হাতে কোনও কাজ না থাকলে অমল সোমের বাড়িতে আড্ডা মারার সুযোগ হয়। আর এই সুযোগ মানে অনেক কিছু অজানা তথ্য জেনে নেওয়া। কিন্তু অমল সোম এখন জলপাইগুড়িতে নেই। তিনি আজকাল মাঝে-মাঝেই উধাও হয়ে যান। সত্যসন্ধানে তাঁর তেমন আগ্রহ নেই। এইরকম সময় অর্জুনের খুব খারাপ কাটে। মা এককালে বলতেন, ওসব শখের গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে চাকরিবাকরির চেষ্টা কর। এখন তো তোর সঙ্গে কত বড় বড় লোকের জানাশোনা হয়েছে। এস পি রায়ের ছেলে এ পি রায় তোকে তো খুব পছন্দ করে। ওকে গিয়ে কল, চা-বাগানে চাকরি দিতে। কথাগুলো অর্জুনের কানে ঢোকেনি। বাঁধাধরা চাকরি করা তার পোষাবে না। মাঝেমধ্যে সে যেসব কেস পেয়েছে তার দক্ষিণায় মোটামুটি চলছে। জলপাইগুড়ি বলে সত্যসন্ধানের কাজ বেশি পাওয়া যায় না। যদি সে কলকাতায় থাকত তা হলে অন্য চিন্তা করতে নিশ্চয়ই মা বলতেন না।

অমল সোম না থাকলে রোজ একবার ওঁর বাড়িতে যায় অর্জুন। অমল সোমের পরিচারক বোকালা হাবু তাকে দেখতে পেয়ে খুশি হয়। আজ সকালে নিজের লাল বাইকে চেপে অর্জুন হাকিমপাড়ায় গেল। অমল সোমের বাড়ি বাগানের গেটের পাশে দুজন বসে আছে। একজন তো হাবু, অন্যজন কালো পোশক পরা দাড়িওয়ালা এক প্রৌঢ়। দাড়িতে সাদা ছোপ লেগেছে। দাড়িওয়ালা একনাগাড়ে বলে যাচ্ছিল আর হাবু মাথা নেড়ে যাচ্ছে সমানে। অর্জুনের হাসি পেল। ইশারা ছাড়া যে কোনও কথা শুনতে পায় না বলেই বোঝে না সেই হাবু ওভাবে মাথা নাড়ছে কেন? বাইকের আওয়াজও হাবু শুনতে পেল না, দাড়িওয়ালা কথা বন্ধ করে তার দিকে মুখ ঘোরায়। এবার হাবু তাকে দেখতে পেয়েই তড়াং করে উঠে দাঁড়িয়ে আঁ-আঁ শব্দ তুলে ইশারায় বোঝাবার চেষ্টা করতে লাগল কিছু।

বাইক থেকে নেমে অর্জুন দাড়িওয়ালাকে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার?

দাড়িওয়ালা বলল, ব্যাপারটা কী তা জানতে-জানতে জীবন কেটে যায় কিন্তু জানা হয় কই? আচ্ছা বলুন তো, আমার বাপ-ঠাকুদা, তাঁর বাবা কেন জন্মেছিলেন?

অর্জুন বলল, তাঁরা না জন্মগ্রহণ করলে আপনি এখানে বসে থাকতে পারতেন না, তাই। হাবুকে কী বোঝাচ্ছিলেন?

বেচার খুব ভয় পাচ্ছে একা থাকে বলে। আমি বললাম তোর কোনও ভয় নেই! তবে ওকে তিনটে জিনিস জোগাড় করতে হবে।

কীরকম?

একটা কালো বেড়াল যার চোখ অন্ধকারে জ্বলে। দু নম্বর হল, একটা কানা কাক। জন্ম থেকেই তাকে কানা হতে হবে, কেউ ঢিল ছুড়ে কানা করে দিলে চলবে না। তিন নম্বর হল, একটা খোঁড়া শকুন। ওই একই ব্যাপার, জন্ম থেকেই খোঁড়া হতে হবে। এই তিনরকম প্রাণী জোগাড় করলে ওর কোনও ভয় থাকবে না আর।

অর্জুনের হাসি পাচ্ছিল। মানুষের বিশ্বাস অন্ধ হলে সে কী না ভাবতে পারে। তবে ওই তিন পশু ও পাখির নির্বাচনে বুদ্ধির ছাপ আছে। কালো বেড়াল, কানা কাক আর খোঁড়া শকুনের কথা শুনলে বেশ ছমছমে পরিবেশ তৈরি হয়।

এদের দিয়ে কী হবে? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।

আমরা যা দেখতে পাই না এরা তা দেখতে পায়। এই যে আমাদের চারপাশে অজস্র আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে আপনি তাদের দেখতে পাচ্ছেন?

না থাকলে কী করে দেখতে পাব?

লোকটি উঠে দাঁড়াল, অর্জুন দেখল ওর কাঁধে একটা বড়সড় ঝোলা রয়েছে। লোকটি শান্তমুখে জিজ্ঞেস করল, আপনাকে একটা প্রশ্ন করব বাবু?

নিশ্চয়ই।

আপনার মা বাবা বেঁচে আছেন? মা আছেন। বাবা নেই।

ও। তা তিনি যখন গত হয়েছিলেন তখন তাঁর শ্রাদ্ধ হয়েছিল?

হ্যাঁ।

তা হলে? শ্রাদ্ধ কেন করা হয়? মৃত মানুষের আত্মাকে মুক্তি দিতে। ওই যে পিণ্ডদান করা হয় তা তো আত্মার উদ্দেশেই। তাতেও যাদের মন ভরে না তারা গয়ায় গিয়ে পিণ্ডদান করে। এর পর আপনি বলবেন আপনার বাবার আত্মা ছিল না, সবাই মিছিমিছি শ্রাদ্ধ করেছে?

অর্জুন ভাল করে দেখল। লোকটি অবশ্যই বুদ্ধিমান। কিন্তু কী উদ্দেশ্যে ও হাবুর মাথা খাওয়ার চেষ্টা করছে তা ধরা যাচ্ছে না। লোকটি বলল, চুপ করে থাকবেন না, জবাব দিন বাবু।

এটা হিন্দুদের প্রচলিত বিশ্বাস। কোনও প্রমাণ নেই। যেহেতু যুগ যুগ ধরে করে আসা হচ্ছে তাই সবাই করে।

যার পেছনে কোনও যুক্তি নেই তা যুগ-যুগ ধরে চলতে পারে না বাবু। আত্মা নেই একথা আপনি প্রমাণ করতে পারবেন না বলেই ব্যাপারটা মেনে নিচ্ছেন। তা যা বলছিলাম, সেই তেনাদের ওই বেড়াল, কাক আর শকুন

দেখতে পায়।

চমৎকার!

আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না?

কালো বেড়াল প্রচুর দেখা যায়, বাকি দুটো পাখির খবর আপনি জানেন?

অবশ্যই। সেনপাড়ায় বলাই মিত্তিরমশাইকে আপনি চেনেন? ব্যবসা করতেন। তিন বছর হল গত হয়েছেন। শ্রদ্ধশান্তি হয়েছে, গয়ায় গিয়ে পিণ্ডি দিয়ে আসা হয়েছে, কিন্তু তবু তাঁর আত্মার শান্তি হয়নি। ও বাড়ি ছেড়ে তিনি কিছুতেই যাচ্ছেন না। শেষপর্যন্ত আমার কথায় মিত্তিরমশাই-এর ছেলে ওই তিনটে প্রাণীকে জোগাড় করেছেন আজ। আমি সেই উদ্দেশ্যেই এসেছিলাম। আগে এসে পড়েছি বলে ভাবলাম, যাই, একবার বড়বাবুর সঙ্গে দেখা করে আসি। লোকটি হাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, চলি ভাই, যা বললাম খেয়াল রেখো। দ্যাখো, ভয় করলেই ভয়, নইলে কিছুই নয়।

কথাগুলো বলে লোকটি অমল সোমের বাড়ির দিকে তাকাল। তারপর গেট খুলে কয়েক পা হেঁটে একটা টগর গাছের পাশে দাঁড়িয়ে সেখানকার মাটিকে প্রণাম করল। অর্জুন দেখল লোকটার দেখাদেখি হাবুও সেই জায়গাটার মাটিকে প্রণাম করল। এবার লোকটি প্রসন্ন মুখে হাঁটা শুরু করতেই অর্জুন বলল, আচ্ছা, এইসব বিশ্বাস নিয়ে আপনারা একটা আলাদা জগৎ তৈরি করে বেশ আছেন, না?

লোকটি বলল, তা আসুন না আজ।

কোথায়?।

ওই যে, যেখানে আমি যাচ্ছি। সেনপাড়ার মিত্তিরমশাইয়ের বাড়িতে। নিজের চোখে সব দেখেশুনে নেবেন। বড়বাবু শুনলে বলবে, ঠিক করেছ গোরক্ষনাথ। চলি।

গোরক্ষনাথ! যে নাম রেখেছিল তার তারিফ না করে পারল না অর্জুন। এদের কী করে বোঝানো যাবে যে, এইসব কুসংস্কার দূর করা দরকার। এখন একটু একটু করে শ্রাদ্ধের প্রচলিত অনুষ্ঠান উঠে যাচ্ছে। মৃতের আত্মীয়বন্ধুরা সেই দিনে একত্রিত হয়ে তাঁর আত্মার শান্তি প্রার্থনা করেন, তাঁর প্রিয় গান গাওয়া হয়।

অর্জুন দেখল বাগানে হাবু কেমন জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাবুর গায়ে যে শক্তি আছে তার ব্যবহার ও যদি ঠিকঠাক করতে পারে তা হলে কোনও কিছুতেই ভয় পাওয়া ওর উচিত নয়। সেই হাবু ভয় পেয়েছে কেন? সে সামনে গিয়ে ইশারা করে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? হাবু মাথা নেড়ে বোঝাল তার কিছু হয়নি। অর্জুন ইশারায় বোঝাল ওই লোকটাকে বাড়িতে ঢুকতে না দিতে। হাবু একটু ভাবল, তারপর আঙুল তুলে টগর গাছের পাশের মাটি দেখাল। অর্জুনের মনে পড়ল ওই জায়গাটার দিকে তাকিয়ে লোকটা প্রণাম করেছে, দেখাদেখি হাবুও। কিন্তু ঘাসমাটি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছে না। লোকটা বড়বাবু বলল কাকে? অমলদাকে? প্রশ্নটা হাবুকে করতেই সে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল। অর্জুন বেশ অবাক হল। তার পক্ষে অমল সোম বাড়িতে থাকলে কে আসছে না আসছে তা জানা সম্ভব নয়, যদি অমলদা না বলেন। এ লোকটার কথা সে কখনও শোনেনি। ইদানীং অমল সোম একটু অন্যরকম হয়ে গিয়েছেন। ইদানীং বলা ভুল হল, কয়েক বছর ধরে তিনি সত্যসন্ধানের কাজ আর করেন না। সারাক্ষণ হয় বই পড়েন, নয় চুপচাপ ভাবেন। আবার হঠাৎ-হঠাৎ উধাও হয়ে যান হাবুর ওপর বাড়ি ছেড়ে দিয়ে। কিন্তু চিরকাল যে মানুষ বিজ্ঞানের সপক্ষে কথা বলে এলেন, তাঁর পক্ষে এই লোকটাকে কী করে মেনে নেওয়া সম্ভব? অর্জুনের মনে পড়ল, অমলদার শেলফে বেশ কিছু পরলোক-সংক্রান্ত বই সে দেখেছে।

অর্জুন এগিয়ে গিয়ে হাবুর দেখানো মাটিতে পা রাখতেই হাবু দ্রুত তাকে টেনে সরিয়ে দিল। তারপর চোখ পাকিয়ে রাগত ভঙ্গিতে ওরকম করতে নিষেধ করল। অর্জুন খুব অবাক হয়ে গেল। এরকম আচরণ হাবু কখনও তার সঙ্গে করেনি। এখন ওকে দেখে মনে হচ্ছে প্রয়োজন হলে শক্তিপ্রয়োগ করতে ও দ্বিধা কবে না। ব্যাপারটা বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছিল অর্জুনের। সে খুব বিমর্ষ ভঙ্গিতে ঘুরে দাঁড়াল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে হাবু শান্ত হয়ে গেল। তারপর মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। অর্জুনের মনে হল ওখানকার জমি ভাল করে দেখা দরকার।

সে ইশারা করে হাবুকে ডাকতেই হাবু মাথা নিচু করেই এগিয়ে এল। পকেট থেকে টাকা বের করে অর্জুন হাবুকে দিয়ে ইশারায় বলল সিগারেট কিনে আনতে। এই কাজটা হবু এর আগেও করেছে। কোন ব্র্যান্ড, তাও জানে। টাকা নিয়ে সে বেরিয়ে গেল। দোকান থেকে ফিরে আসতে হবুর মিনিট দশেক লাগবে। অর্জুন দ্রুত বাগানের এককোণে রাখা কোদাল নিয়ে এসে জায়গাটা খুঁড়তে লাগল। সামান্য গর্ত খুঁড়তেই খট করে শব্দ হল। হাত ঢুকিয়ে জিনিসটাকে বের করল অর্জুন। একটা আট ইঞ্চি চওড়া স্টিলের বাক্স। বাক্সর ঢাকনা খুলতেই একটা লকেট দেখতে পেল সে। চেন ছাড়া লকেটটি চকচক করছে। একটা কালো সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে লকেটের চেহারা নিয়েছে। মুখটা সামান্য উচুতে, ফণা তোলা। খুব হালকা গালা বা ওই জাতীয় পদার্থে লকেটটা তৈরি।

অর্জুন দ্রুত বাক্সটাকে পুঁতে ফেলে মাটি চাপা দিল। কোদাল সরিয়ে রেখে চেষ্টা করল যতটা সম্ভব মাটিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। কিন্তু সেটা সম্ভব হচ্ছিল না কিছুতেই। টগর গাছ থেকে পাতা ছিঁড়ে খোঁড়া জায়গাটার ওপর ছড়িয়ে দিয়ে সে গেটের পাশে চলে এল লকেটটাকে হাতে নিয়ে।

এই সময় টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হল।

জলপাইগুড়িতে এ-সময় একবার বৃষ্টি নামলে আর রক্ষে নেই। অর্জুন দেখল হাবু দৌড়ে আসছে। সিগারেটের প্যাকেট হাতে নিয়ে রেখে দিতে ইশারা করতে হবু দৌড়ে চলে গেল বাগান পেরিয়ে বারান্দায়, বৃষ্টির ছাঁট থেকে বাঁচতে। অর্জুন তাকে ইশারা করে বাইকে উঠে বসল। তার মনে হচ্ছিল বৃষ্টি আরও জোরে নামলে বাঁচা যায়। হাবুর পক্ষে বোঝা সম্ভব হবে না মাটিটা খোঁড়া হয়েছিল।

বাড়িতে এসে জামাপ্যান্ট ছেড়ে অর্জুন লকেটটাকে নিয়ে বসল। যিনি বানিয়েছেন তাঁকে শিল্পী হিসেবে উচুদরের বলতেই হবে। নিটোল সাপ। কালনাগিনী? এমনকী চোখ দুটো ভীষণ রকমের জীবন্ত। এখন কথা হল, এই সাপের লকেটকে কেন টগর গাছের নীচে পুঁতে রাখা হয়েছে? লোকটা এবং হাবু যখন প্রণাম করেছে তখন ওরা এর অস্তিত্ব জানে। লকেট রাখা ছিল স্টিলের বাক্সে, যাতে জল-মাটি এর কোথাও ক্ষতি করতে না পারে। অমলদা কি জানেন? অর্জুনের বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিল না অমল সোম এরকম অবৈজ্ঞানিক কাজকে প্রশ্রয় দেবেন? এটাকে মাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছে কেন? কোথায় যেন পড়েছিল অর্জুন, তান্ত্রিকরা মন্ত্রপূত লোহার সাপ মাটিতে পুঁতে দেয়, যাতে গৃহস্থের বাড়িতে অকল্যাণ প্রবেশ করতে না পারে। অসম্ভব। অমলদা এটা কিছুতেই করতে পারেন না। নিশ্চয়ই ওই লোকটা হাবুকে ম্যানেজ করে এ করেছে।

টেবিলের ওপর লকেটটা রাখতেই মা ঘরে ঢুকলেন, ্যাঁ রে, শুনেছিস, সেনপাড়ার এক বাড়িতে খুব ভূতের উপদ্রব হয়েছে।

অর্জুন হে-হো করে হাসল, মা! তুমিও?

না রে! সবাই বলছে। তোর খোঁজে সুধাদি এসেছিলেন। উনিও গিয়েছেন দেখতে।

সুধামাসি গিয়েছেন ভূত দেখতে?

যে বাড়িতে উপদ্রব হচ্ছে সেই বাড়ির লোকদের তিনি চেনেন।

তা হলে ভূতকেও চিনতে পারবেন।

ইয়ার্কি মারিস না। সুধাদি বলছিলেন তোর সঙ্গে জরুরি দরকার আছে। এই, এটা কী? মা এগিয়ে এলেন টেবিলের কাছে।

লকেট।

কী ভয়ঙ্কর লকেট! কোথায় পেলি?

ভয়ঙ্কর কেন?

জানি না। দেখেই কেমন গা ছমছম করছে। ফেলে দে, ফেলে দে। ওরকম অমঙ্গল জিনিস বাড়িতে রাখিস না।

সুন্দর সাপের মূর্তি, অমঙ্গল বলছ কেন?

না বাবা, চোখ দুটো দ্যাখ, গিলে খাবে। কিনেছিস?

নাঃ। পেলাম।

দূর করে দে। চলে যাওয়ার আগে মা বললেন, সুধাদির সঙ্গে দেখা করিস।

সঙ্গে-সঙ্গে অর্জুনের মনে হল এখনই সেনপাড়ার বলাই মিত্তিরের বাড়িতে গেলে হয়! সুধামাসির সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে, সেইসঙ্গে গোরক্ষনাথের ভেলকিও।

সুধামাসি মায়ের বন্ধু। জলপাইগুড়ির অভিজাত পরিবারের বউ। ওঁর একমাত্র মেয়ে এখন আমেরিকায়। স্বামী মারা গিয়েছেন কয়েক বছর আগে। এখানে তিনি একাই থাকেন। সুধামাসি বই পড়তে খুব ভালবাসেন। মায়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বাবুপাড়া পাঠাগারে। মাকে উনি বলেন অর্জুনকে ওর মতো থাকতে দিতে। বলেছিলেন, সবাই তে চাকরি করে কিন্তু কেউ-কেউ সত্যসন্ধানী হয়। সেটা শোনার পর থেকে ভদ্রমহিলাকে শ্রদ্ধা করে এসেছে অর্জুন।

বাড়ির সামনে পৌঁছে অর্জুন বুঝল জলপাইগুড়ি শহরের অনেকেই খবর জেনে গেছেন। শপাঁচেক লোকের ভিড় জমেছে বাড়ির সামনে। উলটোদিকে কিছু ছেলে চিৎকার করে বলছে, ভূত বলে কিছু নেই! এসব বুজরুকি, আপনারা বিশ্বাস করবেন না।

থানার সেকেন্ড অফিসার তাঁর বাহিনী নিয়ে এসে ভিড় সামলাচ্ছেন। অর্জুনকে দেখে বললেন, এখানে কীসের সন্ধানে? ভেতরে যাবেন? যান।

বাড়ির ভেতরেও লোজন কম নেই। তবে তাঁরা আত্মীয়বন্ধুজন। অর্জুন দেখল শ্রাবাড়িতে যেমন আয়োজন হয় তেমনই ব্যবস্থা হয়েছে। একজন প্রবীণা মহিলা আসনে বসে আছেন মাথায় ঘোমটা দিয়ে। তাঁর সামনে নিলডাউন হয়ে গোরক্ষনাথ বিড়বিড় করে যাচ্ছে। একসময় গলা খুলল সে, বাবু, আপনি তো মানুষ ভাল ছিলেন। তা হলে এরকম করছেন কেন? গিন্নিমা যে কষ্ট পাচ্ছেন বুঝতে পারছেন না? আমি আপনাকে বলছি পিণ্ড গ্রহণ করে এখান থেকে চলে যান। আপনি হ্যাঁ বলুন। ওই ডালটাকে সরিয়ে দিন। ও, দেবেন না? বেশ। তবে মনে রাখবেন, খারাপ হতে চাইলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না। যাই কে আছিস? নিয়ে আয় ওদের।

বলমাত্র একজন প্রৌঢ় এবং একজন যুবক তিনটে খাঁচা নিয়ে এল। অর্জুন বাড়ির ভেতরে যমন আয়োজ-মাথায় ঘোম দেখল খাঁচা তিনটেতে বসে আছে কালো বেড়াল, কানা কাক আর খোঁড়া শকুন। গোরক্ষনাথ বলল, গিন্নিমা, আপনি বিশ্রামে যান। সন্ধে না হলে কাজ শুরু করা যাবে না। ততক্ষণ এরা পাহারায় থাকুক।

বৃদ্ধা উঠে ভেতরে চলে যেতেই অর্জুন দেখল সুধামাসি এগিয়ে আসছেন ওর দিকে। সে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার সুধামাসি?

সুধামাসি বললেন, এই, তুই আমাকে আমেরিকায় নিয়ে যাবি?

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার