অমিতাভকে বারবার বিরক্ত করতে ইচ্ছে হল না। তা ছাড়া উনি নিশ্চয়ই এখন অফিসে। কাজ থেকে টেনে নিয়ে আসার যুক্তি নেই। বেরোবার আগে গেস্ট হাউসের ঘর থেকে কানাইলাল চৌধুরীকে টেলিফোন করল সে। লখনউ থেকে জলপাইগুড়ির লাটাগুড়ির লাইন পেতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হল না। অন্য কেউ ফোন ধরেছিল। নাম বলতেই কানাইবাবু তড়িঘড়ি এসে রিসিভার তুললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলুন। আমি খুব চিন্তায় ছিলাম।

চিন্তার কিছু নেই। আমি এখন লখনউয়ে। ডক্টর বকসি বাইরের কারও সঙ্গে দেখা করেন না। বোধহয় বিজ্ঞাপনের জবাবে যে চিঠি আসে, তা থেকে বেছে নিয়ে অ্যাপয়ন্টমেন্ট দেন। কিন্তু আমি চেষ্টা করছি ওঁর সঙ্গে দেখা করার। অর্জুন বলল।

 আবার কী কথা? ডাক্তার রোগীর লোকের সঙ্গে কেন দেখা করবেন না। ওঁকে বলুন, বিজ্ঞাপনে যা আছে, তা ঠিক হলে যা টাকা লাগবে তাই দেব।

বেশ বলব।

আপনি ক’দিন ওখানে আছেন?

এখনই বলা সম্ভব নয়।

কোথায় আছেন?

গেস্ট হাউসে।

ও! ঠিকানাটা বলুন, আরও কিছু টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি।

এখনই দরকার নেই। লাগলে বলব। রাখছি।

পিনাকীরঞ্জন চুপচাপ শুনছিলেন। কথা শেষ হলে বললেন, এতক্ষণে বুঝতে পারলাম আপনি কেন এত ইন্টারেস্টেড!

কী বুঝলেন?

আপনি কোনও পেশেন্ট নিয়ে এসে ডক্টর বকসিকে দেখাতে চান। তাই তো?

অনেকটাই ঠিক বুঝেছেন।

লোকটা কিন্তু ভাল আয়ুর্বেদ। মুখ দেখে বুঝে গেল আমি কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগছি আর ত্রিফলা খেতে বলল। দারুণ কাজ য়েছে, পিনাকীরঞ্জন বললেন, ভাল ডাক্তার পেশেন্টের মুখ দেখেই রোগ বলে দেন। শুনেছি পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ডক্টর বিধানচন্দ্র রায়ও নাকি তাই বলতে পারতেন।

চলুন। এবার যাওয়া যাক।

এখনই? মানে, এখন একটা পনেরো বাজে?

বাস ধরতেও তো সময় লাগবে।

তা ঠিক। পাঁচ মিনিট দাঁড়াবেন?

কেন?

একটু টয়লেটে যাব। পেটটা কীরকম করছে? উত্তরের অপেক্ষা না করে টয়লেটে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেন পিনাকীরঞ্জন।

.

সময়টা দুপুর বলে বাসে যাত্রীর সংখ্যা কম। শহর ছাড়ার আগেই ওরা বসার জায়গা পেয়ে গেল। পিনাকীরঞ্জন কন্ডাক্টরকে বলে দিলেন, নবাবগঞ্জের বার্ড স্যাংচুয়ারিতে যেন তাদের নামিয়ে দেওয়া হয়। মিনিটদশেক যাওয়ার পর ওঁর মনে সন্দেহ এল। তিনি আবার কন্ডাক্টরকে ডাকলেন, আমি তোমাকে যা বলেছি সেটা মনে আছে তো?

লোকটি জিজ্ঞেস করল, কী বলেছেন? পিনাকীরঞ্জন অর্জুনের দিকে তাকালেন, দেখলেন তো! এদের মাথায় যদি একফোঁটা ঘিলু থাকে! মন্তব্য বাংলায় করে কন্ডাক্টরকে হিন্দিতে বললেন, ভাই দয়া করে আমাদের নবাবগঞ্জের…

ধ্যাত! এককথা বারবার বলছে! লোকটি ফিরে গেল দরজায়।

খেপে গেলেন পিনাকীরঞ্জন, দেখলেন, কী বিশ্রী ব্যবহার!

আপনি এসব গায়ে মাখবেন না। জায়গাটা আমি চিনি। অর্জুন বলল।

বাসে বেশি সময় লাগল নবাবগঞ্জ পৌঁছোতে। পেট্রল পাম্প ছাড়াতেই অর্জুন উঠে পড়ল। এই সময় কন্ডাক্টরের গলা শোনা গেল, বার্ড স্যাংচুয়ারি!

বাস থামলে নামার সময় পিনাকীরঞ্জন গম্ভীর গলায় বললেন, শুক্রিয়া।

স্যাংচুয়ারির গেটে বেশ কয়েকটা গাড়িদাঁড়িয়ে আছে। পিনাকীরঞ্জন সেদিকে তাকিয়ে বললেন, যাবেন নাকি ভিতরে? আমি কখনও দেখিনি।

তিনটে বাজতে বেশি দেরি নেই।

ওহো! তাই তো?

শুনুন! আপনি অসুস্থ, এটা মনে রাখবেন।

ভেবে নিয়েছি, হাসলেন পিনাকীরঞ্জন।

কী ভেবেছেন?

চোখ আধবোজা করে উঃ-আঃ করব। আপনি আমাকে ধরে রাখলে টলতে টলতে হাঁটব। দেখলেই মনে হবে আমি খুব অসুস্থ!

দয়া করে ওটা করবেন না। আপনার পেটে খুব ব্যথা হচ্ছে তাই বাঁ হাত দিয়ে মাঝে মাঝে পেট চেপে ধরবেন। আজ সকাল থেকে কিছু খাননি বলে আরও দুর্বল হয়ে পড়েছেন। এইটুকু। পারবেন তো?

বিলক্ষণ!

আমাকে দেখান তো?

পিনাকীরঞ্জন বাঁ হাত পেটের উপর চেপে মুখ বিকৃত করলেন। অর্জুন হেসে ফেলল, অতটা না করলেও চলবে।

স্যাংচুয়ারির সীমানা শেষ হলে গলি দিয়ে ঢুকল ওরা। খানিকটা যাওয়ার পর লোহার গেট নজরে এলে পিনাকীরঞ্জন বললেন, আরে বাপ! ডাক্তারবাবু দেখছি খুব বড়লোক। অথচ জানেন, আমার স্ত্রী ওঁর নামই শোনেনি।

আপনার স্ত্রী কি বিল গেটসের নাম শুনেছেন?

তিনি কে?

পৃথিবীর অন্যতম ধনী ব্যক্তি। গেট খুলুন।

পিনাকীরঞ্জন এগিয়ে গিয়ে গেট খুললেন। অর্জুন চট করে ভিতরে ঢুকে পড়ল। পিনাকীরঞ্জন ভিতরে ঢুকে গেট বন্ধ করতে না-করতে দূরে লোকটাকে এগিয়ে আসতে দেখল অর্জুন। গালে চাপ দাড়ি, ব্যায়াম করা শরীর।

অর্জুন চাপা গলায় বলল, আপনার পেটে ব্যথা হচ্ছে।

সঙ্গে সঙ্গে পিনাকীরঞ্জন বাঁ হাতে পেট খামচে ধরলেন। মুখ বিকৃত হল। দাড়িওয়ালা লোকটি সামনে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, নাম?

পি-পিনাকী, উঃ! পিনাকীরঞ্জন শেষ করতে পারলেন না।

চলিয়ে, হাত নেড়ে ডাকল লোকটা।

অর্জুন এগিয়ে গিয়ে পিনাকীরঞ্জনকে ধরে কয়েক পা হাঁটতেই লোকটা হিন্দিতে বলল, আপনার যাওয়ার অর্ডার আছে। ওকে গেটের বাইরে যেতে বলুন।

পিনাকীরঞ্জন বললেন, ও হল আমার ভাইপো। আমার শরীর খারাপ বলে স্ত্রী বলেছে ও যেন সব সময় সঙ্গে থাকে। কথা না শুনলে স্ত্রী খুব রেগে যান।

কোনও কথা শুনতে চাই না। অর্ডার হয়েছে একজনকে নিয়ে যাওয়ার। লোকটি বলল।

পিনাকীরঞ্জন বললেন, আচ্ছা মুশকিল! ডাক্তারের কাছে রোগী যাবে, তাতে অর্ডার আবার কীসের। ঠিক হ্যায়, হাম ডাক্তারবাবুকো বলেগা, চলো।

লোকটা একটু ভাবল। তারপর হাঁটতে শুরু করল। খুব দ্রুত হেঁটে যাওয়ায় দূরত্ব বাড়ছিল। অর্জুন বলল, দশে দশ পেয়ে গিয়েছেন। দারুণ অভিনয় করেছেন।

পিনাকীরঞ্জন হাসলেন, ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় স্কুলে একবার অভিনয় করেছিলাম।

বাড়িটার সামনে পৌঁছে লোকটাকে দেখতে পেল না অর্জুন। বাড়ি দেখে পিনাকীরঞ্জন মোহিত হয়ে গেলেন, উরে ব্বাবা! এ তো বাড়ি না, দুর্গ!

আপনার কিন্তু পেটে ব্যথা! অর্জুন মনে করিয়ে দিল।

ও, উঃ! পেট খামচে ধরলেন পিনাকীরঞ্জন।

এই সময় দরজা খুলে লোকটি বেরিয়ে এসে তাদের ভিতরে ঢুকতে বলল। ওরা ঢোকামাত্র দরজাটা বন্ধ করে পাশের একটা ঘর দেখিয়ে অন্যদিকে চলে গেল সে। পিনাকীরঞ্জনকে নিয়ে সেই ঘরে ঢুকল অর্জুন।

ঘরের একপ্রান্তে লম্বা টেবিলের উপর বড় বড় কাঁচের জার। তাতে তরল। পদার্থে লতাপাতা শিকড় ডুবিয়ে রাখা হয়েছে। সেগুলোর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন পিনাকীরঞ্জন, আয়ুর্বেদ! খুব পুরনো চিকিৎসা পদ্ধতি।

এটি কে?

গম্ভীর গলা ভেসে আসতেই ওরা পিছন ফিরল। পিনাকীরঞ্জন বললেন, কী আশ্চর্য! আপনি বাঙালি? টেলিফোনেও তো উর্দু-হিন্দি বললেন, বলেই খেয়াল হতে পেট খামচে ধরলেন।

আপনি একে নিয়ে আসার কথা বলেননি, ডক্টর বকসি কেটে কেটে বললেন।

আমার স্ত্রী কিছুতেই একা ছাড়তে চাইল না যে! পিনাকীরঞ্জন মিত্র বললেন, এটি আমার ভাইপো। নর্থ বেঙ্গলে থাকে। বেড়াতে এসেছে। কিন্তু ইসবগুলে কোনও কাজ হচ্ছে না। উলটে পেটে তীব্র ব্যথা। একবার ভাবলাম, পাড়ায় অ্যালোপ্যাথি ডাক্তারের কাছে যাই। কিন্তু আপনি আমার মুখ দেখেই যখন বলে দিলেন যে, আমি কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগি, তখন আপনার কাছেই ছুটে এলাম ভাইপোকে নিয়ে। পিনাকীরঞ্জন বললেন।

লখনউয়ে থাকেন? অর্জুনের দিকে তাকালেন ডক্টর বকসি।

না। আমি উত্তরবঙ্গে থাকি।

কী করা হয়?

তেমন কিছু নয়। চাকরি খুঁজছি। অর্জুন বলল।

পূর্ববঙ্গে বাড়ি ছিল? চোখ সরাচ্ছিলেন না ডক্টর বকসি।

না। আমরা নদিয়া থেকে উত্তরবঙ্গে গিয়েছিলাম।

কথায় টান নেই। উত্তরবঙ্গের মানুষের কথায় একটা আলাদা টান থাকে, ডক্টর বকসি পিনাকীরঞ্জনকে বললেন, পিনাকেশবাবু, আপনি আমার সঙ্গে ওঘরে চলুন। মনে হচ্ছে আপনাকে পরীক্ষা করা দরকার। আসুন, বলে পাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি।

পিনাকীরঞ্জন ইশারায় জিজ্ঞেস করলেন, এবার কী করব?

অর্জুন ইশারা করল যাওয়ার জন্য। মিনিট কুড়ি পর ডক্টর বকসি ফিরে এলেন, খুব স্যাড ব্যাপার। ওঁর পেটের ভিতর একটা ভয়ংকর টিউমার আছে। কিন্তু উনি আমার কাছে টেলিফোনে মিথ্যে বললেন কেন?

মিথ্যে? মানে?

ওর পেট একেবারে খালি। অথচ বললেন ইসবগুল খেয়েও কাজ হয়নি। লোকটা বেসিক্যালি সরল। তা হলে?

হয়তো টিউমারের জন্য ব্যথা হচ্ছে, উনি ভাবছেন উলটো।

ওকে! আপনি তো ওঁর ভাইপো অপারেশন না করে আমি টিউমারটা গলিয়ে দিতে চাই। তার জন্য আমার কাছে দু’দিন থাকতে হবে। এখনই চিকিৎসা শুরু না করলে টিউমার ফেটে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে বাঁচানো মুশকিল হবে। আপনি বাড়ি ফিরে ওঁর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে আমাকে টেলিফোনে জানান। ডক্টর বকসি চিন্তিত গলায় বললেন।

উনি এখানে থাকতে রাজি হয়েছেন? অর্জুন অবাক!

আলোচনা করার মতো অবস্থায় উনি নেই। প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছিল দেখে ওঁকে ঘুম পাড়াতে বাধ্য হয়েছি। আপনি যত তাড়াতাড়ি জানাতে পারবেন, তত ভদ্রলোকের উপকার হবে।

কীরকম খরচ হবে?

সেটা এখনই বলতে পারছি না।

কাকিমা তো জানতে চাইবেন। মানে ওঁর পক্ষে সম্ভব কিনা…

নার্সিংহোমে অপারেশন করলে যা খরচ হত তার চেয়ে বেশি হবে না। যান, আর কথা বাড়াবেন না, ডক্টর বকসি ঘুরে দাঁড়ালেন।

একটা অনুরোধ…

ডক্টর বকসি আবার ফিরে তাকালেন।

যাওয়ার আগে কাকাকে একবার দেখে যেতে চাই।

একজন ঘুমন্ত মানুষকে দেখার কী আছে?

কাকিমা জানতে চাইবেন। মেয়েদের মন তো! অর্জুন গলা নামিয়ে বলল।

ওঃ! বিরক্ত হলেন ডক্টর বকসি, আসুন। এক মিনিটের বেশি নয়। ডক্টর বকসিকে অনুসরণ করে পাশের ঘর দিয়ে আর-একটি ঘরে চলে এল অর্জুন। সেখানে বেশ উঁচু একটা লম্বা কাঠের টেবিলের উপর শুয়ে আছেন পিনাকীরঞ্জন। তার চোখ বন্ধ। শ্বাস পড়ছে স্বাভাবিকভাবে।

অর্জুন লক্ষ করল লম্বা টেবিলটা বেশ অস্বাভাবিক চেহারার। নীচের দিকে গাড়ির অ্যাকসিলেটরের মতো একটা জিনিস রয়েছে। হয়তো সেটায় চাপ দিলে টেবিলটা উপর-নীচ হয়।

দেখা হল?

উনি তো খুব শান্তভাবে ঘুমোচ্ছেন, অর্জুন কথা বলতে চাইল।

ওষুধের গুণে।

ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়েছেন?

না। একটা বিশেষ গাছের শিকড়ের রস যে-কোনও মানুষকে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘুম পাড়িয়ে দেয়, ডক্টর বকসি বিরক্ত হচ্ছিলেন।

কিন্তু দেখুন, মনে হচ্ছে ওঁর পেটে কোনও ব্যথা নেই। পেট স্বাভাবিক।

ভিতরে বিশাল টিউমার, যে-কোনও মুহূর্তেই ফাটতে পারে।

কিছু মনে করবেন না, এক্সরে না করে আপনি টিউমারের অস্তিত্ব কী করে বুঝতে পারলেন? পেট টিপে কি ঠিকঠাক বোঝা সম্ভব?

আপনি কি আমার চিকিৎসাবিদ্যায় সন্দেহ করছেন?

না না। আমি জানতে চাইছি। অ্যালোপ্যাথি, এমনকী হোমিওপ্যাথি ডাক্তাররাও এক্সরে করতে বলেন। তাতে পেটের ভিতরে ঠিক কোন জায়গায় এবং কী অবস্থায় টিউমার রয়েছে, তা স্পষ্ট বোঝা যায়। অর্জুন বলল।

এবার শব্দ করে হাসলেন ডক্টর বকসি, আপনি আমাকে ডাক্তারি শেখাতে চাইছেন? বেশ, ওঁকে স্বচ্ছন্দে এখান থেকে নিয়ে যেতে পারেন।

কী করে সম্ভব? ওঁর তো জ্ঞান নেই।

জ্ঞান এক মিনিটেই ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করছি, ডক্টর বকসি ঘরের অন্যপ্রান্তে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, সেখানেও টেবিলের উপর অনেক কাঁচের জারে তরল পদার্থ রয়েছে।

অর্জুন বলল, দাঁড়ান। আমাকে ভুল বুঝছেন আপনি। আপনাকে আমি সন্দেহ করিনি। কৌতূহল হচ্ছিল বলে প্রশ্নগুলো করছিলাম। আপনি স্বচ্ছন্দে কাকার চিকিৎসা করতে পারেন। উনি আপনার উপর খুব ভরসা করছিলেন।

ওঁর স্ত্রীর অনুমতির দরকার নেই? ডক্টর বকসি জিজ্ঞেস করলেন?

দেখুন, এখান থেকে লখনউ যেতে-আসতে প্রচুর সময় লেগে যাবে। অন্তত ঘণ্টাতিনেকের আগে ফিরতে পারব না। তার উপর কাকিমা যদি আসতে চান, তা হলে আরও দেরি হয়ে যাবে। এর মধ্যে যদি টিউমারটা… অর্জুন কথা শেষ না করে বেশ উদ্বেগের সঙ্গে তাকাল।

একটা টেলিফোন করে মতামত নিতে পারেন।

কাকার বাড়িতে টেলিফোন নেই, অর্জুন মাথা নাড়ল, তা ছাড়া, আপনাকে বলতে সংকোচ হচ্ছে, কাকা এবং কাকিমার মধ্যে সদ্ভাব নেই। সেই জন্যই কাকা বাড়ি ছেড়ে অত দূরে দশ বছর চাকরি করছেন। আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয়, কাকা মারা গেলে কাকিমা স্বস্তি পাবেন!

অ্যাঁ! তাই নাকি? কীরকম?

দু’জনের মধ্যে কোনও মিল নেই তো! এই যে কাকা আমার সঙ্গে এসেছেন, তা কি খুশি হয়ে এসেছেন? বাধ্য হয়ে এসেছেন। কাকিমার সঙ্গে পেরে উঠবেন না বলে বাধ্য হয়ে এসেছেন। আসার আগে কাকিমা আমাকে আড়ালে বলেছেন যে, এখানে কোনও উপকার না হলে আমি যেন হাসপাতালে ওঁকে ভরতি করে বাড়ি ফিরি। বুঝতেই পারছেন, কাকা না থাকলে কাকিমা সব সম্পত্তির মালিক হয়ে স্বাধীনভাবে থাকতে পারবেন। আপনি ওঁর চিকিৎসা শুরু করুন। আমি চাই কাকা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যান। গড়গড় করে অর্জুন মিথ্যে কথাগুলো বলে বুঝল ডক্টর বকসি তাকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন। তিনি ঘড়ি দেখলেন।

পিনাকেশবাবু যে আমার এখানে এসেছেন, তা ক’জন জানেন?

আমি আর কাকিমা।

হুঁ! দেখুন ভাই, এই টিউমারটার যা আকৃতি, তাতে একটা ঝুঁকি নিতেই হবে। আমার ওষুধে যখন ওটা গলতে শুরু করবে, তখন ওঁর রক্তচাপ বেড়ে যাবে। সেটা আমি কোনও অবস্থাতেই ঠেকাতে পারব না।

কী করা যাবে! অ্যালোপ্যাথি ওষুধেরও সাইড-রিঅ্যাকশন আছে।

আঃ! বারবার আমার সামনে অ্যালোপ্যাথির কথা বলবেন না।

সরি।

আজ অবধি কেউ মারা যায়নি, তবে সহ্য করতে না পারলে হার্ট জখম হতে পারে। সেক্ষেত্রে কথা বন্ধ হয়ে যাবে, মুভমেন্ট করতে পারবেন না। চেয়ারে বসিয়ে রাখলে চমৎকার বসে থাকবেন। তখন আবার নতুন করে চিকিৎসা করে ওঁকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। কিন্তু তার জন্য অন্তত তিন সপ্তাহ সময় দরকার।

পিনাকীরঞ্জনের শরীরের পাশে দাঁড়িয়ে ওঁর বুকে-পেটে হাত বোলাতে বোলাতে কথা বলছিলেন ডক্টর বকসি। অর্জুনের মনে হল ভদ্রলোক বেশ পুলকিত।

তা হলে!

আপনি এবার আসতে পারেন।

এ কী বলছেন! আপনার চিকিৎসা শেষ না হওয়ার আগে আমি যাই কী করে!

আপনার তো থাকার দরকার নেই। কোনও কাজেই আপনি লাগবেন না।

জানি। কিন্তু ওষুধের প্রতিক্রিয়া না জেনে কী করে যাব! কাকিমাকে তো বলতে হবে। আমার অবস্থাটা বুঝুন। এলাম কাকাকে নিয়ে, ফিরে যাব একা? অর্জুন বলল।

ডক্টর বকসি একটু ভাবলেন। তারবল বললেন, যে ঘরে আপনি অপেক্ষা করছিলেন, সেই ঘরে গিয়ে বসুন।

অগত্যা ফিরে গেল অর্জুন। ডক্টর বকসির মতলব ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। এক্সরে ছাড়া কী করে বোঝা যাবে যে, টিউমার ফাটবে ফাটবে করছে! আর পেটে টিউমার থাকলে পিনাকীরঞ্জন টের পেতেন না! এখানে আসা পর্যন্ত ওঁর পেটে বিন্দুমাত্র যন্ত্রণা হয়নি। অর্জুনের কথামতো পেটে ব্যথা হচ্ছে বোঝাতে অভিনয় করছিলেন তিনি। অথচ পেট টিপেই ডক্টর বকসি আবিষ্কার করলেন ওঁর পেটে টিউমার আছে!

ভাবতে ভাবতে অর্জুন হেসে ফেলল। না জেনে একটা তথ্য দিয়ে ফেলেছেন ডক্টর বকসি। রক্তচাপ বেড়ে গেলে, হার্ট জখম হলে পিনাকীরঞ্জন কথা বলতে পারবেন না, হাত-পা বা শরীরের কোনও অংশ নাড়তে পারবেন না, চেয়ারে বসালে বসে থাকবেন। তারপর তিনি ওঁর চিকিৎসা তিন সপ্তাহ ধরে করে সুস্থ করে দেবেন। বিজ্ঞাপনে তো এরকম কথাই লেখা হয়েছিল। মৃতদেহ অবিকল এক চেহারায় রেখে দিতে পারবেন। শুধু তার হৃৎস্পন্দন থাকবে না।

বিজ্ঞাপন দেওয়ার পর লাটাগুড়ির কানাইলাল চৌধুরীর মতো অনেক মানুষ নিশ্চয়ই ডক্টর বকসির খবরের কাগজের বক্স নম্বরে চিঠি লিখেছে। ইচ্ছে করলেই তাদের মধ্যে থেকে রোগী নির্বাচন করে ভদ্রলোক গবেষণা করতে পারতেন। অবশ্য যদি এটা গবেষণা হয়ে থাকে। সেটা না করে পিনাকীরঞ্জনের মতো সুস্থ ব্যক্তিকে গিনিপিগ করতে উদ্যোগী হচ্ছেন কেন?

পাশের দরজা খুলে গেল। অর্জুন দেখল, সেই দাড়িওয়ালা লোকটি একটা প্লেটের উপর কাঁচের গ্লাস বসিয়ে এগিয়ে আসছে। গম্ভীর মুখে সেটা অর্জুনের সামনে ধরে বলল, শরবত।

হালকা নীল পানীয় গ্লাসের ভিতরে। অর্জুন গ্লাস তুলে নিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে আবার প্লেটের উপর রেখে দিয়ে বলল, ধন্যবাদ, আমি শরবত খাই না।

চোয়াল নাড়ল লোকটা, চা, কফি?

এখন টেনশন হচ্ছে খুব, কিছু খাব না, তারপর জিজ্ঞেস করল, টয়লেট কোথায়?

প্রশ্ন শুনে লোকটা বেশ বিরক্ত হল। বলল, পারমিশন নেই।

অ্যাঁ! টয়লেটে যেতেও পারমিশন লাগে এখানে? তুমিও পারমিশন চাও?

লোকটি জবাব না দিয়ে বেরিয়ে যেতেই অর্জুন ওকে অনুসরণ করল। ওই দরজা দিয়ে খানিকটা যেতেই একটা বড় হলঘর। লোকটি হলঘরের প্রান্তে একটা বেসিনে শরবত ঢেলে দিয়ে গ্লাসটা কয়েকবার ধুয়েও তৃপ্ত হল না, লিকুইড সাবানে ধুয়ে ন্যাপকিন দিয়ে পরিষ্কার করে ওপাশের ঘরে চলে গেল।

হলঘর থেকে একটা সিঁড়ি উঠে গিয়েছে উপরে। সিঁড়ির শেষ প্রান্তে চোখ পড়তেই অর্জুন চমকে উঠল। শেষ ধাপের দুদিকে দুটো কঙ্কাল স্বাগত জানানোর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। ও দুটো যে পূর্ণবয়স্ক মানুষের কঙ্কাল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

অর্জুন দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখছিল। এই সময় উপর থেকে নেমে এলেন ডক্টর বকসি। নামার সময় কঙ্কাল দুটোকে দু’হাতে ছুঁয়ে নিলেন। তিনি হলঘরে পা দেওয়ামাত্র দাড়িওয়ালা ওপাশের ঘর থেকে বেরিয়ে মাথা নিচু করে যে কথাগুলো বলল, তা অৰ্জুন শুনতে পেল না। ডক্টর বকসি মাথা নাড়লেন। তারপর কবজি তুলে সময় দেখে বললেন, আর এক ঘণ্টা পর কাজ শুরু করব আমরা। তখন ছেলেটাকে বলবি, কাল সকালে এসে পেশেন্টকে দেখতে। এখন দেখে কোনও লাভ হবে না।

লোকটি কিছু জিজ্ঞেস করল।

ডক্টর বকসি বললেন, ভাল কথায় না গেলে কী করতে হবে, তা তো তোর জানাই আছে। সেটা করলে তোরই লাভ হবে, হাসলেন তিনি। লোকটি মাথা নাড়ল খুশি হয়ে। ডক্টর বকসির পিছন পিছন ওপাশের দরজা দিয়ে চলে গেল।

অর্জুন দ্রুত চলে এল হলঘরে। সিঁড়ি ভেঙে উঠে গেল দোতলায়। লম্বা করিডোর। ডান দিকের ঘরটায় ঢুকে সে অবাক! একটা খাটের চারকোণে চারটে লম্বা কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে। তাদের আঙুলে মশারির দড়ি জড়ানো। ঘরের একপাশে বড় আয়নার সামনে যে চেয়ার, তার হাতল ধরে একটি অল্পবয়সি কঙ্কাল দাঁড়িয়ে। এ বাড়িতে এত কঙ্কাল কেন? অর্জুন পাশের ঘরে ঢুকল দরজা ঠেলে। ঢুকতেই একটা তীব্র পচা গন্ধ নাকে এল। এই ঘরের জানলা দিয়ে ঝিল দেখা যাচ্ছে। বোধহয় এখান থেকেই ঝিলের জলে আলো ফেলা হয়েছিল। ঘরের কোণে একটা বড় রেফ্রিজারেটর। কোনও কারণে তার দরজা ভালভাবে বন্ধ করা হয়নি। গন্ধটা আসছে ওর ভিতর থেকে।

.

রেফ্রিজারেটরের দরজাটা আর-একটু ফাঁক করতেই গন্ধটা অর্জুনের শরীরকে এমন অস্থির করে তুলল যে, মনে হল, বমি হয়ে যাবে। নাকে রুমাল চেপে সে দেখল একটা সসপ্যানে বেশ কয়েকটা মাংসের বড় বড় টুকরো থেকেই ওই দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে। মাংসগুলো হাড় ছাড়া এবং কয়েক দিনের পচা বলে কালচে রং ধরে গিয়েছে। এটা খাসি বা মুরগির তো নয়ই, গোরু বা মোষের হতে পারে। সে আর-একটু ঝুঁকে দেখতে চাইল। পাশেই বড় বড় দুটো বাটিতে রান্না করা মাংস রয়েছে। বাটি নাকের কাছে এনে তেমন গন্ধ পেল না অর্জুন। রান্না করা মাংসেও কোনও হাড় নেই। একজন ডাক্তারের রেফ্রিজারেটরে এত পচা মাংস কেন থাকবে? পাশেই একটা চিলতে ঘর। অর্জুন সে ঘরে ঢুকে একটা অ্যালুমিনিয়ামের মোড়ক দেওয়া টেবিলের উপর মাংস কাটার ছুরি দেখতে পেল। লোকে দোকান থেকে মাংস পিস করে কাটিয়ে আনে, আর এ বাড়িতে এখানে মাংস টুকরো করা হয়। হঠাৎ অস্বস্তি হতে অর্জুন ঘুরে দেখতে পেল, দাড়িওয়ালা লোকটা নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে তার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ওগুলো কীসের মাংস?

অর্জুনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকটা। ওর ওজন এবং শক্তি এত প্রবল যে, অর্জুন আছড়ে পড়ল মাটিতে। লোকটা দু হাত বাড়িয়ে অর্জুনের গলা চেপে ধরতে সে জোড়াপায়ে ওর পেটে লাথি মারল। সামলাতে না পেরে লোকটা উলটে পড়ল টেবিলের গায়ে। হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল কাঠের টেবিল। অর্জুন এক লাফে বাইরে আসার সময় আড়চোখে দেখতে পেল, লোকটা মাংস কাটার ছুরি মাটি থেকে কুড়িয়ে নিচ্ছে। সে বাইরে এসে দরজার ছিটকিনি তুলে দিল। দড়াম দড়াম শব্দ হতে লাগল দরজায়। এবার মাঝখানের হুড়কো টেনে দিয়ে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে আসতে ডক্টর বকসির গলা শুনতে পেল সে। উপরে তখন সমানে শব্দ হয়ে যাচ্ছে। অর্জুন সিঁড়ির পাশে টেবিলে সাজানো জারের পিছনে লুকোতে-না-লুকোতে ডক্টর বকসি হলঘরে ঢুকে চিৎকার করলেন, কী হয়েছে? শব্দ করছ কেন?

উপর থেকে আর্তনাদ ভেসে আসতে ডক্টর বকসি তড়িঘড়ি সিঁড়ি ভেঙে উঠে গেলেন। অর্জুন দৌড়ে চলে এল পিনাকীরঞ্জন যে ঘরে শুয়ে ছিলেন, সেখানে। জোরে ঝাঁকুনি দিয়েও ভদ্রলোককে যখন জাগানো গেল না, তখন সে আর দেরি করল না। বাইরের দরজা খুলে দৌড়ে ঝিলের কাছে পৌঁছে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সে যখন ঝিলের প্রায় মাঝখানে, তখন দাড়িওয়ালা লোকটা ছুরি হাতে দরজা দিয়ে বেরিয়ে এপাশ-ওপাশ দেখছে ক্ষিপ্ত হয়ে। ডক্টর বকসি বেরিয়ে এলেন, এখানে দাঁড়িয়ে দেখছ কী? গেটের দিকে গিয়ে ওকে ধরো। আমি গেট লক করে দিয়েছি। ওদিকে দিয়ে পালাতে পারবে না। মনে রেখো, ছেলেটাকে ওখানেই মারা চলবে না।

দাড়িওয়ালা গেটের দিকে দৌড়োল।

এখন সন্ধের অন্ধকার ঘন ছায়া ফেলেছে ঝিলের জলে। অনেকটা সাঁতরে এপারে এসে হাঁপাতে লাগল অর্জুন। আপাতত সে বেঁচে গেলেও পিনাকীরঞ্জন মৃত্যুর মুখে রয়েছেন। বেশি দেরি করলে ওঁকে বাঁচানো যাবে না।

সে বাগানের মধ্যে দিয়ে স্যাংচুয়ারির পাঁচিলের কাছে চলে আসতেই দূরে চিৎকার উঠল। একজন পাহারাদার চেঁচিয়ে তাকে থামতে বলছে। আর দেরি না করে পাঁচিল ডিঙিয়ে রাস্তার ধারে চলে এল সে। মিনিটপাঁচেকের মধ্যে পেট্রল পাম্পে পৌঁছে অর্জুন অমিতাভকে ফোন করল, আপনি কোথায়?

থানায়।

থানায়?

গেস্ট হাউসে ফোন করে শুনলাম তুমি পিনাকীরঞ্জন মিত্রকে নিয়ে

করে শুনলাম তুমি পশন বেরিয়ে গিয়েছ। কোথায় গিয়েছ জানি। তখনই আমার বন্ধু, যিনি পুলিশের বড়কর্তা, তার সাহায্য নিই। তিনি থানাকে বলেছেন যা করার করতে। আমি থানায় বসে অপেক্ষা করছি। আর আধঘণ্টার মধ্যে কোনও খবর না পেলে তোমায় খুঁজতে যাব ভেবেছিলাম।

থানাটা কোথায়?

এই তো নবাবগঞ্জেই।

বাঁচালেন! আপনি এখনই পুলিশ নিয়ে ওই বাড়িতে চলে আসুন। পিনাকীবাবুর জীবন বিপন্ন, কুইক। কথা শেষ করতেই অর্জুন দেখল একটা সাইকেলে চেপে দাড়িওয়ালা পাম্পের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল। লোকটা নিশ্চয়ই তাকে খুঁজতে বেরিয়েছে। সামনাসামনি হলে ওর সঙ্গে শক্তিতে সে পেরে উঠবে না।

ফোনের টাকা নিয়ে বুথের ছেলেটা বলল, আপনি এরকম ভিজে গিয়েছেন কী করে?

ঝিলের জলে পড়ে গিয়েছিলাম, বলতে বলতে অর্জুন দেখল দাড়িওয়ালা লোকটা আবার ফিরে যাচ্ছে। পাম্প থেকে তেল নেওয়া একটা গাড়ি রাস্তায় বেরোতে সে হাত তুলে তাকে থামাল। তারপর ঝুঁকে গাড়ির ভিতরটা দেখে যেতে বলে সাইকেল চালিয়ে চলে গেল স্যাংচুয়ারির দিকে। ওকে খুব হতাশ দেখাচ্ছিল।

এখন অন্ধকার। হাইওয়ে দিয়ে হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে একের পর এক। অর্জুন সন্তর্পণে হাঁটছিল। হঠাৎ একটা জিপ রাস্তা ছেড়ে তার পাশে চলে এল এবং অমিতাভর গলা কানে এল, উঠে এসো।

পুলিশের জিপে অর্জুন উঠল। দারোগা ছাড়া চারজন সেপাই বসে আছে পিছনে। অমিতাভ অর্জুনের সঙ্গে দারোগার আলাপ করিয়ে দিলে তিনি ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের অভিযোগটা কী? উনি যদি একজন প্রতারক ডাক্তার হন, তা হলে তা প্রমাণ করতে পারবেন? দেখুন, আমরা যেন মানহানির মামলায় না পড়ি!

অর্জুন বলল, আপনার সে ভয় নেই। উনি শুধু প্রতারকই নন, পাক্কা ক্রিমিনাল! বাঁ দিকের রাস্তায় ঢুকতে হবে।

গেট বন্ধ ছিল। হর্ন দিল ড্রাইভার। তারপর সেপাইদের বলল গেট খুলে দিতে। কিন্তু তার আগেই হেডলাইটের আলোয় দাড়িওয়ালা এসে দাঁড়াল। চিৎকার করে বলল, এখন এখানে ঢোকা চলবে না। পারমিশন নেই।

দারোগা বললেন, আমি ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করব।

এখন উনি দেখা করবেন না। পারমিশন নেই, লোকটা বলল।

একজন সেপাই নেমেছিল জিপ থেকে। দারোগা তাকে আদেশ করলেন গেট খুলতে। এগিয়ে গিয়ে গেট খোলার চেষ্টা করল সেপাই কিন্তু গেট খুলল না। সেপাই ফিরে এসে বলল, কোনও তালা নেই কিন্তু গেট খুলছে না।

দারোগা ড্রাইভারকে বললেন, জিপটা এগিয়ে নিয়ে গিয়ে চাপ দিয়ে গেট ভেঙে ভিতরে ঢোকো।

আদেশ পাওয়ামাত্র জিপ এগিয়ে গিয়ে গেটে চাপ দিতেই সেটা ভেঙে দু’পাশে সরে গেল। এতক্ষণে দাড়িওয়ালা বুঝতে পেরেছে এটা পুলিশের জিপ। সে দৌড়োতে লাগল বাড়ির দিকে। জিপ ছুটল। লোকটার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই দুটো সেপাই লাফিয়ে নেমে পড়ল ওকে ধরতে। সঙ্গে সঙ্গে কোমর থেকে ছুরি বের করে উঁচিয়ে ধরল লোকটা, মেরে ফেলব। আর-এক পা এগোলেই মেরে ফেলব।

দারোগা জিপ থেকে নেমে টর্চের আলো ফেললেন লোকটার হিংস্র মুখে। তারপর শান্ত গলায় বললেন, ছুরিটা ফেলে দাও, নইলে গুলি চালাব।

লোকটা আচমকা লাফ দিয়ে রাস্তা থেকে পাশের জঙ্গলে ঢুকে পড়ে চোখের আড়ালে চলে গেল। দুটো সেপাই ওর পিছনে ধাওয়া করতে চেয়েছিল। কিন্তু দারোগা নিষেধ করলেন। মোবাইল বের করে বোতাম টিপে আরও ফোর্স চাইলেন। সেপাই দু’জনকে বললেন, তোমরা ওই গেটের কাছে লাঠি নিয়ে অপেক্ষা করো। ফোর্স এলে জঙ্গল সার্চ করবে। ওর হাতে ছুরি আছে কিন্তু তোমাদের লাঠি দিয়ে ওকে ঘায়েল করতে হবে, যদি ফোর্স আসার আগে ও বেরিয়ে যেতে চায়?

সেপাই দু’জন জিপ থেকে লাঠি বের করে নিয়ে গেটের দিকে চলে গেল।

.

সমস্ত বাড়ি অন্ধকার। বাড়ির ভিতরে কোনও মানুষ আছে কিনা, বোঝা যাচ্ছে না। সেদিকে তাকিয়ে দারোগা বললেন, বাড়িতে তো কেউ নেই দেখছি!

অর্জুন এগিয়ে গিয়ে বেল বাজাল। তৃতীয়বার বাজানোর পর আলো জ্বলল। মিনিটখানেক পর ফতুয়া গায়ে লুঙ্গিপরা টাকমাথা একটা লোক দরজা খুলে বলল, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বলে দরজা খুলতে দেরি হয়ে গেল। কসুর মাফ করবেন। আদেশ করুন।

ডক্টর বকসিকে ডেকে দিন, দারোগা গম্ভীর গলায় বললেন।

ডক্টরসাহেব তো কানপুর গিয়েছেন। শুক্রবার ফিরবেন।

কখন গিয়েছেন?

এই একটু আগে, চোস্ত উর্দুতে কথাগুলো বলল লোকটা।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি কে?

আমি ডক্টরসাহাবের গোলাম। একসময় আমার পূর্বপুরুষ ছিলেন নবাব বাহাদুর শাহ। এখন আমি পথের ভিখারি। ডক্টরসাহাব মহানুভব মানুষ, তিনি দয়া করেছেন বলে আমি এখানে দেখাশোনার কাজে আছি। লোকটি বলল।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আমরা ভিতরে যেতে পারি? উনি এখানকার দারোগা।

অবশ্যই আসবেন। আঃ! ডক্টরসাহাব থাকলে খুব খুশি হতেন। আসুন।

যে ঘরে ওরা প্রথমে বসেছিল, সেই ঘর থেকে দ্রুত হেঁটে অর্জুন দলটাকে নিয়ে চলে এল যেখানে পিনাকীরঞ্জন শুয়ে আছেন। গিয়ে তাজ্জব হয়ে গেল। পিনাকীরঞ্জন সেখানে নেই।

আপনি কি কিছু খুঁজছেন বাবু?

একটু আগে আমি আর-এক ভদ্রলোক এখানে এসেছিলাম। তখন আপনাকে দেখিনি। ভদ্রলোককে ডক্টর বকসি এখানে ঘুম পাড়িয়ে ফেলেছিলেন, আমি চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। সেই ভদ্রলোক কোথায়? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।

আমি বাজারে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে কাউকে দেখিনি। যদি আপনার কথা সত্যি হয়, তা হলে ঘুম ভেঙে গেলে তিনি চলে গিয়েছেন।

আমি এখান থেকে গিয়েছি মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট আগে।

ঘুম ভাঙানোর জন্য বাবুর এক সেকেন্ড লাগে। আমি তো কাউকে দেখিনি।

অমিতাভ বললেন, হয়তো পিনাকীবাবু লখনউ ফিরে গিয়েছেন।

অর্জুন হলঘরে এল। দারোগা কঙ্কাল দুটো দেখে চমকে উঠলেন, এ কী!

ডক্টরসাহাবের শখ। মেডিক্যাল কলেজ পুরনো কঙ্কাল বিক্রি করে দেয়। তাই কিনে নেন ডক্টরসাহাব।

অর্জুন উপরে উঠে এল। যে ঘরে রেফ্রিজারেটর আছে, সেখানে তখনও প্রচণ্ড দুর্গন্ধ। সে রেফ্রিজারেটরের দরজা খুলল। মাংসের সসপ্যান বা রান্না করা মাংস সেখানে নেই!

মাংসগুলো কোথায় গেল?

কোন মাংস?

এখানে পচা মাংস আর রান্না করা মাংস ছিল।

এ বাড়িতে তো কেউ মাংস খায় না। ডক্টরসাহাব নিরামিষ খান। আপনি বোধহয় ভুল দেখেছেন!

আমি ভুল দেখেছি? তা হলে এখনও পচা গন্ধ এখানে কী করে আছে?

ওহো! দু-দুটো বড় ছুঁচো মরে পড়েছিল এখানে। ফেলে দিলেও গন্ধ যায় না সহজে। লোকটি হাসল।

দারোগা বললেন, একমাত্র ওই দাড়িওয়ালা লোকটির আচরণ ছাড়া আমরা সন্দেহজনক কিছু পাচ্ছি না অর্জুনবাবু।

দাড়িওয়ালা? সেই পাগলটা আবার এসেছে নাকি?

আপনি চেনেন? দারোগা জিজ্ঞেস করলেন।

খুউব! ওরকম রাগী পাগল আমি কমই দেখেছি।

অর্জুন জানলায় গিয়ে দাঁড়াল। ঝিলের জলে পাখিরা যেন পাগল হয়ে গিয়েছে। তোলপাড় করছে জল। সে দারোগার কাছ থেকে টর্চ নিয়ে ঝিলের জলে আলো ফেলল। জানলার ঠিক সামনে রাজ্যের পাখি মারপিট করছে কিছু খাওয়ার জন্য। একটা বড় পাখি খাবার নিয়ে একটু উড়তেই তার মুখে মাংসের টুকরো দেখতে পেল বলে মনে হল অর্জুনের। ওরা এই জানলা দিয়ে মাংসগুলো ঝিলের জলে ফেলে দিয়েছে।

সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছিল সবাই। হঠাৎ অর্জুনের নজর পড়ল লোকটির গোড়ালিতে। লুঙ্গির নীচে গোড়ালির যেটুকু একঝলক দেখতে পেল, তাতে বুঝতে অসুবিধে হল না যে, লোকটা মোজা পরে আছে। কাজের লোক লুঙ্গির নীচে জুতো ছাড়া মোজা পরে ঘুরছে! অর্জুন আর দেরি না করে পিছন থেকে লোকটার দু’হাত টেনে ধরে বলল, ডক্টর বকসি, আপনার খেলা শেষ!

দারোগা বললেন, মানে?

ইনিই ডক্টর বকসি। আমার সঙ্গে দেখা করেছিলেন পরচুলা পরে। এখন নিজের টাক নিয়ে লুঙ্গি ফতুয়ায় কাজের লোক সেজেছেন, অর্জুন বলল।

একটু প্রতিবাদ করলেও শেষ পর্যন্ত ডক্টর বকসি ভেঙে পড়লেন। স্বীকার করলেন রেফ্রিজারেটরের মাংসগুলো মানুষের। মানুষের মাংস খেতে তার এবং দাড়িওয়ালার খুব ভাল লাগে। চট করে মৃতদেহ পাওয়া যায় না বলে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। ইতিমধ্যে দু’জন রোগী পেয়ে গিয়েছিলেন। তারা এসেছিলেন কেরল এবং গুজরাত থেকে। রোগী এবং তার এসকর্টদের খাদ্যবস্তু করেছেন ওঁরা।

পিনাকীরঞ্জনকে পাওয়া গেল বাড়ির নীচের চোরাকুঠরি থেকে। তিনটে কঙ্কালের পাশে শুয়ে ছিলেন তিনি। মাথায় জল ঢেলে চেতনা ফেরানো হল তার। চেতনা ফিরতেই কঙ্কাল দেখে ‘ওরে বাবা বলে লাফিয়ে উঠলেন।

একজন সেপাই ঝিলে ডুব দিয়ে মানুষের নাড়িভুড়ি ইত্যাদি বোঝাই বস্তা টেনে উপরে তুলল। সম্ভবত আগেই পচে গিয়েছিল, তার উপর চব্বিশ ঘণ্টা জলে থেকে সেগুলোর চেহারা বীভৎস, গন্ধও আরও কটু হয়ে গিয়েছে।

এই সময় আর-এক গাড়ি পুলিশ চলে এল বাড়ির সামনে। টর্চ নিয়ে তারা নেমে পড়ল দাড়িওয়ালাকে খুঁজতে।

দারোগা বললেন, অর্জুনবাবু, আপনাদের একটু কষ্ট করে থানায় যেতে হবে। পুরো ব্যাপারটা রেকর্ড করে রাখতে চাই।

অর্জুন মাথা নাড়ল। অমিতাভ বললেন, এতদিন বইয়ে ক্যানিব্যালের কথা পড়েছি। আফ্রিকার নরখাদক মানুষ। আজ চোখের সামনে দেখলাম। কী ভয়ংকর।

অর্জুন ডক্টর বকসির সামনে গিয়ে দাঁড়াল, ডক্টর বকসি, সত্যি ছদ্মবেশ ধরার ব্যাপারে আপনার দক্ষতা অসাধারণ। এমনকী উর্দু বলে আমাকেও বিভ্রান্ত করে ফেলেছিলেন। কিন্তু মানুষের মাংস খাওয়ার নেশা কবে থেকে হল?

বছরদশেক আগে। এক নাবিকের জীবনী পড়তে গিয়ে জানতে পারি, ওরা সমুদ্রে জাহাজডুবি হওয়ার পর দ্বীপে আশ্রয় নেয়। সেখানে কোনও প্রাণী ছিল না, যাকে মেরে খেতে পারে। সেখানে অনাহারে থাকার সময় ওদের মধ্যে একজন মারা যায়। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে তার মাংস ঝলসে খেয়ে নেয়। ওরা। প্রথমে ঘেন্না লাগলেও নাবিকটি স্বীকার করে মানুষের মাংস যে অত সুস্বাদু, সে আগে জানত না। ওটা পড়ার পর থেকে একটু-একটু করে আমার মনে খাওয়ার ইচ্ছে প্রবল হয়। তিরুবনন্তপুরমের হাসপাতালে কাজ করতাম আমি। সেখানকার মর্গ থেকে একটা হৃদরোগীর মৃতদেহ চুরি করে নিয়ে এসে খেয়ে বুঝলাম নাবিকের কথা সত্যি। তবে পচিয়ে খেলে আরও স্বাদ বাড়ে। যেমন শুঁটকি মাছ! রাঁধলে গন্ধ থাকে না। মৃতদেহ পাওয়া খুব মুশকিল। তা ছাড়া খারাপ রোগে মরলে অন্য বিপদ। তাই বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম। মরে যাওয়ার পরও প্রিয়জনের দেহ অবিকৃত অবস্থায় রেখে দেওয়া কোনও সভ্য সমাজই মেনে নেয় না। তাই সকলকে লুকিয়ে প্রিয়জনকে ওইভাবে রাখতে হবে। আমার কাছে নিয়ে এসে যদি ফিরে না যায়, তা হলে কেউ জানতে পারবে না ওরা কোথায় গিয়েছিল। কেরল বা গুজরাতের কেউ এখনও খোঁজ করেনি। আপনি অত্যন্ত ধূর্ত বলে পারলেন। অবশ্য আপনাকে দেখে প্রথমেই আমার সন্দেহ হয়েছিল। সেটাকে আমল দিইনি বলে ধরা পড়ে গেলাম।

এই সময় জঙ্গলে চিৎকার উঠল। হইহই! তারপর একজন সেপাই চিৎকার বলে উঠল, ধরা পড়েছে, ধরা পড়েছে।

ডক্টর বকসি বললেন, বেচারা। খুব বিশ্বস্ত লোক ও!

হঠাৎ পিনাকীরঞ্জন মিত্র বললেন, আমাকে একবার যেতে হবে। এখনই।

অমিতাভ বললেন, কোথায়?

আর কোথায়? ওই ইসবগুল খাওয়ার পর টেনশন হলেই… টয়লেট কোথায়?

অর্জুন হেসে ডক্টর বকসিকে বলল, টয়লেটে যাওয়ার পারমিশনটা দেবেন তো?

উত্তরের অপেক্ষা না করে পিনাকীরঞ্জন ছুটে গেলেন বাড়ির ভিতর।

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার