বিপ্রদাস তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল না, কয়েক মুহূর্ত নীরবে থাকিয়া কহিল, না, অপমান তোমাকে মা করেন নি। কিন্তু তিনি নিজে ছাড়া এ কথা তোমাকে কেউ বোঝাতে পারবে না। তর্ক করে নয়, তাঁর কাছে থেকে এ কথা বুঝতে হবে।

বন্দনা জানালার বাহিরে চাহিয়া রহিল।

বিপ্রদাস বলিতে লাগিল, একদিন বাবার সঙ্গে মার ঝগড়া হয়। কারণটা তুচ্ছ, কিন্তু হয়ে দাঁড়াল মস্ত বড়। তোমাকে সকল কথা বলা চলে না, কিন্তু সেই দিন বুঝেছিলাম আমার এই লেখাপড়া-না-জানা মায়ের আত্মমর্যাদাবোধ কত গভীর।

বন্দনা সহসা ফিরিয়া দেখিল, অপরিসীম মাতৃগর্বে বিপ্রদাসের সমস্ত মুখ যেন উদ্ভাসিত হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু সে কিছুই না বলিয়া জানালার বাহিরেই চাহিয়া রহিল।

বিপ্রদাস বলিতে লাগিল, অনেকদিন পরে কি একটা কথার সূত্রে একদিন এই কথাই মাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম— মা, এত বড় আত্মমর্যাদাবোধ তুমি পেয়েছিলে কোথায়?

বন্দনা মুখ না ফিরাইয়াই কহিল, কি বললেন তিনি?

বিপ্রদাস কহিল, জান বোধ হয় মায়ের আমি আপন ছেলে নই। তাঁর নিজের দুটি ছেলেমেয়ে আছে—দ্বিজু আর কল্যাণী। মা বললেন, তোদের তিনটিকে একসঙ্গে এক বিছানায় যিনি মানুষ করে তোলবার ভার দিয়েছিলেন, তিনিই এ বিদ্যে আমাকে দান করেছিলেন বাবা, অন্য কেউ নয়। সেই দিন থেকেই জানি মায়ের এই গভীর আত্মসম্মানবোধই কাউকে একটা দিনের জন্যে জানতে দেয়নি, তিনি আমার জননী নন, বিমাতা। বুঝতে পার এর অর্থ?

ক্ষণকাল নীরবে থাকিয়া পুনরায় সে বলিতে লাগিল, অভিবাদনের উত্তরে কে কতটুকু হাত তুললে, কতটুকু সরে দাঁড়াল, নমস্কারের প্রতি-নমস্কারে কে কতখানি মাথা নোয়ালে, এই নিয়ে মর্যাদার লড়াই সকল দেশেই আছে, অহঙ্কারের নেশার খোরাক তোমাদের পাঠ্যপুস্তকের পাতায় পাতায় পাবে, কিন্তু মা না হয়েও পরের ছেলের মা হয়ে যেদিন মা আমাদের বৃহৎ পরিবারে প্রবেশ করলেন, সেদিন আশ্রিত আত্মীয়-পরিজনদের গলায় গলায় বিষের থলি যেন উপচে উঠল। কিন্তু যে বস্তু দিয়ে তিনি সমস্ত বিষ অমৃত করে তুললেন, সে গৃহকর্ত্রীর অভিমান নয়, সে গৃহিণীপনার জবরদস্তি নয়, সে মায়ের স্বকীয় মর্যাদা। সে এত উঁচু যে তাকে কেউ লঙ্ঘন করতে পারলে না। কিন্তু এ তত্ত্ব আছে শুধু আমাদের দেশে। বিদেশীরা এ খবর ত জানে না, তারা খবরের কাগজের খবর দেখে বলে এদের দাসী, বলে অন্তঃপুরে শেকল-পরা বাঁদী। বাইরে থেকে হয়ত তাই দেখায়—দোষ তাদের দিইনে, কিন্তু বাড়ির দাসদাসীরও সেবার নীচে অন্নপূর্ণার রাজ্যেশ্বরী মূর্তি তাদের যদিও বা না চোখে পড়ে, তোমাদেরও কি পড়বে না?

বন্দনা অভিভূত-চক্ষে বিপ্রদাসের মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়