কোম্পানীর বড় সাহেবের পাশে গাড়িতে চড়া ভয়াবহ কষ্টের ব্যাপার। মানসিক কষ্ট, শারিরীক কষ্ট। চার ঘন্টা ধরে এই কষ্টটাই ফরহাদ করছে। বড় সাহেবের গাড়িতে রংপুর থেকে ঢাকা আসছে। বড় সাহেব সীটে হেলান দিয়ে আছেন। চোখ বন্ধ, তবে তিনি ঘুমুচ্ছেন না। গান শুনছেন। মাঝে মাঝে আংগুলে তাল দিচ্ছেন। ফরহাদ তার পাশে কাঠ হয়ে বসে আছে। তার প্রচন্ড বাথরুম পেয়েছে। সে গাড়ির ড্রাইভারকে বলতে পারছে না, ড্রাইভার সাহেব দুমিনিটের জন্যে গাড়িটা থামান। আমার একটু ইয়ে করা দরকার। বলা সম্ভব না। তার পকেটে বলতে গেলে পুরো এক প্যাকেট সিগারেট! কেনার পর তিনটা মাত্র সিগারেট খাওয়া হয়েছে। এখনো সতেরোটা আছে। কিন্তু খাওয়ার উপায় নেই। চার ঘন্টা হয়ে গেল সে সিগারেট খাচ্ছে না, ভাবাই যায় না।

গাড়ির এসি চলছে। সেই এসি এমনই এসি যে ঠাণ্ডায় শরীর জমে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ফরহাদ ডীপ ফ্রীজের ভেতর বসে আছে। এসি কমানোর কথা ড্রাইভার সাহেবকে বলাই যাবে না। ওরিয়ন ওষুধ কোম্পানীর এমডি জামিলুর রহমান সাহেব গরম সহ্য করতে পারেন না। তার অফিসের ঘরেও এই অবস্থা। ঢুকলে মনে হয় এস্কিমোদের ইগলুতে ঢোকা হয়েছে। অফিস ঘরে ঢুকে দুতিন মিনিট ঠাণ্ডা খাওয়া এক কথা আর চার ঘন্টা ধরে ডীপ ফ্রীজে বসে থাকা অন্য কথা। সেতো আর পচনশীল কোন পদার্থ না, যে তাকে ডীপ ফ্রীজে থাকতে হবে। সে মানুষ।

গাড়ির ট্রাঙ্কে ফরহাদের হ্যান্ড ব্যাগ আছে। হ্যান্ড ব্যাগে চাদর আছে। মাফলার আছে। চাদরটা জড়িয়ে বসে থাকলে জীবন রক্ষা হত। সেটা কোনক্রমে সম্ভব না। গাড়ি থামবে। ড্রাইভারকে নেমে গিয়ে গাড়ির ট্রাঙ্ক খুলতে হবে। ঘটাং করে শব্দ হবে। আবার ট্রাঙ্ক বন্ধ করা হবে। আবার ঘটাং করে শব্দ। বড় সাহেব খুবই বিরক্ত হবেন। তিনি গান শুনছেন। তার গান শোনায় বাধা পড়বে। ফরহাদের কাছে মনে হচ্ছে বড় সাহেব তালকানা। ভুল জায়গায় তাল দিচ্ছেন।

গান বাজছে। সুন্দর সুন্দর সব গান। রবীন্দ্রসংগীত। অন্য সময় এইসব গান। অনেক ভাল লাগত। এখন সহ্যই হচ্ছে না। ফরহাদ একবার অসুস্থ শরীরে ইলিশ মাছ খেয়ে খুব বমি করেছিল। সেই অসুখ কবে সেরে গেছে, কিন্তু ইলিশ মাছ সে এখনো খেতে পারে না। গন্ধ নাকে গেলেই বমি বমি ভাব হয়। এখন মনে হচ্ছে রবীন্দ্রসংগীতের ব্যাপারেও ওই অবস্থা হবে। যতবার রবীন্দ্রসংগীত কানে আসবে ততবারই বমি ভাব চলে আসবে।

ফরহাদের ডান পায়ের হাঁটুতে টনটনে যন্ত্রণা হচ্ছে। পা নাড়াতে পারলে হত। পা নাড়ানো যাচ্ছে না। পায়ের কাছে দুই পাতিল বগুড়ার দৈ। পাতিল যেন উল্টে না যায় তার জন্যে দুপা দিয়ে সামলাতে হচ্ছে।

ড্রাইভারের পাশে বসেছে বড় সাহেবের খাস বেয়ারা মোকাদ্দেস। মোকাদ্দেসেরও পায়ের কাছে দৈ, কোলের উপর দৈ। বড় সাহেব বগুড়ার সব দৈ কিনে ফেলেছেন। বাথটাবে দৈ ঢেলে গোসল করবেন না-কি? পুরানো কালে রাণীরা দুধে গোসল করতেন। এই আমলের বড় সাহেবরা হয়তো দৈ-এ গোসল করেন।

গাড়িতে ওঠার আগে আগে এক বোতল পেপসি খাওয়া বিরাট বোকামী হয়েছে। দু চুমুক খেয়েই আর খেতে ইচ্ছা করছিল না। তবু পয়সায় কেনা জিনিস ফেলতে মায়া লেগেছে বলে খেয়ে ফেলা। এখন মনে হচ্ছে মায়া করা বিরাট বোকামী হয়েছে। বাথরুম এমন চেপেছে যে বলার মত না। এক বোতল পেপসি, সাত বোতল পেচ্ছাব হয়ে চাপ দিচ্ছে। ফরহাদের ইচ্ছে করছে—গাড়িতেই কাণ্ডটা করে ফেলতে। দৈয়ের হাড়িতে পেচ্ছাব ছিটিয়ে দেয়া। পেচ্ছাব মাখা দৈ—খেতে খারাপ হবে না। নোনতা নোনতা স্বাদ হবে। ছিঃ এইসব সে কি ভাবছে? মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে না-কি?

ফরহাদ তার চিন্তা অন্যদিকে নেবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। পেচ্ছাবের কথা কিছুতেই ভাবা যাবে না। যত ভাববে তত সমস্যা হবে। শেষে দেখা যাবে সত্যি সত্যি সে গাড়িতেই কাণ্ডটা করে ফেলেছে।

বড় সাহেব পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেট বের করলেন। সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, ড্রাইভার! গাড়ি সাইড কর।

মীর্জাপুর শালবনের কাছে গাড়ি দাঁড়িয়েছে। মোকাদ্দেস ছুটে নেমে এসে দরজা খুলেছে। কাজটা ফরহাদের করা উচিত ছিল—কিন্তু সে পা নাড়াতে পারছে না। ডান পায়ে ঝি ঝি ধরেছে।

বড় সাহেব বললেন, বাথরুম করা দরকার।

ফরহাদের মনে হল এমন মধুর বাক্য সে তার জীবনে শুনেনি। এখন তাকে অতি দ্রুত একশানে যেতে হবে। সময় নষ্ট করা যাবে না। বড় সাহেব যেদিকে দাঁড়িয়েছেন তার উল্টো দিকে দাঁড়াতে হবে। বড় সাহেবের কাজ শেষ হবার আগেই কাজ শেষ করে গাড়িতে ফিরে আসতে হবে। ঝিঝি ধরা পা টেনে চলাই মুশকিল। রোড ক্রশ করতে হবে। একের পর এক গাড়ি আসছে। চট করে একটা সিগারেট ধরানো যায়। কয়েকটা টান দিতে পারলেও তো লাভ। ফরহাদ পকেটে হাত দিল। তার এমন কপাল যে দেখা যাবে সিগারেট আছে দেয়াশলাই নেই। ফরহাদ অতি দ্রুত মনে মনে বলল, ও আল্লাহপাক দেয়াশলাই যেন থাকে। তার যেমন ভাগ্য দেয়াশলাই অবশ্যই থাকবে না। আর থাকলেও কাঠি থাকবে না। উত্তেজনায় ফরহাদের হাত কাঁপছে। তার ভাগ্য ভাল। সিগারেট ম্যাচ দুইই আছে। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বৃষ্টি মনে হয় নামবে। বৃষ্টি নামলে কি বড় সাহেব এসি বন্ধ করবেন?

 

গাড়ি আবার চলতে শুরু করেছে। রবীন্দ্রসংগীত এখনো চলছে। তবে এখন শুনতে ভাল লাগছে। এখন মনে হচ্ছে বুড়ো রবীন্দ্রনাথ গানগুলি খারাপ লেখেনি।

হাসি কান্না হীরা পান্না দোলে ডালে,
কাঁপে ছন্দে ভালো মন্দ তালে তালে

পায়ে তাল দিতে ইচ্ছে করছে। সাহসে কুলুচ্ছে না। বড় সাহেবের চোখে পড়তে পারে। মুরুব্বীদের সামনে পা নাচানোটা খুবই অদ্রতা। পুরো পা না নাচিয়ে বুড়ো আংগুল নাচালে হয়। জুতার ভেতর বুড়ো আংগুল কি করছে না করছে কে দেখবে। বুড়ো আংগুল নাচালে রক্ত চলাচলটাও ঠিক থাকবে। পায়ে আগের মত ঝিঝি ধরবে না।

ফরহাদ!

ফরহাদ চমকে উঠল। বড় সাহেব তাকে ডাকছেন। তিনি যে তার নাম জানেন এটাই একটা বিস্ময়কর ঘটনা।

জি স্যার!

কটা বাজে?

এগারোটা দশ।

বড় সাহেব আবার চুপ করে গেলেন। ফরহাদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ভাগ্যিস তার হাতে রেডিয়াম ডায়াল দেয়া ঘড়ি ছিল। নয়তো সময় বলতে পারতো না। বড় সাহেব চোখ বন্ধ করে পড়ে আছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে অসুস্থ। তিনি অপরিচিত কেউ হলে জিজ্ঞেস করা যেত, ভাই সাহেবের কি শরীর খারাপ? এখন তা জিজ্ঞেস করা যাবে না। তিনি প্রশ্ন করলেই শুধু জবাব দেয়া যাবে। তিনি যদি বলেন, আমার শরীরটা ভাল না তবেই শুধু উদ্বেগ নিয়ে বলা যাবে, স্যার কি হয়েছে?

বড় সাহেব বললেন, ঢাকা পৌছতে কতক্ষণ লাগবে? প্রশ্নটা কাকে করা হল ফরহাদ বুঝতে পারছে না। কারণ বড় সাহেবের চোখ বন্ধ। তিনি কারো দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন নি। প্রশ্নটা নিশ্চয়ই ড্রাইভারকে করা হয়েছে। ঢাকা পৌছতে কতক্ষণ লাগবে তা বলতে পারে ড্রাইভার। সে কত স্পীডে গাড়ি চালাবে তা সেই জানে। অথচ ড্রাইভার জবাব দিচ্ছে না। ফরহাদ খুবই অস্বস্তি বোধ করছে। বড় সাহেব একটা প্রশ্ন করলেন। গাড়িতে তিনজন মানুষ কেউ জবাব দিল না–অথচ তিনজন মানুষই প্রশ্নটা শুনেছে—তার মানে কি?

ফরহাদ বলল, স্যার আমরা ইনশাল্লাহ এক ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাব।

তুমি কোম্পানীতে জয়েন করছ কবে? এক বৎসর দুই মাস হয়েছে। চাকরি ভাল লাগছে? জ্বি স্যার। খাটুনি বেশি?

ফরহাদ জবাব দিল না। খাটুনি বেশীলতা বটেই, জেলায় জেলায় ঘুরে বেড়ানো আরামের ব্যাপার না। খাটুনি বেশী বললে স্যার ভাবতে পারেন—খাটুনি বেশী তাহলে ঝুলে আছ কেন? চাকরি ছেড়ে দাও। আর সে যদি বলে কোন খাটুনি নেই। তাহলে আদিখ্যেতা দেখানো হয়। মনে হয় বড় সাহেবকে দেখে সে চামচাগিরি করছে।

বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। বেশ ভাল বৃষ্টি। ড্রাইভার গাড়ি স্লো করে দিয়েছে। ফরহাদ ঘন ঘন ঘড়ি দেখছে। এভাবে গাড়ি চালালে এক ঘন্টায় ঢাকা পৌছানো যাবে না। দেড় ঘন্টা লেগে যাবে। স্যার তখন বিরক্ত হয়ে ভাবতে পারেন—এ কেমন ছেলে কোন অনুমান নেই। দেড় ঘন্টা লাগবে, বলে বসেছে এক ঘন্টা। এইসব বেআক্কেল কর্মচারীদের কোম্পানীতে থাকা ঠিক না।

গাড়ি এখন গাজিপুর চৌরাস্তা পার হচ্ছে। এখান থেকে ঢাকা কতদূর-চল্লিশ কিলোমিটার? ঘন্টায় এক কিলোমিটার করে গেলেওতো চল্লিশ মিনিটে পৌঁছে যাবার কথা। ড্রাইভার গাড়ি স্লো চালাচ্ছে ঠিকই তাই বলে ঘন্টায় ষাট কিলোমিটারের নিচে চালাচ্ছে বলেতো মনে হয় না। ফরহাদ একটু সামনে এগিয়ে স্পিডোমিটার দেখার চেষ্টা করল। আর এতেই পায়ের কাছের দৈ-এর হাড়িতে মট করে শব্দ হল।

সর্বনাশ হাড়ি ভাঙ্গে নিতো?

ভাঙ্গা হাড়ি চুইয়ে দৈ পড়বে। দামী গাড়ি মাখামাখি হবে। স্যার ভাববেন এই বেকুব সামান্য একটা দৈয়ের হাড়িও ঠিকঠাকভাবে রাখতে পারে না?

 

ফার্মগেটে গাড়ি থামলো।

ফরহাদ গাড়ি থেকে নামলো। তার খুবই লজ্জা লাগছে। তার জন্যে বড় সাহেবকে গাড়ি থামিয়ে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। গাড়ি থামতো আর সে চট করে নেমে যেত তাহলেও একটা কথা ছিল। তাতো না, গাড়ির ট্রাংক খুলে হ্যান্ড ব্যাগ বের করতে হচ্ছে। তার ভাগ্যটা এমনই যে ট্রাংক খুলছে না। কি যেন আটকে গেছে—ড্রাইভারকে ঘট ঘট করতে হচ্ছে। তিনবারের চেষ্টায় ট্রাংক খুললো। ফরহাদ বড় সাহেবের জানালার কাছে এসে বিনীত গলায় বলল, স্যার যাই?

বড় সাহেব জানালার কাচ নামালেন। এটা অসাধারণ জ্বতার একটা ব্যাপার। বৃষ্টি হচ্ছে, এর মধ্যে জানালার কাচ নামানোর দরকার ছিল না। ফরহাদ দ্বিতীয়বার বলল, স্যার যাই। স্নামালিকুম।

বড় সাহেব বললেন, একটা দৈয়ের হাড়ি নিয়ে যাও।

ফরহাদ অসম্ভব বিব্রত হয়ে বলল, জ্বি না স্যার।

না কেন নিয়ে যাও। আমি এত দৈ দিয়ে কি করব। মোকাদ্দেস একে এক হাড়ি দৈ দিয়ে দাও তো।

বড় সাহেব জানালার কাচ উঠিয়ে দিলেন। এখন আর কথা চলে না। মোকাদ্দেস বিরক্ত মুখে দৈয়ের হাড়ি ফরহাদের হাতে ধরিয়ে দিল।

বারোটা ত্রিশ বাজে। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তা ঘাট ফাঁকা। ফরহাদ যাবে ঝিগাতলা। বেবীটেক্সী নিতে হবে। এত রাতে রিকশা করে যাওয়া ঠিক হবে না। হ্যান্ড ব্যাগ, দৈয়ের হাড়ি সব যাবে। খবরের কাগজের ভাষায়—গভীর রাতে দৈ ছিনতাই।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভেজার অর্থ হয় না। কোন দোকানের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আরাম করে সিগারেট ধরানো যেতে পারে। শেষ সিগারেট দুটা টান দিয়ে ফেলে দিতে হয়েছিল। এবারেরটা ফিল্টার পর্যন্ত খাওয়া যাবে। তবে ফিনফিনা বৃষ্টিতে ভিজতেও খারাপ লাগছে না। তার ঠিক সামনেই একটা পেট্রল পাম্প। পেট্রল পাম্পে অপেক্ষা করা যায়। সমস্যা একটাই পেট্রল পাম্পে সিগারেট খাওয়া যাবে না। তাছাড়া পেট্রল পাম্পে খারাপ টাইপের একটা মেয়েও দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িতে পেট্রল নিতে আসবে এমন কোন কাস্টমারের জন্যে অপেক্ষা। ফরহাদকে দেখে এই মেয়ে উৎসাহিত হয়ে উঠতে পারে। ফরহাদ তার দিকে তাকিয়েছিল বলে এখনই সে খানিকটা উসখুস করছে। পেট্রল পাম্প ছেড়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে তার কাছে চলেও আসতে পারে। প্রথমবার মেয়েটা যা করবে তা হল গম্ভীর ভঙ্গিতে সামনে দিয়ে হেঁটে যাবে। একবারও তাকাবে না। কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে আসবে তখন থমকে দাঁড়িয়ে মাথা ঘুরিয়ে তাকাবে এবং হাসবে। তারপর ফরহাদের দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে এগিয়ে আসতে থাকবে। দূর থেকে মেয়েটাকে সুন্দর দেখা গেলেও কাছে যখন আসবে তখন দেখা যাবে কুৎসিত। শরীর এবং মনের অত্যাচার মেয়েটার মুখে চিরস্থায়ী ছাপ ফেলে দিয়েছে।

কি আশ্চর্য মেয়েটা সত্যি সত্যি আসছে। ফরহাদ দৈয়ের হাড়ি মাটিতে নামিয়ে সিগারেট ধরাল। যারা ধুমপান করে না তারা জানে না ধুমপায়ীদের কাছে সিগারেট শুধুমাত্র নেশা না এক ধরনের আশ্রয়ও। সে এখন সিগারেটের কাছে আশ্রয় খুঁজছে। মেয়েটাকে কি বলা যায়? তাকে বলা যেতে পারে—নিশিকন্যা শুনুন। আপনি ভুল জায়গায় এসেছেন। আমি সেই টাইপের ছেলে না। আমি একজন স্কুল শিক্ষকের জ্যৈষ্ঠ সন্তান। M.Sc পাশ করে বর্তমানে অষুধ কোম্পানীতে ছোট একটা চাকরি করছি। যে চাকরি করছি সেখানে দুনম্বরীর অনেক সুযোগ আছে। এখন পর্যন্ত তার ধারে কাছে যাই নি। কোনদিন যাব তা মনে হয় না। আমি নিতান্তই ভাল মানুষ টাইপের একজন। আমার একটি মেয়ের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছে। মেয়েটির নাম আসমানী। আমি তাকে ঠাট্টা করে ডাকি মিস স্কাই। যে কোন দিন তার সঙ্গে আমার হুট করে বিয়ে হয়ে যেতে পারে। বিয়েটা আসলে আটকে আছে মিস স্কাই-এর মামার জন্যে। তিনি থাকেন জাপানে। কিছু কিছু ভাগ্যবান মানুষ আছেন সূত্রধর টাইপ। দূর থেকে সূতা ধরে পুতুল চালান। আসমানীর এই মামা হচ্ছেন সূত্রধর মামা। তিনি জাপানে বসে আসমানীদের পরিবারের সুতা ধরে থাকেন। এই সূত্রধর মামা তিন সপ্তাহের ছুটিতে দেশে ফিরবেন। তখন আসমানী মামাকে সব বলবে। আসমানীর ধারণা মামা তখন বিয়ের ব্যবস্থা করবেন। কাজেই ম্যাডাম বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আমার কাছে আসা অর্থহীন। আপনার জন্যে পেট্রল পাম্পে গাড়িওয়ালা কোন কাস্টমারের জন্যে অপেক্ষা করাই ভাল হবে।

মেয়েটি ফরহাদের সামনে দিয়ে হেঁটে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই একটা খালি বেবীটেক্সী সামনে দাঁড়াল। দরদাম করার সময় নেই। ফরহাদ বেবীটেক্সীতে উঠে পড়ল। মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। ফরহাদের চট করে বেবীটেক্সীতে উঠা দেখে সে মনে হয় বেশ অবাক হয়েছে। কাছে থেকেও মেয়েটার চেহারা খারাপ লাগছে না। বৃষ্টির জন্যে মাথায় শাড়ির আঁচল তুলে দিয়েছে। মেয়েটার মধ্যে বউ বউ ভাব চলে এসেছে। মিষ্টি নরম চেহারা। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার আসমানীর সঙ্গে মেয়েটার চেহারায় কোথায় যেন একটু মিল আছে। ফরহাদ লজ্জিত বোধ করল—এমন বাজে টাইপের মেয়ের সঙ্গে আসমানীর চেহারার মিল থাকবে কেন?

বেবীটেক্সীওয়ালা টেক্সী স্টার্ট দিয়েছে। ফরহাদ বলল, কলাবাগান চল। বেবীটেক্সীওয়ালা মেয়েটার দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল, একা যাইবেন?

ফরহাদ বিরক্ত মুখে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ একা। বৃষ্টি আবারো জোরে নেমেছে। মেয়েটার উচিত দৌড়ে পেট্রল পাম্পে চলে যাওয়া। সে যাচ্ছে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে। তার চোখে অবাক ভাবটা এখন আর নেই। দৈ-এর হাড়িটা মেয়েটাকে দিয়ে দিলে ভাল হত। এদেরতো কেউ কখনো কোন উপহার দেয় না। সে না হয় দিল এক হাড়ি দৈ। হাড়িটা দিয়ে সে বলতে পারত–বাড়িতে নিয়ে আরাম করে খাও। বগুড়ার মিষ্টি দৈ। ফ্রেশ দৈ। আজই কেনা হয়েছে। ফরহাদ কি বলবে বেবীটেক্সীওয়ালাকে—বেবীটেক্সী ঘুরাতে। অনেক দূর চলে এসেছে। এখন বলাটা ভাল হবে না। বেবীটেক্সীওয়ালা নানান কিছু ভাবতে পারে। ফরহাদের মন খারাপ লাগছে।

 

ঢাকা শহরের বাসাবাড়িতে আজকাল টিউবওয়েল দেখা যায় না। তবে ঝিকাতলায় ফরহাদদের বাসায় টিউবওয়েল আছে, কলতলা আছে। একতলা বাসা। তিন ইঞ্চি গাঁথুনীর দেয়াল উপরে টিনের ছাদ। টিউবওয়েলের পেছনে গ্রামের বাড়ির মত কলাগাছ। সব মিলিয়ে পাঁচটা গাছ। একটায় থোর বের হয়েছে।

টিনের দেয়াল দিয়ে ঘেরা সাত কাঠা জায়গায় চার কামরার এই বাড়ির মালিক ফরহাদের খালাতো ভাই রহমত উল্লাহ। ভদ্রলোক থাকেন সুইডেনে। বছর চারেক আগে এক সুইস মেয়ে বিয়ে করেছেন। তিনি যে দেশে ফিরবেন এবং এই জায়গার দখল নেবেন সেই সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। এই ভরসাতেই ফরহাদের বাবা নিজের শখ মিটিয়ে বাড়ির চারপাশে গাছ পালা লাগিয়েছেন। তার নিজের হাতে লাগানো নারিকেল গাছে নারিকেল ধরে গেছে। গত বছর জাম্বুরা গাছে ছাপ্পান্নটা জাম্বুরা হয়েছিল। কমলার মত মিষ্টি জাম্বুরা। সবই পাড়াপড়শিকে বিলি করা হয়েছে। তবে তিনি ঠিক করেছেন এ বছর থেকে কিছু ফল ফলান্তি বিক্রি করবেন। গাছের পেছনে খরচ আছে, সার কিনতে হয়। হাফ কেজির এক প্যাকেট জৈব সার পঁচিশ টাকা। গোবর কিনতেও অনেক টাকা লাগে। এক বস্তা ভাল গোবর পঁচাত্তর টাকা। কেরিং খরচ আছে নার্সারীর গাছ কিনতেও টাকা লাগে। কলমের একটা দারচিনি গাছ তার খুব মনে ধরেছে। টবের গাছ, দাম চাচ্ছে তিনশ। কুলাকুলি করলে দুশতে দিয়ে দেবে। এইসব খরচপাতির জন্যে ছেলের কাছে হাত পাতার অর্থ হয় না। ফল বিক্রির টাকায় ছছাটখাট খরচ সামাল দেয়া যায়। দশ টাকা করে ধরলেও ছাপ্পান্নটা জাম্বুরার দাম হয় পাঁচশ ষাট টাকা।

ফরহাদ কলের পাড়ে সাবান ডলে গোসল করছে। পাশে বসে গভীর আগ্রহের সঙ্গে ছেলের স্নানের দৃশ্য দেখছেন বেগম রোকেয়া গার্লস হাই স্কুলের রিটায়ার্ড অংক শিক্ষক জোবেদ আলি। তিনি এখনো ভাত খাননি। ফরহাদ রাতে ফিরবে, ছেলের সঙ্গে খাবেন। এই জন্যেই অপেক্ষা। ফরহাদের মা রাহেলা বেগম ভাত চড়িয়েছেন। বোয়া উঠা সদ্য রাধা ভাত ফরহাদের অতি প্রিয়।

টিপটিপ করে বৃষ্টি এখনো পড়ছে। জোবেদ আলি এই বৃষ্টির মধ্যেও বসে আছেন। ফরহাদ বলল, বৃষ্টিতে যেভাবে ভিজছ তুমিতো বাবা ঠাণ্ডা লাগাবে।

জোবেদ আলি গম্ভীর গলায় বললেন, বৃষ্টি গাছের জন্যে যেমন দরকার মানুষের জন্যেও তেমন দরকার। বর্ষার বৃষ্টিতে ভিজলে অসুখ বিসুখ হয় না। ঘুসঘুসা জ্বরের মহৌষধ হল বৃষ্টি। অদ্রিা রোগের জন্যেও বৃষ্টি ভাল।

তাই নাকি?

গ্রামদেশে পাগলের চিকিৎসা কিভাবে করে জানিস? ভরা বৃষ্টির সময় উলংগ করে উঠানে বেধে রাখা হয়।

ও আচ্ছা।

এই চিকিৎসার নাম মেঘ চিকিৎসা। পাগলরা দেখবি মেঘ বৃষ্টি খুব ভয় পায়। কোন পাগলকে দেখবি না নিজের ইচ্ছায় বৃষ্টিতে ভিজছে।

জোবেদ আলি ছেলের সঙ্গে গল্প করে খুব আরাম পাচ্ছেন। আগে তিনি একেবারেই কথাবার্তা বলতেন না। এখন খুব কথা বলেন। তাঁর কথাবার্তা ভাল জমে ফরহাদের সঙ্গেই। ছোট ছেলে মঞ্জু গম্ভীর প্রকৃতির। অল্পতেই বিরক্ত হয়ে ভুরু কুঁচকে তাকায়। তার সঙ্গে আলাপ জমে না।

ফরহাদ!

জ্বি।

দৈয়ের হাড়ি কত দিয়ে কিনলি?

আমি কিনিনি বাবা। আমাদের এমডি সাহেব কিনেছেন। উনার সঙ্গে এক গাড়িতে ফিরেছি। গাড়ি থেকে নামার সময় একটা হাড়ি দিয়ে দিলেন।

মনে হচ্ছে বিশিষ্ট ভদ্রলোক।

হ্যাঁ ভদ্রলোকতো বটেই। আমার বাসে ফেরার কথা। বাসের টিকিটও কাটা ছি। উনি বললেন আমার সঙ্গে চল।

বাসের টিকেটের টাকা কি মার গেছে?

না টিকেট ফিরত নিয়েছে। দশ টাকা কেটে রেখেছে। এমডি সাহেবের দেশ কোথায়?

জানি না কোথায়। উনার মত মানুষের সঙ্গে খেজুরে আলাপ করা যায় না। আমিতো আর জিজ্ঞেস করতে পারি না—স্যার আপনার গ্রামের বাড়ি কোথায়? ছেলে মেয়ে কি? ছেলে মেয়েরা কে কোন ক্লাসে পড়ে।

তাতো বটেই।

ফরহাদের গোসল শেষ হয়েছে। টিউবওয়েলের পানি বরফের মত ঠাণ্ডা। ঠাণ্ডা পানিতে দীর্ঘ গোসলের পর শরীর ঝরঝরে হয়ে গেছে। ঘুম ঘুম ভাব একেবারেই নেই। ক্ষিধে মরে গিয়েছিল—সেই ক্ষিধে জাগিয়ে উঠেছে। তার কাছে মনে হচ্ছে সে এক গামলা ভাত খেয়ে ফেলতে পারবে।

 

রাহেলা বেগম বিরাট এক কাতল মাছের মাথা ছেলের পাতে তুলে দিয়ে মিচকি মিচকি হাসতে লাগলেন। ফরহাদ হতভম্ব গলায় বলল, এত বড় মাছ কোত্থেকে আসল।

জোবেদ আলি আনন্দিত গলায় বললেন, আজ দুপুরে কথা নেই বার্তা নেই মঞ্জু বিরাট এক কাতল মাছ নিয়ে উপস্থিত। কাতল মাছ, দুই কেজি খাসির গোশত। এক কেজি টমেটো। আর ভুটানের মরিচের আচার। কইগো আচারের বোতলটা আন।

ফরহাদ বলল, ব্যাপার কি?

জোবেদ আলি বললেন, ব্যাপার কি কিছুই জানি না। জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে বিরক্ত হয়ে বলল, সামান্য একটা মাছ আনতে ব্যাপার লাগবে না-কি। ওর যা স্বভাব অল্পতেই বিরক্ত। মহা বিরক্ত।

চাকরি পেয়েছেন না-কি?

পেতে পারে। যদি পায়ও আমরা আগে ভাগে কিছু জানব না। মাসের শেষে বেতন পেলে জানলেও জানতে পারি। আবার নাও জানতে পারি। মাঝে মধ্যে কাচা বাজার করে দিলেই বা ক্ষতি কি? অদ্ভুত এক ছেলে।

মঞ্জু ঘুমিয়ে পড়েছে?

ও ঘুমাবে না! কি বলিস তুই? দশটা না বাজতেই বাতি টাতি নিভিয়ে ঘুম।

ফরহাদ মার দিকে তাকিয়ে বলল, মাছের মাথা আমি খাব না মা।

রাহেলা বেগম বললেন, কথা না বাড়িয়ে খাতো। বড় মাছের মাথা সংসারের রোজগারী মানুষের খেতে হয়। অন্য কেউ খেলে সংসারের অকল্যাণ হয়। যতদিন তোর বাবার রোজগার ছিল মাছের মাথা তাকে দিয়েছি। তোদের দেই নি।

ফরহাদ বলল, আমি মাছের মাথা না খেলে সংসারের অকল্যাণ হবে এমন উদ্ভট কথা তোমরা বিশ্বাস কর?

জোবেদ আলি বললেন, দীর্ঘ দিন যে সব কথা চালু হয়ে আছে তার একটা মূল্য আছে। কোন কথাতো আর বিনা কারণে চালু হয় না। যেমন ধর মুরগির কলিজা পুরুষ মানুষের খাওয়া নিষেধ। এখন এর পেছনে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে।

কি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা?

মুরগির কলিজা হচ্ছে কোলেস্টরলের কারখানা। রোজ মুরগির কলিজা খেলে হার্টে ব্লকেজ হতে বাধ্য। একজন রোজগারী পুরুষের যদি হার্ট ব্লকেজ হয় তাহলে সংসারের অবস্থাটা কি হয় চিন্তা করে দেখ।

মেয়েদের হার্ট ব্লক হলে কোন সমস্যা নেই?

মেয়েদের হার্ট ব্লক হয় না?

ফরহাদ থালায় রাখা মাছের মাথার দিকে তাকাল। কয়েক মুহূর্তের জন্যে তার শরীর ঝিমঝিম করে উঠল। মনে হচ্ছে মাছটা জীবন্ত। অপলক চোখে তাকে দেখছে। সেই চোখ ভর্তি বেদনা ও বিস্ময়।

ফরহাদ বাবার পাতে মাথা তুলে দিতে দিতে বলল, সংসারের অমঙ্গল হলেও কিছু করার নেই বাবা। এই মাথা আমি মরে গেলেও খাব না। মাথাটা জীবন্ত।

জীবন্ত মানে?

জীবন্ত মানে জীবন্ত। চোখ পিট পিট করছে।

জোবেদ আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, মাছের চোখের পাতা আছে না-কি চোখ পিট পিট করবে? অতিরিক্ত পরিশ্রমে, টেনশানে তোরতো মনে হয় মাথা টাথা খাপ হয়ে যাচ্ছে। মাছের চোখ খেয়ে দেখ। খুবই মজা পাবি। চুষে চুষে লেবেনচুষের মত খা।

মাছের চোখ তুমি খাও বাবা। তবে আমি আগে খাওয়া শেষ করি তারপর পাও।

 

ফরহাদ ঘুমুতে এল রাত দুটার দিকে। বৃষ্টির কারণে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে। রাতে ভাল ঘুম হবার কথা। তবে যে সব রাতে তার মনে হয় খুব ভাল ঘুম হবে সে সব এতে এক ফোঁটাও ঘুম হয় না। আজও হয়ত হবে না। ফরহাদ ঘরে তার দাদাজান মেম্বর আলিও থাকেন। পাশাপাশি দুটা খাটের একটা মেম্বর আলির। তাঁর বয়স আশির কাছাকাছি। রাতে চোখে কিছুই দেখেন না। বেশীর ভাগ সময় না ঘুম, না জাগরণ অবস্থায় থাকেন। ফরিদ যতবার তার ঘরে ঢুকে ততবারই মনে হয় সে দেখবে দাদাজান বিছানায় মরে পরে আছেন। তার মুখের উপর ভনভন করে মাছি উড়ছে। মানুষটা কখন মারা গেছে কেউ জানেও না।

ফরহাদ দাদাজানের মশারি উঁচু করে নীচু গলায় ডাকল, দাদাজান। দাদাজান। মেম্বর আলি চোখ মেলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার চোখ বন্ধ করলেন। ফরহাদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক মানুষটা এখনো বেঁচে আছে।

রাহেলা বেগম দৈ-এর বাটি হাতে ছেলের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। এখন তার মেজাজ সামান্য খরাপ। তার মন বলছে—তাঁকে দেখেই ছেলে যে কথাটি বলবে তা তিনি জানেন। জানেন বলে এই মুহূর্তে তাঁর মন একটু খারাপ। ছেলের কথার জবাবে কঠিন কিছু কথা অনেকদিন থেকেই তিনি বলবেন বলবেন করছেন। বলা হয় নি। আজ হয়ত বলে ফেলবেন। রোজগারী ছেলেকে কঠিন কথা বলা যায় না। এতে সংসারের অকল্যাণ হয়। তবু বলবেন। সংসার ঠিক রাখার জন্যেও মাঝে মাঝে দুএকটা কঠিন কথা বলা দরকার। কঠিন কথা পেরেকের মত। সংসার নড়বড়ে হলে কঠিন কথার পেরেক লাগে।

রাহেলা জানেন তাকে দেখে ফরহাদ প্রথম যে কথাটা বলবে তা হচ্ছে—দাদাজানকে রাত্রে খেতে দিয়েছ? এটা কেমন কথা তিনি বুড়োকে খেতে দেবেন না কেন? দিনের পর দিন বৎসরের পর বৎসর যে সেবাটা করা হচ্ছে সেটা কেন তার ছেলের চোখে পড়ে না। বুড়ো আজকাল প্রায়ই বিছানা নষ্ট করে। কে সে সব পরিষ্কার করে? কাজের মেয়েরা এইসব কখনো করবে না। এইসব তাকেই করতে হয়। শ্বশুরের যত্ন এক কথা—তার নোংরা পরিষ্কার করা ভিন্ন কথা। বুড়োর নিজের ছেট মেয়ে এই শহরেই বাস করে। বুড়ো তার সঙ্গে গিয়ে থাকলেই পারে। শেষ বয়সে বুড়ো বাপের যত্ন মেয়েরা করবে এটাই স্বাভাবিক। ছেলে যদি মনে করে তার দাদাজানের যত্ন এই বড়িতে হচ্ছে না তাহলে সে বুড়োকে তার ফুপুর বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেই পারে। রাহেলা মনস্থির করলেন আজ যদি ফরহাদ তার দাদাজান বিষয়ে কিছু বলে তাহলে তিনি অবশ্যই বলবেন—ফরহাদ যেন তার দাদাজানকে তার ফুপুর বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।

ফরহাদ মাকে দেখেই বলল, রাতে দাদাজানকে খেতে দিয়েছ?

রাহেলা বললেন, না। উপাস রেখে দিয়েছি।

ফরহাদ চোখ ছোট ছোট করে মার দিকে তাকাল। রাহেলা বললো, উনার পেট খারাপ করেছে। পেটে কিছুই সহ্য হচ্ছে না। এই জন্যে চিড়ার পানি দিয়েছি।

শুধু চিড়া-পানি?

লেবু দিয়া চিড়া-পানি পেটের জন্যে ভাল।

রাহেলা ছেলের খাটের এক পাশে বসতে বসতে বললেন–তোর দাদার নোংরা বিছানা চাদর পরিষ্কার কর এক সমস্যা হয়েছে। কাজের মেয়ে করতে চায় না। এই বয়সে আমিও পারি না।

ফরহাদ বলল, আমাকে দিও। আমি ধুয়ে দেব।

পাগলের মত কথা বলিসনাতো। তুই ধুবি কি?

কোন সমস্যা নেই।

তুই উনাকে কিছুদিন যাত্রাবাড়িতে রেখে আয়। কিছুদিন মেয়ের সেবা নিক। বুড়ো বাবা মার সেবা করাওতো মেয়েদের ব্যাপার। তোর ফুপু কিছু সোয়াব পাক।

ফরহাদ কিছু বলল না। রাহেলা বললেন–জানুর ছোট মেয়েটার পরশু আকিকা। সবাইকে যেতে বলেছে। খালি হাতে তো যাওয়া যায় না। সোনার আংটি হলেও নেয়া দরকার। আমার অবশ্য একটা সোনার চেইন দেয়ার শখ। মেয়ের ঘরের নাতী। একটা চেইন কেনার টাকা দিতে পারবি?

ফরহাদ বলল, না।

রাহেলা ক্লান্ত গলায় বললেন, একটা সামাজিকতার ব্যাপার আছে। সবাই জানতে চাইবে মেয়ের নানী কি দিল?

ফরহাদ বলল, যে যার সামর্থ অনুসারে দিবে। পরে ফকিরতো আর কোহিনুর ইরা দিবে না।

রাহেলা বললেন, তুই পথের ফকির না। আর আমিও কোহিনুর হীরা দিতে »াই না। সামান্য একটা চেইন। হাজার পনেরোশ টাকা দাম।

ফরহাদ বলল, মা শুয়ে পড় আমার ঘুম পাচ্ছে। দৈ-এর বাটি নিয়ে যাও। দৈ খাব না।

তুইতো আজ কিছুই খাস নাই—শরীর খারাপ?

শরীর ঠিক আছে। মাছের মাথাটা চোখ বড় বড় করে আমাকে দেখছিল তাতেই ক্ষিধে মরে গেছে।

রাহেলা ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ফরহাদ হাই তুলতে তুলতে বলল, আমার কোন চিঠিপত্র এসেছে?

এসেছে। তোর ড্রয়ারে রেখেছি।

ড্রয়ারে কেন রাখবে। কতবার বলেছি চিঠি পত্র সব টেবিলের উপর পেপার ওয়েট দিয়ে ঢাকা দিয়ে রাখবে। ঢাকায় ফিরেই যেন চিঠিগুলি চোখে পড়ে।

পান খাবি? পান দেব?

না।

তুই হঠাৎ এমন মেজাজ খারাপ করছিস কেন?

মেজাজ খারাপ করছি না মা? যাও ঘুমুতে যাও।

মাথায় একটু নারিকেল তেল ডলে দেই। অনেক দিন মাথায় তেল না দিলে–অল্পতে মাথা গরম হয়। চুল পড়ে যায়। তোর মাথার চুল কমে যাচ্ছে।

কমুক।

চা খাবি?

আচ্ছা যাও মা। চা নিয়ে আস। চা পান সব আন।

রাহেলা চিন্তিত মুখে ঘর থেকে বের হলেন। ফরহাদ ড্রয়ার খুলে চিঠি বের। করল। সে যা ভেবেছিল তাই—আসমানীর চিঠি। যতবারই সে ঢাকার বাইরে এক সপ্তাহ কাটিয়েছে ফিরে এসে আসমানীর চিঠি পেয়েছে। এবার দিন মাত্র তিন দিন এর মধ্যেই চিঠি পাবার কথা না। কিন্তু ফরহাদের মন বলছিল চিঠি পাবে।

আসমানীর হাতের লেখা সুন্দর। সে চিঠিও খুব গুছিয়ে লেখে। একটা শুধু সমস্যা চিঠি হয় ছোট। হাতে নিতে না নিতেই শেষ। আসমানী লিখেছে—

এই যে

বাবু সাহেব,

আপনি তাহলে ঢাকায় ফিরেছেন? আপনার জন্যে খুবই দুঃসংবাদ। জাপান থেকে আমার মামা এক সপ্তাহ আগেই চলে এসেছেন। এবং আমার মাকে বলেছেন-পাত্র যদি ঠিক থাকে এই শুক্রবার আসমানীর বিয়ে দিয়ে দাও। হুলস্থুল করার কোন দরকার নেই। একজন কাজী ডেকে এনে বিয়ে। পরের দিন কোন ভাল রেস্টুরেন্টে একটা রিসিপশান। রিসিপশনের খরচ আমি দেব। মা মনে হয় রাজি। কাজেই এই শুক্রবারে তোমার বিয়ে। বাবু সাহেব এখন তোমাকে খুবই জরুরী কথা বলছি—তুমি যখনই চিঠিটা পাবে তখনি আমাদের বাসায় চলে আসবে। রাত তিনটার সময় হলে তিনটায় আসবে। কারণ তোমার মুখ দেখতে ইচ্ছা করছে।

আচ্ছা শুনতে আমার সোনার বাংলার পরের লাইনটা যেন কি?

তোমার

পুনশ্চঃ আমার সোনার বাংলার পরের লাইন হচ্ছে—

আমি তোমায় ভালবাসি

 

চিঠি এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা যায় তারপরেও মনে হয় চিঠি পড়া হয় নি। যে কথাগুলি লেখা হয়েছে তার বাইরেও অনেক কিছু লেখা। বাইরের লেখাগুলি পড়তে সময় লাগে। রাত তিনটার সময় চলে আসবে। এর মানে কি? এটা কি শুধু কথার কথা? না সে সত্যি চাচ্ছে গভীর রাতে সে গিয়ে উপস্থিত হবে?

বৃষ্টি পড়ছে। ঘর ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। জানালা খোলা, বৃষ্টির ছাঁট আসছে। দাদাজান ঘরে না থাকলে সে জানালা খোলা রাখত। ঘুমের মধ্যে হালকা গুড়িগুড়ি বৃষ্টির কণা চোখে মুখে পড়া আনন্দের ব্যাপার। ফরহাদ জানালা বন্ধ করে ঘুমুতে গেল। ঘুম এসে পড়ল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। শুধু ঘুম না, ঘুমের সঙ্গে স্বপ্ন। স্বপ্নেও বৃষ্টি হচ্ছে। সে বৃষ্টির মধ্যে দৈ-এর হাড়ি নিয়ে ভিজছে। সে দাঁড়িয়ে আছে পেট্রল পাম্পের ভেতর। মাথার উপরে ছাদ। তার গায়ে বৃষ্টি পড়ার কথা না। কিন্তু বৃষ্টি পড়ছে। এইসব অদ্ভুত ব্যাপারগুলি স্বপ্নেই সম্ভব। পেট্রল পাম্পে তার সঙ্গে আরেকটা মেয়ে ভিজছে। এই মেয়েটা দেখতে অবিকল আসমানীর মত, কিন্তু সে আসমানী না। এই মেয়েটা নিশিকন্যা। মেয়েটা ভিজে জবজবা হয়ে গেছে। ফরহাদ বলল, এই শোন এদিকে আস। মেয়েটা হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে।

ফরহাদ বলল, নাও এই দৈয়ের হাড়িটা নাও।

কেন?

বাসায় নিয়ে যাও। বাসায় নিয়ে খাবে।

উঁহু।

উঁহু কি নিয়ে যাও। নাম কি তোমার?

আমার নাম আসমানী।

আমার সঙ্গে ফাজলামী করবে না। তোমার নাম আসমানী না।

সত্যি আমার নাম আসমানী।

এই সময় খুব ভারী এবং গম্ভীর গলায় কেউ একজন বলল, ঐ মেয়ে সত্য কথা বলছে। তার নাম আসমানী।

ফরহাদ ঘুমের মধ্যেই প্রচন্ড চমকে উঠে বলল, কে কে কথা বলল।

মেয়েটা বলল, আপনার দাদাজান।

তাইতো। দাদাজানেরইতো গলা। তিনি এখানে এলেন কেন? এই বয়সে বৃষ্টিতে ভিজলে উপায় আছে। গোঁ গোঁ শব্দ হচ্ছে। দাদাজানেরই গলার আওয়াজ। মনে হচ্ছে কেউ তাকে গলা চেপে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে। ফরহাদ ব্যাকুল হয়ে চারদিকে তাকাচ্ছে। দাদাজানকে দেখা যাচ্ছে না। অথচ তার গোঁ গোঁ চিৎকার শোনা যাচ্ছে।

ফরহাদ জেগে উঠল। পাশের খাটে দাদাজান সত্যি সত্যি গোঁ গোঁ করছেন। তাকে বোবায় ধরেছে। ফরহাদ উঠে গিয়ে দাদাজানের কপালে হাত রাখতেই তিনি বললেন–পানি খাব। পানি।

দাদাজানের শরীর কাঁপছে। ঘামে তার মুখ ভিজে জবজব হয়ে গেছে। তিনি দুহাতে ফরহাদ শক্ত করে ধরে আছেন এবং বিড়বিড় করে বলছেন—পানি, পানি।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ