কমল বলিল, জানার কথা কি কেবল তোমাদেরই? ছেলেবেলায় চা-বাগানে আমি অনেক রুগীর সেবা করেচি।
তাই ত বলি ! এই বলিয়া সে আর একবার চারিদিকে চাহিয়া দেখিয়া কহিল, আসবার সময় সঙ্গে করে সামান্য কিছু খাবার এনেচি। কুঁজোয় জল আছে দেখে গিয়েছিলাম। খেয়ে নিন, আমি বসচি।
কমল তাহার মুখের পানে চাহিয়া একটু হাসিল, খাবার কথা ত তোমাকে বলিনি, হঠাৎ এ খেয়াল হল কেন?
রাজেন্দ্র বলিল, খেয়াল হঠাৎই হল সত্যি। নিজের যখন পেট ভরে গেল, তখন কি জানি কেন মনে হল আপনারও হয়ত ক্ষিদে পেয়ে থাকবে। আসবার পথে দোকান থেকে কিছু কিনে নিয়ে এলাম। দেরি করবেন না, বসে যান। এই বলিয়া সে নিজে গিয়া জলের কুঁজাটা তুলিয়া আনিল। কাছে কলাই-করা একটা গ্লাস ছিল, কহিল, সবুর করুন, বাইরে থেকে এটা মেজে আনি। এই বলিয়া সেটা হাতে করিয়া চলিয়া গেল। এ বাড়ির কোথায় কি আছে সে কালই জানিয়া গিয়াছিল। ফিরিয়া আসিয়া সন্ধান করিয়া একটুকরা সাবান বাহির করিল, কহিল, অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন, একটু সাবধান হওয়া ভাল। আমি জল ঢেলে দিচ্চি, খাবার আগে হাতটা ধুয়ে ফেলুন।
কমলের পিতার কথা মনে পড়িল। তাঁহারও এমনি কথার মধ্যে বিশেষ রস-কস ছিল না, কিন্তু আন্তরিকতায় ভরা। কহিল, হাত ধুতে আপত্তি নেই, কিন্তু খেতে পারব না ভাই। তুমি হয়ত জান না যে, আমি নিজে রেঁধে খাই, আর এই-সব দামী, ভাল ভাল খাবারও খাইনে। আমার জন্যে ব্যস্ত হবার আবশ্যক নেই, অন্যান্য দিন যেমন হয়, তেমনি বাসায় ফিরে গিয়েই খাব।
তা হলে আর রাত না করে বাসাতেই ফিরে চলুন, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসিগে।
তুমি এখানেই আবার ফিরে আসবে?
আসব।
কতক্ষণ থাকবে?
অন্ততঃ কাল সকাল পর্যন্ত। ওপরের পাঞ্জাবীদের হাতে কিছু টাকা দিয়ে গেছি, একটা মোকাবিলা না করে নড়ব না। একটু ক্লান্ত, তা হোক। এতটা অযত্ন হবে ভাবিনি। উঠুন, এদিকে গাড়ি পাওয়া যাবে না, হাঁটতে হবে। ফেরবার পথে মুচীদের বস্তিটা একবার ঘুরে আসা দরকার! দু’ব্যাটার মরবার কথা ছিল, দেখি তারা কি করলে?
কমলের আবার সেই কথাই মনে পড়িল, এ-লোকটার অনুভূতি বলিয়া কোন বালাই নেই। অনেকটা যন্ত্রের মত। কি একটা অজ্ঞাত প্রেরণা ইহাকে বারংবার কর্মে নিযুক্ত করে—কর্ম করিয়া যায়। নিজের জন্য নয়, হয়ত কোন-কিছু আশা করিয়াও নয়। কাজ ইহার রক্তের মধ্যে, সমস্ত দেহের মধ্যে জলবায়ুর মতই যেন সহজ হইয়া আছে। অথচ, অন্যের বিস্ময়ের অবধি থাকে না, ভাবে, কেমন করিয়া এমন হয়। জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা রাজেন, তুমি নিজেও ত ডাক্তার?
ডাক্তার? না। ওদের ডাক্তারি-স্কুলে সামান্য কিছুদিন শিক্ষানবীশি করেছিলাম।
তা হলে ওদের দেখচে কে?
যম।
তবে তুমি কর কি?
উপন্যাস : শেষ প্রশ্ন Chapter : 17 Page: 112
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: শেষ প্রশ্ন
- Read Time: 1 min
- Hits: 163