বিপ্রদাস কাছে আসিয়া তাহার মাথায় হাত রাখিয়া নীরবে আশীর্বাদ করিলেন, এবং আজ এই প্রথম দিন বন্দনা তাঁহার পায়ের উপর বহুক্ষণ ধরিয়া মাথা পাতিয়া নমস্কার করিল। উঠিয়া দাঁড়াইলে বিপ্রদাস কহিলেন, আজ যাকে তুমি পেলে বন্দনা, তার চেয়ে দুর্লভ ধন আর নেই। এ কথাটা আমার চিরদিন মনে রেখো।
বন্দনা কহিল, রাখবো বড়দা। একদিনও ভুলবো না।
একটু থামিয়া কহিল, একদিন অসুখে আপনার সেবা করেছিলুম, আপনি পুরস্কার দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেদিন নিইনি,—মনে পড়ে সে কথা?
পড়ে।
আজ সেই পুরস্কার চাই। বাসুকে আমি নিলুম।
বিপ্রদাস হাসিমুখে বলিলেন, নাও।
তাকে শেখাবো আমাকে মা বলে ডাকতে।
তাই করো। ওর মা এবং বাপ দু’জনকেই আজ রেখে গেলাম তোমার মধ্যে। আর রেখে গেলাম এই মুখুয্যেবাড়ির বৃহৎ মর্যাদাকে তোমার হাতে।
বন্দনা ক্ষণকাল মাথা হেঁট করিয়া এই ভার যেন নীরবে গ্রহণ করিল, তারপরে কহিল, আর একটি প্রার্থনা। নিজেকে চিনতে না পেরে একদিন আপনার কাছে অপরাধ করেছিলুম। ভুল ভেঙ্গেচে, আজ তার মার্জনা চাই।
মার্জনা অনেকদিন করেছি বন্দনা। আমি জানতাম তোমার অন্তর যাকে একান্তমনে চেয়েছে একদিন তাকে তুমি চিনবেই। তাই, আমার কাছে তোমার কোন লজ্জা নেই।
বন্দনার চোখে আবার জল আসিতেছিল, জোর করিয়া নিবারণ করিয়া বলিল, আরও একটি ভিক্ষে। আমাদের সংসারে কি একদিনও থাকবেন না আর? অভিমানে, সঙ্কোচে কোনদিন মন পূর্ণ করে আপনাকে যত্ন করতে পাইনি, কিন্তু সে বাধা ত ঘুচলো; আর ত আমার লজ্জা নেই—কিছুদিন থাকুন না আমার কাছে? দু’দিন পূজো করি। এই বলিয়া সে সজল চক্ষে চাহিয়া রহিল,—তাহার আকুল কণ্ঠস্বর যেন অন্তর ভেদ করিয়া বাহিরে আসিল।
বিপ্রদাস হাসিমুখে চুপ করিয়া রহিলেন।
বন্দনা বলিল, ওই হাসিমুখের মৌনতাকেই আমি সবচেয়ে ভয় করি বড়দা। কি কঠোর আপনার মন, একে না পারা যায় গলাতে, না পারা যায় টলাতে। দেবেন না উত্তর?
বিপ্রদাস এবার হাসিয়া ফেলিলেন। যেমন স্নিগ্ধ, তেমনি সুন্দর, তেমনি নির্মল। তাঁহাকে এমন করিয়া হাসিতে বন্দনা যেন এই প্রথম দেখিল। বলিল, উত্তর পেলুম, আর আপনাকে আমি পীড়াপীড়ি করব না। কিন্তু মনকে শান্ত করি কি করে বলে দিন। এ যে কেবলি কেঁদে উঠতে চায়।
বিপ্রদাস বলিলেন, মন আপনি শান্ত হবে বন্দনা, যেদিন নিঃসংশয়ে বুঝবে তোমার দাদা দুঃখের মাঝে ঝাঁপ দিতে গৃহত্যাগ করেনি। কিন্তু তার আগে নয়।
কিন্তু এ বুঝবো আমি কেমন করে?
শুধু আমাকে বিশ্বাস করে। জানো ত দিদি, আমি মিছে কথা বলিনে।
বন্দনা চুপ করিয়া রহিল। মিনিট-দুই পরে গভীর নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, তাই হবে। আজ থেকে প্রাণপণে বোঝাবো নিজেকে, বড়দা, সত্যি কথাই বলে গেছেন, সত্যবাদী তিনি, মিছে কথায় ভুলিয়ে চলে যাননি। যেখানে আছে মানুষের চরম শ্রেয়ঃ, সেই তীর্থেই তিনি যাত্রা করেছেন।
উপন্যাস : বিপ্রদাস Chapter : 26 Page: 148
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: বিপ্রদাস
- Read Time: 1 min
- Hits: 156