ক্যাপিটাল হোটেলে ফিরে এসে ম্যাপের সামনে বসেছিল অর্জুন। ওই গুহার সন্ধান পাওয়া সত্যি খুব কঠিন ব্যাপার। খড়ের গাদা থেকে সুচ খুঁজে বের করা বোধহয় অনেক সহজ। তার মনে হচ্ছিল আর এন সিকদার স্যার চেষ্টা করলে একটা হদিশ দিতে পারেন। কিন্তু তাকেও সত্যি কথাটা সে বলতে পারেনি। সে তাকে সেইসব গুহার কথা বলেছে যেখানে মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজি আশ্রয় নিয়েছিলেন। ওরা যে সেই গুহাটির সন্ধান চায় যার মুখ আটশো বছর আগে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ব্যাপারটা বৃদ্ধকে জানালে হয়তো ওঁর পক্ষে তথ্য সংগ্রহ করা সহজ হত। কিন্তু ইতিমধ্যে বিপক্ষের লোক ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। মানুষ হিসেবে উনি কতটা লোভী তা না . জেনে কথাটা বলতে চায়নি সে। উনি বলেছেন, বিপক্ষকে সাহায্য করবেন কিনা তা ভেবে দেখবেন। তাই অপেক্ষা করা ছাড়া পথ নেই।

টেলিফোন বাজল। অভিজাত হোটেলের টেলিফোন রিংটোনও চমৎকার। অর্জুন এগিয়ে গিয়ে রিসিভার তুলতেই গলা শুনল, গুড ইভনিং। আমি একটু আগে পৌঁছেছি। আপনি কি ব্যস্ত?

একদম না। অর্জুন হাসল।

তা হলে আপনার ঘরে আসছি।

একটু পরেই দরজায় শব্দ হল। অর্জুন খুলতেই মহম্মদ বিন কামরুজ্জমান খিলজি ঘরে ঢুকে বললেন, গ্যাংটকে এইসময় যত ঠান্ডা পড়বে ভেবেছিলাম তত পড়েনি। কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?

ভদ্রলোক বসার পর অর্জুন বলল, অন্য সমস্যার সমাধানের সূত্র পেতে যত অসুবিধে হয় এক্ষেত্রে তা বহুগুণ বেশি হবে। আটশো বছর সময়টা কম সময় নয়। আমি এগোছি তবে একেবারে কচ্ছপের গতিতে।

জনাব কামরুজ্জমান বললেন, দ্রুতগামী প্রাণী খরগোশ কিন্তু দৌড় প্রতিযোগিতায় কচ্ছপের কাছে হেরে গিয়েছিল।

অর্জুন মাথা নেড়ে জিজ্ঞাসা করল, রোজিকে কেন গুলি করা হল?

সেদিন সকালে রোজির মোবাইলে একটি আনোন নাম্বার থেকে ফোন আসে। ওকে বলা হয় আমাকে এই অভিযানে যেন যেতে না দেয়। যদি যাই তা হলে আমাদের পরিবারের কেউ জীবিত থাকবে না। এই ফোনটাকে উড়ো ফোন বলে ভেবেছিল রোজি। তখন আমাকেও কিছু বলেনি। দুপুরে ও যখন গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিল তখন আমি ঘুলঘুলাইতে ছিলাম। আমার দু’জন বিদেশি বন্ধুকে ওই ঐতিহাসিক মহল দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। ঘুলঘুলাইয়ার ভেতরে ঢুকে গেলে মোবাইলের টাওয়ার কাজ করে না। গাড়ি চালাতে চালাতে রোজি আমাকে কয়েকবার ফোন করে লাইন পায়নি। ও ভেবে নেয় আমার কিছু হয়েছে। তাই গাড়ি ঘুরিয়ে ও ঘুলঘুলাইয়াতে চলে আসে। আমার ধারণা ওই মহলের সামনে চার বন্দুকধারী আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল। আমি বেরিয়ে এলেই খতম করে দেবে ভেবেছিল হয়তো। কিন্তু তার আগে রোজিকে গাড়িতে দেখে আর অপেক্ষা করেনি। কিন্তু লোকটার গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। গুলি লাগে রোজির হাতে। জনাব কামরুজ্জমান খিলজি বললেন।

লোকটা কি ধরা পড়েছে?

দুর্ভাগ্য। পালাতে গিয়ে পাবলিকের হাত থেকে বাঁচতে অন্ধের মতো দৌড়োচ্ছিল। ফলে বাসের তলায় ওর শরীর ঢুকে গিয়েছিল। পরে আমি পুলিশের কাছে জানতে পারি, ও সুপারিকিলার। টাকা নিয়ে খুন করে। কিন্তু কে ওকে খুন করতে নিয়োগ করেছিল তা জানার সুযোগ পুলিশ পায়নি। জনাব কামরুজ্জমান খিলজি বললেন, আমাদের দুর্ভাগ্য, তাই ওকে জীবন্ত ধরা যায়নি। তা হলে ওকে জেরা করে সব খবর জানা যেত।

রোজি এখন বিপদমুক্ত? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

হ্যাঁ। ওকে বাড়িতে নিয়ে এসেছি। কিছুদিন বাড়িতেই থাকতে হবে।

আপনি কি দিল্লি হয়ে এসেছেন?

হ্যাঁ।

বাগডোগরা এয়ারপোর্ট থেকে ঘুমে যাওয়ার পথে কোনও গাড়ি কি আপনাকে অনুসরণ করেছে বলে মনে হয়েছে?

না। আমি ও ব্যাপারে সতর্ক ছিলাম। সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়েনি।

কিন্তু আমাদের আরও সাবধান হতে হবে।

কিছু হয়েছে?

হ্যাঁ। ওরা আমাদের আগেই এখানে পৌঁছে গিয়েছে। আজ আমি একটা কিউরিও শপে গিয়েছিলাম। বোধহয় আমাকে অনুসরণ করেই ওদের একজন ওই শপে গিয়েছিল। লোকটা এক্সপেডিশন অফ বক্তিয়ার খিলজি নামে বইয়ের সন্ধান করছিল।

সে কী! চোখ কপালে উঠল জনাব কামরুজ্জমান খিলজির। ওরকম বই আছে নাকি? যদি থাকে তা হলে বই-এর দোকানে না খুঁজে কিউরিও শপে কেন খুঁজবে? ব্যাপারটা অদ্ভুত মনে হচ্ছে।

অনেককাল আগে ছাপা বই। বোধহয় এখন পাওয়া যায় না। কার লেখা তাও জানি না। হয়তো ভেবেছে ওটা এখন কিউরিওর পর্যায়ে চলে গেছে। ব্যাপারটা হালকা নয়। আমার মনে হচ্ছে আপনি যা তথ্য জানেন তার অনেকটাই ওরা জেনে গিয়েছে। ওদের লক্ষ্য ওই গুহার দখল আগেভাগে নেওয়া। কিন্তু ওরা কারা? মহম্মদ বিন বক্তিয়ার খিলজির সন্তান ছিল কিনা তা ইতিহাস বইতে নেই। কিন্তু তার ভাইদের ছিল। যেটুকু আমি জেনেছি তার সঙ্গে যেসব তুর্কি যোদ্ধারা এদেশে আফগানিস্তান থেকে এসেছিল তাদের অনেকেরই উপাধি খিলজি ছিল। তাই ওর ভাইদের বংশের আপনি যেমন এখনকার প্রতিনিধি তেমনি অন্যভাইদের উত্তরপুরুষ তো থাকতেই পারে। এই যারা আপনার সঙ্গে পাল্লা দিতে চাইছে তারা সেই বংশধর নয় তো? আপনি কি তাদের জানেন? অর্জুন সরাসরি জিজ্ঞাসা করল।

বিশ্বাস করুন, আমি এতদিন আমার বাবা ঠাকুরদা বা ঠাকুরদার বাবা ছাড়া খিলজি বংশের অন্য কোনও শাখা আছে কিনা তা জানতাম না। জানতাম না বলা ঠিক নয়, আমি এখনও জানি না।

আপনি গ্রামের বাড়ির কথা বলেছেন যেখানে আপনার প্রপিতামহের বাড়ি আছে, একটা লাইব্রেরিও। সেখানে গিয়ে আপনি একটা চিঠির সন্ধান পান যেটা উর্দু ভাষায় লেখা। সেই চিঠি কি আপনি সঙ্গে করে লক্ষ্ণৌতে নিয়ে এসেছিলেন।

না। ওই লাইব্রেরি থেকে কোনও বই বা কাগজ বাইরে নিয়ে যাওয়া নিষেধ বলে নিয়ে আসিনি। তবে চিঠিটি নকল করে এনেছিলাম।

ওই চিঠির কথা কি কাউকে বলেছিলেন?

না। মাথা নাড়লেন জনাব কামরুজ্জমান খিলজি, আমার মেয়ে রোজি ছাড়া আর কাউকে বলিনি। আমি জানি রোজিও কাউকে বলবে না। বলেই

একটু ভাবলেন ভদ্রলোক, নাঃ। একজনকে চিঠিটা দেখিয়েছিলাম।

কাকে?

কেয়ারটেকারকে। উনি এককালে শিক্ষকতা করতেন। উর্দু ভাষাটা ওঁর নখদর্পণে ছিল। ওই চিঠির কয়েকটি শব্দের অর্থ বুঝতে না পেরে ওঁর সাহায্য নিয়েছিলাম। উর্দু ভাষারও বিবর্তন হয়েছে। প্রাচীনকালের অনেক শব্দের অর্থ এখন আমাদের কাছে অস্পষ্ট। চিঠি পড়ে উনি সেসব শব্দের অর্থ বলে দিয়েছিলেন।

উনি এখনও আছেন?

অবিবাহিত মানুষ। বইপত্র নিয়ে থাকতেন। কিছুদিন আগে ওঁর হার্ট অ্যাটাক হয়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় পাওয়া যায়নি।

অর্থাৎ, উনি আর কাউকে তথ্য জানিয়েছিলেন কিনা তা জানা যাচ্ছে না।

না।

কিন্তু তাঁর মৃত্যু কি স্বাভাবিকভাবে হয়েছিল বলে মনে করেন?

অস্বাভাবিক ভাবার তো কোনও কারণ পাইনি।

ঠিক আছে। কাল সকাল দশটায় আমার পরিচিত এক ভদ্রলোক আমাদের নিয়ে যাবেন সরকারি দপ্তরে। এই গ্যাংটক শহর থেকে চিন সীমান্ত পর্যন্ত যে পথ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে গিয়েছে তার আশেপাশে অনুসন্ধান চালাতে হলে ভারত সরকারের অনুমতি নিতে হবে। জনিসাহেব সেই অনুমতি পেতে সাহায্য করবেন। তিনিই আমাদের জন্যে গাইড, পোর্টার, গাড়ি এবং খোঁড়াখুঁড়ির কাজে দক্ষ এমন কয়েকজন শ্রমিককে নিয়ে একটা টিম তৈরি করে দেবেন। এই অভিযানবাবদ যা খরচ হবে তা করতে আপনি তৈরি তো?

অবশ্যই। আপনাকে তো ফোনে বলেছি।

কিন্তু ধরুন, এই অভিযানের পরে দেখা গেল ভারতীয় এলাকায় এই গুহা পাওয়া গেল না আবার চিন অধিকৃত তিব্বতে খোঁজ করতে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া গেল না তা হলে এত খরচ করে আফশোস করবেন না তো?

দেখুন, আমি একটা চেষ্টা করতে চাই। ফল না পেলে আর কী করা যাবে! একটা ব্যাপার নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, আমি আপনাকে এই অভিযান করার জন্যে কত খরচ হবে সে ব্যাপারে কোনও বাজেট চাইনি। আমি নিজে কোটি কোটি টাকা রোজগার করি না। কিন্তু পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া সম্পত্তি তো তাদের ইতিহাস খুঁজতে ব্যয় করতে পারি। ঘড়ি দেখলেন জনাব কামরুজ্জমান খিলজি, আজ বেশ ক্লান্ত। আমি যদি তাড়াতাড়ি ডিনার করে শুয়ে পড়ি তা হলে–।

অবশ্যই। একটা কথা, ঘরেই ডিনার করবেন। কেউ ডাকলেই হোটেল থেকে বের হবেন না। কোনও কিছুতে সন্দেহ হলে আমাকে ফোন করবেন। আর আগামীকাল সকাল সাড়ে নটার মধ্যে তৈরি হয়ে নেবেন। অর্জুন বলল।

ভদ্রলোক বেরিয়ে গেলে অর্জুন জনিসাহেবকে ফোন করল।

জনিসাহেব জানালেন কাল সকালের মধ্যে সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এখন চিন সীমান্ত পর্যন্ত গাড়ি যাওয়ার ভাল রাস্তা তৈরি হয়েছে। যাবতীয় মালপত্র এবং দলের সবাই যাতে স্বচ্ছন্দে যেতে পারে তার জন্যে গাড়ি ভাড়া করা উচিত বলে তিনি মনে করেন। গাড়ি থাকতে আগেকার মতো কেন পায়ে হাঁটার পরিশ্রম করা হবে? অর্জুন সম্মতি দিল। জনাব কামরুজ্জমান খিলজি যখন বলেছেন টাকার কোনও সমস্যা হবে না তখন এই কার্পণ্য করার কোনও মানে হয় না। ফোন রাখার আগে জনিসাহেব জানালেন, কাল সকাল দশটা নয়, এগারোটা নাগাদ যেন অর্জুনরা তার দোকানে আসে। কারণ সরকারি অফিসার সাড়ে এগারোটায় সময় দিয়েছেন।

*

ঠিক এগারোটা পঁচিশে ওরা জনিসাহেবকে নিয়ে সরকারি দপ্তরে পৌঁছে গেল। অফিসার জনিসাহেবকে খাতির করেন তা ওঁর ব্যবহারেই বোঝা গেল। জনিসাহেব জনাব কামরুজ্জমান খিলজি এবং অর্জুনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ভদ্রলোক বললেন, অদ্ভুত ব্যাপার। এতদিন জানতাম খিলজি টাইটেল শুধু ইতিহাসের বইতেই আছে। বলুন কী করতে পারি আমি?

জনাব কামরুজ্জমান খিলজি বললেন, আমি ইতিহাসের একটি বিখ্যাত চরিত্র মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজির বংশধর। আমার এই পূর্বপুরুষ আটশো বছর আগে তিব্বত আক্রমণ করেছিলেন। কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে তাকে পিছু হটতে হয়। আমার অনেক দিনের আগ্রহ যে পথ দিয়ে তিনি তিব্বতে ঢুকেছিলেন সেই পথটাকে একবার দেখব। শুনেছি, ভয়ংকর শীত থেকে রক্ষা পেতে তিনি পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। এসব নিজের চোখে দেখার জন্যে এখানে এসেছি, আপনি যদি অনুমতি দেন তা হলে সেটা সম্ভব হবে।

শুনতে শুনতে ভদ্রলোকের মুখ যে হাঁ হয়ে গিয়েছে তা অৰ্জুন লক্ষ করছিল। তিনি জনিসাহেবের দিকে তাকালেন, অদ্ভুত ব্যাপার। ঠিক এই অনুরোধ-নিয়ে কাল বিকেলে একটা আবেদন আমাদের দপ্তরে জমা পড়ে যা সুপারিশ করেছেন উত্তরপ্রদেশের একজন এম পি। যিনি আবেদন করেছেন তার টাইটেলও খিলজি। আমরা ভারতভূখণ্ডের মধ্যে অনুসন্ধানের অনুমতি তাকে দিয়েছি। মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজি যদি তিব্বতে গিয়ে থাকেন তা হলে সেখানে অনুসন্ধান চালাতে হলে চিন সরকারের অনুমতি নিতে দিল্লিতে যেতে হবে।

কথাটা শুনে জনাব কামরুজ্জামান খিলজির মুখে বিস্ময়ের ছাপ স্পষ্ট হল। তিনি অর্জুনের দিকে তাকালেন।

অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ওরা ঠিক কী কারণে অনুমতি নিয়েছে?

অলমোস্ট একই কারণে। এক্সপেডিশন অফ বক্তিয়ার খিলজি সম্পর্কে ওঁরা তথ্য সংগ্রহ করতে চান। পাহাড়ি মানুষের কাছে জানতে চাইবেন তারা তাদের পূর্বপুরুষের মুখ থেকে খিলজি সম্পর্কে কোনও গল্প শুনেছেন কিনা। এইসব। অফিসার ঠোঁট কামড়ালেন, এখন একই উদ্দেশ্যে আপনারাও যেতে চাইছেন। একজনকে অনুমতি দেওয়ার পরে আবার অনুমতি দেওয়া ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছি না। আপনারা এক কাজ করুন। গাড়ি নিয়ে সীমান্তে যান এবং ফিরে আসুন।

জনিসাহেব মাথা নাড়লেন, আমি কথা দিচ্ছি, আপনাকে এঁরা বিপদে ফেলবেন না।

অফিসার বললেন, বিপদের কথা বলছি না। একই কাজের জন্য দু’জনকে অনুমতি দেওয়া রীতিবিরুদ্ধ। আপনি যদি গতকাল আমাকে ফোন করতেন তা হলে আমি ওদের অনুমতি দিতাম না। আচ্ছা, আপনার টাইটেল তো খিলজি। আপনি কোথায় থাকেন?

লক্ষ্ণৌ শহরে। জনাব কামরুজ্জমান খিলজি উত্তর দিলেন।

অদ্ভুত ব্যাপার। যাঁরা অনুমতি নিয়েছেন তাদের ঠিকানাও তো লক্ষ্ণৌতে। আপনাদের টাইটেলও এক। ওঁদের চেনেন।

নামটা যদি বলেন।

অফিসার টেবিলে রাখা একটা ফাইল খুলে চোখ বুলিয়ে বললেন, মহম্মদ নুরউদ্দিন খিলজি।

এই নামের কাউকে আমি চিনি না।

উনি কিন্তু নিজেকে বক্তিয়ার খিলজির বংশধর বলেছেন।

এবার অর্জুন কথা বলল, না বললে আপনার কাছ থেকে অনুমতি পাওয়া যাবে না। অফিসার, ওই লোকগুলোর উদ্দেশ্য ভাল নয়।

কেন বলছেন একথা? কী খারাপ উদ্দেশ্যে ওই নির্জন পাহাড়ে যাবে ওরা?

সেটা এখনও স্পষ্ট নয়।

অফিসার একটু ভাবলেন। তারপর জনিসাহেবকে দেখিয়ে বললেন, ওঁকে আমরা খুব শ্রদ্ধা করি। উনি নিজে এসে যখন আপনাদের অনুমতি দিতে বলেছেন তখন আমি আর আপত্তি করছি না। আমি একটা পারমিট ইস্যু করছি যা নিয়ে আপনারা সীমান্তের কাছাকাছি যেতে পারবেন। তবে আমাদের সীমান্তরক্ষীরা আপত্তি করলে আপনাদের তৎক্ষণাৎ ফিরে আসতে হবে। ফাইল থেকে একটা ফর্ম বের করে অফিসার জনাব কামরুজ্জমান খিলজির দিকে এগিয়ে দিলেন, এটা ভরতি করে দিন।

*

জনিসাহেব সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। অবশ্য তার জন্যে ওদের আরও একটা দিন অপেক্ষা করতে হল। যে লোকটি গাইড সে একটু গম্ভীর প্রকৃতির, নাম উত্তম শেরিং। ওকে হোটেলে নিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল জনিসাহেবের নাতি। নাম শুনে অবাক হয়েছিল অর্জুন। শেরিং যার উপাধি তার প্রথম নাম উত্তম হয় কী করে? প্রশ্ন শুনে লোকটা হিন্দিতে জবাব দিয়েছিল, বাংলার একজন ফিল্ম স্টারের নাম খুব পছন্দ হয়েছিল আমার বাবার। তার নামে আমার নাম রেখেছিল। তারপর একটু থেমে জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনারা যদি দয়া করে বলেন ঠিক কোথায় কোথায় যেতে চান, ক’দিনের জন্যে যাবেন তা হলে প্ল্যান করতে সুবিধে হবে।

অর্জুন বলল, আমরা চিন সীমান্ত পর্যন্ত যাব। গাড়িতে কতদিন লাগবে?

স্যার, নাথুলা গ্যাংটক থেকে বাহান্ন কিলোমিটার দূরে। রাস্তা খুব খারাপ নয়। তবে পাহাড়ি পথ তো, ভোরবেলায় বের হলে দিনে দিনে পৌঁছানো যায়। ইচ্ছে হলে মাঝখানে হল্ট করতে পারেন। কিন্তু স্যার, নাথুলায় যেতে হলে পারমিট লাগবে।

ওটা নেওয়া হয়েছে। যদি আরও এগিয়ে যেতে চাই?

আমি বলব, সেই চেষ্টা না করাই ভাল। তবে প্রত্যেক সোমবার চিনা সরকার ওদের সীমান্ত পথ খুলে দেয়। তখন অনুমতি পেলে ভেতরে যাওয়া যায়। গতকাল আর একটা দল নাথুলায় রওনা হয়েছে। ওদের কাছে নাকি লাসায় যাওয়ার অনুমতি আছে। আমার এক ভাই ওদের গাইড হিসেবে সঙ্গে গিয়েছে। কিন্তু সে এবং দলের পোটাররা কখনওই সীমান্ত পেরিয়ে ওপারে যাবে না।

অর্জুন তাকাল উত্তম শেরিং-এর দিকে, ওরা কেন গিয়েছে তা তুমি জানো?

না স্যার।

আচ্ছা শেরিংভাই, নাথুলায় যাওয়ার পথে নিশ্চয়ই কিছু গুহা পাওয়া যায়।

স্যার, পাহাড়ে তো গুহা থাকবেই।

যে পথ দিয়ে এখন নাথুলা হয়ে লাসায় সবাই যায় সেই পথ কি অনেক আগেও চালু ছিল? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

আগে এত ভাল ছিল না। বাষট্টি সালের যুদ্ধের পরে রাস্তা ভাল হয়েছে।

উত্তম শেরিং ছাড়া জনিসাহেব আর একজনকে তদারকির কাজে দিয়েছিলেন। তার নাম বাবা সিং। লোকটির বাড়ি হিমাচলে কিন্তু গ্যাংটকে বাল্যকাল থেকে আছে। বয়স পঞ্চাশের আশেপাশে। বাবা সিং খাওয়াদাওয়া থেকে যাবতীয় কাজকর্মের তদারকিতে থাকবে। একটু বেশি কথা বলে। গ্যাংটকের বাজার থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছাড়া একটি পর্বতারোহী সংস্থা থেকে অনেকগুলো তাবু ভাড়া করা হল।

ঠিক সকাল সাতটায় ক্যাপিটাল হোটেলের সামনে থেকে চারটে গাড়ি ছাড়ল। প্রথমটিতে অর্জুন এবং জনাব কামরুজ্জমান খিলজির সঙ্গে উত্তম শেরিং। পরের দুটো সুমোতে বাবা সিং-এর সঙ্গে পোর্টার, রাঁধুনি এবং শ্রমিকরা। শেষেরটিতে যাবতীয় মালপত্র। এবং দু’জন পোর্টার।

গ্যাংটক থেকে ছাঙ্গু লেক যাওয়ার পথ আদৌ দুর্গম না হলেও পৌঁছাতে আড়াই ঘণ্টা লেগে গেল। এটি খুব জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট। শীতকালে লেকের জল একেবারেই বরফ হয়ে যায়। এখন বেশ টলটলে। ঠান্ডা বেশ, অন্তত গ্যাংটকের থেকে অনেক বেশি। ওরা একটা ধাবাজাতীয় খাবারের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে নিল। চা খেতে খেতে জনাব কামরুজ্জমান খিলজি বললেন, আমার পূর্বপুরুষ যখন এখানে এসেছিলেন তখন নিশ্চয়ই সামনের ওই লেকের জল বরফ হয়ে গিয়েছিল। ওঁর বোঝা উচিত ছিল আরও ওপরে আরও ভয়ংকর পরিস্থিত হবে। কিন্তু এই পথটুকু যে আমরা এলাম, কোনও গুহা পথে পড়ল না।

অর্জুন মাথা নাড়ল, থাকলে কি চোখে পড়ার কথা?

মানে?

আপনার পূর্বপুরুষ মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজি তো গুহাটির মুখ ভালভাবে বন্ধ করে গিয়েছিলেন। তা হলে বাইরে থেকে কী করে বুঝবেন আপনি? যেতে যেতে যদি কোনও গুহা দেখা যায় তা হলে বুঝতে হবে ওটা আপনার পূর্বপুরুষের বন্ধ করা গুহা নয়। অর্জুন বলল।

এটা ঠিক বলেছেন। উত্তেজনায় খেয়াল করিনি। আসলে এই পথে যেতে পারছি ভেবেই আমি উত্তেজিত বোধ করছি। লাসায় তো এদিক দিয়েই লোক যেত।

হ্যাঁ, যেত। কিন্তু আটশো বছর আগে পথটা ছিল কিনা তা জানা যাচ্ছে না। তখন এই সিকিম ছিল ভুটানের অধীনে। এই যে ছাঙ্গু লেক, এর সঠিক নাম জানেন?

না।

টি উচ্চারণ না করলে সমগগা। ভুটানি শব্দ। মানে হল জলাশয় বা লেকের উৎপত্তি স্থল। ভুটান আর তিব্বত এদিকে গায়ে গায়ে ছিল। আমরা গ্যাংটক থেকে সীমান্তে যাওয়ার বেশির ভাগ পথটাই পেরিয়ে এসেছি। এখান থেকে নাথুলা মাত্র আঠারো কিলোমিটার দূরে। অর্জুনের কথার মধ্যেই তার মোবাইল ফোন জানান দিল। গতকাল সে জনিসাহেবকে নাম্বারটা দিয়ে এসেছিল। যদিও ছাঙ্গু ছাড়াবার পর টাওয়ার পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে।

মোবাইল ফোন অন করতেই জনিসাহেবের গলা কানে এল। গুড মর্নিং, এখন নিশ্চয়ই ছাতে? ঠান্ডা কেমন?

আছে। তবে এমন কিছু বেশি নয়। অর্জুন বলল।

মিস্টার আর এন সিকদার অনুগ্রহ করে আমার বাড়িতে এসেছেন। উনি কথা বলতে চাইছেন। নিন, কথা বলুন। জনিসাহেব বললেন।

আর এন সিকদার মশাইয়ের গলা শুনতে পেল অর্জুন। আপনারা যে এত তাড়াতাড়ি রওনা হবেন তা আমি ভাবিনি। খিলজি ঠিক কোন পথে দেশে ফিরে এসেছিল তা কেউ লিপিবদ্ধ করে যায়নি। কিন্তু লোকটাকে তার সৈন্যসমেত নদী পার হতে হয়েছিল। সেই নদীতে তাদের অনেকের মৃত্যু হয়। ওই নদী পার হওয়ার আগে ভয়ংকর ঠান্ডায় কাবু হয়ে পড়ে লোকটা। সে যে গুহায় দীর্ঘদিন আশ্রয় নিয়েছিল তার সামনে ছিল বরফে ঢাকা তিন পাহাড়ের চুড়ো। এই খবরটা তার সঙ্গী মহম্মদ শিরান খিলজি ফিরে এসে জানিয়েছিল। সত্য কি মিথ্যে জানি না, এর বেশি কোনও তথ্য আমি পাইনি। আর হ্যাঁ, আমি ভেবে দেখলাম খবরটা আর কাউকে জানাব না, তাই জানাইনি। ফোন বন্ধ করে দিলেন বৃদ্ধ আর এন সিকদারমশাই।

অর্জুন জনাব কামরুজ্জমান খিলজির সঙ্গে আলোচনা করল। ছাঙ্গু লেকের নীচের অংশ গ্যাংটক পর্যন্ত বরফ কদাচিৎ পড়ে। গ্যাংটক থেকে তিস্তা নদী পর্যন্ত কখনও বরফ জমেছে বলে সে শোনেনি। তা হলে যে বরফে ঢাকা তিন পাহাড়ের চুড়ো গুহার সামনে ছিল তা কখনওই ছাঙ্গু লেকের নীচে হতে পারে না। এক্ষেত্রে তাদের নাথুলা পর্যন্ত যেতেই হবে।

ওরা রওনা হল। একটু পরেই তিরতিরিয়ে ফিনফিনে বরফ পড়তে লাগল সামনের রাস্তায়, গাড়ির ওপরে। ক্রমশ রাস্তা চেনা মুশকিল হয়ে গেলে উত্তম শেরিং সক্রিয় হল। তার নির্দেশ মেনে গাড়ি চালাতে শুরু করল ড্রাইভার। একটা মোড় পার হতেই দেখা গেল আকাশ ক্রমশ কালো হয়ে আসছে। উত্তম শেরিং গাড়িগুলোকে পাহাড়ের গা ঘেঁষে রাখতে বলল। তারপর ওরই মধ্যে নীচে নেমে চারপাশ দেখে নিয়ে এসে বলল, এখানে দাঁড়ানো ঠিক হবে না। ধ্বস নামতে পারে। রাস্তার ওপাশে যে ফাঁকা জায়গাটা আছে ওখানে গাড়িগুলো নিয়ে গেলে বিপদ অনেক কমে যাবে।

জনাব কামরুজ্জমান খিলজি সম্মতি দিলেন।

গাড়িগুলোকে পিচের রাস্তা থেকে সরিয়ে পাহাড়ের পেছনের একটু ফাঁকা জায়গায় নিয়ে যেতে ড্রাইভারদের কিছুটা কসরত করতে হল। এবং তখনই ঝড় এল। উত্তম শেরিং উঠে এসেছিল গাড়িতে, হাওয়ার ধাক্কায় অত বড় গাড়িও দুলছে, গাড়ির গায়ে আছাড় খাচ্ছে বরফের টুকরো, সঙ্গে বৃষ্টির জল। ঝড়টা যে দিক থেকে আসছে তার উলটো দিকে গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে রাখতে বলেছিল উত্তম শেরিং তাই সামনের কাঁচে আঘাত লাগছিল না। লোকটা যে বিচক্ষণ তা বুঝতে পেরে খুশি হল অর্জুন।

প্রায় চল্লিশ মিনিট পরে জনাব কামরুজ্জমান খিলজি বললেন, এরকম অভিজ্ঞতা আমার কখনও হয়নি। দেখতে দেখতে চারপাশ বরফে ঢেকে যাচ্ছে। ঝড় না থামলে তো আমরা এগোতে পারব না।

উত্তম শেরিং, চোখ বন্ধ করেছিল। বলল, এই ঝড় চট করে থামবে না। একটু থেমে আবার হবে। তারপর যখন থামবে তখন আমরা যেতে পারব না।

কেন? জনাব কামরুজ্জমান খিলজি জিজ্ঞাসা করলেন।

রাস্তায় যে বরফ জমবে তা ইন্ডিয়া আর্মির জোয়ানরা পরিষ্কার না করে দিলে গাড়ি চলবে না। ততক্ষণ আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। উত্তম শেরিং বলল।

ইন্ডিয়ান আর্মি কোথায়?

কাছেই তো বর্ডার। ওখানে প্রচুর আর্মির লোকজন আছে। এই রাস্তাটা ওদের আন্ডারে। ওরাই দেখাশোনা করে।

দুপুরের মাঝামাঝি ঝড় বন্ধ হল। প্রায় হাঁটু পর্যন্ত নরম তুষার যা একটু পরেই বরফের চেহারা নেবে, চারপাশে জেঁকে বসেছে। বাবা সিংকে সঙ্গে নিয়ে উত্তম শেরিং সেই তুষার ভেঙে রাস্তা দেখে এসে বলল, অসম্ভব। আর্মির জোয়ানরা এসে কাজে না লাগলে আমরা এগোতে পারব না।

বাবা সিং বলল, স্যার, কিছু করার নেই। আজ এখানেই থাকতে হবে আমাদের। পারমিশন পেলে তাঁবু তৈরি করতে বলি।

অর্জুন জনাব কামরুজ্জমানের দিকে তাকালে তিনি মাথা নাড়লেন। এখানকার আবহাওয়াতে বাবা সিং-এর পরামর্শ মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ততা ছড়িয়ে পড়ল। তুষারের মধ্যেই শ্রমিকরা গাড়ি থেকে নেমে তাবু খাটানোর কাজে লেগে গেল। পর পর চারটে তাঁবু তৈরি হয়ে গেল। ছোট তাবুটি দু’জনের। যেখানে অর্জুন আর জনাব কামরুজ্জমান খিলজি থাকবেন। তাঁবুর কাছাকাছি সাময়িকভাবে ব্যবহারের জন্যে টয়লেটের ব্যবস্থা করা হল। বাবা সিং যখন ওদের তাঁবুতে যাওয়ার অনুরোধ করল তথন জমে থাকা তুষার শক্ত হতে শুরু করেছে। তাঁবুর ভেতর ঢুকে জনাব কামরুজ্জমান খুশি হয়ে বললেন, বাঃ, চমৎকার। এত তাড়াতাড়ি বেশ আরামদায়ক ব্যবস্থা করে ফেলেছে। আমরা তো এখানে থেকেই সন্ধানের কাজ চালাতে পারি!

পারি। কিন্তু আর্মি যদি আপত্তি করে তা হলে চলে যেতে হবে। ওরা নিশ্চয়ই জিজ্ঞাসা করবে এত লোকজন নিয়ে আমরা কেন এখানে তাবু ফেলেছি? উত্তর দেওয়া সহজ হবে না। অবশ্য যতক্ষণ সমস্যা তৈরি না হচ্ছে ততক্ষণ থাকা যেতেই পারে। অর্জুন কথা শেষ করতেই বাবা সিং বলল, স্যার, এখন রান্না শুরু হয়ে গিয়েছে। ভাত আর মাংসের ঝোল। রাত্রে রুটি হবে। কোনও সমস্যা নেই তো?

না না, ঠিক আছে। কিন্তু রান্নার জন্যে জল পাবে কোথায়?

কেন? তুষার গরম করলেই তো জল হয়ে যাবে। তা ছাড়া গাড়িতে প্রচুর খাওয়ার জল আছে। ও নিয়ে চিন্তা করবেন না। বাবা সিং বেরিয়ে গেল।

.

বিকেলের অনেক আগেই সন্ধে নেমে পড়ল ঝুপ করে। সেই সঙ্গে ঝড় এবং তুষারবৃষ্টি। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল ঝড়ের টানে তাবু উড়ে যাবে। কম্বল মুড়ি দিয়ে হ্যামকে শুয়ে থেকেও মনে হচ্ছিল ঠান্ডা বেড়ে যাচ্ছে। বাবা সিং একটা হারিকেন জ্বালিয়ে তাবুর একপাশে টাঙিয়ে দিয়ে গেছে। আলোটা কাঁপছিল। জনাব কামরুজ্জমান খিলজি তার সান্ধ্য নামাজ শেষ করে বললেন, এখানেই এমন ঠান্ডা, লাসায় নিশ্চয়ই অনেক বেশি হবে।

অবশ্যই। এখন বুঝতে পারছি মহম্মদ বিন বক্তিয়ার খিলজি কী ভুল করেছিলেন। তখন তো এরকম তাঁবু ছিল না। তিনি হয়তো তখনকার তাবুতে থাকতেন কিন্তু তার সৈন্যরা খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে তুষারঝড়কে মোকাবিলা করতে পারেনি। পারা সম্ভব নয়। অর্জুন বলল।

এত বড় ভুল লোকটা করল কী করে? জনাব কামরুজ্জমান খিলজি মাথা নাড়লেন, এখনও তো শীতকালের অনেক দেরি। এখনই এই অবস্থা। আচ্ছা, তখন আপনাকে যে ভদ্রলোক বরফে ঢাকা তিন পাহাড়ের চুড়োর কথা। বলেছিলেন তিনি কি ঐতিহাসিক?

বোধহয় নয়। তবে লাসায় জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন। ইতিহাস নিয়ে প্রচুর পড়াশুনো করেছেন। আমার সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল জনিসাহেবের দোকানে। কিন্তু জনাব নুরউদ্দিন খিলজি তার আগেই ওঁর কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ ভদ্রলোকের কাছে আর এন সিকদার সম্পর্কে খবর ছিল। অর্জুন বলল।

আশ্চর্য ব্যাপার। লক্ষ্ণৌতে থাকে, টাইটেল খিলজি অথচ আমি ওই নুরউদ্দিন নামের কাউকে চিনি না। কিন্তু মিস্টার সিকদার ওকে তিন পাহাড়ের খবরটা দিয়ে দেননি তো? জনাব কামরুজ্জমান খিলজি উদ্বিগ্ন।

না। উনি আমার অনুরোধ রেখেছেন। অর্জুন বলল।

কিন্তু ওরা আমাদের আগে রওনা হয়েছিল। এই অবধি এসে যখন ওদের দেখা পাইনি তখন বুঝতে হবে ওরা আমাদের আগে আছে। কিন্তু ছাঙ্গু লেক থেকে বর্ডার মাত্র বারো কিলোমিটার দুরে। তার মানে ওরা খুব কাছাকাছি। আছে। জনাব কামরুজ্জমান যেন নিজের সঙ্গেই কথা বলছিলেন।

অর্জুন কিছু বলল না। একথা ঠিক শত্রুপক্ষ সীমান্তে গিয়ে বসে থাকবে না। ইন্ডিয়ান আর্মি সেটা করতে অনুমতি দেবে না। তা হলে ওরা নিশ্চয়ই এক-দুই কিলোমিটারের মধ্যে আছে। ওরা জানে জনাব কামরুজ্জমান খিলজি গুহার খোঁজে আসছেন। গুহার অবস্থান যদি ওদের জানা না থাকে তা হলে ওরা কেন খুঁজতে এসেছে? বেশ কিছুদিন ধরে রোজি এবং তার বাবার পিছু নিয়েছে ওরা। ভয় দেখিয়েছে। মারতেও চেয়েছে। এখানে এসে অভিযান। করতে কম খরচ করতে হচ্ছে না। কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছাড়া কেউ এত খরচ করবে? ঝুঁকি নেবে? নিতে পারে না। হঠাৎ অর্জুনের মনে হল, ওরা অন্য মতলব করছে না তো। এগিয়ে এসে অপেক্ষা করছে। নিশ্চয়ই ভেবেছে গুহাটা কোথায় তার সন্ধান জনাব কামরুজ্জমান খিলজি পেয়ে গেছেন। সেই গুহায় পৌঁছালেই ওরা আক্রমণ করে গুহার দখল নেবে। ভাবনাটা মাথায় আসামাত্র অর্জুন জনাব কামরুজ্জমান খিলজিকে জানাল। তিনি প্রশ্ন করলেন, ওই নুরউদ্দিনের দলে কতজন লোক আছে তা জানতে হবে। আমাদের লড়াইয়ের জন্যে প্রস্তুত হতে হবে।

অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, কী দিয়ে লড়াই করবেন? কোনও অস্ত্র আছে?

ভদ্রলোক একটু হকচকিয়ে গেলেন, তা অবশ্য নেই।

এইসময় বাবা সিং কফি নিয়ে এল। একটা পট আর দুটো কাপ।

গরম কফিতে চুমুক দিয়ে অর্জুন বলল, উত্তম শেরিং এখন কী করছে?

বাবা সিং ফিরে গিয়ে উত্তমকে পাঠিয়ে দিল। অর্জুন বলল, এখন তো বাইরে তুষার আর আগের মতো পড়ছে না। তুমি কি আমার সঙ্গে একটু হাঁটতে পারবে?

আমার আপত্তি নেই। কিন্তু এটা এখানকার আইনবিরুদ্ধ কাজ, উত্তম বলল।

কীরকম?

রাত্রে বাইরে থাকলে আর্মির অনুমতি নিতে হয়। যেহেতু বর্ডার খুব কাছে তাই আর্মি খুব জরুরি না হলে অনুমতি দেয় না।

আমরা যদি গাড়ি চলাচলের পথে না যাই? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, একটু ঘুরপথে গেলে আর্মির চোখ এড়িয়ে যাওয়া যাবে না?

তা যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু স্যার, কোথায় যাবেন? উত্তম জিজ্ঞাসা করল।

সীমান্তের দিকে।

স্যার। রাত্রে এভাবে যাওয়ার বিপদ আছে। আর্মি শত্রু ভেবে গুলি চালাতে পারে।

অর্জুন একটু ভাবল। তার মনে হল উত্তম শেরিংকে কিছুটা কথা বলা দরকার। সে বলল, আমরা আর্মির কাছাকাছি যাব না, শোনো, তুমি নিশ্চয়ই জানো আমরা কয়েকটা গুহার সন্ধানে এসেছি যেসব গুহায় এঁর পূর্বপুরুষ এককালে কিছুদিন কাটিয়েছিলেন।

হ্যাঁ স্যার, জানি।

কিন্তু এঁর শত্রুপক্ষের লোকজন আমাদের আগে এই পথে এসেছে ওই একই উদ্দেশ্য নিয়ে। ওরা এখন ঠিক কোনখানে আছে তা আমাদের জানা দরকার।

তার মানে আমার এক ভাই যে দলটার সঙ্গে গেছে আপনি সেই দলের কথা বলছেন। আমি ভাইকে মোবাইলে জিজ্ঞাসা করতে পারতাম। কিন্তু এখানকার সমস্ত এলাকার মোবাইল টাওয়ার বন্ধ রেখেছে আর্মি। কথা বলা যাবে না। কিন্তু ওই দলটা কি কোনও বদ মতলবে এসেছে। উত্তম শেরিং জিজ্ঞাসা করল।

তা না হলে ওদের খবর নিতে চাইব কেন?

ঠিক আছে স্যার। তা হলে আরও রাত না করে এখনই রওনা হওয়া উচিত। যত রাত বাড়বে তত ঠান্ডা বেশি হবে। তা ছাড়া আবার ঝড় আসতে পারে।

জনাব কামরুজ্জমান খিলজি বেরুবার জন্যে তৈরি হতে যাচ্ছিলেন কিন্তু অর্জুন আপত্তি করল। বলল, আমাদের একজনের এখানে থাকা দরকার। বাবা সিং হয়তো সাধারণ সমস্যা সামলে নেবে কিন্তু যদি কোনওভাবে আর্মি এসে পড়ে তা হলে মুশকিলে পড়বে। কথাটার যুক্তি থাকায় মেনে নিলেন জনাব কামরুজ্জমান খিলজি। বললেন, সাবধানে যাবেন। ওরা যেন আপনাদের দেখতে না পায়।

গ্যাংটক থেকে তাবু ভাড়া করার সময় কিছু দরকারি জিনিসও ভাড়া করা হয়েছিল। সেগুলো কাজে লাগল। হাঁটুর নীচ পর্যন্ত জুতো, গামবুটের থেকে উচ্চমানের, জ্যাকেট, টুপি থেকে গ্লাভসে নিজেদের আড়াল করে ওরা বের হল। আকাশে মেঘ থাকায় সামনে অন্ধকারের দেওয়াল। উত্তম শেরিং বাঁহাতে টর্চ আর ডানহাতে শক্তপোক্ত লম্বা লাঠি নিয়ে সামনে হাঁটছিল। গাড়ির রাস্তা ছেড়ে খানিকটা এগোতেই বোঝা গেল পাহাড়ের বাধা অতিক্রম করা যাবে না। তাদের মাঝে মাঝে গাড়ির রাস্তা ব্যবহার করতেই হবে। উত্তম শেরিং নিচু গলায় বলল, আর্মির গাড়ির আলো দূর থেকে দেখা গেলে আমাদের আড়ালে চলে যেতে হবে স্যার।

সমস্ত শরীর শীতবস্ত্রের আড়ালে থাকা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছিল অর্জুন। সবচেয়ে সমস্যা হল পা ফেলার। পড়ে থাকা তুষার ঘন হচ্ছে। তার ভেতরে পা পড়লে টেনে তুলতে শক্তি ক্ষয় হচ্ছিল। গতি কমছিল।

মিনিট কুড়ি ওইভাবে হাঁটার পর চোখ ধাতস্থ হল। অন্ধকারকে এখন অনেক পাতলা লাগছে। অর্জুন উত্তম শেরিং-এর অবয়বকে আবছা দেখতে পাচ্ছিল। হঠাৎ উত্তমের গলায় সতর্কতা স্পষ্ট হল, স্যার। তাড়াতাড়িই বাঁদিকে চলুন। আমাদের আড়ালে যেতে হবে।

অর্জুন সামনে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেল না। কিন্তু ডানদিকের পাহাড়ের উঁচুতে একটা হলদে আলো যা মেয়েদের কপালের টিপের চেয়ে বড় নয়, একটু একটু করে এগিয়ে আসছিল এবং তারপর দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল।

ওটা কী?

মনে হচ্ছে রাস্তা পরিষ্কার করার গাড়ি। ওরা আমাদের দেখে ফেললে বিপদে পড়তে হবে। চলে আসুন স্যার। আমার পেছন পেছন হাঁটবেন। পাশেই খুব গভীর খাদ আছে। টর্চের আলো জ্বেলেই নিভিয়ে দিচ্ছিল উত্তম। ওকে অনুসরণ করে রাস্তার পাশে ছোট টিলার আড়ালে চলে এল অর্জুন। তারপর অপেক্ষা করল গাড়িটার জন্যে। কিন্তু মিনিট দশেক চলে গেলেও গাড়ির দেখা পাওয়া গেল না।

অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার? ওটা তো এল না!

হয়তো ওপরে বেশি বরফ পড়েছে। ভোরের আলো ফুটলে কাজ শুরু করবে। চলুন, গাড়ির রাস্তায় না হেঁটে এদিক দিয়েই যাওয়ার চেষ্টা করি। আমার মনে হচ্ছে আগের দলটাকে নিয়ে ভাই কোথায় আশ্রয় নিয়েছে তা বুঝতে পারছি।

কোথায় সেটা?

ওইদিকে কিছুটা গেলেই চমৎকার আড়াল আছে। তুষারঝড় আটকে যায় তিন পাহাড়ের জন্যে। এমনকী প্রচণ্ড হাওয়াও ওখানে ঢোকে না ওই আড়ালের কারণে। আমরা অনেকবার ওখানে আশ্রয় নিয়েছি তেমন বিপদে পড়লে। এখান থেকে বেশি দূরে নয় জায়গাটা।

উত্তম শেরিং-এর কথাগুলো কানে যাওয়ামাত্র অর্জুন সোজা হয়ে দাঁড়াল। মহম্মদ নুরউদ্দিন খিলজি কি জেনেশুনেই ওইখানে তাবু ফেলেছেন। তিন বরফের পাহাড়ের ভেতরে যে গুহায় বক্তিয়ার খিলজি আটশো বছর আগে আশ্রয় নিয়েছেন তার খবর লোকটা কার কাছ থেকে জানল? আর এন সিকদার মশাই নিশ্চয়ই কথার খেলাপ করেননি। তা হলে ওদের ওখানে পৌঁছানো কি কাকতালীয় ঘটনা?

অর্জুন বলল, উত্তমভাই, আমরা যতদূর সম্ভব ওদের কাছে যাব কিন্তু ওরা যেন সেটা বুঝতে না পারে।

ঠিক আছে স্যার।

আরও মিনিট চারেক হাঁটার পর অর্জুন অবাক হয়ে দেখল উত্তম শেরিং এর আবছা অবয়ব নীচে নেমে গেল। তারপরেই ওর গলা শুনতে পেল, স্যার, আমাকে ওপরে তুলুন। এখানে গর্ত আছে তা বুঝতে পারিনি।

পড়ার সময় উত্তমের হাত থেকে টর্চ বরফের ওপর ছিটকে গিয়েছিল। কিন্তু সে লম্বা লাঠিটাকে দুহাতে ধরে থাকায় তার দুই প্রান্ত গর্তের দু’পাশে আটকে গিয়েছে। অর্জুন টর্চ তুলে উত্তম শেরিং-এর জন্যে নীচে আলো ফেলতেই চমকে উঠল। গর্তটা অনেক নীচে চলে গেছে। লাঠিটা দু’হাতে ধরে ঝুলে রয়েছে লোকটা। বেশিক্ষণ ওভাবে ঝুলে থাকা সম্ভব নয়। অর্জুন গর্তের পাশে হাঁটু মুড়ে বসে উত্তম শেরিং-এর জ্যাকেটের কলার ধরে ওপরের দিকে টানতে লাগল। উত্তম শেরিং কাতর গলায় বলল, স্যার, আপনি লাঠির মাঝখানটা ধরে ওপরে টানুন।

মিনিট খানেকের চেষ্টার পরে লোকটা ওপরে উঠল। উঠেই হাঁটু মুড়ে হাত জোড় করে প্রার্থনা করতে লাগল। তারপর বলল, স্যার, আপনাকে ধন্যবাদ, আপনি আমার প্রাণ বাঁচালেন। দোষ আমারই। আমি অন্যমনস্ক ছিলাম ভাইয়ের কথা ভেবে। ও যদি খারাপ লোকের দলে কাজ নিয়ে থাকে তা হলে সেটা ঠিক নয়। এটা ভাবতে গিয়ে হাঁটার সময় লাঠি ঠুকে বরফ পরীক্ষা করতে খেয়াল করিনি। চলুন। আমরা এসে গেছি।

অর্জুন অবাক হয়ে গেল। একেবারে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেও লোকটা কীরকম স্বাভাবিক গলায় কথা বলছে! এটা বোধহয় পাহাড়ের লড়াকু মানুষের পক্ষে সম্ভব।

কোথাও কোনও আলো নেই। কিন্তু একটা বরফের চাই-এর আড়ালে দাঁড়িয়ে উত্তম শেরিং দেখাল। না দেখালে চট করে বোঝা প্রায় অসম্ভব ছিল। তিনটে তাঁবু প্রায় মিশে গেছে বরফের পাহাড়ের গায়ে। তিনটে তাঁবুতেই কোনও আলো জ্বলছে না। চাপা গলায় উত্তম শেরিং বলল, স্যার, ওরা হয় আর্মি নয় ঠান্ডার ভয়ে তাবুর ভেতরে বসে আছে। এখন কী করবেন?

ওরা সংখ্যায় কত তা জানা দরকার ছিল।

তা হলে তো তাবুর ভেতরে যেতে হয়।

সেটা সম্ভব নয়। আচ্ছা, কোনওভাবে ওদের তাবুর বাইরে নিয়ে আসা যায় না।

তা হলে আমাকে একটু বদমায়েশি করতে হবে। আসুন। উত্তম শেরিং পেছন দিকে খানিকটা হেঁটে সতর্কভাবে এক পাহাড়ের উপর উঠতে লাগল। ও যত সহজভাবে উঠতে পারল অর্জুন তত সহজে পারল না। ওঠার পর বুঝল পাহাড়ের চারভাগের একভাগে তারা উঠেছে। বাকিটায় উঠতে পারবে শুধু পর্বতারোহীরাই। সেখান থেকে অন্য দুটো পাহাড়ের চুড়ো দেখা যাচ্ছিল। ধূসর হাড়ের মতো রং। এই তিন পাহাড়ের মাঝখানে যদি মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজি আশ্রয় নিয়ে থাকেন তা হলে সেই গুহাটা কোথায়? নীচের অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না, দেখতে গেলে কাছে যেতে হবে।

উত্তম শেরিং বলল, আমি এখান থেকে একটা বরফের চাই নীচে ফেলছি। ওটা ফেলামাত্র আমাদের পেছনে সরে যেতে হবে যাতে নীচ থেকে কেউ দেখতে না পায়।

অর্জুন দেখল। একটু এগিয়ে গিয়ে লাঠির একটা প্রান্ত বরফের খাঁজে ঢুকিয়ে চাড় দিতে লাগল উত্তম শেরিং। কিন্তু ব্যাপারটা সহজসাধ্য ছিল না। বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টার পরে উত্তম শেরিং যতটা বরফের চাইকে নীচে পাঠাবে ভেবেছিল তার থেকে অনেক বড় অংশ নীচের দিকে গড়িয়ে যেতে যেতে আরও অনেক বরফকে সঙ্গী করে নিল। যেহেতু ওরা তাঁবুগুলোর বিপরীত দিকের পাহাড়ে দাঁড়িয়ে তাই বরফের স্তূপ হুড়মুড়িয়ে পড়ল তাঁবুর সামনে। আওয়াজ হল বিকট। নীচে পড়ে ছিটকে যেতে লাগল তারা। সঙ্গে সঙ্গে প্রায় আর্তনাদ করে তাঁবুর বাইরে চলে এল মানুষগুলো। উত্তম শেরিং নিজেকে একটু আড়ালে রেখে মাথা গুনে বলল, বারোজন লোক বলে মনে হচ্ছে। যারা তখনও ভয়ে জোরে জোরে কথা বলছিল তাদের ধমক দিয়ে চুপ করতে বলল একজন। ঠিক তখনই ওপাশের পাহাড়ে গুম গুম শব্দ শুরু হল।

উত্তম শেরিং বলল, সর্বনাশ। তাড়াতাড়ি নেমে চলুন। ওদিক থেকে আলগা বরফ খসে খসে পড়ছে। এখনই নীচের দিকে গড়িয়ে আসবে। জোরে পা ফেলুন।

শব্দটা শত্রপক্ষের লোকদের কানে পৌঁছাতেই তারা আতঙ্কিত হল। দু’জন লোক তাদের শান্ত করার চেষ্টা করেও পারছিল না। নিরাপদ বলে মনে হওয়া একটা জায়গায় এসে উত্তম আচমকা মুখে আঙুল দিয়ে পরপর দু’বার সিটি বাজাল।

অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, এটা কী করছ?

আমার ভাইকে সাবধান করে দিচ্ছি।

সে কি জানে তুমি এখানে এসেছ?

পাক্কা জানে না। আপনাদের সঙ্গে যে কথা হচ্ছিল তা শুনেছিল।

কিন্তু তোমার এই সিটি যদি ওর কানে যায় তা হলে কি বুঝবে?

হ্যাঁ স্যার। উত্তম শেরিং উত্তর দিতেই দু’-দু’বার সিটি বেজে উঠল। উত্তম শেরিং হাসল, দেখলেন তো!

নীচে তখন লোকজন ছুটোছুটি করছে। হঠাৎ অর্জুনের নজরে পড়ল একটা লোক প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে উঠে আসছে এদিকে। উত্তম লোকটাকে দেখতে পেয়ে আহ্লাদে বলল, আমার ভাই। এইসময় একটা তুষার ধ্বস নেমে এল ওপাশের পাহাড় থেকে। নদীর স্রোতের মতো ধাক্কা খেল সামনের পাহাড়ে। তারপর রাস্তা পেয়ে নেমে গেল নীচে। উত্তম শেরিং বলল, যাক লোকগুলো বেঁচে গেল। ওরা যেদিকে গিয়েছিল ধ্বস তার উলটোদিকে নেমে গেছে। কিন্তু তাঁবুগুলোর অবস্থা দেখুন!

অর্জুন দেখেছিল, বেশিরভাগ তাঁবুই বিধ্বস্ত। অনেকখানি বরফের আড়ালে।

যে দু’জন লোক সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছিল তাদের একজনকে এই আধা অন্ধকারেও চিনতে পারল অর্জুন। জনিসাহেবের কিউরিও শপে সিসি টিভিতে ওই লোকটিকে সে দেখেছিল। জনিসাহেবের নাতির সঙ্গে কথা বলছিল! ওই লোকটি কি মহম্মদ নুরউদ্দিন খিলজি? জনাব কামরুজ্জমান খিলজি দেখলে কি চিনতে পারবেন? তিনি তো ওই নামের কাউকে চিনতেই পারেননি।

নীচে তখনও চিৎকার করে চলেছে শ্রমিকরা। অনেকেই সম্ভবত আহত হয়েছে। অর্জুন দেখল মানুষটাকে। কোনওরকমে ওপরে উঠে আসছে। উত্তম শেরিং এগিয়ে গিয়ে লোকটাকে জড়িয়ে ধরল। দু’জনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। শেষ পর্যন্ত উত্তম শেরিং লোকটাকে নিয়ে এগিয়ে এসে বলল, স্যার, আমার ভাই, শ্যাম।

আর ঠিক তখন গাড়ির আওয়াজ কানে এল। একের পর এক গাড়ির হেড লাইট দেখা গেল। তাদের সামনে বরফ সরানোর গাড়ি। ওরা দাঁড়িয়ে গেল পাশের গাড়ির রাস্তায়। আর ওদের দেখামাত্র শ্রমিকরা পড়ি কি মরি করে এগিয়ে যেতে লাগল সাহায্যের জন্যে। উত্তম শেরিং বলল, আর্মির লোকজন এসে গিয়েছে। নিশ্চয়ই তুষারধ্বসের খবর ওদের যন্ত্রে ধরা পড়েছে। স্যার, একটু আড়ালে থাকুন।

কেন? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

মনে হয় আর্মি কাউকে এখানে থাকতে দেবে না। নিরাপত্তার কারণে। রাস্তার দিকে কী হচ্ছে তা অর্জুন দেখতে পাচ্ছিল না আড়াল থাকায়। কিন্তু সেই লোকদুটো, যার একজন যদি নুরউদ্দিন খিলজি হয়ে থাকে, সঙ্গীকে নিয়ে পেছনের দিকে সরে যেতে চাইল। বোঝা যাচ্ছিল ওরা আর্মির সামনে পড়তে চাইছে না। কিন্তু তখনই ওপাশের পাহাড়ে আটকে থাকা একটা বরফের চাঁই ঈষৎ গলে যাওয়ায় খসে পড়ল হুড়মুড়িয়ে। আর্তনাদ করতে করতে লোকদুটো সামনের দিকে ছুটতে চাইল আত্মরক্ষা করার জন্যে। কিন্তু ততক্ষণে সেখানে পৌঁছে গিয়েছে আর্মির জোয়ানরা। ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাদের রাস্তার দিকে নিয়ে গেল ওরা। একটু পরে গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ শোনা গেল। আহত এবং সুস্থ দলটাকে নিয়ে আর্মির লোকজন ফিরে যাচ্ছে তাদের ক্যাম্পের দিকে।

কখন যে চাঁদ উঠেছে তা খেয়াল করেনি অর্জুন। এখন ঝাপসা অন্ধকার অনেকটা স্বচ্ছ হয়েছে। ধ্বংসস্তূপের দিকে তাকিয়ে অর্জুনের মনে হল যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে রণক্ষেত্রের চেহারা বোধহয় এরকমই হয়ে থাকে।

উত্তম শেরিং বলল, স্যার, এখানে দাঁড়িয়ে থাকার কি দরকার আছে? ওরা তো কেউ ফিরে আসবে না। অন্তত আজ আর্মি ওদের ছাড়বে না।

অর্জুন বলল, চলো, নীচে নেমে ওদের তাঁবুগুলো, যেগুলো এখনও সোজা আছে, ভেতরটা দেখি।

স্যার, কাল সকালে দেখলে হত না?

কেন একথা বলছ?

বিকেলে ঝড় হয়েছিল। বরফ পড়েছিল। তারপর এখন চাঁদ উঠেছে। কিন্তু এই চাঁদের আলো দেখে ভুলবেন না। আরও ভয়ংকর ঝড় আসতে পারে।

সেক্ষেত্রে ওই লোকদুটো যে গুহা থেকে বেরিয়ে এসেছিল সেখানেই ঝড়ের সময়টা কাটিয়ে দিতে হবে। এই জায়গাটা দেখার জন্যে আর একদিন কষ্ট করার কোনও মানে হয় না। এসো। অর্জুন সন্তর্পণে নামতে লাগল। উত্তম শেরিং তার ভাই শ্যামকে নিয়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও অনুসরণ করল।

এখন চাঁদের আলো আরও উজ্জ্বল বরফের ওপর সেই আলো পড়ায় চারধার চমৎকার আলোকিত। ওরা তাবুর সামনে পৌঁছে দেখল যে দুটো তাঁবু এখনও আধখাড়া হয়ে রয়েছে তার ভেতরে ঢোকা যাবে না। তাঁবুর দরজা বরফে চাপা পড়ে গেছে। পাশের গুহার দিকে তাকাল অর্জুন। এখানে নুরউদ্দিন খিলজি রাতের আস্তানা গেড়েছিল। সে গুহার ভেতরে ঢুকল।

দুটো স্লিপিং ব্যাগ, দুটো সুটকেস। অর্জুন প্রথম সুটকেস খুলল। চাঁদের আলোর প্রতিফলন যা বরফের কল্যাণে ভেতরে ঢুকেছিল তা দেখার পক্ষে যথেষ্ট। কিছু শার্ট প্যান্ট, আন্ডার গার্মেন্টস, দাঁতের ব্রাশ, পেস্ট, একটা পার্স এবং ছোট্ট ডায়েরি। ডায়েরিতে যা লেখা তা এই আলোয় পড়া সম্ভব নয়। অর্জুন সেটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখল।

দ্বিতীয় সুটকেসটা খুলতে পারল না অর্জুন। মজবুত তালায় বন্ধ হয়ে আছে। ওটা। কিন্তু সুটকেসের পাশে যে চিরুনিটা পড়ে আছে সেটা দিয়ে নিশ্চয়ই আজ চুল আঁচড়ানো হয়েছে। চিরুনিটা চোখের সামনে তুলে ধরল অর্জুন। লম্বা এবং খানিকটা চওড়া বড় দাঁড়ার চিরুনি। চিরুনির ফাঁকে একটা চুল আটকে আছে। চুলটাকে চিরুনি থেকে বের করে ভাল করে দেখল অর্জুন।

ঠিক সেই সময় আচমকা আলো কমে যেতে লাগল। উত্তম শেরিং আর তার ভাই গুহায় ঢুকে এল। উত্তম বলল, আপনাকে যা বলেছিলাম স্যার, তাই হল।

মানে?

ঝড় আসছে। আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গিয়েছে। কতক্ষণ হবে কে জানে!

তা হলে তখন ফিরে গেলে মাঝপথেই ঝড়ের মুখে পড়তে হত। তাতে বিপদ আরও বেড়ে যেত। এই গুহায় থাকলে অনেকটা নিরাপদে থাকা যাবে। অর্জুন কথা শেষ করতে না করতেই পৃথিবীটা অন্ধকারে ঢেকে গেল। প্রচণ্ড শব্দে ঝড় আছড়ে পড়ল পাহাড়টার ওপর। সেই সঙ্গে শুরু হল তুষারবৃষ্টি। একটু আগের চাঁদ যেভাবে আলো ছড়াচ্ছিল তা দেখে এই ঝড়ের আন্দাজ করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। উত্তম শেরিং-এর অভিজ্ঞতা কাজে লাগল।

ঝড় বইছে। বাইরে কী হচ্ছে তার কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ওরা তিনজন গুহার একেবারে ভেতরে দাঁড়িয়েছিল। উত্তম শেরিং টর্চ জ্বেলে একটা উঁচু ঢিপি দেখতে পেয়ে বলল, স্যার, আপনি ওখানে বসতে পারেন।

ঠিক আছে। কিন্তু ওই ঝড় কতক্ষণ থাকবে?

আন্দাজ করা মুশকিল।

এবার শ্যাম কথা বলল, আজ রাত্রে আমাদের বোধহয় এখানেই থাকতে হবে।

অন্ধকারে অর্জুন লোকটির মুখ দেখতে পাচ্ছিল না।

অর্জুন বলল, আচ্ছা শ্যামভাই, তুমি সিটির আওয়াজ শুনে বুঝতে পেরেছিলে ওটা তোমার দাদা দিচ্ছে?!

হ্যাঁ স্যার। ছেলেবেলায় আমরা এই সিটির খেলা খেলতাম।

তুমি অবাক হওনি?!

হ্যাঁ স্যার। কিন্তু মনে হয়েছিল খুব ইমার্জেন্সির জন্যে দাদা ওটা বাজাচ্ছে। দু’বার বাজানো মানে কাছে ডাকছে, তাই আর দেরি করিনি। দাদার জন্যে আমার প্রাণ বেঁচে গেল। না হলে হয়তো তাঁবুর তলায় পড়ে থাকতাম। শ্যাম বলল।

এই গুহায় দুটো সুটকেস দেখছি। সুটকেস নিয়ে কেউ পাহাড়ে আসে না।

ওঁরা মালিক। সুটকেস ক্যারি করেছে পোর্টাররা। ওঁদের কোনও কষ্ট হয়নি।

ওরা ক’জন ছিল?

দু’জন। মনে হয় ওরা কাকা-ভাইঝি।

ভাইঝি? মানে, একজন মহিলা?

হ্যাঁ স্যার। কিন্তু ছেলেদের পোশাক পরে থাকত। মাথায় টুপি থাকায় বোঝা যেত না মেয়ে বলে। শ্যাম বলল।

ওরা যে কাকা-ভাইঝি তা তুমি বুঝলে কী করে?

আমি শুনেছি। মহিলা অন্য মালিককে চাচা বলে ডাকছিল।

অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, কাজের ব্যাপারে কে তোমার সঙ্গে বেশি কথা বলত?

দু’জনেই কথা বলত। ওরা সেই রাস্তাটা খোঁজার কথা বলেছিল যেটা দিয়ে বহু বছর আগে একজন ভয়ংকর বাদশা লাসায় গিয়েছিল। আমি সেই রাস্তার কথা জানি না। কিন্তু রোজগার হবে বলে কাজটা নিয়েছিলাম। ওরকম একজন বাদশার কথা আমিও শুনেছিলাম। ওই পাহাড়ের কোনও কোনও গ্রামের বুড়ো বলে সে তার বাপঠাকুরদার কাছে সেই ভয়ংকর বাদশার কথা শুনেছে। লোকটা সৈন্য নিয়ে এদিকে এসে অনেক মানুষ মেরেছিল। মনেষ্ট্রি ভেঙে দিয়েছিল। সেই পাপে তার সব সৈন্য মারা যায়। কিন্তু সেই বাদশা কোন রাস্তায় এসেছিল তা কেউ জানে না। শ্যাম বলল।

অর্জুন একটু ভাবল। বাইরে ঝড় চলছে সমানে। সঙ্গে তুষারপাত। সে জিজ্ঞাসা করল, এত জায়গা থাকতে তোমরা এখানে ক্যাম্প করলে কেন?

আমরা যখন ছাঙ্গু লেকে ছিলাম তখন মেমসাহেব ফোনে কথা বলে আমাকে জিজ্ঞাসা করেন কোথায় গেলে তিন বরফের চুড়ো তিনপাশে দেখতে পাওয়া যাবে? আমি জবাব দিতেই বললেন, আমরা ওখানে ক্যাম্প করে রাস্তায় সন্ধান করব।

ওরা তো আগেই এখানে এসেছিল, রাস্তার সন্ধান করেছে?

না। রাস্তা খোঁজেনি। এখানে কত গুহা আছে তার লিস্ট বানাতে এসেছিল। আমার লোক চারটে গুহার খবর এনে দেয়। কিন্তু সেই গুহাগুলো দেখে ওরা খুশি হয়নি। কাল সকাল থেকে আবার খোঁজার অর্ডার দিয়েছিল। শ্যাম বলল, স্যার, আমার মনে হয়েছে ওরা রাস্তা খুঁজতে আসেনি। রাস্তা তো পায়ে পায়ে বদলে যায়। যে রাস্তায় সেই বাদশা গিয়েছিল তা কোন বরফের নীচে পড়ে আছে তা কেউ জানে না। সেই রাস্তা কেউ খুঁজতে আসে এতদিন পরে?

হঠাৎ একটা প্রচণ্ড শব্দ হল। সঙ্গে এমন একটা ঝাঁকুনি যে গুহার ভেতরে পঁড়িয়ে ওদের মনে হল ভূমিকম্প হচ্ছে। বাইরে যেন জলস্রোতের মতো কিছু বয়ে চলেছে। তার কিছু অংশ ছিটকে ভেতরে ঢোকায় বোঝা যাচ্ছিল ওটা তুষারের স্রোত। কয়েক সেকেন্ড পরে পায়ের নীচের মাটি শান্ত হল।

একটু একটু করে অন্ধকার পাতলা হয়ে এল। কিন্তু গুহার মুখের ওপরের দিকটায় আলো অস্পষ্ট দেখা গেলেও নীচের দিকটার কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। উত্তম শেরিং গুহার মুখের কাছে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ওঃ, ভগবান! অল্পের জন্যে বেঁচে গেছি।

অর্জুন দ্রুত তার কাছে গেলে উত্তম বলল, তুষারের স্রোত এসে গুহার মুখ প্রায় ঢেকে ফেলেছিল স্যার। আর একটু জোর থাকলে পুরো মুখটাই ঢাকা পড়ে যেত। তখন শ্বাসকষ্ট হয়ে মরতাম আমরা।

অর্জুন বলল, তুষার বরফ হয়ে যাওয়ার আগেই রাস্তা তৈরি করো বাইরে বের হবার। আমাদের কাছে বরফ কাটার যন্ত্রপাতি নেই।

তিনজনে হাত লাগালে কিছুক্ষণের মধ্যে তুষারের কিছু অংশ সরাতে পারল। তারপর বাইরে যাওয়ার পথটা তৈরি হল।

মিনিট দশেকের মধ্যে প্রকৃতির চেহারা বদলে গেল। মেঘ সরে যাচ্ছিল দ্রুত। ক্রমশ আকাশ নিকিয়ে জ্যোৎস্না ছড়াল পাহাড়ে। চাঁদ উঠল।

অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, উত্তমভাই, চঁদ উঠেছে, আবার কি ঝড় আসতে পারে?

বোধহয় না। তবে প্রকৃতির খেয়ালের কথা কে বলতে পারে।

আমরা এখন আমাদের ক্যাম্পে ফিরে যেতে পারি।

চলুন স্যার।

ওরা গুহা থেকে বাইরে বেরিয়ে অদ্ভুত দৃশ্যটা দেখল। চারধার তুষারে এমনভাবে ঢাকা পড়ে গেছে যে কিছুই চেনা যাচ্ছে না। এমনকী যে ভাঙা তাঁবুগুলোকে গুহায় ঢোকার আগে দেখা গিয়েছিল সেগুলোও তুষারের আড়ালে চলে গিয়েছে। উত্তম শেরিং বলল, সাবধানে পা ফেলবেন স্যার। আগে আমি যাচ্ছি, পেছনে আপনারা আসুন। নইলে তুষারের ফাঁদে পড়তে হবে।

লম্বা লাঠি দিয়ে তুষার মেপে মেপে পায়ে পায়ে হাঁটছিল উত্তম শেরিং। তাকে অনুসরণ করছিল অজুর্ন এবং শ্যাম। কিছুটা উঠতেই শ্যাম চিৎকার করে উঠল, আরেব্বা। পাহাড়টা নিচু হয়ে গেল নাকি?

ওরা তাকাল। তিন বরফের চুড়োর একটাকে কিছুটা নিচু দেখাচ্ছে। চূড়োর নীচে পাহাড়ের গা থেকে বরফ অনেকটা খসে গেছে যদিও সেখানে তুষার জমতে শুরু করেছে। ওরা ধীরে ধীরে ওপরে উঠে আসতেই উত্তম শেরিং বিশ্রামের জন্যে একটু দাঁড়াতে বলল। হিম বাতাস বইছে। এইসব কাণ্ডের পর ঠান্ডাটা সয়ে গিয়েছে অর্জুনের। চাঁদের হাসি দেখে আকাশ আহ্লাদিত। হঠাৎ চোখে পড়ল যে পাহাড়ের চূড়ো খানিকটা নিচু লাগছে তার নীচের দিকে একটা গর্ত তৈরি হয়েছে। এই গর্তটা এখানে আসার পরে দেখতে পায়নি অর্জুন। সে উত্তম শেরিংকে বলল, আচ্ছা, ওই গর্তটা কি আগে ওখানে ছিল?

প্রশ্ন শুনে উত্তম শেরিং উলটোদিকের পাহাড়ের গায়ের গর্তটাকে দেখল। তারপর তার মাতৃভাষায় শ্যাম শেরিংকে জিজ্ঞাসা করল। শ্যাম মাথা নাড়ল।

উত্তম বলল, না স্যার। আজ যখন ধ্বস নেমেছিল তখন হয়তো বরফ সরে গিয়ে গর্তের মুখ বেরিয়ে এসেছে। অথবা আজ যে ভূমিকম্পের মতো পাহাড় কেঁপেছিল সেসময় ওখান থেকে একটা বড় চাঙড় খসে পড়তে পারে।

অর্জুন ভাল করে দেখল। গর্তটা পাহাড়ের এমন জায়গায় যে হেঁটে ওখানে পৌঁছোনো যাবে না। পথ দুরের কথা, পাহাড়ের খাঁজে পা রেখেও ওখানে যাওয়া সম্ভব নয়। একমাত্র পর্বতারোহীরাই তাদের সরঞ্জামের সাহায্যে ওখানে পৌঁছাতে পারে। কিন্তু গর্তটা অর্জুনকে টানছিল। আচমকা ভূমিকম্পের কারণে গর্তের যে মুখটা বেরিয়ে পড়েছে তা তো কোনও গুহার মুখও হতে পারে।

ওরা যখন ক্যাম্পে ফিরে এল তখন রাত গম্ভীর হয়ে গিয়েছে। এতটা সময় বরফের ওপর থাকায় অর্জুন বেশ কাহিল হয়ে পড়েছিল। ঠান্ডা হয়ে যাওয়া রুটি আর তরকারি খেয়ে সে তাঁবুর ভেতরে ঝোলানো হ্যামকের ওপর রাখা স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে পড়ল। জনাব কামরুজ্জমান জেগে ছিলেন। ওরা কী দেখল তা জানার জন্যে কৌতূহলী হয়ে অপেক্ষা করছিলেন। উত্তম শেরিং তাকে যা যা ঘটেছে তার বর্ণনা দিলে তিনি খুব উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ওদের কেউ আহত হয়নি তো? সবাই বেঁচে আছে তো?

উত্তম শেরিং বলল, দু-একজন আহত হলেও হতে পারে। তবে সবাইকে আর্মি ওদের ক্যাম্পে নিয়ে গিয়েছে। ওখানে তো ডাক্তার আছে, কোনও চিন্তা নেই।

উত্তম শেরিংতার ভাইকে নিয়ে অন্যতঁবুতে চলে গেলে জনাব কামরুজ্জমান খিলজি অর্জুনকে জিজ্ঞাসা করলেন, ওরা যে গুহায় ছিল সেখানে গিয়ে আপনার কী মনে হল? গুহার ভেতর আর কী কী দেখলেন? ভদ্রলোক অর্জুনের সাড়া পেলেন না। কাছে গিয়ে বুঝলেন গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছে অর্জুন। ধীরে ধীরে তাবুর দরজা ফাঁক করে বাইরে মুখ বাড়ালেন তিনি। আবার আকাশ কালো হয়ে আসছে। এইসময় কোথাও যেতে চাওয়া মানে মৃত্যুকে ডেকে আনা। জনাব কামরুজ্জমান খিলজি আবার তাবুর ভেতর চলে এলেন।

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার