আধঘণ্টা পরে ফোন বাজতেই অর্জুন রিসিভার তুলল।

কী হে! খাওয়াদাওয়া হয়েছে? অমিতাভর গলা।

আপনারা ক্লাবে যা খাইয়ে দিয়েছেন, তারপর আর গলা দিয়ে নামবে না।

সে কী! জলখাবারে রাতের খাবারের প্রয়োজন মিটে গেল। ও হ্যাঁ, আমার মাথা থেকে চিন্তাটা কিছুতেই যাচ্ছে না।

কীসের চিন্তা?

ওই ডক্টর নীলমোহন বকসি!

শুয়ে পড়ুন। কাল কথা হবে, হেসে ফোন রেখে দিল অর্জুন। ঘুম ঘুম লাগতেই বিছানায় শুয়ে আলো নিভিয়ে দিল। ঘুমোনোর আগে সারাদিনের ঘটনাগুলো নিয়ে চিন্তা করা ইদানীং তার অভ্যেস হয়েছে। তাতে ঘুম তাড়াতাড়ি আসে। আজ এখানে এসে অমিতাভর সঙ্গে আলাপটা প্রাপ্তি বলা চলে। মানুষটার মধ্যে কোথাও জটিলতা নেই। চন্দ্রশেখর গাঙ্গুলিমশাই একটু আলাদা ধরনের। গায়ে পড়ে মেশেন না, ভদ্রতার সীমা বজায় রাখেন। যদিও ডাইনিং রুমে বৃদ্ধ নিজেই তার সঙ্গে আলাপ করেছেন, কিন্তু, অমিতাভর মতো ঘনিষ্ঠ হওয়ার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেননি। এই বয়সেও উনি অতুলপ্রসাদের গান চমৎকার গাইতে পারেন।

ফোনটা বেজে উঠল।

অর্জুনের ঘুম আসছিল। উঠতে ইচ্ছে না করলেও শেষ পর্যন্ত উঠতে হল। রিসিভার তুলে বলল, হ্যালো!

আমি পিনাকীরঞ্জন মিত্র।

ও!

ভদ্রলোকের মোবাইল নম্বর ৯৪১৫৪০২৮১১।

আবার বলুন, লিখে নিচ্ছি! অর্জুন বলল।

কাগজ টেনে নিয়ে কলম খুলল সে। পিনাকীরঞ্জন নম্বরটা দ্বিতীয়বার বলতে লিখে নিল। জিজ্ঞেস করল, ভদ্রলোকের নাম কী?

ডক্টর নীলমোহন বকসি। তা হলে রাখছি! লাইন কেটে দিলেন পিনাকীরঞ্জন।

স্তম্ভিত অর্জুন। এক লহমায় তার চোখ থেকে সব ঘুম উধাও।

.

সকাল সাতটা নাগাদ গেস্ট হাউস থেকে বেরিয়ে ঠিক পাঁচটা বাড়ি পার হতেই একটা হাউসিং কমপ্লেক্সের গেট দেখতে পেল অর্জুন। পাশেই গেটকিপারের ঘর। অমিতাভর নাম বলতেই সে কীভাবে ফ্ল্যাটে যেতে হবে বলে একটা খাতায় নাম-ঠিকানা লিখে ফোন করল। বিদেশি শুনে বলল, যাইয়ে।

অমিতাভ নীচে নেমে এসেছিলেন। লিফটে চেপে উপরে উঠে নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়ে অমিতাভ ওঁর স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। ভদ্রমহিলার নাম এণাক্ষী। বললেন, কাল আপনার সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর মনে হচ্ছে কাজকর্ম ছেড়ে ও বোধহয় গোয়েন্দাগিরি করতে পারলে খুশি হয়।

নো! গোয়েন্দাগিরি চলবে না। দিস ইজ সত্যসন্ধান।

বাব্বা! এণাক্ষী অর্জুনকে বসতে বলে চা নিয়ে আসতে গেলেন।

তুমি যে ভাই এরকম সারপ্রাইজ দেবে কল্পনাও করিনি। বাড়ি চিনতে কোনও অসুবিধে হয়নি নিশ্চয়ই। অমিতাভ হাসিমুখে বললেন।

না, আজ ডক্টর বকসির সঙ্গে দেখা করতে যাব! অর্জুন বলল।

উনি তো নেই।

ফিরে এসেছেন কাল রাতে।

অ্যাঁ! তুমি জানলে কী করে?

জেনেছি। ওঁর ফোন নম্বরও পেয়েছি।

সে কী! কাল সারা বিকেল-সন্ধে, মায় রাত দশটা পর্যন্ত আমরা একসঙ্গে ছিলাম। তোমাদের গেস্ট হাউসে নামিয়ে আমি বাড়ি ফিরেছি। এখন সবে সকাল। এর মধ্যে তুমি কী করে এত খবর পেলে? অমিতাভর গলায় অবিশ্বাস।

অর্জুন হাসল, জবাব দিল না।

অমিতাভ বললেন, আমার দ্বারা সত্যসন্ধান করা হবে না। কখন যাবে?

একটা ফোন করব। ডক্টর বকসি যখন যেতে বলেন…

নম্বর আছে?

হ্যাঁ। কিন্তু ল্যান্ড লাইন থেকে করব।

অমিতাভ উঠে টেলিফোনের সেটটা এনে সামনে রাখলে অর্জুন পকেট থেকে কাগজটা বের করে নম্বর দেখে বোতাম টিপল। ওপাশে রিং হচ্ছে। তারপর মিহি গলায় কিন্তু পরিষ্কার উচ্চারণে একজন ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন, কে টেলিফোন করছেন?

আমি ডেলি নিউজের একজন রিপোর্টার। আমার নাম অর্জুন। আপনি কি অনুগ্রহ করে আমাকে মিনিট পনেরো সময় দেবেন?

কেন?

আমার সম্পাদক চাইছেন আপনার গবেষণার বিষয় নিয়ে কাগজে ভালভাবে একটা রাইট আপ তৈরি করতে। অর্জুন ইংরেজিতে জবাব দিচ্ছিল।

ডক্টর বকসি বললেন, সরি। আমি কোনও রিপোর্টারের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলব না। কিছুদিন পর যখন প্রেস কনফারেন্স করব, তখনই কথা বলবেন। ফোন রেখে দিলেন ডক্টর বকসি।

ভদ্রলোকের বক্তব্য অমিতাভকে জানাল অর্জুন। অমিতাভ গম্ভীর হলেন, খুব শক্ত লোক বলে মনে হচ্ছে। যাক গে, গেলে যদি তোমার আইডেন্টিটি প্রুফ চাইত, তা হলে বিপদে পড়তে। তুমি ডেলি নিউজের রিপোর্টার নও এটা বুঝে যেত।

না। ডেলি নিউজ এই ব্যাপারে একটা চিঠি আমাকে দিয়েছে।

অ! তার চেয়ে এক কাজ করি। সোজা গিয়ে দরজা ধাক্কাই। তুমি তো বলছ কাল রাতে ফিরে এসেছেন, তা হলে নিশ্চয়ই বাড়িতে পাওয়া যাবে। একবার মুখোমুখি হতে পারলে যা জানার তা জেনে নিতে পারবে। অমিতাভ পরামর্শ দিলেন।

ঘরে ঢুকে এণাক্ষী বললেন, আসুন।

অমিতাভ বললেন, এখানেই চা দাও না।

উনি প্রথমবার এলেন, শুধু চা দিই কী করে। আসুন।

অতএব যেতে হল। টেবিলে রাজ্যের খাবার। এণাক্ষী জোর করছিলেন সব খাওয়ার জন্য। অর্জুন হাতজোড় করল, বিশ্বাস করুন, সকালবেলায় এত খাওয়া আমার অভ্যেস নেই। ঠিক আছে, কিছু নিচ্ছি।

এণাক্ষী আর চাপ দিলেন না। ওঁর মুখ গম্ভীর দেখে হেসে ফেলল অর্জুন, নাঃ, প্রবাসে থেকেও আপনি ষোলো আনা বাঙালি হয়ে আছেন।

মানে? ভ্রূ কোঁচকালেন এণাক্ষী।

যে-কোনও বাঙালি মা-দিদি-বউদি খাওয়াতে ভালবাসেন। আপনিও তাই।

এবার হেসে ফেললেন এণাক্ষী।

খাওয়া শেষ হলে অমিতাভ জিজ্ঞেস করলেন, ডক্টর বকসির ব্যাপারটা বেশ জটিল হয়ে যাচ্ছে। কী করবে?

দেখি। ভাবি।

ভাবো। ভেবে একটা কিছু বের করে আমাকে ফোন করলেই আমি হাজির হব। লোকটাকে দেখতে আমারও ইচ্ছে করছে।

সে কী! আপনার অফিস…

ছুটি নিয়ে নেব। প্রচুর ছুটি জমা আছে।

.

ঘরে ফিরে মাথায় আসা ভাবনাগুলোকে একের পর এক বাতিল করে দিল অর্জুন। ওই বাড়িতে ডক্টর বকসিকে এড়িয়ে ঢোকা যাবে না। সোজা গিয়ে বেল বাজালে উনি নিজে না দরজা খুলে ওঁর সেই দাড়িওয়ালা কাজের লোককে পাঠাতে পারেন। লোকটার যা বর্ণনা স্যাংচুয়ারির লোকটি দিয়েছে, তাতে ওকে হটিয়ে ভিতরে ঢোকা তার পক্ষে সম্ভব নয়।

দরজায় শব্দ হল। অর্জুন দরজা খুলতে সেই বেয়ারাটি বলল, স্যার, ব্রেকফাস্ট টাইম শেষ হতে যাচ্ছে। গাঙ্গুলিসাহেব আপনার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন।

কোথায় তিনি?

ওঁর ঘরে। ব্রেকফাস্ট খেয়ে এইমাত্র ঘরে গেলেন।

অর্জুন ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

দরজায় টোকা দিতেই মিস্টার গাঙ্গুলির গলা ভেসে এল, আইয়ে জি।

অর্জুন ভিতরে ঢুকে দেখল তিনি দাবার বোর্ডের সামনে বসে আছেন।

বাঃ। মেঘ না চাইতেই জল। ব্রেকফাস্ট হয়েছে? মিস্টার গাঙ্গুলি হাসলেন।

আজ খেললে আপনাকে হারাতে পারব না।

কেন?

অন্য চিন্তা মাথায়।

কীরকম? বলেই মিস্টার গাঙ্গুলি কাঁধ নাচালেন, ব্যক্তিগত হলে শুনতে চাই না।

ব্যাপারটা ডক্টর নীলমোহন বকসি সংক্রান্ত।

ও। কাল তো তোমরা ওঁর দেখা পাওনি। হয়তো বাইরে গিয়েছেন। দেখা করাটা খুব জরুরি হলে ওঁর না ফেরা পর্যন্ত তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। সিম্পল ব্যাপার।

মিস্টার গাঙ্গুলি বোর্ডের চাল দিলেন। বোড়ে কিস্তি দিল ঘোড়াকে। আড়াআড়ি। গজ দিয়ে বোড়েটাকে তুলে নিলে সেটা আর-একটা বোড়ের শিকার হবে।

ব্যাপারটা আর সিম্পল নয়। আজ টেলিফোনে আমি ওঁর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। আপনার সূত্রে পরিচিত হয়ে অক্ষয় গুপ্তা ওঁর সম্পর্কে কাগজ লিখতে বলেছিলেন। আমি অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাইলে উনি এককথায় তা নাকচ করে দিয়েছেন। অর্জুন চেয়ারে বসল।

ওঁর ফোন নম্বর কী করে পেলে? কোথায় আছেন এখন?

কাল রাতে উনি ফিরেছেন, অর্জুন পিনাকীরঞ্জন মিত্রের ঘটনাটা বিশদে বলল। মিস্টার গাঙ্গুলির চোখ বড় হল, তাজ্জব মানুষ!

তারপর চেয়ারের পিছনে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলেন। মিনিটদুয়েক ওইভাবে বসে থাকলেন ভদ্রলোক। অর্জুন দাবার বোর্ডের দিকে তাকাল। আক্রান্ত ঘোড়ায় যাওয়ার সব ঘরে বোড়ে থাকায় ওকে বাঁচাতে গজকে বিসর্জন দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু সেটা হলে ঘোড়া তুলে প্রতিপক্ষের রাজাকে কিস্তি দেওয়া যেতে পারে। রাজা সরলেই দ্বিতীয়বারের কিস্তিতে রাজার সঙ্গে প্রতিপক্ষের গজকে পাওয়া যাবে। তা হলে দু’পক্ষের বল সমান সমান।

অর্জুন ঝুঁকে গজ তুলে বোড়েকে খেয়ে নিল। চোখ খুললেন মিস্টার গাঙ্গুলি, গজটা তো এবার যাবে।

যাক।

মিস্টার গাঙ্গুলি বোড়ে দিয়ে গজ তুলে নিতেই অর্জুন ঘোড়া এগিয়ে রাজাকে কিস্তি দিল। মিস্টার গাঙ্গুলি এক ঘর সরতেই দ্বিতীয় কিস্তি। বিপদ বুঝতে পারলেন মিস্টার গাঙ্গুলি, বাঃ! ভাল খেলেছ। বল সমান করে ফেললে। কিন্তু এই পিনাকীরঞ্জন কি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ?

ওঁর সুটকেস বয়ে নিয়ে এসেছি, বাড়িতে খবর দিয়েছি। হয়তো…

কোনও কোনও মানুষ কৃতজ্ঞতা ব্যাপারটা বোঝে না।

এঁর ক্ষেত্রে সেটা বোধহয় না। মুখে অনেকবার বলেছেন।

হুঁ! মিস্টার গাঙ্গুলি আবার চোখ বন্ধ করলেন।

একটা ব্যাপার আমাকে ধন্দে ফেলেছে, অর্জুন বলল। কিন্তু মিস্টার গাঙ্গুলি চোখ খুললেন না, মুখে কিছু বললেনও না।

ডক্টর বকসির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে ওঁকে যা মনে হল, তার সঙ্গে অচেনা, অজানা পিনাকীরঞ্জন মিত্রকে নিজের ভিজিটিং কার্ড দেওয়াটা কিছুতেই মিলছে না। অথচ, তিনি সেটা দিয়েছেন এবং সেটা দেখে ভদ্রলোক আমাকে নম্বর বলেছেন। কেন আগবাড়িয়ে নেমকার্ড দিলেন ডক্টর বকসি? অর্জুন বলে যাচ্ছিল।

চোখ খুললেন মিস্টার গাঙ্গুলি, মানুষ একটি বিচিত্র প্রাণী! সে কখন কী আচরণ করবে, তা সে নিজেই জানে না। কিন্তু হঠাৎ মনে হচ্ছে, তোমার সামনে একটা ভাল রাস্তা খোলা আছে।

তার মানে?

সোজা হয়ে বসলেন বৃদ্ধ, আচ্ছা বলো, দাবার বোর্ডে বোড়ের ভূমিকা কতটুকু?

মন্ত্রী, গজ, ঘোড়া বা নৌকোর তুলনায় কিছুই না। শুধু রাজাকে দুর্গের ভিতর রাখার জন্য বোড়েদের দরকার হয়, অর্জুন বলল।

নো। বোড়ে হল পদাতিক সেনাবাহিনী। তুমি শত্রুপক্ষকে আকাশ থেকে বোমা ফেলে অথবা জাহাজ থেকে গোলাবর্ষণ করে ধ্বংস করতে পারো, কিন্তু সেই শত্রুর দেশ দখল করতে তোমাকে পদাতিক বাহিনীকে পাঠাতে হবে। বোড়ে সেই পদাতিক সেনা। এক্ষেত্রে তুমি অন্তত একজন পদাতিক সেনা বা বোড়ে পেয়ে গিয়েছ অর্জুন। হাসলেন মিস্টার গাঙ্গুলি।

ঠিক পরিষ্কার হল না।

না হওয়ার কোনও কারণ নেই। এই পিনাকীরঞ্জন মিত্রই হল সেই বোড়ে।

তাই তো! উত্তেজনায় সোজা হয়ে বসল অর্জুন।

পিনাকীরঞ্জন মিত্রকে নিজের কার্ড দিয়ে ডক্টর বকসি বলেছেন ত্রিফলার রস খেয়ে কেমন আছে তা জানাতে। ত্রিফলা যে ভাল কাজ করে, তা সবাই জানে। সেটা জানার জন্য ডক্টর বকসির আগ্রহ অবশ্যই অস্বাভাবিক।

ঠিক কথা। অর্জুন মাথা নাড়ল।

এর পিছনে ডক্টর বকসির অন্য মতলব কাজ করতে পারে।

কী মতলব?

কী আশ্চর্য! আমি কি অন্তর্যামী যে, মতলবটা বুঝে ফেলব! কিন্তু উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই আছে। তোমাকে তার সুযোগ নিতে হবে।

কীভাবে?

পিনাকীরঞ্জনকে ডেকে তাকে কনভিন্স করো। তোমার জন্য তাকে অভিনয় করতে রাজি করাও। যদি কৃতজ্ঞতাবোধ থাকে ওঁর, তুমি এগোতে পারবে।

বেশ। আমার অনুরোধে না হয় রাজি হলেন ভদ্রলোক। কিন্তু…

ডক্টর বকসি ওঁকে ফোন করতে বলেছেন। উনি করবেন। করে জানাবেন ত্রিফলা খেয়েও ওঁর কোষ্ঠকাঠিন্য কমেনি। অ্যালোপ্যাথি ওষুধ ওঁর সাময়িক উপকার করে। তাই ডক্টর বকসির কাছে জানতে চাইবেন, কোনও আয়ুর্বেদিক ওষুধ আছে কি না, যাতে উনি সম্পূর্ণ সুস্থ হতে পারবেন। দ্যাখো না, জবাবে ডক্টর বকসি কী বলেন। হয়তো তার কাছে যেতেও বলতে পারেন। সেটা বললে তুমি ওঁর ভাগনে হয়ে সঙ্গ নিয়ো। মিস্টার গাঙ্গুলি মাথা নাড়লেন।

যদি ওঁকে ঢুকতে দেন কিন্তু আমাকে অ্যালাউ না করেন?

বলবেন ওঁর শরীর খুব দুর্বল। তাই এসকর্ট নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন।

বেশ। ভদ্রলোকের বাড়িতে টেলিফোন নেই। আমাকেই ওঁর কাছে যেতে হবে।

এসব কথা ওঁর পরিবারের লোকের সামনে বোলো না। অমিতাভকে ফোন করে বলো ওঁকে খবর দিতে। উনি এখানে এলে আলোচনা করবে। আশা করি, কী হল আমাকে তা ফোনে জানাবে। উঠে দাঁড়ালেন মিস্টার গাঙ্গুলি।

সে কী! আপনি কি চলে যাচ্ছেন?

হ্যাঁ। এখানকার কাজ হয়ে গিয়েছে। মেয়ে সুস্থ হচ্ছে, এবার ঘরে ফিরি।

ইলাহাবাদে আপনার সঙ্গে কে কে আছেন?

ঈশ্বর! হাসলেন মিস্টার গাঙ্গুলি, এমন কপাল, আমার কাজের লোকটিকে তার বাবা ওই নাম রেখেছিল। ডাকাডাকি করলে আমারও পুণ্য অর্জন করা হয়।

মিস্টার গাঙ্গুলি একটা কাগজে নাম-ঠিকানা-টেলিফোন নম্বর লিখে এগিয়ে ধরলেন, তোমার সাফল্য কামনা করি। গুড লাক!

আপনি কি আজই চলে যাচ্ছেন?

হ্যাঁ। দুপুরেই। কাগজটা অর্জুনের হাতে দিয়ে দিলেন মিস্টার গাঙ্গুলি।

.

ট্যাক্সি নয়, একটা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করল অর্জন। মাত্র একশো টাকায় লখনউয়ের দ্রষ্টব্য স্থানগুলো ঘুরিয়ে দেখাবে। সবিনয়ে চালক বলল, শুধু ভুলভুলাইয়ায় আপনি আধঘণ্টা থাকতে পারেন। বাকিগুলো বাইরে থেকে দেখলেই চলবে।

ঘোড়ার গাড়িতে ওঠার পর অর্জুনের বেশ ভাল লাগছিল। টগবগ শব্দ তুলে ঘোড়া ছুটছে। তার সঙ্গে অবিরাম কথা বলে চলেছে চালক। মাঝে মাঝে সে কথা থামিয়ে পিছন ফিরে অর্জুনকে জানিয়ে দিচ্ছে পাশের ইমারতটির ঐতিহাসিক নাম কী। বেশ ভাল লাগছিল অর্জুনের। মোগল সাম্রাজ্যের শেষ বাদশা এই শহরেই ছিলেন, এই শহর ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল তাঁকে।

একটা বড় গেটের সামনে ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়াল। চালক বলল, চলে যান সাহেব। তবে আধঘণ্টার বেশি থাকবেন না।

এটাই ভুলভুলাইয়া?

জি।

গেট পেরিয়ে বাগানের মধ্যে দিয়ে বিরাট বাড়িটায় ঢুকতে টিকিট কাটতে হল অর্জুনকে। একতলায় নবাবের সমাধি ছাড়া আর যা স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে তাতে আকর্ষণ বোধ করল না সে। বেরিয়ে এসে বাড়িটার একপাশে সিঁড়িটা দেখতে পেয়ে উপরে উঠতে লাগল। তার সামনে কয়েকজন টুরিস্ট উপরে উঠছে। তারা একজন গাইড সঙ্গে নিয়েছে। গাইড তাদের সতর্ক করছিল, কেউ যেন দলছাড়া না হয়। হলে তার পক্ষে বাইরে বেরিয়ে আসা মুশকিল হবে। এক ভদ্রলোক নাকি সাতদিন এখানে আটকে ছিলেন। একটা ছোট কপাটবিহীন দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই আলো কমে গেল। এ দরজা দিয়ে ঢুকে ওই দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেখানে পৌঁছোল, সেখানে আলো নেই। গাইড বলে যাচ্ছিল, নবাবকে হত্যা করতে যদি কোনও গুপ্তঘাতক এখানে ঢুকত, সে বিভ্রান্ত হয়ে যেত। কিছুতেই নবাবের কাছে তার পক্ষে পৌঁছোনো সম্ভব ছিল না। দেওয়ালগুলো খুব মোটা। তার গায়ে কান চেপে ধরতে মনে হল ওপাশে কেউ যেন চিৎকার করছে। মন দিয়ে আওয়াজটা শোনার চেষ্টা করতে আধমিনিট চলে গিয়েছিল। খেয়াল হতে সে দেখল, গাইড টুরিস্টদের দলটাকে নিয়ে চলে গিয়েছে। এঘর থেকে বেরোবার দরজা তিনটে, প্রায় পনেরো মিনিট পাক খেল অর্জুন। মনে ঈষৎ ভয় ঢুকল। যদি এই ভুলভুলাইয়া থেকে সে বের হতে না পারে? অর্জুন ঠিক করল সে বাঁ দিক দিয়ে হাঁটবে। একটা দিকে স্থির থাকলে নিশ্চয়ই সূর্যের আলো দেখতে পাবে।

অনেক অন্ধকার সুড়ঙ্গ পার হয়ে এল অর্জুন। আসার পথে দু’দিকে বেশ কিছু দরজা পাওয়া সত্ত্বেও সে পা বাড়াল । তারপর হঠাৎ গাঢ় ছায়া পাতলা হয়ে গেল। সে একটা বারান্দায় এসে দাঁড়াল। বারান্দাটা চারপাশ দিয়ে গিয়েছে, মাঝখানে কোনও ঘর না থাকায় সেখানে একতলার মেঝে দেখা যাচ্ছে। অর্জুন দাঁড়িয়ে আছে তিনতলার বারান্দায়। এই সময় গাইড টুরিস্টদের নিয়ে উলটো দিকের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। অন্তত পঞ্চাশ গজ পার্থক্যে ওরা দাঁড়িয়ে আছে। গাইড অর্জুনকে দেখে চিৎকার করল, ভাইসাব, আমি একটা দেশলাই জ্বালাচ্ছি। দেখুন তো আপনি দেশলাইকাঠি জ্বালার শব্দ শুনতে পাচ্ছেন কিনা?

লোকটাকে দেশলাইকাঠি বাক্সে ঘষতে দেখল অর্জুন। এবং কী আশ্চর্য! সে বারুদ জ্বলার শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেল। এত দূরে ওই শব্দ আসার কোনও কথাই নয়। গাইড বলল, ওখানে একটা কাগজ পড়ে আছে ভাইসাব, ওটাকে দয়া করে ছিঁড়বেন?

অর্জুন বারান্দায় পড়ে থাকা একটা খবরের কাগজের পাতা তুলে ছিঁড়তেই টুরিস্টরা হাততালি দিয়ে উঠল। তারা কাগজ ছেঁড়ার শব্দ শুনতে পেয়েছে। সেই কবে, কয়েক শতাব্দী আগেকার আর্কিটেক্টরা যে আবিষ্কার করেছিলেন, তা সম্ভবত এখনও ব্যবহার করা যায়নি। নবাবের নিরাপত্তার জন্যই এত সতর্কতা।

.

গেস্ট হাউসে ফিরে এসে বিছানায় শুয়ে অর্জুন ভুলভুলাইয়ার কথা ভাবছিল। এত নিরাপত্তা সত্ত্বেও নবাবরা দীর্ঘজীবী হননি। ভয় যাদের তীব্র, তারা যতই ঘেরাটোপের মধ্যে থাকুক না কেন, একটা ছিদ্র থেকেই যায়, যার মধ্যে দিয়ে বিপদ তাদের কাছে পৌঁছে যায়। ডক্টর বকসিও নিজেকে অনেক আড়ালে রাখার চেষ্টা করেছেন। চেষ্টা করলে তার কাছে নিশ্চয়ই পৌঁছোনো যাবে।

বিকেল সাড়ে পাঁচটায় অমিতাভ এলেন। বললেন, হঠাৎ পিনাকীরঞ্জনকে দরকার পড়ল? ভদ্রলোককে খবরটা দিতে কীরকম ঘাবড়ে গেলেন।

শহর দেখতে যাওয়ার আগে ফোনে অমিতাভকে এই কাজটা করার জন্য অনুরোধ করেছিল অর্জুন। জিজ্ঞেস করল, কীরকম?

বললেন, কাল তো কথা বলে এলাম। এর মধ্যে পুলিশ ওঁর কাছে এসেছে নাকি? ওঁকে আশ্বস্ত করলাম, পুলিশ আসেনি। অর্জুনের কী একটা দরকার, তাই।

যাচ্চলে। আসবেন কিনা কে জানে!

অর্জুনের কথা শেষ হতেই দরজায় শব্দ হল। সে উঠে দরজা খুলতেই দেখল, পিনাকীরঞ্জন সসংকোচে দাঁড়িয়ে আছেন, আমাকে আসতে বলেছেন?

হ্যাঁ, আসুন আসুন। বসুন। ইনি অমিতাভ, নিশ্চয়ই চেনেন।

আজই প্রথম দেখলাম।

সে কী! বেঙ্গলি ক্লাবের এত কাছে থেকেও আপনাদের পরিচয় হয়নি?

আমি, আমি একটু ঘরকুনো, তা ছাড়া অনেক দিন বাইরে আছি।

চা খাবেন?

না, না। আমি চা খাই না।

পিনাকীবাবু, আপনার কাছে আমি একটা সাহায্য চাই!

আমার কাছে? কী যে বলেন! আমার কী ক্ষমতা!

এভাবে বলবেন না। ব্যাপারটা সামান্যই। আপনার সঙ্গে ডক্টর বকসির আলাপ হয়েছে। ওঁর মতো বিখ্যাত আয়ুর্বেদ ভারতে খুব কমই আছেন। কিন্তু চেষ্টা করলেও ওঁর অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া যায় না। আমার এক আত্মীয় আলসারে ভুগছেন। অ্যালোপ্যাথি ওষুধে কোনও কাজ হচ্ছে না। ওঁর অসুখের যাবতীয় তথ্য আমি সঙ্গে এনেছি। কিন্তু আমি তো চেষ্টা করেও ওঁর দেখা পাব না। আপনি যদি একটু সাহায্য করেন। অর্জুন বলল।

আমি? আমি বললে উনি কি শুনবেন? মনে হয়েছিল খুব রাগী লোক। বেশ জড়তা নিয়ে বললেন পিনাকীরঞ্জন।

অমিতাভ এতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন, বললেন, ঠিক কথা। উনি শুনবেনই না।

তা হলে? পিনাকীরঞ্জন যেন স্বস্তি পেলেন।

অর্জুন বলল, একটাই উপায় আছে। আমার মনে হয়, কোনও কারণে আপনাকে ওঁর ভাল লেগে গিয়েছে। নইলে যেচে ওষুধ দিতেন না। আপনি যেতে চাইলে উনি বোধহয় না বলবেন না। অবশ্য যেতে চাওয়ার জন্য একটা ঠিকঠাক কারণ দেখাতে হবে।

আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না মশাই। ওঁর কাছে যাওয়ার কোনও দরকারই নেই যখন, তখন কারণ খুঁজব কেন? পিনাকীরঞ্জন মাথা নাড়লেন।

আপনার নেই মশাই, কিন্তু অর্জুনের তো আছে। আপনি গেলে আপনার সঙ্গে অর্জুন যেতে পারে। অমিতাভ জানালেন।

মাথা নাড়লেন পিনাকীরঞ্জন, না না। ঝুঁকি আছে। উনি অ্যালাউ না-ও করতে পারেন। খুব কড়া ধাতের মানুষ তো!

ঝুঁকি তো নিতেই হয় পিনাকীবাবু। এই যে অর্জুন এতটা পথ আপনার সুটকেস বয়ে নিয়ে এল, তাতে ঝুঁকি ছিল না? পুলিশ যদি সুটকেস খুলতে বলত, অর্জুন পারত না। সুটকেসের চাবি তো আপনার কাছে ছিল। তাই না?

অমিতাভ হাসতে হাসতে কথাগুলো বললেন।

অ! চোখ বন্ধ করলেন ভদ্রলোক।

অর্জুন বলল, আপনি কাল সকালে একটা ফোন করবেন। বলবেন ত্রিফলা খেয়ে আপনার কোনও উপকার হয়নি, উলটে শরীর আরও কষে গিয়েছে।

কী যে বলেন! কাল রাতে গিন্নিকে বলেছিলাম ত্রিফলা ভিজিয়ে রাখতে। সেই জল আজ ভোরে খেয়েছিলাম। দুপুরে চমৎকার পেট পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। একগাল হাসলেন পিনাকীরঞ্জন। তৃপ্তির হাসি।

অর্জুন এক সেকেন্ড ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি ট্রেনে পুলিশকে বলেছিলেন আপনার নাম পিনাকেশ। বলেননি?

হকচকিয়ে গেলেন পিনাকীরঞ্জন, হ্যাঁ, মানে…

আপনি বলেছিলেন যে, আপনার পেশা শিক্ষকতা। বলেননি?

বাধ্য হয়ে বলেছি। বিপদ দেখে।

তার মানে আপনি প্রয়োজন হলে চমৎকার অভিনয় করতে পারেন। আপনাকে অনুরোধ, আপনি আর-একবার অভিনয় করুন। অর্জুন বলল।

সেকেন্ডসাতেক মাথা নিচু করে ভাবলেন পিনাকীরঞ্জন। তারপর বললেন, বেশ। আপনি আমার উপকার করেছেন। এটা করলে যদি ঋণ শোধ হয়ে যায়, তা হলে করব। কিন্তু ভদ্রলোক খুব কঠিন ধাতের। ঠিক কী বলতে হবে। বলে দিন।

অর্জুন বুঝিয়ে দিল কী বলতে হবে টেলিফোনে। পিনাকীরঞ্জন সেটা কয়েকবার আউড়ে উঠে দাঁড়ালেন, আমি কাল সকাল দশটায় ওঁকে ফোন করব। কী বলেন, সেটা তারপর আপনাকে জানিয়ে দেব।

পিনাকীরঞ্জন চলে গেলে অমিতাভ জিজ্ঞেস করলেন, কী মনে হয়, ইনিঃ ফোন করবেন?

কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে সেটা জানার জন্য। আপনি গাড়ি এনেছেন?

হ্যাঁ।

সন্ধেটা কি ফ্রি আছেন?

এণাক্ষী বলছিল সাতটা নাগাদ ক্লাবে যাবে। কেন?

ক্লাব ক’টা পর্যন্ত খোলা থাকে?

দশটা। সমস্যাটা কী বলো না?

ভাবছি একবার নবাবগঞ্জ থেকে ঘুরে এলে কেমন হয়। অর্জুন বলল।

কী লাভ! গেলে তো দেখা পাবে না বলেই মনে হয়।

না না। দেখা করতে যাব না। দেখতে যাব।

অমিতাভ ব্যাপারটা বুঝলেন না কিন্তু ব্যাখ্যাও চাইলেন না। পকেট থেকে মোবাইল বের করে স্ত্রীকে বললেন, তুমি ছোটুকে ফোন করে বলো ক্লাবে নিয়ে যেতে। আমি ওখানে একটু দেরিতে পৌঁছোব। হ্যাঁ, হ্যাঁ, অর্জুনের সঙ্গে বেরোচ্ছি।

.

আজ নবাবগঞ্জ পৌঁছোতে যেন অনেক কম সময় লাগল। সন্ধে নেমে গিয়েছিল। বার্ড স্যাংচুয়ারির সামনে অমিতাভকে গাড়ি থামাতে বলল অর্জুন। স্যাংচুয়ারি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। যে লোকটির সঙ্গে ওরা আগের দিন কথা বলেছিল, তার ডিউটি নিশ্চয়ই শেষ হয়ে গিয়েছে।

অর্জুন বলল, ভিতরে যেতে হবে।

ভিতরে? কেন? অমিতাভ বুঝতে পারলেন না।

ঝিলের ধারে যাব। এখন স্যাংচুয়ারিতে কোনও টুরিস্ট নেই। কর্মচারীরাও বাড়ি চলে গিয়েছে। ঝিলের এধার থেকে ডক্টর বকসির বাড়িটাকে একটু দেখব।

কিন্তু যাবে কী করে? তা ছাড়া স্যাংচুয়ারিতে পাহারাদার থাকবেই। তারা আপত্তি করবে। আগে বললে অনুমতি নিয়ে আসা যেত লখনউ থেকে।

আমি তো জানিয়ে আসতে চাইনি। আপনি এক কাজ করুন। গাড়িটা নিয়ে পাশের পেট্রল পাম্পে চলে যান। আমি ঘণ্টা দেড়-দুয়েকের মধ্যে ফিরে আসছি। পাহারাদাররা আমাকে দেখতে পাবে না, অর্জুন বলল।

মানে? তুমি একা যাবে? না না, আমিও যাব। অমিতাভ মাথা নাড়লেন।

আপনি তো এসব ব্যাপারে অভ্যস্ত নন। তা ছাড়া গাড়িতে একজনের থাকা উচিত। খালি গাড়ি পড়ে থাকলে যে-কেউ সন্দেহ করবে, অর্জুন দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও অমিতাভ গাড়ি চালু করলেন। সেটা চোখের আড়ালে চলে যেতে অন্ধকার যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল। স্বস্তি পেল অর্জুন। সে এগিয়ে গেল।

গেটে তালা ঝুলছে। এই গেট সহজেই টপকানো যায়। কিন্তু পাহারাদাররা যদি এদিকে থাকে, তা হলে সহজেই ওদের নজরে পড়ে যাবে সে। অর্জুন পাঁচিল ধরে খানিকটা এগিয়ে গেল। মুশকিল হচ্ছিল হাইওয়ের গাড়ি নিয়ে। ওদের হেডলাইটের আলোয় তাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ফলে গাড়ি দূরে দেখলেই পাঁচিল ছেড়ে রাস্তায় উঠে আসতে হচ্ছিল। যেন কোনও কাজে যাচ্ছে সে, এমন ভঙ্গিতে হাঁটতে হচ্ছে। জমিটা ঢালু হওয়ায় পাঁচিল নীচে নেমেছে। আশপাশে কোনও গাড়ি নেই দেখে অর্জুন লাফিয়ে পাঁচিলের উপর উঠেই বসে পড়ল। তারপর সন্তর্পণে ভিতরের দিকে নেমে পড়ল। এদিকে প্রচুর গাছগাছালি। ফলে জায়গাটা ঘন অন্ধকারে ঢাকা। দূরে স্যাংচুয়ারির কোনও বাড়িতে আলো টিমটিম করছে। অর্জুন যেখানে নেমেছিল, সেখান থেকে সরে একটা বড় গাছের আড়ালে চলে এল।

ঝিলটা ঠিক কোন দিকে ঠাওর করার চেষ্টা করল সে। বড় রাস্তা থেকে গেট খুলে সোজা অনেকটা গিয়ে বাঁ দিকে ঘুরে ডক্টর বকসির প্রাসাদ দেখতে পেয়েছিল ওরা। আর তার পাশেই ঝিলের ওপার। তা হলে সোজা গিয়ে বাঁ দিকে যেতে হবে তাকে। হঠাৎ গলার স্বর কানে আসামাত্র গাছের আড়ালে স্থির হয়ে দাঁড়াল অর্জুন। দুটো লোক কথা বলতে বলতে আসছে। লোক দুটো লম্বা, ইউনিফর্মটা যদি কালো বা ঘন নীল হয়, তা হলে অন্ধকারে বোঝা যাবে না। কথা হচ্ছে হিন্দিতে। একজন বলল, আরে ঝিলে তো কেউ মাছ ধরে না রাতে, পাখিও মারবে না। বলেছে পাখির ফোটো তুলবে। তাও বেশিক্ষণ না।

কিন্তু সেটাও তো নিষেধ।

আলবাত! কিন্তু দেখতে হবে ফোটো তুললে পাখিদের কোনও ক্ষতি হচ্ছে কিনা! দিনভর লোকে এত ফোটো তুলছে, তাতে তো পাখিদের ক্ষতি হয় না। রাতে তুললে হবে কেন? আমরা যদি ওদিকে না যাই, তা হলে পাঁচশো টাকা পেয়ে যাব। বলতে বলতে লোকটা সঙ্গীকে নিয়ে ওপাশে চলে গেল। অর্জুন দ্রুত ওদের অনুসরণ করল, নিঃশব্দে।

দ্বিতীয় লোকটি বলল, এর ছমাস আগে বোধহয় ওরা রাতে পাখিদের ফোটো তুলেছিল। মনে আছে?

প্রথমজন বলল, সেবার চারশো দিয়েছিল। এবার একশো বাড়িয়েছে।

ঠিক হ্যায়! চলো, আমরা রান্নাবান্না করি। ঝিলের ধারে না থাকলে কী হচ্ছে, সেটা তো দেখতে পাব না। দ্বিতীয়জন বলল।

এই তো! এতক্ষণে ঠিক কথা বললে, চলো।

অর্জুন চট করে আড়ালে চলে গেল। লোকদুটো তার দু’হাত দূর দিয়ে চলে গেল, যেদিকে আলো জ্বলছিল, সেইদিকে।

অর্জুন একটু দাঁড়াল। কেউ রাতে ঝিলের উপর ভেসে থাকা পাখিদের ফোটো তুলতে চায়। মাসছয়েক আগেও তুলেছিল। কিন্তু কেন? পাখিদের ফোটো তো ভোরের আলো ফুটলে চমৎকার তোলা যায়। রাতের অন্ধকারে তুলতে গেলে তো আলো জ্বালতে হবে। সেই আলোয় পাখিরা বিরক্ত হবেই। ওরা ওড়ার চেষ্টা করবে, চিৎকার করে প্রতিবাদ জানাবে। সেই বিশৃঙ্খলাকে ক্যামেরায় ধরে কী লাভ? অর্জুন বুঝতে পারছিল না।

মিনিটদশেক বাগানের অন্ধকারে হাঁটার পর হঠাৎ হালকা হয়ে গেল অন্ধকার। সামনেই ঝিল। উপরে সন্ধে পার হওয়া আকাশের তারাদের ভিড়। সেই দূরবর্তী নক্ষত্রের আলো চুঁইয়ে নেমে আসছে ঝিলের জলে। ফলে চোখের সামনের দৃশ্যাবলি কিছুটা আবছা। অর্জুন একটা ছোট ঝোঁপের ভিতর ঢুকে পড়ল। ঝোঁপটা ঝিলের গা ঘেঁষা। ঝোঁপের তলায় ঘাস থাকায় আরাম করে বসতে পারল সে। এখান থেকে ঝিলের জল দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। পাখিদের হইহল্লা শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ওরা এত জোরে ডুব দিচ্ছে যে, জলে শব্দ হচ্ছে। ঝিলের ওপাশে ডক্টর বকসির বাড়ি। এখান থেকে কীরকম ছায়া ছায়া দেখাচ্ছে। বাড়িতে কোনও মানুষ আছে কি না, বোঝা যাচ্ছে না। কারণ, কোনও জানলায় আলোর প্রতিফলন নেই। এমন হতে পারে ডক্টর বকসি আবার বেরিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু সেই দাড়িওয়ালা লোকটির তো ওখানে থাকার কথা!

এখন লোকটি যে ওই বাড়িতে আছে, তাও এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে না।

অমিতাভকে যে সময় দিয়ে এসেছে তার মধ্যেই ফিরতে হবে অর্জুনকে। কিন্তু মিনিট পনেরো চলে যাওয়ার পরও বাড়িটা অস্পষ্ট ছবির মতো দাঁড়িয়ে থাকল। তাকিয়ে থাকতে থাকতে যখন আশা ছেড়ে দিচ্ছিল অর্জুন, তখনই একতলার জানলায় আলো জ্বলে উঠল। কাঁচের জানলায় একটা মানুষের ছায়া কেঁপে সরে গেল। তারপর সামনের দরজা খুলে বেরিয়ে এল লোকটা। বেশ স্বাস্থ্যবান, লম্বা। বেরিয়ে এসে চারপাশে তাকাল। ঝিলের ধারে পৌঁছে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। অর্জুন লক্ষ করতে চেষ্টা করল। ঝিলের এপার থেকে দূরত্বের কারণে লোকটার চোখ-মুখ বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু ও যে ঝিলটাকে খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করছে, তা বুঝতে অসুবিধে হল না।

মিনিট আড়াই পরে লোকটা ফিরে গেল বাড়ির ভিতর। অর্জুন অনুমান করল, ওই লোকটি অবশ্যই ডক্টর বকসি নন। বাড়ি পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব যার উপর, সেই দাড়িওয়ালা লোকটিকেই সে দেখেছে। ডক্টর বকসি কোথায় গেলেন!

একটু পরেই লোকটা বেরিয়ে এল পিঠে একটা বোঝা নিয়ে। এখন ওর পরনে একটা কালচে হাফপ্যান্ট। বোঝাটা বেশ ভারী, তাই একটু ঝুঁকে হাঁটতে হচ্ছে ওকে। ঝিলের ধারে এসে লোকটা চারপাশে তাকাল। তারপর ধীরে ধীরে জলে নামতে লাগল বোঝাটা নিয়ে। ক্রমশ ডুবে যাচ্ছিল লোকটা। তারপর আর দেখা গেল না।

পাখিগুলো সমানে চিৎকার করে চলেছে। অর্জুন ভেবে পাচ্ছিল না, রাতের অন্ধকারে পিঠে বোঝা নিয়ে লোকটা ঝিলের জলে নেমে কী করছে? ব্যাপারটা বেশ রহস্যজনক। ভারী বোঝা নিয়ে যখন কেউ জলে নামে, বিশেষ করে সন্ধের পর, তখন সেটা স্বাভাবিক কাজের মধ্যে পড়ে না।

একটু পরেই লোকটা উঠে এল। সঙ্গে বোঝাটা নেই। জল থেকে উঠে সোজা চলে গেল বাড়ির ভিতর। দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। তার দশ মিনিট পরে বাড়ির দোতলার জানলা থেকে আলো ছিটকে এল ঝিলের উপর। অর্জুন দেখল লম্বা, রোগা একটা লোক আলোর পাশে ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খুব মগ্ন হয়ে ফোটো তুলছে লোকটা। আলোটা ঝিলের জলে পিছলে পিছলে যাচ্ছে। বিরক্ত পাখিগুলো তুমুল প্রতিবাদ করছে আলো দেখে। বেশ কিছুক্ষণ আলোটা যেন জলের উপর কিছু খুঁজল। তারপর টুপ করে নিভে গেল।

লোকদুটোর কথা মনে পড়ল। এই ফোটো তোলার কথাই ওরা বলছিল। কিন্তু এটা কী ধরনের ফোটো তোলা? আলো পাখিদের যতটা না ধরেছে, তার চেয়ে লোকটা যেখানে ডুব দিয়েছিল, সেখানকার জলটাকেই বারবার আলোকিত করেছে। ফোটো ভোলা নিশ্চয়ই বাহানা। এমন হতে পারে যে, বোঝাটাকে জলের নীচে নামিয়ে দিয়ে আসা হয়েছে সেটা আবার ভেসে উঠল কিনা, তা দেখার জন্য ওই আলোটাকে ব্যবহার করা হয়েছে।

উপরের আলো নিভে গিয়েছে। বাড়ি এখন আবার নিঝুম। অর্জুন একটু ভাবল। তারপর জামাপ্যান্ট খুলে সন্তর্পণে জলে নামল। ডুবসাঁতার দিয়ে ঝিলের মাঝখানে চলে গিয়ে লোকটার ডোবার জায়গা ঠাওর করে শ্বাস নিয়ে আবার ডুব দিল।. ঝিল বেশ গভীর। ঝিলের তলায় একটা বড় গাছ আড়াআড়ি পড়ে আছে। সেই গাছের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে বোঝাটা। অর্জুনের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। কোনও রকমে উপরে উঠে আসতেই হাঁপাতে লাগল সে। ধীরে ধীরে যেখান থেকে জলে নেমেছিল, সেখানে ফিরে এসে কিছুক্ষণ বসে থাকল চুপচাপ। ঝিলের জলের নীচে যে ভারী বস্তাটা সে দেখেছে, তার ভিতরে কী আছে, তা অনুমান করা সম্ভব নয়। কিন্তু ওইখানে পড়ে থাকা গাছের ডালে শক্ত করে যে লোকটা বেঁধে এল, তার শরীরের শক্তি সম্পর্কে একটা আন্দাজ পাওয়া গেল। অত নীচে ডুব দিয়ে কাজ শেষ করে উপরে উঠে এসে স্বচ্ছন্দে হেঁটে চলে গিয়েছিল লোকটা। একটুও ক্লান্তির ছাপ ওর আচরণে বোঝা যায়নি। এরকম একটা লোককে ডক্টর বকসির কেন প্রয়োজন হল? কী আছে ওই বস্তার ভিতর? যাই থাক, সেটা প্রকাশ্যে রাখতে ডক্টর বকসি অথবা ওই লোকটা চায় না। আর যেহেতু ওই বাড়িতে থেকে নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করার স্বাধীনতা কাজের লোকের থাকার কথা নয়, তাই ধরে নিতে হবে ডক্টর বকসির আদেশেই লোকটা ঝিলের নীচে নেমেছিল।

অর্জুন ভাবল আর-একবার জলে নামবে কিনা। দীর্ঘকালের অনভ্যাসে সে দম হারিয়েছিল কিন্তু দ্বিতীয়বারে হয়তো কিছুটা বেশি সময় জলের নীচে থাকতে পারবে। ঠিক তখনই ঝিলের উপর আলো এসে পড়ল। আলো আসছে ডক্টর বকসির জানলা থেকে। আলোর বৃত্ত ঘুরে ঘুরে জল দেখছে। পাখিগুলো আবার চিৎকার শুরু করল। অর্জুন দ্রুত ঝোঁপের ভিতরে চলে এল। এখন স্পষ্ট হল। ওরা ওই বস্তাটা বাঁধন খুলে উপরে ভেসে উঠেছে কিনা, তাই যাচাই করছে। ওঠেনি দেখে আলো নিভিয়ে দিল।

অর্জুন আর জলে নামার ঝুঁকি নিল না।

.

গাড়ি চালাতে চালাতে অমিতাভ জিজ্ঞেস করলেন, জলে নেমেছিলে নাকি?

হ্যাঁ। ঝিলের জলে।

মাই গড! কেন?

অর্জুন ঘটনাটা অমিতাভকে বলল। অমিতাভ বললেন, না না। ওই জলে নেমে খুব ঝুঁকি নিয়েছ। একে অন্ধকার তার উপর পচা জল। বিষাক্ত সাপও থাকতে পারে।

অর্জুন হাসল, বিষাক্ত সাপ জলে বাস করে না বলে শুনেছি।

তোমার যদি সন্দেহ হয় কোনও নিষিদ্ধ জিনিস বস্তায় পুরে ওরা ঝিলের নীচে বেঁধে রেখেছে, তা হলে সেটা কী, জানতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগবে।

কীরকম?

পুলিশের এক বড়কর্তা আমার পরিচিত। এখনই তাকে ফোন করে বললে তিনি দলবল নিয়ে এসে ওটাকে জল থেকে তুলে আনতে পারেন, বলতে বলতে গাড়ি রাস্তার একপাশে দাঁড় করিয়ে মোবাইল বের করলেন অমিতাভ।

তারপর যদি পর্বতের মূষিক প্রসব হয়?

মানে?

পুলিশ বস্তাটা তুলে যদি দ্যাখে ওর মধ্যে কোনও নিষিদ্ধ বস্তু নেই?

তা হলে লুকিয়ে রাখবে কেন?

ঠিক। কী লুকিয়েছে, তা আগেই না জেনে কেন লুকিয়েছে, সেটা জানা দরকার। তা ছাড়া আজ পুলিশ গেলে ডক্টর বকসি বুঝতেই পারবেন, তার উপর নজর রাখা হয়েছিল। ফলে তিনি সতর্ক হবেন। আগামীকাল পিনাকীবাবু ওঁর পাত্তা পাবেন না। কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করাই ভাল। অর্জুন বলল।

অমিতাভ গাড়ি চালু করলেন, ঠিক বলেছ। তুমি দেখছি ঠান্ডা মাথায় বেশ ভাবতে পারো।

অর্জুন হাসল, এটা আমার জীবিকা।

.

অমিতাভ চেয়েছিলেন অর্জুনকে বেঙ্গলি ক্লাবে নিয়ে যেতে। কিন্তু সে রাজি হল না। প্রথমত, জামাপ্যান্ট নোংরা হয়ে গিয়েছে। দ্বিতীয়ত, সে কিছুক্ষণ একা থাকতে চায়। গেস্ট হাউসে তাকে নামিয়ে দিয়ে অমিতাভ চলে গেলেন।

বিছানায় শুয়ে অর্জুন ভাবছিল। বিজ্ঞাপনে ডক্টর বকসি দাবি করেছেন যে, মৃত্যুর পরও প্রিয়জনকে ঠিক আগের চেহারায় রেখে দেওয়ার প্রক্রিয়া তিনি আয়ুর্বেদের মাধ্যমে আবিষ্কার করেছেন। ঘটনা যদি তাই হয়, তা হলে ওঁকে নিয়ে হইহই পড়ে যাওয়ার কথা। এমনকী নোবেল পুরস্কারও পেয়ে যেতে পারেন। কিন্তু লখনউ শহরের লোক ব্যাপারটা জানেন বলে মনে হচ্ছে। না। কিন্তু ডক্টর বকসি কেন নিজেকে এত আড়ালে রাখছেন? ওঁর বাড়ির গেট থেকে দরজা, সর্বত্র সতর্কতামূলক ব্যবস্থা রেখেছেন। একজন প্রচণ্ড শক্তিশালী কাজের লোক ছাড়া বিশাল বাড়িতে কেউ নেই। নবাবগঞ্জ থেকে লখনউ বেশি দূর নয়। কিন্তু তিনি এখানকার বাঙালিদের সঙ্গে পরিচিত হতে চাননি। আর এত জায়গা থাকতে নবাবগঞ্জে কেন? ওই বাড়ি কি উনি পৈতৃক সূত্রে পেয়েছেন? তা হলে লখনউয়ের পুরনো বাঙালিরা জানত।

অস্বস্তি হচ্ছিল অর্জুনের। যে-কোনও গবেষণায় একবারেই সাফল্য পাওয়া যায় না। ওঁর গবেষণার যা বিষয়, তাতে মৃত্যুর কাছাকাছি আসা মানুষ দরকার। যদি উনি আয়ুর্বেদিক ওষুধ ব্যবহার করে থাকেন, তা হলে সাফল্য পেতে অনেক মানুষকে মৃত্যুর পর তাকে বাতিল করতে হয়েছে। সেই মানুষের আত্মীয়স্বজনরা কেন চুপ করে থাকবেন? ডক্টর বকসি তাদের প্রিয়জনের শরীর নিয়ে গবেষণা করে ব্যর্থ হয়েছেন বলে তারা পাঁচজনকে জানাবেন। পুলিশও চুপ করে বসে থাকবে না। মিডিয়া ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু এসবের কিছুই এক্ষেত্রে হয়নি। কেন?

টেলিফোন বেজে উঠল। বিছানা থেকে ধীরেসুস্থে উঠে রিসিভার তুলে হ্যালো বলতেই কানে এল, দিনটা কেমন কাটল ভাই?

মিস্টার গাঙ্গুলির গলা বুঝতে পেরে খুশি হল অর্জুন, ভালই। আপনি ভালভাবে পৌঁছেছেন তো?

খারাপভাবে পৌঁছোইনি। কিন্তু তুমি ভালর পর একটা ‘ই’ যোগ করলে কেন?

যে জন্য এসেছি, সেটা ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে।

কীরকম?

আজ সন্ধের পর বার্ড স্যাংচুয়ারিতে গিয়েছিলাম। ঝিলের ওপাশেই ডক্টর বকসির বাড়ি। দেখতে চেয়েছিলাম বাড়িতে ক’জন থাকে, স্বাভাবিক কিনা। যেটুকু দেখলাম তাতে অস্বাভাবিক বলেই মনে হয়েছে। অর্জুন বলল।

তোমার মুখে যা শুনেছি, তার উপর নির্ভর করে খোঁজখবর নিচ্ছিলাম। আমার এক বন্ধু দীর্ঘদিন লখনউয়ে ছিলেন। আমার চেয়ে দু’বছরের বড় তিনি। তার কাছে জানলাম, স্যাংচুয়ারির পাশের বাড়িটা তৈরি হয়েছিল নাইনটিন টোয়েন্টি এইটে। নবাব বাহাদুর শাহর এক কর্মচারীর বংশধর ওই বাড়ি তৈরি করেন। ভদ্রলোক থাকতেন লখনউ শহরে। প্রতি সপ্তাহে ওই বাড়িতে নাচগানের আসর বসাতেন। ওঁর মৃত্যুর পর বাড়িটা বন্ধ পড়ে থাকে। বহুকাল। এরপর হাতবদল হতে হতে হয়তো এই ডক্টর বকসিই একদিন বাড়ির মালিক হয়েছেন। তবে তিনি বছরপাঁচেকের মধ্যে মালিকানা পেয়েছেন। পাওয়ার পর যা কিছু আধুনিকীকরণ, তা ওঁরই করা। এই তথ্য থেকে তুমি বুঝতে পারছ ডক্টর বকসি ওই অঞ্চলে মাত্র পাঁচ বছর ধরে আছেন।

অর্জুন বলল, খুব উপকার করলেন খবরটা দিয়ে। আপনি যে ইলাহাবাদে গিয়েও আমার সমস্যা নিয়ে ভাবছেন, এর জন্যে আমি কৃতজ্ঞ।

ওসব কথা বোলো না। তুমি আমার নাতির বয়সি। তা ছাড়া ব্যাপারটা আমার কাছে খুব ইন্টারেস্টিং বলে মনে হচ্ছে। এই বুড়োবয়সে কোনও কিছু নিয়ে ভাবার সুযোগ পেলে সময়টা বেশ কেটে যায়। আচ্ছা রাখছি। মিস্টার গাঙ্গুলি লাইন কেটে দিলেন। এগারোটা নাগাদ পিনাকীরঞ্জন মিত্র অর্জুনের ঘরে এলেন। তার মুখে বেশ উত্তেজনা, মশাই, স্ত্রীকে লুকিয়ে কোনও কাজ করা আমার ধাতে নেই। আজ সেই কাজটা করে বেশ টেনশনে আছি। আমি কি পাপ করছি?

কীরকম?

আরে আপনি আমাকে বললেন ডক্টর বকসিকে ফোন করে বলতে, ত্রিফলায় কোনও কাজ হয়নি। কিন্তু কাল রাতে ত্রিফলা খেয়ে আজ সকালে দু’বার টয়লেটে যেতে হয়েছে। স্ত্রী সেটা দেখে বলেছেন অনেক দিন আগেই নাকি আমার ত্রিফলা খাওয়া উচিত ছিল। কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণে নাকি আমার মুখ হাঁড়ি হয়ে থাকে। এর পর উনি যদি জানতে পারেন ডক্টর বকসিকে আমি মিথ্যে বলছি, তা হলে আর দেখতে হবে না। তাই ওর কাছে ব্যাপারটা লুকোলাম। পাপ করিনি তো? পিনাকীরঞ্জন রুমাল বের করে মুখ মুছলেন।

অর্জুন হাসল, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জুনকে কৃষ্ণ কী উপদেশ দিয়েছিলেন মনে করে দেখুন।

বুঝলাম। আপনি তো কৃষ্ণ নন, অর্জুন!

ফোন করেছিলেন?

হুঁ।

কী কথা হল?

বিশ্বাস করুন, আমি সাজিয়েগুজিয়ে মিথ্যে বলতে পারি না। ট্রেনে পুলিশকে যা বলেছি, তা নেহাত সম্মানের ভয়ে। হঠাৎ বলে ফেলেছিলাম।

ধরা পড়ে গিয়েছেন?

না, না। বললাম, বাধ্য হয়ে ফোন করছি। ত্রিফলা খেয়েছি কিন্তু কোনও রেজাল্ট নেই। অন্যদিন তবু চেষ্টাচরিত্র করে কিছু হয়, আজ তাও হয়নি, এইটে বেশি বলে ফেলেছি। অনভ্যাসে। বলেছি, না হওয়ার জন্য খিদে হচ্ছে না। শুনে জিজ্ঞেস করলেন, কোন দোকান থেকে ত্রিফলা কিনেছি? গুল মারিনি। বললাম, পাড়ার দোকান থেকে। বললেন, নিশ্চয়ই ত্রিফলা বলে অন্য কিছু বিক্রি করেছে। বললাম, আপনি অন্য কোনও ওষুধ দিন, যাতে সুস্থ হতে পারি। উনি একটু ভেবে বললেন, আজ বিকেল তিনটের সময় যেন ওঁর বাড়িতে যাই। তিনটে পাঁচ হলে উনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবেন। স্যাংচুয়ারির পাশের গলি দিয়ে গেলে একটা গেট দেখতে পাব। সেখানে ওঁর লোক থাকবে আমাকে ভিতরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমার খুব ভয় করছে ভাই। যদি এমন ওষুধ দেন, যা খেলে হাতের জল না শুকোয়? পিনাকীরঞ্জনকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে, তিনি খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছেন।

নিয়ে আসবেন ওষুধ, কিন্তু খাবেন না। অর্জুন হাসল।

ওঃ! তাই তো। এটা ভাবিনি। বাঃ, এখন মন হালকা লাগছে।

তা হলে তিনটের সময় যেতে হবে। নবাবগঞ্জ যেতেও তো সময় লাগবে। অর্জুন বলল।

আপনি বলেছিলেন সঙ্গে যাবেন!

হ্যাঁ।

কিন্তু আপনাকে যদি ঢুকতে না দেয়?

আমি আপনার ভাইপো। ধরুন, আমার নাম শিবরঞ্জন মিত্র। আপনার শরীর খুব খারাপ লাগছে বলে আমাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন।

ও! পিনাকীরঞ্জন মাথা নাড়লেন, শিবরঞ্জন। মনে থাকলে হয়।

বেশি ভাববেন না, তা হলে মনে থাকবে।

এখন তো সওয়া এগারোটা বেজে গিয়েছে, কখন বাস ধরবেন?

বাস?

ট্যাক্সিতে অনেক খরচ হয়ে যাবে।

দেড়টা নাগাদ বেরোলেই হবে। খেয়ে এসেছেন?

হ্যাঁ। একটু বেশি খাওয়া হয়ে গিয়েছে।

এখনও তো অনেক সময়। প্রায় দু’ঘণ্টা। এদিকে কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকলে ঘুরে আসতে পারেন, অর্জুন বলল।

কোথায় যাব? আমার তো চেনাজানা কম।

তা হলে বসুন। বসে টিভি দেখুন।

না না। আমি টিভি বেশিক্ষণ দেখতে পারি না। চোখ টনটন করে। আমি এখানেই বসে আছি, আপনি যা করার তা করুন।

অর্জুন উঠল। বাথরুমে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখল। একটা ঝুঁকি থাকছেই। ডক্টর বকসির লোকটি তাকে ঢুকতে না-ও দিতে পারে। না দিলে লোকটা তাকে চিনে রাখবে। পরে ঢোকা মুশকিল হবে। কিন্তু ঝুঁকিটা নিতেই হবে। সে দাড়ি কামাবে বলে মুখে সাবান ঘষে ব্রাশ দিয়ে বোলাতে বোলাতে পিছন ফিরে দেখল পিনাকীরঞ্জন চেয়ারে বসে আছেন চোখ বন্ধ করে।

আচ্ছা, পিনাকীবাবু। অর্জুন আয়নার দিকে তাকিয়ে বলল।

বলুন।

প্রত্যেক মানুষকে একদিন-না-একদিন মরতেই হয়। তা আপনার প্ল্যান কী? মরার পরে আপনি কী করবেন?

হে হে! রসিকতা করছেন! মরার পর কিছু করার ক্ষমতা থাকে নাকি?

কেন থাকে না! তাজমহল দেখলেই মমতাজ-শাহজাহানের কথা মনে পড়বে? শাহজাহান প্ল্যান করেছিলেন বলেই আমাদের মনে পড়ে।

কোথায় শাহজাহান আর কোথায় আমি!

বেশ, কেউ যদি প্রস্তাব দেয়, আপনার মৃত্যুর পরও ওই শরীরটাকে অবিকল একরকম রেখে দেবে। পচা দূরের কথা, একটুও টসকাবে না, রাজি হবেন?

আমার শরীরটা? মরার পরও?

হ্যাঁ। শুধু কথা বলতে বা হাঁটাচলা করতে পারবেন না।

যাঃ। তা কি হয়? তা ছাড়া, তার দরকারও নেই।

দাড়ি কাটছিল অর্জুন। হাত নামিয়ে ঘুরে দাঁড়াল, কেন?

আমার স্ত্রী বলেন আমাকে দেখলে ওঁর হাড়পিত্তি জ্বলে যায়! মরে যাওয়ার পরও যদি আমাকে এই চেহারায় উনি দ্যাখেন, তা হলে তো জ্বলা কমবে না। কী দরকার কষ্ট দিয়ে। করুণমুখে বললেন পিনাকীরঞ্জন।

অর্জুন হাসতে গিয়ে সামলে নিল।

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার