অর্জুনের ঘুম ভাঙল বাবা সিং-এর ডাক শুনে। সে চোখ খুলে দেখল বাবা সিং-এর হাতে চায়ের পট এবং গ্লাস। বাবা সিং বলল, গুড মর্নিং স্যার।

গুড মর্নিং। অর্জুন উঠে বসল।

উত্তমের কাছে শুনলাম, খুব কষ্ট হয়েছে কাল। বাবা সিং বলল, আগে চা খেয়ে নিন, তারপর টয়লেটে যাবেন।

চায়ের গ্লাস হাতে নিয়ে অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, খিলজিসাহেব কোথায়? বাবা সিং চারপাশে তাকাল, ওঁকে তো দেখতে পাইনি স্যার। আপনাদের দু’জনের জন্যে চা নিয়ে এসেছিলাম। দেখলাম আপনি একাই তাবুতে আছেন।

সেকী! এই ঠান্ডায় বরফের মধ্যে কোথায় যেতে পারেন উনি। টয়লেটে যাননি তো?

অর্জুনের প্রশ্ন শুনে বাবা সিং তাবু থেকে বেরিয়ে গেল। ফিরে এল খুব দ্রুত, না স্যার। টয়লেট ফাঁকা। এখন নরম তুষার ফাঁদ পেতে আছে সব জায়গায়। নতুন লোকের পক্ষে হাঁটতে যাওয়া খুব বিপদজনক হবে।

অর্জুন দ্রুত তৈরি হয়ে বাবা সিং-এর সঙ্গে বাইরে এসে চিৎকার করল, মিস্টার খিলজি! মিস্টার খিলজি। তার চিৎকার শুনে উত্তম শেরিং তার তাবু থেকে বেরিয়ে এল, স্যার, উনি ভোরের আলো ফুটতেই আমার ভাইকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন।

বেড়াতে গিয়েছেন? এটা কি বেড়ানোর জায়গা? তুমি আপত্তি করোনি? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

করেছিলাম। কিন্তু উনি শুনলেন না। বললেন, তোমার ভাই সঙ্গে আছে, বিপদ হবে না। কাল যখন আপনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তখন আমার ভাইয়ের সঙ্গে ওঁর আলাপ হয়।

এখন ওদের ফিরে আসার জন্যে অপেক্ষায় থাকা ছাড়া কিছু করার নেই। অর্জুন নিজের তাবুতে ফিরে এল। কিন্তু জনাব কামরুজ্জমান খিলজির এই বেড়াতে যাওয়ার আগ্রহ তার ভাল লাগছিল না।

গত রাতের ঘটনাগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সেই ছোট ডায়েরির কথা মনে এল। ওটা পকেটেই ছিল। বের করে পাতা খুলে সে একটু হকচকিয়ে গেল। ডায়েরির পাতায় দু-তিনটে করে লাইন লেখা হয়েছে এবং সেটা উর্দু ভাষায়। সে ভাষা পড়ার ক্ষমতা অর্জুনের নেই। হঠাৎ কী মনে হল সে তাবু থেকে বেরিয়ে চারপাশে তাকাতে উত্তম শেরিংকে দেখতে পেল। তার কাছেই আসছিল লোকটা। কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, স্যার, আজকের প্রোগ্রাম কী হবে?

মিস্টার খিলজির জন্যে অপেক্ষা করছি। উনি ফিরে এলে ঠিক করব।

ওকে স্যার। উত্তম শেরিং ফিরে যাচ্ছিল।

আচ্ছা, তোমার এই দলের কেউ উর্দু পড়তে জানে?

স্যার, বাবা সিং অনেক ভাষা জানে। এমনকী স্প্যানিশও জানে। একবার একটা স্প্যানিশ টিমের সঙ্গে দু’মাস থেকে অনেক কথা বলতে শিখেছিল।?

ঠিক আছে, ওকে পাঠিয়ে দাও। উত্তম শেরিং খবর দিতেই বাবা সিং চলে এল। অর্জুন তাকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি শুনলাম অনেক ভাষা জানো, উর্দ পড়তে পারো?

চেষ্টা করতে পারি। বাবা সিং বলল।

অর্জুন তাকে ছোট ডায়েরিটা দিল। ডায়েরির প্রথম পাতা খুলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বাবা সিং ভেতরের পাতায় চোখ রাখল। অর্জুন বুঝতে পারল বাবা সিং অর্থ উদ্ধার করতে পারছে না। কিন্তু হঠাৎ একটা পাতা দেখতে দেখতে বাবা সিং বলে উঠল, আমি ঠিক পড়তে পারছি না কিন্তু কোনও একজন মেয়ের কথা লেখা আছে।

মেয়ের কথা?

হ্যাঁ স্যার। বাবা সিং বলল, মেয়েটার নামও এখানে লেখা হয়েছে। কিন্তু কীরকম অদ্ভুত হাতের লেখা। নামটাও পড়া যাচ্ছে না। তবে ছোট্ট নাম। বাবা সিং তখনও পড়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল।

ঠিক আছে থ্যাঙ্ক ইউ। ডায়েরিটা নিজের কাছে রেখে দিল অর্জুন। দূরে উত্তম শেরিংকে পঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাকে হাত নেড়ে কাছে ডেকে সে জিজ্ঞাসা করল, রাস্তার অবস্থা কীরকম? গাড়ি যাবে?

না স্যার। আজ রোদ উঠলে তুষার পড়বে, আর্মি এসে রাস্তা পরিষ্কার না করা পর্যন্ত গাড়ি যাবে না। আপনি কোনদিকে যেতে চান?

আর্মি ক্যাম্পে।

ওরা কিন্তু অনেক প্রশ্ন করবে।

তার জবাব দিতে আমি তৈরি।

তা হলে তো হেঁটেই সেখানে যাওয়া যায়। তুষার-বরফের জন্যে একটু সময় লাগলেও দূরত্ব তো বেশি নয়। হেঁটে যাবেন? উত্তম শেরিং জিজ্ঞাসা করল।

মিনিট কুড়ি অপেক্ষা করি মিস্টার খিলজির জন্যে’ অর্জুন তাঁবুর ভেতরে চলে এল। জনাব কামরুজ্জমান খিলজির হঠাৎ কিছু না বলে বেরিয়ে যাওয়াটা সহজভাবে মানতে পারছিল না সে। তারপর এই ডায়েরির ছোট্ট মেয়েলি নাম, কাল সেই গুহায় দেখা চিরুনিতে আটকে থাকা চুল যেন এই রহস্যটাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। মহম্মদ নুরউদ্দিন খিলজির সঙ্গে যে ছিল সে যদি মহিলা হয়, বাবা সিং তাই বলেছে, তা হলে তাকে আর্মি ক্যাম্পে গেলে নিশ্চয়ই দেখতে পাওয়া যাবে। হঠাৎ মনে হল জনাব কামরুজ্জমান খিলজি ওদের সন্ধানে ভোর হতে না হতেই বেরিয়ে যাননি তো! মহিলার নাম ছোট, বাবা সিং বলতে পেরেছে, সেই নামটা রোজি নয় তো! তা কী করে হবে। রোজি তো গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতাল ফেরত বাড়িতে রয়েছে। তার পক্ষে এই বরফের পাহাড়ে আসা সম্ভবই নয়।

অর্জুন জনাব কামরুজ্জমানের হ্যামকের দিকে তাকাল। একটু ওপাশে পোর্টেবল টেবিলের ওপর তার ব্যাগ রাখা আছে। অর্থাৎ ব্যাগ নিয়ে যখন যাননি তখন নিশ্চয়ই ওঁর ফিরে আসার ইচ্ছে আছে। অথবা তাড়াহুড়োয় ব্যাগের কথা ভুলেই গিয়েছেন। অর্জুন এগিয়ে গিয়ে ব্যাগটা হ্যামকের ওপর রেখে দেখল সেটা একটা পলকা তালায় আটকানো রয়েছে। একটু চাপ দিতেই তালাটা না ভেঙে খুলে গেল। চেন টেনে ভেতরটা দেখার সময় একটু অপরাধবোধ হচ্ছিল বটে কিন্তু সেটাকে আমল দিল না সে। ব্যাগের ভেতর বেশ কিছু জামা, দুটো প্যান্ট, অন্তর্বাস, আর একটা চামড়ার ছোট ব্যাগ যা পাঁচশো টাকার নোটে ঠাসা। স্বস্তি পেল অর্জুন। গ্যাংটক ছাড়ার সময় দলের সবাইকে খানিকটা অগ্রিম দিয়েছিলেন জনাব কামরুজ্জমান খিলজি। যা টাকা আছে তাতে বাকিটা দিতে অসুবিধে হবে না।

না, ভদ্রলোকের ব্যাগে সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেল না।

প্রায় আধঘণ্টা অপেক্ষা করার পর ওদের দুজনের কেউ ফিরে না আসায় অর্জুন উত্তম শেরিংকে নিয়ে হেঁটে সীমান্তের ভারতীয় আর্মির ক্যাম্পে যাবে বলে পাহাড়ের আড়াল থেকে রাস্তার ধারে চলে এল। এখন রাস্তাটাকে একদম চেনা যাচ্ছে না। উত্তম শেরিং লাঠি চালিয়ে পরীক্ষা করে বলল, অন্তত তিনফুট তুষার পড়েছে স্যার। গাড়ি তো যাবেই না, হেঁটে যাওয়া ঠিক হবে না। ভাল রোদ উঠেছে, একটু পরেই তুষার গলতে আরম্ভ করবে। ততক্ষণ অপেক্ষা করা উচিত।

কথাটার যুক্তি আছে। অর্জুন ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছিল কিন্তু কানে ইঞ্জিনের শব্দ ভেসে এল। উত্তম শেরিং বলল, আর্মির রাস্তা পরিষ্কার করার গাড়ি এদিকে আসছে স্যার। আড়ালে সরে আসুন।

না না। অর্জুন বলল, আমরা তো আর্মির কাছেই যেতে চাইছিলাম। এখন আড়ালে যাব কেন? ওই যে দু দুটো গাড়ি দেখা যাচ্ছে। এসো, হাত নাড়ি।

প্রথমে গাড়ির সামনে লাগানো ব্লেড রাস্তার তুষার দু’পাশে সরিয়ে দিচ্ছে। যেটুকু অবশিষ্ট থাকছে তা দ্বিতীয় গাড়ি করছে। দুটো গাড়ি তৈরি হয়েছে দুই কাজের জন্যে যাদের শহরের রাস্তায় দেখা যায় না।

কাছাকাছি হতেই দেখা গেল প্রথম গাড়িতে চালকের পাশে একজন থাকলেও দ্বিতীয় গাড়িতে জনা আটেক জোয়ান এবং অফিসার আছেন যাঁরা প্রত্যেকেই আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত। অর্জুন এবং উত্তম হাত নাড়ছিল। খানিকটা তফাতে গাড়ি দুটো থেমে গেলে দু’জন অফিসার নীচে নেমে এল। একজন জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের পরিচয় কী? এখানে কেন?

অর্জুন বলল, আমরা একটা এক্সপিডিশন টিম নিয়ে এসেছি। আমার নাম অর্জুন।

অর্জুন?

হ্যাঁ। আমরা গ্যাংটক থেকে সরকারি অনুমতি নিয়ে এসেছি।

কিন্তু সেটা নিয়ে এলেও প্রথমে আমাদের কাছে রিপোর্ট করোনি কেন?

সুযোগ পাইনি। এই পর্যন্ত এসেই আবহাওয়া খারাপ হয়ে গিয়েছিল। অর্জুন পকেট থেকে অনুমতিপত্র বের করে এগিয়ে ধরল। একজন অফিসার তাতে চোখ বুলিয়ে ফেরত দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের এক্সপিডিশনের বিষয় কী?

মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজি আটশো বছর আগে কোন পথে এসেছিলেন তা খুঁজে দেখতে এসেছি। বুঝতেই পারছেন এর একটা ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে।

অদ্ভুত ব্যাপার! তুমি কি জানো প্রায় এইরকম উদ্দেশ্য নিয়ে আর একটা দল এই অঞ্চলে এসেছিল? কিন্তু ভয়ংকর তুষারঝড়ে ওদের এক্সপিডিশন বাতিল হয়ে গেছে। যখন তুষারঝড় হচ্ছিল তখন তোমরা কোথায় ছিলে?

উত্তম শেরিং জবাব দিল, এই পাহাড়ের আড়ালে ছিলাম বলে সমস্যা হয়নি।

যাক গে, এখন আবহাওয়া ভাল নয়। আমরা ওই দলটাকে আজই ফেরত পাঠাচ্ছি। রাস্তা খারাপ বলে আমরা ওদের হেলিকপ্টারে ছাঙ্গুতে পাঠাচ্ছি। এখানে কত লোক আছে?

সংখ্যাটা বলল উত্তম শেরিং। অর্জুন যোগ করল, কিন্তু একজনকে পাওয়া যাচ্ছে না আজ সকাল থেকে। তার খোঁজে আমরা বেরিয়েছি।

আচ্ছা! আমরা কাল রাত্রে ওই দলটাকে রেসকিউ করেছিলাম। কিন্তু ওদের দু’জনকে আজ সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। এখানে হেঁটে যাওয়া খুব রিস্কি ব্যাপার।

কিছু মনে করবেন না, ওদের একজন কি মহিলা?

হ্যাঁ। কিন্তু পুরুষের পোশাক পরে আছে বলে সহজে চেনা যাবে না।

ওর নাম কি রোজি? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

একজ্যাক্টলি। কিন্তু আপনি ওকে জানলেন কী করে?

প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল অর্জুন। বলল, তা হলে আমি অনুমান করতে পারি কোথায় গেলে এই তিনজনকে পাওয়া যাবে!

তিনজন?

আমাদের একজন, আপনাদের দু’জন, যাদের পাওয়া যাচ্ছে না। অর্জুন হাসল।

কোথায় পাওয়া যাবে?

কাল যেখান থেকে ওদের রেসকু করেছিলেন?

অফিসার দু’জন নিজেদের মধ্যে কথা বলল খানিকক্ষণ। তারপর গাড়ি ঘোরাতে বলে অর্জুনের দিকে তাকাল। ওয়েদার যদি ভাল থাকে এবং রাস্তা যদি গাড়ি চলাচলের উপযুক্ত হয়ে যায় তা হলে আজই আপনাদের নীচে নেমে যেতে হবে। আমরা কোনও ঝুঁকি নিতে চাই না।

অর্জুন মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলল, আপনারা কি গতরাতের স্পটে এখন যাচ্ছেন?

হ্যাঁ।

আমরা কি সঙ্গে যেতে পারি?

প্রথম অফিসার হাসল, বেশ, অনুমান সত্যি হলে ভাল।

প্রথম গাড়িতে উঠল ওরা। কয়েক মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেল তিন বরফের চুড়োর পাশে। অফিসার দু’জনের সঙ্গে অর্জুন এবং উত্তম শেরিং রাস্তা থেকে ভেতরে ঢুকে দেখল তাবুগুলোর ওপর থেকে একটু তুষার গলেছে। তাদের ওপরটা এখন উঁকি মারছে যেন। কিন্তু কোনও মানুষের অস্তিত্ব আছে বলে বোঝা যাচ্ছে না।

অফিসাররা বেশ কষ্ট করে তুষার সামলে গুহার ভেতর ঢুকে দুটো। সুটকেস নিয়ে বেরিয়ে এল। একজন অফিসার চেঁচিয়ে বলল, সরি, কেউ নেই এখানে। তোমার অনুমান একেবারেই ভুল।

ঠিক তখনই তুষারের ওপর জুতোর ছাপ দেখতে পেল অর্জুন। সেটা লক্ষ করেছিল উত্তম শেরিংও। সে দ্রুত সেই ছাপ দেখে খানিকটা যেতেই শরীরটাকে দেখে চিৎকার করে উঠল। সেটা কানে যেতেই অর্জুন দৌড়াল। পেছন থেকে একজন অফিসার সতর্ক করল, সাবধান, তুষারের ফাঁদে পড়ে যাবেন।

ততক্ষণে উত্তম শেরিং উপুড় হয়ে পড়ে থাকা শরীরটাকে চিত করে ফেলে দুই গালে চড় মারতে শুরু করেছে। অর্জুন দেখল শ্যাম শেরিং স্থির হয়ে পড়ে আছে। অফিসার দু’জন কাছে এসে পরীক্ষা করে বলল, না মারা যায়নি। তারপর একজন জোরে হুইসল বাজাল। মিনিট খানেকের মধ্যে চারজন জোয়ান ছুটে এল। তাদের নির্দেশ দিতেই তারা শ্যামকে তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল। গাড়ির আওয়াজ কানে এল।

একজন অফিসার জিজ্ঞাসা করল, লোকটা কে?

উত্তম শেরিং বলল, আমার ভাই। গাইডের কাজ করে।

এখানে এল কী করে?

এই দলটার গাইড ছিল শ্যাম। চিন্তা কোরো না। তোমার ভাই বেঁচে যাবে। চলো, এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কোনও লাভ নেই। তুষার গলে গেলে তাঁবুগুলো চেক করা যাবে। ওরা যে সংখ্যা বলেছিল তত লোককেই কাল রেসকু করা হয়েছে।

অফিসাররা পা বাড়ালেও উত্তম শেরিং শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করল, স্যার, আমার ভাইকে কে মারল? কেন মারল?

সেটা তোমার ভাই ঠিক বলতে পারবে। কিন্তু এখানে ওই তিনজনের থাকার কথা। নিশ্চয়ই আমাদের দেখে কোথাও লুকিয়ে আছে। অর্জুন বলল।

হঠাৎ উত্তম শেরিং গলা খুলে চিৎকার করল, অ্যাই। সাহস থাকে তো, বেরিয়ে আয়। এটা আমাদের জায়গা। এখান থেকে বেরুতে পারবি না তোরা।

অফিসারদের একজন ধমক দিল, চুপ করো। তোমার চিৎকারে বরফ ধ্বসে পড়তে পারে। পিছিয়ে এসে উত্তমের হাত ধরে টানল অফিসার, শান্ত হও। তোমার ভাই ভাল হয়ে যাবে।

কিন্তু যে আমার ভাইকে মেরেছে তাকে আমি ছেড়ে দেব না।

কাকে ধরবে তুমি। এখানে আমরা ছাড়া কোনও মানুষ নেই। অফিসার বলল, ক্যাম্প হসপিটালে চলো। তোমার ভাইয়ের জ্ঞান ফিরে এলে ওকে। জিজ্ঞাসা করবে।

কিন্তু উত্তম শেরিং অত তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেওয়ার মানুষ নয়। সে অফিসারের হাত ছাড়িয়ে আরও একটু এগিয়ে গিয়ে ওপরের দিকে তাকাল। তারপর চেঁচিয়ে অর্জুনকে বলল, স্যার, কাল আমরা যে গর্তটা দেখেছিলাম, লুকিয়ে থাকার পক্ষে ওটা তো ভাল জায়গা।

অর্জুন বলল, কিন্তু ওখানে পৌঁছাতে হলে পাহাড়ে ওঠার ট্রেনিং চাই।

না স্যার। এদিক দিয়ে উঠে যাওয়া যায়। পরপর স্টেপ ফেললে ওই গর্তের ভেতরে চলে যাওয়া যাবে। আমি দেখছি। উত্তম শেরিং পা বাড়াল।

অফিসারদের দ্বিতীয়জন বলল, ও পাগল হয়ে গিয়েছে। আমরা বাইরে যাচ্ছি, তুমি বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওকে নিয়ে এসো।

অফিসাররা চোখের আড়ালে চলে গেলে উত্তম শেরিং চিতাবাঘের মতো বরফের ফাঁকে পা ফেলে ওপরে উঠে যাচ্ছিল। হঠাৎ চিৎকার ভেসে এল, স্টপ। তারপর হিন্দিতে শাসানো হল, যদি প্রাণের মায়া থাকে তা হলে এখনই এই জায়গা ছেড়ে চলে যাও।

গলার স্বর যেদিক থেকে আসছে সেদিকে তাকিয়ে অর্জুন সেই গর্তের মুখে মহম্মদ নুরউদ্দিন খিলজিকে দেখতে পেল। লোকটার হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। তারপর লোকটার পাশে এসে দাঁড়ালেন জনাব কামরুজ্জমান খিলজি। বেশ গম্ভীর গলায় ভদ্রলোক বললেন, অর্জুন, আপনি আমার ভাড়া করা গোয়েন্দা। আপনাকে আর আমার প্রয়োজন নেই। আপনি আপনার ওই লোকজনদের নিয়ে গ্যাংটক ফিরে যান। আর হ্যাঁ, কামরুজ্জমান খিলজি কাউকে বঞ্চিত করে না। টেন্টে আমি একটা ব্যাগ রেখে এসেছি। তাতে যা টাকা আছে তা দিয়ে সবার প্রাপ্য মিটিয়ে নিজেরটা রাখতে পারবেন। আই ডোন্ট নিড ইউ এনি মোর। লিভ দিস প্লেস। এইবার ভদ্রলোকের পাশে রোজিকে দেখা গেল।

আর যখন দরকার নেই তখন নিশ্চয়ই চলে যাব। কিন্তু আমাকে ভাঁওতা দেবার চেষ্টা করেছেন কেন? আপনার মেয়ে নাটক করছিল। আপনার পাশে যে দাঁড়িয়ে আছে তার নাম শুনেও চিনতে পারেননি। রোজিকে হাসপাতালে পাঠিয়েছিলেন। এসবের কী দরকার ছিল?

ছিল। আমরা দুটো দলে ভাগ হয়ে কাজটা করতে চাইছিলাম। আপনার সাহায্য দরকার ছিল কিন্তু আপনাকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজি আমাদের পূর্বপুরুষ। এই সেই জায়গা যেখানে তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই গুহার মুখও আটশো বছর বন্ধ ছিল। এখানেও তার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে। কিন্তু আসল গুহাটা এখানেই আছে। তাকে আমরাই খুঁজে বের করব। আপনারা ভদ্রভাবে চলে যান। জবাব কামরুজ্জমান বললেন।

আমি এত সহজ তোমাদের ছেড়ে দেব না। আমার ভাইকে তোমরাই মেরেছ।

না। তোমার ভাই পা পিছলে পড়ে গেছে। মহম্মদ নুরউদ্দিন খিলজি বলল।

মিথ্যে কথা, একদম মিথ্যে কথা। আমার ভাই এই পাহাড়ে চোখ বন্ধ করে ওঠানামা করতে পারে। আমি ওপরে উঠি আগে তারপর বোঝাঁপড়া করব? ওপরে ওঠার চেষ্টা করল উত্তম শেরিং।

ঠিক তখনই মহম্মদ নুরউদ্দিন খিলজি আগ্নেয়াস্ত্র উত্তম শেরিং-এর দিকে তাক করল। অর্জুন এক মুহূর্ত দেরি না করে একটা বরফের চাই তুলে নিয়ে লোকটার হাত লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিল। হাতে বরফের আঘাত লাগামাত্র ওর আঙুল ট্রিগারে চাপ দিল। কান ফাটানো আওয়াজ হলেও গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে বিপরীত দিকের পাহাড়ের ওপরের বরফে ঢুকে গেল। প্রচণ্ড ঘাবড়ে গিয়ে উত্তম শেরিং দ্রুত নীচে নামতে না নামতেই গুড়গুড় শব্দ শুরু হল।

*

বিপর্যস্ত মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজি হয়তো তিস্তা নদী কোনওক্রমে পার হয়ে এসেই মারা যেতেন যদি না তার পথপ্রদর্শক আলি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত। অবশ্য গিয়াসউদ্দিন খিলজিও তার পাশে ছিল। কোনওরকমে তারা ফিরে এলেন গৌড়ে। গৌড়ে তখন মহম্মদ আলি মর্দান খিলজির শাসন চলছে। তিব্বত অভিযানের আগে মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজি তাকেই দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন।

মহম্মদ আলি মর্দান খিলজি দীর্ঘসময় শাসনকর্তা হয়ে থেকে ক্রমশ এমন অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে তার ইচ্ছে করত না। তা ছাড়া মাঝে মাঝে খবর পেতেন মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজির সৈন্যরা মারা পড়ছে, তার অবস্থাও খুব খারাপ। ঠান্ডায় হেরে গিয়েছেন তিনি। ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই এসব খবর তাঁর কাছে আনন্দদায়ক ছিল। সেই বক্তিয়ার খিলজি আহত, অসুস্থ অবস্থায় ফিরে এসেছে শুনে তার মাথা গরম হয়ে গেল। তার ছুরির আঘাতে মহম্মদ বক্তিয়ারের বর্ণবহুল জীবন শেষ হয়ে গেল।

.

ধুন্দুমার কাণ্ড হয়ে গেল পাহাড়ে। একটি গুলির তীব্র শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে যেন আদিম যুগের যাবতীয় শেকড় উপড়ে বরফের চেহারা ভয়ংকর করে তুলল। অর্জুন এবং উত্তম শেরিং কোনওমতে বাইরে পৌঁছানোর আগে বিপুল তুষার এবং বরফের স্রোত আছড়ে পড়ল তিন চুড়োর মধ্যবর্তী এলাকায়। তার বিকট আওয়াজে মানুষের হাহাকার শোনা যাওয়ার কথা নয়। তুষার ছিটকে ছিটকে ওপরে উঠতে লাগল। তার টানে তিন পাহাড়ের সমস্ত বরফ যেন ছুটে আসতে লাগল। কয়েক মিনিটের মধ্যে বিশাল বরফের আস্তরণের আড়ালে চলে গেল এলাকাটা। যে গর্তটা গতরাতে মুখ দেখিয়েছিল সেটা ঠিক কোথায় তা বোঝা অসম্ভব হয়ে গেল।

অর্জুন বুঝতে পারল যাকে গর্তের মুখ ভেবেছিল, যা একদা গুহা ছিল, যার ভেতরে খিলজি বংশের তিন বংশধর পৌঁছাতে পেরেছিল তার মুখ চিরকালের জন্যে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গিয়েছে। আটশো বছর আগে মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজি যদি স্বেচ্ছায় গুহার মুখ বন্ধ করে দিয়ে থাকেন, তাঁর উত্তরাধিকারীরা হয়তো আরও কয়েকশো বছর বন্ধ গুহায় প্রাণহীন হয়ে পড়ে থাকবে।

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার