মাসী কহিলেন, কি আর বলব বাবা, কপালের লেখা কে খণ্ডাবে বল? এখন দাও একটু ওষুধ পিওনাথ, যাতে গোলোক চাটুয্যের উঁচু মাথা না নিচু হয়। একটা দেশের মাথা, সমাজের শিরোমণি! পুরুষমানুষ—তার দোষ কি বাবা? কিন্তু তার ঘরে এসে তুই ছুড়ি কি ঢলাঢলিটা করলি বল্‌ দিকি!

প্রিয়র মুখ ফ্যাকাশে হইয়া গেল। একবার জ্ঞানদার মুখখানা তিনি দেখিবার চেষ্টা করিলেন, তারপরে ধীরে ধীরে কহিলেন, তোমরা বরঞ্চ বিপিন ডাক্তারকে খবর দাও মাসী, এ-সব ওষুধ আমার কাছে নেই। বলিয়া তিনি হেঁট হইয়া নিজের বাক্সটা এবং বইগুলা সংগ্রহ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন।

রাসমণি আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, বল কি পিওনাথ, আর কি পাঁচ-কান করা যায়? হাজার হোক তুমি আপনার জন, আর বিপিন ডাক্তার পর, শূদ্দুর, বামুনের মান-মর্যাদা কি তারে বলা যায়?

কিন্তু বলিবার পূর্বেই সহসা দ্বার খুলিয়া নিঃশব্দে গোলোক প্রবেশ করিলেন এবং প্রিয়র বাঁ হাতটা চাপিয়া ধরিয়া মিনতি করিয়া কহিলেন, বিষের ভয়ে ও যে আর কারও ওষুধ খেতে চায় না বাবা, নইলে কষ্ট তোমাকে দিতাম না। এ বিপদটি তোমাকে উদ্ধার করতেই হবে, প্রিয়নাথ।

প্রিয় হাত ছাড়াইয়া লইয়া বলিলেন, না, না, ওসব নোংরা কাজের মধ্যে আমি নেই। আমি রোগী দেখি, রেমিডি সিলেক্ট করি, ব্যস্‌! বিপিন-টিপিনকে ডেকে পরামর্শ করুন—আমি ওসব জানি-টানিনে। বলিয়া আর একবার তিনি বইগুলা বগলে চাপিবার আয়োজন করিলেন।

গোলোক সেই হাতটা তাহার আর একবার নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া প্রায় কাঁদ-কাঁদ গলায় কহিতে লাগিলেন, প্রিয়নাথ, বুড়োমানুষের কথাটা রাখো বাবা। সম্পর্কে তোমার আমি শ্বশুরই হই। রাখবে না জানলে যে তোমাকে আমরা বলতাম না। দোহাই বাবা, একটা উপায় করে দাও—হাতে ধরচি তোমার—

প্রিয়নাথ হাতটা পুনরায় ছাড়াইয়া লইয়া কহিলেন, সম্পর্কে শ্বশুর হন বলে কি আপনার কথায় জীবহত্যা করব? আচ্ছা লোক ত আপনি! পরলোকে জবাব দেব কি!

গোলোক দ্বারের কাছে সরিয়া গেলেন। তাঁহার মুখের চেহারা, চোখের ভাব, গলার স্বর সমস্তই যেন অদ্ভুত জাদুবলে এক নিমিষে পরিবর্তিত হইয়া গেল। কর্কশকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, এত রাত্রে তুমি ভদ্রলোকের বাড়ির ভেতরে ঢুকেচ কেন? এখানে তোমার কি দরকার?

প্রশ্ন শুনিয়া প্রিয় শুধু আশ্চর্য নয়, হতবুদ্ধি হইয়া গেলেন; বলিলেন, কি দরকার! বাঃ- বেশ ত! চিকিৎসা করতে কে ডেকে পাঠালে? বাঃ—

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়