বেলায়েত নিখোঁজ হয়েছে। ভোরবেলা নিজের ট্রাকে করে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে ময়মনসিংহ গিয়েছিল। কাজ শেষ করে রাত আটটার মধ্যে তার ফেরার কথা। সে ফেরে নি। রাত একটায় ড্রাইভার মোবাইল ফোনে। জানিয়েছে, স্যারের কোনো খোঁজ নাই, এখন কী করি?

বেলায়েতের স্ত্রী হেনা টেনশন নিতে পারে না। সামান্যতে সে অস্থির হয়ে পড়ে। বেলায়েতের খবরে তার বুক ধড়ফর শুরু করল। তার মন বলছে মানুষটা খুন হয়েছে। অবশ্যই খুন হয়েছে। খুন করেছে ড্রাইভার কুদুস। ট্রাকের সামনে ধাক্কা দিয়ে ফেলে উপর দিয়ে ট্রাক নিয়ে চলে গেছে। এখন বলছে স্যারের কোনো খোঁজ নাই।

রাত তিনটায় টেলিফোনের পর টেলিফোন করে হেনা, হেদায়েতের ঘুম ভাঙালো। কাঁদতে কাঁদতে বলল, তোমার ভাইয়ের কোনো খবর জানো?

হেদায়েত বলল, না তো। মনে হয় সে খুন হয়েছে।

কে খুন করেছে?

কে খুন করেছে এখনো পরিষ্কার না। ট্রাক ড্রাইভার কুদ্স সম্ভবত খুন করেছে। বাসায় চলে আস বিস্তারিত শুনবে।

ভাবি আমি এক্ষুনি আসছি, আপনি কান্না বন্ধ করেন।

হেনা কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমার স্বামী মারা গেছে আমি কাঁদব না! ঝিম ধরে বসে থাকব! কী রকম কথা বলো!

 

হেদায়েত তার ভাইয়ের বাসায় পৌঁছে দেখে প্রচুর লোকজন। হেনা তার আত্মীয়স্বজন সবাইকে খবর দিয়ে এনেছেন। একজন পুলিশ অফিসারও (ধানমণ্ডি থানার সেকেন্ড অফিসার) এসেছেন। পরিমল বাবু পুলিশের সঙ্গে কথা বলছেন। হেনার কথা বলার মতো অবস্থা না। সে কিছুক্ষণ পর পর এলিয়ে পড়ে যাচ্ছে। তার মুখ দিয়ে ফেনা ভাঙছে।

সেকেন্ড অফিসার বিরক্ত গলায় বললেন, একজন মানুষের খবর পাওয়া যাচেছ না চব্বিশ ঘণ্টাও পার হয় নাই, আপনারা এরকম কেন করছেন?

পরিমল বাবু বললেন, স্যার, উনি কখনও রাতে ঢাকার বাইরে থাকেন না। নিজের ঘরে না শুলে তার ঘুম আসে না। এই জন্যই দুশ্চিন্তা।

দুশ্চিন্তা দূর করুন। ময়মনসিংহের তার যেসব আত্মীয়স্বজন আছে তাদের বাড়িতে খোঁজ নিন। তাঁর সঙ্গে কি মোবাইল ফোন সেট আছে?

জি স্যার আছে।

টেলিফোন করে দেখেছেন?

জি স্যার। রিং হয় কিন্তু কেউ ধরে না।

আমাকে নাম্বারটা দিন। আমি টেলিফোন করে দেখি! নাম্বার কত?

নাম্বার হেদায়েত বলল। তার সব নাম্বারই মুখস্থ। হেদায়েতের কাছেই জানা গেল যে, তার বড় ভাইয়ের দু’টা মোবাইল সেট। একটা সাধারণ ব্যবহারের জন্যে, অন্যটা শুধু তার ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলার জন্য। দুটা নাম্বারেই চেষ্টা করা হলো। রিং হয় কিন্তু কেউ ধরে না।

সেকেন্ড অফিসার বললেন, হয়তো মোবাইল সেট রেখে কোথাও গেছেন। কিংবা সেট দু’টা ছিনতাই হয়েছে। আপনারা দুশ্চিন্তা করবেন না। ময়মনসিংহ থানায় আমি খবর দিয়ে দিচ্ছি। ট্রাক ড্রাইভার কুদুসকে বলুন যেন সে তার স্যারের জন্যে অপেক্ষা করে।

হেনা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, কুদুসকে এ্যারেস্ট করবেন না?

সেকেন্ড অফিসার বিরক্তি গলায় বললেন, তাকে এ্যারেস্ট করার সময় পার হয়ে যায় নি। অল্পতে অস্থির হবেন না প্লিজ। আমি নিশ্চিত কাল দিনের মধ্যে আপনার স্বামী ফেরত আসবেন।

 

সাতদিন পার হয়ে গেল, বেলায়েতের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। এখন আর মোবাইলেও কোনো রিং হয় না। হেদায়েত সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভাইকে খোঁজে। পথে পথে হাঁটে। বেশির ভাগ দিন তার সঙ্গে পরিমল বাবু থাকেন। তিনি অদ্ভুত অদ্ভুত জায়গায় খুঁজতে যান। যেমন বুড়িগঙ্গা নদীর নৌকা, নারায়ণগঞ্জ উর্দু বস্তি নামের এক বস্তি।

অদ্ভুত অদ্ভুত কথাও বলেন। যেমন একদিন বললেন, আমার ধারণা স্যার বিবাগী হয়েছেন।

হেদায়েত বলল, বিবাগী কেন হবেন?

সংসারে শান্তি ছিল না। এই জন্যে বিবাগী হয়েছেন। মাডামের সঙ্গে খেঁচাখেছি ছিল। সংসারে শিশু ছিল না। পিতা-মাতা হলো ইট। আর শিশু সিমেন্ট। দুই ইট আটকায়ে রাখে।

হেদায়েত বলল, ভাইজান বিবাগী হয়ে কোথায় যাবেন?

পরিমল বাবু বললেন, আগে বিবাগী হয়ে পুরুষ মানুষ আসাম চলে যেত। কামরূপ কামাক্ষ্যা। এখন পাসপোর্টের ঝামেলার কারণে দেশেই থাকে। সাধারণত পতিতাপল্লীতে আশ্রয় নেয়। মনের মতো মেয়ে খুঁজে বের করে সংসার পাতে।

বলেন কি!

আপনি চিন্তা করবেন না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, দেশের সব কটা পতিতাপল্লীতে অনুসন্ধান করব। নিজেই যাব।

কবে যাবেন?

ঢাকার খোঁজটা শেষ করে শুভদিন দেখে রওনা হব। প্রথম যাব টাঙ্গাইল। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পতিতাপল্লী টাঙ্গাইলে। সেখানে কিছু মেয়ে আছে অত্যাধিক রূপবতী। আবার কুহকিনী। মায়াজালে আটকায়ে ফেলে।

 

মৃত্যু শোক সাতদিনের বেশি স্থায়ী হয় না। কারণ সবাই জানে, যে গেছে সে আর ফিরবে না। নিখোঁজ শোক দীর্ঘস্থায়ী হয়। কারণ একটাই, নিখোঁজ ব্যক্তির ফিরে আসার সম্ভাবনা। আনন্দের সম্ভাবনাই সেখানে শোকের প্রধান কারণ।

স্বামী নিখোঁজ হওয়ায় হেনার বড় ধরনের উপকার হয়েছে। তার শরীর শুকিয়ে গেছে। চেহারায় সৌন্দর্য এবং লাবণ্য ফিরে এসেছে। স্বামীর নানান ব্যবসায় হাল ধরার জন্যেও প্রচুর ছোটাছুটি করছে। বেলায়েতের লোকজন কেউই তাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে না। এই মনকষ্টে সে আরো শুকাচ্ছে।

তার বাড়িতে মুনসি হাফিজ নামের এক মাওলানা স্থায়ী হয়েছেন। তিনি জিন সাধক এবং তার অধীনে সার্বক্ষণিক সঙ্গীর মতো একজন জিনও না-কি থাকে। জিনের নাম হাফসা।

হেনা চেষ্টা করছে হাফসা জিনের মাধ্যমে স্বামীর সংবাদ বের করতে। প্রায় প্রতিদিনই জিনের আসর বসছে।

পঞ্চাশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়ছে। রোজই নানান ধরনের লোকজন খোঁজ নিয়ে আসছে। সবার কথাই বিশ্বাস করার মতো। হেনা এদেরকে নিয়েও ব্যতিব্যস্ত। তার এখন নিঃশ্বাস ফেলারও সময় নেই। তাকে দেখে মনে হয় সে আনন্দেই সময় কাটাচ্ছে। হেনা একজন সেক্রেটারি রেখেছে। এম, এ, পাশ সেক্রেটারি। নাম শারমিন। এই সেক্রেটারি পুরুষ হলে মিস্টার বাংলাদেশ হত। এমন পুষ্ট শরীর। সে পেটমোটা চামড়ার ব্যাগ নিয়ে সারাক্ষণই হেনার সঙ্গে আছে।

নতুন করে এডমিনস্ট্রেশন শুরু করতে গিয়ে হেনা কয়েকজনের চাকরি খেয়েছে। তার একজন হচ্ছে পরিমল বাবু। তাঁকে চাকরি চলে যাওয়ায় মোটেই চিন্তিত মনে হচ্ছে না। বাসা ছেড়ে দিতে হয়েছে বলে তিনি এখন বেলায়েত টিম্বারের অফিসে ঘুমান। তিনি হেদায়েতকে সঙ্গে নিয়ে স্যারকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন এবং একেকদিন একেক গল্প ফাঁদছেন।

প্রাণীকুলের মধ্যে ভেড়া যাবে স্বর্গে আর ছাগল হবে নরকবাসী, এটা কি জানেন?

না।

ম্যাথুর গসপেলে পরিষ্কার লেখা আছে।

আপনি খ্রিস্টান না-কি?

না। কিছুদিন এক পাদ্রীর সঙ্গে ছিলাম। তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। আমার স্বভাবই হলো, যার সঙ্গে থাকি তার কাছে থেকেই কিছু না কিছু শিখি।

ভাইজানের কাছ থেকে কী শিখেছেন?

উনার কাছ থেকে কিছু শিখতে পারি নাই। কারণ উনার ছিল ভালোমানুষি। এটা শেখা যায় না। জন্মসূত্রে নিয়া আসতে হয়। আপনার কাছ থেকে কী শিখেছি শুনবেন?

না।

মানুষ শুধু যে মানুষের কাছ থেকে শিখবে তা-না। পশুপাখির কাছ থেকে অনেক কিছু শেখা যায়। কাকের মতো নিকৃষ্ট যে পাখি, তার কাছেও অনেক কিছু শেখার আছে। কাক সবার সামনে ময়লা খায় না। আড়ালে খায়। কাকের কাছ থেকে এইটাই শিক্ষণীয়।

সারাদিন হাঁটাহাঁটি করে সন্ধ্যায় হেদায়েত ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে। গরম পানিতে গোসল সেরে টিভি দেখতে বসে। সে চ্যানেল টিপাটেপি করে না। টিভি চালু করার পর যে চ্যানেল আসে সেটাই দেখে। আগ্রহ নিয়েই দেখে। রাত নটায় টিফিন কেরিয়ার করে হোটেল থেকে খাবার আসে। হোটেলের বয় নান্টু (বয়স ১০) খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত দাড়িয়ে থাকে। খাওয়া শেষে থালাবাসন ধুয়ে সে টিফিন কেরিয়ার নিয়ে চলে যায়। যতক্ষণ খাওয়া না হয় ততক্ষণ সে হেদায়েতের পাশেই সোফায় বসে টিভি দেখে।

 

অনেকদিন পর সেতু টেলিফোন করল। হেদায়েত আনন্দিত গলায় বলল, ভালো আছ?

হ্যাঁ। তুমি কেমন আছ?

আমি ভালো আছি। তোমাদের ছবির কাজ কি শুরু হয়েছে?

হা। এই জন্যেই এতদিন তোমাকে টেলিফোন করা হয় নি। দেশের বাইরে ছিলাম সাতদিন। ব্যাংককে একটা গানের পিকচারাইজেশন হয়েছে। খুব ভালো হয়েছে।

হেদায়েত বলল, ছবির নামের অর্থটা কী বলো তো – দ্বিতীয় কদম ফুল মানে কী?

সেতু বলল, প্রথম এই নাম ছিল। রবিন ভাইয়ের দেয়া নাম। রবীন্দ্রনাথের গান থেকে নেয়া। এখন নাম চেঞ্জ হয়েছে। এখন ছবির নাম ‘দুষ্ট প্রজাপতি’। নাম সুন্দর না?

বুঝতে পারছি না, সুন্দর কি-না।

কমার্শিয়াল ছবির জন্যে খুব সুন্দর নাম। ভালো কথা, নাদুর মা ঠিকমতো কাজ করছে?

ও তো চলে গেছে।

বল কি! আমাকে তো কিছু বলো নি। কবে গেছে?

মনে নাই কবে গেছে।

তোমার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা কী?

হোটেল থেকে খাওয়া আসে, কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।

রাতে ঘুম ভালো হচ্ছে?

খুব ভালো ঘুম হচ্ছে। সারাদিন খুব পরিশ্রম করি তো, এই জন্যে রাতে বিছানায় যাওয়া মাত্র ঘুম।

কীসের এত পরিশ্রম?

সারাদিন হেঁটে হেঁটে ভাইজানকে খুঁজি। উনি হারিয়ে গেছেন এই জন্যেই খুঁজা।

বলো কি? কত দিন আগের ঘটনা?

প্রায় এক মাস। সেতু আমি রাখি। খুব ঘুম পাচ্ছে।

হেদায়েত টেলিফোন রেখে ঘুমুতে গেল। ঘুমুতে যাওয়টি এখন তার জন্যে অনেক আনন্দময় হয়েছে। সারাদিনের পরিশ্রমের সঙ্গে যুক্ত হয় ঘুমের ওষুধ। আরামদায়ক তন্দ্রা নিয়ে আত্মা ইকুয়েশনের চিন্তা। টাইম ইনডিপেনডেন্ট ইকুয়েশন বের করতে হবে। কারণ আত্ম সময় নির্ভর না। আচ্ছা পশু-পাখি এদের কি আত্মা আছে? নিম্ন শ্রেণীর আত্মা। এদের বোধশক্তি কিছু পরিমাণে আছে। বোধ কি আত্মার কোনো ধর্ম?

আবার টেলিফোন বাজছে। সেতু কি আবার করেছে? না-কি ভাইজান? ভাইজান হবার সম্ভাবনা কতটুকু? হেদায়েতের ঘুম পুরোপুরি কেটে গেল।

হ্যালো?

স্যার আমি নীতু।

ও আচ্ছা। আমি ভেবেছিলাম ভাইজান টেলিফোন করেছেন।

স্যার আমি টেলিফোন করতাম না খুব জরুরি কারণে টেলিফোন করেছি। সময় জানার জন্যে টেলিফোন করেছি। আমার ঘরে কোনো ঘড়ি নেই। মা’র ঘরে ঘড়ি। মা দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়েছেন। আমি তো ঘুম থেকে ডেকে তুলে সময় জিজ্ঞেস করতে পারি না।

এখন বাজছে এগারোটা দশ।

ও এত কম? আমি ভেবেছি বারটার উপর বাজে। সার Thank you সময় বলার জন্যে। আপনি কি এখন ঘুমুতে যাবেন?

হ্যাঁ।

আমার ঘুম আসছে না। স্যার কী করি বলুন তো?

ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়।

ঘুমের ওষুধ কই পাব? মা’র কাছে অবশ্যি আছে। আমি যদি মার কাছে ঘুমের ওষুধ চাই তাহলে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটবে।

তাহলে না ঘুমিয়ে রাত পার করে দাও।

ম্যাডাম কেমন আছেন স্যার?

ভালো আছে।

আসল কথা বলতে ভুলে গেছি। স্যার আমি আপনার বাসায় গিয়েছিলাম।

ঠিকানা কোথায় পেয়েছ?

ঠিকানা তো আপনিই দিয়েছেন। স্যার আপনার এত ভুলো মন কেন? আপনি হচ্ছেন Absent minded professor, আচ্ছা, স্যার আপনি কি Absent minded professor ছবিটি দেখেছেন?

না।

খুবই হাসির ছবি। হাসতে হাসতে আপনার দম বন্ধ হয়ে যাবে। হেঁচকি উঠে যাবে। Walt disney-র ছবি। ছবিটার একটা DVD আমার কাছে আপনি চাইলে আপনাকে দিতে পারি।

দরকার নেই। নীতু আমি এখন শুয়ে পড়ব।

এত সকাল সকাল কেন ঘুমিয়ে পড়বেন? এখন তো ইচ্ছা করলেই আপনি রাত জাগতে পারেন। সকালে উঠে কলেজে দৌড়াতে হবে না। আচ্ছা ঠিক আছে, ঘুমিয়ে পড়ুন। আপনি আরাম করে ঘুমাবেন আর আমি জেগে থাকব। কী বিশ্রী! স্যার শেষ এক মিনিট কথা বলি?

বলো।

আমি এমন একটা মিসটেক করেছি, বুঝতে পারার পর নিজের গালে নিজে কয়েকবার চড় মেরেছি। তবে তাতে তো আর কোনো লাভ হবে না। মিসটেকটা হচ্ছে- বান্ধবীদের সঙ্গে আপনার বাসায় আসার ব্যাপারটা গল্প করেছি। এরা তার অন্য মিনিং বের করেছে।

কী মিনিং?

খারাপ মিনিং।

খারাপ মিনিংটা কী?

এটা স্যার আমি অপানাকে বলতে পারব না। আমার বয়েসী মেয়েরা তো গসিপ পছন্দ করে। এই গসিপটা খুব ছড়িয়েছে।

নীতু রাখি। ঘুমে আমার চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

আচ্ছা। স্যার ঘুমান।

হেদায়েত বিছানায় শোয়া মাত্র আবার টেলিফোন বেজে উঠল। আজ মনে হয় টেলিফোন দিবস। সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি লাইনটা খুলে রাখা। হেদায়েত আবার উঠে টেলিফোন ধরল। হ্যালো। কে?

কেউ কথা বলছে না। ওপাশ থেকে শো শো শব্দ আসছে। শঙ্খে কান রাখলে যেমন শব্দ আসে তেমন শব্দ। হেদায়েত বলল, কে ভাইজান?

ক্ষীণ স্বরে কেউ একজন যেন বলল, হুঁ।

ভাইজান তুমি কোথায়? হ্যালো হ্যালো।

আর কোনো শব্দ আসছে না। এমন কী হতে পারে যে ভাইজান টেলিফোন পর আছেন, কোনো কারণে কথা বলতে চাচেছন না। হেদায়েতের উচিত কথা চালিয়ে যাওয়া।

ভাইজান আমরা ভালো আছি। তুমি কোথায় লুকিয়ে আছ? ভাবি খুব দুশ্চিন্তা করছেন। তোমার সমস্যাটা কী আমাকে বলো। আমাদের খবর ভালো। তবে আমি মনে হয় পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমি ঠিক করেছি এখন থেকে ডায়েরি লিখব। এতে প্রতিদিনকার কথা লেখা থাকবে। ধীরে ধীরে কীভাবে পাগল হচ্ছি সেটা বোঝা যাবে।

সেতু ভালো আছে। তার ছবিটার নাম বদল হয়েছে। তারা একটা কমার্শিয়াল নাম দিয়েছেন— দুষ্ট প্রজাপতি। সিনেমার কারণে সেতু তার নিজের নাম বদলে রেখেছে দিলরুবা। সিনেমা জগতের নিয়ম হচ্ছে, পুরনো সব ফেলে দিয়ে নতুন করে সব করতে হয়। বিবাহিতা মেয়েদের ছবি দর্শক দেখে না। এই কারণে দিলরুবা অর্থাৎ সেতু হয়তো বিবাহ বিচ্ছেদের দিকে যাবে। আমি এখনও নিশ্চিত না।

তোমার খোঁজ লাগানোর আমরা নানান চেষ্টা করছি। কোনোটাতে লাভ হচ্ছে না। তোমার বাসায় একজন জিন সাধক রাখা হয়েছে। তার নিজস্ব পোষা জিন আছে। জিনের নাম হাফসা। জিন সাধক রোজই হাফসাকে নানান জায়গায় পাঠাচ্ছেন। সে এখনও কোনো খবর আনতে পারছে না। আমার কাছে পুরো বিষয়টাই মিথ্যা বলে মনে হচ্ছে। তোমার কী ধারণা?

তোমার কাষ্ঠ বিতানে একদিন গিয়েছিলাম। সেখানে তোমার একটা অদ্ভুত ক্ষমতার কথা শুনে মুগ্ধ হয়েছি। তুমি না-কি চোখ বন্ধ করে শুধু কাঠের গন্ধ কে বলতে পার এটা কোন গাছের কাঠ?

হ্যালো। ভাইজান হ্যালো। আমার কথা শুনতে পাচ্ছ? হেনা ভাবির একটা কথা বলতে ভুলে গেছি, উনি রোগা হয়ে গেছেন। দেখলে তুমিও চিনতে পারবে না। BMা স্বাভাবিক পর্যায়ে নেমে এসেছে বলে আমার ধারণা। যদিও আমি মাপি নাই। BMI মনে আছে তো বডি মাস ইনডেক্স। আঠারো থেকে বিশের মধ্যে হবার কথা। কিলোগ্রামে শরীরের ওজনকে বড়ি মাসের স্কয়ার দিয়ে ভাগ করতে হবে।

হ্যালো। হ্যালো। ভাইজান হ্যালো।

 

হেদায়েতের লেখা প্রথম দিনের ডায়েরি

আজ ২১ তারিখ। একুশ সংখ্যা হিসাবে খারাপ না। তিন এবং সাত দিয়ে বিভাজ্য। পিথাগোরাসের মতে, তিন এবং সাত এই দুটি সংখ্যাই Magical. নিউমারোলজিতে একুশ হলো তিন। তারা ২১-কে ২+১ হিসেবে তিন করে। এটি একটি হাস্যকর প্রক্রিয়া।

ভাইজান নিখোঁজ আছেন সতেরোদিন ধরে। সতেরো একটা প্রাইম সংখ্যা। এবং আমার খুবই পছন্দের সংখ্যা। এক এবং সাতে সতেরো। এখানে এক যেমন প্রাইম সংখ্যা, আবার সাতও প্রাইম সংখ্যা। আলাদা দুটি প্রাইম সংখ্যায় নতুন একটি প্রাইম সংখ্যা হচ্ছে। ব্যাপারটা আনন্দজনক।

যাই হোক ভাইজানের খোঁজ না পাওয়ায় নানান সমস্যা শুরু হবে। আমি ফ্ল্যাট ভাড়া দিতে পারব না। মাসের তিন তারিখে (আরেকটা প্রাইম সংখ্যা) ফ্ল্যাটের ভাড়া দিতে হয়। এই কাজটা আগে ভাইজান করতেন। আমাকে মনে হয় ভাইজানের কলাবাগানের বাড়িতে উঠতে হবে। পরিমল বাবু আমাকে এই উপদেশ দিলেন। তিনি বললেন, নিজের ভাইয়ের বাড়িতে উঠবেন সমস্যা কি!

সামান্য সমস্যা আছে। হেনা ভাবি চাচ্ছেন না আমি তার বাড়িতে উঠি। তিনি বলেছেন— আমি নিজের যন্ত্রণায় অস্থির। তুমি নতুন যন্ত্রণা নিয়ে আসবে। আমার হাতে নাই টাকাপয়সা। ব্যাংকে তোমার ভাইয়ের একাউন্ট তার নিজের নামে। একটা পয়সা তুলতে পারছি না। তোমার ভাইয়ের বিজনেস থেকে একটা পাই পয়সা আসছে না। শাড়ি-গয়না বেচে খাচ্ছি। তুমি এই বাড়িতে উঠধে না। এটা আমার সোজা কথা।

পরিমল বাবুকে হেনা ভাবির কথা কিছু বলি নাই। এতে ভাবির বদনাম করা হয়। স্বামী নিখোঁজ, এই কারণে দ্রমহিলা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। মানসিক বিপর্যস্ত একজন মানুষ অনেক অর্থহীন কথা বলতে পারেন।

আমি যে খুব চিন্তিত তাও না। তেমন সমস্যা হলে ভাইজানের মতো নিখোঁজ হয়ে যাব। সব মানুষেরই নিখোঁজ হবার Option থাকলে ভালো হতো।

কোয়ান্টাম মেকানিক্স প্যারালাল পৃথিবীর কথা বলে। নিখোঁজ হওয়া মানে এক পৃথিবী থেকে অন্য পৃথিবীতে চলে যাওয়া।

এখন বাজে এগারোটা সাত (দু’টাই প্রাইম সংখ্যা)। কিছুক্ষণ আগে চা খেয়ে পত্রিকা পড়েছি। পত্রিকার বিনোদন পাতায় দিলরুবার (সেতু) একটা ইন্টারভিউ পড়েছি। ইন্টারভিউ’র মাধ্যমে জানলাম তার পছন্দের রঙ সবুজ। কারণ আমাদের প্রফেট (দঃ) সবুজ রঙ পছন্দ করতেন। তিনি সবুজ রঙের পাগড়ি এবং জোব্বা পরতেন। বিষয়টা আমার জানা ছিল না।

দিলরুবার পছন্দের খাবার যে শুটকি এটাও জানতাম না। আমি জানতাম সে শুঁটকির গন্ধই সহ্য করতে পারে না। হয়তো এখন খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন হয়েছে।

আজ এই পর্যন্তই। পরিমল বাবু চলে এসেছেন। আমাকে ভাইজানের সন্ধানে যেতে হবে। পরিমল বাবু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন। বেচারার হাঁটুতে কী যেন সমস্যা হয়েছে।

পরিমল বাবুকে জিজ্ঞেস করতে হবে, যিশুখ্রিস্টের প্রিয় রঙ কী? পরিমল বাবু খ্রিস্টান ধর্ম সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ