হাজি এনায়েত করিম চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। তাঁর ডান হাতে তসবি। তিনি তসবি টানছেন। যে-কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তিনি অজিফা পাঠ করেন। আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবেন। হেদায়েতকে কলেজের চাকরি থেকে বাদ দেয়া হবে। কলেজের পরিচালনা পরিষদও এই মত পোষণ করে। কমিটি মেম্বার দশজনের মধ্যে ছয়জন এ বাদ দেয়ার পক্ষে। বাকি চারজনের ধারণা আরেকবার সুযোগ দেয়া উচিত। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত হচ্ছে— প্রিন্সিপ্যাল সাহেব ঠিক করবেন কী করা উচিত। অংকের একজন ভালো শিক্ষক কলেজের জন্যে দরকার এটা যেমন ঠিক, আবার শিক্ষকের মেন্টালিটিও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে এটা মেয়েদের কলেজ।

হেদায়েত বসে আছে প্রিন্সিপ্যালের ঠিক সামনের চেয়ারটায়। আধঘণ্টার উপর সে বসা। কী জন্যে তাকে ডাকা হয়েছে এখনো তা সে জানে না। তবে তার সময় খারাপ কাটছে না। সে তাকিয়ে আছে প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের ঠিক মাথার উপর রাখা ঘড়িটার দিকে। তার চিন্তা ঘড়ির কাঁটা ডান দিকে ঘুরবে এই ধারণা প্রথম কার মাথায় এল? ঘড়ির কাটা বাদিকে ঘুরলে কি সমস্যা ছিল? প্রথম যিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ঘড়ির কাঁটা ডান দিকে ঘুরবে, তিনি সিদ্ধান্তটা কোন বিবেচনায় নিয়েছেন?

হেদায়েত সাহেব।

জ্বি স্যার।

অনেকক্ষণ আপনাকে বসিয়ে রাখলাম, কিছু মনে করবেন না। অজিফা পাঠ করছিলাম। মন অশান্ত হলে অজিফা পাঠ করে মন শান্ত করার চেষ্টা করি।

হেদায়েত একবার ভাবল জিজ্ঞেস করে অজিফা ব্যাপারটা কী? শেষ। পর্যন্ত জিজ্ঞেস করল না। কারণ প্রিন্সিপ্যাল সাহেব এখনও চোখ বন্ধ করে আছেন। কাউকে কোনো প্রশ্ন করলে চোখের দিকে তাকিয়ে করতে হয়।

প্রিন্সিপ্যাল সাহেব, তজবি পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন। হেদায়েতের দিকে চোখ মেলে তাকালেন।

হেদায়েত সাহেব।

জ্বি স্যার।

একটি অপ্রিয় কাজ করার দায়িত্ব আমার উপর পড়েছে। আপনাকে একটা সংবাদ দেব।

স্যার দিন।

কলেজ কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে আপনাকে এই কলেজে রাখা হবে না। আপনার মতো শিক্ষক পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তারপরেও বাধ্য হয়ে এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।

হেদায়েত বলল, আমি কি কোনো সমস্যা করেছি?

অবশ্যই করেছেন। আপনার সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে আমার রুচিতে বাঁধছে, তারপরেও বলছি। আপনি গভীর রাতে ক্লাশের ছাত্রীদের টেলিফোন করেন। তাদের অশ্লীল পর্নোগ্রাফিক কথা বলেন।

হেদায়েত অবাক হয়ে বলল, স্যার না তো!

প্রিন্সিপ্যাল বললেন, আপনি না বললে তো হবে না। নীতু নামের এক ছাত্রী কমপ্লেইন করেছে। আমার কাছেই করেছে। সে অবশ্যি written কিছু দেয় নাই। written দেয়ার প্রয়োজন নাই। চা খাবেন?

জ্বি না স্যার। আমি কি এখন বাসায় চলে যাব, আর আসব না?

এক তারিখে আসবেন। পুরো মাসের বেতন নিয়ে যাবেন। একটু অপেক্ষা করুন। খোঁজ নিয়ে দেখি। ক্যাশে টাকা থাকলে পুরো মাসের বেতন আজই নিয়ে যান। টাকার জন্য আবার আসার ঝামেলা কেন করবেন?

বেতন নিয়ে দুপুর দু’টায় হেদায়েত বাড়ি ফিরল। সেতু খেতে বসেছিল। হেদায়েতকে দেখে উঠে পড়ল। আনন্দিত গলায় বলল, চটকরে হাতে-মুখে পানি দিয়ে আস, একসঙ্গে খাই। আজ একটা নতুন ধরণের রান্না করেছি। কচুর লতির সঙ্গে মাংসের কিমা। কোনো রান্নার বই থেকে শিখে যে বেঁধেছি তা-না। নিজে নিজেই রাঁধলাম। কচুর লতির সঙ্গে যায় শুধু চিংড়ি মাছ। আমি এই তথ্য বিশ্বাস করি না। খেয়ে দেখ তো কেমন হয়েছে।

হেদায়েত বলল, খুব ভালো হয়েছে।

তুমি তো এখনও খেতে বোস নি। কীভাবে বুঝলে ভালো হয়েছে। হাত-মুখ ধুয়ে আস।

হেদায়েত নিঃশব্দে খেতে বসল। সেতু আগ্রহের সঙ্গে বলল, খেতে কেমন হয়েছে?

হেদায়েত বলল, ভালো।

সেতু বলল, শুধু ভালো? এর বেশি কিছু না?

বেশ ভালো।

এক থেকে দশের মধ্যে কত দেবে?

ছয়।

ছয়! মাত্র ছয়?

হেদায়েত বলল, ছয়কে তুচ্ছ করবে না। ছয় হলো একটি Perfect সংখ্যা। পিথাগোরাসের অত্যন্ত পছন্দের সংখ্যা। ছয়কে ভাগ করা যায় ৩, ২ এবং ১ দিয়ে। ৩+২+১ হয় ছয়। এটাই হলো পারফেক্ট সংখ্যার ধর্ম। আরেকটা পারফেক্ট সংখ্যা হলো ১২, বারোকে ৬, ৩, ২ এবং ১ দিয়ে ভাগ করা যায়। ৬+৩+২+১ কত হয়? বারো।

সেতু বলল, প্লীজ চুপ কর। তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করাই ভুল হয়েছে। ভালো কথা, আমরা কয়েক বন্ধু কক্সবাজার বেড়াতে যাচ্ছি। তুমি যাবে?

নাহ!

জানতাম তুমি যাবে না। কাজেই তোমাকে বাদ দিয়েই প্রোগ্রাম করেছি।

হেদায়েত বলল, রবিন সাহেব কি যাচ্ছেন?

সেতু বলল, হঠাৎ রবিন সাহেবের কথা উঠল কেন? উনি গেলে তোমার কোনো সমস্যা আছে। উনি তোমার মতো গর্ত-মানব না যে গর্ত খুঁড়ে গর্তে বসে থাকেন। উনি ঘুরতে পছন্দ করেন। উনার বারো সিটের একটা মাইক্রোবাস আছে। সেটা নিয়ে আমরা যাচ্ছি।

ভালো তো।

রবিন ভাইকে নিয়ে তোমার কি কোনো কনফিউশন আছে। কনফিউশন থাকলে ঝেড়ে কাশ।

কোনো কনফিউশন নেই।

তোমাকে বলতে ভুলে গেছি উনি একটা ছবি প্রডিউস করতে চাচ্ছেন। ফুল লেংথ ছবি। ইন্টিলেকচুয়াল শুকনা গরুর খড় টাইপ ছবি না। কমার্শিয়েল ছবি। নাচ থাকবে, গান থাকবে, মারপিট থাকবে। হিরো থাকবে, ভিলেন থাকবে, কমেডিয়ান থাকবে। রবিন ভাই চাচ্ছেন আমি যেন সেই ছবিতে অভিনয় করি। তোমার কি আপত্তি আছে?

না।

দিনের পর দিন আউটডোরে থাকতে হবে, এটা মাথায় রেখে তারপর বল। তোমার অসুবিধা হবে না?

উঁহু।

হেদায়েত খাওয়া শেষ করে বলল, আমি একটু ভাইজানের কাছে যাব।

সেতু বলল, যাও। এমন ভাবে বললে যেন আমার পার্মিশন চাচ্ছ। তোমার সেখানে যেতে ইচ্ছা করলে যাবে। রাতে কী খাবে বল, আমি নিজেই রান্না কব। ইটালিয়ান খাবার করব? খাবে।

হুঁ।

তোমার কি ফিরতে দেরী হবে?

বুঝতে পারছি না। ভাইজান আমাকে এক পীর সাহেবের কাছে নিয়ে যাবেন। উনি তাবিজ দিবেন।

তুমি ম্যাথের টিচার। টুয়েন্টিফার্স্ট সেঞ্চুরিতে গলায় তাবিজ বেঁধে ঘুরবে?

ভাইজান আগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছেন। তাছাড়া আমি এখন ম্যাথের টিচার না। আমার চাকরি চলে গেছে।

সেতু বলল, তোমার চাকরি চলে গেছে মানে?

হেদায়েত বিড় বিড় করে বলল, প্রিন্সিপ্যাল সাহেব নিজেই ডেকে বলেছেন। পুরো মাসের বেতন দিয়ে দিয়েছেন।

চাকরি চলে গেল কেন?

একটা মেয়ে আমার বিরুদ্ধে কমপ্লেইন করেছে।

কী কমপ্লেইন করেছে?

আমি না-কি গভীর রাতে ওদের টেলিফোন করি, পর্নোগ্রাফিক কথা বলি।

সেতু বলল, মেয়েটা পাগল না অন্যকিছু? আমার তো ইচ্ছা করছে। মেয়েটাকে থাপড়াতে।

হেদায়েত বলল, বাদ দাও।

সেতু বলল, বাদ দেব কেন? আমার তো রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। একটা মেয়ে মিথ্যা করে একটা কথা বলল আর তাতেই তোমার চাকরি চলে গেল। এটা কি মগের মুল্লুক?

হেদায়েত বলল, আমি এখন যাই। রাতে কথা হবে।

 

বেলায়েতের পরিচিত পীর সাহেব ভক্তদের নিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে এক বজরা টাইপ নৌকায় বাস করেন। তার যোগাযোগ নাকি পানির পীর খিজির আলায়হেস্ সালামের সঙ্গে। তাকে কোনো প্রশ্ন করলে তিনি নদীর পানি ছুঁয়ে জবাব দেন। পানি থেকে তিনি না-কি ইশারা পান।

বেলায়েত ভাইয়ের সমস্যা বিস্তারিত বলতে গেল। পানি-পীরের এক মুরিদান বেলায়েতকে থামিয়ে দিয়ে উদাস গলায় বলল, পানি-পীর কেবলাকে কিছু বলা লাগে না। তিনি সবই জানেন। খামখো সময় নষ্ট। আপনার ভাইকে পীর সাহেবের সামনে হাঁটু গেড়ে বসতে বলেন।

হেদায়েত পানি-পীরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। পানি-পীর ডান হাত নদীর পানিতে ভিজিয়ে হেদায়েতের মাথায় রেখে চোখ বন্ধ করলেন। কিছু সময় পার করার পর চোখ মেলে বললেন, বাধা! রাতে কি ঘুম একেবারেই হয় না।

হেদায়েতের রাতের ঘুমের কোনো সমস্যা নেই। বিছানায় শোয়া মাত্রই ঘুম। তারপরেও বলল, জ্বি ঘুম হয় না।

বদ হজম হয়? কোনো কিছুই হজম হয় না। চুয়া ঠেহর।

হেদায়েতের হজমের কোনো সমস্যা নেই। তারপরেও সে ক্ষীণ স্বরে বলল, জ্বি।

প্রসাবেরও সমস্যা আছে? প্রসাবের রাস্তায় জ্বালাপোড়া আছে? মাঝে মাঝে রক্ত যায়?

হেদায়েত ক্ষীণ স্বরে বলল, জ্বি। তার কাছে মনে হচ্ছে নোংড়া কম্বল গায়ে বসে থাকা মানুষটা ভয়ংকর প্রকৃতির। তার প্রতিটি কথা মেনে নেওয়াই যুক্তিযুক্ত।

বেলায়েত অসহায়ভাবে ভাইয়ের দিকে তাকাচ্ছে। হেদায়েত এইসব কঠিন সমস্যা তার কাছে গোপন করেছে এই ব্যাপারটাও তাকে দুঃখ দিচ্ছে।

পানি-পীর বললেন, চিন্তার কিছু নাই। খিজির বাবার দোয়ায় সব সমস্যার আহসান হবে। আরেকবার আসতে হবে শনিবারে। শনি মঙ্গলবার ছাড়া খিজির বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব নয়।

বেলায়েত পানি-পীরকে কদমবুসি করে পাঁচশ টাকা দিল। পানি-পীর বললেন, আত্মা এতো ছোট কেন বাবা। আত্মা বড় কর। টাকা-পয়সার কোনো প্রয়োজন আমার নাই। বুড়িগঙ্গা নদীর পানি খেয়ে একবার তিনমাস কাটিয়েছি। টাকা দিয়ে আমি কী করব? টাকার দরকার আমার মুরিদানদের বুঝেছ? Understand? দিলে নিম্নে এক হাজার, না দিলে এক কাপ পানি হাতে ঢাইলা দিবা, তাতেও চলবে। Understand?

বেলায়েত আরও একটা পাঁচশ টাকার নোট দিয়ে ভাইকে নিয়ে রওনা হলো। বেলায়েতের মনটা অত্যন্ত খারাপ। ভাইয়ের এত সমস্যা, সে কাউকে কিছু বলছে না।

হেদায়েত বলল, ভাইজান আমার চাকরি চলে গেছে।

বেলায়েত হতভম্ব গলায় বলল, বলিস কি! চাকরি কেন গেল?

হেদায়েত কিছু বলল না। বেলায়েত বলল, বৌকে কিছু জানানোর দরকার নাই। বেকার স্বামী কোনো স্ত্রী দেখতে পারে না। অকারণে ঝগড়াঝাটি করবে। কী দরকার? তুই কলেজ টাইমে বেলায়েত টিম্বারে চলে আসবি। বই-পুস্তক পড়বি। মাসের এক তারিখে বেতনের টাকা আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবি।

আচ্ছা।

দি নিউ বিরানী হাউস এন্ড রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার তোকে বানায়ে দিতে পারি। টাকা-পয়সার হিসাব রাখবি, পারবি না?

পারব।

অংকে তোর যেরকম মাথা না পারার কোনো কারণ নেই। তবে ভাইয়ের রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার হওয়া ঠিক না।

হেদায়েত চুপ করে আছে। ভাইয়ের দুঃখে বেলায়েতের মন অদ্র। তার কেঁদে ফেলতে ইচ্ছা করছে। চোখে পানি চলে আসছে। ভাইয়ের সামনে চোখের পানি ফেলার প্রশ্নই উঠে না। বেলায়েত আলোচনা অন্য খাতে নেয়ার চেষ্টা করল। গলা খাকাড়ি দিয়ে বলল, হাওয়াই মিঠাই বানানোর একটা যন্ত্র। কিনেছি। তোকে দিয়ে দেব। মাঝে মধ্যে হাওয়াই মিঠাই বানাবি।

হেদায়েত বলল, আচ্ছা।

এখন শুধু দুই কালারে বানানো যায়। লাল আর সাদা। তুই চেষ্টা করে দেখ কয়েকটা কালারের করা যায় কি-না। একই ষ্টিকে পাঁচ কালার— সাদা, লাল, সবুজ, হলুদ, নীল।

হেদায়েত বলল, ফুড কালার লাগবে।

বেলায়েত বলল, ফুড কালার তুই ঘুরে ঘুরে জোগাড় করবি। তোর হাতে তো এখন কাজ-কর্ম নাই। তুই বেকার মানুষ।

তা ঠিক।

বেকার বলেছি বলে মনে কষ্ট পাস নাই তো?

না।

অন্য কোনো হোটেলে খান খাবি? চল দুই ভাই মিলে নতুন একটা রেস্টুরেন্টে খানা খাই। দি নিউ দিল্লী হাউস হোটেলের খানা অসাধারণ বলে শুনেছি। পরীক্ষা হয়ে যাক।

হেদায়েত বলল, সেতু আজ নিজের হাতে রান্না করবে। ইটালিয়ান খাবার। বাসায় না খেলে মন খারাপ করবে।

তাহলে বাসায় গিয়ে খা। ভোর এখন প্রধান কাজ স্ত্রীকে তুষ্ট রাখা।

হেদায়েত বলল, তুমি হোটেলে খাও, আমি সামনে বসে থাকব।

বেলায়েতের চোখে আবার পানি আসার উপক্রম হলো। এই না হলে ভাই? বড় ভাই খাবে, সে সামনে বসে থাকবে। রক্তের বন্ধন ছাড়া এই জিনিস কখনও হবে না।

হেদায়েত বাসায় ফিরে দেখে সেতু নেই। চিঠি লেখে চলে গেছে। চিঠিতে লেখা—

হ্যালো পতি!

বিরাট ঝামেলা হয়েছে। রবিন ভাই সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়েছেন। হাতের হাড়ি কনুইয়ের কাছে ভেঙেছে। কম্পাউন্ড ফ্রেকচার। এখন আছেন এ্যাপোলো হাসপাতালে। বেচারা খুবই ভয় পেয়েছে। আমি সান্ত্বনা দেবার। জন্যে যাচ্ছি। রাত দশটার মধ্যে চলে আসব। যদি না আসি, তাহলে বুঝবে আটকা পড়ে গেছি। রবিন ভাইয়ের নিকট আত্মীয় ঢাকায় কেউ নেই। বেচারা অল্পতেই অস্থির হয়ে পড়ে।

তুমি রাতে যা হয় কিছু খেয়ে নিও। নাদুর মাকে বলেছি কষানো মুরগী করতে। আলু চিকণ করে কেটে আলু ভাজি করতেও বলেছি। তোমার তো আলুভাজি পছন্দ। ইটালিয়ান খাবার করতে পারলাম না, সরি।

আরেকটা কথা চাকরি নিয়ে কোনো দুঃশ্চিন্তা করবে না। কোনো একটা ব্যবস্থা হবে।

ইতি

তোমার পত্নী

হেদায়েত ঘড়ি দেখল। সাড়ে দশটা বাজে। সেতু রাতে ফিরবে না। সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বড় বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে আরাম করে ঘুমানো যাবে। শুয়ে শুয়ে সিগারেট খাওয়া যাবে। ভাইজানের কাছ থেকে হাওয়াই মিঠাইয়ের বাক্সটা নিয়ে এসেছে। হাওয়াই মেঠাই বানানো যেতে পারে। ফুড কালার লাগবে। হেদায়েত ডাকল, নাদুর মা!

নাদুর মা বলল, টেবিলে খানা লাগিয়েছি ভাইজান।

হেদায়েত বলল, আজ আর ভাত খাব না। দু’টা হাওয়াই মিঠাই খেয়ে শুয়ে পড়ব।

কী খাইবেন?

হাওয়াই মিঠাই। ক্যান্ডি ফ্লস। আচ্ছা শোনো, হলুদ বেটে কয়েক ফোঁটা হলুদের রস চিপে দিতে পারবে। চেষ্টা করে দেখতাম হলুদ রঙের হাওয়াই মিঠাই করা যায় কি-না।

রাতে সত্যই খাবেন না?

না। তুমি আমাকে কয়েক ফোঁটা হলুদের রস দিয়ে শুয়ে পড়।

নাদুর মা, এখনও দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে হতাশা। সে ঠিক করেছে এই বাড়িতে আর কাজ করবে না। চোখের সামনে এত কিছু ঘটতে দেখা ঠিক না।

ভাইজান একটা কথা বলি?

বল।

দেশের বাড়িত জমি নিয়া মামলা-মোকদ্দমা চলতাছে, আমার যাওয়া দরকার।

দরকার হলে অবশ্যই যাবে। কাল সকালে চলে যাও। বেতন যা পাওনা আছে আমাকে বললেই দিয়ে দিব। আমার সঙ্গে টাকা আছে। আজ মাসের এগারো তারিখ কিন্তু পুরো মাসের বেতন পেয়ে গেছি। কাল সকালে যখন যাবে তখন আমার কাছ থেকে কিছু হাওয়াই মিঠাই নিয়ে যেও। বাচ্চাকাচ্ছাদের দেবে। তারা খুশি হবে।

টেলিফোন বাজছে। হেদায়েত টেলিফোন ধরার জন্যে উঠে গেল। রিসিভার কানে লাগিয়ে বলল, কে সেতু?

ওপাশ থেকে বলল, হুঁ।

রবিন সাহেবের অবস্থা কী?

ভালো।

তুমি কি রাতে ফিরবে?

হুঁ।

অনেক রাত হয়ে গেছে। রাতে না ফিরে বরং সকালে ফির। সেটাই ভালো হবে।

ওপাশ থেকে বলল, আচ্ছা স্যার! আপনি কি ম্যাডামের গলাও চেনন না? আমি নীতু।

ও আচ্ছা, তুমি নীতু।

স্যার, আমি সরি বলার জন্যে টেলিফোন করেছি।

সরি বলবে কেন?

ঐ যে মিথ্যা করে প্রিন্সিপ্যাল স্যারের কাছে আপনার নামে লাগিয়েছি।

মিথ্যা করে লাগালে কেন?

নীতু বলল, আপনাকে আমি টেলিফোন নাম্বার দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আপনি টেলিফোন করবেন। আপনি টেলিফোন করেন না। আমি রোজ রাতে অপেক্ষা করে থাকি। শেষে খুব রাগ উঠে গেল। তখন মিথ্যা করে আপনার নামে লাগিয়েছি। স্যার আপনি কি আমাকে ক্ষমা করেছেন?

হুঁ।

হুঁ না। পরিষ্কার করে বলুন ক্ষমা করেছি।

ক্ষমা করেছি।

আপনার চাকরি চলে যাবার খবর শুনেছি। আমরা খুব হৈচৈ করছি। ধর্মঘট হচ্ছে।

কী জন্যে ধর্মঘট?

আপনাকে যেন আবার নেয়া হয়, এই জন্যে ধর্মঘট।

ও আচ্ছা।

আর আমি প্রিন্সিপাল স্যারকে কী বলেছি জানেন? আমি উনাকে বলেছি – আমার ভুল হয়েছে। অন্য এক লোক টেলিফোন করত। তার গলা হেদায়েত স্যারের মতো। ভালো করেছি না?

বুঝতে পারছি না, ভালো করেছ কি-না। নীতু আমি এখন জরুরি কাজ করছি। টেলিফোনটা রাখি।

এত রাতে কী জরুরি কাজ করছেন?

হলুদ রঙের হাওয়াই মিঠাই বানানোর চেষ্টা করছি।

আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। হলুদ রঙের হাওয়াই মেঠাই কেন বানাবেন?

হাওয়াই মেঠাই বানানোর একটা যন্ত্র আমার বড় ভাই আমাকে কিনে দিয়েছেন। ঐ যন্ত্রটা দিয়ে হাওয়াই মেঠাই বানাচ্ছি।

স্যার সত্যি?

হুঁ সত্যি। নীতু রাখি?

হেদায়েত টেলিফোন রেখে হাওয়াই মেঠাই বানাতে গেল। তার মাথায় নূতন আইডিয়া এসেছে। হাওয়াই মিঠাই তৈরীতে যদি শুকনা মরিচের গুঁড়া দেওয়া হয় তা হলে কি ঝাল হাওয়াই মেঠাই তৈরী হবে? গোল মরিচের গুঁড়া দিলে কী হবে?

রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত হেদায়েত হাওয়াই মিঠাই বানালো। মোট উনিশটা। প্রাইম নাম্বার। এর মধ্যে বারোটা মিষ্টি। বারো হচ্ছে পারফেক্ট নাম্বার। নয়টা ঝাল-মিষ্টি।

রাত সাড়ে তিনটায় হাত-মুখ ধুয়ে বিছানায় ঘুমুতে এসে হেদায়েত অবাক হয়ে দেখল ঝলমলে শাড়ি পরে একটা তরুণী-মেয়ে বিছানায় বসে আছে। তার গায়ের রঙ শ্যামলা। চোখ বিষণ্ণ। মেয়েটাকে খুব চেনা-চেনা লাগছে। মেয়েটা বলল, অনেক রাত হয়েছে। শুয়ে পড়।

হেদায়েত বিড় বিড় করে বলল, আচ্ছা।

মেয়েটা বলল, আজ ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা আছে। তারপরও এসি দেয়া যায়। এসি দেব।

দাও।

মেয়েটা রিমোট টিপে এসি ছাড়ল। হেদায়েতের দিকে তাকিয়ে বলল, শুয়ে পড়। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। বাতি নিভিয়ে দিই?

দাও।

মেয়েটা হেদায়েতের মাথার চুলে বিনি করে দিচ্ছে। মেয়েটার গায়ে কচি আমপাতার গন্ধ। কিছুক্ষণের মধ্যেই হেদায়েত গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।

তার ঘুম ভাঙলেন ম্যাথমেটিসিয়ান রামনুজন। অর্থাৎ হেদায়েতের স্বপ্ন শুরু হলো। হেদায়েত সাহেব সরি আপনার ঘুম ভাঙলাম। রাত সাড়ে তিনটায় ঘুমাতে গেছেন। ঘুম ভাঙানোটা ঠিক হয় নি।

হেদায়েত বলল, কোনো সমস্যা নেই স্যার। আমি আপনাকে চিনেছি। আপনি রামানুজন। যদি অনুমতি দেন পা ছুঁয়ে কদমবুসি করি। আমি আপনার একজন ভাবশিষ্য।

প্রাইম নাম্বার নিয়ে তোমার মাতামাতি দেখে সেটা বুঝা যায়।

স্যার কি একটা ক্যান্ডি ফ্লস খাবেন?

খেতে পারি।

মিষ্টিটা খাবেন, না কি ঝাল-মিষ্টি।

ঝাল-মিষ্টিটাই দাও। ডায়াবেটিস আছে তো।

হেদায়েত অবাক হয়েছে। পরকালে ডায়াবেটিস থাকে এটা জানা ছিল না।

রামানুজন বললেন, তোমার সমস্যাটার একটা সমাধান বের করেছি।

কোন সমস্যার কথা বলছেন স্যার?

ঐ যে একটা মেয়েকে তোমার বিছানায় দেখ। মেয়েটাকে চিনেছ?

জি না স্যার।

ওর নাম মাহজাবিন। রোল নাইনটিন। প্রাইম নাম্বার। মেয়েটাকে তুমি অত্যান্ত পছন্দ কর বলে তোমার মস্তিস্ক তাকে দেখাচ্ছে।

ও আচ্ছা।

আমার ধারণা তুমি পাগল হয়ে যাচ্ছে।

হতে পারে। আমার দাদা পাগল ছিলেন।

ব্যাপারটা বংশগত কারণে নাও হতে পারে। অনেক বড় ম্যাথমেটিশিয়ানরা একটা পর্যায়ে পাগল হয়ে যায়। ক্যান্ডি ফ্লস আরেকটা দাও।

হেদায়েত ক্যান্ডি দিল। রামানুজন বললেন, তুমি আত্মার ইকুয়েশন বের করার চেষ্টা করছ। আমি খুশি। শুরুতেই বেশি জটিলভাবে চিন্তা করবে না।

জি আচ্ছা স্যার। আমি অত্যান্ত আনন্দিত যে আপনি এসেছেন।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ