বৌদি করচো কি? বাহির হইতে দ্বিজদাসের আর একদফা তাগাদা আসিল।
যাচ্চি ভাই, হয়েছে—বলিয়া সতী তাড়াতাড়ি বাহির হইয়া পড়িল।
স্টেশন হইতে দ্বিজদাস যখন একাকী ফিরিয়া আসিল তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়াছে। ঘরে ঘরে তেমনি আলো জ্বলিয়াছে, তেমনিভাবেই লোকজন আপন-আপন কাজে ব্যস্ত, এই বৃহৎ পরিবারে কোথায় কি বিপ্লব ঘটিয়াছে কেহ জানেও না। বাহিরের মহলে উপরে বিপ্রদাসের বসিবার ঘরের জানালা-দরজা বন্ধ,—ও দিকটা অন্ধকার। এমন কত দিনই আলো জ্বলে না, বিপ্রদাস থাকেন কলিকাতায়, অভাবনীয় কিছুই নয়। সিঁড়ির বাঁ দিকের ঘরটায় থাকে অশোক, জানালা দিয়া চোখে পড়িল ইজি-চেয়ারে পা ছড়াইয়া বাতির আলোকে সে নিবিষ্টচিত্তে কি একখানা বই পড়িতেছে। কলেজ কামাই করিয়া অক্ষয়বাবু আজও আছেন, তাঁর ঘরটা শেষের দিকে, তিনি ঘরে আছেন কিংবা বায়ু-সেবনে বহির্গত হইয়াছেন জানা গেল না। মোটর হইতে প্রাঙ্গণে পা দিয়াই দ্বিজদাসের চোখে পড়িয়াছিল ত্রিতলের লাইব্রেরিঘরটা। সন্ধ্যার পরে এ ঘরটা প্রায় থাকে অন্ধকার, আজ কিন্তু খোলা জানালা দিয়া আলো আসিতেছে। তাহার সন্দেহ রহিল না এখানে আছে বন্দনা। বই পড়িতে নয়, চোখ মুছিতে। লোকের সংস্রব হইতে আত্মরক্ষা করিতে সে এই নির্জনে আশ্রয় লইয়াছে। আজ রাত্রিটা কোনমতে কাটাইয়া সে কাল চলিয়া যাইবে সুদূর বোম্বাই অঞ্চলে—যেখানে মানুষ হইয়া সে এত বড় হইয়াছে—যেখানে আছে তাহার পিতা, আত্মীয়-স্বজন, তাহার কত দিনের কত বন্ধু এবং বান্ধবী। কোনদিন কোন ছলে কখনো যে এ গ্রামে তাহার আবার আসা সম্ভব ভাবাও যায় না। না আসুক কিন্তু এ বাড়ি সে সহজে ভুলিবে না। বিচিত্র এ দুনিয়া,—কত অদ্ভুত অভাবিত ব্যাপারই না এখানে নিমিষে ঘটে। একটা একটা করিয়া সেই প্রথম দিন হইতে আজ পর্যন্ত সকল কথাই দ্বিজুর মনে পড়িল। সেই হঠাৎ আসা আবার তেমনি হঠাৎ রাগ করিয়া যাওয়া। মধ্যে শুধু ঘণ্টা-খানেকের আলাপ-আলোচনা। সেদিন বন্দনা সহাস্যে বলিয়াছিল, শুধু চোখের পরিচয়টাই নেই দ্বিজুবাবু, নইলে দেওরের গুণাগুণ লিখে পাঠাতে মেজদি কখনো আলস্য করেন নি। আমি সমস্ত জানি, আপনার সম্বন্ধে আমার কিছু অজানা নেই। যতদিন যত জ্বালিয়েছেন বাড়িসুদ্ধ লোককে, তার সমস্ত খবর পৌঁচেছে আমার কাছে। দ্বিজদাস জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, আমরা কেউ কারুকে চিনিনে, তবু আপনার কাছে আমার দুর্নাম প্রচার করার সার্থকতা ছিল কি? বন্দনা হাসিয়া জবাব দিয়াছিল, বোধ করি আসলে মেজদি আপনাকে দেখতে পারতেন না,—এ তারই প্রতিশোধ।
তার পরে দুজনেই হাসিয়া কথাটাকে পরিহাসে রূপান্তরিত করিয়াছিল। কিন্তু সেদিন উভয়ের কেহই ভাবে নাই এ ছিল সতীর দ্বিজুর প্রতি বন্দনার চিত্ত আকর্ষণের কৌশল। যদি কখনো বোনটিকে কাছে আনা যায়, যদি কখনো তাহার হাতে দিয়া অশান্ত দেবরটিকে শাসন মানানো চলে। কিন্তু সে ঘটিল না, তাহার গোপন বাসনা গোপনেই রহিয়া গেল,—আজও দুজনের কেহই সে-সব চিঠির অর্থ খুঁজিয়া পাইল না।
উপন্যাস : বিপ্রদাস Chapter : 24 Page: 122
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: বিপ্রদাস
- Read Time: 1 min
- Hits: 202