বাদল দিনের দ্বিতীয় কদম ফুল

প্রথম প্রকাশ – ফেব্রুয়ারি ২০০৯

 

উৎসর্গ

উপন্যাস লেখার একটা পর্যায়ে উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে রক্ত-মাংসের মানুষ মনে হতে থাকে। তাদেরকে বই উৎসর্গ করা কি যুক্তিযুক্ত না? ‘বাদল দিনের দ্বিতীয় কদম ফুল’ বইটির হেদায়েতের বড় ভাই বেলায়েতকে।

 

০১.

হেদায়েতের (হেদায়েতুল ইসলাম) বয়স তেত্রিশ। দেখে মনে হয় চল্লিশ। জণ্ডিস রোগীর মতো হলুদ চোখ। মাথার চুল পড়ে গেছে। জুলফির কাছে যা আছে তার বর্ণ তামাটে। সে একটা মেয়েদের কলেজের (বেগম রোকেয়া মেমোরিয়াল কলেজ) অংকের শিক্ষক। ছাত্রীরা তাকে ডাকে গিরগিটি স্যার। তার চেহারার সাথে তারা গিরগিটির মিল খুঁজে পেয়েছে।

হেদায়েত একজন সুখী মানুষ। সুখী মানুষদের ঘুমের কোনো সমস্যা হয় না। হেদায়েতেরও তাই। রাত নয়টার পর থেকে সে হাই তুলতে থাকে। রাত নটায় ঘুমুতে যাওয়া সম্ভব না বলে সে কষ্ট করে জেগে থাকে। টিভিতে কী হচ্ছে দেখার চেষ্টা করে। হেদায়েতের স্ত্রী সেতুর টিভি দেখা বাতিক আছে। সে রাত আটটার খবর শেষ হবার পর রিমোট নিয়ে বসে এবং একের পর এক চ্যানেল বদলাতে থাকে। হঠাৎ কোনো একটা চ্যানেল পছন্দ হয়ে গেলে মূতীর মতো হয়ে যায়। চোখে পলক না পড়ার মতো অবস্থা হয়। তার পছন্দ ভূত-প্রেতের ছবি। ভূতের ছবি চলার সময় সে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে। এক হাতে সে হেদায়েতের হাত চেপে ধরে থাকে। সেতুর নখ লম্বা (সৌন্দর্য বিষয়ক কারণে), প্রায়ই হেদায়েতের হাতে নখের দাগ বসে যায়।

এই মুহূর্তে সেতু যে চ্যানেল দেখছে সেখানে কোনো একটা ছবি দেখানো হচ্ছে। ছবিতে একজন বৃদ্ধকে ঘিরে নাচানাচি হচ্ছে। বৃদ্ধের মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। দাড়ি সাদা কিন্তু চুল কাশে। হেদায়েত নাচানাচি দেখতে গিয়ে দু’টা জিনিস লক্ষ করল সাতটা মেয়ে নাচছে। সাত হলো একটা প্রাইম নাম্বার। এক এবং সাত ছাড়া এই সংখ্যাকে অন্য কিছু দিয়ে ভাগ দেয়া যাবে না। সাতটা মেয়ের সঙ্গে এগারোজন পুরুষও নাচছে। এগারো আরেকটা প্রাইম নাম্বার। বৃদ্ধকে নিয়ে সর্বমোট সংখ্যা উনিশ। উনিশ আরেকটা প্রাইম নাম্বার। নাচের দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে প্রাইম নাম্বারেরই খেলা। পরিচালক কি ব্যাপারটা ইচ্ছা করেই করেছেন, না-কি কাকতালীয়ভাবে হয়ে গেছে? ছবিতে নিশ্চয়ই নাচের দৃশ্য আরো কয়েকটি থাকবে। সেখানেও যদি প্রাইম নাম্বারের খেলা দেখা যায়, তা হলে বুঝতে হবে ব্যাপারটা চিন্তা-ভাবনা করে করা। হেদায়েত এখন ছবিটি দেখার ব্যাপারে আগ্রহ বোধ করতে শুরু করল। নড়ে-চড়ে বসল।

সেতু বলল, অসাধারণ ছবি। তাই না?

হেদায়েত মাথা নাড়ল। এই মাথা নাড়া থেকে হা-না বুঝার কোনো উপায় নেই।

সেতু বলল, অমিতাভ আংকেলের অভিনয় দেখেছ? অভিনয় গা থেকে ঝড়ে ঝড়ে পড়ছে।

হেদায়েত প্রায় বলেই ফেলছিল, “কোন জন অমিতাভ আংকেল?” শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলালো। বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রীদের চিনতে না পারলে সেতু বিরক্ত হয়। সে মনে করে ইচ্ছা করে না চেনার ভান করা হচ্ছে। ইন্টেলেকচুয়েল সাজার চেষ্টা।

সেতুর বয়স একুশ। সে যথেষ্টই রূপবতী। সাধারণ মেয়েদের তুলনায় লম্বা (পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি)। গায়ের রঙ গোলাপী না হলেও কাছাকাছি। মাথার চুল কোকড়ানো। তবে কিছুদিন আগে পার্লার থেকে চুল স্ট্রেইট করে এনেছে। এতে তাকে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। রূপবতী মেয়েরা সারাক্ষণ সেজেগুজে থাকতে পছন্দ করে। সেতুর মধ্যে এই ব্যাপারটা নেই। তবে আজ সে সুন্দর করে সেজে আছে। গা থেকে সেন্টের গন্ধ আসছে। সেন্টের নাম ব্লু মুন। কোথাও বেড়াতে যাবার কথা থাকলে সেতু সাজে এবং ব্লু মুন সেন্ট গায়ে মাখে। হেদায়েতের ধারণা মুন খুব বাজে সেন্ট। পিসাবের গন্ধের সঙ্গে লেবু এবং বাসি বেলী ফুলের গন্ধ মিশালে যে গন্ধ হয় সে রকম গন্ধ। হেদায়েত অবশ্যি এই সব কথা সেতুকে বলে নি। সে ঠিক করে রেখেছে কোনো এক দিন খুব ভদ্রভাবে সেতুকে এই কথাটা বলবে। আজই বলা যেতে পারে। আজ সেন্ট থেকে পিসাবের গন্ধটা বেশি আসছে। মনে হচ্ছে ত্রিশ পার্সেন্ট পেসাব, বিশ পার্সেন্ট লেবু এবং পঞ্চাশ পার্সেন্ট বাসি বেলী ফুল। অন্য দিন পিসাবের গন্ধ দশ থেকে পনেরো পার্সেন্টের মধ্যে থাকে।

সেতু বলল, কটা বাজে দেখ তো?

হেদায়েত বলল, নয়টা সতেরো। বলে সে নিজেই চমকালো। নয় একটা প্রাইম সংখ্যা আবার সতেরো একটা প্রাইম সংখ্যা। আজ দেখি প্রাইম সংখ্যার ধুম পড়ে গেছে। ব্যাপার কি?

সেতু বলল, এত সুন্দর ছবি, শেষটা দেখতে পারব না!

হেদায়েত হাই চাপতে চাপতে বলল, শেষটা দেখ। আজ না হয় একটু দেরী করে ঘুমালাম।

সেতু বলল, সাড়ে নটার মধ্যে ব্লবিন ভাই গাড়ি পাঠাবেন। আজ রাতে মার বাসায় থাকব। তুমি ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছ কেন? তোমাকে তো যেতে বলছি না। মায়ের বাড়িতে তুমি যেতে চাও না, এই খবরটা আমি জানি। আমার মাও জানেন। কোনো অনুষ্ঠানে এই কারণেই মা তোমাকে ডাকেন না।

হেদায়েত অস্পষ্ট গলায় বলল, প্রয়োজন হলে যাব। অবশ্য আজ শরীরটা খারাপ লাগছে। জ্বর জ্বর ভাব।

সেতু বলল, জুরের অজুহাত দিতে হবে না। তোমার যাবার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি কাল ভোরে দশটা নাগাদ চলে আসব।

আচ্ছা।

ইন্টারকম বাজছে। গাড়ি নিশ্চয় চলে এসেছে। সেতু উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ছবিটা ভালো মতো দেখে রাখ। পরে আমাকে গল্পটা বলবে।

আচ্ছা।

ক্ষিধে হলে বুয়াকে বললেই খাবার দিবে। রাতে ডাল-গোশত করা হয়েছে। তোমার ফেবারিট আইটেম।

থ্যাংক য়ু।

হেদায়েত সামান্য ধাঁধায় পড়ে গেল। ডাগ-গোশত তা ফেবারিট আইটেম কেন হবে? কোনো দিন কি বলেছে? বলার কথা না। খাওয়া-দাওয়া নিয়ে আলাপ করতে তার ভালো লাগে না। অংক নিয়ে আলাপ করতে ভালো লাগে। তবে কেউ পছন্দ করে না বলে সেই আলাপও করা হয় না। ম্যাথমেটিশিয়ান ইউলারের একটা গল্প সে অনেক দিন সেতুকে বলতে চেয়েছে। কি করে ইউলার অংক দিয়ে প্রমাণ করলেন যে, ঈশ্বর আছেন। সেতু গল্পের শুরুতেই বলে, অংক মানসংকের গল্প বন্ধ। অংকের গল্প বলার চেয়ে তুমি বরং আমার গালে একটা চড় দাও।

সেতু চলে গেছে। হেদায়েতের ভালো লাগছে কারণ সেন্টের গন্ধটা এখন আর তাকে কষ্ট দিচ্ছে না। সে হাই তুলতে তুলতে ছবি দেখছে। এখন বড় করেও হাই তুললে সমস্যা নেই। সেতু দেখবে না এবং বলবে না–এত বড় করে হাই তুলছ কেন? আলজিব দেখা যায়। হেদায়েত ছবির গল্পটা মনে রাখার চেষ্টা করছে। কাহিনী কেমন যেন জট পাকিয়ে গেছে। বৃদ্ধ অভিনেতা এখন একটা পাহাড়ি ঝর্নার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর হাতে পিস্তল। পিস্তলটা তিনি তার পরনের কালো রঙের সাফারির পকেটে লুকিয়ে রেখেছেন। ঝর্নার পানিতে অতি রূপবতী একজন তরুণী গোসল করছে। বৃদ্ধ এই দৃশ্য আড়াল থেকে দেখছে। রূপবতী তরুণী কে, বৃদ্ধের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী- কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। এদিকে চোখও মেলে রাখা যাচ্ছে না। হেদায়েতের মনে হচ্ছে সে সোফাতেই ঘুমিয়ে পরবে। ঘুমানোর জন্য সোফাটা আরামদায়ক। অনেকখানি চওড়া, নরম গদি। ছুটির দিনে দুপুরে (যে সব দিন সেতু বাসায় থাকে না) হেদায়েত এই সোফায় ঘুমায়।

 

হেদায়েত সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছে। তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল কাজের বুয়া নাদুর মা।

ভাইজান! খাবার গরম কইরা টেবিলে দিছি, খাইতে আসেন। চোখে পানি দিয়া আসেন।

নাদুর মা আজ খাব না।

খেয়ে ঘুমাইলে আফা গোস্বা হইব। খাইতে আসেন।

হেদায়েত খেতে বস। ডাল-গোশতের সঙ্গে আলু ভাজি করা হয়েছে। সৃজনে-ডাটা রান্না হয়েছে সরিষা দিয়ে। সজনার বোটানিক্যাল নম গত সপ্তাহে এক পত্রিকায় পড়েছে। নামটা মনে আছে।

নাদুর মা’র রান্না ভালো। বেশ ভালো। তার একটাই সমস্যা–খাওয়ার সময় সে পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে। কেউ আশপাশে থাকলে হেদায়েত খেতে পারে না। সেতুর ক্ষেত্রেও এটা সত্যি। তবে সেতু বেশির ভাগ সময় সামনে থাকে না।

হেদায়েত সজনা পাতে নিতে নিতে নাদুর মার দিকে তাকিয়ে বলল, সজনার বোটানিক্যাল নাম মোরিঙ্গা অবিফেরা।

নাদুর মা বলল, ও আচ্ছা।

সাধারণত ফলের আকার হয় গোল। আম, জাম, কাঁঠাল, লটকন, জামরুল— সবই গোল কিম্বা গোলের কাছাকাছি। সজনা একটা ফল। এই ফলটা লম্বা।

জ্বি আচ্ছা।

হেদায়েত বলল, কলাও লম্বা ফল। কলার কথাটা মনে ছিল না। সরি!

নাদু’র মা বলল, ভাইজান মাংস নেন।

মাংস নিতে নিতে হঠাৎ হেদায়েতের মনে হলো – সজনা সম্পর্কে সে এত কিছু জানে অথচ নাদু’র মা’র বিষয়ে কিছুই জানে না।

হেদায়েত বলল, তোমাকে আমরা নাদু’র মা বলি, নাদু ছেলে না মেয়ে?

ছেলে।

সে কত বড়?

বড় আছে। গত বছর শাদী করছে।

নাদু করে কী?

রিকসা চালায়। ভাইজান আপনে তারে দেখেছেন। কতবার এই বাড়িতে টাকা নিতে আসছে। আমার বেতনের টাকা সে নেয়। তার সংসারে লাগায়।

ও আচ্ছা।

একবার আপনে তারে একশ’ টেকা দিছিলেন— সিগারেট আনতে। সিগারেট আইনা বিশ টেকা আপনেরে ফিরত দিল। আপনে বললেন, টাকা ফিরত দিতে হবে না। এটা বখশিশ। ভাইজান মনে নাই?

না। ভুলে গেছি।

ভুইলা গেলেন ক্যামনে? টেকা পাইয়া আফনেরে পাও ছুইয়া সেলাম করছে।

খাওয়া শেষ করে হেদায়েত উঠে পড়েছে। নাদুর মার সিগারেট প্রসঙ্গ তোলায় তার ভালো লাগছে। আজ আরাম করে শোবার ঘরে সিগারেট খাওয়া যাবে। বিয়ের পর একদিনও বিছানায় শুয়ে শুয়ে সিগারেট খাওয়া হয় নি। সেতু সিগারেটের গন্ধ সহ্য করতে পারে না। তার মাথা ধরে। হেদায়েতকে সিগারেট খেতে হয় বারান্দায়। প্রতিবার সিগারেট খাবার পর ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজতে হয় এবং গায়ের শার্টটা বদলাতে হয়। সার্টেও নাকি সিগারেটের গন্ধ লেগে থাকে। সেতুর নাক খুব সেনসেটিভ। হেদায়েত একবার রিডার্স ডাইজেস্টে পড়েছিল, যে সব মানুষের নাক সেনসেটিভ হয় তাদের কান কম সেনসেটিভ হয়। প্রকৃতি একটা বেশি দিলে অন্যটা কমিয়ে দেয়। হেমায়েতের কাছে ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। মানুষ কৃপণ, প্রকৃতি কৃপণ না।

অনেকদিন পর বিছানায় শুয়ে হেদায়েত পর পর দু’টা সিগারেট খেল। বড় ভালো লাগল। ভালো লাগা এমন এক জিনিস যে একবার শুরু হলে সব কিছুই ভালো লাগতে থাকে। শোবার ঘরের বিছানার চাদরটা দেখতে ভালো লাগছে। অন্যদিন এই চাদরের বড় বড় হলুদ ফুলের রঙ চোখে লাগত। আজ লাগছে না। বৃড় বিছানায় আজ আরাম করে একা ঘুমানো যাবে। এটা ভাবতেও ভালো লাগছে। হেদায়েত ঘুমের মধ্যে খুব নড়াচাড়া করে। সেতুর ঘুম খুব পাতলা বলে ঘুম ভেঙ্গে যায়। সেতু রাগ করে। আজ হেদায়েত যত নড়াচড়াই করুক সেতুর ঘুম ভাঙ্গবে না।

খাটের পাশে রাখা টেলিফোন বাজছে। নিশ্চয়ই সেতুকে কেউ টেলিফোন করেছে। এ বাড়িতে হেদায়েতকে টেলিফোনে কেউ চায় না। তা ছাড়া রাত অনেক হয়েছে। সবাই জানে এত রাত পর্যন্ত হেদায়েত জেগে থাকে না।

ধরবে না ধরবে না করেও হেদায়েত টেলিফোন ধরে অনভ্যস্ত গলায় বলল, কে? কে?

ওপাশ থেকে সেতু বলল, টেলিফোন ধরেই কেউ কে কে বলে? সাধারণ ভদ্রতাও শিখবে না? প্রথমে বলবে হ্যালো, তারপর অন্য কিছু।

সরি!

খেয়েছ?

হুঁ।

কী-জন্যে টেলিফোন করেছি মন দিয়ে শোনো। কিছুক্ষণ আগে দেখলাম আমার হতে হীরার আঙটিটা নাই। খুলে পড়ে গেছে কি-না বুঝতে পারছি না। এদিকে এত আনন্দ হচ্ছে আমি কিছুতেই মন দিতে পারছি না। তুমি কি বাথরুমে একটু দেখবে আঙটিটা আছে কি-না। মাঝে মাঝে হাত-মুখ ধোয়ার সময় আমি আঙটি খুলে বেসিনে রাখি।

দেখে আসছি। আমি টেলিফোন ধরে আছি। তুমি দেখে এসে আমাকে বল।

বাথরুমের বেসিনে বা অন্য কোথাও আঙটি নেই। হেদায়েত ফিরে এসে টেলিফোন ধরল। সেতু বলল, পেয়েছ?

হেদায়েত অস্পষ্ট স্বরে বলল, হুঁ।

সেতু বলল, স্পষ্ট করে বল পেয়েছ, না-কি পাও নি?

পেয়েছি।

থ্যাংক গড। আঙুটিটা কি এখন তোমার হাতে?

না।

তা হলে কোথায়?

যেখানে ছিল সেখানেই রেখে এসেছি।

তোমার কি মাথাটা খারাপ? আঙটিটা এনে তিন নম্বার ড্রয়ারে রাখ।

আচ্ছা রাখছি।

এখানে খুবই মজা হচ্ছে। রবিন ভাই ম্যাজিক দেখাচ্ছেন। দড়ি কাটা একটা ম্যাজিকের কৌশল আমি ধরে ফেলেছি।

কী কৌশল?

কী কৌশল আমি কি টেলিফোনে বুলব না-কি? আচ্ছা আমি রাখছি। তুমি আঙটিটা এনে টেবিলের তিন নম্বর ড্রয়ারে রাখ।

আচ্ছা।

সেতু টেলিফোন রেখে দিয়েছে। হেদায়েত সামান্য অস্বস্থি বোধ করছে। কাল সেতু যখন দেখবে ড্রয়ারে আঙটি নেই তখন কী হবে? হেদায়েত ভুড় কুঁচকে আগামীকালের কথাবার্তা কী হবে চিন্তা করার চেষ্টা করছে–

কেন বললে আঙুটি পেয়েছ? কেন মিথ্যা কথা বললে?

তুমি আনন্দ করতে পারছিলে না। মনটা খারাপ করে ছিলে।

আজ যখন দেখলাম আঙটি নাই— মনটা কি ভালো হয়েছে? চুপ হয়ে। থাকবে না, জবাব দাও।

হেদায়েত বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। আগামীকাল কী হবে সেটা আগামীকাল দেখা যাবে। মানুষ ভবিষ্যতে বাস করে না। বর্তমানে বাস করে। ঘুমানোর আগে জটিল কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে হেদায়েতের ভালো লাগে। এই মুহূর্তে সে চিন্তা করছে— আলোর গতি নিয়ে। আইনস্টাইন প্রমাণ করেছেন আলোর গতি ধ্রুবক। কেউ আলোর দিকে এগিয়ে গেলেও সে যে গতি পাবে আলো থেকে উল্টো দিকে দৌড়ালেও একই গতি। সব সময় সব অবস্থায় আলোর গতি এক— এটা কি ঠিক। বিগ ব্যাং এর সময়েও কি তাই ছিল? কোনো কোনো অবস্থায় আলোর গতির হেরফের হতে পারে- এটা ভাবলে কেমন হয়? অতি ক্ষুদ্র জগৎ অর্থাৎ প্লংকের জগতেও কি আলোর একই।

বড় বড় বিজ্ঞানীরা মাঝে মাঝে বিজ্ঞানের ক্ষতিও করেন। তাদের থিওরির বাইরে অন্যরা চিন্তা বন্ধ করে দেয়। ল্যাবরেটরির ফলাফল যা-ই হোক না কেন, সবার একটাই চেষ্টা থাকে প্রচলিত থিওরিতে ফলাফল ব্যাখ্যা করা।

আচ্ছা আইনস্টাইনের জন্ম যদি না হতো তা হলে পদার্থবিদ্যার বর্তমান অবস্থা কী হতো? হেদায়েতের সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে। সিগারেটের প্যাকেট হাতের কাছে। বাতি না জ্বালিয়েই প্যাকেট এবং লাইটার খুঁজে বের করা যাবে। ঘরে ঘুটঘুটি অন্ধকার। বাতি জ্বালাতে হলে সুইচবোর্ডও হাতরে হাতরে খুঁজতে হবে। হেদায়েত সামান্য দ্বিধায় পড়ে গেল। সে সুইচবোর্ড খুঁজবে, না সিগারেটের প্যাকেট এবং লাইটার খুঁজবে?

হেদায়েত সিগারেটের প্যাকেটের জন্যই ডান হাত বাড়িয়ে খাটের পাশের টেবিল হাতড়াতে শুরু করল। আর তখনি তার হাত হঠাৎ করে অন্য একজনের হাতের উপর পড়ল। নরম মেয়ে মানুষের হাত। সেই হাতের আঙ্গুল আলতো করে চেপে ধরল হেদায়েতের হাতের আঙ্গুল। ঘরে তো আর কেউ নেই। এটা কার হাত? হেদায়েত বিকট চিৎকার দিতে চেষ্টা করল চিৎকার দিতে পারল না। শব্দ গলার কাছে এসে আটকে গেল। হেদায়েত হাত ছাড়াতে চেষ্টা করল। পারল না। হেদায়েতের সমস্ত শরীর হঠাৎ ঠাণ্ডা হয়ে গেল।

এর পরের ঘটনাগুলি কীভাবে ঘটেছে, কোনটার পর কোনটা ঘটেছে— হেদায়েত জানে না। সে শুধু দেখল ঘরের বাতি জ্বলছে। ঘরে কেউ নেই। বাতি সে নিজেই জ্বালিয়েছে এটা নিশ্চিত। কোন হাতে জ্বালিয়েছে ডান হাতে না বাম হাতে?

হেদায়েত সময় দেখল- রাত এগারোটা দুই মিনিট। আজকের তারিখ হচ্ছে তিন। তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে—১১ ২ ৩… ফিবোনাক্কি রাশিমালা। ফিবোনাক্কি রাশিমালার বিশেষত্ব হলো— এই রাশিমালার যে-কোনো সংখ্যা

তার আগের দুটি সংখ্যার যোগফল।

হেদায়েতের বাথরুমে যাওয়া প্রয়োজন। খাট থেকে নামতে সাহস হচ্ছে না। কে জানে হাতটা হয়তো খাটের নিচে কোথাও আছে। হেদায়েত খাট থেকে নামমাত্র হাতটা তার পা চেপে ধরবে।

ব্যাপারটা কি স্বপ্নে ঘটেছে? চিন্তা করতে করতে হঠাৎ কখন ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেই জানে না। ভয়ংকর স্বপ্নটা দেখার পর ঘুম ভেঙ্গেছে এবং সে তড়িঘড়ি করে বাতি জ্বালিয়েছে। এত জিনিস থাকতে স্বপ্নে সে হাতটাই বা কেন দেখবে? যুক্তি দাঁড়া করানো যায়। সে সেতুর সঙ্গে আঙটি নিয়ে কথাবার্তা বলেছে। আঙটি আঙ্গুলে পরা হয়। আঙুল থেকে হাত।

যুক্তি দাড়া করাবার পর হেদায়েতের ভয় কিছুটা কমল এবং সঙ্গে তৃষ্ণা অনেক বাড়ল। নাদুর মা খাটের কাছে এক গ্লাস পানি পিরিচে ঢেকে রেখে গিয়েছিল। গ্লাসটা এখনও আছে। পিরিচ দিয়ে ঢাকা। কিন্তু গ্লাসে কোনো পানি নেই। গ্লাসের পানি সে কখন খেয়েছে মনে করতে পারল না।

হেদায়েত সাবধানে খাট থেকে নামল। পানি খাবার জন্য প্রথমে রান্না ঘরে যাবে না-কি প্রথম যাবে বাথরুমে এই নিয়ে সামান্য সমস্যা হলো। ছোটখাট বিষয় নিয়ে তার মাঝে মাঝে বেশ সমস্যা হয়। সে ঠিক করল প্রথমে বাথরুমে যাবে। তৃষ্ণায় পানি খাওয়া আরামের ব্যাপার। বাথরুমের অস্বস্থি মাথায় থাকলে পানি খাবার আনন্দটা থাকবে না।

বড় এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি খেয়ে হেদায়েত ঘুমুতে গেল। ঘড়িতে বাজছে দু’টা পাঁচ। ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে আসছে। ঘরে বাতি জ্বললে সে ঘুমুতে পারে না। বাতি নেভাতে ভয় ভয় লাগছে। হেদায়েত বাতি নেভাল। সেতু যে দিকে শোয় সেদিকে সরে গেল। সেতুর বালিশে মাথা রাখল। এখান থেকে সুইচে সহজেই হাত যাবে। তা ছাড়া আগের মতো হাত টেবিলে যাবে না। অন্ধকারে সুইচ খুঁজে না পাওয়া গেলেও সমস্যা নেই। পাশের বালিশে টিভির রিমোট কন্ট্রোলটা রাখা আছে। পাওয়ার বাটনে চাপ দিলেই টিভি চালু হবে। সুইচ না টিপেও ঘর আলো করার মতো ব্যবস্থা করা যাবে। হেদায়েত চোখ বন্ধ করল। চোখ খোলা থাকলে ঘর যতটা অন্ধকার থাকে চোখ বন্ধ করলে ততটা থাকে না। এটা একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। মানব মস্তিষ্ক হয়তো অন্ধকার পছন্দ করে না। নিজেই নিজের জন্য কিছু আলোর ব্যবস্থা করে। হেদায়েত টিভির রিমোট কন্ট্রোলটার জন্যে হাত বাড়াল। রিমোট হাতেই ধরা থাকুক। তেমন সমস্যা দেখা দিলে যেন রিমোটের জন্য হাতড়াতে না হয়।

রিমোটটা পাওয়া যাচ্ছে না। বালিশ থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে গেছে। হেদায়েত বালিশ থেকে হাত বিছানায় নামিয়ে আনতেই অন্য একটা হাতের উপর হাত পড়ল। সেই হাতের আঙ্গুল আলতো করে আঙ্গুল চেপে ধরেছে। আঙ্গুল বরফের মতো শীতল।

হেদায়েত বিকট চিৎকার করতে শুরু করল। নাদুর মা জেগে উঠেছে। দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে আতঙ্কিত গলায় বলছে— ভাইজান কী হয়েছে? দরজা খুলেন ভাইজান। হেদায়েত গোংগানীর মতো করে চিৎকার করছে–সুইচটা কোন দিকে? নাদুর মা সুইচ কোন দিকে?

এ সময় সে সুইচ খুঁজে পেল। বাতি জ্বালালেী। কোথাও কিছু নেই। বালিশের উপর টিভির রিমোট কন্ট্রোল।

সেতু বাসায় ফিরল সকাল দশটার কিছু পর। হেদায়েত তখনও ঘুমুচ্ছে। নাদুর মা বলল, ভাইজানের কি জানি হইছে। রাইতে এমন চিৎকার!

বল কি!

এমন অবস্থা হইছিল একবার ভাবলাম দরজা ভাইঙ্গা ভিতরে ঢুকি।

পেটে ব্যাথা বা এরকম কিছু?

জ্বে না— স্বপ্ন দেইখ্যা এই অবস্থা।

কী স্বপ্ন?

জিজ্ঞাস করি নাই। রাইতে স্বপ্নের বিষয়ে কোনো কথা বলা ঠিক না। এখন আপনে গিয়া জিগান। দরজা খোলা আছে। ভাইজানকে বলছি দরজা খোলা রাইখা ঘুমান। আবার কী স্বপ্ন দেখেন তার নাই ঠিক।

সেতু শোবার ঘরে ঢুকে দেখে সব কটা বাতি জ্বলছে। হেদায়েত টিভির রিমোট কন্ট্রোল হাতে ধরে ঘুমাচ্ছে। গায়ে হাত দিয়ে ঘুম ভাঙ্গাতেই হেদায়েত চেঁচিয়ে বলল, না না না!

সেতু বলল, উঠে বস তো। কী স্বপ্ন দেখেছ বল? তুমি তো সাত-আট বছরের বাচ্চা না। এমন কী দুঃস্বপ্ন দেখলে যে চিৎকার চেঁচামেচি করে অস্থির? হাত-মুখ ধুয়ে নাশতা খেতে আস। তোমার সঙ্গে ব্রেকফাস্ট করব বলে আমি শুধু এক কাপ চা খেয়েছি।

হেদায়েত দেখল সেতু তিন নম্বর ড্রয়ার খুলছে। হীরার আঙটির এখনই খোঁজ পড়বে। হেদায়েত প্রায় দৌড়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ল। সে অপেক্ষা করছে কখন সেতু বলবে আঙটি কোথায়? সেতু কিছু বলছে না। মনে হয় ঝড়টা উঠবে নাশতার টেবিলে। সবকিছু গুছিয়ে রাখা দরকার। সমস্যা একটাই টেনশনের সময় হেদায়েত গুছিয়ে কথা বলতে পারে না।

নাশতার টেবিলে সেতু আঙটির প্রসঙ্গ তুলল না। পরোটা মুখে দিতে দিতে বলল, স্বপ্নটা কী দেখেছ বল?

হেদায়েত বলল, একটা হাত দেখেছি।

হাতটা কী করল, তোমার গলা চেপে ধরল?

উঁহু।

তাহলে কী? একটা হাত দেখে শুধু শুধু তো কেউ ভয় পাবে না। ছেলের হাত না মেয়ের হাত, না-কি ভূত-পেত্নীর হাত?

মেয়ের হাত।

মেয়ের হাত কী করে বুঝলে— আঙটি পরা ছিল?

হেদায়েত জবাব না দিয়ে অবাক হয়ে সেতুর হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। সেতুর হাতে হীরার আঙটি ঝলমল করছে। হেদায়েত জানে এই আঙটি সে বাথরুমে খুঁজে পেয়ে তিন নম্বর ড্রয়ারে রাখে নি।

সেতু বলল, কথা বলছ না কেন? আঙটি পরা হাত দেখেছ?

হাতের আঙ্গুলগুলি কেমন ছিল? আমার আঙ্গুলের মতো সুন্দর? প্রশ্ন করে করে জানতে হচ্ছে কেন? তুমি নাশতা শেষ করে হড়হড় করে সব বলবে।

আজ তোমার কলেজ নেই? আছে তো! সর্বনাশ!

হেদায়েত নাশতার টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ল। বারোটায় কোঅর্ডিনেট জেওমেট্রির একটা ক্লাস তার আছে। আজকের বিষয় Circle.

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ