অন্নদা বলিল, টাকার টান নয় দিদি, আজ দুদিন থেকে তিনি নিজেও শয্যাগত। ছেলের অসুখে সেখানে তারা বিব্রত, খবর দেওয়াও যায় না, অথচ এখানে দত্তমশাই পর্যন্ত নেই—তিনি গেছেন ঢাকায়, একা আমি মুখ্যু মেয়েমানুষ কিছুই বুঝিনে, ভয় হয় অসুখটা পাছে শক্ত হয়ে ওঠে। বিপিনের কখনো কিছু হয় না বলেই ভাবনা। বিয়েটা চুকে গেলে একবার পারবে না যেতে দিদি?
শঙ্কায় বন্দনার মুখ বিবর্ণ হইয়া উঠিল,—ডাক্তার এসেছেন? কি বলেন তিনি?
বললেন, ভয় নেই, কিন্তু সেই সঙ্গে অন্য ডাক্তার ডাকতেও বলে গেলেন। অন্নদার চোখ জলে ভরিয়া গেল, বন্দনার হাত চাপিয়া ধরিয়া কহিল, এ দুটো দিন যেমন করে হোক কাটাবো, কিন্তু বিয়ে চুকে গেলেও যাবে না? আমাদের ওপর রাগ করেই থাকবে? তোমাদের কোথায় কি ঘটেছে আমার জানবার কথা নয়, জানিও নে, কিন্তু এ জানি আর
যে-ই দোষ করে থাক বিপিন কখনো করেনি। তাকে না জানলে হয়ত ভুল হয়, কিন্তু জানলে এ ভুল হবে না দিদি।
বন্দনা ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, বলিল, চলো আমি যাচ্ছি।
এখুনি যাবে?
হ্যাঁ, এখুনি বৈ কি।
বাড়িতে বলে যাবে না? এঁরা ভাববেন যে।
বলতে গেলে দেরি হবে অনুদি, তুমি এসো। এই বলিয়া সে উত্তরের অপেক্ষা না করিয়া মোটরে গিয়া বসিল। বেহারাকে ইঙ্গিতে কাছে ডাকিয়া বলিয়া দিল, মাসীমাকে জানাইতে সে মেজদির বাড়িতে চলিল, সেখানে বিপ্রদাসবাবুর অসুখ!
বন্দনা আসিয়া যখন বিপ্রদাসের ঘরে প্রবেশ করিল তখন বেলা গেছে কিন্তু আলো জ্বালার সময় হয় নাই। বিপ্রদাস বালিশগুলা জড়ো করিয়া দেওয়ালে হেলান দিয়া বিছানায় বসিয়া, মুখ দেখিয়া মনে হয় না যে অসুখ গুরুতর। মনের মধ্যে স্বস্তি বোধ করিয়া বলিল, মুখুয্যেমশাই, নমস্কার করি। মেজদি উপস্থিত থাকলে রাগ করতেন, বলতেন, গুরুজনের পায়ের ধুলো নিয়েই প্রণাম করতে। কিন্তু ছুঁতে ভয় করে পাছে ছোঁয়া যান!
বিপ্রদাস কিছুই না বলিয়া শুধু একটু হাসিল। বন্দনা বলিল, ডেকে পাঠিয়েছেন কেন,—সেবা করতে? অনুদি বলছিলো ওষুধ খাওয়াবার সময় হয়েছে। কিন্তু একি ব্যাপার! ডাক্তারি ওষুধের শিশি যে? কবরেজের বড়ি কৈ? ডাক্তার ডাকার বুদ্ধি দিলে কে আপনাকে?
বিপ্রদাস কহিল, আমাদের চলতি ভাষায় ডেঁপো বলে একটা কথা আছে তার মানে জানো বন্দনা?
বন্দনা বলিল, জানি মশাই জানি। মানুষ হয়ে যারা মানুষকে ঘেন্না করে, ছোঁয় না তাদের বলে। তাদের চেয়ে বড় ডেঁপো সংসারে আর কেউ আছে নাকি?
বিপ্রদাস বলিল, আছে। যাদের সত্যি-মিথ্যে যাচাই করবার ধৈর্য নাই, অকারণে নির্দোষীকে হুল ফুটিয়ে যারা বাহাদুরি করে তারা। তাদের দলের মস্তবড় পাণ্ডা তুমি নিজে।
অকারণে কোন্ নির্দোষী ব্যক্তিটিকে হুল ফুটিয়েছি আপনি বলে দিন ত শুনি?
আমাকে বলে দিতে হবে না বন্দনা, সময় এলে নিজেই টের পাবে।
উপন্যাস : বিপ্রদাস Chapter : 17 Page: 74
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: বিপ্রদাস
- Read Time: 1 min
- Hits: 193