অবাক হয়ে গেল অর্জুন, তুমি আমেরিকায় যাবে?

হ্যাঁ রে, এবার না গিয়ে উপায় নেই। জামাইয়ের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। মেয়ে ফোন করেছিল, অবস্থা ভাল নয়। ওকে সংসার দেখতে হচ্ছে, হাসপাতালে ছুটতে হচ্ছে দু বেলা। বলল, মা, যদি পারো চলে এসো।

সুধামাসি একদমে কথাগুলো বলে গেলেন।

সুধামাসির মেয়ে বছর দুয়েক আগে এসেছিলেন তাঁর ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে। একদিন দেখাও হয়েছিল। আমেরিকায় যাঁরা থাকে তাঁদের মতো চেহারা। মায়ের কাছে শুনেছে সে, অনেক অনুরোধ করা সত্ত্বেও সুধামাসি দুর্ঘটনার খবরে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, এটা অস্বাভাবিক নয়।

কীসের দুর্ঘটনা হয়েছে ওঁর?

ফোনে তো মেয়ে কিছুই বলল না। তারপর থেকে আমি স্বস্তি পাচ্ছি না।

এখানে এসেছ কেন

ওই যে শুনলাম, একজন তান্ত্রিক নাকি ভূত তাড়াবে। এসব তো কখনও বিশ্বাস করিনি তাই ভাবলাম নিজের চোখে দেখে আসি। তা সন্ধেবেলার আগে তো কিছু হবে না। এসব থাক, ততার সঙ্গে আমার কথা আছে। তুই আমার বাড়িতে যাবি?

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ওরা পৌঁছে গেল। সুধামাসির বাড়ি অনেকটা জমিজমা গাছগাছালি নিয়ে। মেসোমশাইয়ের বাবা রায়বাহাদুর ছিলেন। প্রচুর সম্পত্তি রেখে গিয়েছিলেন তিনি। মেসোমশাই এখানকার কলেজে পড়াতেন। পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। হঠাৎই দু দিনের অসুখে মারা গিয়েছিলেন তিনি। এখন এত বড় বাড়িতে সুধামাসি থাকেন বিশ্বস্ত কর্মচারীদের নিয়ে। ব্যাঙ্কের সুদ বাবদ যা পান তা এসব খরচ চালানোর পক্ষে পর্যাপ্ত।

বাইরের ঘরে পূর্বপুরুষদের ছবি টাঙানো। দেওয়াল জুড়ে স্মৃতি আর স্মৃতি। পুরনো আমলের সোফায় বসে সুধামাসি বললেন, আমাকে যেতেই হবে রে! মুশকিল হল, আমি তো একা কখনও কোথাও যাইনি তাই সঙ্গে তুই গেলে ভাল হয়।

আমার কথা মনে পড়ল কেন? অর্জুন হাসল।

তুই তো এর আগে একবার গিয়েছিলি। রাস্তাঘাট চিনিস। তোর মাকে বলেছিলাম, সে বলল তোর সঙ্গে কথা বলবে। এখন তোর হাতে জরুরি কাজ আছে?

এই মুহূর্তে নেই।

তা হলে চল বাবা। সেরকম হলে আমাকে পৌঁছে দিয়েই চলে আসবি।

অর্জুন আবার হাসল, তুমি এমনভাবে বলছ যে, দার্জিলিং মেলে কলকাতায় তোমাকে পৌঁছে দিয়ে সেই সন্ধেবেলায় ট্রেন ধরে ফিরে আসা। কবে যেতে চাও?

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

কিন্তু তোমার পাশপোর্ট আছে?

হ্যাঁ। দু বছর আগে মেয়ে এসে জোর করে দরখাস্ত করিয়েছিল, মাসতিনেক বাদে ডাকে সেটা এসেছিল। পাশপোর্ট ছাড়া তো যাওয়া যায় না। তুই এখন বল, চেনাজানা কার পাশপোর্ট আছে বুঝব কী করে? তুই গিয়েছিলি বলে জানি তোর আছে।

অর্জুন বলল, শোনো, যাব বললেই যাওয়া যাবে না কিছু নিয়মকানুন আছে। কলকাতায় গিয়ে ভিসার জন্যে আবেদন করতে হবে আমেরিকান কনস্যুলেটে। তারপর কবে টিকিট পাওয়া যাবে তার ওপর যাওয়া নির্ভর করছে।

সুধামাসি মাথা নাড়লেন, এসব মেয়ে আমাকে ফোনে বলেছে। ওর চেনা একটা অফিস আছে কলকাতায়, যারা সব ব্যবস্থা করে দেবে। আমি নাম-ঠিকানা লিখে রেখেছি। তুই বললে আজকালের মধ্যে এক লাখ টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে ফেলব।

অত টাকা কেন?

মেয়ে যে বলল ওইরকম লাগবে।

তা হলে ট্রাভেলার্স চেকে নিয়ো। আমি মায়ের সঙ্গে কথা বলছি।

তোর মা বলেছে তার আপত্তি নেই। আমরা আগামীকালই কলকাতায় রওনা দিই। সেখানে কয়েকদিন থেকে যত তাড়াতাড়ি পারি প্লেনে উঠব।

হাঁ?

বেশ।

 

বাড়িতে ফিরে মাকে সে জিজ্ঞেস করল, আমেরিকায় যাওয়ার ব্যাপারটা জেনেও তুমি আমাকে কিছু বলেনি কেন?

মা হাসলেন, যে যেতে চাইছে তার মুখ থেকে শোনাই তো ভাল। কী বলেছিস?

কাল যেতে চাইছেন উনি।

ঠিক আছে।

তুমি একা থাকতে পারবে?

আহা কী কথা! যখন তুই এখানে-ওখানে যাস তখন কে থাকে আমার সঙ্গে।

বেশ। আমি চেষ্টা করব দিন সাতেকের মধ্যে ঘুরে আসতে।

হ্যাঁ রে, ভূত দেখেছিস?

না। দিনের বেলায় নাকি হবে না, সন্ধের অন্ধকার নামলে তবে ভূত নামবেন ওবাড়িতে। যতসব বুজরুকি।

তুই কী কী নিয়ে যাবি বল, সুটকেসে গুছিয়ে রাখব।

তুমি তো জানো। গতবার যা-যা নিয়ে গিয়েছিলাম, তাই দিয়ো।

 

গোরক্ষনাথ চিৎকার করে মন্ত্র পড়ছিল।

এখন সন্ধে পেরিয়ে গেছে। বিরাট উঠোনের মাঝখানে আসনে বসে আছে গোরক্ষনাথ। তার সামনে সেই বৃদ্ধা বাবু হয়ে বসে আছেন মাথায় সাদা কাপড়ের ঘোমটা টেনে। নানারকমের শ্রাদ্ধের উপচার ছাড়াও তিন-তিনটি খাঁচা রাখা হয়েছে সামনে। আর ওদের ঘিরে বৃত্তাকারে জমজমাট ভিড় নিশ্ৰুপ হয়ে রয়েছে। অর্জুন সেই ভিড়ের সামনে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে গোরক্ষনাথকে লক্ষ করছিল।

মন্ত্র পড়া আচমকা থামিয়ে গোরক্ষনাথ বলল, মানুষের চেয়ে আত্মারা অনেক বেশি বুদ্ধিমান হয়। মানুষ নিজেকে লুকোতে পারে না কিন্তু আত্মা পারে, এটাই ওদের সুবিধে। কিন্তু মা, আপনার স্বামী ছিলেন বিষয়ী মানুষ। মারা যাওয়ার পরেও তিনি বিষয়ের মায়া ত্যাগ করতে পারছেন না। আমরা যে তাঁর মুক্তির ব্যবস্থা করেছি এখানে, এটা তাঁর সহ্য হচ্ছে না বলে তিনি দূরে-দূরে আছেন এখন। কিন্তু তাঁকে আসতেই হবে। আর তিনি এলে তাঁকে দেখতে পাবে ওরা। ওই কালো বেড়াল, কানা কাক আর খোঁড়া শকুন। ফাঁকি দিতে পারবে না।

এবার অর্জুন কথা বলল, কিন্তু কাক শুনেছি কানাই হয়।

গোরক্ষনাথ মুখ ঘুরিয়ে অর্জুনকে দেখে হাসল, ও, আপনি এসে গিয়েছেন। ভালই হল, ভগবানে যারা বিশ্বাস করেন ভূতে তাদের অবিশ্বাস হবে কেন? হ্যাঁ, আপনি যা শুনেছেন তা অর্ধসত্য। কাক একসঙ্গে দু চোখে দেখতে পায় না বলে মাথা ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে দ্যাখে। এ-চোখ যখন দ্যাখে তখন অন্য চোখ দৃষ্টিরহিত হয়ে যায়। কিন্তু এই কাকটি সত্যিকারের কানা। কানা বলে ওর দৃষ্টিশক্তি বেশি। অত দূরে কেন, আপনি এখানে আসুন না!

না, ঠিক আছি।

গোরক্ষনাথ বলল, এবার এখানকার সব আলো নিভিয়ে দেওয়া হোক।

সঙ্গে সঙ্গে উঠোন, বারান্দা এবং ঘরগুলোর আলো কেউ নিভিয়ে দিল। গোরক্ষনাথ বলল, মা, আপনার সামনে কলাপাতায় পিণ্ড রাখা আছে। তুলে নিন, পেয়েছেন?

মহিলার নিচু গলা শোনা গেল, হ্যাঁ।

বেশ! আমি বলামাত্র ওই পিণ্ড সামনে ফেলে দেবেন। তারপরেই তার গলা থেকে সংস্কৃত শব্দ বের হতে লাগল। অর্জুন যার বাংলা করল এভাবে, হে প্রেত, তুমি অশান্ত। তোমার এই অতীত বাড়িতে ফিরে আসছ যে টানে তা অবাস্তব। তোমার আবিভাব এখানে কাম্য নয়।

অর্জুন দেখল অন্ধকারে বেড়ালের চোখ জ্বলছে। হঠাৎ কাকের ডাক শোনা গেল এবং সেইসঙ্গে পাখা ঝাপটানোর আওয়াজ। সেটা যে শকুন করছে তা অনুমান করা গেল। গোরক্ষনাথ চিৎকার করে উঠল, আমি জানি তুমি এখানে উপস্থিত হয়েছ। ওই কালো বেড়াল, কানা কাক আর খোঁড়া শকুন নিশ্চয়ই তোমাকে দেখতে পাচ্ছে। তুমি ধরা পড়ে গিয়েছ। অতএব হে প্রেত, এই পিণ্ড গ্রহণ করে তুমি বাসনামুক্ত হয়ে যাও। মা, পিণ্ডটা ফেলুন এবারে।

কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ। তারপর গোরক্ষনাথ হাঁকল, কে আছ, আলো জ্বালো।

দপ্ করে চারপাশ আলোকিত হতে দেখা গেল বৃদ্ধা উপুড় হয়ে রয়েছেন। নিজের আসনে খাড়া হয়ে বসে আছে গোরক্ষনাথ। অর্জুন দেখল, বেড়াল

অথবা শকুন এখন শান্ত হয়ে খাকলেও কাকটা কাত হয়ে পড়ে রয়েছে।

গোরক্ষনাথ আসন ছেড়ে এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে দেখল মাটিতে পড়ে থাকা চালকলার পিণ্ডটিকে। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করল কিছু।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কী হল?

অতি শয়তান প্রেত। পিও গ্রহণ করেনি।

কী করে করবে? আপনি সংস্কৃতে যা বলছিলেন তা ওর পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়? বেঁচে থাকতে সাধারণ বাঙালির মতো সংস্কৃত বুঝতে উনিও নিশ্চয়ই পারতেন না।

আপনি রসিকতা করছেন বাবু?

মোটেই না। ভেবে দেখলে বুঝতে পারবেন আমি সত্য বলছি। অর্জুন বলল, আগে লোকে সংস্কৃত পড়ত, তাদের প্রেতরা তাই মন্ত্র বুঝতে পারত।

গোরক্ষনাথ কাত হয়ে পড়ে থাকা কাকটাকে দেখাল, ওর এই অবস্থা কী করে হল?

অর্জুন এগিয়ে গিয়ে কাকটাকে দেখল। ঘাড় মটকে গিয়েছে।

গোরক্ষনাথ বলল, এ প্রেত স্বাভাবিক প্রেত নয়। আজ কাকের ওপর ওর ক্রোধ মিটিয়েছে। কিন্তু এখানেই আছে সে। বলমাত্র একটা ঝাঁটা তুলে নিয়ে গোরক্ষনাথ বারংবার মাটিতে মারতে লাগল, সেইসঙ্গে বিড়বিড় করে মন্ত্রপাঠ চলল। হয়তো সেই ঝটার শব্দেই খাঁচায় বসা শকুনটা নড়েচড়ে উঠল। বারংবার ন্যাড়ামাথা ঘোরাতে লাগল। গোরক্ষনাথ ছুটে গেল। চিৎকার করে বলল, খবরদার। ওর গায়ে হাত দিলে তোর সর্বনাশ হয়ে যাবে। হাতের ঝাঁটা দিয়ে একটা জায়গায় দ্রুত বৃত্ত আঁকল যেন গোরক্ষনাথ। তারপর বলল, থাক এখানে বন্দি হয়ে।

গোরক্ষনাথকে এখন কিছুটা প্রসন্ন দেখাল। চিৎকার করে বলল, আপনারা এখন চলে যান। আত্মা বন্দি হয়ে আছে। ছাড়া পেয়ে গেলে আপনাদের ক্ষতি করতে পারে। যান আপনারা। সঙ্গে সঙ্গে দুমদাম করে মানুষজন পালাতে আরম্ভ করল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বাড়ি ফাঁকা।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি ওঁর আত্মাটাকে বন্দি করেছেন?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

কিন্তু ওখানে আত্মা আছে তা বুঝব কী করে?

একটা মাটির পাত্র থেকে কালো তিল মুঠোয় নিয়ে সেই জায়গাটায় ছুড়ে-ছুড়ে মারতে লাগল গোরক্ষনাথ, কী, চলে যাবি? আর আসবি না তো? কথা দিচ্ছিস? বেশ, যাওয়ার আগে ওই পিণ্ডর দুলাটাকে ভেঙে দিয়ে যা। ঝাঁটা নিয়ে উলটোদিক থেকে বৃত্ত আঁকল গোরক্ষনাথ। তারপর একদৃষ্টিতে তাকাল মাটিতে পড়ে থাকা চালকলার পিণ্ডটির দিকে। গোরক্ষনাথের মুখে হাসি ফুটল, দেখুন বাবু, ওটা ভেঙে দিয়ে গেল। বলে আর দাঁড়াল না। গোরক্ষনাথ। উঠোন পেরিয়ে পাশের একটা ঘরে ঢুকে গেল।

অর্জুন এগিয়ে গিয়ে পিণ্ডটাকে দেখল। সত্যি চিড় ধরেছে মাঝখান থেকে। কিন্তু এই চিড়টা যে আগে থেকে ছিল না তার কোনও প্রমাণ নেই। মাটিতে পড়ে থাকতে-থাকতে অনেকসময় আপনা থেকেই চিড় ধরতে পারে। সে কাকের খাঁচাটার কাছে গেল। ঘাড় ভেঙে রক্ত বেরিয়ে এসেছে।

বৃদ্ধাকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হল। চোখের সামনে যা ঘটে গেল তার সত্যতা অস্বীকার করে লাভ নেই। প্ৰেত এসে কাকের গলা টিপে মেরেছে এ খবরটা চাউর হবেই। অর্জুন বারান্দায় উঠে যে ঘরে গোরক্ষনাথ ঢুকেছিল সেখানে গেল। মেঝের ওপর পাটি পেতে গোরক্ষনাথ শুয়ে পড়েছে এর মধ্যে। অর্জুন পাশের তক্তপোশে বসল, প্রেত আছে কিনা তা প্রমাণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু আজ এখানে প্রেত আসেনি।

আপনি বললে তো হবে না, সবাই দেখেছে। গোরক্ষনাথ হাসল।

পকেট থেকে সাপের লকেটটা বের করল অর্জুন। সামনে ধরে বলল, এ জিনিস মাটির নীচে পোঁতা থাকলে যদি বাড়িতে কোনও অশুভ ব্যাপার না ঘটে তা হলে মাটির ওপর পকেটে থাকলে কোনও প্রেতের আসা উচিত নয়। তাই না?

গোরক্ষনাথের চোখ জ্বলে উঠল। তড়বড়িয়ে উঠে বসে বলল, এ কী! এ জিনিস আপনি কোথায় পেলেন?

আপনি আমার প্রশ্নের জবাব দিন।

লকেটটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে গোরক্ষনাথ বলল, হ্যাঁ, সেই জিনিস। পৃথিবীতে মাত্র দুটো আছে। একটা আমার গুরু আমাকে দিয়েছিলেন। বড়বাবুর মঙ্গলের জন্যে আমি তাঁর বাড়ি বেঁধে রেখেছিলাম একে দিয়ে। আপনি মাটি খুঁড়েছেন বাবু?

আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।

গোরক্ষনাথের মাথা নেমে গেল, হ্যাঁ, আজ আমাকে অভিনয় করতে হয়েছিল। কিন্তু এ বাড়ির কাছেই সেই দুষ্ট আত্মা আছে। অনেক চেষ্টা করেও তাকে না আনতে পেরে মানুষকে বোঝাতে অভিনয় করতে হয়েছিল আমাকে।

আপনার ভান হাত তুলুন তো?

গোরক্ষনাথ তার হাত তুলতেই বোঝা গেল রক্ত শুকিয়ে রয়েছে আঙুলে। গোরক্ষনাথ বলল, আপনি ঠিকই ধরেছেন, কাকটাকে আমিই মেরেছি। না মারলে লোকে বিশ্বাস করত না। এখন বুঝতে পারছি ওই লকেটটার জন্যে প্রেত এই বাড়িতে পা দেয়নি। ওটা আমাকে দিন।

কেন?

ওটা আমার জিনিস। ভয়ঙ্কর জিনিস। মাটিতে পোঁতা না থাকলে প্রচণ্ড ক্ষতি হয়ে যাবে। অস্তিমুনির ক্রোধ ধ্বংস করে দেবে আপনাকে।

আবার গল্প শোনাচ্ছেন?

না বাবু। নীলার কথা শোনেননি? অনেকের সহ্য হয় না, ধ্বংস হয়ে যায়!

দেখা যাক। আপনি তো মাটির তলায় পুঁতে দিয়েছিলেন, আপনার আর কোনও দাবি থাকতে পারে না। এখন বলুন তো, এটা কে বানিয়েছিল?

গোরক্ষনাথ বলল, আমার গুরুদেব আমাকে মারা যাওয়ার আগে দিয়েছিলেন। তিনি যৌবনে জাহাজে চাকরি করতেন। আফ্রিকার এক বন্দরে কীভাবে জানি না ওটা ওঁর হাতে আসে। খবরটা জানাজানি হয়ে যাওয়ায় একদল আফ্রিকার মানুষ ওঁর পেছনে ধাওয়া করে জিনিসটা ফেরত নেওয়ার জন্যে। গুরুদেব জাহাজে ফিরে এসে রক্ষা পান। পথে জাহাজ ঝড়ের মুখে পড়ে। জাহাজড়ুবি হয়। একটা কাঠ আঁকড়ে তিনদিন ভেসে থাকার পর অন্য জাহাজের লোকজন তাঁকে উদ্ধার করে। সেই ভেসে থাকার সময় গুরুদেবের শরীর যখন অসাড়, জ্ঞান লোপ পেয়ে যাচ্ছে, তখন তিনি অনুভব করতেন একটা বিশাল সাপ তাঁর আঁকড়ে থাকা কাঠটাকে ভাসিয়ে রাখছে। সেই থেকে উনি প্রতিদিন ওই লকেটটাকে নিয়ম করে দুধকলা ভোগ দিতেন। আমাকে তিনি বলেছিলেন, নিয়মের ব্যতিক্রম যেন না হয়। হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে অনেক ভোগ দিয়ে মাটিতে পুঁতে রাখতে। আমি তাই করেছিলাম। দিন বাবু।

দিতে পারি। কিন্তু আপনাকে এটা দিলে আমি সবাইকে ডেকে বলব কাকটাকে আপনি মেরেছেন, কোনও প্রেত যে আসেনি তা আপনিই স্বীকার করেছেন।

না বাবু! দয়া করে অমন কাজ করবেন না। এ বাড়ির চারপাশে প্রেত আছে। আমি আজ সামান্য ছলনার আশ্রয় নিয়েছি ঠিক, কিন্তু–।

আমি চললাম। অর্জুন দরজার দিকে এগোল।

গোরক্ষনাথ ককিয়ে উঠল, যাবেন না বাবু। ওটা সঙ্গে রাখলে আপনার সর্বনাশ হয়ে যাবে। ভয়ঙ্কর জাগ্রত সর্পদেবতা।

অর্জুন বেরিয়ে এসে তার বাইকে চাপল।

 

দার্জিলিং মেল ঠিক সময়েই শেয়ালদায় পৌঁছেছিল। সূর্য সেন স্ট্রিটের একটা হোটেলে ওরা দুটো ঘর ভাড়া করল। স্নান-খাওয়া শেষ করে সুধামাসির পাশপোর্ট সঙ্গে নিয়ে অর্জুন চলে এল থিয়েটার রোডে। এর আগে কলকাতায় কিছুটা পরিচিত হয়েছিল রাস্তাঘাটের সঙ্গে। কিন্তু ভিড় বাসে উঠতে একদম ইচ্ছে করে না ওর। ফলে ট্যাক্সি নিয়েছিল সে। সুধামাসির মেয়ে যে কোম্পানির নাম ফোনে বলেছিলেন তা তিনি লিখে রেখেছিলেন। নাম্বার মিলিয়ে সে যে অফিসটিতে পোঁছল সেটি একতলায়। লম্বা ঘরের দু পাশে মানুষজন কাজ করছেন। ঘরের একপ্রান্তে বড় টেবিলের ওপাশে সৌম্যদর্শন এক প্রৌঢ় বসে আছেন। অর্জুনকে দেখে হেসে বললেন, বলুন।

মিস্টার লাহিড়ী একটু বেরিয়েছেন, আমিই শিবাজি সিন্হা। কোত্থেকে আসছেন?

জলপাইগুড়ি থেকে। অর্জুন বলল, আমরা আমেরিকায় যেতে চাই।

খুব ভাল কথা। পাশপোর্ট এনেছেন?

হ্যাঁ। এই সময় লম্বা ছিপছিপে এক ভদ্রলোক ঢুকতেই শিবাজি সিনহা বললেন, এই যে অরূপ এসে গেছে। অরূপ দ্যাখো তো।

নিজের চেয়ারে বসে অরূপ লাহিড়ী বললেন, বলুন ভাই।

অর্জুন বলল, আমরা জলপাইগুড়ি থেকে আসছি। আমেরিকায় যেতে চাই।

আমরা মানে?

আমি আর একজন বয়স্কা মহিলা।

অরূপ লাহিড়ী অর্জুনের মুখের দিকে তাকালেন একটু, তারপর হাত বাড়ালেন, দিন, পাশপোর্টটা দেখি। অর্জুন দুটো পাশপোর্ট টেবিলে রাখল।

সুধামাসিরটা দেখার পর দ্বিতীয়টা হাতে নিয়ে ছবির সঙ্গে মিলিয়ে অরূপ লাহিড়ী বললেন, এবার কী হবে? ম্যানহাটনে হানটান?

তার মানে?

আরে ভাই, আপনি তো সেই অর্জুন? লাইটারের অর্জুন? আপনার কথা অনেক শুনেছি আমি। এই চা দাও এখানে। বিখ্যাত লোকদের কেন যে তোমরা বুঝতে পারো না। হাতে হাত মেলালেন অরূপ লাহিড়ী।

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার