কমল কিছুক্ষণ ধরিয়া কি ভাবিল, তাহার পরে কহিল, জানিয়ো, লজ্জা করো না। পুনরায় কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া বলিল, রাজেন, তোমার আশ্রমের দাদারা তোমাকে অল্পই চিনেছেন, তাই তাঁরা তোমাকে উপদ্রব মনে করেন। কিন্তু আমি তোমাকে চিনি। সুতরাং আমাকেও চিনে রাখা তোমার দরকার। অথচ, তার জন্যে সময় চাই, সে পরিচয় কথা-কাটাকাটি করে হবে না। একটুখানি স্থির থাকিয়া পুনরায় কহিল, আমি নিজে রেঁধে খাই, একবেলা খাই, অতিদরিদ্রের যা আহার,—সেই একমুঠো ভাত-ডাল। কিন্তু এ আমার ব্রত নয়, তাই ভঙ্গ করতেও পারি। কিন্তু দিন-দুই খাইনি বলেই নিয়ম লঙ্ঘন আমি করব না। তোমার স্নেহটুকু আমি ভুলব না, কিন্তু কথা রাখতেও তোমার পারব না রাজেন। তাই বলে রাগ করো না যেন।
না।
কি ভাবচ বল ত?
ভাবচি, পরিচয়-পত্রের ভূমিকা অংশটুকু মন্দ হল না। আমি দেখচি, সহজে ভুলতে পারব না।
সহজে ভুলতেই বা আমি তোমাকে দেবো কেন? এই বলিয়া কমল হঠাৎ হাসিয়া ফেলিল। কহিল, কিন্তু আর দেরি করো না, যাও। যত শীঘ্র পার ফিরে এস। ঐ বড় আরাম-চৌকিটায় একটা কম্বল পেতে রাখব—দু’চার ঘণ্টা ঘুমোবার পরে যখন সকাল হবে, তখন আমরা বাসায় চলে যাব, কেমন?
রাজেন্দ্র মাথা নাড়িয়া কহিল, আচ্ছা। ভেবেছিলাম রাত্রিটা বোধ হয় আমাকে আজও জেগে কাটাতে হবে। কিন্তু ছুটি মঞ্জুর হয়ে গেল, স্বামীর শুশ্রূষার ভার নিজের হাতেই নিলেন। ভালই। ফিরতে বোধ করি আমার দেরি হবে না, কিন্তু ইতিমধ্যে ঘুমিয়ে পড়বেন না যেন।
কমল বলিল, না। কিন্তু, এই লোকটি যে আমার স্বামী এ খবর তোমাকে দিলে কে? এখানকার ভদ্রলোকেরা বোধ করি? যে-ই দিয়ে থাক, সে তামাশা করেছে। বিশ্বাস না হয়, একদিন এঁকে জিজ্ঞেস করলেই খবর পাবে।
রাজেন্দ্র কোন কথা কহিল না। নিঃশব্দে বাহির হইয়া গেল।
শিবনাথ ঠিক যেন এই জন্যই অপেক্ষা করিয়া ছিল। পাশ ফিরিয়া চোখ মেলিয়া চাহিল, জিজ্ঞাসা করিল, এই লোকটি কে?
শুনিয়া কমল চমকিত হইল। কণ্ঠস্বর স্পষ্ট, জড়তার চিহ্নমাত্র নাই। চোখের চাহনিতে তখনো অল্প একটুখানি ঘোর আছে বটে, কিন্তু মুখের চেহারা প্রায় স্বাভাবিক। অসমাপ্ত নিদ্রা ভাঙ্গিয়া জাগিয়া উঠিলে যেমন একটু আচ্ছন্ন ভাব থাকে তাহার অধিক নয়। এতবড় রোগের এত সহজে ও এত শীঘ্র যে সমাপ্তি ঘটিয়াছে, কমল হঠাৎ তাহা বিশ্বাস করিতে পারিল না। তাই উত্তর দিতে তাহার বিলম্ব হইল। শিবনাথ আবার প্রশ্ন করিল, এ লোকটি কে শিবানী? তোমাকে সঙ্গে করে ইনিই এনেছেন?
হাঁ। আমাকেও এনেছেন এবং তোমাকেও সঙ্গে করে যিনি কাল রেখে গিয়েছেন তিনি। নাম?
রাজেন্দ্র।
তোমরা দু’জনে কি এখন এক বাড়িতে থাকো?
সেই চেষ্টাই ত করচি। যদি থাকেন আমার ভাগ্য।
হুঁ। ওকে এখানে এনেছ কেন? আমাকে দেখাতে?
কমল এ প্রশ্নের জবাব দিল না। শিবনাথও আর কোন প্রশ্ন করিল না, চোখ বুজিয়া পড়িয়া রহিল। বহুক্ষণ নিঃশব্দে কাটার পরে শিবনাথ জিজ্ঞাসা করিল, আমার সঙ্গে তোমার আর কোন সম্বন্ধ নেই এ কথা তুমি কার মুখে শুনলে? আমি বলেচি, এই কি লোকেরা বলে নাকি?
উপন্যাস : শেষ প্রশ্ন Chapter : 17 Page: 114
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: শেষ প্রশ্ন
- Read Time: 1 min
- Hits: 161