বেগম রোকেয়া মেমোরিয়েল কলেজ হেদায়েতের বাসা থেকে বেশি দূরে না। হেঁটে যেতে লাগে উনিশ মিনিট। রিকশায় লাগে পঁচিশ মিনিট। তবে ছুটির দিনে সময় বেশি লাগে। হেঁটে যেতে লাগে তেইশ মিনিট। রিকশায় লাগে সাতাশ মিনিট। ছুটির দিনে রাস্তাঘাট ফাঁকা থাকলেই সবার মধ্যে আলস্য চলে আসে। সবই হেদায়েতের হিসাব করা। হাঁটা পথে তিন মিনিটের আলস্য।

হেদায়েত রিকশা নিয়ে নিল। রিকশায় চিন্তা করার সুযোগ বেশি। কোনো দিকে তাকাতে হয় না। রিকশাওয়ালা যুবক, চেহারা সুন্দর। হাতে ঘড়ি আছে। ঘড়ি পরা রিকশাওয়ালা খুব কম দেখা যায়। হেদায়েত বলল, তোমার নাম কি নাদু?

রিকশাওয়ালা অবাক হয়ে বলল, আমার নাম কালাম। নাদু হবে কী জন্য?

কয়টা বাজে কালাম?

ঘড়ি নষ্ট স্যার।

হেদায়েত ক্লাসে কী পড়ানো হবে সেই চিন্তায় মন দিল।

বৃত্তের ইকোয়েশন গত ক্লাসে বলা হয়েছে।

(x-a)^2 + (y-b)^2 = r^2

বৃত্ত সম্পর্কে মজার কথাটা আজ বলবেন। কোনো বৃত্তের ব্যাস যদি অসীম হয় তখন বৃত্ত আর বৃত্ত থাকে না। বৃত্ত সরল রেখা হয়ে যায়। বৃত্তের পরিধিকে ব্যাস দিয়ে ভাগ দিলে পাওয়া যায় পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় জিনিস। রহস্যময় জিনিসটার নাম ‘পাই’।

2 πr / 2r = π

এই পাইয়ের মান পৃথিবীর কোনো কম্পিউটার এখনও বের করতে পারে নি। তারা হিসাব করেই যাচ্ছে—

3.14159265…

এই হিসাব কখনও শেষ হবে না।

 

ছাত্রীদের কাছে ‘গিরগিটি স্যার’ ছাড়াও হেদায়েতের আরেকটি নাম আছে– ‘আফু স্যার’। আফু হলো আইনস্টাইনের ফুফাতো ভাই।

হেদায়েত ক্লাসে ঢুকে বেশির ভাগ সময়ই দেখেন বোর্ডে লেখা—

আ+ফু = মা+আ

উভয় পক্ষ থেকে আ বাদ দিলে হয়—

ফু = মা

হেদায়েত অনেকবার এই ইকোয়েশনের অর্থ জানতে চেয়েছে। সবাই মুখ টিপে হেসেছে, কেউ জবাব দেয় নি। এক সাহসী মেয়ে শুধু বলেছে, স্যার এটা একটা ধাঁধা। অংকের ধাঁধা। খুব জটিল।

অংকের ধাঁধাটা তেমন জটিল না। মাহজাবিন আহমেদ এই ক্লাসের একজন ছাত্রীর নাম। যার রোল নাম্বার ১৯, হেদায়েত যখনই কোনো প্রশ্ন করেন রোল নাম্বার ১৯-কে করেন। কারণ ১৯ একটা প্রাইম নাম্বার। অন্য প্রাইম নাম্বারের মেয়ে যেমন ১৭, ১৩, ৭, ৫, ৩, ২, ১ এদেরকে প্রশ্ন করে দেখেছেন। কেউ জবাব দিতে পারে না। রোল নাম্বার উনিশ পারে। ছাত্রীরা মাহজাবিনের সঙ্গে হেদায়েত স্যারকে মিলিয়ে মজা করে। মাহজাবিন ব্যাপরটা বুঝতে পেরে কান্না করে। হেদায়েত কিছুই বুঝে না বলে নির্বিকার থাকে।

 

হেদায়েত রোল কল শেষ করেছে। বোর্ডের দিকে তাকাল। আজ বোর্ডে লেখা–

A + F = (M + A)^2 মনে হচ্ছে নতুন কোনো ধাঁধা। হেদায়েত রেজিস্টার খাতা বন্ধ করতে করতে বলল, রোল নাম্বার…

হেদায়েত কথা শেষ করার আগেই ক্লাসের অধিকাংশ মেয়ে একসঙ্গে বলল, লাইনটিন।

হেদায়েতের কাছে ব্যাপারটা মোটেই অস্বাভাবিক মনে হলো না। সে উঠে দাঁড়াতে বাড়াতে বলল, ইয়েস রোল নাইনটিন–দাড়াও।

রোল নাইনটিন কাঁদো কাঁদো মুখে উঠে দাঁড়াল। হেদায়েত বললেন, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সবচেয়ে সিমেট্রিক অবজেক্ট কী?

রোল নাইনটিন প্রায় ফোঁপানোর মতো করে বলল, স্যার স্ফিয়ার! গোলক!

হেদায়েত মনে মনে বলল, বাহ! ক্লাসে Circle পড়ানো হচ্ছে। মেয়েটির পক্ষে বলা স্বাভাবিক ছিল—Circle! তা না বলে সে বলেছে Sphere।

হেদায়েত বলল তোমার Answer correct. Sphere কাটলেই আমরা পাই সার্কেল। তোমার নাম কী?

মাহজাবিন।

ক্লাসের অরেকটি মেয়ে (ছটফটি স্বভাব, রোল ১০, লম্বা ফর্সা, নাম নীতু) গম্ভীর গলায় বলল, স্যার আপনি ইচ্ছা করলে মাহজাবিন সর্ট করে মা ডাকতে পারেন।

ক্লাসে হাসির দমকা ঝড় বয়ে গেল। হেদায়েত এই হাসির কারণ ধরতে পারল না। অল্প বয়েসী মেয়েদের সব কর্মকাণ্ডের পেছনে তেমন কারণ অবশ্য থাকেও না। মাহজাবিন মেয়েটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে। হেদায়েতের হঠাৎ মনে হলো ক্লাসের সবচেয়ে বুদ্ধিমতী এই মেয়েটিকে যদি গত রাতের ঘটনাটা বলেন তাহলে সে হয়তো ঘটনার পেছনের কারণ সম্পর্কে কিছু বলতে পারবে। মেয়েটিকে আলাদা করে কিছু না বলে– পুরো ক্লাসের সবাইকে বলা যেতে পারে। ক্লাসে ছাত্রী সংখ্যা ৩৯, একটা প্রাইম সংখ্যা। প্রাইম সংখ্যার একগাদা মেয়ের মিলিত বুদ্ধি বেশি হওয়ার কথা।

হেদায়েত বললেন, রোল নাম্বার উনিশ বোস।

নীতু বলল, বসবে কেন্ স্যার? দাঁড়িয়ে থাকুক না।

আবারও সবাই হাসছে। হেদায়েত বলল, কাল রাতে আমার জীবনে অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাটা তোমাদের বলব। পড়াশোনার কিছু ক্ষতি হবে।

রোল দশ বলল, স্যার ক্ষতি হোক।

হেদায়েত রাতের ঘটনাটা বলল। কিছুই বাদ দিল না। স্ত্রীর আঙটি হারানো। সেই আঙটি তিন নম্বর ড্রয়ারে খুঁজে পাওয়া। কোনো কিছুই বাদ পড়ল না।

হেদায়েত কলল, তোমরা চিন্তা করবে। তোমাদের মাথায় কোনো ব্যাখ্যা যদি আসে আমাকে বলবে।

ক্লাস শেষের ঘণ্টা পড়ল। হেদায়েত টিচার্স কমনরুমের দিকে রওনা হলো। ক্লাস শেষ হবার পরপরই সে এক কাপ কড়া লিকারের চা খায়। দপ্তরী কালিপদ বিষয়টা জানে। সে চা বানিয়ে রাখে।

কালিপদ চায়ের কাপ হেদায়েতের হাতে দিতে দিতে বলল, পিনছিপাল স্যার আপনেরে দেখা করতে বলেছেন। মনে হয় প্রবলেম।

কী প্রবলেম?

সেটা জানি না। পিনছিপাল স্যাররে বেজার দেখলাম। চা খায়া দেখা করেন।

প্রিন্সিপাল হাজি এনায়েত করিম ছোটখাট মানুষ। মুখে ফিনফিনে দাড়ি আছে। মাথায় সব সময় বেতের টুপী পরেন। প্রচণ্ড গরমেও আচকান পরেন। কলেজে সানগ্লাস পরে থাকেন। তিনি মেয়েদের কলেজের প্রিন্সিপ্যাল। কিন্তু কখনও কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকান না।

স্যার! আমাকে ডেকেছেন?

এনায়েত করিম সাহেব কি সব ফাইল দেখছিলেন। ফাইল থেকে চোখ না তুলেই বললেন, বসুন। ক্লাস শেষ?

জ্বি স্যার।

আপনি যখন ক্লাস নিচ্ছিলেন তখন আপনার ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল আপনি গল্প করছেন। আমার ভুলও হতে পারে।

হেদায়েত বলল, ভুল না স্যার। কাল রাতে আমার জীবনে একটা ঘটনা ঘটেছে, সেটাই সবাইকে বলছিলাম। ভৌতিক ধরনের ঘটনা।

আপনি শিক্ষক মানুষ। আপনার কাজ শিক্ষকত। জীবনের ঘটনা বলা না। আমাকে আপনার একজন কলিগ বলল, ক্লাসে আপনি একবার দাড়িপাল্লা নিয়ে গিয়েছিলেন। এটা কি সত্যি?

জ্বি।

অংকের ক্লাসে দাড়িপাল্লাটা কি জনে বুঝলাম না।

হেদায়েত বলল, হেনরি ক্যাভেনডিস কীভাবে পৃথিবীর ওজন বের করেছিলেন এটা বুঝাবার জন্যে একটা দাড়িপাল্লা নিয়ে গিয়েছিলাম। স্যার আপনি কি পৃথিবীর ওজন জানেন?

না।

পৃথিবীর ওজন হলো (৫৯৭৬x১০)^২১ কিলোগ্রাম। ক্যাভেনডিস সাহেব ওজনটা কীভাবে বের করেছিলেন বুঝিয়ে বলব? শুনলে আনন্দ পাবেন।

এনায়েত করিম সাহেব বললেন, না। আমাকে বুঝিয়ে বলার দরকার নাই। আপনি অংকের শিক্ষক, অংক শেখাবেন। দাড়িপাল্লা দিয়ে পৃথিবীর ওজন মাপা আপনার কাজ না।

জ্বি আচ্ছা।

আপনার সঙ্গে আমার কথাবার্তা ফার্স্ট ওয়ার্নিং হিসাবে ধরবেন। আপনি ভালো শিক্ষক, এতে সন্দেহ নাই। কিন্তু নানান কমপ্লেইন আপনার সম্পর্কে আসছে। এটা ঠিক না।

কী কমপ্লেইন আসছে?

পড়া বাদ দিয়ে পৃথিবীর ওজন মাপা, ব্যক্তিগত গল্পগুজব করা। সবই তো কমপ্লেন। ক্লাস রুম ব্যক্তিগত বৈঠকখানা তো না।

স্যার উঠি?

এনায়েত করিম মাথা নাড়লেন এবং মনে মনে বললেন, গাধার বাচ্চা গাধা।

সামান্য মন খারাপ করে হেদায়েত টিচার্স কমনরুমে বসে আছে। আজ তার একটাই ক্লাস ছিল। ইচ্ছা করলে বাসায় চলে যাওয়া যায়, তবে প্রিন্সিপ্যাল সাহেব বলেছেন ক্লাস শেষ করেই কেউ বাড়ির দিকে কেউ রওনা হবেন না। ক্লাসের পরেও অনেক দায়িত্ব থাকে। অফিস যেমন দশটা-পাঁচটা, কলেজও দশটা-পাঁচটা।

কালিপদ আরেক কাপ চা নিয়ে এসেছে। হেদায়েত চায়ে চুমুক দিল। কালিপদ গলা নামিয়ে বলল, আপনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলতাছে। অংকের নতুন শিক্ষক খুঁজা হইতাছে। শুনছি একজন পাইছে। মহিলা।

হেদায়েত বলল, ও আচ্ছা!

সবকিছুর মূলে আছে আজিজ স্যার।

হেদায়েত আবারও বলল, ও আচ্ছা।

কালিপদ গলা নামিয়ে বলল, তবে আপনেরে কিছু করতে পারবে না। আপনার মতো শিক্ষক কই পাইব? মহিলা শিক্ষক দিয়া অংক আর বাছুর দিয়া হাইল জমি চাষ এক জিনিস।

হেদায়েত বলল, হুঁ হুঁ!

আজকার মতো আপনার ক্লাস শেষ?

হুঁ।

বাড়িতে চলে যান। ঝিম ধরে বইসা থাইকা ফয়দা কী?

তাও ঠিক।

আপনেরে দেইখা মনে হয় চিন্তার মধ্যে আছেন? ঠিক ধরছি কি-না বলেন।

ঠিক ধরেছ।

কী নিয়া চিন্তা করেন?

প্রিন্সিপ্যাল স্যারকে একটা ভুল তথ্য দিয়েছি, এটা নিয়ে চিন্তার মধ্যে পড়েছি।

উনারে কী বলেছেন?

পৃথিবীর ওজন কত সেটা বলেছি। মূল সত্যটা বলা হয় নাই। মূল সত্য হচ্ছে পৃথিবীর কোনো ওজন নাই। পৃথিবীর ওজন শূন্য।

শূন্য?

হুঁ। পৃথিবীর ওজন যেমন শূন্য, তোমার আমার সবার ওজনও শূন্য। বুঝিয়ে বলব- ফাল্ডামেন্টাল পার্টিকেলস হলো ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন। এদেরও ভাঙ্গা যায়। সবশেষে আমরা পাই লেপটনস। এদের কোনো ভর নাই। কাজেই পৃথিবীর কোনো ভর নাই। আমাদের কারোরও নাই। বুঝেছ?

জ্বি।

তাজ্জব হয়েছ না?

হয়েছি।

হেদায়েত বলল, স্ট্রিং থিওরি কথা শুনলে আরো তাজ্জব হবে। অদ্ভুত ব্যাপার! রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাবে। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখবে ছোট বড় স্ট্রিং।

কালীপদ বলল, স্যার আরেক দিন শুনব। এখন ঘণ্টা দিব। ঘণ্টার সময় হয়ে গেছে।

ঘণ্টা দিয়ে চলে আস।

স্যার আইজ না। কিছু কাজও আছে।

আচ্ছা— আরেক দিন।

হেদায়েত কাঠের চেয়ারে হেলে চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে থাকতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল। বিকাল চারটার দিকে প্রিন্সিপ্যাল স্যার হেদায়েতের ঘুম ভাঙ্গালেন বিরক্ত গলায় বললেন— যান বাড়িতে যান। বাড়িতে গিয়ে ঘুমান। কোনো শিক্ষক চেয়ারে বসে নাক ডেকে ঘুমাচেই দেখতেও খারাপ লাগে। রাতে জেগে থাকেন না-কি?

হেদায়েত বলল, জ্বি আচ্ছা স্যার।

প্রিন্সিপ্যাল সাহেব বললেন, জ্বি আচ্ছা স্যার মানে? কী প্রশ্ন করছি— আর কী জবাব দিচ্ছেন! আজ কী বার বলুন তো?

বুধবার।

যান বাড়িতে যান। আর যেন আপনাকে কলেজে এসে ঘুমোতে না দেখি।

হেদায়েত রিকশা করে বাড়ি ফিরছেন। মাথায় ঘুরছে বুধবার। বুধগ্রহ থেকে বারের নাম হয়েছে বুধ। বুধ সূর্যের সবচেয়ে কাছের গ্রহ! মাত্র ৮৮ দিনে সূর্যের চারদিকে একবার চক্কর দেয়। মেরিনার দল এই গ্রহটার খুব কাছাকাছি গিয়েছিল ১৯৭৪ সনের মার্চ মাসে। মাত্র ৪৩৫ মাইল দূর থেকে মেরিনার ছবি তুলেছে।

আচ্ছা সন্ধ্যা তারা কি মারকারি না ভেনাস? হেদায়েত মনে করতে পারছে না। নিজের উপর অত্যন্ত বিরক্ত লাগছে। মনে থাকবে না কেন?

রিকসাওয়ালা বলল, কই যাবেন বললেন না?

হেদায়েত বলল, একটু পর বলি, একটা বিষয় মনে করার চেষ্টা করছি।

কোন দিকে যাব, সেটা বলেন।

হেদায়েত হতাশ গলায় বলল, কেন বিরক্ত করছ?

রিকশা উল্টা দিকে যাচ্ছে। হেদায়েত তাতে তেমন কোনো সমস্যা দেখল। কলাবাগানের কাছাকাছি গেলে রিকশা থেকে নেমে পড়লেই হবে। কলাবাগানে হেদায়েতের বড় ভাইয়ের বাড়ি। বড় ভাইয়ের নাম বেলায়েত। সপ্তাহে তিন দিন বড় ভাইকে না দেখলে হেদায়েতের খুব খারাপ লাগে। এই সপ্তাই শেষ হতে চলল, এখনও তার বড় ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়নি। পর পর তিন দিন দেখা করতে হবে—বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্র।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ