙ্গে মিশিস। রায়বাড়ির প্রথম গ্রাজুয়েট মেয়ে শুধু নয়, প্রথম মেয়ে যে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজের জীবন নিয়ন্ত্রণ করছে এমন ভূমিকায় তোকে দেখতে চাই আমি। আর ধর, আমার যে অসুখ হয়েছে, তা যদি বাড়াবাড়ি রকমের খারাপ হয়ে যায় তা হলে তো আমি তুই কী করলি তা দেখার জন্যে থাকব না, তখন নিজের কাছে কৈফিয়ত দিস, কী করলি? তুই যদি এখানে আসতিস তা হলে বেশ মজা হত। আসতে না পারিস চিঠি লিখতে তো পারিস। খাম যদি না পাস আমার মায়ের কাছে চিঠি লিখে পৌঁছে দিস, আমি পেয়ে যাব। স্নেহ ভালবাসা তোর জন্যেই, সানুদাদা।

.

মিছিলটা উঠে আসছিল স্লোগান দিতে দিতে। সেই সঙ্গে ভুটোর চিৎকার চড়ছে সমানে। ব্রাউন তাকে বকলেন খুব। ভুটো থামতে তিনি দরজায় গিয়ে দাঁড়ালেন। পাহাড় পাহাড়িদের জন্য। সমতলের মানুষ দুর হটো। জ্যোতিবাবু মুর্দাবাদ। গোর্খাল্যান্ড হবেই হবে।

এদের অনেককেই ব্রাউন চেনেন না। নিশ্চয়ই বাইরে থেকে এসেছে। হঠাৎ তাঁর চোখ ছোট হল, পদমকুমার না! আকাশের দিকে মুঠো ছুঁড়ে রাগত ভঙ্গিতে স্লোগান দিচ্ছে। পদমকুমার যখন সামনে এল তখন ইশারায় কাছে ডাকলেন ব্রাউন। মুখচোখে বিরক্তি ফুটে উঠলেও ছেলেটা সরে এল মিছিল থেকে। শেষ লোকটি ওপরে চলে যাওয়ার পর ব্রাউন জিজ্ঞাসা করলেন, কাল রক্ত দিয়ে আজ এত হাঁটাহাঁটি করছ কেন?

পদমকুমার বেশ গর্বিত ভঙ্গিতে জবাব দিল, ওই রক্ত শরীর থেকে বের হলে কোনও অসুবিধে হয় না। আমি ভাল আছি।

তুমি রাজনীতি কর?

না তো। পার্টির একজন বলেহে মিছিল-টিছিল করলে ড্রাইভিং লাইসেন্স বের করে দিতে পারে। পদমকুমার হাসল, আর এসব কথা তো ঠিক।

কী সব কথা?

পাহাড় পাহাড়িদের জন্যে। বাজারে যাও, বেশির ভাগ দোকানদার মাড়োয়ারি, বাঙালিও আছে। এখান থেকে টাকা কামিয়ে দেশে পাঠাচ্ছে। ঠিক কি না।

ব্রাউন বললেন, ঠিক। কিন্তু দোকানদারগুলো যদি না থাকত তা হলে আমরা জিনিসপত্র পেতাম কী করে? নেপালিদের মধ্যে কেউ তো ওইরকম দোকান করতে এগিয়ে আসেনি। ঠিক কি না?

কেউ না কেউ তখন দোকান দিত। আমাদের মধ্যে অনেকের তো টাকা আছে।

টাকা থাকা এক কথা আর ব্যবসা করা অন্য কথা।

পদমকুমারের এ সব কথা ভাল লাগছিল না। সে বললেন, আচ্ছা, আমি যাচ্ছি।

ব্রাউন বলল, তুমি তোমার রক্ত দিয়ে কাল একটা জীবন বাঁচিয়েছ বলে আমি তোমার জন্যে যিশুর কাছে প্রার্থনা করেছি। তিনি নিশ্চয়ই তোমার আশা পূর্ণ করবেন।

হঠাৎ যেন মনে পড়ে গেল, অথবা ব্রাউনের কথায় একটু নাড়া খেল পদমকুমার। জিজ্ঞাসা করল, ওই ছেলেটা এখন কী রকম আছে?

কাল মাঝরাতে দেখে এসেছি ও ভাল হয়ে উঠছে। ব্রাউন বললেন আচ্ছা, ও তো পাহাড়ি নয়। তা হলে এই জায়গা থেকে ওর চলে যাওয়া উচিত, তাই না?

পদমকুমার ব্রাউনের মুখের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল।

ব্রাউন বললেন, আবার তোমার রক্ত ওর শরীরে যাওয়ার পর ওকে পাহাড়ি নয় বলে ভাবতেও পারছি না। আমার সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে যে। রাত্রে যাকে রক্ত দিয়ে বাঁচালে দিনের বেলায় তাকেই তাড়িয়ে দিতে চাইছ। ব্রাউন তাঁর বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলেন। পদমকুমার কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নিজের ভূমিকা নিয়ে এবার যেন সে দ্বিধায় পড়েছে। এই সময় নীচ থেকে সশব্দে একটা মোটরবাইক উঠে এল ওপরে। পদমকুমারকে দেখে আরোহী ব্রেক কষে জিজ্ঞাসা করল, মিছিল কতক্ষণ আগে ওপরে গিয়েছে?

এই তো একটু আগে।

তুমি মিছিলে যাওনি কেন?

যাচ্ছিলাম।

পেছনে উঠে বসো। কী নাম তোমার?

পদমকুমার।

বাইক চালু করে আরোহী জিজ্ঞাসা করল, তুমি এখানে থাকো?

জি।

ওখানে ওই যে নার্সিংহোম আছে, ওখানকার একটা ছেলে বাঙালিদের গান শিখিয়ে আমাদের বাচ্চাদের ব্রেন ওয়াশ করতে চাইছে। ছেলেটাকে জানো?

জি।

বাঃ, ভাল হল। ওকে এখান থেকে চলে যেতে হবে।

কেন?

কেন মানে? আমি কী বললাম তুমি বুঝতে পারছ না?

কিন্তু ও খুব অসুস্থ।

অসুস্থ তো গান শেখাচ্ছে কী করে?

কাল রাত্রে ওর প্রাণ বাঁচাতে রক্ত দিতে হয়েছে।

তোমাকে কে বলল?

আমিই তো আমার রক্ত ওকে দিয়েছি।

আচমকা ব্রেক কষল আরোহী। তারপর গম্ভীর গলায় বলল, নেমে যাও।

পদমকুমার খুব ঘাবড়ে গিয়ে মাটিতে পা রাখতেই বাইকটা ওপরে উঠে গেল। এবার ওর মনে হল, কথাটা বলে সে খুব ভুল করেছে। এই লোকটা নিশ্চয়ই পার্টির ওপর তলার কেউ হবে। এ যদি আপত্তি করে তাহলে কখনওই তার ড্রাইভিং লাইসেল বের হবে না। পদমকুমার দৌড়োতে লাগল। যেমন করেই হোক মিছিলের প্রথমে গিয়ে তাকে স্লোগান দিতে হবে। তাকে স্লোগান দিতে দেখলে হয়তো লোকটা একটু নরম হতে পারে।

.

নিরাময়ে এখন যে কজন চিকিৎসার জন্য এসেছে তাদের অবস্থা মোটামুটি ভাল। আর একটু ভাল হলেই এদের ইচ্ছে হয় বাড়ি ফিরে যেতে। সেই অবস্থায় বেশ অসহায় বোধ করেন ডাক্তার। আজ রাউন্ডে বের হয়ে প্রতিটি ঘরে ঢুকে গল্প করার সময় তিনি সায়নের ঘটনাটা বলবেন। যে ছেলেটা কাল বিকেলেও স্বাভাবিক ছিল রাত্রে তার শরীরের অবস্থা আচমকা কী রকম বদলে গিয়েছিল। ওই পরিস্থিতিতে বাড়িতে থাকলে হয়তো চরম বিপদ হয়ে যেতে পারত। একটি কিশোর, যে খুব ভাল গান যায়, জিজ্ঞাসা করল, তাহলে আমাদের সারাজীবন এখানেই থাকতে হবে?

এই প্রশ্নেব কোনও জবাব ডাক্তারের জানা নেই। যতদিন সম্ভব অসুখের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে জীবনটাকে বঁচিয়ে রাখা যায় ততদিনই লাভ, অবস্থাটা যখন এই পর্যায়ে আছে তখন কোনও ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব নয়।

তবু ডাক্তার বললেন, না, সারাজীবন থাকতে হবে কেন? তোমাদের মধ্যে যাদের অবস্থা ভাল তারা মাঝে মাঝে এক-দু মাসের জন্যে বাড়ি ঘুরে আসতে পার।

ছেলেটি বলল, এক-দু মাস? চিরদিন নয়?

প্রথমে এক-দু মাস থেকে দ্যাখো, তারপর ধীরে ধীরে সময়টা বাড়ানো যাবে। ডাক্তার নিজেও জানেন ওগুলো কথার কথা। তাঁর চোখের সামনে নিয়ম মেনে থাকলে তিনি রোগটাকে মাথা তুলতে দেবেন না। কিন্তু তাঁকে ভীষণ রকম দুশ্চিন্তায় ফেলেছে সায়ন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ঘুষ খেয়ে ধরা পড়েছেন বলে ওর আবার রক্তপাত হল! মনের ওপর চাপ পড়লে শরীরে প্রতিক্রিয়া হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু ব্যক্তিগত কোনও কারণ নয়, দেশের একটি ঘটনা ওকে যদি এভাবে নাড়া দেয় তাহলে দিনদিন সমস্যা বেড়ে যাবে।

ডাক্তার সায়নের ঘরে এলেন, কেমন আছ?

ভাল। সায়ন হাসল। তারপর চিঠিগুলো এগিয়ে দিল, পোস্ট করতে হবে।

মাকে লিখলে?

হ্যাঁ।

ডাক্তাব ভেবেছিলেন সায়নের সঙ্গে কথা বলবেন ওর গতকালের অসুস্থতা নিয়ে। কিন্তু এখন মত পাল্টালেন। ঠিক তখনই বাইরে মোটরবাইকের আওয়াজ হল। বাইকটা এসে থামল নিরাময়ের গেটে।

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার