ব্রাউন এবং ফাদার দুর্ঘটনা দেখার ধাক্কা কাটিয়ে যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেলেন গাড়িটার কাছে। চিৎকার এবং গোঙানি ভেসে আসছে কাত হয়ে থাকা গাড়ির ভেতর থেকে। যেহেতু গাড়িটা মারুতি তাই ওঁরা টেনে হিঁচড়ে সেটাকে সোজা করতে পারলেন। ড্রাইভার অজ্ঞান হয়ে গেল, প্রচুর রক্ত বের হচ্ছে তার শরীর থেকে। পেছনে বসা মেয়েটি সিটের ওপর শরীর এলিয়ে দিয়ে উঃ আঃ করে যাচ্ছে। তারও মাথা থেকে রক্ত বের হচ্ছে। চেষ্টা করেও ওঁরা দুজন দরজা খুলতে পারলেন না। ধাক্কা লাগায় গাড়িটার শরীর এমনভাবে তুবড়ে গেছে যে দরজা খোলা যাচ্ছে না। এই সময় বড়বাহাদুর ছুটে এল। পাথর তুলে কাঁচ ভেঙে ভেতর থেকে চাপ দিয়ে কোনওরকমে ওপাশের দরজা খুলে ফেলল সে। ফাদার বললেন, এদের এখনই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার। বড়বাহাদূরের চিৎকার কানে যেতে নিরাময় থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন ডাক্তারবাবু। ব্যাপারটা বুঝেই তিনি ভেতরে চলে গেলেন। আহতদের বাইরে নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার গাড়ি নিয়ে চলে এলেন পাশে। ফাদার বললেন, অনেক ধন্যবাদ ডাক্তার। ড্রাইভার একটু বেশি রকমের আহত হয়েছে, ওদের হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে আসি চলুন।

দুজনকে গাড়ির পেছনের আসনে তোলা হলে ব্রাউন বললেন, ফাদার, আপনি খুবই ক্লান্ত, আপনার বিশ্রামের প্রয়োজন, আমি যাচ্ছি ওদের সঙ্গে।

ফাদার হাসলেন, না না। এই কাজটা অনেক বেশি জরুরি। আপনি বরং এদের বাড়িতে খবরটা পৌঁছে দিন।

গাড়িটা আর দাঁড়াল না। এবং তখন ব্রাউনের খেয়াল হল ড্রাইভারকে তিনি চেনেন না। এই অঞ্চলের গাড়িও নয়। তিনি বড়বাহাদুরকে জিজ্ঞাসা করলেন, এদের তুমি চিনতে পেরেছ?

বড়বাহাদুর মাথা নাড়ল, মনে হচ্ছে দার্জিলিং-এর গাড়ি। মাঝে মাঝে এই রাস্তা দিয়ে ওপরে উঠে যায় বিকেলবেলায়। যখন যায় তখন খালি থাকে। ফেরার সময় ওই মেয়েটাকে পেছনে বসে থাকতে দেখেছি।

কোথায় যায়? কোন বাড়িতে?

কোঅপারেটিভ দোকানের পাশ দিয়ে যে রাস্তা পাহাড়চূড়ায় চলে গিয়েছে সেখানে মনে হয় ভাড়া থাকে ওরা। বেশি দিন আসেনি। প্রধানের বাড়ি।

ব্রাউন মনে করতে পারলেন। নিমা প্রধান এককালে গাড়ি চালাত। সেটা করতে করতে ট্যাক্সির মালিক হল। শিলিগুড়ি দার্জিলিং রুটে সিজনে প্রচুর পয়সা। তা থেকে আরও ট্যাক্সি। এখন বাস আর লরির মালিক হয়েছে। টমসনবুড়ির বাড়িটা কিনে নিয়ে নতুন করে সাজিয়েছিল থাকবে বলে। শেষ পর্যন্ত মত বদলে শিলিগুড়ির সেবক রোডে বাড়ি করে চলে গিয়েছে। মাস পাঁচেক হল ওই বাড়িতে ভাড়াটে এসেছে। ব্রাউন খবর পেয়েছিলেন ভাড়াটে পরিবার কারও সঙ্গে মেশে না। জিনিসপত্র এবং জীবনযাপনের ধরন দেখে বোঝা যায় টাকাপয়সা রয়েছে। ম্যাথুজের দোকানে যাতায়াতের পথে ওপাড়ার লোকজন এসব গল্প করে যায়। ভাসা ভাসা কানে আসে ব্রাউনের।

পরিবারটি ক্রিশ্চান হওয়া সত্ত্বেও চার্চে যায় না বলে অনেকের অনুযোগ আছে। ব্রাউন এসব নিয়ে মাথা ঘামাননি। যদি কেউ তার নিজের মতো বেঁচে থাকতে চায় তা হলে নাক গলানো অনুচিত।

ব্রাউন ওপরে ওঠার জন্যে হাঁটতে শুরু করতেই নিরাময়ের দরজায় সায়নকে দেখতে পেলেন। তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি চেঁচিয়ে বললেন, গুড মর্নিং, মাই বয়।

গুড মর্নিং। সায়ন একটা চাপা উত্তেজনা নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, অ্যাকসিডেন্টে কেউ মারা যায়নি তো! আমাকে ছোটবাহাদুর বলল–!

নো মাই বয়। কেউ মারা যায়নি। তবে একজন গুরুতর আহত হয়েছে। তোমার পড়াশুনো হয়ে গেল? ব্রাউন কথা বলতে বলতে গত রাতের স্বপ্নটার কথা ভাবছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তার নজর চলে গেল সায়নের চিবুকের দিকে। শিহরিত হলেন তিনি। এই বৃদ্ধ বয়সেও লোমকূপ ফুলে উঠল। শরীর ঝিম ঝিম করতে লাগল।

অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে শোনার পর আর পড়তে ইচ্ছে করছে না। কী করে হল?

গাড়ির অ্যাকসিডেন্ট দুটো কারণে হয়। যন্ত্রপাতি আচমকা খারাপ হয়ে গেলে অথবা ড্রাইভারের নিয়ম না মেনে চালানোর কারণে। এক্ষেত্রে দ্বিতীয়টাই কারণ। অত বিশ্রী জোরে গাড়িটা উঠে আসছিল। আচ্ছা, আমি চলি, ওদের বাড়ির লোক এখনও জানে না, খবরটা দিয়ে আসা দরকার।

ব্রাউন পা বাড়াতেই সায়ন এগিয়ে এল, আমি যদি আপনার সঙ্গে যাই তা হলে কি আপত্তি করবেন?

খুশি হলেন ব্রাউন, না-না। আমার আপত্তি থাকবে কেন? তবে ডাক্তার যেন মনে না করেন তুমি ডিসিপ্লিন ভেঙেছ।

মুখে কিছু না বলে একগাল হেসে মাথা নাড়ল সায়ন। তারপর দৌড়ে ভেতরে চলে গেল। ওর ছোটার ভঙ্গি দেখে আশ্বস্ত হলেন ব্রাউন। ছেলেটা নিশ্চয়ই সেরে উঠেছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বেরিয়ে এল সায়ন, বড়বাহাদুরকে বলে এলাম। কয়েক পা হেঁটে সে নিশ্বাস নিল শব্দ করে, আঃ! কী ভাল।

ব্রাউন আড়চোখে তাকালেন ছেলেটার দিকে। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, কাল রাত্রে তোমার ঘুম কী রকম হয়েছিল?

ঘুম? কাল আমি স্বপ্ন দেখছিলাম।

স্বপ্ন? কখন? ভোরের দিকে? ব্রাউন উত্তেজিত হলেন।

কখন বলতে পারব না, নির্মাল্যকে স্বপ্নে দেখলাম। ও খুব মন খারাপ করে বসে আছে। আমি অনেক ডাকলাম, সাড়া দিল না।

নির্মাল্য কে?

এখানে থাকত। আমরা খুব বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম। ওর বাবা ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন।

ও কি সুস্থ হয়ে ফিরে গেছে?

নাঃ।

একটু হতাশ হলেন ব্রাউন। নক্ষত্রের শবীর থেকে বেরিয়ে আসা আলোকখণ্ড যা নিরাময়ের ওপর নেমে এসেছিল তার স্বপ্নে তার সঙ্গে সায়নের দেখা স্বপ্নের কোনও মিল নেই।

ওপরে ওঠার সময় ব্রাউন খুব শ্লথ হয়ে যান। তাঁর বয়স হয়েছে। সামান্য ঝুঁকি বিপদ ডেকে আনতে পারে। তা ছাড়া সায়নের কথা মনে রাখতে হচ্ছে তাকে। বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলেন ভুটো তখনও একাই বসে আছে। তাঁকে দেখতে পেয়ে একবার ছোট্ট করে ডাকল। ডেকে ভেতরে চলে গেল।

সায়ন বলল, কুকুরটা সবসময় ছাড়া থাকে?

হ্যাঁ। ও কোথাও যায় না। গার্ল ফ্রেন্ড ওর কাছে আসে।

সায়ন হেসে ফেলে। কুকুরের গার্ল ফ্রেন্ড আছে ভাবলেই কী রকম লাগে। তারপরই মনে হল ইংরেজি শব্দটায় তো কোনও ভুল নেই। হাসির কী আছে।

ম্যাথুজের দোকান আজও বন্ধ। অতএব তার দোকানের পাশে নিচু পাঁচিলে কোনও আড্ডা জমেনি। ওপর থেকে দুজন বয়স্কা মহিলা নামছিলেন। তাদের একজন কপালে হাত ঠেকিয়ে বললেন, যিশু কা বড়াই।

সঙ্গে সঙ্গে ব্রাউন একই শব্দ উচ্চারণ করলেন।

দ্বিতীয় মহিলা বললেন, আপনার শরীর কেমন আছে?

ব্রাউন বললেন, একদম ঠিক আছি। এভাবে ঠিক থাকতে থাকতে যদি যিশু আমাকে টেনে নেন তা হলে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ থাকবে না।

মহিলা দুজন একসঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠলেন। ব্রাউন জিজ্ঞাসা করলেন, তা এই সাতসকালে সেজেগুজে কোথায় চললে তোমরা?

মহিলারা প্রতিবাদ করলেন একসঙ্গে। প্রথমজন বললেন, ওমা, কোথায় সেজেছি আমরা? একে কি সাজ বলে? তিনধারিয়া যাচ্ছি। ওখানকার স্কুলে শুনছি আয়া নেবে। দেখি চেষ্টা করে।

তিনধারিয়া? সেন্ট টমাস স্কুল?

হ্যাঁ।

ওখানকার প্রিন্সিপালকে আমার কথা বলবে। উনি আমাকে চেনেন।

উঃ, কী ভাল হল। মহিলারা খুশি হয়ে নেমে গেলেন।

ব্রাউনকে কয়েক পা যেতে না-যেতেই দাঁড়াতে হচ্ছে। ওপর থেকে যারা নামছে তারা তো বটেই, রাস্তার একপাশের বাড়িগুলোর বারান্দায় দাঁড়ানো কোনও না কোনও মানুষ আগ বাড়িয়ে কথা বলছে। সায়ন দেখল ব্রাউন এঁদের সব খবর রাখেন। এবং কথা বলার সময় এমন গলায় বলছেন যে তাকে ওদের ঘরের লোক বলে মনে হচ্ছে। এভাবে থেমে থেমে ওঠায় সায়নের ভাল লাগছিল।

কোঅপারেটিভ স্টোর্স তখনও খোলেনি। অনেকটা চড়াই ভেঙে ব্রাউন এখন একটু হাঁপাচ্ছিলেন। সায়ন তার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে লজ্জা পেলেন। ওর কাঁধে হাত রেখে বললেন, বয়স কাউকে রেহাই দেয় না। যে পথটা আমি একদমে স্বচ্ছন্দে উঠে আসতাম সেই পথ ধীরেসুস্থে এলেও শরীর ঠিক নিতে পারছে না এখন। আমার ইঞ্জিনের শক্তি কমে গিয়েছে বেশ বুঝতে পারছি। চলো।

একজনকে জিজ্ঞাসা করতেই সে বাড়িটা দেখিয়ে দিল। বাড়িটা ছিমছাম। একপাশে স্কোয়াশের ঝোপে স্কোয়াশ ঝুলছে, অন্য দিকে ফুলের বাগান। ব্রাউন এগিয়ে গিয়ে দরজার ফ্রেমে লাগানো বোতাম টিপলেন। সায়ন দেখল দুটো হনুমান স্কোয়াশের ঝোপ থেকে লাফিয়ে ওপাশে চলে গেল।

দরজা খুললেন একজন প্রৌঢ়া মহিলা। পোশাক এবং মুখচোখে বেশ সম্ভ্রান্ত ভাব।

ব্রাউন বললেন, আমি ব্রাউন। নীচে থাকি। আপনার নামটা–?

মিসেস ডিসুজা।

ওয়েল, মিসেস ডিসুজা, আপনার কোনও মেয়ে কি বাড়ির বাইরে গিয়েছে?

সেই খবরে আপনার কী প্রয়োজন? আমি চাই না কেউ আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে খোঁজখবরে আগ্রহী হয়। মিসেস ডিসুজা কঠিন মুখে বললেন।

আপনার আপত্তি থাকলে কারও আগ্রহ দেখানো উচিত নয়। কিন্তু আমি নিরুপায় হয়ে এসেছি। মেয়েটি ঠিক আপনারই এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। দু-একজন বলল সে এবাড়িতে থাকে তাই খবরটা দিতে আসতে হয়েছে।

এবার সন্দেহের চোখে তাকালেন ভদ্রমহিলা, কী ব্যাপার বলুন তো?

একটু আগে নীচের নিরাময় আরোগ্য নিকেতনের সামনে একটি লাল মারুতি অ্যাকসিডেন্ট করেছে। ড্রাইভারটির অবস্থা ভাল নয়। পেছনে যে মেয়েটি বসেছিল তার আঘাত বেশি নয়। আপনার মেয়ের কি মারুতি গাড়িতে আসার কথা ছিল?

এবার মহিলার চেহারা পাল্টে গেল। আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় আছে ওরা? আমার মেয়ে, মানে, ও গাড়িতে আসে কখনও ফিয়াট কখনও মারুতিতে। দাঁড়ান প্লিজ, আমি ফোন করে দেখি।

কয়েক মিনিটের মধ্যে ভদ্রমহিলা ছুটে এলেন, কোথায় আছে ও?

ওদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু–?

আমার মেয়ে দার্জিলিং থেকে মারুতি গাড়িতে ফিরছিল। মাই গড, এখন কী হবে? আমি কী করি? অস্থির হয়ে উঠলেন প্রৌঢ়া।

আপনার দুশ্চিন্তার কারণ নেই। যদি ও আপনার মেয়ে হয় তা হলে তেমন কোনও বিপদ হয়নি। ওদের নিয়ে ডক্টর এবং ফাদার হাসপাতালে গিয়েছেন। আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি মিসেস ডিসুজা। আপনি তৈরি হয়ে নিন। কোঅপারেটিভ স্টোর্সের পাশে স্টিফেন থাকে। ওর ট্যাক্সি আছে। আমি বলে দিচ্ছি আপনার কাছে আসতে। আপনি হাসপাতালে চলে যান।

আমি আপনাদের সঙ্গে যাচ্ছি। সময় নষ্ট করতে চাই না আমি। প্রৌঢ় কথাগুলো যখন বলছেন তখন আর একটি মেয়ে এসে দাঁড়াল পেছনে। ব্রাউনের মনে হল এই মেয়েটি মারুতি গাড়িতে বসা মেয়েটির থেকে অনেক বেশি সুন্দরী। জিনস আর শার্ট পরে থাকলেও সৌন্দর্য উথলে পড়ছে।

মেয়েটি বলল, মামি, আমি তোমার সঙ্গে যাব?

না। তুমি বাড়িতে থাকো সোনা। আমি এখনই আসছি। প্রৌঢ়া আবার ভেতরে ছুটে গেলেন। ব্রাউন হাসলেন, তোমার নাম কী খুকি?

মেয়েটির কপালে ভাঁজ পড়ল, জুলি ডিসুজা। দিদির সেন্স ছিল না?

ছিল। কিন্তু সে এত নার্ভাস ছিল যে কথা বলার মতো অবস্থা ছিল না। দ্যাখো, আমি এখনও জানি না সে তোমার দিদি কিনা। কিন্তু এটা বলতে হবে যিশু তাকে রক্ষা করেছেন। ব্রাউন বললেন।

এর মধ্যে যিশু এল কী করে?

মানে?

অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। যদি বেঁচে যায় তা হলে বুঝতে হবে বেশি আঘাত লাগেনি। লাগলে বাঁচত না। যিশু কবে মারা গিয়েছেন। তার পক্ষে এতদিন পরে এসে সব কাজ ফেলে দিদিকে বাঁচাতে যাওয়ার কথা কল্পনা করা একটু বাড়াবাড়ি নয় কি? তার অত দায়িত্ব থাকলে তো তিনি অ্যাকসিডেন্টটাই হতে দিতেন না। মেয়েটির গলায় কীরকম ঠাট্টা ফুটে উঠল।

ব্রাউন হাসলেন, বাঃ! তোমার সঙ্গে কথা বলে খুব ভাল লাগল। আজ এখন তো ঠিক পরিস্থিতি নয়, তোমার যদি সময় হয় আমার কাছে এসো। নীচের রাস্তায় মিস্টার ব্রাউনের বাড়ি বললে যে-কেউ দেখিয়ে দেবে।

ইতিমধ্যে প্রৌঢ়া বেরিয়ে এলেন। তিনি পোশাক বদলেছেন এবং হাতে ব্যাগ নিয়েছেন। সায়ন লক্ষ করল এই মহিলার মধ্যে একটা আলাদা ছাপ রয়েছে যা এখানকার অন্য মহিলার মধ্যে নেই।

স্টিফেনকে পাওয়া গেল। সে গাড়ি বের করছিল তখন শহরের ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে যাবে বলে। তাকে বলতেই সে রাজি হয়ে গেল। হাসপাতালে পৌঁছে দিতে তিরিশ টাকা নেবে। প্রৌঢ়া পেছনে উঠে বসলে স্টিফেন বলল, বাবা, তোমরা সামনে বসে যাও। নামিয়ে দিচ্ছি।

ব্রাউন মাথা নাড়লেন, না। ওঁর আপত্তি থাকতে পারে।

মিসেস ডিসুজা পাথরের মতো মুখ করে বললেন, ঠিক আছে, বসতে পারেন।

পাহাড়ের ওপর থেকে পাক খাওয়া রাস্তা ধরে গাড়িতে আসতে সায়নের খুব ভাল লাগে। নির্মাল্যর নাকি গা গোলায়, বমি পায়। সায়নের ওসব কিছুই হয় না। ব্রাউনের বাড়িটা দেখা যেতেই তিনি বললেন, এসে গিয়েছে ও।

সায়ন দেখল ভুটোর পাশে আর একটা কুকুর চুপচাপ বসে আছে। স্টিফেন গাড়িটা থামালে ওরা নেমে পড়ল। ব্রাউন একটু ঝুঁকে বললেন, এই হল আমার বাড়ি। আমি আর আমার কুকুর থাকি। যদি কোনও প্রয়োজন পড়ে স্বচ্ছন্দে আমাকে খবর দেবেন। যিশু আপনার মেয়ের মঙ্গল করবেন।

মিসেস ডিসুজা বললেন, ধন্যবাদ।

গাড়িটা নেমে গেল নীচে। ভুটো এবার জোর গলায় ডেকে উঠতেই দ্বিতীয় কুকুর সুড়সুড় করে হাঁটা শুরু করল। যেন ব্রাউনকে ফিরে আসতে দেখে ভুটো ওকে চলে যেতে বলল। সায়ন বলল, আমি চলি।

যাবে? একটু ভেতরে এসো না। কফি খাবে?

ভেতরে এল সায়ন, না। ডাক্তার আঙ্কল আমাকে রুটিনের বাইরে খেতে নিষেধ করেছেন। তা ছাড়া কফি আমার খুব কড়া লাগে।

ঠিক আছে তা হলে। এই হল আমার প্রার্থনার ঘর। একটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ব্রাউন বললেন। কাঠের মেঝের ওপর সুন্দর কার্পেট পাতা। দেওয়ালের দিকে বড় আসনের ওপর যিশুর মূর্তি। তার পায়ের কাছে মোমবাতি জ্বলছে বাতিদানে। সেই আলোয় মূর্তিটিকে অপূর্ব দেখাচ্ছে।

সায়ন বলল, কী ভাল।

তাই? তোমাকে একটা কথা বলি?

সায়ন তাকাল বৃদ্ধের মুখের দিকে।

যিশুর চিবুকের সঙ্গে তোমার চিবুকের মিল আছে।

সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে উঠল সায়ন। তারপরই খুব মজা পেল, যা। উনি ভগবান। ভগবানের সঙ্গে কি মানুষের মিল থাকে?

ব্রাউন বললেন, যিশু ভগবান নন। ভগবান হলেন সর্বশক্তিমান। যিশু তার পুত্র। তিনি মহামানব। ঈশ্বরের আশীর্বাদ পৃথিবীর মানুষের কাছে পেয়ে দিতে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পদচিহ্ন ধরে হাঁটলে, তার ছায়ায় নিজের ছায়া মিলিয়ে দিলে তাকে স্পর্শ করা যায়। প্রতি যুগে মানুষ কারও না কারও মধ্যে যিশু কিংবা মা মেরিকে দেখেছে। দেখেছে বলে মানুষ ধ্বংস হয়ে যায়নি।

সায়নের মনে পড়ল, যেমন মাদার টেরেসা। তাই তো?

ব্রাউন অবাক হয়ে তাকালেন, তিনি যা করছেন তার তুলনা খুব কম আছে। তবে তিনি নিজেকে মহামানবী বলে ভাবতে চান না। বলা যায়, সাধারণ মানুষ আর মহামানবের মাঝখানে যদি কোনও স্তর থাকে তা হলে তিনি সেই স্তরে আছেন।

হঠাৎ সায়ন জিজ্ঞাসা করল, আপনার একা থাকতে খারাপ লাগে না?

ব্রাউন মাথা নাড়লেন, দিনের বেলায় এই পাহাড়ের মানুষদের সঙ্গে বেশ কেটে যায়, রাত্রে মাঝে মাঝে খারাপ লাগে। তখন এই ঘরে আসি। ওর সামনে বসলে আমার মন ভাল হয়ে যায়। যিশু পরম করুণাময়।

সায়ন চোখ বন্ধ করে যিশুর মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে তাকেই কল্পনা করল। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ চোখের পাতায় যিশু চলে এলেন। সে খুশি হল। আর কোনওদিন যিশু তার কাছ থেকে হারিয়ে যাবেন না। কাউকে চিরকাল নিজের কাছে ধরে রাখতে সে এই পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। এখন চোখ বন্ধ করলেই সে মাকে দেখতে পায়।

.

হাসপাতালে পৌঁছোনো পর্যন্ত মেয়েটির মুখ থেকে একটি কথা বের হয়নি। ফাদার তার ক্ষতস্থানে রুমাল বেঁধে দিয়েছিলেন। বারংবার প্রশ্ন করা সত্ত্বেও সে চুপ করে ছিল। ড্রাইভারের রক্তপাত হচ্ছিল খুব। মাথার একপাশে আঘাত লেগেছে। ওর অবস্থা দেখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রাখতে চাইলেন না। তখনই ফার্স্ট এইড দিয়ে ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দেওয়া হল শিলিগুড়ির মেডিক্যাল কলেজ হসপিটালে।

মেয়েটা মাথায় আঘাত লাগা ছাড়া পায়ে খুব চোট পেয়েছিল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের হাতে তাকে ছেড়ে দিয়ে ডাক্তার এবং ফাদার যখন চলে আসছিলেন লোক্যাল থানার সাব-ইনসপেক্টর এলেন। যে কোনও দুর্ঘটনা এবং তা থেকে আহতদের ঘটনাগুলো পুলিশের এক্তিয়ারে পড়ে। ডাক্তার দেখলেন সাব-ইনসপেক্টরটি নতুন, আগে দেখেননি।

সাব-ইনসপেক্টর বললেন, আপনারা যখন আহতদের হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন তখন আপনাদের স্টেটমেন্ট নেব। একটু কোঅপারেশন চাই।

ফাদার বললেন, অফিসার। আমি খুব জরুরি কাজ ফেলে এসেছি। আজ ভোরে একজন মারা গিয়েছেন। তাঁর পারলৌকিক কাজ শুরু করা দরকার।

এক্ষেত্রে আপনার আসা উচিত হয়নি ফাদার। সাব-ইনসপেক্টর বললেন।

চোখের সামনে দুর্ঘটনা ঘটলে আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াটা জরুরি বলে মনে হয়েছিল। চিরকালই তাই মনে হবে। এখন এখানে আমার কিছু করার নেই। আপনাকে যদি স্টেটমেন্ট বিকেলে দিই তা হলে কি খুব অসুবিধে হবে?

সাব-ইনসপেক্টর কাঁধ নাচালেন, আপনি কোনও চার্চে আছেন?

ডাক্তার শুনছিলেন চুপচাপ। এবার বললেন, ফাদার। এত দেরি যখন হয়েছে আরও কয়েকটা মিনিট খরচ করলে যদি আমাদের ইয়াং অফিসার বন্ধুর কাজ হয়ে যায় তা হলে তাই করে দেওয়া যাক। অফিসার, আমি একজন ডাক্তার। এখান থেকে তিন মাইল দূরে পাহাড়ে আমার একটা নার্সিংহোম আছে। আজ সকালে চিৎকার-চেঁচামেচি কানে যেতে আমি বেরিয়ে এসে দেখি একটি মারুতি গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়েছে। গাড়িতে দুজন মানুষ ছিল। ড্রাইভার এবং একটি মেয়ে। ড্রাইভারের জ্ঞান ছিল না। মেয়েটি বোধহয় প্রাথমিক শকে কথা বলতে পারছিল না। আমি আমার গাড়ি বের করে ফাদারকে নিয়ে ওদের হাসপাতালে পৌঁছে দিতে এসেছি।

অ্যাকসিডেন্ট কীভাবে হয়েছিল?

আগেই বললাম চিৎকার শুনে যখন আমি নার্সিংহোমের বাইরে আসি তার আগেই অ্যাকসিডেন্ট হয়ে গিয়েছিল। কীভাবে হয়েছিল দেখতে পাইনি।

ভিক্টিমদের পরিচয় জানেন?

না। আমি জানি না।

হুম। ফাদার, আপনি অ্যাকসিডেন্টটা দেখেছেন?

হ্যাঁ। গাড়িটা প্রচণ্ড গতিতে ওপরে উঠতে গিয়ে সামলাতে পারেনি। পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা লেগে কাত হয়ে পড়ে।

কেউ কি গাড়িটাকে চেজ করছিল?

না তো।

ওখানে কী করছিলেন আপনি?

আমি আর মিস্টার ব্রাউন ডাক্তারের ওখান থেকে চা খেয়ে ফিরে যাচ্ছিলাম। হঠাৎই ওই দুর্ঘটনা ঘটল।

মিস্টার ব্রাউন কে?

আমাদের ওখানকার একজন প্রবীণ মানুষ।

প্যাসেঞ্জারদের আপনি চেনেন?

না।

সে কী? আপনি একজন ফাদার। আপনার এলাকার মানুষদের না চেনা কি বিশ্বাসযোগ্য? ভেবে বলুন।

যাকে চিনি না তাকে ভেবে চেনা যায় না অফিসার।

তাই নাকি?

এবার ডাক্তার সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, ওয়েল, অফিসার। আপনার সঙ্গে কোঅপারেশন করা হল। এবার আমরা যাচ্ছি। একটা কথা, আমাকে আপনার থানার অফিসার ইন চার্জ ভাল করে চেনেন। দার্জিলিং জেলার পুলিশের কর্তারাও আমার পরিচিত। আপনি যেভাবে জেরা করলেন তা জানলে এরপর কোনও সাধারণ মানুষ আহতদের হাসপাতালে পৌঁছোতে আসবে না। প্লিজ নিজেকে রেক্টিফাই করার চেষ্টা করুন।

আপনি আমাকে হুমকি দিচ্ছেন?

আপনি তরুণ, এখনও–।

শুনুন। আমি আপনাকে থানায় যেতে বাধ্য করতে পারি তা জানেন?

কোন কারণে?

আপনি পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতা করছেন না। প্রকৃত ঘটনা আড়াল করার চেষ্টা করছেন। আমার ওপরওয়ালার সঙ্গে পরিচয় আছে বলে হুমকি দিচ্ছেন।

বাঃ। চমৎকার। আচ্ছা, আপনি কি এর আগে বাঁকুড়া পুরুলিয়া বা মালদার গ্রামে ছিলেন? বর্ধমানেও শুনেছি দিনকে রাত করে দেওয়া হয়। আপনি আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। একটা কথা মনে রাখবেন, পাহাড় সমতল নয়। ওই একই মেজাজে এখানকার মানুষদের সঙ্গে ব্যবহার করলে বিপদে পড়ে যাবেন ভাই। আচ্ছা, চলি। আসুন ফাদার। ডাক্তারের পিছন পিছন যখন ফাদার বেরিয়ে আসছেন ঠিক তখনই মিসেস ডিসুজা হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলেন, একসকিউজ মি। একটু আগে অ্যাকসিডেন্টে উডেড কোনও মেয়েকে কি হসপিটালে নিয়ে আসা হয়েছে?

ডাক্তার বললেন, হ্যাঁ ম্যাডাম। আপনি?

মিসেস ডিসুজা বললেন, ও কি কথা বলতে পারছে? নাম বলেছে?

ডাক্তার বললেন, ওর তেমন আঘাত লাগেনি। কিন্তু কথা বলছে না। আমরাই ওদের নিয়ে এসেছি। আপনি ওয়ার্ডে গিয়ে খোঁজ করলেই পেয়ে যাবেন।

এই সময় অফিসার কাছে এল, আপনি মেয়েটির মা?

যদি লিজা হয় তা হলে আমি ওর মা। ও কোথায়?

এক মিনিট। শুনলেন তো শি ইজ আউট অফ ডেঞ্জার। আপনার মেয়ে একা মারুতি গাড়িতে করে কোত্থেকে আসছিল?

হঠাৎ ভদ্রমহিলা শক্ত হয়ে গেলেন, অ্যাকসিডেন্টের সঙ্গে এই প্রশ্নের কোনও কানেকশন নেই অফিসার। সে যেখানে ইচ্ছে যেতে পারে। অ্যাকসিডেন্ট কেন হয়েছিল তা আমি জানি না। ড্রাইভার কি ড্রাঙ্ক ছিল?

ডাক্তার বললেন, না মিসেস ডিসুজা। ড্রাইভার মদ খায়নি।

দেন, আমি আমার মেয়ের কাছে যাচ্ছি।

ভদ্রমহিলা ছুটে চলে যেতে অফিসার হতাশ গলায় বললেন, আপনারা বুঝতে পারছেন না, ঘটনাটা স্বাভাবিক নয়। হসপিটাল থেকে থানায় খবর যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও একটা ফোন আসে। যে ফোন করেছিল সে পরিচয় দেয়নি। লোকটা বলেছে, মেয়েটি গতরাতে দার্জিলিং-এ ফুর্তি করে ভাড়া করা মারুতি গাড়িতে ফিরছিল। শি ইজ এ কলগার্ল।

ফাদার বললেন, আপনাকে একটা কথা বুঝতে হবে অফিসার। এই মেয়েটি এবং তার ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে আমাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। বেচারা দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিল, আমরা হসপিটালে পৌঁছে দিয়েছি। আমাদের ভূমিকা এই পর্যন্ত। আচ্ছা–।

ফাদার এবং ডাক্তার হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলেন। গাড়িতে ওঠার সময় ওঁরা দেখতে পেলেন কিছু মানুষ উত্তেজিত হয়ে গেটের সামনে চিৎকার করছে। ওঁদের দেখতে পেয়ে ভিড়টা যেন ছুটে এল সামনে। উত্তেজিত কণ্ঠগুলো একসঙ্গে কথা বলায় স্পষ্ট কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত জানা গেল এরা সবাই ট্যাক্সি ড্রাইভার। ওদের একজন সহকর্মী দুর্ঘটনায় আহত হয়ে এখানে এলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব না নিয়ে কেন শিলিগুড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে ওরা তার কৈফিয়ত চাইছে।

কিছুক্ষণ কথা বলে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রেহাই পেলেন ওঁরা। গাড়িতে বসে ফাদার বললেন, আজকাল মানুষ কত দ্রুত উত্তেজিত হয়ে পড়ে। পাহাড়ে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে উত্তেজিত হওয়ার প্রবণতা আরও বেড়ে গিয়েছে।

ডাক্তার বললেন, কোনও ঘটনা একা ঘটে না। সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করার জন্যে নানান প্ররোচনা দেওয়া হয়। এই যে অফিসারটির কথা ধরুন, এর কথাবার্তা তো আমাকেই উত্তেজিত করে তুলছিল। থাকগে, মিস্টার রায়ের কাজ কখন হচ্ছে?

জানি না। ডক্টর তামাংকে বলেছি মিস্টার রায়ের আত্মীয়স্বজনদের খবর দিতে। মনে হয় কাল সকালের আগে কিছু করা যাবে না।

গাড়িটা শহর ছেড়ে কিছুটা পিচের রাস্তা ধরে এগিয়ে এবার কাঁচা পথ ধরে ওপরে উঠতে লাগল। হঠাৎ ফাদার জিজ্ঞাসা করলেন, একটা প্রশ্ন মাঝে মাঝে আমার মনে আসে।

কী ব্যাপারে? সামনে চোখ রেখে ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন।

আপনার নিরাময়ের বাসিন্দারা সবাই রক্তের অসুখে ভুগছে। ব্যাপারটা খুব সিরিয়াস। কলকাতা দিল্লি বোম্বের মতো বড় শহরেও এই রোগের সঙ্গে ডাক্তাররা পাল্লা দিয়ে পেরে উঠছেন না বলে শুনেছি। ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে শুনলেই মনে হয় জীবন শেষ হয়ে এল। বড় শহরে থাকলে আপনি অনেক বেশি বিজ্ঞানের সাহায্য পেতেন। তা না করে এই পাহাড়ে এসে নিরাময় খুললেন কেন?

ডাক্তার হাসলেন, ফাদার। আমি দীর্ঘকাল হেমাটলজি নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছি। ক্যান্সারের ওষুধ এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। তাই রক্তে ক্যান্সার হলে আপনার আশঙ্কাটা খুব অস্বাভাবিক নয়। বোন ম্যারো পাল্টে দিয়ে আমরা লড়াই চালাতে পারছি এখনও। কিন্তু লড়াই করা মানে জিতে যাওয়া নয়। অনেকটা মহাভারতের অভিমন্যুর মতো অবস্থা আমাদের। আপনি অভিমন্যুর কাহিনী জানেন ফাদার?

হ্যাঁ। আমি মহাভারতের সংক্ষিপ্ত ইংরেজি সংস্করণ পড়েছি।

ডাক্তার ফাদারের মুখ ভাল করে দেখলেন। খুব কম হিন্দু পুরোহিতকে বলতে শোনা যাবে তিনি বাইবেল পড়েছেন। ডাক্তার বললেন, পরাজয় নিশ্চিত জেনেও আমাদের একসময় লড়ে যেতে হত। কিন্তু শেষপর্যন্ত আমরা জানতে পারলাম অসুখটাকে দুটো ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগের রুগিদের ক্ষেত্রে কোনও চিকিৎসাই কাজে দেয় না। তাদের শরীরে রক্তকণিকা এত অল্প এবং নতুন রক্ত তৈরির ক্ষমতা না থাকায় অসুখের লক্ষণ ধরা পড়ার পর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তারা মারা যায়। দ্বিতীয় শ্রেণীর রুগিরা অতটা ক্ষতিগ্রস্ত নয়। লোহিতকণিকা কমে গেলেও শরীরে নতুন রক্ত অল্প পরিমাণে হলেও তৈরি হচ্ছে। বোন ম্যারো পাল্টে যে চিকিৎসা রয়েছে তা এদের উপকারে নিশ্চয়ই আসে। কিন্তু আসল কথা হল এইসব রুগিকে কঠোর নিয়মের মধ্যে থাকতে হয়। রক্ত তরল হয়ে নাক বা কান দিয়ে বেরিয়ে আসা মাত্রই নতুন রক্ত শরীরে দিতে হয়। সেটা দেওয়ার পদ্ধতিও স্বতন্ত্র। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাড়িতে ফিরে যাওয়া রুগি পরিচর্যার অভাবে মারা যায়। ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ার পর পনেরো বছর বেঁচে আছে এমন রুগির কথা আমি জানি। আপনি যে প্রশ্নটা করেছেন তার উত্তরটা এবার দিই। আমার ধারণা এই পাহাড়ি শহরের আবহাওয়া আমার রুগিদের পক্ষে খুব উপকারী। এখানে ঘাম হয় না, মানুষ কাহিল হয়ে পড়ে না আবার তীব্র শীতও পড়ে না। তবু, যারা চলাফেরা করতে পারছে তাদের ইচ্ছে হলে আমি বড়দিনের সময় মাসখানেকের জন্যে বাড়িতে যেতে দিই। গতবার সেটা করে একটি ভাল ছেলেকে আমি হারিয়েছি। বাড়িতে যাওয়ার পর খেলতে খেলতে তার নাক দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এসেছিল। আমার নির্দেশ অনুযায়ী তাকে নতুন রক্ত দেওয়ার কথা। আমি বলে দিয়েছিলাম নতুন রক্ত বোতলে ভরে মুখটা নীচের দিকে রেখে শিশি ফ্রিজে কয়েক ঘণ্টা রেখে দিতে। এতে লোহিতকণিকার অংশ বোতলের মুখের দিকে চলে আসবে, সাদা অংশ ওপরে। এই অবস্থায় বোতল থেকে শরীরে রক্ত দিলে আগে লোহিতকণিকা ভেতরে যাবে। কিন্তু ওখানকার ডাক্তার রক্ত নিয়েই সরাসরি রুগির শরীরে দিয়েছেলেন। ফলে সেই মিশ্রিত রক্ত রুগির শরীর নিতে পারেনি। ডাক্তার আফসোসে মাথা নাড়লেন, আসলে সামান্য অজ্ঞতাই কত বড় বিপদ ডেকে আনে। আপনি জানেন কিনা জানি না, এই পাহাড়ি অঞ্চলে অন্তত দেড়শো জন মানুষ প্রয়োজন হলে তাদের রক্ত আমার রুগিদের দিয়ে থাকেন। হ্যাঁ, অর্থ তাদের দেওয়া হয় কিন্তু রক্ত দেওয়ার ইচ্ছাটাকে তো কেউ টাকা দিয়ে কিনতে পারে না। আমার এখানে অসুস্থ ছেলেমেয়েগুলো ধীরে ধীরে নিজেদের সুস্থ ভাবতে শুরু করে। মন থেকে ভয় চলে গেলে রোগ বেশ দমে যায়। আমেরিকার দুটো রিসার্চ সেন্টারের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে। সামনের মাসে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন থেকে প্রতিনিধি আসবেন দেখতে। ওঁরা আমার অপারেশন থিয়েটারকে আরও আধুনিক করতে চান। মুশকিল হল আমি একা। দ্বিতীয় একজন মানুষ খুঁজে পাচ্ছি না যে পাশে দাঁড়াবে আর আমি চলে গেলেও নিরাময়কে বাঁচিয়ে রাখবে। আমারও তো বয়স হচ্ছে।

ফাদার বললেন, একটা বোর্ড তৈরি করছেন না কেন?

দেখি। আমি কোনওরকম রাজনীতি বরদাস্ত করতে পারি না। কয়েকটা মাথা এক জায়গায় হলেই ওটা যে আসবে না তা কে বলতে পারে। তবে আমি খুশি কারণ পাহাড়ের রাজনৈতিক দলগুলো আমার কাজকে সমর্থন করেছে। জি এন এল এফ জানতে চেয়েছে চিকিৎসার ব্যাপারে আমার কতটা আর্থিক সাহায্যের প্রয়োজন।

ফাদারকে চার্চের দরজায় পৌঁছে দিলেন ডাক্তার। ইতিমধ্যে দুর্ঘটনার খবর চাউর হয়ে গেছে। ওঁদের দেখে স্থানীয় মানুষজন ভিড় করে এলেন। যা ঘটেছিল তা সংক্ষেপে বলে ডাক্তার অনুরোধ করলেন ফাদারকে ছেড়ে দেওয়ার জন্যে। তাঁর বিশ্রামের প্রয়োজন। ডাক্তার যখন গাড়ি ঘোরাচ্ছিলেন তখন একজন প্রৌঢ় এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন তিনি নিরাময় পর্যন্ত গাড়িতে যেতে পারেন কিনা! ডাক্তার আপত্তি না করায় প্রৌঢ় নিজেই দরজা খুলে উঠে বসলেন, আমার নাম নিমা তামাং। আপনি আমাকে চিনবেন না। আমি দার্জিলিং-এ থাকি। ভাইপোর কাছে এসেছিলাম। মেয়েটা তাহলে মরেনি?

কোন মেয়ের কথা জিজ্ঞাসা করছেন? ঢালু পথে সতর্ক হয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলেন ডাক্তার। এরকম আচমকা প্রশ্নে ঠিক তাল রাখতে পারলেন না।

ওই যে, সবাই বলছিল আপনাদের নিরাময়ের কাছে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে আজ। ড্রাইভার আর মেয়েটার নাকি খুব খারাপ অবস্থা?

ও। না, মেয়েটির তেমন কিছু হয়নি। ফাদার তো এ কথা একটু আগে বললেন।

হ্যাঁ, শুনেছি। খুব গন্ধা ফ্যামিলির মেয়ে।

ডাক্তার তাকালেন প্রৌঢ়ের দিকে। কিন্তু কিছু বললেন না।

আগে ওরা দার্জিলিং-এ থাকত। ওর মায়ের দু-দুটো স্বামী। দুজনেই মাল খেয়ে টাকা চাইতে আসত। বহুত হুজ্জত হত তখন। তা ছাড়া মাঝরাতে গাড়ি এসে ওদের নামিয়ে দিত বাড়িতে। মেয়েগুলোর কথা বলছি। পাড়ার লোক খুব ক্ষেপে গিয়েছিল ওদের ওপর। তখন ওরা এখানে চলে আসে। এখান থেকে দার্জিলিং-এ যায় ব্যবসা করতে। এ ব্যবসার তো মার নেই। তবে আপনাকে বলি, মেয়েগুলোকে কী দেখছেন, যদি ওদের মাকে যৌবনে দেখতেন, আঃ, কী জিনিস ছিল।

প্রৌঢ়ের মুখ থেকে থুতু ছিটকে বের হতেই ডাক্তার ব্রেক কষলেন, নেমে যান।

অ্যাঁ? প্রৌঢ় অবাক।

আপনাকে আমি নেমে যেতে বলছি।

লোকটা নেমে গেলেও ডাক্তারের অস্বস্তি যাচ্ছিল না। যেন কোনও নোংরা জিনিসে হাত পড়েছে, এখনই ধোয়া দরকার, এরকম অনুভূতি হচ্ছিল। বাঁক নিয়ে নিরাময়ের সামনে পৌঁছোতেই তিনি গানটা শুনতে পেলেন। নিরাময়ের উল্টোদিকের রাস্তার খাদের ধারে রেলিং ঘেঁষে গোটা সাতেক ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে গান গাইছে। হালকা রোদে পাহাড় পরিষ্কার, আকাশ তকতকে নীল। ডাক্তার লক্ষ করলেন তার নিরাময়ের কয়েকজন ছাড়া স্থানীয় নেপালি বাচ্চাগুলোও গাল ফুলিয়ে গান গাইছে। ধনধান্যপুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা। ভাল করে যে বাংলা বলতে পারে না সে সুরের সাহায্য পেয়ে গেয়ে যাচ্ছে আন্তরিকভাবে।

ঠিক এইসময় মোটরবাইকের আওয়াজ শোনা গেল। তারপরই ওদের দেখা গেল। দুটো বাইকে চারজন ছেলে বেশ জোরেই ওপরে উঠে আসছে। নিরাময়ের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ওদের গান শোনামাত্র ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল বাইক দুটো। চামড়ার জ্যাকেট পরা একটা ছেলে এগিয়ে গিয়ে নেপালি ভাষায় চিৎকার করে নিষেধ করল গান গাইতে। গাইয়ের দল গান থামাল। নেপালি বাচ্চারা যেন ভয় পেল। সায়ন এগিয়ে এল, গান গাইতে নিষেধ করছ কেন?

ছেলেটি দু পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলল, এসব গান পাহাড়ে চলবে না। ওদের এই গান শেখাচ্ছে কে? তুমি? তোমাকে আমি ওয়ার্নিং দিয়ে যাচ্ছি। তুমি কোথায় থাকো? কোন বাড়ি?

সায়ন আঙুল তুলে নিরাময় দেখিয়ে দিল।

ছেলেটা সেদিকে তাকিয়ে একটু ভাবল। তারপর এগিয়ে গিয়ে সায়নের কাঁধে হাত রাখল, তোমার ওই গানে পাহাড় কুয়াশার কথা আছে?

হ্যাঁ আছে। কোথায় এমন ধুম্র পাহাড়। ধুম্র পাহাড় মানে ধোঁয়ার পাহাড়। ধোঁয়া মানে এক্ষেত্রে কুয়াশা।

তাই নাকি? অত বড় গানটায় ওই দুটো শব্দমাত্র? বাকি সব তো প্লেইন ল্যান্ডের বর্ণনা। তাই না? আমরা সেইসব গান এখানকার বাচ্চাদের শেখাতে চাই না যার সঙ্গে আমাদের জীবনের কোনও সস্পর্ক নেই। বুঝলে? ছেলেটি ফিরে গেল বাইকে। ডাক্তার দেখলেন ওরা তাঁর গাড়ির পাশ কাটিয়ে ওপরে উঠে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে নেপালি বাচ্চাগুলো দৌড়ে চলে গেল নীচের দিকে।

খুব ধীরে ধীরে গাড়িটাকে নিরাময়ের সামনে নিয়ে এলেন ডাক্তার। গাড়ি থেকে নেমে দেখলেন সায়ন তখনও ওখানে ওই ভঙ্গিতেই দাঁড়িয়ে আছে। নিরাময়ের দুটো ছেলে তার পেছনে। কী করবে বুঝতে না পেরে তারা ধীরে ধীরে গেটের দিকে এগোতে লাগল। ডাক্তার সায়নের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।

সায়ন জিজ্ঞাসা করল, এই গান কি এখানকার মানুষের গান নয়?

ডাক্তার হাসলেন। এই গান পৃথিবীর সব দেশের মানুষ গাইতে পারে।

তা কী করে হবে? মরুভূমির মানুষ কী করে গাইবে। ধনধান্যপুষ্প তো তাদের মাটিতে জন্মায় না। সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে আমাদের দেশটিকে সেরা বলা হয়েছে। পৃথিবীর অন্য মানুষেরা তো সেটা নাও মানতে পারে। বিচলিত দেখাচ্ছিল সায়নকে।

ডাক্তার কথা বলতে যাচ্ছিলেন এমন সময় ডাকপিওনকে দেখতে পেলেন। লোকটা ডাক্তারের কাছে এগিয়ে এসে গোটা পাঁচেক খাম দিল। ডাক্তার তার মধ্যে থেকে একটা আলাদা করে সায়নের দিকে বাড়িয়ে দিলেন, তোমার চিঠি।

খামের উপর হাতের লেখা দেখেই মুখে হাসি ফুটল সায়নের।

ডাক্তার সেটা লক্ষ করে জিজ্ঞাসা করলেন, খুশি হয়েছ দেখছি, কার চিঠি?

মায়ের।

.

০৪.

স্নেহের সায়ন, তোমার চিঠি পেয়েছি। সেইসঙ্গে ডাক্তারবাবুর চিঠি এসেছে। তিনি তোমার বাবাকে লিখেছেন যে তোমার শরীরের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। এই খবর পেয়ে আমরা খুব খুশি হয়েছি। তোমার বাবা এই বাড়ির বড়মাকে খবরটা দিলে তিনি ঠনঠনের কালীবাড়িতে পুজো দিয়েছেন। দিনরাত আমি ভগবানকে ডাকি যাতে তিনি তোমাকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে দেন। তোমাকে ছেড়ে আর কতকাল থাকতে হবে জানি না। সামনের মাসে তোমার বাবা যাবেন ওখানে। ইচ্ছে আছে আমিও সঙ্গে যাব। ডাক্তারবাবু যদি রাজি হন তাহলে কিছুদিনের জন্যে তোমাকে এখানে নিয়ে আসব। শুনলাম তুমি এখন রাস্তায় একাই হাঁটাহাঁটি করছ। পাহাড়ি পথ, সবসময় সাবধান থাকবে। একটুও মন খারাপ করো না। জেনো, সবসময় আমি তোমার পাশে আছি। তোমাকে ছাড়া আমরা যেরকম থাকা যায় তেমনই থাকছি। আমার বুকভরা স্নেহ-ভালবাসা নিও। ইতি, আশীর্বাদিকা, তোমার মা।

হঠাৎ সায়নের মনে হল, মায়ের চিঠিগুলো একরকম হয়ে যাচ্ছে। এর আগের চিঠিগুলো যা বাক্সে জমিয়ে রেখেছে, তারিখ পাল্টে দিলে প্রায় একই চিঠি হয়ে যায়। প্রথম প্রথম মা তাকে সাধুভাষায় চিঠি লিখত। স্বদেশভূমির লেখক বনবিহারী মাইতির মতো সাধুভাষায় লিখতে লিখতে চলতি শব্দ লিখে ফেলত। তুমি যদি মন খারাপ করিয়া থাকো তাহলে–! বনবিহারীবাবুর ওই আটচল্লিশ পাতার বইতে অনেকগুলো তাহলে রয়েছে।

আচমকা বৃষ্টির শব্দ কানে আসতেই সায়ন জানলার কাছে গেল। ঠাণ্ডার জন্যে কাচের জানলা সবসময় বন্ধ থাকে। সে উঁকি মেরে দেখল ইতিমধ্যে আকাশ কালো হয়ে বৃষ্টি নেমেছে। কোনও কিছুই দেখা যাচ্ছে না। পাহাড়ে মেঘ জমলে অথবা বৃষ্টি হলে তার একদম ভাল লাগে না। সে ঘরের আলো জ্বেলে দিল। এবং তখনই নেপালি ছেলেগুলোর মুখ চোখের সামনে ভেসে এল। এখানে আসার পর এই প্রথম ছেলেগুলোকে দেখল সে। ওদের কথাবার্তা শুনলেই বোঝা যায় অসম্ভব রেগে আছে ওরা। এমন কি ধনধান্যপুষ্পভরা গানটিকেও সহ্য করতে পারছে না। কেন? এখানে আসার আগে সে শুনেছিল পাহাড়ে গোলমাল হচ্ছে। পাহাড়ের রাজনৈতিক নেতারা স্বাধীন গোর্খাল্যান্ড চায়। এই আন্দোলনে অনেক মানুষ মারা গিয়েছে। পশ্চিমবাংলার মধ্যে ওরা থাকতে চায় না। কিন্তু সরকার এ দাবি মেনে নিতে পারেনি। কারণ এই দাবি মানলে আরও অনেক ছোট গোষ্ঠীর মানুষ নিজেদের জন্যে পৃথক রাজ্য চাইবে। ফলে ভারতবর্ষ টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত যে সমঝোতা হয়েছিল তাতে পাহাড়ে শান্তি ফিরে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে থেকেও এখানকার মানুষ অনেক ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে। আর এসব কারণেই বাবা তাকে এখানে পাঠাতে প্রথমে রাজি হননি। কিন্তু ডাক্তার আঙ্কল ভরসা দিয়েছিলেন। যাদের সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই তাদের পাহাড়ে কোনও বিপদ হবে না। মা এবং বাবা এখানে এসে সেটা নিজের চোখে দেখেও গিয়েছেন। এতদিন এখানে সে রয়েছে কোনও ঝামেলা হয়েছে বলে শোনেনি। তবে মাঝে মাঝে ধর্মঘট হয়েছে। ওটা কলকাতাতেও হয়।

কিন্তু এই ছেলেগুলো এত বাংলাবিদ্বেষী কেন? বাঙালি তো হিন্দি ইংরেজি গান গায়। কেউ তাদের নিষেধ করে না। নেপালিরাও হিন্দি গান গাইতে ভালবাসে। সেখানেও কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু ওরা নিজেদের কথা যে বাংলা গানে নেই সেটা গাইতে দিতে রাজি নয়। কেন? গান কি অত প্ল্যান করে গাওয়া যায়?

মিস্টার ব্রাউনের মুখ মনে পড়ল তার। কী ভাল ব্যবহার করেন। একবারের জন্যে মনে হয়নি উনি বাংলাবিদ্বেষী। ওঁকে জিজ্ঞাসা করলে হয়তো জানা যাবে এই ছেলেদের রাগের কারণ কী। এখন এখানে থাকতে থাকতে কিছু কিছু নেপালি শব্দের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে। নেপালি ভাষায় কথা বললে অনেকটাই বুঝতে পারে। বাচ্চাগুলো যেমন শব্দের মানে না বুঝে বাংলা গান গেয়ে যাচ্ছিল তারও তো উচিত নেপালি গান শিখে নেওয়া। সায়ন ঠিক করল সে নেপালি গান শিখবে। প্রথমে বড়বাহাদুরকে বলবে শেখাতে। সে না রাজি হলে ছোটবাহাদুরকে। কথাটা মনে আসামাত্র সে ঘর থেকে বের হল। অদ্ভুত একটা অস্থিরতা সমস্ত শরীরে পাক খাচ্ছে। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। ঘেরা বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঠাণ্ডা বাতাসের ঝটকায় একটু কুঁকড়ে যেতেই সে ছোটবাহাদুরকে দেখতে পেল। তিনটে বাসি খবরের কাগজ নিয়ে যাচ্ছে। সায়নের মনে হল অনেকদিন কাগজ পড়া হয়নি। সে ছোটবাহাদুরকে বলল, বাংলা কাগজটা দেবে?

ছোটবাহাদুর তিনটে কাগজ দেখে বিচক্ষণের মতো বাংলা কাগজ এগিয়ে দিল। সেটা নিয়ে সায়ন জিজ্ঞাসা করল, তুমি নেপালি গান জানো?

গান? অদ্ভুত সুন্দর হাসল ছোটবাহাদুর। তারপর মাথা নেড়ে না বলল।

বড়বাহাদুর জানে?

থোড়া থোড়া। ছোটবাহাদুর চলে গেল।

ঘরে ফিরে এল সায়ন। চেয়ার টেনে বসে টেবিলে খবরের কাগজ খুলল। প্রথম পাতায় বড় বড় অক্ষরে লেখা ভারতবর্ষের নামী মন্ত্রীকে কয়েক কোটি টাকা চুরির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরও কয়েকজন মন্ত্রী এবং আমলা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে সি-বি-আই ব্যবস্থা নিচ্ছে। পাশে মন্ত্রীর ছবি। হাসিমুখে হাত নেড়ে পুলিশ ভ্যানে উঠছেন। তিনি শাসিয়েছেন, কে দুর্নীতিগ্রস্ত নয়? আমাকে ফাঁসালে আমি সবার হাঁড়ি ভেঙে দেব।

থরথর করে কাঁপতে লাগল সায়ন। এ কী অবস্থা? ভারতবর্ষের একজন মন্ত্রী এই আচরণ করেছেন? গ্রেপ্তার হওয়ার পরও তিনি লজ্জিত নন? যে ভারতবর্ষকে স্বপ্নের দেশ হিসেবে ভেবেছিলেন শহিদরা, যাকে মা বলতে শিখিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, তাকে এভাবে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে লোভী মানুষরা মন্ত্রিত্ব দখল করে?

সায়ন চোখ বন্ধ করল। এই লোকটির বিচার হলে হয়তো টাকা দিয়ে সব কিছু সামলে নেবেন। হয়তো আবার তাকে ভারতবর্ষের মন্ত্রী হিসেবে দেখা যাবে। হঠাৎ শরীর খারাপ করতে লাগল সায়নের। নাকের তলায় চটচটে অনুভূতি হল। সে উঠে দাঁড়িয়ে আয়নায় নিজের মুখ দেখল। তারপর ধীরে ধীরে বেল টিপে বিছানায় বসে পড়ল। বৃষ্টির আওয়াজ ছাপিয়ে নিরাময়ে সেই বেলের আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে ডাক্তার আঙ্কল ছুটে এলেন তার ঘরে। একপলক দেখে নিয়েই পেছনে ছুটে আসা ছোটবাহাদুরকে বললেন, স্ট্রেচার নিয়ে এসো। তারপর ধবধবে সাদা রুমাল বের করে নাকের তলার রক্ত মুছিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছিল? কী ভাবছিলে তুমি? সায়ন আঙুল তুলে খবরের কাগজের হেডিং দেখিয়ে দিল।

.

উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা।

সন্ধ্যা মুখার্জির গান বাজছিল শিবমন্দিরের মাথার ওপর টাঙানো লাউডস্পিকারে। হিন্দির বদলে বাংলা, জীবনমুখীর বদলে ষাট দশকের হৃদয়জুড়ানো বাংলা গান বাজালে একটা আন্তরিক আবহাওয়া তৈরি করা যায় বলে ধারণা প্রচারিত হওয়ায় সন্ধ্যা মুখার্জি বেজে যাচ্ছিলেন। এই গান এলাকার কেউ শুনছে কিনা তা নিয়ে মাথা ঘামানোর কেউ না থাকলেও একজন শ্রোতা মনোযোগী ছিল। সে গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আবৃত্তি করছিল। টেনে টেনে, ধীরে ধীরে।

মেয়েটির বয়স তেরো। লম্বা, ছিপছিপে, শরীরে লাল ফ্রক। সে একা ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে বিকেলের মরে আসা আলোয় পায়রাদের খুঁজছিল কবিতার শব্দ উচ্চারণ করতে করতে। ছদটি বিশাল। একশো বছরের আগে তৈরি বাড়িটার গায়ে তেমন কোনও সংস্কার না হলেও ছাদটির জায়গায় জায়গায় রাজমিস্ত্রির হাত পড়েছে। পাঁচটি সিঁড়ি বিভিন্ন দিক দিয়ে ছাদে উঠে এসেছে। ছাদ থেকে সরাসরি ঘরে যাওয়ার দরজা আছে তিনটি। রোদ নিস্তেজ হলে, বিকেলটা যখন হাঁটু গেড়ে বসে তখন বিভিন্ন সিঁড়ি আর দরজা দিয়ে একে একে বাসিন্দাদের অনেকে উপস্থিত হয় খোলা আকাশের নীচে, এই ছাদে। সন্ধ্যা মুখার্জির গান শোনার আগ্রহ ওদের কারও নেই কিন্তু গান না বাজলে অস্বস্তি হয়। শব্দ যেন ওদের স্বাচ্ছন্দ্য দেয়। একটি কম্পিত আড়াল চারপাশে তৈরি হয়। এ বাড়ির বিভিন্ন শরিকের বউ-মেয়েরা কিছুক্ষণ প্রাণ জুড়োতে চলে আসে এখানে, এসময়। ছাদ জুড়ে যেন মেলা বসে যায়। মধ্যবয়সিনীদের চেহারা যাই হোক না কেন, গায়ের রং চোখে পড়ার মতো ফরসা। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের দেখা পাওয়া যাবে না এ বাড়িতে বউ হয়ে আসা মহিলাদের মধ্যে। অবশ্য এঁদের সন্তানদের কেউ কেউ গৌরবর্ণ পায়নি। এই না-পাওয়াটা অনেকের মনে আক্ষেপের জন্ম দিয়েছে।

ছাদের একপাশে এইরকম চারজন মহিলা গল্প করছিলেন। এঁদের তিনজন বেশ স্বাস্থ্যবতী, গায়ের রং ফেটে পড়ছে। মুখচোখ মোটেই সুন্দর নয় কিন্তু একধরনের ভোঁতা সুখ সেই সুখে ছড়িয়ে আছে। চতুর্থ জন অপেক্ষাকৃত ক্ষীণাঙ্গিনী, সুন্দরী, কম বয়সী। তবে তার গায়ের রং তীব্র ফরসা নয়। স্বাস্থ্যবতীদের একজন বলল, আর পারি না ভাই। বাঙাল মেয়েদের রান্নার প্রশংসা শুনতে শুনতে কান পচে গেল। কোথায় চিতল মাছের মুঠি না কী যেন বলে খেয়ে এসেছে তার কত ব্যাখ্যান। বললাম, একটা বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করলেই পারতে। শুনে তার রাগ হয়ে গেল।

দ্বিতীয় অর্ধাঙ্গিনী বললেন, শুনেছি তারা ভাল রাঁধে।

এবার চতুর্থজন বললেন, এখন আর কে বাঙাল আর কে ঘটি। পঞ্চাশ বছর আগে ওসব ছিল। আর সত্যি বলতে হলে বলতে হয়, পূর্ববঙ্গের মেয়েরা এদেশে না এলে এখনও আমাদের চিকের আড়ালে থাকতে হত। লেখাপড়াও হত না।

প্রথমজন ঠোঁট ওল্টালেন, কাল টিভিতে কী ছবি আছে ভাই?

তৃতীয়জন খুক করে হাসলেন, মা শীতলা। আমার শাশুড়ি আসনে বসে দেখবে।

ধ্যেৎ। দিলে দিনটাকে নষ্ট করে। আমি কোথায় ভাবলাম উত্তরকুমারের ছবি দেবে। সেই ওগো বধু সুন্দরী দেখার পর থেকে বুকটা থম মেরে রয়েছে। দ্বিতীয়জন তাঁর বৃহৎ বুকে হাত রেখে চোখ বন্ধ করলেন। তার চোখমুখ প্রায় ভাববিহ্বল।

ক্ষীণাঙ্গিনীর নাম ঊর্মিলা, হেসে ফেলল, ওগো বধু সুন্দরীতে উত্তমকুমার তো বাপের বয়সী। তবু তাকে ঘিরে এত আহ্লাদ? তোমার বর তো এখনও যুবক।

োথায় সুভাষ বোস আর কোথায় পেঁয়াজের কোষ। তোমরা মুখে স্বীকার করবে না কিন্তু আমার বাবা রাখঢাক নেই। উত্তমকুমারের জন্যে আমি মরে যেতেও পারি।

ঊর্মিলা আবার হাসল, ইসস। তাই? ওঁকে যখন দাহ করছিল তখন সহমরণে যেতে পারতে।

দ্বিতীয় রাগত ভঙ্গিতে এক ঝটকায় মুখ সরিয়ে নিয়েই স্থির হয়ে গেলেন, অ্যাই! এসেছে!

সবাই বিস্মিত হয়ে দেখল মেয়েটিকে। এ বাড়ির ন’বাবুর মেয়ে টুকটুকি। অষ্টমঙ্গলার পর শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে আর যাওয়ার নাম করছে না। বাড়ি থেকেও বের হয় না।

তৃতীয়া বললেন, আমাদের কালোর মা তো ওদের বাসনও মাজে। ও বলছিল মেয়েটা নাকি বিছানায় উপুড় হয়ে দিনরাত কেঁদে চলেছে। স্বামী নেয় না।

নেয় না কেন? প্রথমজন জিজ্ঞাসা করলেন।

কী জানি। দেখতে তো খারাপ নয়।

দেখতে তো মাকাল ফলও সুন্দর।

দ্যাখো, হয়তো স্বামীকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। অনেক মেয়েছেলের ওসব আসে না।

ধ্যাৎ।

হ্যাঁ গো, ও আমাকে বলেছে।

কথাগুলো হচ্ছিল নিচু গলায়। যাকে কেন্দ্র করে হচ্ছিল এদিকে পেছন ফিরে ছাদের আলসে ধরে সে নীচের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তার পেছনে যে কয়েকটি শিশু কানামাছি খেলায় মত্ত তা যেন টেরই পাচ্ছে না।

ঊর্মিলা মেয়েটিকে দেখল। কত বয়স হবে? বড় জোর পনেরো। এর মধ্যে শাড়ি পরিয়ে খোঁপা বাঁধিয়ে বিয়ে দেওয়া হয়ে গিয়েছে। ঊর্মিলা বলল, এসব মনগড়া কল্পনা না করে সত্যি ঘটনাটা ওকে জিজ্ঞাসা করলেই তো জানা যায়।

না বাবা। ওর মাকে বিশ্বাস নেই। চিৎকার করে বাপের নাম উদ্ধার করে দেবে। দ্বিতীয়জন চোখ ঘুরিয়ে জানিয়ে দিল।

আমরা তো অন্যায় কিছু করছি না। ঊর্মিলা বলল।

বাকিরা দোনামনা করেও শেষ পর্যন্ত এগোল। মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়ে ঊর্মিলা ডাকল, এই টুকটুকি! কী দেখছ?

টুকটুকি চমকে মুখ ফিরিয়ে চারজনকে দেখে বেশ থতমত হয়ে গেল। তারপর আবার রাস্তার দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, কিছু না।

তুমি অনেকদিন পরে ছাদে এলে, আসো না কেন? ঊর্মিলা জিজ্ঞাসা করল।

টুকটুকি জবাব দিল না। ওর মাথা আরও ঝুঁকে পড়ল বুকের ওপর।

প্রথমজন এবার দ্বিতীয়াকে ইশারা করল। দ্বিতীয়া তৃতীয়াকে ঠেলল। এবার তৃতীয়জন হাসলেন, পথ চেয়ে আছ, কারও বুঝি আসার কথা আছে ভাই?

টুকটুকি অবাক হয়ে মুখ তুলল, কার?

কার আবার? এলে তো একজনই আসবে। কী যেন নাম জামাই-এর? দ্বিতীয়জন জিজ্ঞাসা করল।

টুকটুকি মাথা নিচু করল। তৃতীয়জন বলল, বাহারে বুদ্ধি। ও কী করে স্বামীর নাম উচ্চারণ করবে! তা তিনি বাইরে গিয়েছেন বুঝি? অনেকদিন তাই এখানে আছ?

টুকটুকি এবারও জবাব দিল না। ঊর্মিলা এবার ওর বাজুতে হাত রাখল, তোমার খুব খারাপ লাগছে এইসব প্রশ্ন শুনতে, না?

আমি কী উত্তর দেব! গলায় কান্নার আভাস পাওয়া গেল। এবং সঙ্গে সঙ্গে তার হাত আঁচল টেনে এনে ঠোঁটে চাপা দিল। ঊর্মিলা দেখল তার সঙ্গী বউয়েরা হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠে যাই ভাই কাজ আছে ইত্যাদি বলতে বলতে দ্রুত যে যার নিজের ঘরে ফিরে গেল। এ বাড়ির কয়েকটি অলিখিত আইনের মধ্যে একটি হল কেউ অন্যের সংসারের ঝামেলায় নিজেকে জড়াবে না। ওই বউয়েরা তাই সরে গেল।

ঊর্মিলা টুকটুকির হাত ধরল, মন শক্ত করো ভাই। রাগারাগি হলে কদিন বাদে ঠিক হয়ে যাবে।

রাগারাগি তো হয়নি। টুকটুকি আঁচল সরাল।

ও। ঊর্মিলার মনে হল আর এগোনো অনুচিত। ওই বউদের অনুমান যদি ঠিক হয়, টুকটুকির শারীরিক গোলমালের জন্যেই ওর স্বামী যদি ওকে ত্যাগ করে তাহলে সেই ব্যক্তিগত কথা জিজ্ঞাসা করে ওকে লজ্জায় ফেলার অধিকার তার নেই। অথচ চট করে এখান থেকে অন্য বউদের মতো চলে যেতেও ঊর্মিলা পারছিল না। সে বলল, বিয়ের আগে তো তুমি পড়াশুনা করতে। তাই না?

আমি এইটে উঠেছিলাম। একটু অবাক হল টুকটুকি অন্যধরনের প্রশ্নে।

আমি বলি কি, আবার পড়াশুনা শুরু করো।

পড়াশুনা?

হ্যাঁ। পড়াশুনা করে নিজের পায়ে দাঁড়ালে দেখবে আর কেউ তোমাকে তার ইচ্ছেমতন কষ্ট দিতে পারবে না। তোমাকে অন্যের অন্যায় মেনে নিতে হবে না।

কিন্তু। টুকটুকি হঠাৎ উদাস হয়ে গেল।

কিন্তু কী?

আমার যে আর পড়াশুনা ভাল লাগে না। বিয়ের জল গায়ে পড়লে সরস্বতী আর দয়া করেন না। সরল বিশ্বাসে কথাটা বলল টুকটুকি।

ধ্যেৎ। কে বলেছে তোমাকে এই বাজে কথা?

মা। মা বাজে কথা বলবে কেন? কোন মা নিজের মেয়ের খারাপ চায়? তুমি এমন কথা বলেছ শুনলে মা খুব রাগ করবে। টুকটুকি চোখ ঘোরাল।

ঊর্মিলা অস্বস্তিতে পড়ল। টুকটুকির মায়ের কণ্ঠস্বরের খ্যাতি এ বাড়িতে রয়েছে। মেয়ের কাছে খবর পেয়ে তিনি শান্ত থাকার পাত্রী নন। এটা কমলেন্দু পছন্দ করবে না। ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাকে একটু নত হতে হল, দূর। জেঠিমা ভুল বলবেন কেন? উনি কত জানেন। কিন্তু আমি যা বলেছি তুমি সেটা বুঝতে পারেনি। তুমি যদি বরের সঙ্গে ভালভাবে সংসার করো তাহলে আলাদা কথা কিন্তু যদি তোমাকে একা থাকতে হয় তাহলে ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিজের পায়ে তো দাঁড়াতে হবে। তাই পড়াশুনা করলে সরস্বতী নিশ্চয়ই সদয় হবেন।

তার মানে তুমি বলতে চাইছ তিনি আমাকে কোনওদিন ফেরত নেবেন না।

কেন নেবে না? নেবে না বললেই হল। বিয়ের পর স্বামীর ঘরে থাকা স্ত্রীর অধিকারের মধ্যে পড়ে। তুমি চলে গেলে কার সাধ্য তোমাকে তাড়িয়ে দেয়।

দেবে।

কেন দেবে?

আমাতে তাঁর মন বসেনি। আবার মুখে আঁচল তুলে কান্না সামলাল টুকটুকি। দ্রুত চলে গেল সিঁড়ির দিকে, চোখের আড়ালে। ঊর্মিলা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অল্পবয়সী সরল একটি মেয়েকে দেখেশুনে বিয়ে করার পর কদিন যেতে না-যেতেই সেই লোকটি বুঝে গেল তার মন বসছে না? মামার বাড়ি? ঊর্মিলার খুব রাগ হচ্ছিল। সে ধীরে ধীরে ফিরে এল তাদের ঘরে। দরজা ভেজানোই ছিল।

ঊর্মিলাকে এ বাড়ির অনেকেই ঈর্ষা করে। ভাগ্যগুণে বিয়ের আগেই তার শাশুড়ি গত হয়েছিল এবং বিয়ের দু বছরের মধ্যেই শ্বশুর মারা যায়। যেহেতু কমলেন্দুর কোনও ভাইবোন নেই তাই নিজের ইচ্ছেমতন সংসার করতে পারছে ঊর্মিলা, এই ব্যাপারটা এ বাড়ির অনেকেই সহজ মনে নিতে পারছে না।

কমলেন্দু খাটে শুয়েছিল পাশ ফিরে। তার হাতে বই। বই পড়াই তার একমাত্র নেশা। রোগা ফরসা ছিপছিপে মধ্যবয়সী মানুষটির সংসার চলে ডিভিডেন্ড-এর টাকায়। পিতৃপুরুষ যেসব শেয়ার কিনে গিয়েছিলেন, কোম্পানি লাভবান হওয়ায় তা থেকে ভাল ডিভিডেন্ড আসছে। বইয়ের প্রতি তার আসক্তি বউয়ের থেকে বেশি, এরকম অভিযোগ ঊর্মিলা প্রায়ই করে থাকে। কিন্তু এই বিশাল বাড়ির কোনও সংসারেই কমলেন্দুর মতো পড়ুয়া নেই বলে ঊর্মিলার মনে একটা অন্যধরনের ভাল লাগাও তৈরি হয়।

স্ত্রীকে ঢুকতে দেখে বই থেকে চোখ না সরিয়ে কমলেন্দু জিজ্ঞাসা করল, কী? আজ এত তাড়াতাড়ি পি এন পি সি শেষ হয়ে গেল?

তাতে তোমার কি অসুবিধে হচ্ছে?

আমার কেন অসুবিধে হবে! তাড়াতাড়ি চলে এলে তাই বলছি।

তুমি আজকাল বড় চিমটি-কেটে কথা বল!

কমলেন্দু পাশ ফিরে স্ত্রীর দিকে তাকাল, তাই?

হ্যাঁ, তাই।

মেজাজ বিগড়েছে মনে হচ্ছে! কী ব্যাপার?

ঊর্মিলা জানলার কাছে গেল। শিবমন্দিরের মাইকে সন্ধ্যা মুখার্জি বেজেই যাচ্ছে। সে মাথা নাড়ল, মেয়েদের সবচেয়ে বড় শত্রু হল মেয়েরাই।

একশোবার। ঘটনাটি জানতে পারি?

তোমার ন’জ্যাঠার মেয়ে টুকটুকি আজ ছাদে এসেছিল।

ন’জ্যাঠার মেয়ে?

কয়েক মাস আগে যার বিয়ে হয়েছিল।

ও! তা বাপের বাড়ি এলে ছাদে যেতেই পারে। এতে অন্যায়টা কোথায়?

আমি বলেছি সেকথা?

না বলোনি, তবে লোকে ভাবে বিকেলবেলায় মেয়েরা ছাদে উঠলে কোনও না কোনও মতলব কাজ করে। ছাদের যে দিকটা রাস্তার গায়ে সেইখানে একসময় এক মানুষ উঁচু পাঁচিল ছিল যাতে রাস্তা থেকে কেউ মেয়েদের দেখতে না পায়।

পাঁচিলটা ভাঙল কে?

ভূমিকম্পে। আমাদের ছোটবেলায়। কিন্তু টুকটুকি ছাদে এসেছিল বলে তুমি কী যেন বলছিলে? কমলেন্দু বিছানায় উঠে বসে বইটা বন্ধ করল। ঊর্মিলা বইয়ের মলাটে নাম দেখতে পেল। রবীন্দ্রনাথের ‘স্ত্রীর পত্র’। রবীন্দ্ররচনাবলি কেনেনি কমলেন্দু। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সমস্ত গল্প উপন্যাস কবিতার বই আলাদা করে কিনে আলমারি ভরেছে। প্রায়ই সে রবীন্দ্রনাথ পড়ে। ওইসময় ওকে বেশ পবিত্র দেখায়।

মেয়েটা বড় অদ্ভুত। অবশ্য ওকে একা দোষ দিয়ে লাভ নেই। বেশির ভাগ মেয়ের তো একই দশা। বিয়ের পর স্বামীর পছন্দ হয়নি, বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। বউকে আর ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে না। কোনও প্রতিবাদ নেই, আইনিব্যবস্থার কথা ভাবা হচ্ছে না, টুকটুকি বুকে পাথর নিয়ে বসে আছে।

তো কী করবে? জোর করে স্বামীর বাড়ির দরজা ভেঙে ঢুকবে?

তা কেন? নিজের পায়ে দাঁড়াক।

হেসে উঠল কমলেন্দু, সোজা কথা? বি এ, এম এ পাস করে ছেলেরা ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, পায়ের তলায় মাটি পাচ্ছে না, বাজে কথা বোলো না তো।

তাই বলে মেয়েটার ভবিষ্যৎ কেউ ভাববে না?

 ভাববে ওর মা বাবা! তোমাকে আমি অনেকবার বলেছি এ বাড়ির অন্য পরিবারে কী ঘটছে তা নিয়ে তুমি কখনও মাথা ঘামাবে না। অন্যের ব্যাপারে নাক গলানো ঠিক নয়। তুমি সেই একই কাজ করতে চলেছ! এখন যদি ন’জ্যাঠা এসে আমাকে চার্জ করে আমি কী জবাব দেব সেটা ভেবে দেখেছ?

চার্জ করবেন?

হ্যাঁ। তার মেয়েকে তুমি বিষিয়ে দিচ্ছ! কমলেন্দু বই তুলে নিল।

ঊর্মিলা নিশ্বাস ফেলল, কী গল্প পড়ছ তুমি?

কমলেন্দু হেসে বলল, স্ত্রীর পত্র।

ঊর্মিলা দ্রুত এগিয়ে গেল স্বামীর কাছে। হাত থেকে বইটা টেনে নিয়ে উন্মাদের মতো পেপারব্যাক বইটি ছিঁড়তে লাগল। হাঁ হাঁ করে উঠল কমলেন্দু, কী করছ? আরে? রবীন্দ্রনাথের বই ওটা। আমার ওপর রাগ করে রবীন্দ্রনাথের বই ছিঁড়ছ?

তোমার ওপর রাগ করে কে বলল? রাগ তার ওপরই কেউ করে যার কাছে আশা করা যায়। রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীর পত্র পড়ার কোনও যোগ্যতা তোমার নেই। মৃণালকে অপমানের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে এই বই ছিঁড়ে ফেললাম। দু হাতে টুকরোগুলো ওপরে ছুঁড়ে দিল সে। ঘরের পাখার বাতাস তা ছড়িয়ে দিল চারপাশে। কমলেন্দু কোনও শব্দ খুঁজে পাচ্ছিল না।

.

সন্ধ্যা মুখার্জির গান শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন কিশোরকুমার বাজছে। একদিন পাখি। মেয়েটি আলসেতে ঝুঁকে গান শুনছিল। হঠাৎ তার শরীরে অস্বস্তি শুরু হল। তলপেটে যে ব্যথা তার সঙ্গে সে অপরিচিত। এবং তখনই মনে হতে লাগল ইজের ভিজে গেছে। সে চারপাশে তাকাল। গল্প-করা বউয়েরা, খেলতে ব্যস্ত মেয়েদের চেহারাগুলো তার কাছে ঝাপসা হয়ে গেল। একটা তীব্র ভয় তাকে জড়িয়ে ধরতেই সে চিৎকার করে ছুটতে লাগল তাদের দরজার দিকে। সে ছুটছে না বাতাসে উড়ে যাচ্ছে সেই বোধ তার ছিল না। ছাদের ভিড়টা নিজেদের ভুলে গিয়ে ওর যাওয়াটা দেখছিল। ঘরে ঢুকেই সে বাবাকে দেখতে পেল। জানলার পাশে চেয়ারে বসে চা খাচ্ছেন। সে ডুকরে উঠল, বাবা, মা কোথায়?

তৃপ্তমুখে বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, কেন? কী হয়েছে টুপুর?

সে চোখ বন্ধ করে চিৎকার করল, মা!

কী হল? অমন করে চিৎকার করার কী হয়েছে? চায়ের কাপ রাখতে রাখতে সমরেন্দ্রনাথ কন্যার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাতেই চমকে উঠলেন। তারপর তাঁকেই চেঁচিয়ে উঠতে শোনা গেল, শুনছ? এ-দিকে এসো! তাড়াতাড়ি।

কৃষ্ণা রান্নাঘরে ছিলেন। মেয়ের চিৎকার তাঁর কানে গেলেও গা করেননি। এবার স্বামীর গলা পেয়ে দ্রুত ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে?

মেয়েকে অদ্ভুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাঁর নজর পায়ের দিকে গেল, কৃষ্ণা তৎক্ষণাৎ বললেন, বাথরুমে যা, বাথরুমে গিয়ে দাঁড়া, আমি আসছি।

সমরেন্দ্রনাথ বাধা দিলেন, আমার সন্দেহ হচ্ছে–! তিনি কথাটা শেষ করলেন না। হ্যাঁ। ঠিকই। কৃষ্ণা মাথা নাড়লেন।

তাহলে কিছু করার আগে মায়ের সঙ্গে কথা বলো। এ ব্যাপারে এ বাড়ির কিছু রীতি আছে বলে শুনেছি। রীতি লঙ্ঘন কোরো না। সমরেন্দ্রনাথ অন্য দিকে তাকালেন।

মশা মারতে শেষে কামানদাগা হয়ে যাবে না তো? কৃষ্ণার গলায় বিরক্তি।

হলে হবে। আমাদের কিছু করার নেই।

যাকে নিয়ে এত কথা সে এবার বলে উঠল, তোমরা এসব কী বলছ? আমার কী হয়েছে। আমি তো ইচ্ছে করে কিচ্ছু করিনি।

চুপ। কৃষ্ণা ধমকে উঠল। তারপর গলা তুলে ডাকল, মা, এ-দিকে একটু আসবেন? আপনার ছেলে ডাকছে।

কৃষ্ণার কথা শেষ হতেই মেয়েটি ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল, তারপর ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করল, তুমি যা বলছিলে আমার তাই হয়েছে, না?

এইসময় বৃদ্ধা সৌদামিনী দরজায় এসে দাঁড়াতেই কৃষ্ণা তাকে ঘটনাটা জানাল, সঙ্গে সঙ্গে সৌদামিনীর মুখের চেহারা বদলে গেল, করেছ কী বউমা? এই অবস্থায় ওকে জড়িয়ে ধরতে দিয়েছ? আঃ। ওকে এই ঘরে ঢুকতে দিয়েছ কেন?

কৃষ্ণা থতমত হয়ে বললেন, ছেলেমানুষ তো, ঠিক বোঝানো যায়নি।

ছেলেমানুষ! ওই বয়সে আমাদের সময় বাচ্চা হয়ে যেত। অ্যাই ছুঁড়ি, ছাড়, ছাড় মাকে, সরে দাঁড়া। দাঁড়া বলছি। সৌদামিনী ধমকে উঠলেন।

কেন? সরে দাঁড়াব কেন? আমি কী করেছি?

আশ্চর্য! বউমা, ওকে সরিয়ে দাও।

কৃষ্ণা বলল, তুই দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়া।

গলার স্বরে এমন কিছু ছিল যে মেয়েটি ভয় পেল। মায়ের কাছ থেকে সরে গেল সে। এবার আর এক ধরনের বিস্ময় মেশানো ভয় তাকে আচ্ছান্ন করল।

সৌদামিনী জিজ্ঞাসা করলেন, কখন হল?

কৃষ্ণা মাথার ঘোমটা খোঁপার উপর তুলে দিয়ে বলল, এই তো শুনলাম।

ভাঁড়ার ঘরে একটা বস্তা পেতে দাও, আপাতত ওখানে বসুক। নইলে সারা পৃথিবী ছোঁয়াছুঁয়ি করে দেবে। যাও। সৌদামিনী আদেশ দিলেন।

আমি কেন ভাঁড়ার ঘরে যাব? ওমা, বলো না, ভাঁড়ার ঘরে আরশুলা আছে। না, আমি কিছুতেই যাব না। আমি তো কোনও অন্যায় করিনি। চিৎকার করে কান্না শুরু হল।

সমরেন্দ্রনাথ কয়েক পা এগিয়ে যেতে সৌদামিনী সাবধান করল, খবরদার খোকা, আর এগোসনি। বউমার সঙ্গে তোকেও এই অবেলায় নাইতে হবে।

সমরেন্দ্রনাথ থমকে গেলেন। তারপর যতটা সম্ভব স্নেহ গলায় এনে খানিকটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে বললেন, তুমি এখন বড় হয়েছ, বুঝতে চেষ্টা করো মা! এ বাড়ির যা নিয়ম তা তো মানতেই হবে; আমরা তো কেউ তোমার শত্রু নই। তোমার ভালর জন্যেই ঠাকুমা ভাঁড়ার ঘরে যেতে বলেছেন। যাও, কথা শোনো, লক্ষ্মী মা আমার।

মেয়েটি অদ্ভুত চোখে তার বাবাকে দেখল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, আমাকে কতক্ষণ ওই ঘরে বসে থাকতে হবে?

বেশিক্ষণ নয়। তোমার কোনও কষ্ট হবে না। আমি বলছি তুমি দেখে নিও।

কৃষ্ণা গিয়ে মেয়েকে ভাঁড়ার ঘরে বন্দী করে রেখে এলেন। সৌদামিনীর পরামর্শে শেকল তুলে দিলেন দরজায়। শেকলের শব্দে মেয়ে চিৎকার করে উঠল, ওরা আমাকে ঘরে আটকে রাখছে কেন? সেইসঙ্গে দরজায় শব্দ শুরু হল। কৃষ্ণা ঠোঁট কামড়ালেন কিন্তু সেইসঙ্গে সরেও এলেন।

সৌদামিনীকে এখন চিন্তিত দেখাচ্ছে। কৃষ্ণা ঘরে ঢোকামাত্র তিনি বললেন, এখনই চিঠি লিখে কালোর-মাকে ওপরে পাঠাও।

ওপরে?

হ্যাঁ। উনি যা বিধান দেবেন তাই মানতে হবে। এ বাড়ির নিয়ম।

কী লিখব?

লিখে দাও যা ঘটেছে। খুব ভক্তিভরে লিখবে। জানতে চাইবে এখন কী করণীয়? সৌদামিনীর গলায় বিদ্রুপ ফুটল, মনে হচ্ছে এ বাড়িতে নতুন এসেছ। এর মধ্যে কতবার এমন ঘটনা ঘটেছে তোমার কানে যায়নি বউমা? আশ্চর্য!

.

আঁচলের আড়ালে খাম নিয়ে কালোর-মা হনহনিয়ে হাঁটছিল, বিশাল বাড়ির পথ অনেক বাঁক নিয়ে গোলকধাঁধা হয়ে আছে, অচেনা লোকের তেমনই মনে হবে। সমরেন্দ্রনাথের অংশ যে-দিকে ঠিক তার বিপরীতে যেতে হচ্ছিল কালোর-মাকে। একতলায় নেমে চাতালের সামনে দিয়ে যেতে যেতে মা ভবানীর মূর্তির দিকে একপলক তাকিয়ে নিয়েই মুখ ফিরিয়ে নিল সে। চাতালের শেষে উঁচু ঠাকুরমণ্ডপে মা ভবানীর মূর্তির সামনে বসে ঠাকুরমশাই এখন সন্ধ্যাবাতি দেবার আয়োজন করছেন। তাকে দাঁড়াতে দেখলেই বুড়ো ঠিক ফাইফরমাস করবে।

কালোর মায়ের বয়স আটত্রিশ। এ বাড়িতে কাজে এসেছিল আঠারো বছর বয়সে বাগনান থেকে। খেতে দিতে পারত না বলে স্বামী নিত না। শেষ পর্যন্ত এ বাড়ির এক বুড়ি তাকে কাজটা পাইয়ে দিয়েছিল। তা কুড়ি বছরে অনেক জল গড়াতে দেখেছে সে এবাড়িতে। টিভি-তে একটা সিনেমা দুবার দেখিয়েছিল, সাহেব বিবি গোলাম। দেখে মনে হয়েছিল এবাড়ির সঙ্গে বেশ মিল আছে। কথাটা সে বউদিদিকে বলেছিল। কৃষ্ণা হেসে বলেছিলেন, মিল আছে বলে বইটা সবার ভাল লাগে। আসলে বড়লোকেরা সব একরকম হয়।

উল্টোদিকের বাড়ির সিঁড়ি ভাঙছিল কালোর-মা। চওড়া কম, দুজন লোক পাশাপাশি উঠলে গায়ে গা ঠেকবে। এইসময় নাকে অম্বুরি তামাকের গন্ধ লাগতেই কালোর-মা দাঁড়িয়ে গেল। গন্ধ আসছে সেইসঙ্গে বিদ্যাসাগরি চটির শব্দ। একমাথা ঘোমটা টেনে পেছন ফিরেই কালোর-মা বুঝতে পারল গন্ধরাজ একেবারে পেছনে নেমে এসেছে।

এটা আবার কে গো? কারও বউ-মেয়ে নাকি কাজের লোক?

কালোর-মা জবাব দিল না। গন্ধরাজ আবার বলল, আমার মস্তিষ্ক বিকৃত হয়েছে। এ বাড়ির বউ-মেয়ে এই শাড়ি পড়বে কোন দুঃখে। ও বাছা, নামটি বলো।

আমি কালোর-মা। ফিসফিসিয়ে বলল কালোর-মা।

আই বাপ! তাই তো। পাছা দেখেই আমার চেনা উচিত ছিল। এ-সব বয়স হওয়ার লক্ষণ। সবকটা ইন্দ্রিয় বিট্রে করছে। ওপরে যাচ্ছিস? কার কাছে?

বড়মায়ের কাছে।

কেন রে? সমরেন্দ্রনাথের বাড়িতে কী ঘটল?

আমরা ছোটলোক, বড়লোকের খবর জানব কী করে!

দেখ। যা, উঠে যা। তবে একটা কথা, বেনারস থেকে সরেস পান আনিয়েছি। আজ রাতের বেলায় এসে এক খিলি খেয়ে যাবি? হ্যাঁরে কালোর-মা?

অসুবিধে আছে। কথাটি বলেই পাশ কাটিয়ে দ্রুত উপরে উঠতে লাগল কালোর-মা। বাঁ দিকের সিঁড়ি চলে গেছে গন্ধরাজের ঘরে। ডান দিকেরটা ধরল সে।

ডান দিকে সিঁড়ি একবার পাক খেয়ে যে দরজায় পৌঁছেছে সেটি বন্ধ। কালোর-মা যখন প্রথম এবাড়িতে পা দিয়েছি। তখন কলিং বেলের বোতাম ছিল না, কড়া নাড়তে হত।

দরজা খুলল একজন বৃদ্ধা পরিচারিকা। এর পোশাক-আশাক দেখে পরিচারিকা বলে মনে হয় না। বড়মা যখন দশ বছর বয়সে এবাড়িতে বউ হয়ে এসেছিলেন তখন এর মা তাঁর বাপের বাড়ি থেকে সঙ্গে এসেছিল। সেই সময় এর বয়স ছিল দুই। আট বছর কাজ করার পর মা ফিরে যায় স্বামীর ঘরে, মেয়েকে পাঠিয়ে দেয় বড়মায়ের সঙ্গিনী হয়ে থাকতে। সেই দশ বছর বয়স থেকে বড়মায়ের পাশে ছায়ার মতো রয়েছে, এই দরজার বাইরে পা দিয়েছে যখন বড়মা কোথাও গিয়েছে। বিয়ে-থা হয়নি, ও চায়নি না বড়মা দেয়নি এ নিয়ে এককালে কৌতূহল ছিল। কিন্তু এ বাড়ির পুরুষদের লকলকে চাহনি থেকে ও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিল বড় মায়ের আড়ালে থেকে। বৃদ্ধার নাম আতরবালা। আতরবালা জিজ্ঞাসা করল, কী চাই?

চিঠি আছে বড়মায়ের।

কোন তরফ?

আহা, আমাকে দ্যাখোনি তুমি! এই নাও। চিঠি তুলে দিল কালোর-মা।

এখানে দাঁড়াও।

আতরবালা চিঠি নিয়ে বড় ঘর পেরিয়ে পর্দা সরিয়ে বলল, চিঠি এসেছে। লম্বা গদিওয়ালা ইজিচেয়ারে শুয়েছিলেন বড়মা। শরীরের চামড়া কুঁচকে এলেও তার রঙের আভিজাত্য চলে যায়নি। এই ভর বিকেলে দামি শাড়ি পরে সাদা চুলে খোঁপা বেঁধে জানলা দিয়ে আকাশ দেখছিলেন তিনি। সেই অবস্থায় মৃদু গলায় ডাকলেন, নাতবউ, এদিকে এসো।

ডাকামাত্র ওপাশের ঘর থেকে একটি তরুণী যাকে প্রতিমার মতো দেখতে নম্র পায়ে এগিয়ে এল, বলুন ঠাম্মা।

চিঠিটা পড়ো।

তরুণী খাম খুলে চিঠি বের করল। এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে পড়া শুরু করল, পরম শ্রদ্ধেয় বড়মা, শতকোটি প্রণাম নিবেদন করিয়া জানাইতেছি যে আমার পুত্র সমরেন্দ্রনাথের একমাত্র কন্যা টুপুর ত্রয়োদশ বৎসর বয়সে আজ অপরাহে প্রথম রজঃদর্শন করিয়াছে। তাহাকে সঙ্গে সঙ্গে আলাদা ঘরে বিচ্ছিন্ন করিয়া রাখিয়াছি। এমন অবস্থায় আপনার আদেশের জন্য এই পত্র দাসীর মাধ্যমে পাঠাইলাম। শতকোটি প্রণাম অন্তে সৌদামিনী দেবী।

বিশাল শরীরটি ইজিচেয়ার থেকে সামান্য তুলে বড়মা খানিকক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে রইলেন। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, পাঁজি আর চশমা।

আতরবালা দ্রুত ছুটে গিয়ে সেই দুটি বস্তু নিয়ে এলে বৃদ্ধা চোখে চশমা এঁটে পাতা খুললেন, সৌদামিনীর বয়স হল এখনও ভাল করে চিঠি লিখতে শেখেনি।

আতরবালা বলল, আমার মনে হয় ওঁর বউমা লিখে দিয়েছে।

পাঁজির পাতায় চোখ রেখে বড়মা বললেন, হুঁ।

মিনিটখানেক পড়াশুনা করে তিনি মুখ তুললেন, রাত দশটা বত্রিশ থেকে চল্লিশ। আতর বলে দে ওই সময় যেন ঠাকুরদালানে মেয়েটাকে নিয়ে আসে। যে অবস্থায় আছে ঠিক সেই অবস্থায় নিয়ে আসতে হবে। সেইসময় এ বাড়ির সব আলো নেবানো থাকবে। পুরুষমানুষেরা যেন তখন ঘরের বাইরে না বের হয়।

.

খবরটা সব শরিকের কাছে পৌঁছোল।

নন্দিনী সোয়েটার বুনছিলেন, ওই গরমের সময়েও, হেনা ঢুকে জিজ্ঞাসা করল, শুনেছ?

নন্দিনী মাথা নাড়লেন, হুঁ।

আশ্চর্য, শুনে চুপ করে থাকবে? এই টি ভির যুগে এমন আদিম আচরণের কোনও প্রতিবাদ করবে না? শোনার পর আমার মাথা গরম হয়ে গিয়েছে। হেনা সশব্দে চেয়ার টানল।

নন্দিনী বললেন, মাথা ঠাণ্ডা রাখ। এ বাড়ির যা নিয়ম তা এ বাড়িতে থাকলে মেনে চলতেই হবে। তোর আমার ভাগ্য ভাল যে মেয়ে নেই।

থাকলে তুমিও এই নিয়ম মেনে চলতে?

এ বাড়ির ছেলেরা যদি মানে আমি না মেনে কী করে পার পাব।

উঃ। ওই বুড়িটাকে পুড়িয়ে মারা উচিত।

চুপ! কথাটা কানে গেলে বুড়ি কী করবে জানিস? তোর বরও তোকে সাপোর্ট করবে না। গলার স্বর পাল্টালেন, এসব আমারও মেনে নিতে ইচ্ছে করে না হেনা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে আড়ালে আবডালে ঝগড়াঝাটি যাই হোক না কেন, বড় মায়ের বিরুদ্ধে একটি কথাও এ বাড়ির কেউ বলবে না। যাক গে, বরের চিঠি পেলি?

হ্যাঁ। তোমার দেওর তো এখন সিমলের পাহাড়ে ফুর্তি করছেন।

আহা গেছে বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে, সেখানে তোকে নিয়ে যাবে কী করে?

আমি তো আমাকে নিয়ে যেতে বলিনি। আমি বলেছিলাম পাহাড়েই যখন যাচ্ছ তখন দার্জিলিং-এ যাও। ছেলেটার সঙ্গে কয়েকদিন কাটিয়ে এসো। শুনলই না।

চল, তোতে আমাতে গিয়ে সায়নকে দেখে আসি।

যাবে? চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল হেনার। তার পরেই বিমর্ষ হয়ে গেল সে, দুর! ও ফিরে না আসা পর্যন্ত কোথাও যাওয়া হবে না। শাশুড়ি ছিঁড়ে খাবে।

এখন শান্ত আছে?

শান্ত? চিতায় না ওঠা পর্যন্ত শান্ত হবে না। জীবনে তো অনেক পেয়েছেন মহিলা তবু সন্দেহ করতে ওর ভাল লাগে কেন বলো তো? আর কাউকে না পেয়ে শ্বশুরকেই সন্দেহ করছেন আমার ব্যাপারে। ভাবতে পারো?

ধ্যেৎ। কী যে বলিস?

সত্যি বলছি। তুমি একদিন কথা বলে দ্যাখো। এখন মাঝে মাঝে মনে হয় বিয়ে-থা না করে কুমারী হয়ে থেকে গেলে ঢের ভাল হত। হেনা বলল।

নন্দিনী মাথা নাড়লেন, সেটা কী করে হবে? আমাদের দেশে মেয়েরা বিয়ে করে না, বিয়ে করে ছেলেরা, মেয়েদের বিয়ে হয়।

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার