অর্জুন@বিপবিপ ডট কম (২০০৬)
অর্জুন সমগ্র ৫ – সমরেশ মজুমদার

কদমতলার মোড়ে বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে ছিল জগন্নাথদা। জলপাইগুড়ি শহরের কিছু এই মানুষ অনেক চেষ্টা করেও ব্যবসায় সফল হতে পারেননি। না পারার কারণ তাঁর সততা। এই জগন্নাথদাকে অনেকদিন ধরে চেনে অর্জুন। বাড়ির নীচে বড় রাস্তার উপর তাঁর দোকান। গত দশ বছরে অন্তত তিনবার দোকানের চরিত্র বদলাতে বাধ্য হয়েছেন ব্যাবসা না জমায়। এখন করছেন। মোবাইলের ব্যাবসা।

প্রথম দিকে বেশ ভিড় দেখেছে অর্জুন জগন্নাথদার দোকানে। ইদানীং লোকজন চোখে পড়ত না। খদ্দের নেই বলেই বোধহয় জগন্নাথদা দোকানের সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। অর্জুন পাশে গিয়ে দাঁড়াল, কী ব্যাপার? বাইরে দাঁড়িয়ে আছ?

ভিতরে বসে কী করব? খদ্দের কোথায়?

সেকী! এখন তো প্রায় পঞ্চাশভাগ মানুষের হাতে মোবাইল। তোমার তো ব্যাবসা ভাল হওয়া উচিত। অর্জুন বলল।

তুমি সত্য অন্বেষণ করে বেড়াও, অথচ কোনও খবর রাখে না। আমার দোকানে এসে মোবাইল কিনলে কাস্টমারকে তার আইডেন্টিটির প্রমাণ দ্যাখাতে হয়। ফর্ম ভরতি করতে হয়। কোনও মোবাইল কোম্পানির পোস্ট-পেড কানেকশন নিতে হলে নিয়মকানুন মানতে হয়। তা ছাড়া আমি কোম্পানির কাছ থেকে যে-দামে সেট নিয়ে আসি, তাতে খুব বেশি কমিশন পাই না। তাতেই এক-একটা সেট চার থেকে পাঁচ হাজারের কমে বিক্রি করা যায় না। অথচ জলপাইগুড়িতে দেড়-দু’হাজারে প্রচুর সেট পাওয়া যাচ্ছে অনায়াসে। কোনও নিয়মকানুন নেই। অতএব লোক।

আমার কাছ থেকে কিনবে কেন? শ্বাস ফেললেন জগন্নাথদা।

এত সস্তায় সেট কী করে পাচ্ছে? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।

বিদেশ থেকে স্মাগলাররা নিয়ে আসছে। এখন ক্যামেরা লাগানো মোবাইল সেট ছ’হাজারে কেনা যাচ্ছে। জগন্নাথদা বললেন।

কিন্তু সেগুলো খারাপ হয়ে গেলে?

সাধারণত দু-তিন বছরের মধ্যে খারাপ হয় না। কি-প্যাড নষ্ট হয়ে যেতে পারে। চল্লিশ টাকা খরচ করলে নতুন প্যাড লাগিয়ে নেওয়া যায়?

পুলিশ কিছু বলছে না?

জানি না ভাই। দেখবে সবাই প্রি-পেড কার্ড ব্যবহার করে। ফলে কোনও অপরাধীকেই মোবাইলের সূত্র ধরে ধরা যাবে না।

কাছাকাছি কাউকে পাওয়া যাবে, যে চোরাই সেট বিক্রি করে?

রূপমায়া সিনেমায় যারা টিকিট ব্ল্যাক করে, তাদের কাছে গিয়ে খোঁজ করো, পেয়ে যাবে। জগন্নাথদা বললেন।

.

এখন বিকেল। রূপমায়াতে শাহরুখের ছবি চলছে। হাউসফুল। ম্যাটিনি ভেঙেছে একটু আগে। অর্জুন হলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বেশ ভিড়। কানে এল গুনগুনানি, কুড়ি পঞ্চাশ, কুড়ি পঞ্চাশ। সঙ্গে সঙ্গে একজন ছেলেটার কাছ থেকে চারটে টিকিট কিনে নিল। এইসময় অর্জুনের সামনে এসে হাতজোড় করে দাঁড়াল টাকমাথা একটা লোক, দাদা আপনি? সিনেমা দেখবেন?

লোকটাকে কয়েকবার দেখেছে বলে মনে হল অর্জুনের। সে কিছু বলার আগেই লোকটা বলল, বাম্পার হিট। হাউসফুল চলছে। তবে আপনি চিন্তা করবেন না। আপনাকে দামে-দামেই টিকিট দিতে বলে দিচ্ছি ওদের।

কেন?

কী যে বলেন! আপনাকে কে না চেনে? আপনার একটা ফোনে এস পি সাহেব চলে আসবেন দশ মিনিটের মধ্যে! জানি না নাকি? লোকটা হাসল।

অর্জুন মাথা নাড়ল, রাস্তা থেকে ফোন করব যে, ফোন কোথায়?

কেন? আপনার মোবাইল নেই? টাকমাথা নোকটা খুব অবাক হল।

একটু ভাবল, আপনি কাল সকালে বাড়িতে থাকবেন?

কেন?

যে মোবাইল বিক্রি করে, তাকে বলব, বেশ কয়েকটা সেট নিয়ে যেতে। আপনি পছন্দ করে নেবেন। দামের জন্যে ভাববেন না, বাজার থেকে অনেক কমে পাবেন।

আমার বাড়ি কোথায় জানা আছে?

কী যে বলেন দাদা! এখন বলুন, সিনেমার ক’টা টিকিট লাগবে?

না না। আমি এক বন্ধুকে খুঁজতে এসেছিলাম। সিনেমা দেখতে নয়।

.

ঠিক সকাল নটায় টাকমাথা লোকটা বেঁটে মোটা মানুষকে নিয়ে এল। লোকটার হাতে একটা অ্যাটাচি। সেটা খুলতেই অর্জুন নানা মডেলের মোবাইল সেট দেখতে পেল। লোকটি বলল, এগুলো উইথ ক্যামেরা এবং রেডিয়ো। কানে এই নবটা ঢুকিয়ে রাখলে আপনাকে আর সেট হাতে ধরে রাখতে হবে না। গাড়ি বা বাইক চালাতে চালাতে আরামসে কথা বলতে বা শুনতে পারবেন। এগুলোয় রেডিয়ো নেই, শুধুই ক্যামেরা। আর এগুলো অর্ডিনারি সেল, কিন্তু তিন বছরের মধ্যে ব্যাটারি চেঞ্জ করতে হবে না।

এগুলো ব্যবহার করা সেট নয় তো?

কী বলছেন স্যার! একেবারে অরিজিন্যাল নিউ সেট আসছে বাইরে থেকে। এই দেখুন। এই নম্বর টিপলেই দেখতে পাবেন ব্যাটারি কবে তৈরি হয়েছে।

অর্জুন দেখল। মাত্র তিনমাস আগের ব্যাটারি।

ক্যামেরা-রেডিয়ো সমেত সেটটির দাম জিজ্ঞেস করল অর্জুন। লোকটি হাসল। আপনার কাছে তো বাড়তি দাম চাইতে পারব না। এদেশে কোম্পানির কাছ থেকে কিনতে আশি হাজারের নীচে পাবেন না।

আপনি কততে দিচ্ছেন? অর্জুন তাকাল।

আমরা পঁয়ত্রিশে দিয়ে থাকি, আপনি না হয় ত্রিশ দিন।

ওরে বাবা! অর্জুন মাথা নাড়ল।

এর নীচে দেওয়া যায় না স্যার। কত হাত ঘুরে আসছে বলুন।

কত হাত?

শুনেছি বিদেশি জাহাজ থেকে ঝেড়ে মায়নামারে নামানো হয় পেটি। তারপর সেই পেটিগুলো খুলে খুলে বিভিন্ন জায়গায় চালান করা হয়। ইন্ডিয়ায় ঢোকে ভুটান হয়ে। অন্তত ছ’বার হাতবদল হয়। লোকটি গর্বের সঙ্গে বলল।

আপনি পেয়েছেন কার হাত থেকে?

আমি শিলিগুড়ির একজন ব্যবসায়ীর সেল-এজেন্ট।

কী নাম?

মাফ করবেন স্যার। নাম বলতে পারব না। নিষেধ আছে। এবার যে লোকটি সতর্ক হয়েছে, তা তার মুখ-চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল।

তিনি ভুটান থেকে নিয়ে আসেন?

ওই আর কী! আপনি যদি নেন, তা হলে ত্রিশে দিয়ে দিতে পারি।

যদি পুলিশ আমাকে জিজ্ঞেস করে, কোথায় পেলে?

সেই ব্যবস্থাও আছে। তার জন্য মাত্র দু’হাজার বেশি দিতে হবে।

কীরকম?

বলবেন, থিম্পু থেকে কিনেছি। থিম্পুর একটা দোকানের রসিদ দিয়ে দেব আপনাকে। অরিজিন্যাল রসিদ। লিগাল পেপার। ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে যেতে ভারতীয়দের ভিসা করতে হয় না, পাসপোর্টের প্রয়োজন নেই। পুলিশ বিশ্বাস করতে বাধ্য। কারণ দোকানটা আছে কিনা, ই খোঁজ করতে থিম্পু যাওয়া ভারতীয় পুলিশের পক্ষে সম্ভব নয়। দুটো দেশ তো আলাদা।

ভূটান-পুলিশকে অনুরোধ করতে পারে তদন্ত করে দ্যাখার জন্য।

আপনি কি ভেবেছেন এরকম ঘটনা আগে ঘটেনি? ভুটানের পুলিশ জানিয়ে দিয়েছে ওই নামের দোকান থিম্পুতে আছে এবং তারা আইনসংগতভাবে সেট বিক্রি করে।

অর্জুন তাকাল, কিন্তু আপনারা বেআইনি কাজ করছেন এবং এই অন্যায় করার জন্য, যারা আইন মেনে ব্যাবসা করতে চান তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আমি ইচ্ছে করলে আপনাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারি।

নিশ্চয়ই পারেন। আমাকে পুলিশে দিলে যদি এই মোবাইল ব্যাবসা বন্ধ হয়ে যায়, তা হলে দিতে পারেন। আমি আপত্তি করব না।

অর্জুন ভাবল, লোকটা যে-গলায় কথা বলছে তাতে কোথাও ওর জোর আছে। হয়তো পুলিশকে বলবে সবক’টার বৈধ কাগজপত্র আছে। তা ছাড়া একজনকে ধরলে তো অন্য স্মাগলারদের ব্যাবসা বন্ধ করা সম্ভব হবে না।

লোকটা বলল, এক কাজ করুন, আপনি পঁচিশ দিন। আমার একটা পয়সা লাভ থাকবে না, উলটে লস-ই হবে। হোক।

আপনি যেতে পারেন। মোবাইল কিনতে হলে আমি ভারতীয় মোবাইল এখানকার দোকান থেকে কিনব। অর্জুন উঠে দাঁড়াল।

.

বিকেলে অর্জুন জলপাইগুড়ি থানার কম্পাউন্ডে বাইক থেকে নামল। থানার ওসি তখন অফিস থেকে বেরোচ্ছিলেন, অর্জুনকে দেখে এগিয়ে এলেন, কী ব্যাপার, কেমন আছেন? আপনার তো সমস্যা না হলে আমাদের কথা মনে পড়ে না।

একেবারে সত্যি কথা। সমস্যায় না পড়লে এখানে আসা মানে আপনাদের সময় নষ্ট করা। কোনও জরুরি কাজে বেরোচ্ছেন?

না না। গত তিনদিন আমার থানায় কেউ একটা ডায়েরি করতে আসেনি। এটা একটা রেকর্ড! তাই ভাবলাম শহরটাকে একবার ঘুরে দেখে আসি। ওসি বললেন।

তা হলে চলুন, আমি একটা কমপ্লেন নথিভুক্ত করতে চাই।

কীরকম?

এই শহরে স্মাগল্ড মোবাইল সেট এত কম দামে বিক্রি হচ্ছে যে, সৎ দোকানদারদের ব্যবসায় লালবাতি জ্বলার উপক্রম হয়েছে। এই চোরাকারবারিদের উৎখাত করতে পুলিশ সক্রিয় হোক।

ওসি জিজ্ঞেস করলেন, পাবলিককে ঠেকাবেন কী করে?

তার মানে?

ছ’হাজারের জিনিস যদি দু’হাজারে পাওয়া যায়, তা হলে পাবলিক হাজার নিষেধ সত্ত্বেও কিনবে। লুকিয়ে কিনে ব্যবহার করবে, ওসি বললেন, আমার পক্ষে তো সবাইকে হাতেনাতে ধরা সম্ভব নয়।

ঠিক। কিন্তু যে বা যারা ওগুলো বিদেশ থেকে এনে এজেন্ট মারফত বিক্রি করছে, তাদের খুঁজে বের করা তো সম্ভব! অর্জুন বলল।

আমরা চেষ্টা করছি। এর আগে কয়েকটা সেট সিজ করলেও ছেড়ে দিতে হয়েছে। কারণ, ওরা থিম্পু কিংবা পারোর দোকানের রসিদ দেখিয়েছে। আপনার কাছে যদি কোনও সূত্র থাকে, তা হলে আমাদের সাহায্য করুন। কথা দিচ্ছি, অলআউট যাব।

.

অর্জুন জগন্নাথদার দোকানে চলে এল। তখন একজন বয়স্ক মানুষ কাউন্টারের এপাশে দাঁড়িয়ে। বাইক থেকে নেমে দোকানে ঢুকতেই জগন্নাথদা একটু অবাক হয়ে তাকালেন।

ভাবছি, এবার মোবাইল নেব।

বেশ তো! তোমার ক্ষেত্রে এটা প্রয়োজন, যেরকম ঘুরে বেড়াও।

ভদ্রলোক বললেন, পঁচিশ বছর আগে এই যন্ত্রের কথা কে জানত!

তা ঠিক। জগন্নাথদা বললেন, তার ছাড়া কথা বলার ব্যাপার কল্পনাতেই ছিল না।

শুনুন একটা ঘটনা। আমার এক আত্মীয়ের বাতিক ছিল টেলিফোনের। যে-বাড়িতেই যেত, তাদের ফোন থাকলে বলত, একটা কল করতে পারি? কোনও জরুরি কথা নয়! ডায়াল করে বলত, আমি এই বাড়িতে আছি এখন, কিছুক্ষণের মধ্যে বেরোব। আমরা বুঝতাম এটা ওর অসুখ। ফোন দেখলে স্থির থাকতে পারে না। একদিন আমি ওকে ব্যঙ্গ করে বলেছিলাম, তোমার যা অবস্থা, তাতে রাস্তায় হাঁটার সময় বাসে চলার সময়ও ফোন থাকলে খুশি হও। বছরতিনেক আগে সে আমাকে ফোন করে বলল, তোমার কথাই ঠিক হল, আমি বাসের সিটে বসে তোমাকে ফোন করছি। আমি আর কী বলব? একসময় যা অসম্ভব মনে হত, বিজ্ঞান তাকে কত দ্রুত সম্ভব করে। দিয়েছে।

জগন্নাথদা বললেন, ঠিক কথা। মোবাইল হাতে ধরে কথা বলতে হয় বলে সে সময় মানুষ অন্য কাজ করতে পারে না। গাড়ি যাঁরা চালান, তাঁরা চলন্ত অবস্থায় ওইভাবে কথা বললে দুর্ঘটনা ঘটা অসম্ভব নয়। তাই বেরিয়ে গেল রিমোট সিস্টেম। সরু তারের হেডফোন কানে গুঁজে, পকেটে মোবাইল সেট রেখে, দিব্যি দু’হাত মুক্ত রেখে সব কাজ করতে করতে কথা বলা সম্ভব হয়ে গিয়েছে।

ভদ্রলোক হাসলেন, দেখুন না, কিছুদিনের মধ্যে মোবাইল সেট-ই উঠে যেতে পারে। আপনাকে দোকান বন্ধ করতে হতে পারে।

সে তো এখনই করব ভাবছি। চোরাই ব্যাবসার সঙ্গে পেরে উঠব কী করে? জগন্নাথদা মাথা নাড়লেন, কিন্তু কেন বললেন কথাটা?

সেদিন আর বেশি দূরে নেই, যেদিন হ্যান্ডসেটের কোনও প্রয়োজন হবে। না। যার সঙ্গে কথা বলব তার মস্তিষ্কের সেল নেটওয়ার্কে ধরে কথা বললেই সে হয়তো শুনতে পাবে। কিছুই বলা যায় না। প্রি-পেড ক্যাশকার্ড কিনে ভদ্রলোক বেরিয়ে গেলেন।

জগন্নাথদা বললেন, খুব খুশি হব। আমার দোকান না হয় বন্ধ হবে, কিন্তু স্মাগলাররা তো বিপদে পড়বে। ও হ্যাঁ, কী ধরনের সেট নেবে?

সবচেয়ে কম দামের কী আছে?

তিন হাজার চারশোতে পেয়ে যাবে।

ঠিকঠাক কাজ করবে তো?

কথা বলা-শোনায় অসুবিধে হবে না। তবে দাম কম বলে শক্তিও কম। তুমি পাঁচ হাজারের এই সেটটা নাও। এর সম্পর্কে কোনও কমপ্লেন নেই।

ঠিক আছে। আমাকে কী করতে হবে?

নিয়ম হল, তোমার পরিচয়পত্র আর ফোটো দিয়ে এই ফর্মটা ভরতি করতে হবে। এখনই পোস্ট-পেডে যেয়ো না। প্রি-পেড ক্যাশকার্ড কিনে দ্যাখো কীরকম খরচ হচ্ছে। জগন্নাথদা ফর্ম বের করে প্রশ্ন করে করে সেটা ভরতি করলেন। ঠিক হল, অর্জুন আগামীকাল এসে ফোটো এবং প্রমাণপত্র দিয়ে যাবে। জগন্নাথদা চেক নিতে রাজি হলেন। অর্জুন বাড়ি ফিরে এল। মা বললেন, ইস, একটু আগে এলে তুই মেজরের সঙ্গে কথা বলতে পারতিস।

আচ্ছা! মেজর ফোন করেছিলেন? অর্জুন সবিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল।

হ্যাঁ। বললেন কয়েকদিনের মধ্যে উনি এদিকে আসছেন। দিল্লি হয়ে সোজা বাগডোগরায় নামবেন। বললেন, দিল্লিতে নেমে তোকে ফোন করবেন।

খুশি হল অর্জুন। মেজর আসা মানে দিনগুলো অন্যরকম হয়ে যাওয়া। ভদ্রলোক যে কেন এই বয়সে আমেরিকায় একা রয়েছেন, তা বুঝতে পারে না সে। এটা ওঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার ভেবে জিজ্ঞেসও করেনি।

এইসময় হাবু এল। হাবুকে দেখলেই অমল সোমের কথা মনে পড়ে যায়। অমলদা জলপাইগুড়ি ছেড়েছেন অনেকদিন, কিন্তু বাড়ি বিক্রি করেননি। হাবু সেই বাড়িটিকে বেশ যত্নে রেখেছে। বছরে দু’বার হাবুর নামে টাকা পাঠান অমল সোম। তাতে দিব্যি চলে যায় তার। সেই টাকায় ইলেকট্রিক, ট্যাক্স, টেলিফোনের ভাড়া মিটিয়ে হাবুর খাওয়া-পরায় কোনও অসুবিধে হয় না। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার?

হাবু হাসল। বেচারা কথা বলতে পারে না। তারপর পকেট থেকে একটা খাম বের করে সামনে ধরল। উপরে অর্জুনের নাম, কেয়ার অফ অমল সোম লেখা। একটু অবাক হল সে। অমলদা তার ঠিকানা জানা সত্ত্বেও নিজের বাড়ির ঠিকানায় চিঠি পাঠালেন কেন? চিঠি বের করে চোখ রাখল অর্জুন,

স্নেহের অর্জুন, আশা করি ভাল আছ। শ্রীমান হাবু যাতে একটু নড়াচড়া করে তাই আমার ঠিকানায় চিঠিটি পাঠাচ্ছি। মাঝে মাঝে ও মাথার ব্যথায় কষ্ট পেত। ওর কথা বলতে না পারার কারণ কণ্ঠনালি জিভ অথবা মস্তিষ্কের ঘাটতির কোনটা জানি না। তুমি ওর ব্রেন স্ক্যান এবং পি ই টি করিয়ে রিপোর্টটা পাঠাতে পারবে? এই একটা ব্যাপার, আমরা শরীর সুস্থ রাখতে পরীক্ষা করাই, কিন্তু ব্রেন সম্পর্কে বড় উদাসীন। তুমিও নিশ্চয়ই কখনও তোমার ব্রেন স্ক্যান করাওনি। তুমিও তোমার ব্রেনের স্ক্যানিং এবং পি ই টি রিপোর্ট পাঠাবে। এটা জরুরি। দুটো রিপোর্টই আমাকে মেলে পাঠাবে। আমার অ্যাড্রেস হল, সোম এ ডট নেট ডট কম।

তোমাদের অমলদা।

পুনশ্চ: তোমার মোবাইল নম্বর কী অবশ্যই জানাবে।

হাবুর দিকে তাকাল অর্জুন। মুখে হাসি যেন সেঁটে আছে।

সব ঠিক আছে তো?

মাথা নাড়ল হাবু। মাথায় হাত দিয়ে বোঝাল সেখানে ব্যথা হয়।

কাল সকাল আটটায় এখানে চলে এসো।

মাথা নেড়ে হাবু চলে গেল। হাবুর না হয় মাথায় ব্যথা হয়, তার তো কোনও সমস্যা নেই। তা হলে খামোখা স্ক্যান করাতে যাবে কেন? অমলদার যে বয়স বাড়ছে, এতে বোঝা যাচ্ছে। মাকে চিঠির কথা বলতেই উলটো কথা শুনল অর্জুন, দ্যাখ, উনি এখন প্রায় সন্ন্যাসীর জীবনযাপন করেন। ওঁর কথা ফেলিস না, যা বলেছেন তাই কর।

তার মানে তুমি বলতে চাও অমলদা যোগবলে জানতে পেরেছেন। আমার মাথার ভিতরে কিছু হয়েছে, যেটা আমিই জানি না। কপাল!

মা গম্ভীর হলেন, গুরুর আদেশ সবসময় শিরোধার্য করতে হয়। উনি যা করতে বলেছেন তাই কর বাবা।

.

টেলিফোনে অর্জুন কথা বলে রেখেছিল ক্লিনিকের ডাক্তারের সঙ্গে। হাবুকে নিয়ে সোয়া আটটার সময় সেখানে হাজির হয়ে সমস্যায় পড়ল অর্জুন। তার কাছে কোনও প্রেসক্রিপশন নেই। ওটা না থাকলে ঠিক কী রিপোর্ট চাইছে, তা স্পষ্ট হচ্ছে না। অর্জুন অমল সোমের চিঠি দ্যাখাল। হাবুর ব্যাপারটা ওঁরা বুঝতে পারলেন। জিজ্ঞেস করলেন, যিনি চিঠি লিখেছেন তিনি কি ডাক্তার?

না। তিনি একসময় সত্যসন্ধানী ছিলেন।

তা হলে কোনও ডাক্তারকে দিয়ে প্রেসক্রিপশন করিয়ে আনুন, প্লিজ।

কাছেই চৌধুরী মেডিক্যাল স্টোর্স। তার মালিক রামদার বয়স বেড়ে যাওয়ায় শুধু সকালের দিকটায় দোকানে আসেন। এখন ওঁর ছেলেই দোকান চালায়। হাবুকে নিয়ে সেখানে গেলে রামদাকে দেখতে পেল অর্জুন। মাথার চুল এখন ধবধবে সাদা হয়ে গেলেও হাসিটি অবিকল আছে। বললেন, কী খবর? ভাল তো?

ভাল ছিলাম। কিন্তু অমলদা বিপাকে ফেলেছেন। পড়ে দেখুন।

চিঠিটা পড়লেন রামদা। হাবুকে দেখলেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ওরা কি প্রেসক্রিপশন চাইছে?

হ্যাঁ।

পাশে-বসা ভদ্রলোককে রামদা জিজ্ঞেস করলেন, অর্জুনকে চেনেন?

আলাপ নেই, তবে জানি। ভদ্রলোক বললেন।

ওর গুরুর ইচ্ছে পূর্ণ করতে একটু সাহায্য করুন। অর্জুন, ইনি ডক্টর সুধীর রায়। আসা-যাওয়ার পথে আমাকে দোকানে দেখলে একটু গল্প করে যান।

অমলদার চিঠিটা পড়ে দু’জনের জন্য দুটো আলাদা প্রেসক্রিপশন লিখে নাম জিজ্ঞেস করলেন। হাবুর পদবি অর্জুনের জানা নেই। তাকে জিজ্ঞেস করেও কোনও লাভ হবে না। অতএব লিখতে হল, শ্রীহাবু…। অর্জুন রামদাকে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, ওঁর সম্মানদক্ষিণা কত?

ডক্টর রায় সেটা শুনতে পেয়ে হেসে ফেললেন, একটা পয়সাও না। রিপোর্টে কোনও গোলমাল থাকলে ওরাই বলে দেবে, তখন আমার চেম্বারে আসবেন।

.

রিপোর্ট আজ বিকেলে পাওয়া যাবে। পাঁচ হাজার টাকার সঙ্গে ছবি এবং ঠিকানার প্রমাণপত্র হিসেবে পাসপোর্টের জেরক্স নিয়ে জগন্নাথদার দোকানে চলে এল অর্জুন। সব দেখেশুনে জগন্নাথদা তিনটে তিনরঙের সেট সামনে রেখে জিজ্ঞেস করলেন, কোনটা পছন্দ, বলো?

অর্জুন ইস্পাতরঙা সেটটা তুলে নিল।

সব ঠিকঠাক করে জগন্নাথদা বললেন, এই তোমার নম্বর। একবার এই কাগজে চোখ বোলালেই তুমি বুঝে যাবে কী করে অপারেট করতে হবে। তোমার ফোন চালু হতে ঘণ্টাদুয়েক সময় লাগবে। দেখবে বাঁ দিকে একটা লাইন ফুটে উঠেছে।

আপাতত নিষ্ক্রিয় মোবাইল পকেটে রেখে বাইক চালিয়ে রিপোর্ট নিতে গেল অর্জুন। রিপোর্ট পেয়ে শুনল তার তো বটেই, হাবুর রিপোর্টও নর্মাল। হাবুর না হয় স্ক্যান করানো প্রয়োজন ছিল, কিন্তু নিজের স্ক্যানের পিছনে দেওয়া টাকাটার জন্য এখন আপশোস হতে লাগল অর্জুনের। অনেক টাকা ফালতু নষ্ট হল।

একটা সাইবার কাফেতে ঢুকল সে। মালিক তার চেনা। ঘণ্টায় কুড়ি টাকা নেয়। তাকে বলল, এই রিপোর্ট দুটো মেল করতে হবে। কত দেব?

একবার চোখ বুলিয়ে ছেলেটি বলল, দশ টাকা দেবেন। আপনি করবেন? তা হলে ওই মেশিনটার সামনে বসুন।

অর্জুন বসল। নেট খুলল। এই মেশিনগুলোর আয়ু বোধহয় ফুরিয়ে এসেছে। অনেক দেরিতে কানেকশন পাওয়া গেল। পুরো রিপোর্ট টাইপ করে অমলদার ই-মেল অ্যাড্রেসে পাঠিয়ে দিল অর্জুন। সেই সঙ্গে নতুন মোবাইলের নম্বর।

তারপর দশটা টাকা দিয়ে বাইকে উঠে বসল। হঠাৎ মনে হল, কাছাকাছি কোথাও টেলিফোন বাজছে। প্রথমে সে গুরুত্ব দেয়নি। তারপর বুঝতে পারল, আওয়াজটা আসছে তার পকেট থেকে। দ্রুত সেটটা বের করে সে বোম টিপে হ্যালো বলল। সঙ্গে সঙ্গে জগন্নাথদার গলা শুনতে পেল, তোমার মোবাইল চালু হয়ে গিয়েছে ভাই।

.

তিনদিনের মধ্যে শহরের পরিচিত ব্যক্তিরা অর্জুনের মোবাইল নম্বর জেনে গেল। গলির মুখেই বুড়িদির সঙ্গে দ্যাখা। ক’দিন হল বাপের বাড়িতে এসেছে। বুড়িদি জিজ্ঞেস করল, হারে অর্জুন, তুই মোবাইল নিয়েছিস?

এটা কোনও ঘটনা?

তা না। কিন্তু ভাবতেই পারছি না চোরাকারবারিদের কাছ থেকে কিনেছিস! বুড়িদি বলল, দেখি তোর মোবাইলটা।

অর্জুন দ্যাখাল। বুড়িদি দেখে বলল, কত দিয়েছিস বল, পনেরোশো?

এর দাম পনেরোশো বুঝি?

হ্যাঁ। আমার দেওর কিনেছে। এই এক মডেল। তোর কাছ থেকে কত নিয়েছে?

পাঁচ হাজার।

অ্যাঁ! হায়, তোর গলা কেটেছে রে। তুই জানিস না, নর্থ বেঙ্গল এখন টানা মালে ভরে গেছে।

আমি জগন্নাথদার দোকানে ফর্ম ভরতি করে কিনেছি।

বুড়িদি হাঁ হয়ে গেল। তারপর সামলে নিয়ে বলল, তাই বল।

তুমি কী করে ভাবলে আমি টানা মাল কিনব!

ভাবতে তো পারিনি। কিন্তু যেটা দেড় হাজারে পাওয়া যায় সেটা পাঁচ হাজারে কেউ কিনবে, তাও বিশ্বাস করতে পারিনি। ইস, আমার মন খুব ছোট হয়ে গিয়েছে রে।

দুর! তুমি ঠিকই ভেবেছ। আমি ধরে নিলাম, এ ক্ষেত্রে সতোর দাম তিন হাজার টাকা। এদিক দিয়ে ভাবলে মনে হবে খুব সস্তা।

কদমতলায় চায়ের দোকানের বন্ধুরাও খুব আওয়াজ দিল তার নির্বুদ্ধিতার জন্য। আদর্শের জন্য সাড়ে তিন হাজার টাকা লস করার কোনও মানে হয় না। জগুদা মোবাইল ব্যবহার করেন না। গম্ভীর মুখে বললেন, বোকামির দাম সাড়ে তিন হাজার টাকার অনেক বেশি হয়ে যেতে পারে।

একজন জিজ্ঞেস করল, তার মানে?

তুমি দশ হাজারের মোবাইলটা সাড়ে পাঁচে কিনেছ। পুলিশ যদি তোমাকে ধরে তুমি থিম্পুর রসিদ দ্যাখাবে। তাই তো?

নিশ্চয়ই।

কিন্তু ওখানে যে তারিখ লেখা আছে, সেই তারিখে তুমি এখানে অফিস করেছ তা প্রমাণ করতে পুলিশের কোনও অসুবিধে হবে না।

দুর! অত ঝামেলা পুলিশ করবে না।

যদি করে? তা হলে মোবাইলটা বাজেয়াপ্ত হবে। অন্তত দিনসাতেকের জেল হয়ে যেতে পারে। এরকম হলে অফিস তোমাকে সাসপেন্ড করতে পারে। মোবাইল কিনে তুমি যে সাড়ে চার হাজার প্রফিট করেছিলে, তার বহুগুণ লস করবে এরকম হলে। জগুদা বললেন।

ছেলেটি চুপ করে থাকল। অর্জুন বুঝল, বেচারা খুব চিন্তায় পড়ে গেল।

.

রাতে যখন শুতে যাচ্ছে তখন ল্যান্ডলাইনের ফোন বাজল। রিসিভার তুলে হ্যালো বলতেই মেজরের গলা কানে এল, এই যে তৃতীয় পাণ্ডব, কেমন আছ?

আপনি? আপনি কোত্থেকে?

দিল্লিতে। একটু আগে পৌঁছেছি। কাল সকালে বাগডোগরায় ফ্লাইট ধরব। এয়ারপোর্টে আসবে নাকি?

অবশ্যই। অর্জুন হাসিমুখে বলল।

.

মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল অর্জুনের। কাছাকাছি কোথাও রিং হচ্ছে। মোবাইল বাজছে। দ্রুত বিছানা থেকে নেমে টেবিলে রাখা মোবাইলটা তুলল সে। না, কোনও শব্দ নেই। কেউ কি তাকে মোবাইলে ফোন করেছিল? ধরছে না দেখে লাইন কেটে দিয়েছে? সে বোতাম টিপে কল রেজিস্টারে চলে এল। তারপর মিল্ড কলসে গিয়ে দেখল, কয়েকটা ডট ফুটে উঠেছে। কোনও নম্বর নেই। যে ফোন করে কেটে দিয়েছে, এখানে তার নম্বর ফুটে ওঠার কথা। কয়েকটা ডট কারও নম্বর হতে পারে না। তা হলে? মাথামুন্ডু বুঝতে না পেরে ফোনটা অফ করে শুয়ে পড়ল অর্জুন। যার দরকার, সে কাল সকালে ফোন। করবে। সে যাঁদের নম্বর দিয়েছে, তাঁদের কেউ মাঝরাতে রসিকতা করার জন্য ফোন করবেন না। তা হলে…। খচখচানি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই ঘুম এসে গেল।

.

প্রতিবারই কোথাও গেলে মা যে ব্যাগটা এগিয়ে দেন, তাতে তিন দিনের পোশাক ইত্যাদি থাকে। আজও সেই ব্যাগ নিয়ে সকালবেলায় কদমতলার মোড়ে এসে অর্জুন দেখল, জগন্নাথদা দোকান খুলছেন। পকেট থেকে মোবাইল বের করে সে জগন্নাথদাকে গত রাতের অভিজ্ঞতার কথা জানাল। ভদ্রলোক হেসে বললেন, এরকম হওয়া অস্বাভাবিক। বিলেত থেকে ফোন এলেও তিন-চারটে নম্বর ফুটে উঠবে। দাও তো দেখি। মোবাইল সেট নিয়ে নম্বর টিপে দেখলেন তিনি। তারপর বললেন, কোনও সমস্যা নেই। সব ঠিক আছে। তুমি ঘুমন্ত অবস্থায় ভুল শুনেছ।

তাই যদি হবে, তা হলে এই ডটগুলো এল কী করে? অর্জুন মাথা নাড়ল, যাক গে। আমি এখন বাগডোগরা যাচ্ছি। ওখানে তো নেটওয়ার্ক পাব না, না?

পাবে। রোমিং করে নিতে হবে। আগে প্রি-পেডে রোমিং হত না। এখন হচ্ছে। তোমার এই কার্ড থেকেই চার্জ কেটে নেবে। অর্থাৎ যতটা কল তুমি করতে পারতে, রোমিং-এর কারণে সেটা কমে যাবে।

ঠিক আছে। যা করার করে দিন।

.

জলপাইগুড়ি থেকে শিলিগুড়ি হয়ে যখন অর্জুন বাগডোগরায় পৌঁছোল তখন ভরদুপুর। দিল্লির ফ্লাইট আজ দেরিতে আসছে। এখনকার এয়ারপোর্টের চেহারা দেখলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে বছরচারেক আগের কথা। তখন একতলার একটা হলঘরে যাত্রীদের ঠাসাঠাসি করে বসে থাকতে হত। আজকের তুলনায় সেটা প্রায় গ্রাম্য ছিল বলাই ঠিক। আধুনিক রেস্টুরেন্টে বসে খাবার অর্ডার দিয়ে চারপাশে তাকাল অর্জুন। আশপাশের টেবিলগুলোয় নারী-পুরুষরা গল্প করছেন। এঁরা হয় নিজেরা উড়বেন অথবা কাউকে নিতে এসেছেন। একেবারে কোনার টেবিলে যিনি একা বসে আছেন, তাঁর চোখে রোদচশমা, গালে একটা হাত, অন্য হাতে ম্যাগাজিন ধরা। দেখলে মনে হবে, মনোযোগ দিয়ে ম্যাগাজিন পড়ছেন। কিন্তু অর্জুনের মনে হল, উনি মূল দরজার দিকে নজর রাখছেন। মুখ ঈষৎ বেঁকে থাকায় ধারণাটা তৈরি হল। ভদ্রলোকের পরনে নীল জ্যাকেট। চেহারা বলে দিচ্ছে, উনি পাহাড়ের মানুষ। নেপালি নন, হয় সিকিম বা ভুটানের মানুষ।

মঙ্গোলিয়ান মানুষের মুখ দেখে মনের ভাব বোঝা অসম্ভব। খাবার এসে যাওয়ায় সেদিকে মন দিল অর্জুন। তখনই ঘোষণা কানে এল, দিল্লির ফ্লাইট এখনই পৌঁছে যাবে। দ্রুত খাওয়া শেষ করে কাঁচের দেওয়ালের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই প্লেনটা মাটিতে নামতে দেখল সে। কিছুটা ঘোরাঘুরি করে এয়ারপোর্ট বিল্ডিং-এর সামনে এসে থামতেই সিঁড়ি লাগিয়ে দেওয়া হল দরজা খোলার পর। একে-একে যাত্রীরা নামতে লাগলেন। মেজরের শরীরটাকে সে দেখতে পেল সবার শেষে। মেজরের সঙ্গে একজন অল্পবয়সি মহিলা কথা বলতে বলতে নামলেন। তার পরনে জিন্স আর টপ। মেজরের চেহারা প্রায় একই রয়েছে। কাঁচাপাকা দাড়িতে আঙুল ঢুকিয়ে একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে নিয়ে হাঁটতে লাগলেন মহিলার সঙ্গে।

অর্জুন বেরোবার দরজার সামনে গিয়ে দেখল বেশ ভিড় জমেছে সেখানে। অনেকেই অপেক্ষা করছেন পরিচিতদের রিসিভ করার জন্য। সে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াল। মিনিটকুড়ি বাদে ট্রলিতে ঢাউস ঢাউস তিনটে সুটকেস চাপিয়ে মেজরের শরীর বেরিয়ে এল ভিড় ফুড়ে। তাঁর পিছনের মহিলার ট্রলিতে একটা সুটকেস। ফাঁকায় এসে মেজর রুমালে কপাল মুছে চারপাশে তাকালেন। অর্জুন বুঝল, তাকে দেখেও ঠাহর করতে পারলেন না মেজর। সে স্পষ্ট শুনতে পেল, মহিলাকে মেজর বলছেন, না। এরকমটা তো হওয়ার কথা নয়। লুসি, তুমি জানো না, আমরা দু’জনে কত অভিযান একসঙ্গে করেছি। কখনওই অর্জুনকে আমি শৃঙ্খলা ভাঙতে দেখিনি। ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে ও চলে। চিন্তা হচ্ছে, এখানে আসতে গিয়ে কোনও অ্যাক্সিডেন্ট হয়নি তো!

মহিলা, যাঁর নাম লুসি, বললেন, হয়তো উনি যা নন, তাই ভেবে নিয়েছ তুমি। আমার এক বন্ধু বলেছিল, ইন্ডিয়ানরা আর যাই করে করুক, সময় রেখে চলতে শেখেনি। কিন্তু কথাটা হল, আর কতক্ষণ ওঁর জন্য অপেক্ষা করবে?

অনন্তকাল। কিন্তু লুসি, হোয়াট এ চেঞ্জ! এই এয়ারপোর্টের চেহারা একদম বদলে গিয়েছে। এমনও হতে পারে, অর্জুন বাইরে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।

আই ডোন্ট থিঙ্ক সো। লেটস গো।

ওঁরা মূল দরজার দিকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, অর্জুন তাঁদের অনুসরণ করল। গেটের বাইরে ওঁরা চলে যেতেই অর্জুন প্রি-পেড ট্যাক্সিবুথে গিয়ে শিলিগুড়ির জন্য ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে রসিদ নিল। সেটায় ট্যাক্সির নম্বর লেখা রয়েছে। আগে বাইরে বের হলে ঝাঁপিয়ে পড়ত ড্রাইভাররা। টানাটানি করত প্যাসেঞ্জারদের নিয়ে। দরাদরি করার পর তাদের ট্যাক্সিতে উঠতে হত। এখন সেই অরাজকতা নেই। প্রি-পেড ছাড়া ট্যাক্সি পাওয়া যায় না। যাত্রীরা কে কোথায় যাবে, তার কিলোমিটার অনুযায়ী ট্যাক্সিভাড়া ঠিক করা আছে। দরাদরির কোনও ঝামেলা নেই।

রসিদটা নিয়ে বাইরে বের হতেই অর্জুন দেখল, মেজর চুরুট ধরাবার চেষ্টা করছেন। সে পিছনে দাঁড়িয়ে বলল, সরি স্যার। এখানে চুরুট ধরালে আপনাকে এক হাজার টাকা ফাইন দিতে হবে।

প্রবল বিস্ময়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে অর্জুনকে দেখতে পেয়ে মেজর যেভাবে চিৎকার করে উঠলেন, তা কানে গেলে জলদাপাড়া ফরেস্টের সমস্ত গন্ডার পড়ি কি মরি করে পালিয়ে যেত। দু’হাতে অর্জুনকে জড়িয়ে ধরে ওর মুখে কাঁচাপাকা দাড়ির জঙ্গল চেপে ধরে বলতে লাগলেন, ওঃ, কতদিন পরে দেখা হল। খুব মনে পড়ে তোমার কথা। অথচ তুমি আমায় একদম ভুলে গেলে মাই ডিয়ার থার্ড পাণ্ডব!

কোনওরকমে নিজেকে ছাড়িয়ে অর্জুন বলল, ভুল বললেন, আপনাকে আমি কখনও ভুলতে পারি?

এক পা পিছিয়ে গিয়ে মেজর অর্জুনের আপাদমস্তক দেখে নিলেন, না, একই রকম আছ। নো এক্সট্রা ফ্যাট। আমি চার কেজি বেড়েছি। গ্যালিস দেওয়া প্যান্ট পরতে হচ্ছে হে। ওহো, তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। এ হচ্ছে লুসি। শব্দ নিয়ে গবেষণা করে বস্টন ইউনিভার্সিটিতে। আর লুসি, ইনি হলেন…।

মেজরের কথা থামিয়ে দিয়ে লুসি বললেন, বুঝেছি। ইনি অর্জুন।

কী করে বুঝলেন? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।

সেই জে এফ কে থেকে আপনার নাম অন্তত পাঁচশোবার শুনতে বাধ্য হয়েছি! আপনার মতো বুদ্ধিমান বিনয়ী ছেলে নাকি পৃথিবীতে পাওয়া যাবে না।

স্নেহ মানুষকে অন্ধ করে। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি নর্থ বেঙ্গলে এর আগে কখনও এসেছেন?

মাথা নাড়লেন লুসি, নো। কখনওই আসিনি।

এইসময় একটি লোক এসে সামনে দাঁড়াল, স্যার, আপনারা কি প্রি পেড ট্যাক্সি নিয়েছেন? সব প্যাসেঞ্জার চলে যাচ্ছে…।

অর্জুন মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। তোমার ট্যাক্সি কোথায়?

মেজর এবং লুসি মালপত্র ডিকিতে রেখে পিছনের আসনে উঠে বসলে অর্জুন ড্রাইভারের পাশে উঠে পড়ল। মেজর বললেন, আচ্ছা! তুমি আগেই ট্যাক্সির ব্যবস্থা করতে গিয়েছিলে আর লুসি ভাবছিল যে আসোইনি।

কথাটা বাংলায় বললেন মেজর, যদিও নিজের নামটা শুনতে পেয়ে লুসি উৎসুক চোখে তাকালেন।

এখন এটাই সিস্টেম এখানে। কোথায় যাবেন জানি না বলে শিলিগুড়ি পর্যন্ত বুক করেছি এটাকে। কথা বলতে বলতে অর্জুন দেখল, এয়ারফোর্সের ইউনিফর্ম পরা সৈনিকরা সাইকেলে চেপে তাঁদের কাজে যাচ্ছেন। পুরো এলাকাটা এয়ারফোর্সের অধীনে। সাধারণ যাত্রীরা গাড়িতে চেপে এয়ারপোর্টে আসার পথে কিছু নিয়মকানুন মানতে বাধ্য।

শিলিগুড়ি! মেজর মাথা নাড়লেন, কেন শিলিগুড়ি? হোয়াই নট জলপাইগুড়ি?

আপনি তো কিছু বলেননি! এখন বলুন কোথায় যেতে চান, কী আপনাদের প্রোগ্রাম, সেইমতো ব্যবস্থা করছি। অর্জুন ফিরে তাকাল।

লুসি বসে আছে জানলার বাইরে চোখ রেখে। মেজরের ঠোঁটে সেই চুরুটটা ধরাই রয়েছে, এখনও আগুন দেননি।

লুসির ইচ্ছে ইস্টার্ন ইন্ডিয়ার কোনও গভীর জঙ্গলে ক’দিন থাকবে। বিশেষ করে যেসব জঙ্গলে নানাধরনের পাখি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়, সেইসব জায়গায় যদি ব্যবস্থা করতে পারো, তা হলে খুব ভাল হয়। মেজর বললেন।

অর্জুন একটু ভাবল। যে-কোনও ফরেস্ট বাংলোয় গেলে আজকাল চটপট জায়গা পাওয়া যায় না। বাংলোগুলোয় যেমন দপ্তরের অফিসাররা কাজেকর্মে প্রায়ই আসেন, তেমনই টুরিস্টরাও কলকাতা থেকে বুক করে বেড়াতে আসেন। পনেরো-কুড়ি বছর আগে এই ঝোঁকটা ছিল না। উত্তর বাংলায় ফরেস্ট বাংলো বলতে গোরুমারা, চাপড়ামারি, খুঁটিমারি, হলং আর মাদারিহাট বাংলো। কোথায় বেশি পাখি আসে, এই মুহূর্তে অর্জুনের জানা নেই। সে শুনেছে, কাজিরাঙা ফরেস্ট বাংলোতে নাকি এখনও গভীর জঙ্গল থাকায় পশু এবং পাখিদের সংখ্যা বেশি। তবে কাজিরাঙা তো অসমে। অর্জুন সিদ্ধান্ত নিল, একমাত্র জলপাইগুড়ির ডি এফ ও এই ব্যাপারে সঠিক সাহায্য করতে পারেন। সে বলল, তা হলে আগে জলপাইগুড়ির ডিস্ট্রিক্ট ফরেস্ট অফিসে যেতে হয়। ওখানেই সব খবর পাওয়া যাবে।

শিলিগুড়ি শহরের মহানন্দা নদীর উপর সেতু চওড়া করে দেওয়ায় এখন তেমন জ্যাম হয় না। কিন্তু আজ হয়েছে। মিনিটতিনেক গাড়িতে বসে থাকার পর ড্রাইভার নেমে গেল ব্যাপারটা কী জানতে। ফিরে এসে বলল, খুব বড় অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে সাব। একজন স্পট ডেড। যে-গাড়িটা মেরেছে সেটা হাওয়া হয়ে গিয়েছে। এখন ভাঙা গাড়ি রাস্তা ব্লক করে দিয়েছে। আমি যে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে যাব তার কোনও উপায় নেই। কখন যে খুলবে কে জানে, আপনারা একটু হেঁটে গেলে এয়ারভিউ হোটেলের সামনে আবার ট্যাক্সি পেয়ে যাবেন।

অর্জুন মেজরের দিকে তাকাল। তিনি মাথা নাড়লেন, ইমপসি। এত পাহাড় বয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আমার নেই।

একমত হল অর্জুন। যতই চাকা লাগানো থাক, এত সুটকেস টেনে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। মিনিট তিনেকের মধ্যে গাড়ির হর্ন বাজতে লাগল, ইঞ্জিনের আওয়াজ, চেঁচামেচি থেকে বোঝা গেল সামনের বাধা সরানো হয়েছে। তাদের ট্যাক্সি চলতে শুরু করলে মেজর বললেন, বুঝলে অর্জুন, পেশেন্স। এই পেশেন্সের বিকল্প আর কিছু নেই।

জলপাইগুড়ি শহরে ওরা যখন পৌঁছোল তখন বিকেল। এখন দু-তিনটে মোটামুটি কাজ চালানোর হোটেল হয়েছে শহরে। তবে সবচেয়ে ভাল থাকার জায়গা রাজবাড়ি ছাড়িয়ে সরকারি অতিথিনিবাস। সেখানে যাওয়ার আগে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা ডি এফ ও অফিসে হাজির হল অর্জুনরা।

ডি এফ ও অফিসের বড়বাবু অর্জুনকে দেখেই চিনতে পেরে হেসে বললেন, কী ব্যাপার? জঙ্গল নিয়ে কোনও সমস্যা?

না। সমস্যা নয়। ইনি মেজর আর উনি লুসি। মেজর আমার দীর্ঘকালের পরিচিত। ওঁরা আমেরিকা থেকে আসছেন। কয়েকদিন জঙ্গলে থাকতে চান। যে-জঙ্গলে প্রচুর পাখি আছে, সেই জঙ্গলে থাকার ব্যবস্থা করে দিন। অর্জুন বলল।

পাখি আসে শীতকালে। জঙ্গলের লেকগুলো বিদেশি পাখিতে ভরে যায়। এখন তো তেমন…। বড়বাবু মাথা নাড়লেন।

বিদেশি পাখির জন্য বিদেশ থেকে এদেশে আসব কেন? দিশি পাখি যেখানে বেশি পাওয়া যায় সেখানে যেতে চাই। মেজর প্রায় ধমকের ভঙ্গিতে বললেন।

বড়বাবু ওঁদের নিয়ে গেলেন তাঁর বড়সাহেবের চেম্বারে। অবাঙালি ডি এফ ও অর্জুনের নাম শুনে হাত বাড়ালেন, আমি আপনার নাম শুনেছি।

করমর্দন করে অর্জুন প্রস্তাবটা জানাল।

ডি এফ ও বড়বাবুকে নির্দেশ দিলেন কোন ফরেস্ট বাংলো খালি আছে তা দ্যাখার জন্য। তারপর গল্প শুরু করলেন। কেন লুসি পাখির ডাক শুনতে চান? লুসি তাঁকে জানালেন, ইতিমধ্যে আফ্রিকার কিছু অঞ্চল এবং আমেরিকার পাখিদের ডাক তিনি সংগ্রহ করে দেখেছেন, দুই মহাদেশের কিছু পাখির ডাক হুবহু এক। অথচ এরা এক প্রজাতির নয়। এদের ডানায় সেই শক্তি নেই যে, সমুদ্র পেরিয়ে দুই মহাদেশে যাতায়াত করতে পারবে। লুসি শুনেছেন, ভারতবর্ষের এই অঞ্চলে নাকি প্রচুর পাখি পাওয়া যায়। তিনি ওদের গলার স্বর রেকর্ড করতে চান। তিনি প্রমাণ করতে চান, পৃথিবীর যে-প্রান্তেই জন্মাক, পাখিদের ভাষায় বেশ মিল আছে। আফ্রিকান পাখির ডাক টেপে তুলে সেটা আমেরিকার জঙ্গলে বাজিয়ে শুনেছেন, একটি পাখি তাতে সাড়া দিচ্ছে। সে ভাবছে, তারই সঙ্গী কেউ তাকে ডাকছে।

বড়বাবু এসে জানালেন, একমাত্র খুঁটিমারি ছাড়া আর কোনও বাংলোতে জায়গা নেই। অর্জুন জলদাপাড়ার কথা বলল। ডি এফ ও বললেন, ওটা কোচবিহারের ডি এফ ও-র এলাকা। খুঁটিমারির জঙ্গল যদিও খুব ঘন নয়, কিন্তু ওখানে পাখি পাবেন। তা ছাড়া সঙ্গে যদি গাড়ি থাকে, তা হলে যে কোনও জঙ্গলে গিয়ে লুসি তাঁর কাজ করতে পারবেন। বড়বাবুকে ওই অনুমতি লিখিতভাবে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন তিনি।

কদমতলার মোড়ে এসে শিলিগুড়ির ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে পরিচিত একটি নেপালি ড্রাইভারকে কয়েকদিনের জন্য সঙ্গী করে নিল অর্জুন। তারপর মোবাইল বের করে বাড়িতে ফোন করে মাকে জানিয়ে দিল কোথায় যাচ্ছে।

তিস্তা ব্রিজ পেরিয়ে ময়নাগুড়ি বাইপাস দিয়ে যখন নেপালি ড্রাইভার তার মারুতি ঝড়ের বেগে চালাচ্ছে, তখন মেজর বললেন, ওহে তৃতীয় পাণ্ডব, পেটে কিছু দেওয়া যাবে না?

ওহো! কিন্তু এখানে খেতে হলে কোনও ধাবার সামনে দাঁড়াতে হবে।

যে চুলোয় হোক, পেটের নাড়িভুড়ি জ্বলছে।

ড্রাইভারের নাম পদমবাহাদুর। ধুপগুড়ির পথে একটা ধাবার সামনে সে গাড়ি দাঁড় করাল। অর্জুন গাড়ি থেকে নামতে নামতে দেখল, ধাবা থেকে দুটো লোক খুব দ্রুত বেরিয়ে এসে সামনে দাঁড়ানো সুমো গাড়িতে উঠে বসল। তারপর স্টার্ট নিয়ে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল ধুপগুড়ির দিকে। ওদের চলে যাওয়ার ধরনটা বেশ অস্বাভাবিক।

ধাবাতে ঢুকতেই গলা শুনতে পেল অর্জুন, আইয়ে সাব। বহুত দিন পর আপ আয়া। বিশাল চেহারার সর্দারজিকে দেখে মনে পড়ে গেল অর্জুনের। লোকটার নাম জ্ঞান সিংহ। এর আগে এই ধাবায় খেতে এসে আলাপ হয়েছিল।

কেমন আছেন? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।

কোনওরকমে চলে যাচ্ছে। বসুন। প্লিজ সিট ডাউন। ইংরেজিতে অনুরোধ মেজর এবং লুসিকে।

মেজর জিজ্ঞেস করলেন কী পাওয়া যাবে?

জ্ঞান সিংহ বলল, চিকেন, মাটন, ফিশ কারি, কষা, চাপ, কাবাব। সঙ্গে রাইস, প্লেন রুটি, তন্দুরি। নবরতন তরকারি।

আমাকে চিকেন চাপ, তন্দুরি রুটি আর এই ভদ্রমহিলাকে চিকেন কাবাব দিন। অর্জুন, তুমি কী খাবে? মেজর জিজ্ঞেস করলেন।

আমি হাফ প্লেট কাবাব নেব। অর্জুন বলল।

লুসি এসব কথা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলেন, চিকেন স্যান্ডউইচ বলুন আমার জন্য।

জ্ঞান সিংহ মাথা নাড়ল, নো ম্যাডাম নো স্যান্ডউইচ!

মেজর লুসিকে আশ্বস্ত করলেন, যে খাবার বলা হয়েছে তাতে লুসির অসুবিধে হবে না। কোনও মশলা নেই তাতে।

জ্ঞান সিংহ অর্ডারগুলো সহকারীদের জানিয়ে দেওয়ার পরে কাছে এলে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ওই লোকগুলো আমাদের দেখেই কি ওইভাবে পালাল?

জ্ঞান সিংহ হাসল, আপনাকে যারা চেনে, তারা হয় হেসে আপ্যায়ন করে, নয়তো দৌড়ে পালায়।

আচ্ছা, এদের পালাবার কারণ?

আপনি গাড়ির সাইডটা দ্যাখেননি, না? অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। ওদের কথাবার্তায় মনে হল, কেউ মারাও গেছে। ওরা শিলিগুড়ি থেকে আসছে।

জ্ঞান সিংহের কথায় মহানন্দা ব্রিজের উপর ঘটা দুর্ঘটনার কথা খেয়ালে এল। লোক দুটো কেন থানায় রিপোর্ট না করে দূরে পালিয়ে যাচ্ছে? অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি যখন বুঝতে পারলেন, তখন ওদের আটকাবার চেষ্টা করলেন না কেন?

দেখুন সাব, আমার এখানে হাজার রকমের মানুষ খেতে আসে। কার মনে কী মতলব আছে তা বুঝব কী করে? আপনাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে যেভাবে পালাল, তাতেই বুঝলাম ওরা ক্রিমিনাল। তখন তো কিছু করার ছিল না। তা ছাড়া আমি যদি আমার ধাবায় ক্রিমিনাল ধরি তা হলে কাল থেকে কোনও গাড়ি আর এখানে দাঁড়াবে না। না খেয়ে মরতে হবে আমাকে। জ্ঞান সিংহ বলল।

কিছু বলার ছিল না একথা শোনবার পর। কিন্তু অস্বস্তিটা যাচ্ছিল না অর্জুনের। শিলিগুড়িতে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল। অ্যাক্সিডেন্ট তো হতেই পারে। ধরা পড়ার ভয়ে অনেকেই পালিয়ে যায়। কিন্তু তাকে দেখে ওরা ওভাবে পালাল কেন? যেখানে ওই অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল তার ধারেকাছে ওদের গাড়ি ছিল না। পিছনের লম্বা গাড়ির লাইনে কে কোথায় রয়েছে, তা দ্যাখার কোনও সুযোগই ছিল না এদের। এ ক্ষেত্রে দুটো চিন্তাই মাথায় আসছে। এক, এরা দাগি অপরাধী, তাকে আগে থেকেই চিনত। নয়তো এরাও এয়ারপোর্ট থেকে আসছিল। সেখানে মেজরদের সঙ্গে তাকে কথা বলতে দেখেছে। এই দ্বিতীয় ভাবনাটা তেমন জোরদার নয়। অচেনা তিনটে মানুষকে এয়ারপোর্টে দেখলে কেউ সেটা মনে রাখে না। রাখলেও তাকে দেখে ভয় পেয়ে পালাবার কথা ভাবে না।

চিকেন রেশমি কাবাব মুখে দিয়ে লুসি খুব খুশি। মশলা নেই, বেশ তুলতুলে, নরম। জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের ওখানে অনেক ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট আছে। সেখানে কি এই খাবার পাওয়া যায়?

তন্দুরি রুটিতে মাংস তুলে মুখে পুরতে পুরতে মেজরের চোখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেই অবস্থায় বললেন, ওঃ! শিয়োর। তোমরা তো সেদ্ধ ছাড়া কিছু খেতে জানলে না। ভাল খাবার খেতে হলে ওই ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে ঢুকতে হবে।

ধুপগুড়ি পেরিয়ে গয়েরকাটা হয়ে নাথুয়ার দিকে যখন গাড়ি ঘোরাল পদমবাহাদুর, তখন ছায়া ঘন হয়ে গিয়েছে। দূরে জঙ্গল দেখা যাচ্ছে। মেজর জিজ্ঞেস করলেন, আর কত দূরে হে?

এই তো সামনে মেছুয়া পুল, ওটা পার হলেই জঙ্গলে ঢুকব, অর্জুন বলল।

নেহি সাব। মেছুয়া পুল কা নাম চেঞ্জ হহা গয়া, পদমবাহাদুর বলল।

তাই নাকি? কী নাম হয়েছে? অর্জুন অবাক হল।

মধুবনি, পদম জবাব দিল।

দু’পাশে এখন ঘরে ফেরা পাখির চিৎকার। লুসি উৎসুক চোখে তাকাচ্ছেন। অর্জুন দেখল, জঙ্গল বেশ ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। তবু অন্ধকার নেমে পড়ায় চারপাশ রহস্যময় হয়ে উঠেছে। জঙ্গলের মধ্যে নুড়ি বিছানো রাস্তায় চাকার শব্দ তুলে পদম গাড়িটাকে বাংলোর সামনে দাঁড় করিয়ে মৃদু হর্ন বাজাল। বাংলো অন্ধকার। পিছন দিকে ছোট একতলার একটা ঘরে আলো জ্বলছে। পদম চেঁচাল, কোই হ্যায়?

একটা হারিকেন উপরে তুলে যে-লোকটা এগিয়ে এল, তার মুখে রাজ্যের বিরক্তি। অর্জুন বলল, তুমি নিশ্চয়ই চৌকিদার?

জি।

আমরা জলপাইগুড়ি থেকে আসছি। ডি এফ ও সাহেব এই বাংলোয় থাকার অনুমতি দিয়েছেন। দরজা খুলে দাও।

চাবি তো আমার কাছে নেই সাহেব।

যার কাছে আছে তাকে ডেকে নিয়ে এসো।

লোকটা লণ্ঠন হাতে গেটের দিকে চলে গেল। কথাবার্তা হচ্ছিল বাংলায়। লুসির পক্ষে বোঝার উপায় নেই। মেজর কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে লুসি জিভ দিয়ে আওয়াজ করল, যাতে তিনি চুপ করে থাকেন। শব্দটা কানে এল। এই ভর সন্ধেবেলায় পাখিটা ডাকছে, চোখ গেল। একা-একাই ডেকে যাচ্ছে।

লুসি দ্রুত তার ব্যাগ খুলে রেকর্ডার বের করার আগেই ডাক থেমে গেল। তার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঝিঁঝির ডাক শোনা গেল। লুসি খুব হতাশ হয়ে বললেন, আপনারা ওই পাখিটার কী নাম দিয়েছেন?

চোখ গেল। অর্জুন বলল।

মানে কী?

মেজর তাঁর মতো করে বুঝিয়ে দিলেন লুসিকে। লুসি হাসলেন, মাই গড। ফ্লোরিডার জঙ্গলে অবিকল একই ডাক শুনেছি আমি। স্থানীয় মানুষ বলেন, পাখিটা গালাগাল দিচ্ছে, গো হেল’। অদ্ভুত! কোথায় খুঁটিমারির জঙ্গল আর কোথায় ফ্লোরিডা!

লণ্ঠনটাকে এগিয়ে আসতে দ্যাখা গেল। কেয়ারটেকার বাঙালি। বললেন, জলপাইগুড়ি থেকে কোনও অর্ডার এখনও আসেনি। অ্যাডভান্স কপি সঙ্গে থাকলে আপনারা স্বচ্ছন্দে থাকতে পারেন। অনেক অবাঞ্ছিত লোক এখানে এসে টাকা দিয়ে থাকতে চায়। তাদের আমি অ্যালাউ করি না।

ডি এফ ও সাহেবের অর্ডার হারিকেনের আলোয় দেখে নিয়ে কর্মচারীটিকে জেনারেটর চালাতে বললেন কেয়ারটেকার। কয়েক মিনিটের মধ্যে চারপাশ আলোকিত হয়ে উঠলেও জেনারেটরের শব্দ ভাল লাগছিল না।

দোতলায় দুটো সুন্দর সাজানো ঘর। ওপাশের লম্বা বারান্দায় সোফা পাতা। দোতলা থেকে এ পাশের জঙ্গলটার অন্ধকার আরও রহস্যময় বলে মনে হচ্ছে।

আপনারা ডিনার করবেন তো? কেয়ারটেকার জিজ্ঞেস করলেন।

কী খাওয়াবেন? মেজর ঘুরে দাঁড়ালেন।

আজ রাতে ডিম আর রুটি ছাড়া কিছু পারব না স্যার।

তাই হোক। মেমসাহেবের জন্যে ঝাল দেবেন না।

অর্জুন হাসল, আজ একটা অভিনব ব্যাপার দেখছি।

কী হে? মেজর ঘুরে তাকালেন।

এয়ারপোর্ট থেকে এখন পর্যন্ত আপনি একবারও নিব বের করে চুমুক দেননি। এরকম তো আগে কখনও দেখিনি, অর্জুন বলল।

নিব? আপনি হুইস্কি-রামের কথা বলছেন। না স্যার, ওসব বিলিতি জিনিস এই জঙ্গলে পাবেন না। তবে অর্ডার দিলে গয়েরকাটা থেকে আনিয়ে দিতে পারি। গাড়ি তো আছেই, কেয়ারটেকার সবিনয়ে জানালেন।

তাঁর কথা শেষ হওয়ামাত্র মেজর চিৎকার শুরু করলেন, গেট আউট, গেট আউট ফ্রম হিয়ার। আমাকে, এই মেজরকে বলে কিনা হুইস্কি-রাম কিনে এনে দেবে! সারাজীবনে ওসব কত খেয়েছি তা কি জানো ছোকরা? হুম। আজ তিন মাস হল আমি ওসব ত্যাগ করেছি। আর সেই আমার কানের কাছে ওই নামগুলো না জপলে চলছিল না!

অর্জুন বলল, আমি সত্যি দুঃখিত। আপনি যে এতদিনের অভ্যেস ছেড়ে দিয়েছেন, এই খবর আমার জানা ছিল না।

না জানা থাক, আমাকে দেখে তুমি বুঝতে পারছ না? সবসময় কীরকম ঝিমিয়ে আছি। আগের মতো আজ সারাদিনে কোনও চেঁচামেচি করেছি? ধাবায় বসে যখন খাচ্ছিলাম, তখন যেদিকে লোকেরা বিয়ার খাচ্ছিল, সেদিকে দ্বিতীয়বার তাকাইনি। নো মোর হুইস্কি-রাম! সব হাডসনের জলে বিসর্জন দিয়ে দিয়েছি হে। বেশ জোরে শ্বাস ফেললেন মেজর।

.

রাতের খাওয়ার পর বারান্দায় বসেছিল ওরা। দশটা বাজতেই জেনারেটর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ওটা বন্ধ হওয়ায় আলো নিভে গিয়েছে, পাখা ঘুরছে না বটে, কিন্তু মনে হল এরই নাম শান্তি। কর্কশ একটানা আওয়াজটা আর কানের পরদাকে বিব্রত করছে না। আর শব্দটা থেমে যাওয়ার খানিক বাদেই সামনের জঙ্গল থেকে অদ্ভুত আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল। রাত-পাখিরা এখন মাঝে মাঝেই ডেকে উঠছে। হঠাৎ কোনও প্রাণী জানান দিল, কিট কিটকিট কিটুস।

হঠাৎ লুসি বললেন, লেটস গো।

মেজরের বোধহয় ঘুম পাচ্ছিল। বললেন, সেই ভাল, ঘুমোতে যাই চলো।

ওঃ! নো। টর্চ নিয়ে জঙ্গলের ভিতরে গেলে ওইসব ডাক খুব ভালভাবে রেকর্ড করতে পারব আমরা। এটাই ঠিক সময়। আজেবাজে আওয়াজ এখন নেই, লুসি বেশ উত্তেজিত হয়ে নতুন একটা ডাক শুনলেন।

অর্জুন মাথা নাড়ল, আপনি কি আত্মহত্যা করতে চান?

মানে?

এখন জঙ্গলে ঘুরে বেড়ালে কাল সকালে যদি আপনার শরীর কেউ খুঁজে পায়, তা হলে দেখে চিনতে পারবে না! এদিকের জঙ্গলে কয়েকটা দলে ভাগ হয়ে প্রায় শখানেক হাতি ঘুরে বেড়াচ্ছে। জঙ্গলে তাদের খাবার নেই বলে হামলা করছে পাশের গ্রামগুলোতে। গ্রামবাসীরা স্বাভাবিক কারণে ওদের বাধা দেয়। ফলে হাতিরা মানুষ দেখলেই খেপে ওঠে। হাতি ছাড়া চিতাবাঘের সংখ্যাও বাড়ছে। আপনি তো জানেন, চিতাদের মতো হিংস্র প্রাণী খুব বেশি নেই। অর্জুন বলল।

আপনি আমাকে অযথা ভয় দেখাচ্ছেন না তো? লুসির গলায় সন্দেহ।

আমার কী লাভ?

আচ্ছা, আমরা তো বাংলোর কম্পাউন্ডের মধ্যে থেকে রেকর্ড করতে পারি।

যাওয়ার মধ্যে আমি নেই। আমার ঘুম পেয়েছে খুব, হাই তুলতে তুলতে মেজর ঘরে ঢুকে গেলেন।

অর্জুন বলল, লুসি, আমার মনে হয়, আজ রাতে আপনার বিশ্রাম নেওয়া উচিত। আগামীকাল থেকে আমরা পরিকল্পনা করব, যাতে আপনি রাতের পাখিদের ডাক ভালভাবে তুলতে পারেন।

লুসি একটু ভাবলেন। তারপর মাথা নেড়ে ‘গুড নাইট’ বলে চলে গেলেন নিজের ঘরে। অর্জুন বারান্দার রেলিং ধরে জঙ্গলের দিকে তাকাল। হঠাৎ সে খেয়াল করল অন্ধকারে কী একটা নড়ছে। ওরা যে একটা হাতির দল, তা বুঝতে সময় লাগল না। খুব খেপে না গেলে ওরা বাংলোর কম্পাউন্ডে ঢোকে না, এই বাঁচোয়া!

এই বাংলোর দোতলায় দুটো ঘর। একটা ঘরে লুসি রয়েছেন, দ্বিতীয়টায় মেজর আর অর্জুন। হঠাৎ কানে এল শব্দ। যেন বুনো দাঁতাল শুয়োর মারপিট করছে ঘরের মধ্যে। কৌতূহলী হয়ে সে অন্ধকার ঘরের দরজায় এসেই বুঝতে পারল, মেজর নাক ডাকছেন! এইরকম ডাককেই কি গর্জন বলে? এই গর্জন কানে নিয়ে সে পাশের খাটে ঘুমোবে কী করে? তারপরেই টের পেল। বাংলোয় মৃদু কাঁপুনি হচ্ছে। এইসময় লুসির ঘরের দরজা খুলে গেল।

লুসি জিজ্ঞেস করলেন, কীসের আওয়াজ হচ্ছে?

অর্জুন হাসল, আপনার রেকর্ডারটা নিয়ে আসুন।

লুসি ঘরে ঢুকেই চাপা গলায় বললেন, ওঃ মাই গড! তারপর দৌড়ে চলে গেলেন নিজের ঘরে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে রেকর্ডার চালু করলেন লুসি। মেজরের নাক থেকে যে বিচিত্র শব্দাবলি ফোয়ারার মতো বের হচ্ছিল, তা টেপ রেকর্ডার গিলে নিতে লাগল।

মিনিটপাঁচেক পরে ক্লান্ত হলেন লুসি। রেকর্ডার নিয়ে ফিরে গেলেন ঘরে। আর কী আশ্চর্য, মেজর পাশ ফিরতেই আচমকা আওয়াজটা থেমে গেল। এখন মৃদু শ্বাসের শব্দ, যা কানে গেলেও ঘুমোতে অসুবিধে হবে না। ওই ভয়ংকর আওয়াজ যদি সমান তালে চলত, তা হলে এই ঘরে তার পক্ষে ঘুমোনো সম্ভব হত না। সারারাত বাইরের বারান্দায় কাটাতে হত সে ক্ষেত্রে। মেজর আবার শব্দ করার আগে ঘুমিয়ে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

মোবাইলটা দেখল অর্জুন! লঃ, এখানে নেটওয়ার্ক আছে। ওটাকে বালিশের পাশে রেখে শুয়ে পড়ল সে। আর তখনই জঙ্গল থেকে ভেসে আসা আওয়াজ তার কানে এল। সেই আওয়াজ হাওয়ার জন্য, রাত-পাখি আর প্রাণীদের হাঁকাহাকির কারণে হতে পারে। কিন্তু বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে তা শুনতে শুনতে অর্জুনের বেশ রহস্যময় বলে মনে হল।

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার