আর কোন সময়ে দয়াময়ী নিজেও হাসিয়া হয়ত কত কথাই ছেলেকে বলিতেন, কিন্তু এখন চুপ করিয়া রহিলেন।

অন্নদা বন্দনাকে ডাকিতে গিয়াছিল, সে এইমাত্র স্নান করিয়া পিতার ঘরে যাইতেছিল, অন্নদার আহ্বানে দ্রুতপদে নীচে আসিয়া ব্যাপার দেখিয়া হতবুদ্ধি হইয়া রহিল। দয়াময়ী কহিলেন, আজ আমরা বাড়ি যাচ্চি বন্দনা!

বাড়ি? সেখানে কি হয়েচে মা?

না, হয়নি কিছু। কিন্তু দুদিনের জন্যে এসে দশ-বারো দিন দেরি হয়ে গেল, আর বাড়ি ছেড়ে থাকা চলে না। তোমার বাবার সঙ্গে দেখা হলো না—তখনো তিনি ওঠেন নি—আমার ত্রুটি যেন বেহাই মার্জনা করেন। দ্বিজু রইল, অন্নদা রইল, তুমিও দেখো যেন তাঁর অযত্ন না হয়। এসো বৌমা, আর দেরি করো না, এই বলিয়া তিনি গাড়িতে গিয়া উঠিলেন।

সতী পিছনে ছিল, সে কাছে আসিয়া বোনের হাত ধরিয়াই কাঁদিয়া ফেলিল,—আমরা চললুম ভাই—আর কিছু তাহার মুখ দিয়া বাহির হইল না, চোখ মুছিতে মুছিতে গাড়িতে তাহার শাশুড়ীর পাশে গিয়া বসিল।

বন্দনা স্তব্ধ-বিস্ময়ে নির্বাক দাঁড়াইয়া,—যেন পাথরের মূর্তি, অকস্মাৎ এ কি হইল!

বাসু আসিয়া যখন তাহার পায়ের কাছে প্রণাম করিয়া বলিল, আমি যাচ্চি মাসীমা,—তখনই তাহার চৈতন্য হইল, তাহারও এখনো কাহাকেও প্রণাম করা হয় নাই। তাড়াতাড়ি বাসুর কপালে একটা চুমা দিয়া সে গাড়ির দরজার কাছে আসিয়া হাত বাড়াইয়া দয়াময়ী ও মেজদির পায়ের ধূলা লইল। সতী নীরবে তাহার চিবুক স্পর্শ করিল, মা অস্ফুটে আশীর্বাদ করিলেন, কিন্তু কি বলিলেন, বুঝা গেল না। মোটর ছাড়িয়া দিল।

অন্নদা কহিল, চল দিদি, আমরা ওপরে যাই।

তাহার স্নেহের কণ্ঠস্বরে বন্দনা লজ্জা পাইল, ক্ষণকালের বিহ্বলতা সজোরে ঝাড়িয়া ফেলিয়া বলিল, তুমি যাও অন্নদা, আমি রান্নাঘরের কাজগুলো সেরে নিয়ে যাচ্চি। এই বলিয়া সেই দিকে চালিয়া গেল।

কাল বিকালেও কথা হইয়াছিল রায়সাহেব বোম্বাই রওনা হইলে সকলে একত্রে বলরামপুর যাত্রা করিবেন। কিন্তু আজ তাহার উল্লেখ পর্যন্ত নয়, সুদূর ভবিষ্যতে কোন একদিনের মৌখিক আহ্বান পর্যন্ত নয়।

ঘণ্টা-খানেক পরে নিজের হাতে চায়ের সরঞ্জাম লইয়া বন্দনা পিতার ঘরে গেলে তিনি অত্যন্ত আক্ষেপ-সহকারে বলিয়া উঠিলেন, বেহানরা চলে গেলেন, সকালে উঠতে পারিনি মা, ছি ছি, কি না-জানি আমাকে তাঁরা মনে করে গেলেন!

বন্দনা বলিল, বাবা, আমরা কবে বোম্বায়ে যাব?

বাবা বলিলেন, তোমার যে বলরামপুরে যাবার কথা ছিল মা, গেলে না কেন?

মেয়ে বলিল, তোমাকে একলা ফেলে রেখে কি করে যাব বাবা, তুমি যে আজও ভাল হতে পারনি।

ভাল ত হয়েছি মা। বেহানকে কথা দেওয়া হয়েছে তুমি যাবে, না হয়, যাবার পথে আমি তোমাকে বলরামপুরে নাবিয়ে দিয়ে যাব। কি বল মা?

না বাবা, সে হবে না। তোমাকে এতটা পথ একলা যেতে আমি দিতে পারব না।

কন্যার কথা শুনিয়া পিতা পুলকিতচিত্তে তিরস্কার করিয়া বলিলেন, দূর বুড়ি! দেখা হলে বেয়ান তোরে ঠাট্টা করে বলবে, বুড়ো বাপটাকে মেয়েটা চোখের আড়াল করতে পারে না। ছি—ছি—

তুমি খাও বাবা, আমি আসচি, এই বলিয়া বন্দনা বাহির হইয়া গেল।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়