বহু চেষ্টায় একটা টাইম টেবল সংগ্রহ করিয়া উত্তর ও পূর্ববঙ্গের সমস্ত রেল-স্টেশন একে একে পড়িয়া গেলাম, কিন্তু স্টেশনের আদ্যক্ষর পর্যন্ত তিনি স্মরণ করিতে পারিলেন না। দুঃখ করিয়া বলিলেন, লোকে কত কি জিনিসপত্র টাকাকড়ি ধার বলে চেয়ে নিয়ে যায় বাবা, মনে করতে পারিনে, আদায়ও হয় না। মনে মনে বলি মাথার ওপর ধর্ম আছেন, তিনিই এর বিচার করবেন।

নবীন আর সহিতে পারিল না, গর্জন করিয়া উঠিল, হাঁ, তিনিই তোমার বিচার করবেন, না করেন করব আমি।

চক্রবর্তী স্নেহার্দ্র-মধুরকণ্ঠে বলিলেন, নবীন, মিছে রাগ করিস্‌ কেন দাদা, তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেচে, পারলে কি আর এটুকু করিনে? গহর কি আমার পর? সে যে আমার ছেলের মত রে!

নবীন কহিল, সে-সব আমি জানিনে, তোমাকে শেষবারের মত বলচি, বাবুর কাছে আমাকে নিয়ে যাবে ত চল, নইলে যেদিন তাঁর মন্দ খবর পাব সেদিন রইলে তুমি আর আমি।

চক্রবর্তী প্রত্যুত্তরে ললাটে করাঘাত করিয়া শুধু বলিলেন, কপাল নবীন, কপাল! নইলে তুই আমাকে এমন কথা বলিস!

অতএব, পুনরায় দু’জনে ফিরিয়া আসিলাম। বাটীর বাহিরে দাঁড়াইয়া আমি ক্ষণকাল আশা করিলাম অনুতপ্ত চক্রবর্তী যদি এখনো ফিরিয়া ডাকে। কিন্তু কোন সাড়া আসিল না, দ্বারের ফাঁক দিয়া উঁকি মারিয়া দেখিলাম চক্রবর্তী পোড়া কলিকাটা ঢালিয়া ফেলিয়া নিবিষ্টচিত্তে তামাক সাজিতে বসিয়াছে।

গহরের সংবাদ পাইবার উপায় চিন্তা করিতে করিতে আখড়ায় ফিরিয়া আসিয়া যখন পৌঁছিলাম তখন বেলা প্রায় তিনটা। ঠাকুরঘরের বারান্দায় মেয়েদের ভিড় জমিয়াছে; বাবাজীরা কেহ নাই, সম্ভবতঃ সুপ্রচুর প্রসাদসেবার পরিশ্রমে নির্জীব হইয়া কোথাও বিশ্রাম করিতেছেন। রাত্রিকালে আর একদফা লড়িতে হইবে তাহার বলসঞ্চয়ের প্রয়োজন।

উঁকি মারিয়া দেখিলাম ভিড়ের মাঝখানে বসিয়া এক গণক; পাঁজি, পুঁথি, খড়ি, শেলেট, পেন্সিল প্রভৃতি গণনার যাবতীয় উপকরণ তাঁহার কাছে। আমার প্রতি সর্বাগ্রে চোখ পড়িল পদ্মার, সে চেঁচাইয়া উঠিল, নতুনগোঁসাই এয়েছে।

কমললতা বলিল, তখনি জানি গহরগোঁসাই তোমাকে অমনি ছেড়ে দেবে না, কি খেলে সে—

রাজলক্ষ্মী তাহার মুখ চাপিয়া ধরিল—থাক দিদি, ও আর জিজ্ঞাসা করো না।

কমললতা তাহার হাত সরাইয়া দিয়া বলিল, রোদ্দুরে মুখ শুকিয়ে গেছে, রাজ্যের ধুলোবালি উঠেচে মাথায়—স্নানটান হয়েচে ত?

রাজলক্ষ্মী বলিল, তেল ছোঁন না, হলেও ত বোঝা যাবে না দিদি।

অবশ্য সর্বপ্রকার চেষ্টাই নবীন করিয়াছে, কিন্তু আমি স্বীকার করি নাই, অস্নাত অভুক্তই ফিরিয়া আসিয়াছি।

রাজলক্ষ্মী মহানন্দে কহিল, গণকঠাকুর আমার হাত দেখে বলেছে, আমি রাজরানী হবো।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়