সতর
হঠাৎ বড়মাসীর সঙ্গে হাওড়া স্টেশনে বন্দনার যখন দেখা হইয়া গেল তখন বোম্বাই যাওয়া বন্ধ করিয়া তাহাকে বাড়ি ফিরাইয়া আনা মাসীর কষ্টসাধ্য হইল না। তিনি মেয়ের বিবাহ-উপলক্ষে স্বামীর কর্মস্থল উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল হইতে দেশে আসিতেছিলেন। মাসীর প্রস্তাবে রাজি হওয়ার আসল কারণটা ছাড়া আরও একটা হেতু ছিল এখানে তাহা প্রকাশ করা প্রয়োজন। বন্দনার ছেলেবেলা হইতে এতকাল সুদূর প্রবাসেই দিন কাটিয়াছে, তাহার শিক্ষা-দীক্ষা সমস্তই সেদিকের, অথচ, যে সমাজের অন্তর্গত সে, তাহার বৃহত্তর অংশটাই আছে কলিকাতায়, ইহার সহিত আজও তাহার ঘনিষ্ঠ পরিচয় নাই। সামান্য পরিচয় যেটুকু সে শুধু খবরের কাগজ, মাসিকপত্র ও সাধারণ সাহিত্যের গল্প-উপন্যাসের সহযোগে। কলিকাতায় সর্বদা আনাগোনা যাহাদের, তাহাদের মুখে মুখে অনেক তথ্য মাঝে মাঝে তাহার কানে আসে—অ্যানিটা চ্যাটার্জি এম.এ., বিনীতা ব্যানার্জি বি. এ., অনসূয়া, চিত্রলেখা, প্রিয়ম্বদা প্রভৃতি বহু জমকালো নাম ও চমকানো কাহিনী—বিংশ শতাব্দের অত্যাধুনিক মনোভাব ও রোমাঞ্চকর জীবনযাত্রার বিবরণ—কিন্তু ইহার কতটা যে যথার্থ ও কতটা যে বানানো দূরে হইতে নিঃসংশয়ে অনুমান করা ছিল তাহার পক্ষে কঠিন। তাই আপন সমাজের কোন চিত্রটা ছিল তাহার মনের মধ্যে অতিরঞ্জিত ঘোরালো, কোনটা বা ছিল অস্বাভাবিক রকমের ফিকা, এই ছবিগুলিই প্রত্যক্ষ পরিচয়ে স্পষ্ট ও সত্য করিয়া লইবার সুযোগ মাসীমার মেয়ে প্রকৃতির বিবাহ উপলক্ষে যখন মিলিল তখন বন্দনা উপেক্ষা করিতে পারিল না, সহজেই সম্মত হইয়া তাঁহার বালিগঞ্জের গৃহে আসিয়া উপস্থিত হইল। আপন দলের বহুজনের সঙ্গে তাঁহাদের জানাশুনা, বিশেষতঃ, প্রকৃতি এখনকার স্কুল-কলেজে পড়িয়াই বি এ. পাস করিয়াছে, তাহার নিজের বন্ধু ও বান্ধবীর সংখ্যাও নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর নয়।
আসিয়া পর্যন্ত এই দলের মাঝখানেই বন্দনার এই কয়দিন কাটিল। পিতা অনাথ রায় বোম্বায়ে ফিরিয়া গেলেন, কিন্তু সুধীর রহিল কলিকাতায়। আসন্ন-বিবাহের আনন্দোৎসব নিত্যই চলিয়াছে, সেদিন বেলঘরের একটা বাগানে পিকনিক সারিয়া সদলবলে বাড়ি ফিরিবার পথেই সে দ্বিজদাসের সংবাদ লইতে এ বাড়িতে আসিয়া হাজির হইয়াছিল। এই খবরটাই অন্নদা সেদিন বিপ্রদাসকে দিয়াছিল।
মাসীর বাড়িতে দলের লোকের আসা-যাওয়া, খাওয়া-দাওয়া, শলা-পরামর্শের কামাই নাই, আজও ছিল অনেকের চায়ের নিমন্ত্রণ। অতিথিগণ আসিয়া পৌঁছিয়াছেন, উপরের ঘরে মহাসমারোহে চলিয়াছে চা-খাওয়া। এমন সময়ে বিপ্রদাসের প্রকাণ্ড মোটর আসিয়া গেটের মধ্যে প্রবেশ করিল। ভৃত্যের দল অবহিত হইয়া উঠিল, কিন্তু শোফার দরজা খুলিয়া দিতে যে প্রৌঢ়া স্ত্রীলোকটি অবতরণ করিল তাহার পোশাকের সামান্যতায় ও স্বল্পতায় সকলে বিস্মিত ও বিব্রত হইয়া পড়িল। মোটরের সঙ্গে মানুষটির সামঞ্জস্য নাই। অন্নদার পরনে ছিল সাদা থান, তেমনি একটা সাদা মোটা চাদর গায়ে জড়ানো, পা খালি, হাত খালি, মাথার আঁচলটা কপালের অর্ধেকটা চাপা দিয়াছে—সে নিজেও যেন সলজ্জ সঙ্কোচে কিছু জড়সড়ো। ভৃত্য-বেহারাদের চাপকান-পাগড়ির সাজসজ্জায় বুঝা কঠিন কে কোন্ দেশের, তথাপি সম্মুখের লোকটাকে বাঙালী আন্দাজ করিয়া অন্নদা জিজ্ঞাসা করিল, বন্দনাদিদি বাড়ি আছেন?
উপন্যাস : বিপ্রদাস Chapter : 17 Page: 72
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: বিপ্রদাস
- Read Time: 1 min
- Hits: 170