একচল্লিশ দিন পার হয়েছে বেলায়েতের কোনো খোঁজ নেই। জিন হাফসা জানিয়েছে বেলায়েত বর্ডার পার হয়ে ইন্ডিয়াতে আছে। তার শরীর সামান্য

হেদায়েতকে ফ্ল্যাটবাড়ি ছেড়ে দিতে হয়েছে। বাড়িওয়ালা পাওনা ভাড়া বাবদ ফ্লাটের সবকিছু রেখে দিয়েছে। শুধু হাওয়াই মিঠাই বানানোর যন্ত্রটা ফেরত দিয়েছে। হেদায়েত এখন পরিমল বাবুর সঙ্গে বেলায়েত টিম্বারের অফিস ঘরে থাকে। দুজনই তিনবেলা দি নিউ বিরানী হাউস এন্ড রেস্টুরেন্টে খায়। এই ফ্রি খাওয়াও বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে। হেনার সেক্রেটারি মিস শারমিন বিষয়টা একেবারেই পছন্দ করছেন না। তিনি হেদায়েতকে সরাসরি বলেছেন, আপনার ভাই বেলায়েত সাহেব যখন নিজের রেস্টুরেন্টে খেতেন তখন পয়সা দিয়ে খেতেন। সেখানে দিনের পর দিন আপনি ফ্রি খেতে পারেন। না। আপনি যে একা খাচ্ছেন তা-না, একজন সঙ্গীও আছে। সে আমাদের কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত না। সে কীভাবে ফ্রি খাচ্ছে?

হেদায়েত বলল, ভাবি কি খেতে নিষেধ করেছেন?

শারমিন বলল, উনি শোকে কাতর একজন মহিলা। সব দিক দেখা তার পক্ষে সম্ভব না। রেস্টুরেন্টটা পুরোপুরি আমি দেখছি। তবে ম্যাডাম বলেছেন, ফ্রি খাওয়া-খাওয়ি বন্ধ।

হেদায়েত বলল, আমরা কোথায় খাব?

সেটা আপনারা জানেন। আমি কী করে বলব? পরিমল বাবু যে বেলায়েত টিম্বারে থাকেন এটা ম্যাডামের খুবই অপছন্দ। অফিস ঘুমানোর জায়গা না।

উনার তো যাওয়ার কোনো জায়গা নাই।

এই বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। আপনার কিছু বলার থাকলে ম্যাডামকে বলুন। আমার কাছে সুপারিশ করে কিছু হবে না। সরি!

হেদায়েত হেনার সঙ্গে দেখা করতে গেল। পরিমল বাবু বাসার সামনে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করতে লাগলেন। হেদায়েত কী খবর নিয়ে আসে তার জন্যে অপেক্ষা। কোনো সুখবর আসবে সে-রকম মনে হচ্ছে না। আজ সকালের নাশতা খাওয়া হয়েছে। দুপুরের কোনো ব্যবস্থা হয় নি।

হেনা চোখমুখ শক্ত করে সোফায় বসে আছে। অতি কদাকার দেখতে এক মহিলা তার মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছে। মনে হয় আরামদায়ক অবস্থা, কারণ হেনার চোখ বন্ধু।

হেনা বলল, তুমি সমস্যায় আছ সেটা আমি শুনব। কিন্তু পরিমন বাবুটা কে? তার বিষয়ে দরবার করতে এসেছ কেন?

হেদায়েত বলল, বেচারার কেউ নাই। ভাইজান ফিরে না আসা পর্যন্ত থাকুক।

তোমার ধারণা তোমার ভাইজান ফিরে আসবে?

জি।

যে একচল্লিশ দিনে ফেরে না সে একচল্লিশ বছরেও ফেরে না। বুঝেছ?

হেদায়েত বলল, বুঝতে পারছি না। একচল্লিশ দিনের সঙ্গে একচল্লিশ বৎসরের সম্পর্ক বুঝতে পারছি না। অবশ্য ৪১ একটা প্রাইম নাম্বার। ৪১ বৎসর হচ্ছে ৩৬৫ দিন ৬ ঘণ্টা। ৬ ঘণ্টা হিসাবে ধরা হয় না। প্রতি চার বছরে একবার হিসাবে আসে। তখন হয় ৩৬৬ দিনে বৎসর।

হেনা বলল, বকবকানি বন্ধ কর। হাজার যন্ত্রণায় অস্থির, তুমি শুরু করেছ বৎসরের হিসাব। মাথা কি পুরোপুরি গেছে?

হেদায়েত চুপ করে রইল। ভাবিকে তার খুব অচেনা লাগছে। মনে হচ্ছে অচেনা একজন মহিলা।

হেনা বলল, তোমার বিষয়ে এই মুহূর্তে কিছু করতে পারছি না। কোর্ট থেকে পাওয়ার অব এটর্নি বের করার চেষ্টা করছি। বের করতে পারলে তোমার ভাইয়ের একাউন্ট থেকে টাকা তুলতে পারব। তখন তোমার বিষয়ে কিছু করার চেষ্টা করব। বুঝেছ? এখন যাও। সকাল থেকে আমার মাথায় যন্ত্রণা। প্রেসারের ওষুধও এখন দুইবেলা খেতে হয়, বুঝেছ? এখন যাও।

হেদায়েত বলল, ভাইজানের রেস্টুরেন্টে কি খেতে পারব ভাবি?

হেনা জবাব দিল না। সামনে থেকে উঠে গেল। তার মানে হ্যাঁ  না-কি না এটা পরিষ্কার হচ্ছে না। না হলে মুখে সরাসরি না বলত।

 

হেদায়েত পরিমল বাবুর সঙ্গে র্যাংগস ভবনের সামনের ঝরনার পাশে বসে আছে। এখান থেকে রাংগস ভবন ভাঙার দৃশ্য দেখা যায়। হেদায়েততের সিগারেট খেতে ইচ্ছা হচ্ছে। সঙ্গে সিগারেট নেই।

পরিমল বাবু বললেন, দুশ্চিন্তা করবেন না।

হেদায়েত বলল, দুশ্চিন্তা করছি না। সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে।

পরিমল বাবু বললেন, সিগারেটের ব্যবস্থা করছি।

কীভাবে করবেন?

সিগারেট ভিক্ষা চাইব। টাকা ভিক্ষার মধ্যে লজ্জা আছে। সিগারেট ভিক্ষায় লজ্জা নেই। কারণ সিগারেট ক্ষতিকর জিনিস।

পরিমল বাবু উঠে গেলেন এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এলেন। তাঁর হাতে দু’টা সিগারেট। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, একটা এখন খান আরেকটা খাবেন লাঞ্চের পরে।

লাঞ্চ কোথায় করব?

স্যারের রেস্টুরেন্টেই করব। গলা ধাক্কা দিয়ে বের না করে দেয়া পর্যন্ত সেখানেই যাব। দুঃসময়টা আপনার জন্যে কী রকম ভালো হয়েছে লক্ষ করেছেন?

কী ভালো হয়েছে?

আপনার ভাই কোথায় আছে, তার কী হয়েছে এটা নিয়ে এখন আর চিন্তা করছেন না। এখনকার একমাত্র চিন্তা খাব কী? কোথায় খাব?

হেদায়েত বলল, ভাইজানকে নিয়ে আমি রাতে চিন্তা করি। দিনে করি না।

সেটা ভালো। চিন্তার জন্যে রাত্রি উত্তম। আচ্ছা আপনার কাছে তো হাওয়াই মেঠাই বানানোর যন্ত্রটা আছে।

জি আছে।

বিশটা হাওয়াই মেঠাই আমাকে বানিয়ে দিন। আমি বিক্রি করব। বানাতে পারবেন না?

পারব। বিশটা না বানিয়ে উনিশটা বানাই?

উনিশটা কেন?

উনিশ একটা প্রাইম নাম্বার।

ও আচ্ছা। আপনার তো আবার প্রাইমের ঝামেলা আছে। বানান উনিশটাই বানান।

 

দিলরুবা ম্যাডামের আজ সারাদিনে দু’টা মাত্র শট। প্রথমটা হয়ে গেছে। দ্বিতীয়টা কিছুক্ষণের মধ্যে হবে। আয়োজন চলছে। দোলনার শট। নায়িকা দোলনায় দুলছে। নায়ক পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে দোলনা দোলাচ্ছে। এক পর্যায়ে ধাক্কা বেশি হয়ে গেল। নায়িকা দোলনা থেকে পড়ে ব্যথা পেল। তার নাক দিয়েও রক্ত পড়তে লাগল। তখন একে অন্যকে দেখে হাসতে শুরু করল। এই হাসি থেকে গানের শট চলে যাওয়া হবে—

সব ফুল যদি ফাল্গুনে ফোটে
শ্রাবণে ফুটবে কী?
ভালোবাসা যদি তোমার আমার
তাহাদের গতি কী?

গানের কয়েকটা শটও আজ হওয়ার কথা ছিল। ড্যান্স ডিরেক্টর আসে নি বলে হবে না। শুটিং প্যাক আপ হয়ে যাবে। রবিন সেতুকে নিয়ে বড় কোনো রেস্টুরেন্টে খেতে যাবেন। আজ রবিনের জন্মদিন।

রবিন চলে এসেছেন। দোলনার শটটা এক্ষুনি শুরু হবে। মেকআপম্যান শেষবারের মতো মেকআপ ঠিকঠাক করছেন। রবিন মেকআপ রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, ‘আজ আসার পথে মজার এক দৃশ্য দেখলাম। দৃশ্যটা তোমার সঙ্গে শেয়ার করব কি-না বুঝতে পারছি না। তোমার তো মেজাজের কোনো ঠিক নেই, কীভাবে নেবে কে জানে!

সেতু বলল, আমাকে কিছু বলার দরকার নেই।

রবিন বললেন, হেদায়েত সাহেবকে দেখলাম ছোটাছুটি করে হাওয়াই মেঠাই বিক্রি করছেন। আমার কাছেও এসেছিলেন। আমাকে চিনতে পারেন নি।

সেতু বলল, ও আচ্ছা।

তার চেহারায় কোনো ভাবান্তর হলো না। আয়নায় নিজের চেহারার দিকে তাকিয়ে রইল।

ব্যাপারটা মনে হয় তোমার কাছে তেমন ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে না।

সেতু বলল, ওর আবার শুটিং দেখার শখ ছিল। তুমি এক কাজ কর, তাকে নিয়ে এসো শুটিং দেখবে।

এখন যাব?

তোমাকে যেতে হবে না। ড্রাইভারকে পাঠাও।

বাদ দাও তো, পরে দেখা যাবে।

সেতু রবিনের দিকে তাকাল। কঠিন দৃষ্টি। তারপর সেই দৃষ্টি মুহূর্তেই স্বাভাবিক করে বলল, যা করতে বলেছি কর।

রবিন বললেন, এখন গেলে তো পাওয়া যাবে না।

সে বলল, পাওয়া যেতেও তো পারে।

রবিন বলল, শুটিং দেখার ব্যাপারটা অন্য একদিন করলে হয় না? আমরা খেতে যাব।

সেতু বলল, সেও যাবে আমাদের সঙ্গে। জন্মদিনের উৎসবে একজন বাড়তি মানুষ থাকল। There is compary.

তার সঙ্গে আরো একজনকে দেখলাম। বৃদ্ধ।

বৃদ্ধও আমাদের সঙ্গে যাবেন।

 

হেদায়েতকে যথেষ্টই আনন্দিত মনে হচ্ছে। উনিশটা হাওয়াই মেঠাইয়ের মধ্যে এগারোটা বিক্রি হয়ে গেছে। বারো নম্বরটা মনে হয় এখন বিক্রি হবে। মেয়েটা যেভাবে অবাক হয়ে তাকাচ্ছে— সে না কিনেই পারে না।

হেদায়েত বলল, নতুন ধরনের কিছু হাওয়াই মেঠাই আছে—-ঝাল-মিষ্টি। ট্রাই করে দেখবেন?

মেয়েটা গাড়ি থেকে নেমে এসে বলল, স্যার আপনি আমাকে চিনতে পারেন নি?

না।

স্যার আমি আপনার ছাত্রী। আমার নাম মাহজাবিন। রোল উনিশ।

হেদায়েত অবাক হয়ে বলল, খুবই আশ্চর্য ব্যাপার! আমি হাওয়াই মেঠাই বানিয়েছিলাম উনিশটা। এর মধ্যে এগারোটা বিক্রি হয়ে গেছে। তুমি যদি একটা কেন তাহলে বারোটা বিক্রি হয়ে যাবে। থাকবে সাত। সাত একটা প্রাইম নাম্বার। ‘মায়াদের কাছে সাত ছিল অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ণ সংখ্যা। ওরা সবসময় সাতজন করে মানুষ বলি দিত।

স্যার, আপনি হাওয়াই মেঠাই বিক্রি করছেন কেন?

হেদায়েত বলল, বিপদে পড়েছি। মহা বিপদে বলতে পার। চাকরি নেই, ওইদিকে ভাইজান নিখোঁজ। ভাইজানের রেস্টুরেন্টে খেতাম। সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। হাওয়াই মেঠাই বিক্রি করে যে টাকাটা পাব সেটা দিয়ে লাঞ্চ খাব। ভাইজানের রেস্টুরেন্টেই খাব তবে পয়সা দিয়ে খাব। ভালো কথা তুমি কাঁদছ কেন?

মাহজাবিন চোখ মুছতে মুছতে বলল, আমি কেন কাঁদছি জানি না স্যার।

হাওয়াই মেঠাই কিনবে?

জি না স্যার।

আচ্ছা ঠিক আছে। রোল নাম্বার নাইনটিন, ভালো থেকো। আসল কথা তোমাকে বলতে ভুলে গেছি। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি তো— এই জন্যে মাঝে মাবো হ্যালোসিনেশনের মতো হয়। একটা মেয়েকে মাঝে মাঝে দেখি। মেয়েটার চেহারার সঙ্গে তোমার অদ্ভুত মিল।

স্যার, আপনি কোথায় থাকেন, ঠিকানাটা একটু বলবেন?

হেদায়েত বলল, এত দিন থাকতাম বেলায়েত টিম্বার নামের একটা দোকানে। আজ থেকে অন্য কোথাও থাকব। পরিমল বাবু ব্যবস্থা করবেন। তুমি চলে যাও, তোমার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আমার বিক্রি বন্ধ।

 

সেতুরা খেতে গেছে শেরাটন হোটেলে। সুইমিং পুলের পাশেই রেস্টুরেন্ট। লাঞ্চ শুরুর আগে রবিন ব্লাডি মেরি নিয়েছেন। গরমে ব্লাডি মেরি খেতে ভালো লাগছে। রবিন বললেন, তুমি একটা ব্লাডি মেরি ট্রাই করবে?

সেতু বলল, না।

রবিন বললেন, তোমার আজকের অভিনয় দেখে খুব ভালো লাগল। এরকম একটা ডিফিকাল্ট সিকোয়েন্স এক টেকে মেরে দেবে চিন্তাই করি নি।

সেতু বলল, থ্যাংক য়্যু।

রবিন বললেন, হেদায়েত সাহেবকে খুঁজে পেলে ভালোই হতো। দুজন আসলেই খালি খালি লাগছে। ঐ রাস্তায় দু’বার আসা-যাওয়া করেছি। নো ট্রেস।

সেতু বলল, তুমি ওখানে যাও নি। মিথ্যা করে বললে গিয়েছিলে।

কে তোমাকে বলল, যাই নি?

আমি প্রডাকশনের একটি ছেলেকে গাড়ি দিয়ে তোমার পেছনে পেছনে পাঠিয়েছিলাম। সে বলেছে তুমি গাড়ি নিয়ে বের হয়ে রমনা গ্রিনের দিকে কিছুদূর গিয়েছ। গাড়ি থেকে নেমে একটা সিগারেট খেয়েছ, তারপর ফিরে এসেছ।

রবিন চুপ করে রইলেন। সেতু বলল, আমাকে একটা ব্লাডি মেরি দিতে বলো।

 

রাত এগারোটা।

হেনা হতভম্ব হয়ে বসে আছে। তার শরীরে জ্বলা রোগ শুরু হয়েছে। এর সঙ্গে শুরু হয়েছে মাথাঘোরা। নিঃশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে তার সেক্রেটারি মিস শারমিন দু’টা খবর দিয়েছে। প্রথম খবর সে ব্যাংকে ছোটাছুটি করে বের করেছে ব্যাংকে বেলায়েতের চার কোটি সাতান্ন লক্ষ টাকা আছে।

দ্বিতীয় খবর বেলায়েত একটা উইল করে গেছে। রেজিস্ট্রি করা উইল। সেখানে লেখা— তার মৃত্যু হলে স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তির মালিক হবে তার ছোটভাই হেদায়েত। সেখানে হেনার কোনো উল্লেখই নেই।

হেনা বলল, তুমি ঠিকমতো উইল পড়েছ?

জি ম্যাডাম।

আমার কোনো উল্লেখই নেই?

জি ম্যাডাম।

বদ্ধ উন্মাদ ছাড়া এই কাজ কেউ করে? এরা দুই ভাইই বদ্ধ উন্মাদ। সহজভাবে ঘুরে বেড়ায়, কারোর বুঝার উপায় নেই যে এরা উন্মদি। ঠিক বলেছি কি-না বলো?

অবশ্যই ঠিক বলেছেন। মাডাম উইলের একজন সাক্ষীর নাম শুনলে আপনি চমকে উঠবেন।

হেনা বলল, অনেক চমকেছি, আর চমকাতে ইচ্ছা করে না। কে সে?

পরিমল বাবু।

হেনা বিড়বিড় করে বলল, বদটা সাক্ষী? অথচ আমাকে কিছুই বুঝতে দেয় নাই। সে উইলের কথাটা আগে বললে…

হেনা কথা শেষ করল না। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে।

শারমিন বলল, ম্যাডাম পরিমল বাবুকে কি খবর দিয়ে আনব? তারা তো বেলায়েত টিম্বারেই রাতে থাকে।

তাকে এখন খবর দিয়ে কী হবে? আচ্ছা যাও খবর দাও।

 

হেদায়েত, পরিমল বাবু কাউকেই বেলায়েত টিম্বারে পাওয়া গেল না। তারা কোথায় গেছে তাও কেউ জানে না।

পরিমল বাবু রাত্রি যাপনের জন্যে হেদায়েতকে কমলাপুর রেলস্টেশনে নিয়ে এসেছেন। তিনি বলেছেন, নিরিবিলি ঘুমের এক মজা আবার হৈচৈয়ের মধ্যে ঘুমের আরেক মজা। একেকবার ট্রেন এসে থামবে। বিরাট হৈচৈ, ইনজিনের শব্দ, হুইসেল। ঘুম ভাঙবে। কিছুক্ষণ ট্রেন দেখে আবার ঘুমিয়ে পড়বে। আসুন জায়গা খুঁজে বের করি। চোখের উপর সরাসরি আলো এসে পড়বে না এমন জায়গা।

হেদায়েত বলল, স্টেশনে আপনি আগেও রাত কাটিয়েছেন?

কত কাটালাম। একেকবার চাকরি চলে যায়। সঞ্চয় শেষ হয়। স্টেশনে এসে আশ্রয় নেই। কোলকাতায় আমার বড় বড় আত্মীয়স্বজন আছে। তারা খুব চাপাচাপি করে যাতে তাদের কাছে চলে যাই। নিজের দেশ ছেড়ে কেন যাব বলুন তো!

তারা মোটামুটি নিরিবিলি একটা জায়গা খুঁজে বের করল। চোখের উপর আলো পড়বে না। পাবলিক টয়লেট কাছেই। খবরের কাগজের উপর চাদর বিছিয়ে বিছানা। হেদায়েত বলল, যথেষ্ট আরামদায়ক ব্যবস্থা।

পরিমল বাবু বললেন, আরাম ভাবলেই আরাম। পুরো ব্যাপারটাই ভাবের উপর। একই পরিস্থিতিতে কষ্টে আছি ভাবলে কষ্টে থাকবেন। আনন্দে আছি ভাবলে আনন্দে থাকবেন।

হেদায়েত বলল, অংকেও এরকম ব্যাপার আছে। ইমাজিনারি সংখ্যার গুণিতক নিয়ে ব্যাপার। একই পরিস্থিতিতে উত্তর পজেটিভ হবে আবার নেগেটিভও হবে। যিনি অংকটা করছেন তার উপর নির্ভর করবে তিনি কোন উত্তরটা নেবেন।

বাহ ভালো তো। আসুন চা খাই। চা-সিগারেট খেতে খেতে অংক নিয়ে আলাপ। যদিও আমি অংক ভয় পাই। জীবনে কোনো পরীক্ষায় অংকে চল্লিশের উপর পাই নাই। আপনার মতো শিক্ষক পেলে কাজ হতো।

হেদায়েত বলল, আপনি চাইলে আমি আপনাকে অংক শেখাতে পারি। গোড়া থেকে শুরু করতে পারি।

পরিমল বাবু বললেন, এটা খারাপ না। শেষ বয়সে শিখলাম কিছু অংক।

প্রথমে মুখে মুখে শুরু করি তারপর কাগজ-কলমে যাব।

তাই ভালো। অংক করতে করতে ঘুম।

হেদায়েত বলল, আপনি ঘুমিয়ে পড়ার পরেও আমাকে বেশ কিছু সময় জেগে থাকতে হবে। আমি মনে মনে একটা অংক করছি তো তার জন্যে। আত্মার ইকুয়েশন বের করার চেষ্টা করছি।

আত্মার ইকুয়েশন? বলেন কি!

অনেকদূর এগিয়েছি– কিছু বাকি আছে। বাকিটাও হয়ে যাবে। বড় বড় অংকবিদরা আমাকে সাহায্য করছেন।

পরিমল বাবু চিন্তিত গলায় বললেন, ও আচ্ছা।

হেদায়ে বলল, আত্মা বাস করে Planck জগতে। সব আত্মা একসঙ্গে বাস করে বলেই আত্মার সঙ্গে আত্মার যোগাযোগ থাকে। এই যোগাযোগ অনন্তকালের।

পরিমল বাবু বললেন, আমার আত্মা আমার ভেতর থাকে না?

আপনার প্রশ্নের উত্তর— থাকে আবার থাকেও না। ইকুয়েশনটা বের করে ফেলতে পারলে বুঝাতে সুবিধা হবে।

পরিমল বাবু বললেন, তাহলে অপেক্ষা করি আপনি ইকুয়েশনটা বের করুন।

হেদায়েত বলল, একটা সমস্যা আছে।

কী সমস্যা?

ইকুয়েশনটা বের করার সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথাটা পুরোপুরি খারাপ হয়ে যাবে। কাউকে কিছু বুঝাতে পারব না।

তাহলে তো ইকুয়েশনটা নিয়ে চিন্তা না করাই ভালো।

উপায় নাই। অনেকদূর এগিয়েছি। এখন আর থামা যাবে না। ব্যাপারটা চেইন রিঅ্যাকশনের মতো। একবার শুরু হলে আর থামানো যায় না। শেষ হয়…

হেদায়েতের কথা শেষ হবার আগেই হুড়মুড় করে প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ঢুকল। হেদায়েত মুগ্ধ হয়ে ট্রেনের দিকে তাকিয়ে আছে। লোকজনের উঠানামা দেখছে। তার খুবই ভালো লাগছে। একটা বাচ্চা মেয়ে বাবার হাত ধরে গুটগুট করে হাঁটছে। কী সুন্দর লাগছে দেখতে বাহ্!

প্রথম রাতেই হেদায়েতের হাওয়াই মেঠাইয়ের মেশিন, পরিমল বাবুর হ্যান্ডব্যাগ এবং কাপড়ের পুঁটলি চুরি হয়ে গেল। পরিমল বাবু বললেন, সম্পূর্ণ ঝামেলা মুক্ত হয়ে গেলাম। ভিক্ষাবৃত্তির নতুন জীবন শুরু করব। এর আলাদা আনন্দ আছে।

হেদায়েত বলল, কী আনন্দ!

জুয়াখেলার আনন্দের মতো আনন্দ। উত্তেজনার আনন্দ। যার কাছে ভিক্ষা চেয়েছি সে ভিক্ষা দিবে, না দিবে না— এই উত্তেজনার আনন্দ।

 

নতুন জীবনে হেদায়েত অভ্যস্থ হয়ে গেছে। ঘুমুতে যাবার আগে সে পরিমল বাবুকে অংক শেখায়। তখন বাইরের কিছু মানুষও কৌতূহলী হয়ে পাশে বসে। হেদায়েতের ভালো লাগে। পরিমল বাবু ছাত্র হিসাবে বেশ ভালো। তিনি দ্রুত ব্যাপারলি ধরছেন। এটাও আনন্দের ব্যাপার।

একদিন রেলস্টেশনেই প্রিন্সিপ্যাল এনায়েত করিমের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি রাতের ট্রেনে চিটাগাং যাচ্ছিলেন। পানির বোতল কিনতে এসে হেদায়েতকে দেখে বললেন, আপনার এ কী অবস্থা!

হেদায়েত বলল, ভালো অবস্থা স্যার।

কী করছেন আজকাল?

ভিক্ষাবৃত্তি।

তার মানে?

আমি আর পরিমল বাবু সারাদিন ভিক্ষা করি। রাতে স্টেশনে শুয়ে ঘুমাই।

এনায়েত করিম বললেন, আমি আপনরি কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। স্টেশনে ঘুমান মানে কী?

হেদায়েত মানে বোঝাতে পারল না। তার আগেই ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। প্রিন্সিপ্যাল এনায়েত করিম দৌড়ে ট্রেনে উঠলেন। জানালা দিয়ে মুখ বের করে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। কারণ হেদায়েত ট্রেনের সঙ্গে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে।

হেদায়েত এইমাত্র আত্মার ইকুয়েশন বের করে ফেলেছে। সে এই খবরটাই প্রিন্সিপাল সাহেবকে দিতে চাচ্ছে। প্ল্যাটফর্মের লোকজনও তাকিয়ে আছে। তারা অবাক হয়ে মানুষটার দৌড় দেখছে। মানুষটা ট্রেনে উঠার চেষ্টা করছে না। অকারণে দৌড়াচ্ছে— এর মানেটা কী?

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ