বন্দনা সেখান হইতেই আস্তে আস্তে বলিল, কেন হবে না বাবা, তুমি সঙ্গে থাকলে ত ভালই হয়।

রায়সাহেব উৎসাহ-ভরে কহিলেন, তাতে আরও একটা সুবিধে এই হবে যে, তোদের বিয়ের পরেও মাস-খানেক সময় পাওয়া যাবে, কোনরকম তাড়াহুড়ো করতে হবে না।
বুঝলে না সুধীর, সুবিধেটা?

ইহাতে সুধীর ও বন্দনা উভয়েই মাথা নাড়িয়া সায় দিল। দয়াময়ী এতক্ষণে বুঝিলেন এই ছেলেটি রায়সাহেবের ভাবী জামাতা। অতএব, তাঁহারও পুত্র-স্থানীয়। বুকের ভিতরটায় হঠাৎ একবার তোলপাড় করিয়া উঠিল, কিন্তু তিনি বিপ্রদাসের মা, বলরামপুরের বহুখ্যাত মুখুয্যে-পরিবারের কর্ত্রী, মুহূর্তে নিজেকে সংবরণ করিয়া লইয়া ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, সুধীর, তোমাদের বাড়ি কোথায় বাবা?

সুধীর কহিল, এখন বোম্বায়ে। কিন্তু বাবার মুখে শুনেচি আগে ছিল দুর্গাপুরে, কিন্তু বর্তমানে সেখানে বোধ করি আমাদের আর কিছু নেই।

কোন্‌ দুর্গাপুর সুধীর? বর্ধমান জেলার?

সুধীর বলিল, হাঁ, বাবার মুখে তাই শুনেচি। কালনার কাছে কোন্‌ একটি ছোট্ট গ্রাম, এখন নাকি সে দেশ ম্যালেরিয়ায় ধ্বংস হয়ে গেছে।

দয়াময়ী ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া প্রশ্ন করিলেন, তোমার বাবার নামটি কি?

সুধীর বলিল, আমার বাবার নাম শ্রীরামচন্দ্র বসু।

দয়াময়ী চমকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমার পিতামহের নাম কি ছিল হরিহর বসু?

প্রশ্ন শুনিয়া রায়সাহেব পর্যন্ত বিস্ময়াপন্ন হইলেন, বলিলেন, আপনি কি ওদের জানেন নাকি?

হাঁ, জানি। দুর্গাপুরে আমার মামার বাড়ি। ছেলেবেলায় দিদিমার কাছে মানুষ হয়েছি বলে ও-গ্রামের প্রায় সকলকেই চিনি। ওঁদের বাড়ি ছিল আমাদের পাড়ায়। কিন্তু এখন আর কথা কইবার সময় নেই সুধীর, আমার আহ্নিকের দেরি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিছু না খেয়েও যেন তুমি চলে যেও না,—আমি এখনি সমস্ত ঠিক করে দিতে বলচি।

সুধীর সহাস্যে কহিল, তার আর বাকি নেই,—বিপ্রদাসবাবু আগেই সে কাজ সমাধা করে দিয়েছেন।

দিয়েছে? আচ্ছা, তা হলে এখন আমি আসি, এই বলিয়া দয়াময়ী বাহির হইয়া গেলেন। বন্দনার প্রতি একবারও চাহিলেন না, একটা কথাও বলিলেন না।

পরদিন সকালে স্নান-আহ্নিক সারিয়া বিপ্রদাস প্রতিদিনের অভ্যাসমত মায়ের পদধূলির জন্য আজও তাঁহার ঘরে প্রবেশ করিয়া ভয়ানক আশ্চর্য হইয়া দেখিল তাঁহার জিনিসপত্র বাঁধাছাঁদা হইতেছে।

এ কি মা, কোথাও যাবে নাকি?

দয়াময়ী বলিলেন, তোকে খুঁজে পেলুম না, তাই দত্তমশায়কে জিজ্ঞেসা করে জানলুম সাড়ে-নটার গাড়িতে বার হতে পারলে সন্ধ্যার আগেই বাড়ি পৌঁছতে পারব। কিন্তু পরশু তোর মকদ্দমার দিন, তুই ত সঙ্গে যেতে পারবি নে, দ্বিজুকে বলে দে, ও আমাদের পৌঁছে দিয়ে আসুক।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়