অর্জুন, অর্জুন। হ্যালো হ্যালো! অর্জুন, শুনতে পাচ্ছ?

একটা কণ্ঠস্বর অনেক দূর থেকে ভেসে আসছিল। আগেকার দিনে, যখন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলে তবেই দুর দেশের লোক টেলিফোনে কথা শুনতে পেত, সেই রকমের শব্দ। যা মিহি হতে হতে কানের পরদায় এসে মিলিয়ে যাচ্ছে। গভীর ঘুমে তলিয়ে থাকা অর্জুন ক্রমাগত সেই ডাক শুনতে

শুনতে অস্ফুটে ‘উঁ’ বলল।

অর্জুন, অর্জুন। হ্যালো, হ্যালো! অর্জুন শুনতে পাচ্ছ? কণ্ঠস্বর চেনা যাচ্ছে না, খুব মিহি। ঘুমন্ত অর্জুন কোনওমতে সাড়া দিল, হ্যাঁ, পাচ্ছি, পাচ্ছি।

উঠে পড়ো, এখনই ঘুম থেকে উঠে পড়ো। দিনে ঘুমোও, রাতে জায়গা। অর্জুন, অর্জুন। হ্যালো, হ্যালো! গলার স্বর যেন পরিচিত, অমলদার নয়, অনেকটা বিষ্টসাহেবের মতো।

তারপর আর কোনও সাড়া নেই। যেন গভীর জলের নীচ থেকে ভুস করে উপরে উঠে এল অর্জুন। ঘুম ভেঙে যেতেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। সঙ্গে, সঙ্গে মাথার ভিতরটা টনটন করে উঠল। দু’হাতে কপালের দু’পাশের শিরা চেপে ধরল। মেজর আবার নাক ডাকছেন, তবে এবার মৃদু আওয়াজ হচ্ছে। অর্জুন মাথা ঝাঁকাল। মাথা ধরে গিয়েছে প্রচণ্ড। এরকম বিশ্রী স্বপ্ন সে কখনও দ্যাখেনি। না, ঠিক হল না। দ্যাখা নয়, শোনেনি। স্বপ্ন কি কেউ শোনে? কিন্তু সে তো কিছু দেখেছে বলে মনে পড়ছে না। তাকে কেউ যে ডাকছিল সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। আজব ব্যাপার! মাথা ধরা সারাবার কোনও ট্যাবলেট সঙ্গে নেই। সে আবার শোওয়ার জন্য বালিশে মাথা রাখতেই দেখতে পেল, মোবাইলের আলোটা টুপ করে নিভে গেল। মোবাইল সে অন করে শুয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ওটা তো লক হয়ে থাকার কথা!

মোবাইল তুলে নিয়ে লকটা খুলতে কোনও মিল্ড কল ফুটে উঠল না। কল রেজিস্টারে গিয়ে রিসিভজ্ঞ কলে যেতেই ফুটে উঠল ‘নম্বর আনোন। আনোন নম্বর থেকে ফোন এসেছিল? সাধারণত বিদেশের ফোন এলে পুরোটা ফুটে ওঠে না। সে টাইম অফ কল দেখতে চাইল। দেখে হতভম্ব হয়ে গেল অর্জুন। রাত দুটো পনেরো, তারিখ আজকের। অর্থাৎ রাত বারোটার পর যে দিনটা শুরু হয়েছে সেই দিনের। তার মানে, এই মোবাইলে কল এসেছিল। কিন্তু রিং হয়নি। রিং হলে সেই আওয়াজে তার ঘুম নির্ঘাত ভেঙে যেত। কিন্তু কল এসেছিল একটু আগে, যখন সে ঘুমোচ্ছিল। ঘুমন্ত অবস্থায় কী করে যে ফোন করেছিল তার কণ্ঠস্বর সে শুনতে পারে? অথচ একটা ফোন এসেছিল ওই মোবাইলে কিন্তু রিং হয়নি। নম্বর ওঠেনি এটা প্রমাণিত।

বাথরুমে গিয়ে বেসিন খুলে ঘাড়ে-মুখে জল দিল অর্জুন। কিন্তু মাথার ভিতরের দপদপানিটা যাচ্ছিল না। বহু দূর থেকে কথা বললে যেরকম শুনতে লাগে, সেইরকম শোনাচ্ছিল লোকটার গলা। ঘুম থেকে উঠে পড়ো! দিনে ঘুমাও, রাতে জাগো।

দরজা খুলে বাইরের বারান্দায় পা বাড়ানোর আগে ঘরের আলো নিভিয়ে দিল অর্জুন। অনেকটা ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ এখন জঙ্গলের মাথায়। শেয়াল ডাকছে দূরে। এখন অন্ধকার অনেক পাতলা হয়ে গিয়েছে। গাছেদের রহস্য তরল।

অর্জুন রেলিং-এর ধার ঘেঁষা সোফায় বসল। কে বলল কথাটা? এত কিছু থাকতে, ঘুম থেকে উঠে পড়তে বলল কেন? হাসল অর্জুন, তার পক্ষে কি রাতে না ঘুমিয়ে দিনে ঘুমিয়ে থাকা সম্ভব? তা ছাড়া সেটা করবেই বা কেন?

মাথা ধরাটা যাচ্ছে না, ঘুমও আসছে না। মেজরের নাক ডাকার শব্দ প্রথম রাতের মতো ভয়ংকর নয়। মেজর বেশ বদলে গিয়েছেন। ভেজা মুড়ির মতো লাগছে এবার। সেটা মদ্যপান ছাড়ার কারণে না বয়স বাড়ার জন্য, বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু হম্বিতম্বি চিৎকার করে কথা না বললে মেজরকে মানায় না।

হঠাৎ একটা গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ কানে এল। গয়েরকাটা-নাগুয়ার রাস্তাটা বাংলো থেকে বেশি দূরে নয়। এত রাতে বিশেষ প্রয়োজনে কোনও গাড়ি যেতেই পারে। কিন্তু অর্জুনের কান সজাগ হল। ইঞ্জিনের আওয়াজ মিলিয়ে তো গেলই না, বরং কাছে এগিয়ে আসছে। কোনও গাড়ি যে বাংলোর গেটে পৌঁছে গিয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু গাড়ির হেডলাইটের আলো কোথায়? এত রাতে কোনও গাড়ি আলো নিভিয়ে আসবে কেন? আলো জ্বাললে তো নীচের বাগান, লন, সামনের জঙ্গলের কিছুটা আলোকিত হয়ে যেত। অর্জুন নিঃশব্দে বারান্দার কোনায় চলে এসে শরীরটা যতটা সম্ভব আড়ালে রেখে, গেটের দিকে তাকাতেই গাড়িটাকে দেখতে পেল। ফিকে অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছিল ওটা সুমো। আলো নিভিয়ে চুপচাপ বাংলোমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর আবার ইঞ্জিন চালু হল। উলটো দিকে মুখ ঘুরিয়ে সুমো দাঁড়িয়ে গেল। প্রায় নিঃশব্দে দরজা খুলে দুটো লোক গাড়ি থেকে নামল। তারপর গেট খুলে চুপচাপ বাংলোর বাগানে চলে এসে উপরের দিকে তাকাল। সম্ভবত অন্ধকার বাংলো ওদের বিভ্রান্ত করছিল। তারপর ওপাশ দিয়ে হেঁটে চোখের আড়ালে চলে গেল ওরা।

এত রাতে কেউ আশ্রয় পাওয়ার জন্য কোনও বাংলোয় এলে এমন চোরের মতো আচরণ করে না। চিৎকার করে দরোয়ানকে ডাকবে। অতএব লোক দুটো যে অসৎ উদ্দেশ্যে এসেছে, এটা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। এখন কী করা উচিত? অর্জুন ভাবল। সোজা নীচে নেমে ওদের চ্যালেঞ্জ করবে। ওরা তো বলতেই পারে, এখানে থাকার জায়গা খুঁজতে এসেছিল। সব অন্ধকার দেখে মনে হয়েছে, ডেকে কোনও লাভ হবে না। এটুকু জানিয়ে চলে গেলে সে কিছুই করতে পারবে না।

মিনিটতিনেক পরে কাঠের সিঁড়িতে শব্দ হল জুতোর। ওরা উপরে উঠছে। অর্জুন সোজা সিঁড়ির মুখে গিয়ে দাঁড়াল। বাঁক নিয়ে ওরা উপরের সিঁড়িতে পা রাখতেই মুখ তুলে অর্জুনের ছায়ামূর্তি দেখে থমকে গেল।

অর্জুন পরিষ্কার বাংলায় জিজ্ঞেস করল, কে আপনারা? কী চাই?

ওদের মুখ অন্ধকারের জন্যে দ্যাখা যাচ্ছে না। হঠাৎ লম্বা লোকটা পকেটে হাত ঢুকিয়ে কিছু একটা দ্রুত বের করতেই অর্জুন বিদ্যুৎবেগে দেওয়ালের আড়ালে সরে এল। লোকটা যে কোনও আগ্নেয়াস্ত্র বের করছিল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তার পরই দুদ্দাড় শব্দ তুলে লোক দুটো বাংলো থেকে নেমে গাড়ির দিকে ছুটে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই গাড়িটা হেডলাইট জ্বালিয়ে ছুটে গেল পিচের রাস্তার দিকে।

অর্জুন ফিরে গেল বারান্দায়। সোফায় বসামাত্র কথাটা মনে এল, এখনই ঘুম থেকে উঠে পড়ো। দিনে ঘুমোও, রাতে জাগো।

যদি তাকে কেউ এই কথাগুলো না বলত, যদি তার ঘুম না ভাঙিয়ে দিত, তা হলে…! থমকাল অর্জুন। লোক দুটো কী উদ্দেশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে এত রাতে এই বাংলোয় এসেছিল, তা জানার উপায় আপাতত নেই। হঠাৎ সোজা হয়ে বসল সে। আজ জ্ঞান সিংহের ধাবা থেকে যে লোক দুটো সুমোয় করে পালিয়ে গিয়েছিল, যারা শিলিগুড়িতে অ্যাক্সিডেন্ট করেছিল, সেই লোক দুটো কি এরাই?

অন্ধকারের আড়ালে থাকায় সুমো গাড়ির চেহারা দ্যাখা যায়নি। কিন্তু ওই লোক দুটোর শরীরের আদলের খুব মিল আছে ধাবার সামনের লোক দুটোর সঙ্গে। ধারণাটা যদি সত্যি হয়, তা হলে বুঝতে হবে, ওই লোক দুটো এয়ারপোর্টে গিয়েছিল। প্রি-পেড থেকে শিলিগুড়ির জন্যে ট্যাক্সি ভাড়া করা হয়েছে, তা জেনেছিল। জেনে আগেভাগে শিলিগুড়ি চলে আসার পথে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। শিলিগুড়ি থেকে তাদের অনুসরণ করে জলপাইগুড়িতে এসেছিল। জলপাইগুড়ির ডি এফ ও অফিস থেকে ওরা খবর পেয়েছিল যে, অর্জুনরা খুঁটিমারি জঙ্গলের বাংলোয় থাকবে। জেনে রওনা হয়ে জ্ঞান সিংহের ধাবায় খেয়েছিল। কিন্তু পরপর এত ঘটনা বড় কাকতালীয় বলে মনে হচ্ছিল অর্জুনের। তা ছাড়া ওরা তাদের অনুসরণ করবে কেন? মেজর যে লুসিকে নিয়ে আসছেন, সেটা ওদের জানার কথা নয়। অর্জুনকে অনুসরণ করার কোনও কারণ থাকতে পারে না। অর্জুন চুলে আঙুল বোলাল। এবং তখনই আবিষ্কার করল, তার মাথা একেবারে হালকা হয়ে গিয়েছে। সেই যন্ত্রণা উধাও!

.

জঙ্গলে রাত শেষ হওয়ার দৃশ্য অসাধারণ। যেন গহীন অন্ধকারের জাল কেউ ছুঁড়েছিল পৃথিবীর উপর সেই সন্ধের মুখে, সূর্য ওঠার একঘণ্টা আগে থেকে সে ধীরে ধীরে গুটিয়ে নিচ্ছে জাল। একটু একটু করে ফরসা হচ্ছে আকাশ। গাছের পাতাদের নাচতে দ্যাখা যাচ্ছে বাতাসে। রোদ নেই, সূর্য ওঠার আগে গম্ভীর ছায়ার চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আছে সামনের বাগান, লন, খুঁটিমারির জঙ্গল। কিন্তু জঙ্গলের গাছে গাছে শুরু হয়ে গিয়েছে পাখিদের অর্কেস্ট্রা। ভোর হল, ভোর হল।

গুড মর্নিং! বলেই লুসি চমকে জঙ্গলের দিকে তাকালেন, মাই গড!

পাখিরা আপনার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে।

মাথা নাড়লেন লুসি, না। এই হট্টগোল রেকর্ড করে কোনও লাভ হবে না। কোনও পাখিকেই আলাদা চেনা যাবে না। কিন্তু আপনি কি আর্লি রাইজার?

আমি? না তো। তারপরেই খেয়াল হল, ওঃ। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। তারপর আর ঘুম আসেনি।

ঠিক তখনই চিৎকারটা শোনা গেল। অর্জুন কান খাড়া করেই বুঝতে পারল ওটা পদমবাহাদুরের গলা। সে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে বাংলোর পিছনে চলে এল। পদমবাহাদুর চিৎকার করে যাচ্ছে। চৌকিদার তার পাশে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে। গাড়ির বনেট খোলা, সামনের চাকা মাটিতে বসে গিয়েছে।

কী হয়েছে?

অর্জুনকে দেখে কয়েক পা এগিয়ে এল পদমবাহাদুর, সাব, দেখুন গাড়ির কী অবস্থা করেছে! ভিতরের তার ছিঁড়েছে, চাকার হাওয়া বের করে দিয়েছে।

চৌকিদার বলল, এরকম ঘটনা এর আগে এখানে ঘটেনি সাব! রাতে বাইরের লোক এখানে আসে না।

বাইরের লোক আসে না! পদমবাহাদুর খিঁচিয়ে উঠল, তা হলে এসব কে করল?

এইসময় মেজর এবং লুসি পিছনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন। সব দেখে মেজর ঘুসি মারলেন গাড়ির দরজায়, শুট করব, ক্ষতিপূরণ চাইব। হোয়্যার ইজ দ্যাট কেয়ারটেকার? কল হিম।

চৌকিদার ছুটল। পদমবাহাদুর জানাল, শুধু তারগুলো জুড়ে ঠিকঠাক করতে এই বেলাটা কেটে যাবে। তার কাছে একটা স্টেপনি আছে। অথচ দুটো চাকার হাওয়া বেরিয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে কোনও গ্যারাজ থেকে আর একটা স্টেপনি ধার করে আনতে হবে। তারপর গাড়িটাকে নিয়ে গিয়ে খোলা চাকায় হাওয়া ভরতে হবে।

অর্জুন মাথা নাড়ল, এসব কিছুই করতে হবে না। তুমি পিচরাস্তা থেকে একটা ভ্যান-রিকশা ডেকে এনে তাতে চাকা তুলে গয়েরকাটার গ্যারাজে নিয়ে যাও। সেখানে হাওয়া ভরার পর, একজন গাড়ির ইলেকট্রিক মিস্ত্রিকে সঙ্গে নিয়ে এসো।

পদমবাহাদুর চাকা খুলতে বসে গেল জ্যাক বের করে।

বাংলোর দোতলার বারান্দায় চেয়ারে বসে টি-পট থেকে কাপে চা ঢালছিলেন মেজর। এখন সোনা সোনা রোদ্র চারপাশে। মেজর বললেন, বুঝলে লুসি, কোনও একটা দুষ্টু ছেলে কাণ্ডটা করেছে। বাচ্চাদের মাথায় তো কত রকমের বুদ্ধি খেলা করে। সাধারণ ব্যাপার।

লুসি চায়ের কাপ তুলে নিলেন, আমরা কি এখানে আজকের দিনটা থাকব?

যদি তোমার কাজ না হয় তা হলে নিশ্চয়ই থাকব। মেজর বললেন।

অর্জুন ভাবছিল কী করে গত রাতের ঘটনাগুলো এঁদের জানাবে। ব্যাপারটা যে একেবারেই ছেলেমানুষি নয়, তা জানলে এঁরা নিশ্চয়ই বেশ . আপসেট হয়ে পড়বেন। বিশেষ করে লুসির মতো ভদ্রমহিলা বিদেশে এসে বড় রকমের ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে নিশ্চয়ই চাইবেন না।

চায়ে চুমুক দিয়ে লুসি অর্জুনের দিকে তাকালেন, আমি ম্যাপে দেখলাম নর্থ বেঙ্গলের ফরেস্টের শুরু এখান থেকেই। তার মানে ওপাশে আরও গভীর জঙ্গল আছে। আমরা আজই সেরকম কোনও জঙ্গলে চলে যেতে পারি না?

নিশ্চয়ই পারি।

বেশ। কোথায় যাবেন ঠিক করে নিন। আর সারাদিন আমি যেন নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারি, সেটা দেখবেন প্লিজ। বেশি প্রচার করে না যাওয়াই ভাল। চা-টা শেষ করে লুসি উঠে চলে গেলেন তার ঘরে। মেজর চায়ের কাপ হাতে সুর ভাঁজছিলেন, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি…।

অর্জুন তাকাল, আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব?

শিয়োর, চায়ে চুমুক দিলেন মেজর।

আমি ছাড়া এদেশে আপনাদের আসার কথা আর কেউ কি জানে?

ওদেশে অনেকেই জানে। বিষ্ণু সাহেবকে বলে এসেছি। তিনি এখন কিছুটা সুস্থ। কিন্তু বনে-জঙ্গলে ঘুরতে হবে শুনে এলেন না। লুসির গবেষণার ব্যাপারটা যাঁরা স্পনসর করছেন তারা জানেন। আর এদেশে দু’জন জানেন।

কারা?

তোমার মা আর অমল সোম।

অমলদার সঙ্গে আপনার যোগাযোগ আছে?

হ্যাঁ। কথা হয় না। মাঝে মাঝে ইন্টারনেটে পত্র বিনিময় হয়।

কিন্তু মেজর, আমার বিশ্বাস আপনাদের উপর নজরদারি করতে কেউ বা কারা বেশ সক্রিয়। দু’জন গত রাতে এই বাংলোয় এসেছিল। তারাই যাওয়ার সময় গাড়িটার অবস্থা ওইরকম করে গিয়েছে, অর্জুন বলল।

হাঁ হয়ে গেলেন মেজর, মাই গড। লোক দুটো এখানে এল কী করে?

সুমো গাড়িতে চেপে।

তুমি দেখলে ওরা গাড়িটাকে নষ্ট করছে আর চুপ করে থাকলে?

খালি হাতে কিছু করতে যাওয়া বোকামি হত।

কখন এসেছিল?

রাত আড়াইটের পর।

তখন তুমি জেগে ছিলে? ঘুমোওনি?

ঘুম ভেঙে যাওয়ায় বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে ছিলাম।

আশ্চর্য! আমাকে ডাকলে না কেন? মেজর বিরক্ত।

ওদের কাছে অস্ত্র ছিল। কিছুই করা যেত না। তা ছাড়া আপনি যেরকম গভীর ঘুমে ডুবে ছিলেন, তাতে সহজে ওঠানো যেত না, অর্জুন বলল।

কিন্তু, কিন্তু লোক দুটো কোন উদ্দেশ্যে এখানে এসেছিল?

ওদের সঙ্গে আমার কোনও কথা হয়নি। বোধহয় জেগে আছি দেখে আর এখানে দাঁড়াতে চায়নি। লোক দুটো নর্থ বেঙ্গলের। এখানকার সব কিছু জানে। হয়তো কেউ ওদের রিক্রুট করেছে, অর্জুন বলল। লুসিকে এসব কথা না বলাই ভাল।

মেজর বললেন, এমন তো হতে পারে, কে বা কারা পছন্দ করছে না, লুসি এই গবেষণা করুন। ওঁর সঙ্গে কথা বললে জানা যেত আমেরিকায় এরকম কেউ আছে কিনা। মেজর তাকালেন।

তা যদি হয়েও থাকে, তা হলে তারা নর্থ বেঙ্গলের লোককে রিক্রুট করবে কী করে? বড্ড অস্বাভাবিক বলে কি মনে হচ্ছে না আপনার?

মেজর মাথা নাড়লেন। একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, একটা কথা বলি। কাল রাত্রে তুমি এসব স্বপ্নে দ্যাখোনি তো?

তার মানে? স্বপ্ন দেখলাম আর সেইমতো গাড়িটাকে ওই অবস্থায় সকালে পাওয়া গেল? অর্জুন বেশ জোরে বলে ফেলল।

এইসময় লুসি এলেন। পরনে জিন্স, টপ, পায়ে জঙ্গলে ঘোরার উপযোগী জুতো, কাঁধে বড় ব্যাগ। আমি তৈরি।

এখনই বেরোবে? ব্রেকফাস্ট খেয়ে গেলে হত না? মেজর বললেন।

না না। তখন রোদ আরও কড়া হয়ে যাবে।

.

মিনিটপাঁচেকের মধ্যে ওরা বাংলো ছেড়ে পিছনের পথ দিয়ে জঙ্গলে ঢুকল। এত অল্প সময়ের মধ্যে মেজরকে তৈরি হতে দেখে ভাল লাগল অর্জুনের। বয়স হওয়া সত্ত্বেও বার্ধক্য ওঁকে গ্রাস করেনি।

প্রথম দিকের জঙ্গল বেশ ফাঁকা। পুরনো গাছ কেটে নতুন যে গাছগুলো লাগানো হয়েছিল, তাদের শৈশব অবস্থা কাটেনি। কিন্তু পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে খুব। বিশেষ করে ‘বউ কথা কও’ বলে পাখিটা জঙ্গল কাঁপয়ে দিচ্ছে। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি এই পাখির ডাক আগে শুনেছেন?

না। কী পাখি ওটা?

এখানে বলা হয় ‘বউ কথা কও’।

বউ…! থেমে গেলেন লুসি।

অর্জুন হেসে ফেলল, এর ইংরেজি অনেকটা এইরকম, ব্রাইড, সে সামথিং।

ইজ ইট? লুসি প্রায় নিঃশব্দে এগিয়ে গেলেন একটা গাছের তলায়। তারপর ব্যাগ থেকে টেপ রেকর্ডার বের করে চাপা গলায় কিছু বলে যন্ত্রটাকে উঁচু করে ধরলেন। সঙ্গে সঙ্গে ডাকটা থেমে গেল। মিনিটদুয়েক নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থেকেও আর পাখিটাকে ডাকতে শুনল না ওরা।

ফিরে এসে লুসি বললেন, এখন থেকে কেউ আর কথা বলব না এবং জুতোয় যাতে শব্দ না হয় সেটা খেয়াল রাখব। কেমন?

একটু পরেই জঙ্গল গম্ভীর হলেও পায়ে চলা পথ ধরে এগোতে অসুবিধে হচ্ছিল না। আচমকা একটা পাখির ডাক শুনে থমকে দাঁড়ালেন লুসি। পাখিটা উঁচু হয়ে চলে গেল জঙ্গলের আরও ভিতরে। টিপ টিপ টিসুম। টিপ টিপ টিসুম! লুসি ডাকটা রেকর্ড করছিলেন।

অর্জুন মেজরের দিকে তাকাতেই চমকে উঠল। এখন মেজরের মাথায় টুপি। আর সেই টুপির উপর একটা কালো জোঁক নৃত্য করছে। বললেই মেজর এমন চিৎকার করে উঠবেন যে, জঙ্গলের সব পাখি উড়ে পালাবে। সে ইশারায় মেজরের কাছ থেকে টুপিটা দেখতে চাইল। খুব গর্বিত হাসি হেসে মেজর টুপিটা মাথা থেকে নামিয়ে অর্জুনের হাতে দিলেন। অর্জুন সঙ্গে সঙ্গে জোঁকটাকে ঝেড়ে ফেলতে চাইল। কিন্তু ওর পড়ে যাওয়ার বিন্দুমাত্র বাসনা ছিল না। ততক্ষণে জোঁকটাকে দেখতে পেয়ে মেজর দু’হাতে নিজের মুখ চেপে ধরেছেন প্রবল শক্তিতে। মাটিতে টুপি নামিয়ে একটা কাঠির সাহায্যে জোঁকটাকে টুপি থেকে নামাতে পারল অর্জুন। জুতোয় পিষে ওটাকে মারতে চাওয়া অর্থহীন। তবু মেজর সেই চেষ্টা করে ক্ষান্ত হলেন।

.

বেলা এগারোটায় ওরা একটা ঝরনার সামনে দাঁড়িয়ে। ইতিমধ্যে লুসি গোটাদুয়েক ক্যাসেট পরিবর্তন করেছেন।

মেজর বললেন, লুসি, এবেলার জন্য অনেক হয়েছে। এবার ফেরা যাক।

লুসিকে বেশ খুশি দ্যাখাচ্ছিল। তিনি প্রথম ক্যাসেটটা বের করে রেকর্ডারে ঢুকিয়ে বললেন, একটু চেক করে নিই, সাউন্ড ঠিক আছে কিনা।

লুসি ক্যাসেট রি-ওয়াইন্ড করছিলেন। অর্জুন ঝরনার দিকে তাকাল। একটা বেশ বড়সড় পাথরঠোকা মাছ প্রায় হাতের নাগালে এসে পাক খেয়ে চলে গেল। এই ঝরনায় মাছ আছে। আর এই মাছেরা নীচের দিকে যায় না! মেছুয়া পুলের নীচের ঝরনায় এদের তো একসময় দেখা যেত।

হঠাৎ শব্দ হল। অর্জুন ঝরনার ওপাশে তাকাতেই চমকে উঠল। জঙ্গল কুঁড়ে সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে একটা বিশাল চেহারার দাঁতাল হাতি। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে তাদের লক্ষ করছে। ঝরনাটা চওড়ায় বড়জোর কুড়ি ফুট।

মাই গড! মেজরের গলা দিয়ে বেরোনো স্বরটাকে ঠিক বোঝা গেল না মেজরের বলে। ঠিক সেই সময় রি-ওয়াইন্ড সম্পূর্ণ হওয়ার পর প্লে বোতাম টিপে উঠে দাঁড়ালেন লুসি, মেজরের জন্যে একটা সারপ্রাইজ প্রথমে বাজবে।

দাঁড়িয়ে থেকে হাতির পায়ের তলায় পিষে মরার কোনও মানে হয় না। অর্জুন ফিসফিস করে বলল, দৌড়োন।

সে ঘুরে দাঁড়াতেই মেজর তাকে অনুসরণ করলেন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ভয়ংকর আওয়াজ শোনা গেল। সেই সঙ্গে লুসির আর্তনাদ। মেজর অর্জুনের হাত ধরে টেনে থামালেন, শুনতে পাচ্ছ? এটা নিশ্চয়ই বাঘ। নিশ্চয়ই জন্তুটা লুসির উপরে ঝাঁপিয়েছে। হাতির ভয়ে পালালাম আমরা অথচ মেয়েটাকে ছেড়ে এলাম বাঘের পেটে যাওয়ার জন্য। কী জবাব দেব? কী জবাব দেব আমি ওর বাবা-মাকে? মেজর কান্নায় ভেঙে পড়লেন। অর্জুনের কানে এল গাছপালা ভাঙার শব্দের সঙ্গে বন্য জন্তুর হুংকার মেশা বিচিত্র আওয়াজ। সে দেখল, মেজর হাত মুঠো করে হাঁটছেন ঝরনার দিকে। অর্জুন মেজরের সঙ্গ নিতেই হুংকার থেমে গেল। মেজর ফিসফিসিয়ে বললেন, বাঘটা বোধহয় চলে গেল। কিন্তু হাতিটা তো ওখানে আছে!

বাঘে-হাতিতে একসঙ্গে ঝরনার জল খায় না।

আঃ, তুমি এই সময়ও রসিকতা করছ?

জঙ্গল সরিয়ে ঝরনা দেখে ওপারে তাকাল অর্জুন। হাতিটাকে দ্যাখা যাচ্ছে । প্রাণীটা যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেই জায়গার গাছপালার উপর যেন তাণ্ডব বয়ে গিয়েছে। মুখ ফেরাতে সে লুসিকে দেখতে পেল। উবু হয়ে বসে টেপ রেকর্ডারে কিছু করছেন। মেজরকে সেটা দ্যাখাতেই তিনি হাত উঁচু করে চিৎকার করতে করতে ছুটলেন। ও লুসি, মাই লিটল ডিয়ার, তোমার কিছু হয়নি তো? হাতি বা বাঘ তোমাকে আহত করেনি দেখে আমি যে কী খুশি হয়েছি!

লুসি অবাক হলেন, বাঘ? এখানে বাঘ কখন এল? একটা হাতিকেই তো দেখলাম।

লুসির কথা শোনামাত্র অর্জুনের মনে পড়ে গেল। বাঘের ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে গেল তার কাছে। সে লুসিকে বলল, আওয়াজটা মেজরকে শোনান।

লুসি হেসে প্লে-বোতাম টিপবার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে গর্জন শুরু হল।

মেজর জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এই আওয়াজ কোথায় রেকর্ড করলে? এ তো বাঘ কিংবা সিংহের গর্জন। একবার আফ্রিকায়…।

কাল রাতে অর্জুন ডেকে শোনালে আমি রেকর্ড করেছিলাম। এই আওয়াজ তোমার নাক থেকে বেরিয়েছে মেজর, লুসি হাসলেন।

মেজর এমন হকচকিয়ে গেলেন যে, দাড়ি-গোঁফের আড়ালে ঢেকে থাকা মুখেও লজ্জা লজ্জা ভাব ফুটে উঠল।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, হাতিটা এপারে আসেনি?

আপনারা চলে যেতে আমি কী করব বুঝতে না বুঝতেই হাতি জলে পা রেখেছিল এপারে আসবে বলে। ঠিক তখনই টেপ রেকর্ডার থেকে মেজরের নাক ডাকার শব্দ বেরিয়ে এসেছিল। প্লে-বোতাম টেপার পর কয়েক সেকেন্ড গ্যাপ ছিল হয়তো। আমি ভয় পেয়ে ভলিউম বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। সেই আওয়াজ কানে যেতেই হাতি থমকে দাঁড়িয়ে এপাশ-ওপাশ তাকাতে লাগল। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে পাগলের মতো দৌড়োতে লাগল পিছন ফিরে। গাছগুলো ভাঙল কিন্তু ওর সেদিকে খেয়াল ছিল না। এমন প্রাণভয়ে পালাতে আমি আজ পর্যন্ত কোনও জন্তুকে দেখিনি, লুসি এগিয়ে এসে মেজরের হাত ধরলেন, তোমাকে কী বলে ধন্যবাদ দেব মেজর, জানি না। তুমি আজ আমার জীবন রক্ষা করেছ। আই অ্যাম গ্রেটফুল টু ইউ।

মেজর ততক্ষণে স্বমহিমায় ফিরে এসেছেন, এ এমন কিছু নয়। আমি কী নাক ডাকি! তোমরা তো মারিয়ার নাক ডাকা শোনোনি?

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, মারিয়া কে?

উগান্ডায় আমার যে গাইড ছিল। লিকলিকে রোগা, পাঁচ তিন লম্বা। মাথা ন্যাড়া রাখতে ভালবাসে। ও যখন রাতে নাক ডাকে তখন পৃথিবী কাঁপতে থাকে। ভয়ংকর ব্যাটল স্নেকরা ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। হাতি তো তার কাছে কিছু নয়। কিন্তু মাই ডিয়ার লুসি, এবার তোমার যন্ত্রটাকে বন্ধ করবে? মেজর বললেন।

অর্জুন বলল, হ্যাঁ। বন্ধ করুন। তাকিয়ে দেখুন, ঝরনার মাছগুলো উধাও হয়ে গিয়েছে এখান থেকে। কোনও গাছে পাখি ডাকছে না।

মেজর বললেন, আমি ইচ্ছে করলে তোমাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারি তা জানো? অনুমতি ছাড়া আমার ব্যক্তিগত শব্দ চুরি করেছ! এবার ছেড়ে দিচ্ছি, কারণ, ওই শব্দ লুসির প্রাণ বাঁচিয়েছে। এখন চলো, হাঁটা যাক।

.

গোটা দুপুর লুসি তার ঘরে টেপ রেকর্ডার নিয়ে কাটালেন। আজ যত পাখির ডাক তিনি রেকর্ড করেছেন, সেগুলো সম্পর্কে একটা ডায়েরিতে মন্তব্য লিখে রাখছিলেন। অর্জুনকে তিনি অনুরোধ করেছিলেন সাহায্য করবার জন্যে। লাঞ্চের পর যখন মেজর একটু বিছানায় গড়াতে গেলেন, তখন অর্জুন এসেছিল লুসির ঘরে। এখন লুসির পরনে হাঁটুর তিন ইঞ্চি নীচে নামা প্যান্ট আর গেঞ্জি। খাটের উপর রেকর্ডার এবং ডায়েরি নিয়ে বাবু হয়ে বসে কাজ করছেন। কোনও কোনও বাঙালি মেয়ে হয়তো এরকম পোশাকে স্বচ্ছন্দে কাজ করতে পারে, কিন্তু এখনও তাদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য নয়। লুসি যে কাজপাগল মানুষ তাতে সন্দেহ নেই।

রেকর্ডারের স্টপ বোতাম টিপে লুসি তাকালেন, পাখিদের সম্পর্কে কোনও ধারণা আছে আপনার? পাখিদের পৃথিবীটা কীরকম জানেন?

মাথা নাড়ল অর্জুন, জানি না।

লুসি যেন ছাত্র পেয়ে খুশি হলেন, ১৮৫৭ সালে পি এল স্কাটার নামে এক ভদ্রলোক পাখিদের পৃথিবীটাকে ভাগ করেছেন ছ’ভাগে। এক, নিয়ার্কটিক, উত্তর আমেরিকা এবং মধ্য মেক্সিকো। দুই, নিউ ট্রপিক্যাল, মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকা। তিন, প্যালিয়াটিক, ইয়োরোপ, আফ্রিকার উত্তর-পশ্চিম অংশ, এশিয়ার পশ্চিমাংশ। চার, ইথিওপিয়ান, আফ্রিকার অধিকাংশ এবং আরব দেশ। পাঁচ, ওরিয়েন্টাল, ভারত, মায়ানমার, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া আর ছয়, অস্ট্রেলিয়ান, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের আকাশে যেসব পাখিদের দেখা যায়। কিন্তু এর পঁয়ত্রিশ বছর পর ক্লিস্টন হার্ট মেরিয়াম বললেন, ভৌগোলিক এলাকা অনুযায়ী পাখিদের ভাগ করা খুব ভুল হবে। তিনি বললেন, টেম্পারেচার এবং হিউমিডিটি অনুযায়ী পাখিদের চরিত্র তৈরি হয়।

অর্জুন মাথা নাড়ল, এটাই তো সহজ। শীতের পাখি, গরমের পাখি। আপনাদের আমেরিকায় কত পাখি আছে তার গণনাও কি করা হয়েছে?

জোর দিয়ে বলা যাবে না। তবে সামারের শুরুতে প্রায় ছয় মিলিয়ন পাখি আমেরিকায় থাকে। ধরে নেওয়া যেতে পারে, প্রতি একর জমিতে প্রায় তিনটি পাখি। এই হিসেবটা খুব কাছাকাছি। আপনাদের এখানে পাখির সংখ্যা কি গোনা হয়েছে? লুসি জিজ্ঞেস করলেন।

অর্জুন চোখ বন্ধ করল। প্রায়ই শোনে, হাতি, গন্ডার বা বাঘ গোনা হচ্ছে। কিন্তু পাখি গোনার কথা কানে আসেনি। সে মাথা নেড়ে না বলল।

লুসি টেপটা চালু করতেই কাঠঠোকরার আওয়াজ কানে এল। অর্জুন নামটা বলতেই লুসি বললেন, উডপোকার। ট্রপিক্যাল দেশগুলোতে প্রচুর দ্যাখা যায়।

হঠাৎ কানে এল একটা ডাক। বিপ বিপ বিপ। তারপর একটু শিস। লুসি উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এই পাখির নাম কী?

না, আমি কখনও শুনিনি।

কোনও পক্ষীবিশারদের নাম জানা আছে?

সলিম আলির নাম মনে পড়ল অর্জুনের। কিন্তু তিনি বেঁচে আছেন কিনা, তা তার জানা নেই। আর-একজন, লেখক বুদ্ধদেব গুহ। ওঁর নানা লেখায় বিচিত্র সব পাখির ডাক পাওয়া যায়।

লুসি বোধহয় আন্দাজ করলেন। বললেন, এই পাখির ডাক আমার আরও দরকার।

ওঁর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল যেন বিশাল গুপ্তধনের সন্ধান পেয়ে গিয়েছেন।

আপনাদের ওখানকার কোনও পরিচিত পাখির ডাকের সঙ্গে মিল পাচ্ছেন বুঝি?

অর্জুন জিজ্ঞেস করতে লুসি মাথা নাড়লেন, নো। তারপর আবার রি ওয়াইন্ড করে ডাকটা শোনালেন। বন্ধ করে জিজ্ঞেস করলেন, শোনার পর কি কিছু মনে আসছে?

বিপ বিপ বিপ। শিসের আওয়াজ। শিসের আওয়াজ খুব স্পষ্ট রেকর্ড হয়নি। অর্জুন চোখ বন্ধ করল। বিপ বিপ বিপ টেলিফোনের নম্বর ঘোরানোর পর অনেক সময় লাইনটা পাওয়ার আগে বিপ বিপ বিপ শব্দ শোনা যায়। নির্দিষ্ট নম্বরে পৌঁছোবার প্রয়াস চালিয়ে যায়।

অর্জুন মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

চলুন, বেরিয়ে পড়ি। পাখিটাকে লোকেট করতেই হবে।

কেন?

ওর ডাকটাকে ব্যবহার করা যায়। লুসি নেমে পড়লেন।

অর্জুন ঘড়ি দেখল, এখন জঙ্গলে গেলে ফিরতে সন্ধে হয়ে যাবে। আমাদের তো আজই এখান থেকে চলে যাওয়ার কথা। অর্জুন বলল।

কিন্তু আমার যে ওই পাখিটাকে দরকার।

আপনি পাবেন। এই খুঁটিমারিতে যত পাখি আছে, তার সবটাই পাওয়া যাবে গোরুমারায়। চাপড়ামারি অথবা জলদাপাড়ায়।

যদি না পাওয়া যায়?

তা হলে এখানে ফিরে আসব। এমন কিছু দূরত্ব নয়, অর্জুন আশ্বস্ত করল তাকে। গুছিয়ে নেওয়ার জন্য দশ মিনিট সময় দিয়ে অর্জুন নিজেদের ঘরে ঢুকে দেখল, মেজর ডায়েরি লিখছেন। তাকেও তৈরি হতে বলে মোবাইলটা অন করল অর্জুন। বাঃ, এই মুহূর্তে নেটওয়ার্ক আছে। সে জলপাইগুড়ির বাড়ির ল্যান্ডলাইন ধরবার জন্যে বোতাম টিপতেই শুনতে পেল, বিপ বিপ বিপ। তারপর স্ক্রিন সাদা, নেটওয়ার্ক চলে গেল। অবিকল ওই পাখির ডাক।

.

গাড়ি সারানো হয়ে গিয়েছিল। লুসি বসলেন ড্রাইভারের পাশে, ওরা পিছনে। অর্জুন লক্ষ করছিল কেউ তাদের অনুসরণ করছে কিনা। সে ঠিক করল, গয়েরকাটার চৌমাথা দিয়ে জলদাপাড়ায় যাবে না। ড্রাইভারকে বলল, পদমবাহাদুর, তুমি হিন্দুপাড়া দিয়ে বিনাগুড়ির রাস্তাটা চেনো?

জি সাব।

ওই রাস্তায় চলো।

কয়েক মিনিটের মধ্যে শর্টকাট পথ ধরে ওরা বিনাগুড়ির দিকে ছুটতে লাগল। একটু তরল গলায় জিজ্ঞেস করল অর্জুন, পদমবাহাদুর, কাল রাত্রে যারা গাড়ির ক্ষতি করেছে, তাদের খবর পেলে?

বদমাশরা বেঁচে গিয়েছে!

মানে?

কাল রাতে, ভোর রাতে, একটা সুমো গাড়ি নাথুয়ার দিক থেকে এসে গয়েরকাটার তিনমোড়ে গাছের গায়ে ধাক্কা মারে। তখন সবাই ঘুমোচ্ছিল। শব্দ শুনে বেরিয়ে এসে দ্যাখে, গাড়িটা কাত হয়ে পড়ে আছে। ড্রাইভার বা কেউ নেই। দুপুরে আমার গাড়ি নিয়ে ফেরবার সময় দেখলাম, পুলিশ এসে গিয়েছে। শুনলাম, ওই সুমোটা নাকি গতকালই চুরি হয়ে গিয়েছিল শিলিগুড়ি থেকে।

অদ্ভুত ব্যাপার। এরা গাড়ি চালালেই অ্যাক্সিডেন্ট করে নাকি! কিন্তু অত ভোরে এই গয়েরকাটার মতো নির্জন জায়গা পেরিয়ে গিয়ে লুকোবে কোথায়? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।

পদমবাহাদুর মাথা নাড়ল, কোনও ট্রাক ধরে হাওয়া হয়ে গিয়েছে।

সেটা অস্বাভাবিক নয়। জাতীয় সড়ক দিয়ে প্রতি মিনিটে ট্রাক যাওয়া আসা করে অসম থেকে। তার একটাকে থামিয়ে উঠে পড়লেই হল।

গয়েরকাটা ছাড়িয়ে বীরপাড়া হয়ে মাদারিহাটের দিকে ছুটে যাচ্ছিল গাড়ি। অর্জুন দেখল, রাস্তার দুপাশে জঙ্গল কেটে বসতি তৈরি হয়ে গিয়েছে বীরপাড়া পর্যন্ত। মাদারিহাটে যখন তাঁরা পৌঁছোল তখন ঘন বিকেল। আর-একটু এগিয়ে রাস্তাটা যেখানে বাঁক নিয়েছে সেখানে টুরিস্ট বাংলো। বাংলোয় গিয়ে পরিচয় দেওয়ার আগেই কেয়ারটেকার বললেন, নমস্কার অর্জুনবাবু।

অর্জুন বলল, নমস্কার। আমরা কাল রাতে ছিলাম খুঁটিমারির বাংলোয়। জলপাইগুড়ির ডি এফ ও অনুমতি দিয়েছিলেন। এই ভদ্রমহিলার শখ পাখির ডাক রেকর্ড করা। তা আমাকে বলা হয়েছে, জলদাপাড়া কোচবিহারের ডি এফ ও-র এলাকা। আপনাদের বাংলোয় নিশ্চয়ই জায়গা নেই। কোনও প্রাইভেট থাকার ব্যবস্থা আছে?

ভদ্রলোক হাসলেন, তার আর দরকার হবে না। একটু আগে হলং বাংলোটা খালি হয়েছে। কলকাতার এক পার্টি চার দিনের জন্যে বুক করেছিল। ওরা গতকাল এসেছিল, কিন্তু আজই একটা খারাপ খবর পেয়ে ফিরে গিয়েছে কলকাতায়। এ ক্ষেত্রে তিনটে রাত বাংলো খালি থাকছে। আপনারা স্বচ্ছন্দে তিন রাত ওখানে থাকতে পারেন।

বাংলোটা কোথায়?

একেবারে জলদাপাড়া ফরেস্টের ঠিক মাঝখানে। আপনারা চলে যান, আমি ওখানকার রেঞ্জারকে ফোনে বলে দিচ্ছি।

ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়িতে উঠল অর্জুন। ঢোকার মুখে পাহারাদারের চৌকি, গেট বন্ধ। সেখানে পরিচয়পত্র দেখালে, লেখালেখির পর গেট খুলে দেয়। যেহেতু ওরা কেয়ারটেকারের কাছ থেকে আসছে, তাই কোনও সমস্যা হল না।

মেজর এতক্ষণে মুখ খুললেন, আচ্ছা অর্জুন, তুমি জানতে ফরেস্টের কোনও বাংলোয় জায়গা নেই। শুধু খুঁটিমারিই আমাদের ভরসা ছিল। তা হলে কোন সাহসে সেই বাংলো ছেড়ে এদিকে এসেছিলে! কিছু না পেলে তো আবার ফিরে যেতে হত!

না, যেতাম না। এখান থেকে ফুন্টশোলিং ঘণ্টাখানেকের রাস্তা। ওখানে চলে যেতাম। বিদেশ ঘোরাও হয়ে যেত। অর্জুন হাসল।

জঙ্গলের মধ্যে চমৎকার রাস্তা। অর্জুন বলল, এই জঙ্গলে গন্ডার, বাইসন এবং হাতি যে-কোনও মুহূর্তে দেখলে অবাক হবেন না।

কথাটা সে বলেছিল ইংরেজিতে। লুসি কাঁধ নাচালেন, আই অ্যাম নট ইন্টারেস্টেড। এর মধ্যে বুঝতে পেয়েছি, প্রচুর পাখি আছে এখানে।

রেঞ্জার সাদরে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে অর্জুনকে বললেন, আপনি কি এবার কোনও অভিযানে এসেছেন? তা হলে আমাকে সঙ্গে নেবেন।

অর্জুন মাথা নাড়ল, এবার এসেছি পাখির ডাক শুনতে। উনি ওই নিয়ে গবেষণা করছেন। খুব ইন্টারেস্টিং ব্যাপার।

রেঞ্জার বললেন, কিছুটা দূরে জঙ্গলের মধ্যে একটা ঝিল তৈরি করা হয়েছে। প্রচুর পাখি হয় শীতকালে। এখনও কিছু আছে। গিয়ে দেখতে পারেন।

মেজর জিজ্ঞেস করলেন, এখানে আপনাদের সমস্যা কী কী?

মূল সমস্যা দুটো। চোরা-কাঠকারবারি আর গন্ডারশিকারি। তবে আগের চেয়ে অনেক কমে গিয়েছে।

তখন সন্ধে হয়ে এসেছে। জঙ্গলের উপর ঘন ছায়া। লুসি ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন, রাতে এই জঙ্গলের ভিতর ঢোকা কি নিরাপদ নয়?

না। বিশেষ করে বাইসন বা হাতির সামনে পড়লে ফিরে আসতে পারবেন না, রেঞ্জার বললেন। সবচেয়ে ভাল সময় ভোর সাড়ে চারটে থেকে পাঁচটা। প্রচুর পাখির ডাক শুনতে পাবেন সে সময়।

হলং বাংলোটি চমৎকার। বোঝাই যায় মন্ত্রী বা বড় আমলারা ওখানে মাঝেমধ্যে ওঠেন। তিনটে খালি ঘর পাওয়ায় সুবিধে হয়েছিল। রাত দশটায় জেনারেটর বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন হারিকেনের আলো ভরসা। তার আগে খেয়ে নিতে হবে। নিজের ঘরে বসে অর্জুন মোবাইলে গেম খেলছিল। হঠাৎ মেজর ঢুকলেন বেশ উত্তেজিত হয়ে, কাম, ভিতরে এসো। পাজি, নচ্ছার।

অর্জুন উঠে দাঁড়িয়ে দেখল, একটি রোগা মানুষ দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে হাতজোড় করে। ভয়ে কাঁপছে বেচারা। মেজর বললেন, কী আস্পর্ধা, আমার ঘরে মশারি টাঙাতে আসে একপেট হুইস্কি খেয়ে! আবার যতবার জিজ্ঞেস করছি ডিউটিতে থাকার সময় কেন হুইস্কি খেয়েছ, ততবারই বলছে খায়নি। লায়ার। ওর শাস্তি হওয়া উচিত।

অর্জুন তাকাল লোকটার দিকে। লোকটা চেঁচিয়ে উঠল, আমি হুইস্কি খাইনি সাহেব।

আবার মিথ্যে কথা! সারাজীবন ওটা খেয়ে এসেছি, আমি জানি না ওরকম নেশা কী খেলে হয়! তুমি নিশ্চয়ই আমার উপর এ ব্যাপারে আস্থা রাখবে অর্জুন।

নিশ্চয়ই। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা। হুইস্কি কিনে খাওয়া ওর পক্ষে তো অসম্ভব ব্যাপার। তা হলে ও খেল কোথায়? অর্জুন বলল।

সোজা ব্যাপার। কোনও গেস্টের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছে।

আমার তা মনে হয় না। এই জঙ্গলের গভীরে, ও জিনিস যারা পছন্দ করে তারা টাকা দিতে পারে, কিন্তু নেশার বস্তু দান করবে না। অর্জুন এগিয়ে গেল, বুঝলাম, তুমি সত্যি কথা বলছ, হুইস্কি খাওনি।

এতক্ষণে লোকটার মুখে হাসি ফুটল, হ্যাঁ সাহেব, হুইস্কি খাইনি।

কিন্তু কিছু একটা খেয়ে নেশা করেছ। কী সেটা?

হাঁড়িয়া। আমরা যে হাঁড়িয়া খাই, তা সবাই জানে।

হাঁড়িয়া? মেজর একপা এগিয়ে এলেন, হোয়াট দ্যাট?

কান্ট্রি লিকার। ওরা বাড়িতে বানিয়ে খায়। অনেকটা বিয়ারের মতো।

মাই গড। সেটার এফেক্ট একেবারে হুইস্কির মতো?

তা আমি বলতে পারব না।

কিন্তু জিনিসটা আমি দেখতে চাই।

অর্জুন পকেট থেকে দশ টাকার নোট বের করে এগিয়ে ধরল। এতে এক বোতল হাঁড়িয়া পাওয়া যাবে?

লোকটা সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়ল। অর্জুন বলল, যাও, নিয়ে এসো। এই সাহেবকে দ্যাখাবার পর কাজ শেষ হয়ে গেলে তুমি খেয়ে নিয়ো।

লোকটা তৎক্ষণাৎ টাকা হাতে নিয়ে অন্ধকারে উধাও হয়ে গেল। মেজর মাথা নাড়লেন, না, অর্জুন একটা মিথ্যেবাদীকে তুমি প্রশ্রয় দিলে!

বোধহয় না। এখন বলুন, এখানে কেমন লাগছে আপনার?

দারুণ। তবে আফ্রিকার জঙ্গলের মতো রহস্যময় নয়।

তা হলে আসুন, আমরা আজকের রাতটা জেগে দেখি, রহস্য কিছু আছে কিনা!

মেজরের চোখ ছোট হল, বলছ? একটা রাত তো জেগে থাকাই যায়। লুসিকেও বলি।

না না। ওঁকে রেস্ট নিতে দিন। কাল সকালে ওঁর তো অনেক কাজ। অর্জুন আপত্তি করল। এইসময় তার মোবাইলে আলো জ্বলে উঠল। কেউ ফোন করেছে মনে করে ওটা তুলতেই আলো নিভে গেল। অর্জুন দেখল নেটওয়ার্ক আছে। কিন্তু ফোন এলে তো রিং হত।

মেজর বললেন, ওই বস্তুটি খুব বিরক্তিকর। তোমার প্রাইভেসি বলে কিছু থাকবে না। যেখানেই যাও, লোকে তোমার কাছে পৌঁছে যাবে। আমেরিকার রাস্তায় প্রতি তিনজনের দু’জনে বিড়বিড় করতে করতে হাঁটে। আজকাল তো কানে ফোন চেপে রাখতে হচ্ছে না, রিমোটে শুনতে পাচ্ছে।

অর্জুন বলল, এটা নেওয়ায় মা খুব খুশি। যখন ইচ্ছে আমার খবর পাবেন। অথচ গতকাল থেকে তিনি একবারও ফোন করেননি!

এইসময় দরজায় শব্দ হল। অর্জুন বলল কে?

সেই লোকটি সসংকোচে ঘরে ঢুকল। হাতে ছোট বোতল।

অর্জুন মেজরকে বলল, নিন, পরীক্ষা করে দেখুন।

মেজর খপ করে বোতলটা ধরে উপরে তুলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলেন। নাকের নীচে নিয়ে এসে গন্ধ শুকলেন, কী দুর্গন্ধ!

ভাত পচিয়ে ওরা ওই তরল পদার্থ তৈরি করে, যাকে আপনি দামি হুইস্কি ভেবে ভুল করছিলেন। অর্জুন বলল।

আমার বিশ্বাস হচ্ছে না ভাই। যা বলছ, তাতে বুঝতে পারছি এটা খুব সস্তার জিনিস। তা হলে দামি জিনিসের সমান এফেক্ট কী করে হবে। আর যদি হয়, তা হলে আন্তর্জাতিক মদ্যপায়ী অ্যাসোসিয়েশনের নজরে আনা উচিত। হয়তো দেখবে লক্ষ লক্ষ লিটার হাঁড়িয়া বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। গন্ধটা যদি কোনওভাবে কমানো যায় তা হলে…। অবশ্য এফেক্ট একই থাকবে কিনা সন্দেহ হচ্ছে, মেজর বোতলটাকে ভাল করে দেখলেন আবার, কোনও নাম লেখা নেই। তার মানে নেহাতই দিশি।

অর্জুন বলল, আপনি তো বিয়ার-হুঁইস্কিরাম এ জীবনে আর মুখে তুলবেন না বলে ঘোষণা করেছেন। খুব ভাল সিদ্ধান্ত। কিন্তু টি-টেস্টারের মতো হাঁড়িয়া-টেস্টার হবেন না, এমন প্রতিজ্ঞা কি করেছেন?

না, তা অবশ্য করিনি, বলে লোকটির দিকে তাকালেন। ঠিক হ্যায়, তুমি যেতে পারো। কাল সকালে তোমার সঙ্গে কথা বলব।

লোকটা চলে গেল। হঠাৎ খেয়াল হল মেজরের, ইস, লুসি অনেকক্ষণ একা আছে। যাই, ওর খবর নিয়ে আসি। আমি আজ ঘরেই ডিনার খেয়ে নেব, বুঝলে? বেশ টায়ার্ড। গুড নাইট।

.

রাত তখন একটা। হলং ফরেস্ট নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে জঙ্গল থেকে অদ্ভুত সব প্রাণীর চিৎকার ভেসে আসছে। অর্জুন জানলার পাশের চেয়ারে বসে অলস চোখে অন্ধকার দেখছিল। একটু ঝিমুনি আসছে। কোনও কারণ নেই, তবু সে স্থির করেছিল রাতে ঘুমাবে না। দিনে ঘুমোও, রাতে জাগো’, নির্দেশটা না হয় আজ পালন করবে। এইসময় অন্ধকারকে একটু নড়তে চড়তে দেখে সে সোজা হয়ে বসল। তারপর বুঝল, গেটের বাইরে হাতির দল দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে তাদের চেহারা অস্পষ্ট। তবু, এক-দুই করে গোটাছয়েকের শরীরের আভাস পেল অর্জুন। শেষপর্যন্ত দলটা চলে গেল বাঁদিকে। অর্জুনের মনে প্রশ্ন এল, ওরা কখন ঘুমোয়?

রাত গড়াচ্ছিল। হঠাৎ অন্ধকার ঘরে মোবাইলের আলো দপদপ করে উঠতেই চমকে তাকাল অর্জুন। কোনও রিং হচ্ছে না। মোবাইলের স্ক্রিনে ফুটে উঠেছে, প্রাইভেট নম্বর। আর তখনই মাথার ভিতরে অদ্ভুত অস্বস্তি শুরু হল। স্পষ্ট কানে এল, বিপ, বিপ, বিপ…? তিনবার ওই একটানা শব্দের পর গলার স্বর কানে এল, হ্যালো, হ্যালো অর্জুন! তুমি কি শুনতে পাচ্ছ? হ্যালো অর্জুন?

পাচ্ছি। আপনি কে? ফিসফিস শব্দে জিজ্ঞেস করল অর্জুন।

আমি, আমি। শোনো, ওই মেয়েটির দিকে নজর রেখো। সাবধান। মেয়েটি খুব বিপদের মধ্যে আছে, যা ওর জানা নেই। হ্যালো হ্যালো…! যেভাবে টেলিফোনের লাইন কেটে যায় তেমনভাবে কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হয়ে গেল। আর সেটা হওয়ামাত্র মাথা ধরে গেল অর্জুনের। কপালের দু’পাশের শিরা দপদপ করতে লাগল। সে মোবাইল তুলে দেখল, আলো নিভে গিয়েছে। কল রিসিভড-এ লেখা হয়েছে, আ প্রাইভেট নম্বর।

এইসময় দরজায় টোকা পড়ল। হারিকেনের আলো ঈষৎ বাড়িয়ে দিয়ে দরজা খুলল অর্জুন। মেজর দাঁড়িয়ে আছেন, ওটা হুইস্কির বাবা, বুঝলে। কথা জড়ানো।

আপনি পুরোটা খেয়ে নিলেন? অর্জুন অবাক।

না খেলে বুঝব কী করে? আমার খুব নেশা হয়ে গিয়েছিল।

কী করে বুঝলেন?

বুঝব না? হঠাৎ মনে হল, কে যেন জানলা দিয়ে একটা বড় জবাফুলের মালা ছুঁড়ে দিল আমার গলায়। আশ্চর্য, উঠতে না-উঠতে মালাটা ভ্যানিশ হয়ে গেল। বুঝতে পারছ, কী বিপুল নেশা! এরকম আমার কখনও হয়নি। তাই তোমাকে না জানিয়ে পারলাম না, মেজর আবার নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন।

অর্জুন বাধা দিল, মেজর!

ইয়েস মাই বয়!

আমি একটা বইয়ে পড়েছি, যারা বুঝতে পারে তাদের নেশা হয়ে গিয়েছে, তাদের মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে যায় না। আপনার হয়নি, দাঁড়ান। নিজের ঘর বন্ধ করে সে মেজরকে নিয়ে ওপাশের ঘরে ঢুকল। হারিকেনের আলো টিমটিম করছে। সেটাকে বাড়াল।

হেসে জিজ্ঞেস করল, জবাফুলের মালা ওই জানলা দিয়ে কেউ ছুঁড়েছিল?

ইয়েস। মাথা নাড়লেন মেজর।

আপনার কী করে মনে হল ওটা জবার মালা, গাঁদাও তো হতে পারে।

নো, রেডিশ, লালচে।

বাব্বা! আপনার রংও খেয়াল আছে।

অ্যাজ বিকজ আমার নেশা হয়নি। মেজর টলছিলেন।

এইজন্য বলে, অনভ্যাসের চন্দন কপালে চড়চড় করে।

তার মানে?

অনেকদিন পরে খেলেন তো! অভ্যেস চলে গিয়েছে। বোতলটা তুলে ভাল করে দেখল অর্জুন। এক বিন্দুও তলানি নেই।

ঘুম পাচ্ছে হে, গুড নাইট। মেজর বিছানার দিকে গেলেন।

আরে! আমি চলে গেলে দরজা বন্ধ করে তবে তো শোবেন। খাটের তলায় উঁকি মারল অর্জুন, মালা কেউ ছোড়েনি। স্বপ্ন দেখেছেন। মশারি টাঙাননি কেন? টাঙিয়ে দেব? ভোরের মশা কিন্তু মারাত্মক।

না ভাই। আচ্ছা, দুটো বালিশ ছিল, একটা কোথায় গেল? তুমি নিয়েছ?

অদ্ভুত কথা বলেন। নিশ্চয়ই ওপাশে পড়ে গিয়েছে। অর্জুন ঘুরে খাটের ওপাশে গিয়ে বালিশটাকে দেখে বাঁহাত বাড়াতে যেতেই ফোঁস করে ফণা তুলল একটা কালচে সাপ। মেঝে থেকে অন্তত চার ফুট উঁচুতে ফণাটা উঠতেই ডান হাতে ধরা হাঁড়িয়ার বোতলটা দিয়ে অর্জুন বিদ্যুৎগতিতে আঘাত করল ওর মাথায়। ছিটকে পড়ে গেল সাপটা। লাফিয়ে পাশে গিয়ে চটিপরা ডান পা ওর মাথার উপর সমস্ত শক্তি দিয়ে চেপে ধরতেই সাপটা কয়েকবার লেজ আছড়ে নেতিয়ে পড়ল।

ওটা মরে গিয়েছে বোঝবার পর অর্জুন সাপটাকে মাথার নীচে ধরে উপরে তুলল। অন্তত এক কেজি ওজনের বিষধর সাপ। এতক্ষণ মেজর হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অর্জুন হাসল, এই আপনার জবাফুলের মালা। স্বপ্নেও রঙের কাছাকাছি গিয়েছিলেন! কেউ ওই জানলা দিয়ে আপনার বিছানায় এটা ছুঁড়ে দিয়েছিল। বোধহয় বালিশে ধাক্কা লাগায়, ইনি বালিশের সঙ্গেই নীচে পড়ে যান। নইলে আপনার কী অবস্থা এতক্ষণে হত অনুমান করে দেখুন!

মাই গড। এত বড় সাপ ছুড়বে কে? মেজরের নেশা পাতলা হচ্ছিল।

কে ছুঁড়েছিল জানতে হলে, কেন ছুঁড়েছিল তা জানা দরকার।

কেন ছুঁড়েছিল! মেজর বিড়বিড় করলেন, আমি তো এখানে প্রথম এলাম। কারও সঙ্গে আমার শত্রুতা নেই।

মনে হচ্ছে, ওরা ঘর ভুল করেছে। অর্জুন বলল, যাক গে, এখন এসব নিয়ে ভেবে কোনও লাভ হবে না। জানলাটা বন্ধ করে দিচ্ছি। আপনি দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ুন। মরা সাপটাকে জানলার বাইরে ছুঁড়ে দিয়ে জানলাটা বন্ধ করে দিল অর্জুন।

তুমি ঘুমোবে না?

না।

ও। তা হলে চলো, তোমার খাটে না হয় শোব আমি। মানে, তুমি যখন আজ ঘুমোচ্ছ না, তখন তো খাটটা খালিই থাকবে…!

ঘুমোব না, কিন্তু খাটে শোব না কি বলেছি? দরজা বন্ধ করুন। অর্জুন ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই দূরে সাদা কিছুকে সরে যেতে দেখল। যেন কেউ দৌড়ে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। একটু আগে সেই কণ্ঠস্বর জানিয়েছে যে, লুসি জানেন না তিনি বিপদে আছেন। কাল সকালে ওঁর সঙ্গে কথা বলতে হবে।

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার