গুলশানে রবিন খানের একটা তিনতলা গেস্ট হাউস আছে, নাম ওয়েসিস। লেকের দিকে মুখ করা নিরিবিলি বাড়ি। বেশির ভাগ সময় বিদেশী গেস্টরা থাকেন। দেশের কিছু নামী-দামী মানুষকেও বান্ধবীদের নিয়ে এখানে আসতে দেখা যায়। ছোটর মধ্যে চমৎকার ব্যবস্থা। ছাদে সুইমিং পুলও আছে। গেস্ট হাউসে বিদেশী অতিথি যখন বেশি হয় তখন সুইমিং পুলে পানি দেয়া হয়। ওয়েসিসের লিকার লাইসেন্স আছে। বেশির ভাগ গেস্ট হাউসের এই সুবিধা নেই।

রবিন খান মাঝে মাঝে নিজের গেস্ট হাউসে রাত্রি যাপন করেন। তিন তলায় একটা ডিলাক্স রুম তার জন্যে সব সময় আলাদা করা। ডিলাক্স কমের সুবিধা হলো বেড রুমের সঙ্গে লাগোয়া একটা বসার ঘর আছে। বসার ঘরের বড় কাচের জানালা থেকে লেকের পানি দেখা যায়। রবিন খান সোফায় শুয়ে ডিভিডিতে ছবি দেখতে পছন্দ করেন। এই ঘরে ডিভিডি লাইব্রেরি আছে। দেয়ালে ঝুলানো ৪৮ ইঞ্চির একটা ফ্ল্যাট টিভি আছে। টিভিতে ঝকঝকে ছবি আসে।

রাত দশটা, রবিন খানের হাতে গ্লাস। গ্লাসে ব্লাক লেভেল অন দ্যা রক। তিনি গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললেন, সেতু এক চুমুক হুইস্কি খাবে?

শোবার ঘর থেকে সেতু বলল, আমি মদ খাই না।

রবিন বললেন, এসো ছবি দেখি।

সেতু বলল, বাংলা কিছু আছে? ইংরেজি ছবি দেখতে ইচ্ছা করছে না।

তোমার ইংরেজি দেখতে ইচ্ছা করছে না। আর আমার বাংলা দেখতে ইচ্ছা করছে না। দু’জনের মতামতই সমান গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে। এখন বল কী করা যায়?

সেতু বলল, আমার মাথায় কিছু আসছে না।

অন্য কোনো ভাষার ছবি দেই? ইংরেজি সাব টাইটেল থাকল। Is it ok?

Ok.

চায়নিজ কিছু ডিরেক্টর আছেন অসাধারণ ছবি বানান। চায়নিজ ছবি দেখবে?

সেতু শোবার ঘর থেকে বসার ঘরে এসে বসতে বসতে বলল, বাসায় চলে যাব। চব্বিশ ঘণ্টার বেশি হয়ে গেছে হোটেলে আছি। এখন দমবন্ধ লাগছে।

লং ড্রাইভে যাবে? চল আশুলিয়া চলে যাই। সাভারের বাগানবাড়িতে যেতে পারতাম কিন্তু জেনারেটরটা নষ্ট। এসি চলবে না। গরমে কষ্ট পাবে।

সেতু বলল, বাসায় যাব।

রবিন বললেন, হেদায়েত সাহেবের জন্যে অস্থির লাগছে?

সেতু বলল, অস্থির লাগছে। তবে কার জন্যে লাগছে বুঝতে পারছি না। তুমি আমাকে নামিয়ে দেবে, নাকি তোমার ড্রাইভার নামিয়ে দিবে?

আমিই নামিয়ে দিব। তোমার স্বামী যদি জেগে থাকেন তাহলে উনার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করব। সমস্যা আছে?

সমস্যা নেই।

আমি এত রাতে তোমাকে নামিয়ে দিচ্ছি এতেও সমস্যা নেই?

না। সে তোমার আমার মতো সাধারণ মানুষ না।

অসাধারণ মানুষ?

হ্যাঁ অসাধারণ।

কোন অর্থে অসাধারণ? নির্বোধ অর্থে?

সেতু বলল, আমি খারাপ মেয়ে। প্রায়ই তোমার সঙ্গে রাত কাটাচ্ছি। তাই বলে তুমি নির্বোধ বলে আমার স্বামীকে অপমান করতে পার না।

রবিন বললেন, যে স্বামী স্ত্রীর এইসব কর্মকাণ্ড ধরতে পারবে না তাকে সোসাইটি নির্বোধ বলবে না? একি তুমি কেঁদে ফেলছ কেন? সরি! আমি তোমার সঙ্গে কথা চালাচালি খেলা করছিলাম এর বেশি কিছু না। বিলিভ মি। চল তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসি। আমি কিন্তু সত্যি সত্যি তোমার স্বামীর সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করতে চাই।

সে জেগে থাকলে তার সঙ্গে গল্প করবে। আমার ধারণা সে জেগে নেই। রাত ন’টার মধ্যে সে ঘুমিয়ে পড়ে।

আজ হয়তো তিনি জেগে আছেন। তুমি ফিরবেন তার জন্যে অপেক্ষা করছেন।

সেতু বলল, সে কারো জন্যে অপেক্ষা করে না।

রবিন বলল, তুমি এমনভাবে কথাটা বললে যেন এটা বিরাট বড় কোনো গুণ। এটা কোনো গুণ না। আমরা মানুষ। খুবই সামাজিক প্রাণী। আমরা একে অন্যের জন্যে অপেক্ষা করব। এটাই স্বাভাবিক।

সেতু বলল, তোমাকে আগেও বলেছি, এখনও বলছি, সে স্বাভাবিক মানুষ না।

 

হেদায়েত জেগে ছিল। তার হাতে ডরমিকাম টেবলেট। টেবলেট দু’ভাগ করা হয়েছে। ভাগ সমান হয় নি। একদিকে একটু বেশি হয়েছে, অন্যটা কম হয়েছে। সে বেশিটা খাবে, না কমটা খাবে— এটা বুঝতে পারছে না। সেতুর সঙ্গে পরামর্শ করলে হতো। সেতুকে টেলিফোন করতে ইচ্ছা করছে। না। নাদুর মার সঙ্গে পরামর্শ করা যেতে পারে। অষুধপত্রের ব্যাপারটা মেয়েরা ভালো বুঝে।

হেদায়েত নাদুর মা’কে ডাকতে যাবে তখন দরজা ঠেলে সেতু ঢুকল। বিরক্ত মুখে বলল, এত রাত হয়েছে, সদর দরজা খোলা কেন?

হেদায়েত বলল, তুমি আসবে এই ভেবেই হয়ত নাদুর মা খোলা রেখেছে।

সেতু বলল, রনি ভাই আমার সঙ্গে এসেছেন। তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করবেন। চা খাবেন। বসার ঘরে চল। শার্ট গায়ে দিয়ে আস। একজন গেস্টের সাথে কথা বলবে খালি গায়ে! তুমি কথা বল। আমি গোসল করে ড্রেস চেঞ্জ করে তোমাদের সঙ্গে জয়েন করব।

হেদায়েত রবিন ভাইকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। অতি রূপবান একজন মানুষ। বয়স পঞ্চাশের উপর। মাথা ভর্তি সাদা-কালো চুল। বড় বড় চোখ। হাসি হাসি মুখ। রবিন হেদায়েতকে দেখে প্রথমেই বললেন, ভাই আপনার ফ্ল্যাট কি স্মোক ফ্রি জোনে? আজকাল বেশির ভাগ বাড়িই স্মোক ফ্রি। সিগারেট খেতে হলে ছাদে উঠতে হয়।

হেদায়েত বলল, আপনি সিগারেট খান। শুধু আমাদের শোবার ঘরে সিগারেট খাওয়া নিষেধ।

রবীন বললেন, আমি ভাগ্যবান যে আমাকে শোবার ঘরে বসানো হয় নি।

নাদুর মা চা নিয়ে এসেছে। তার চা বানাতে এক মিনিটেরও কম সময় লাগে। চুলায় ফুটন্ত পানির কেটলি থাকে। কেউ চা চাইলে কাপে পানি ঢেলে টি ব্যাগ দিয়ে নিয়ে আসা।

রবিন বললেন, সেতুর কাছে আপনার অনেক গল্প শুনেছি। ইদানীং নাকি রাতে ভূত দেখছেন। মেয়ে ভূত।

হেদায়েত বলল, ভূত ঠিক না। একটা হাত দেখি। দেখিও ঠিক না। আমার কাছে মনে হয় একটা হাতের উপর আমার হাত পড়েছে। মেয়েদের হাতের মতো নরম হাত।

রবিন বললেন, নেট টাইম হাতে একটা ভোলা সেফটিপিন নিয়ে ঘুমাবেন। যেই হাতের উপর হাত পড়বে ওমি সেফটিপিনের সূচ ভাবিয়ে দেবেন।

হেদায়েত বলল, কাজটা ঠিক হবে না।

ঠিক হবে না কেন?

হাতটা তো আমার কোন ক্ষতি করছে না। আমি শুধু শুধু কেন তাকে ব্যাথা দেব?

রবিন বললেন, আমি ঠাট্টা করছিলাম। আপনার যা দরকার তা হলো একজন ভালো নিউরোলজিস্টের সঙ্গে কথা বলা। আমার ধারণা আপনার সমস্যাটা নিউরোলজিক্যাল। নিউরোলজির এক্সপার্ট আমার একজন ভালো বন্ধু আছেন। তাকে দেখাবেন? অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দেব।

হেদায়েত বলল, সমস্যাটা যদি আরো বাড়ে তা হলে আপনাকে বলব।

রবিন বললেন, এই জাতীয় সমস্যা বাড়তেই থাকে কখনও কমে না। কাজেই শুরুতেই টেক কেয়ার করা উচিত। ভাই আমি উঠি।

সেতু তো এখনও বাথরুম থেকে বের হয় নি।

রবিন বললেন, আমি তো সেতুর সঙ্গে কথা বলতে আসি নি। তার সঙ্গে তো প্রায়ই কথা হয়। আমি কথা বলতে এসেছিলাম আপনার সঙ্গে। কথা শেষ হয়েছে, কাজেই বিদায়। নিউরোলজিস্টের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আপনাকে খবর দেব। চায়ের কাপে অনেকখানি চা ছিল। রবিন এক চুমুকে চা শেষ করে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

 

সেতুর গোসল করতে অনেক সময় লাগে। বাথটাবে অনেকক্ষণ পা ডুবিয়ে বসে না থেকে সে গোসল করতে পারে না। গা ডুবিয়ে বসে থাকার সময় তার গান শুনতে হয়। বাথরুমে গান শোনার ব্যাবস্থা আছে। সেতু কিছু পছন্দের গান এই সময় শুনে। পছন্দ ঘন ঘন বদলায়। এখন স্নান সঙ্গীত হিসেবে তার পছন্দ হলো— নদীর নাম ময়ূরাক্ষী কাক কালো তার জল। গানের একটা লাইনে আছে— ‘কোনো ডুবুরী সেই নদীটির পায় নি খুঁজে তল। এই লাইন আসা মাত্র সে বাথটাবের পানিতে মাথাটা পুরোপুরি ডুবিয়ে দেয়। ভাবটা এরকম যেন সে ময়ূরাক্ষী নদীর তল খোঁজার চেষ্টা করছে।

গায়ে টাওয়েল জড়িয়ে সেতু বাথরুম থেকে বের হলো। হেদায়েত বলল, তোমাকে খুব পবিত্র লাগছে।

সেতু বলল, পবিত্র লাগছে মানে কী?

হেদায়েত বলল, মানে গুছিয়ে বলতে পারব না। তবে তোমাকে দেখে নিজের মধ্যে পবিত্র ভাব হচ্ছে। তুমি গায়ে ধবধবে সাদা একটা টাওয়েল

জড়িয়ে আছ, এই জন্যেও হতে পারে। সাদা পবিত্রতার রঙ।

সেতু বলল, অপবিত্রের রঙ কোনটা? আমি যদি গায়ে কালো রঙের টাওয়েল জড়াই তা হলে কি আমাকে অপবিত্র দেখাবে?

জানি না।

সেতু বলল, কালো রঙের টাওয়াল গায়ে জড়াচ্ছি। ভালো করে দেখে বল অপবিত্র লাগছে কি-না।

সেতু কালো টাওয়েল গায়ে জড়ল। হেদায়েত বলল, এখনও পবিত্র লাগছে।

তাহলে তো ভালোই। আমাকে চা দিতে বল। চা খেয়ে পবিত্র অবস্থায় ঘুমুতে যাব। অষুধ খেয়েছ?

অর্ধেকটা খেয়েছি। কম অর্ধেকটা।

এতেই হবে। কিছুক্ষণ গল্প করে ঘুমাতে যাবো। অনেকদিন তোমার সঙ্গে গল্প করা হয় না। সুন্দর একটা গল্প রেডি কর।

ম্যাথমেটিসিয়ান এবেলিয়নের গল্প শুনবে?

ইন্টারেস্টিং তো?

ইন্টারেস্টিং না, দুঃখজনক। এমন প্রতিভাবান একজন অংকবিদ ডুয়েট লড়তে গিয়ে গুলি খেয়ে মারা গেলেন।

দুঃখের গল্প শুনব না। তোমার অংকবিদদের মধ্যে আনন্দের বা মজার কোনো গল্প নেই।

Euler এর গল্প আছে। উনি অংক দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে আল্লাহ আছেন।

ঠিক আছে, Euler সাহেবের গল্পই শুনব।

হেদায়েতের ভালো লাগছে যে তার স্ত্রীর গা থেকে পচা সেন্টের গন্ধটা আসছে না। শোবার সময় সেতু নিশ্চয়ই গায়ে সেন্ট মেখে ঘুমাবে না।

সেতু চা খেয়ে ঘুমুতে এসে দেখে হেদায়েত আরাম করে ঘুমাচ্ছে।

সারারাতই হেদায়েত আরাম করে ঘুমালো। একবার শুধু মনে হলো তার হাত একটা মেয়ের কোমল হাতের উপর পরেছে। এটা কি সেতুরই হাত না-কি অন্য কারোর? তখন হেদায়েত স্বপ্নে ম্যাথমেটিশিয়ান ইউলারকে দেখল। তিনি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলছেন— এটা কার হাত তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা কেন করছেন? যে কোনো সমস্যার সমাধান অংক দিয়ে করা যায়।

হেদায়েত বলল, স্যার আমাকে তুমি করে বলবেন। আপনার মতো মানুষ আমাকে আপনি করে বলছেন আমার খুবই লজ্জা লাগছে।

আমি সবাইকে আপনি বলি। সাত বছরের বালককেও আপনি বলি। বুঝেছ?

ইয়েস স্যার।

এখন আসুন অংক দিয়ে আপনার সম্যাসার সমাধান করি। হাতের আঙ্গুল থাকে পাঁচটা, কাজেই আমাদের ইকুয়েশনটার ফ্যাক্টর হবে পাচটা। ফিফথ অর্ডার ডিফারেনশিয়াল ইকুয়েশন ভেরিয়েবলও পাঁচ। হেদায়েত হাতে কি কোনো আংটি আছে?

ইয়েস স্যার।

এই তো একটা ঝামেলায় ফেললেন। আংটি কি একটা না দুটা।

একটা।

পাথর বসানো আংটি?

জ্বি স্যার।

বিরাট জটিল অংকের মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। কাগজ-কলম দিয়ে ট্রাই করে দেখি।

স্বপ্নের এই পর্যায়ে হেদায়েতের ঘুম ভাঙল। সে বাতি জ্বালালো। অবাক হয়ে দেখল সেতুর হাতে হাত রেখে সে ঘুমাচ্ছে। সেতুর হাতে হীরার আংটি ঝলমল করছে। এই আংটি সেতুর যেই মামা লন্ডন থাকেন তিনি দিয়েছেন।

 

রবিন সাহেবের ঠিক করা নিউরো সার্জনের কাছে হেদায়েত গিয়েছে। সে একা যায় নি, তার ভাইকে নিয়ে গেছে। বেলায়েত ভীতু মুখে বসে আছে এবং মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়ছে। ভাইয়ের জন্যে সে দুঃশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে। নিউরো সার্জনের নাম ড, আখলাক। গম্ভীর ধরণের মানুষ, কিছুটা রাগী। এর মধ্যে একবার বেলায়েতকে বলেছেন, আমি রুগীকে যে সব প্রশ্ন করছি তার উত্তর রুগী দেবে। আপনি উত্তর দিচ্ছেন কেন? আপনাদের বংশে কোনো পাগল আছে?

হেদায়েত উত্তর দেবার আগেই বেলায়েত বলল, চৌদ্দ গুষ্টিতে কেউ নেই স্যার। আমার পরদাদার পাগলামী স্বভাব ছিল, তবে উনি পাগল ছিলেন না। উনি ঠিক করেছিলেন পায়ে হেঁটে মক্কাশরীফে যাবেন। উড়িষ্যা পর্যন্ত যাবার পর তাকে একটা বাঘে খেয়ে ফেলেছিল। চিতা বাঘ। গাছের উপর ঘাপটি মেরে বসেছিল, ঝাপ দিয়ে পড়েছে।

ড. আখলাক, বেলায়েতের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি আর একটি শব্দও করবেন না।

হুঁ, হ্যাঁও না।

বেলায়েত ঝিম মেরে গেল। ড. আখলাক হেদায়েতকে বললেন, আপনার গন্ধ বিষয়ক কোনো সমস্যা আছে?

হেদায়েত বলল, জ্বি না।

বেলায়েত বলল, সে না বলছে কিন্তু স্যার তার গন্ধ বিষয়ে সমস্যা আছে। আমার স্ত্রীর গায়ে কোনো গন্ধ নাই। হেদায়েত তার গা থেকে রসুনের গন্ধ পায়।

ড, আখলাক বললেন, নিউরো সমস্যায় গন্ধ একটি বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। রুগী হঠাৎ নাকে পোড়া গন্ধ পায়। ঝাঝানো গন্ধ পায়। আবার উল্টোটাও হয়– রুগী হঠাৎ হঠাৎ কিছু কিছু সময়ের জন্যে গন্ধহীন হয়ে যায়। আমি কিছু টেস্ট দিচ্ছি। টেস্টগুলি করবেন, CT scan করতে হবে। দশদিন পর আসবেন। একা আসবেন। ভাইকে আনবেন না।

বেলায়েত বলল, স্যার আমার ভাইকে ঠিক করে দিন। টাকা-পয়সা কোনো ব্যাপার না। প্রয়োজনে তাকে ব্যাংকক-সিঙ্গাপুর যেখানে বলেন সেখানে নিয়ে যাব। আপনাদের দোয়ায় আমার টাকা-পয়সা আছে। ক্যাশ টাকা অবশ্যি কম। বেশির ভাগ টাকাই ব্যাবসায় খাটাচ্ছি। তারপরেও চব্বিশ ঘণ্টার নোটিশে দশ-পাঁচ লাখ বের করতে পারব ইনশাল্লাহ।

ড. আখলাক কঠিন গলায় বললেন, সাতদিন পর আসবেন। এবং আবারও বলছি— রুগী একা আসবে। রুগীর সঙ্গে কেউ আসবে না।

চেম্বার থেকে বের হয়ে বেলায়েত বিরস গলায় বলল, ডাক্তার সুবিধার না। বদ ডাক্তার। যে রুগীকে কথা বলতে দেয় না, সে কেমন ডাক্তার। তুই কি বলিস?

হেদায়েত বলল, ভাইজান আমাদের বংশে কোনো পাগল নাই, কথাটা তো ঠিক না। দাদাজান পাগল ছিলেন। শেষের দিকে তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো।

বেলায়েত বলল, আগ বাড়িয়ে মানুষকে এইসব কথা বলার কোনো দরকার আছে? সব জিনিসই প্রকাশ করতে নাই। তোর ভাবীর কিছু সমস্যা আছে, সেটা কি কখনও তোকে বলছি?

না।

বেলায়েত বলল, যাই হোক, তুই যে সমস্যায় পড়েছিস সেটা ডাক্তারের আন্ডারে পড়ে না। পীর-ফকিরের আন্ডারে পড়ে। আমি লোক লাগিয়ে দিয়েছি তারা পাওয়ারফুল পীর-ফকির খুঁজতে শুরু করেছে।

আচ্ছা।

ইসমে আজম জানা কাউকে পাওয়া গেলে তার এক ফুতে সব ঠিক হয়ে যাবে।

হেদায়েত বলল, ইসমে আজমটা কী?

হাই লেভেলের কেরামতি, মারফতি জিনিস। তুই বুঝবি না। তোর বুঝার দরকার কী? তোর সমস্যার সমাধান হলেই তো হলো। না-কি?

হুঁ।

বেলায়েত বলল, একটা সিএনজি নিয়ে চলে যা। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আরাম করে একটা ঘুম দে।

হেদায়েত বলল, বাসায় যেতে ইচ্ছা করছে না।

তাহলে কী করবি?

তোমার সঙ্গে থাকব।

বেলায়েত বলল, আমার সঙ্গে থাকবি মানে কী? আমাকে তোর ভাবীর মায়ের বাসায় যেতে হবে। কার না-কি জন্মদিন। বিয়ে করে এমন যন্ত্রণায় পড়েছি শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের জন্মদিনের যন্ত্রণায় জীবন অস্থির।

হেদায়েত বলল, আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাও।

তোর দাওয়াত নাই, তোকে আমি কীভাবে নিয়ে যাব।

হেদায়েত বলল, ভাবীর মায়ের বাসায় যেতে দাওয়াত লাগবে কেন?

বেলায়েত বলল, লজিকের কথা বলেছিস। তাহলে চল। পথে সস্তা টাইপের খেলনা-ফেলনা কিনতে হবে।

জন্মদিনটা কার?

জানি না কার। কোনো পুলাপানের হবে। তোর ভাবী সকাল থেকে ঐ বাড়িতে বসে আছে।

দুই ভাই একশ’ ত্রিশ টাকা দিয়ে হলুদ রঙের একটা গাড়ি কিনে জন্মদিনের উৎসবে উপস্থিত হলো। জন্মদিন হচ্ছে হেনার বড় ভাইয়ের। সে গ্রামীণফোনের একজন বড় অফিসার। জন্মদিনে হলুদ গাড়ি পেয়ে বেচারা খুবই হকচকিয়ে গেল।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ