আমি করি তাঁর তদবির। তাঁর গুণমুগ্ধ পরম ভক্ত আমি। এই বলিয়া সে কমলের বিস্ময়-অভিভূত মুখের প্রতি ক্ষণকাল চাহিয়া থাকিয়া একটু হাসিল, কহিল, যম নয়, তিনি যমরাজ। বলিহারি তাঁর প্রতিভাকে যিনি রাজা বলে এঁকে প্রথমে অভিবাদন করেছিলেন। রাজাই বটে। যেমন দয়া, তেমনি সুবিবেচনা। বিশ্ব-ভুবনে সৃষ্টিকর্তা যদি কেউ থাকে, এ তাঁর সেরা সৃষ্টি আমি বাজি রেখে বলতে পারি।
কমল আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কি পরিহাস করচ রাজেন?
একেবারে না। শুনে সতীশদা মুখে গম্ভীর করে, হরেনদা রাগ করে বলেন আমাকে সিনিক্, তাঁদের আশ্রমে সকলে মিলে তাঁরা কৃচ্ছ্রতা, সংযম, ত্যাগ ও নানাবিধ অদ্ভুত কঠোরতার অস্ত্রশস্ত্র শানিয়ে যমরাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। অতএব, মনে করেন আমি তাঁদের উপহাস করি। কিন্তু তা করিনে। দুঃখীদের পল্লীতে তাঁরা যান না, গেলে আমার ধারণা—আমারই মত পরম রাজভক্ত হয়ে উঠতেন। শ্রদ্ধাবনত-চিত্তে মৃত্যুরাজার গুণগান করতেন এবং অকল্যাণ মনে করে তাঁকে গাল দিয়ে আর বেড়াতেন না।
কমল কহিল, এই যদি তোমার সত্যিকার মত হয়, তোমাকে সিনিক্ বলাটা কি দোষের?
দোষের বিচার পরে হবে। যাবেন একবার আমার সঙ্গে মুচীদের পাড়ায়? গড়াগড়া পড়ে আছে,—আজকের ইন্ফ্লুয়েঞ্জা বলেই শুধু নয়—কলেরা, বসন্ত, প্লেগ, যে-কোন একটা উপলক্ষ তাদের জুটলেই হল। ওষুধ নেই, পথ্যি নেই, শোবার বিছানা নেই, চাপা দেবার কাপড় নেই, মুখে জল দেবার লোক নেই,—দেখে হঠাৎ ঘাবড়ে যেতে হয় এর কিনারা আছে কোথায়? তখনি কূল দেখতে পাই, চিন্তা দূর হয়, মনে মনে বলি ভয় নেই, ওরে ভয় নেই,— সমস্যা যতই গুরুতর হোক, সমাধান করবার ভার যাঁর হাতে তিনি এলেন বলে। অন্যান্য দেশের অন্যান্য ব্যবস্থা, কিন্তু আমাদের এ দেব-ভূমির সমস্ত ভার নিয়েছেন একেবারে রাজার রাজা স্বয়ং। এক হিসেবে আমরা ঢের বেশী সৌভাগ্যবান্। কিন্তু কোথা থেকে কি-সব কথা এসে পড়ল। চলুন, রাত হয়ে যাচ্ছে। অনেকটা পথ হাঁটতে হবে।
কিন্তু তোমাকে ত আবার এই পথটা হেঁটেই ফিরতে হবে?
তা হবে।
তোমার মুচীদের পাড়া কত দূরে?
কাছেই। অর্থাৎ এখান থেকে মাইল-খানেকের মধ্যে।
তা হলে তোমার পা-গাড়ি করে ঘুরে এসো গে,—আমি বসচি।
রাজেন বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিল, সে কি কথা! আপনার যে দুদিন খাওয়া হয়নি।
কে দিলে তোমাকে এ খবর?
ওই যে খেয়ালের কথা হচ্ছিল, তাই। কিন্তু খবরটা আমি নিজেই সংগ্রহ করেচি। আসবার সময়ে আপনার রান্নাঘরটা একবার উঁকি মেরে এসেছিলাম, রান্না ভাত মজুদ, পাত্রটির চেহারা দেখলে সন্দেহ থাকে না যে সে গত রাত্রির ব্যাপার। অর্থাৎ দিন-দুই চলেচে নিছক উপবাস। অতএব, হয় চলুন, না হয় যা এনেচি আহার করুন। আজ স্বপাকের অজুহাত অবৈধ।
অবৈধ? কমল একটু হাসিয়া কহিল,—কিন্তু আমার জন্যে তোমার এত মাথাব্যথা কেন?
তা জানিনে। কারণ নিজেই অনুসন্ধান করচি, সংবাদ পেলে আপনাকে জানাব।
উপন্যাস : শেষ প্রশ্ন Chapter : 17 Page: 113
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: শেষ প্রশ্ন
- Read Time: 1 min
- Hits: 184