দ্বিজদাস সোজা উপরে উঠিয়া গেল। পর্দা সরাইয়া ভিতরে প্রবেশ করিয়া দেখিল বন্দনার কোলের উপর বই খোলা, কিন্তু সে জানালার বাহিরে চাহিয়া স্থির হইয়া আছে। একটা ছত্রও পড়িয়াছে কিনা সন্দেহ, বুঝিয়াও শুধু কথা আরম্ভ করিবার জন্যই সে প্রশ্ন করিল, কি বই পড়ছিলেন?
বন্দনা বই মুড়িয়া টেবিলে রাখিল, দাঁড়াইয়া উঠিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আপনার ফিরতে এত দেরি হলো যে? কলকাতার গাড়ি ত গেছে কোন্ কালে।
দ্বিজদাস বলিল, দেরি হোক তবু ত ফিরেচি। না ফিরলেও ত পারতুম।
বন্দনা বলিল, অনায়াসে।
দ্বিজদাস একমুহূর্ত নীরব থাকিয়া বলিল, ঠিক এই কথাটাই আমার প্রথমে মনে হয়েছিল। গাড়ি ছেড়ে দিলে, জানালায় গলা বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাসু হাত নাড়তে লাগলো, ক্রমশঃ তার ছোট্ট হাতখানি গেল বাঁকের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে। প্রথমে মনে হলো গেলেই হতো ওদের সঙ্গে—
বন্দনা কহিল, আপনি বাসুকে ভারী ভালবাসেন, না?
দ্বিজদাস একটু ভাবিয়া বলিল, দেখুন জবাব দেবো কি, এ-সব জিনিসের আমি বোধ হয় স্বরূপই জানিনে। প্রকৃতিটা এত রুক্ষু, এমন নীরস যে, দু’দণ্ডেই সমস্ত উবে গিয়ে শুকনো বালি আবার তেমনি ধূধূ করে। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে চোখে একবার জল এলো, কিন্তু তখনি আবার আপনিই শুকলো,—বাষ্পের চিহ্নও রইলো না।
বন্দনা কহিল, এ একপ্রকার ভগবানের আশীর্বাদ।
দ্বিজদাস বলিতে লাগিল, কি জানি, হতেও পারে। অথচ, এই বাসুর ভয়েই মা কাল থেকে ঘরে দোর দিয়ে আছেন। নইলে দাদার জন্যেও না, বৌদিদির জন্যেও না। মা ভাবেন বাসুকে বুঝি তিনি মানুষ করেছেন, কিন্তু হিসেব করলে দেখতে পাবেন ওর বয়সের অর্ধেক কাল কেটেছে ওঁর তীর্থবাসে। তখন কার কাছে থাকতো ও? আমার কাছে। টাইফয়েড জ্বরে কে জেগেছে ষাট দিন? আমি। আজ যাবার সময় কে দিলে সাজিয়ে? আমি। ওর জামাকাপড় থাকে আমার আলমারিতে, ওর বই-শ্লেটের জায়গা হলো আমার টেবিল, ওর শোবার বিছানা আমার খাটে। মা টানাটানি করে নিয়ে যান—কিন্তু কত রাতে ঘুম ভেঙ্গে ও পালিয়ে এসেছে আমার ঘরে।
বন্দনা নির্নিমেষে চাহিয়াছিল, বলিল, তবু ত চোখের জল শুকিয়ে যেতে এক মুহূর্তের বেশি লাগে না।
দ্বিজদাস কহিল, না। এই আমার স্বভাব। ওকে নিয়ে আমার ভাবনা শুধু এই যে, সে পড়বে গিয়ে তার বাপ–মায়ের হাতে। আপনি বলবেন, জগতে এই ত স্বাভাবিক, এতে ভয়ের কি আছে? কিন্তু স্বাভাবিক বলেই বিপদ হয়েছে এই যে, এত বড় উলটো কথাটা মানুষকে আমি বোঝাবো কি করে!
বন্দনা এ কথা বলিল না যে, বুঝাইবার প্রয়োজনই বা কি! অন্যপক্ষে বাপ-মায়ের বিরুদ্ধে এত বড় অভিযোগ সত্য বলিয়া বিশ্বাস করাও তাহার কঠিন, বিশেষতঃ, বিপ্রদাসের বিরুদ্ধে। কিন্তু কোন তর্ক না করিয়া সে নীরব হইয়াই
রহিল।
পরক্ষণে বক্তব্য স্পষ্টতর করিতে দ্বিজদাস নিজেই কহিল, একটা সান্ত্বনা বৌদি রইলেন কাছে, নইলে দাদার হাতে দিয়ে আমার তিলার্ধ শান্তি থাকতো না।
উপন্যাস : বিপ্রদাস Chapter : 24 Page: 123
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: বিপ্রদাস
- Read Time: 1 min
- Hits: 167