কাজেই একটির পর একটি করিয়া অশ্রু কৌচের মখমল চাদরের উপর আসিয়া পড়িতে লাগিল। বহুক্ষণ পরে সুরেন্দ্রনাথ কক্ষে প্রবেশ করিলেন; অত পুরু গালিচার উপর পদশব্দ হয় না, কাজেই এ আগমন মালতী জানিতে পারিল না, সে যেমন কাঁদিতেছিল তেমনই কাঁদিতে লাগিল। সুরেন্দ্রনাথ নিস্তব্ধে তাহা দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিলেন। কিছুক্ষণ পরে আরো একটু নিকটে আসিয়া দাঁড়াইলেন, তাহার পর ডাকিলেন, মালতী!
মালতী চমকিয়া চাহিয়া দেখিল; বলিল, এসো।
সুরেন্দ্রনাথ নিকটে উপবেশন করিলেন। তাহার দুটি হাত নিজের হাতে লইয়া স্নেহার্দ্র–স্বরে কহিলেন, আবার কাঁদছিলে?
মালতী হাতে–হাতে ধরা পড়িয়া গিয়াছে, এইজন্য ইচ্ছা থাকিলেও ‘না’ বলিতে পারিল না। চুপ করিয়া রহিল।
কেন কাঁদিতেছিলে?
মালতী কথা কহিল না।
তিনিও কিছুক্ষণ কিছুই বলিতে পারিলেন না। পরে তাহার হাত দুটি আরো একটু টিপিয়া ধরিয়া ধীরে ধীরে কহিলেন, দুঃখ এই যে এত চেষ্টাতেও তোমাকে সুখী করিতে পারিলাম না, হৃদয়ের সহস্র কামনাতেও তোমার মন পাইলাম না।
মালতী একটা উত্তর খুঁজিল কিন্তু পাইল না, আরো একটা কাজ তাহার দ্বারা হইল না। ইতিপূর্বেই সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল যে, যাহাই হউক আর কাঁদিবে না কিন্তু অশ্রুর উপর প্রভুত্ব বজায় রাখিতে পারিল না। তাহারা যেমন পড়িতেছিল, তেমনিই পড়িতে লাগিল।
সুরেন্দ্রনাথ বলিতে লাগিলেন, কি করলে যে একজন সুখী হইতে পারে তাহা মানুষে বুঝিতে পারে না এবং দেবতারা পারেন কি না তাও বলিতে পারি না। তৃপ্তির জন্য, সুখের জন্য এ ভবন এমন করিয়া সাজাইলাম, এ দেবীপ্রতিমা এ ভবনে এত যত্নে প্রতিষ্ঠিত করিলাম, কিন্তু সুখী হইতে পারিলাম কি? সুখের কথা ছাড়িয়া দিই— বোধ হয় আমার অসুখের মাত্রাই বৃদ্ধি হইয়াছে। যাহাকে সুখী করিতে এত করিলাম তাহাকে একদিনের জন্যও সুখী দেখিলাম না, তোমাকে পাইয়া অবধি ও অধরে একতিলের জন্যও হাসির রেখা দেখিলাম না,—বলিতে বলিতে সুরেন্দ্রনাথ তাহার হাত ছাড়িয়া দিয়া নিতান্ত অধীরভাবে সে অশ্রুমলিন মুখখানি তুলিয়া ধরিলেন; বলিলেন, মালতী, কতদিন কাটিয়া গেল কিন্তু কিছুতেই কি তুমি প্রফুল্ল হইবে না, কিছুতেই কি একবার হাসিয়া চাহিবে না?
উপন্যাস : শুভদা (অধ্যায় ২) Chapter : 10 Page: 44
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: শুভদা (অধ্যায় ২)
- Read Time: 1 min
- Hits: 178