আসমানীদের ফ্ল্যাট বাড়িতে ফরহাদ এর আগেও এসেছে।

ফ্ল্যাট বাড়িগুলি এম্নিতেই ছিমছাম ধরনের থাকে—এইটা আরো বেশি ছিমছাম। নানান কায়দাকানুন। গেটে দারোয়ানের কাছে বইতে নাম লেখতে হয়। দারোয়ান তারপর ইন্টারকম করে। ইন্টারকমে যদি ক্লিয়ারেন্স পাওয়া যায় তবেই লিফটে ওঠা যায়। ক্লিয়ারেন্স পাবার পরও দারোয়ান এমনভাবে তাকিয়ে থাকে যেন একজন ভয়ংকর অপরাধী লিফট করে উঠে যাচ্ছে।

বাড়িতে ঢোকার পরেও সমস্যা। মনে হয় কোন হোটেলে ঢুকে পরা হয়েছে। বসার ঘর এমন করে সাজানো যে সহজ হয়ে বসা যায় না। ফরহাদের প্রধান সমস্যা হয়—জুতা পায়ে দিয়ে সে কার্পেটে উঠবে, না-কি জুতা খুলে উঠবে? জুতা যদি খুলে তাহলে জুতা রাখবে কোথায়? বসার ঘরে ঢোকার আগে দরজার পাশে, না-কি বসার ঘরের কার্পেটে। এখানে থাকা মানেই সারাক্ষণই এক ধরনের টেনশান। বসার ঘরটা কি স্মোক-ফ্রি জোন? না-কি সিগারেট খাওয়া যায়। সিগারেট খেলে ছাই কোথায় ফেলবে? একবার ছাইদানীতে ছাই ফেলার পর আসমানী ভুরু কুচকে বলল—কোথায় ছাই ফেললে? এটা এসট্রে না। মোমদানী। নিচে নোম লেগে আছে দেখেও বুঝতে পারলে না? আশ্চর্যতো। তারপর সে কাজের মেয়েটাকে ডাকল মোমদানীর ছাই ফেলে ধুয়ে আনার জন্যে। কাজের মেয়েটা এসে এমনভাবে তার দিকে তাকাল যেন সে বাংলাদেশের মহা বেকুবদের একজন প্রতিনিধি। মোমদানী এবং এসট্রের সামান্য প্রভেদটাও জানে না।

ফরহাদের ধারণা আসমানী ছাড়া এ বাড়ির একটা মানুষও তাকে দেখতে পারে। যেমন আসমানীর বাবা নেজাম উদ্দিন। ভদ্রলোক ব্যাংকার ছিলেন—এখন অবসর জীবন যাপন করছেন। রিটায়ার্ড লোকজন নিজের সংসারে তেমন পাত্তা পায় না বলে—বাইরের লোকজনের সঙ্গে তাদের ব্যবহার খুব আন্তরিক হয়ে থাকে। ব্যতিক্রম সম্ভবত নেজামত সাহেব। ফরহাদকে দেখলেই তিনি চোখ মুখ কঠিন করে ফেলেন। প্রফেশনাল উকিলদের মত জেরা করতে থাকেন। জেরার ফাঁকে ফাঁকে এমন দুএকটা কথা বলেন যে রাগে রক্ত গরম হয়ে যায়। যেমন একবার নেজামত সাহেবের দেখা হল। ফরহাদ এসে ঢুকেছে তিনি বেরুচ্ছেন এমন অবস্থায় দেখা। ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে চোখ মুখ কঠিন করে ফেললেন। ভুরু কুচকে গেল। চোখ সরু হয়ে গেল। তিনি শীতল গলায় বললেন, তুমি কে? কাকে চাও?

ভদ্রলোক ভাল করেই জানেন ফরহাদ কে? এবং সে কার কাছে এসেছে। তারপরেও জিজ্ঞেস করা। ফরহাদ কাচু মাচু ভঙ্গিতে বলল, জি আমার নাম ফরহাদ। আমি আসমানীর কাছে এসেছি। ওকি বাসায় আছে?

ও আচ্ছা আচ্ছা। তোমাকেতো আরো কয়েকবার দেখেছি। তোমার দেশ যেন কোথায়?

জ্বি নেত্রকোনা।

নেত্রকোনার লোকদের বিশেষত্ব কি বল দেখি।

ফরহাদ চুপ করে রইল। ভদ্রলোক বললেন—নেত্রকোনার বিশেষত্ব হচ্ছে এই অঞ্চলের লোকজন সব সময় উল্টা ভাব ধরে থাকে। বুঝতে পেরেছ কি বললাম?

জ্বি না।

যে বেকুব সে বুদ্ধিমান ভাব ধরে। যে মূর্খ সে জ্ঞানীর ভাব ধরে। যে বেকার সে এমন ভাব ধরে থাকে যেন কোন কোম্পানীর জি এম।

ফরহাদ চুপ করে রইল। তার মেজাজ খুবই খারাপ হচ্ছিল কিন্তু আসমানীর বাবার সঙ্গে মেজাজ খারাপ করার প্রশ্নই উঠে না।

নেত্রকোনার মেয়েদের বিশেষগুণ কি বল দেখি।

বলতে পারছি না।

সেকি—তুমি নেত্রকোনার ছেলে হয়ে নেত্রকোনার মেয়েদের বিশেষ গুণ কি বলতে পারছ না? তাদের বড়গুণ হচ্ছে ঘরের কাজকর্ম তারা খুব ভাল পারে। বাংলাদেশে যত বুয়া আছে তার শতকরা ৬০ ভাগ আসে নেত্রকোনা থেকে। নেত্রকোনা হচ্ছে বাংলাদেশের বুয়া ভান্ডার। ভালমত খোঁজ নিলে দেখবে তোমার আত্মীয় স্বজনদের মধ্যেও দুএকজন এক্সপার্ট বুয়া বের হয়ে যাবে।

কথাগুলি অপমান করার জন্যে বলা। অপমান ফরহাদ গায়ে মাখে না তবু মনটা খারাপ হয়। সে কিছুতেই ভেবে বের করতে পারে নি নেজামত সাহেব তাকে এতটা অপছন্দ কেন করেন। তার পছন্দের মাপকাঠিটা কি?

মেয়ের প্রেমিককে অপছন্দ করা সাধারণ নিয়মের মধ্যে পড়ে। তাই বলে এত অপছন্দ? সে রাজপুত্র না, তার চেহারা পিটার ও টুলের মত না, বিদেশী কোম্পানীর ভাইস প্রেসিডেন্টও সে না। তারপরেও একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজন মানুষ সামাজিক সৌজন্য বজায় রাখবে না? তার মেয়ে আজেবাজে টাইপের একটা ছেলেকে পছন্দ করেছে এই কারণে তিনি যদি রাগ করে থাকেন, সেই রাগটা তিনি করবেন মেয়ের উপর। ফরহাদের উপর না।

কলিংবেলে চাপ দিয়ে ফরহাদ খুবই অস্বস্তি নিয়ে অপেক্ষা করছে। সম্ভাবনা শতকরা ৯০ ভাগ যে দরজা খুলবেন নেজামত সাহেব। রিটায়ার্ড করা লোকজনের উপর সংসারের আজেবাজে কাজগুলি করার দায়িত্ব এসে পরে। ছোট ছেলে হয়ত কলেজের পড়া তৈরি করছে। কলিংবেল শুনে সে যাবে না। কাজের বুয়াও যাবে না। সেও জরুরী কিছু কাজ করছে। পারাটা ভাজছে। একমাত্র কর্মহীন মানুষ হিসেবে বাড়ির কর্তাকেই যেতে হবে। বলাই বাহুল্য দরজা খুলবেন নেজামত সাহেব এবং চোখ মুখ কুঁচকে বলবেন—তুমি কে? কাকে চাও?

ফরহাদকে অবাক করে দিয়ে দরজা খুলল আসমানী। নামকরণের সার্থকতা প্রমাণ করার জন্যেই সে মনে হয় এই ভোরবেলাতেই আসমানী রঙের একটা শাড়ি পরেছে। চুল টান টান করে মাথায় যে টাওয়েলটা পেঁচানো তার রঙও হালকা নীল। ফরহাদ মনে মনে ভাবল-মেয়েরা যদি জানতে গোসলের পর মাথায় টাওয়েল জড়ানো অবস্থাতেই তাদের সবচে সুন্দর লাগে—তাহলে সব মেয়ে বিয়ে বাড়িতে কিংবা জন্মদিনের উৎসবে মাথায় টাওয়েল জড়িয়ে যেত। বিউটি পার্লারে মাথায় টাওয়েল জড়িয়ে সাজিয়ে দেবার ব্যবস্থা থাকত।

আসমানী বলল, এই আমার চিঠি কখন পড়েছ?

রাত দুটায়।

চিঠিতে কি লেখা ছিল যখন এই চিঠি তোমার হাতে পড়বে তখনি তুমি এ বাড়িতে আসবে। লেখা ছিল না?

হুঁ।

আসনি কেন?

রাত দুটার সময় চলে আসব?

অবশ্যই।

তোমাদের ফ্ল্যাটবাড়ির দারোয়ান এত রাতে আমাকে কম্পাউণ্ডের ভেতরই আসতে দিত না। সে গেট খুলত না।

গেট না খুললেও ইন্টারকমে খবর পাঠাতে। আমি নিজে এসে তোমাকে নিয়ে যেতাম। তুমি মস্ত একটা সুযোগ নষ্ট করেছ।

কি সুযোগ?

আমার প্রতি তোমার ভালবাসা যে কত তীব্র তা প্রমাণ করার সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারালে। এ রকম সুযোগ আর পাবে না।

পাব।

উঁহু পাবে না। দুদিন পর আমাদের বিয়ে হয়ে যাবে। বিয়ের পর তুমি আমার জন্যে যত পাগলামীই কর কোন পাগলামী এখনকার মত ভাল লাগবে না। নাশতা খেয়ে এসেছ?

না।

ভাল করেছ। মামার সঙ্গে নাশতা খাও। খেতে খেতে গল্প কর। তারপর তোমাকে নিয়ে আমি বের হব।

কোথায়?

বিয়ের শপিং করব। আমি আজ দশটা শাড়ি কিনব শাড়িগুলি তুমি পছন্দ করে দেবে। আর তোমার জন্য সার্ট পেন্ট এই সব আমি পছন্দ করে কিনব। মামা আমাকে এক হাজার ডলার দিয়েছেন। আচ্ছা শোন–ডলার কোথায় ভাঙ্গাতে হয় তুমি জান?

জানি।

আজ সারাদিনের জন্যে মামা আমাকে একটা গাড়ি ভাড়া করে দিয়েছেন। মাইক্রোবাস। দুজন মাইক্রোবাসে সারাদিন ঘুরব। তোমার অফিস নেইতো?

অফিস আছে।

একদিন অফিসে না যাবার জন্যে নিশ্চয়ই তোমার চাকরি চলে যাবে না?

তা যাবে না। শুধু পাঁচ মিনিটের জন্যে একবার দেখা দিয়ে আসতে হবে।

পাঁচ মিনিট কেন তুমি আধঘন্টার জন্যে দেখা দিয়ে এসো। আমি গাড়িতে বসে কোক খাব আর তুমি আধঘন্টার জন্যে যাবে। হবে না?

হবে।

তোমাকে এমন চিন্তিত লাগছে কেন?

চিন্তিত না। রাতে ভাল ঘুম হয় নি।

আসমানী হাসতে হাসতে বলল—বিয়ের ডেট ফাইন্যাল হবার পর মেয়েরা রাতে এক ফোটা ঘুমুতে পারে না। ছেলেরা নাক ডাকিয়ে ভোস ভোস করে ঘুমায়। তোমার ব্যাপারে দেখি উল্টোটা হচ্ছে।

বিয়ের ডেট ঠিক হয়ে গেছে নাকি?

ইয়েস স্যার। আগামী শুক্রবার।

আসমানী হাসছে। ফরহাদ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। এত সুন্দর করে কোন মেয়ে হাসতে পারে তাই তার কল্পনায় ছিল না। বিয়ের পর আসমানীকে যে কাজটা করতে হবে তা হচ্ছে প্রতিদিন ভোরে নাশতা খাবার আগে তোয়ালে দিয়ে মাথা পেঁচিয়ে তার সামনে বসে (উঁহু দাঁড়িয়ে) হাসতে হবে। হাসি থামতে না বলা পর্যন্ত হাসি থামানো যাবে না।

ফরহাদ বলল, তোমার মামা লোক কেমন?

ভয়ংকর টাইপ। একটু উনিশ বিশ করেছ কি তোমাকে কপ করে গিলে ফেলবে।

তোমার বাবার চেয়েও ভয়ংকর?

বাবা ভয়ংকর কোথায়? বাবা খুবই অর্ডিনারী টাইপ মানুষ। সামান্য বোকা। শিক্ষিত বোকা। শিক্ষিত বোকারা যেমন জ্ঞানী জ্ঞানী কথা বলেন। বাবাও তাই করেন। এটাই তার একমাত্র দোষ। রিটায়ার্ড করার পর অফিসে বোকামী করার সুযোগ পাচ্ছে না। যা করার বাসায় করছে।

তোমার মামা জ্ঞানী কথা বলেন না?

না। জ্ঞানী কথা শুনলে তিনি আছাড় দেন। খবর্দার তুমি কোন জ্ঞানী কথা বলতে যাবে না।

উনার নাম কি?

কামরুল ইসলাম। আশ্চর্য তুমি সত্যি সত্যি ভয় পাচ্ছ না-কি? মামা অতি অতি অতি ভালমানুষ। তার সঙ্গে পাঁচ মিনিট কথা বললেই তোমার মন ভাল হয়ে যাবে।

আসমানীর মামা কামরুল ইসলাম উদোম গায়ে চক্রাবক্রা রঙের বার্মিজ লুঙ্গি পরে চায়ের কাপ হাতে বসার ঘরে উপস্থিত হলেন। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। শরীর ভারী। মুখের ভাব গম্ভীর হলেও মানুষটা হাসিখুশি। তিনি এক হাতে নিজের ভুড়িতে থাবা দিতে দিতে অতি পরিচিত ভঙ্গিতে বললেন—তুমি হচ্ছ ফরহাদ?

ফরহাদ উঠে দাঁড়াল।

তিনি বললেন, আসমানী বলছিল তুমি বেঁটে। বেঁটে কোথায়? আমার কাছেতো লম্বাই মনে হচ্ছে। হাইট কত?

পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি।

দাঁড়িয়ে আছ কেন বোস। পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি মানে কত সেন্টিমিটার? এক ইঞ্চি সমান কত? ওয়ান পয়েন্ট ফাইভ ফোর সেন্টিমিটার না?

আমি বলতে পারছি না।

কাগজ কলম নিয়ে বের করে ফেলতো? কলম আছে?

জ্বি না।

আচ্ছা দাঁড়াও কাগজ কলম কিছুই লাগবে না। ক্যালকুলেটর এনে দিচ্ছি। জাপান থেকে গোটা ছএক ক্যালকুলেটর এনেছি। যাকে যাকে উপহার দিতে ইচ্ছা করছে তাদেরকে শুরুতে একটা অংক করতে দিচ্ছি। তারা যখন অংক নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে তখন গিফট হিসেবে ক্যালকুলেটর। ভাল বুদ্ধি না?

জ্বি।

এইবার তোমার ভাইবা শুরু হচ্ছে। নানান ধরনের প্রশ্ন টশ্ন করব। ঠিক ঠিক উত্তর দেবে। প্রথম প্রশ্ন–তোমার সেন্স অব হিউমার কেমন?

ভাল।

তুমি কি মজার মজার কথা বলে লোকজন হাসাতে পার?

জ্বি না।

তাহলে তুমি কি করে বললে তোমার সেন্স অব হিউমার ভাল?

অন্যের কথায় হাসতে পারি।

অর্থাৎ জোকস ধরতে পার?

জ্বি পারি।

আমি আসমানীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম—তুই যে ছেলেটাকে পছন্দ করেছিস, কি জন্যে করেছিস? সে বলেছে, তার সেন্স অব হিউমার দেখে। সেন্স অব হিউমার প্রসঙ্গে এই কারণেই প্রশ্ন করলাম।

ফরহাদ চুপ করে আছে। মানুষটাকে তার পছন্দ হয়েছে। বিদেশে যারা দীর্ঘদিন থাকেন তাদের মানসিকতায় সাধারণত দুধরনের পরিবর্তন হয়। একদল হয়ে পড়েন শুকনা কাঠখোট্টা রোবট। আরেক দল হন অতিরিক্ত রকমের সাধারণ মানুষ। ভদ্রলোক মনে হচ্ছে দ্বিতীয় দলের।

ফরহাদ।

জ্বি।

মেয়েদের কিছু পিকিউলিয়ার ব্যাপার আছে। তারা প্রেমিকের সেন্স অব হিউমার খুব পছন্দ করে কিন্তু স্বামীর সেন্স হিউমার পছন্দ করে না। এটা কি জান?

জি-না।

বিয়ের পর আসমানীর সঙ্গে রসিকতা করলে দেখবে সে বিরক্ত হচ্ছে বা রেগে যাচ্ছে। কিন্তু এখন তোমার সামান্য রসিকতাতেই হাসবে। ব্যাপারটা আমার কাছে সব সময়ই স্ট্রেঞ্জ মনে হয়। যাই হোক এখন তোমার সম্পর্কে বল—

কি বলব?

তুমি অষুধ কোম্পানীতে আছ?

জ্বি।

কোম্পানীর নাম কি?

ওরিয়ন ইন্টারন্যাশনাল।

বিদেশী কোম্পানী?

জ্বি-না। দেশী কোম্পানী।

কাজটা কি?

ছোট কাজ। অষুধের বাক্স নিয়ে জেলায় জেলায় ঘুরা।

কাজটা করতে ভাল লাগে?

জ্বি-না।

অন্য কোন কাজের চেষ্টা করছ?

তেমন কিছু পাচ্ছি না।

বেতন যা পাও—তাতে কি তোমাদের চলে?

জ্বি।

বাড়ি ভাড়া দিতে হয় না?

না।

নিজের বাড়ি?

জ্বি-না নিজের বাড়ি না।

নিজের বাড়ি না, কিন্তু ভাড়া দিতে হয় না। এই ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না।

আমাদের এক আত্মীয়ের বাড়ি। তিনি দেশের বাইরে থাকেন।

তোমরা সেই বাড়ির কেয়ার টেকার?

জ্বি।

তোমার আত্মীয় যদি দেশে চলে আসেন তখন কি হবে? কিংবা ধর বিদেশে থেকেই বাড়িটা বিক্রি করে দেন তখন?

ফরহাদ কিছু বলল না। আসমানীর মামা কিছুক্ষণ উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলেন। তার পর অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন।

বোনদের বিয়ে হয়েছে?

আমার একটিই বোন। তার বিয়ে হয়েছে।

বোনের স্বামী কি করেন?

ব্যবসা করেন।

বড় ব্যবসা না-কি ছোট ব্যবসা?

ছোট।

নাশতা চলে এসেছে। পরোটা-ভাজি, মুরগির ঝোল, পায়েস। একটা বাটিতে কলা। বিরাট আয়োজন। নাশতা নিয়ে এসেছে আসমানীর ছোটবোন নিশা। মেয়েটা এম্নিতেই গম্ভীর—আজ তাকে আরো গম্ভীর লাগছে।

সে ফরহাদের দিকে স্পষ্ট বিরক্তি নিয়ে তাকাল। ফরহাদ বলল কেমন আছ নিশা?

নিশা জবাব দিল না। সে ট্রে থেকে টেবিলে নাশতার থালা-বাটি নামাতে ব্যস্ত। এমন ভাব করছে যেন প্রশ্নটা শুনতে পায় নি।

আসমানীর মামা বললেন, ফরহাদ নিশার সঙ্গে তোমার বোধহয় তেমন আলাপ পরিচয় নেই। ও দারুণ রসিক মেয়ে এটা কি তুমি জান?

ফরহাদ বলল, জ্বি-না। জানি না।

ওর গল্পগুজব শুনলে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যায়। তাকে দেখে অবশ্যি এটা বোঝার কোন উপায়ই নেই। এই নিশা তোর দরজির গল্পটা বলতো।

নিশা গম্ভীর গলায় বলল, গল্পটা মনে নেই মামা।

অবশ্যই মনে আছে বলতো।

নাশতা খাও তারপর বলছি।

আসমানীর মামা বললেন, ও গল্প বলবে না। দাঁড়াও আমিই বলি—এক দরজি তার ছোট ছেলেকে নিয়ে বাজারে গেছে। সেখানে অন্য এক লোকের সঙ্গে দেখা। লোকটা বলল, এ আপনার ছোট ছেলে না? দরজি বলল, হ্যাঁ। লোকটা বলল, আপনার বড় ছেলেটা কত বড়? দরজি বলল, ছোটটার চেয়ে চাইর গিরা বড়।

ফরহাদ তাকিয়ে আছে। কামরুল ইসলাম সাহেব হেসেই যাচ্ছেন। তার হাসির কারণে যে সোফায় বসেছিলেন সেই সোফা কাঁপছে। ফরহাদের কাছে মনে হচ্ছে—শুধু সোফা না, পুরো বাড়িই কাপছে। ফরহাদের হাসি আসছে না। বাড়িঘর কাঁপিয়ে হাবার মত কোন গল্পও এটা না। কিন্তু ভদ্রলোক এমন হাসছেন কেন?

অস্বস্তি দূর করাবার জন্যে হাসছেন? ফরহাদের নিজেকে খুব বোকা বোকা লাগছে।

আরেকটা গল্প বলি শোন। এটা অবশ্যি নিশা বলে নি। কোন এক পত্রিকায় পড়েছিলাম। এক ছেলে তার বন্ধুকে বলেছে—শেষ পর্যন্ত আমার চাচা শান্তি পেয়েছেন। চিরশান্তি। বন্ধু বলল, তোর চাচা কি মারা গেছেন? সে বলল, না চাচা মারা যান নি চাচী মারা গেছেন।

গল্প শেষ করে ভদ্রলোক আগের চেয়েও অনেক বেশী উচ্ছাস নিয়ে হাসছেন। ফরহাদ তাকিয়ে আছে। এক সময় তিনি হাসি থামিয়ে বললেন, তোমাকে পর পর দুটা মজার মজার গল্প বললাম। তুমি একটুও হাস নি। তুমি যে বললে তোমার সেন্স অব হিউমার ভাল—এটাতো তুমি ঠিক বলনি।

 

মাইক্রোবাসে উঠতে উঠতে আসমানী বলল, মামাকে কেমন লাগল।

ফরহাদ বলল, ভাল।

মামা হলেন সেলফ মেড ম্যান। মেট্রিক পাশ করে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। তিন বছর তাঁর কোন খোঁজই ছিল না। কেউ জানত না তিনি কোথায়। তিন বছর পর দেশে ফিরলেন। কলেজে ভর্তি হলেন। পাশ করলেন। ইউনির্ভাসিটিতে গেলেন। এম.এসসি শেষ করে আবারো দেশের বাইরে।

বিয়ে করেছেন?

না বিয়ে করেন নি। আমরা বিয়ে করতে বলছি! মামা বলছেন—এখন আমার বয়স চুয়ান্ন চলছে এখন বিয়ে করব কি?

আমি বললাম, মামা পিকাসোসতুর বছর বয়সে বিয়ে করেছিলেন। মামা বললেন, আমি কি পিকাসো নাকি? আমি অতি নগন্য কামরুল ইসলাম।

আসমানী হাসতে হাসতে বলল, মামা যতই না না করুক আমরা উঠে পরে লেগেছি মামাকে বিয়ে দিয়ে দেব।

ভাল। মামা ভাগ্নির এক সঙ্গে বিয়ে।

আসমানী হাসছে। মেয়েরা তাদের হাসি যে কোন সময় চট করে থামিয়ে দিতে পারে। আসমানী পারে না। একবার হাসতে শুরু করলে সে অনেকক্ষণ হাসে। ফরহাদ বলল—আমরা কোনদিকে যাব? প্রথমে তুমি কি ডলার ভাঙ্গাবে?

ডলারতো ভাঙ্গাবই তবে প্রথমে ভাঙ্গাব না। দ্বিতীয়তে ভাঙ্গাবো। প্রথমে গাড়ি করে আমরা এক ঘন্টা ঘুরব। তোমাকে অফিসে কখন যেতে হবে?

বারোটার দিকে গেলেই হবে।

মনে থাকে যেন। জাস্ট পাঁচ মিনিটের জন্যে যাবেও না, সরি তোমাকে আধঘন্টা টাইম দিয়েছিলাম।

পাঁচ মিনিটের বেশী লাগবে না।

আমি তোমাকে লম্বা একটা চিঠি লিখে রেখেছিলাম। তুমি যদি আজ না আসতে এই চিঠি তোমাদের বাসায় দিয়ে আসতাম।

চিঠি কি সঙ্গে আছে?

চিঠি সঙ্গে থাকবে কেন? আমি পোস্টম্যান নাকি?

ফরহাদ সিগারেট বের করল। আসমানী বলল—তুমি দয়া করে জানালার ধার ঘেসে বস। সিগারেটের ধোয়া জানালা দিয়ে বাইরে ফেলবে।

আচ্ছা।

যেদিন বিয়ে হবে সেদিন থেকে কিন্তু তোমার সিগারেট বন্ধ। শুধু ভোরবেলা নাশতার সময় একটা, দুপুরে ভাত খাবার পর একটা এবং রাতে ঘুমুবার আগে একটা।

আচ্ছা।

তবে বিশেষ বিশেষ উৎসবে কয়েকটা সিগারেট এড করা যেতে পারে যেমন তোমার জন্মদিন, তোমার বিবাহ বার্ষিকী…

থ্যাংক য়্যু।

সিগারেটের ধোয়া তোমারতো বাইরে ফেলার কথা ছিল। তুমি ভেতরে ফেলছ কেন?

সরি।

তোমাকে যে চিঠি লিখেছিলাম সেটা কি সত্যি সত্যি পড়তে চাও।

সঙ্গে আছে।

পড়তে চাও কি-না সেটা বল।

অবশ্যই চাই।

পড়লে কিন্তু রাগ করবে। কারণ চিঠিতে মিষ্টি মিষ্টি কোন ব্যাপারই নেই।

না থাকুক।

আসমানী তার কোলে রাখা ব্যাগ থেকে চিঠি বের করল। চিঠির সঙ্গে ছোট্ট একটা আয়না। কিশোরীদের মত আনন্দময় গলায় বলল—চিঠি পড়ার আগে আয়নাটা দেখ। আয়নাটা সুন্দর না?

হুঁ।

না দেখেই বলে ফেললে। এটা হল বিশেষ ধরনের নাইট মেকাপ আয়না। এই আয়নায় পাওয়ারফুল সোলার ব্যাটারী আছে। দিনেরবেলায় সূর্যের আলো থেকে এই ব্যাটারী চার্জ হয়ে থাকে। রাতে বোতাম টিপলেই আয়নার বাল্ক এমনভাবে জ্বলে যে আলোটা ঠিক মুখে এসে পরে। সেই আলোতে আয়নায় মুখ দেখে মেকাপ নেয়া। সুন্দর না?

খুব সুন্দর।

হাতে নিয়ে দেখ। একটা সুন্দর জিনিস তোমার হাতে নিতে ইচ্ছা করে না?

ফরহাদ আয়না হাতে নিল। বোতাম টিপে আলো জ্বালালো। আসমানী বলল, মামা প্রতিবারই যখন বিদেশ থেকে আসে সবার জন্যে মজার মজার জিনিস নিয়ে আসে। নিশার জন্যে কি এনেছে জান? মাকড়সা!

মাকড়সা?

হুঁ। প্লাস্টিকের মাকড়সা। দূর থেকে দেয়ালে ছুঁড়ে মারলে দেয়ালে লেগে যায়। তারপর এক্কেবারে আসল মাকড়সার মত দেয়াল বেয়ে নামতে থাকে।

বল কি?

খুবই ঘিন্নাকর। দেখবে?

তুমি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছ নাকি?

তোমাকে দেখাবার জন্যে এনেছি।

এখন আমি মাকড়সা দেখব না। চিঠিটা আগে পড়ি।

তুমি চিঠি পড়বে আমি কি করব?

তুমি জাপানী আয়নায় মেকাপ ঠিক কর। কিংবা মাকড়সা নিয়ে খেলা কর। ফরহাদ চিঠি পড়তে শুরু করল—

এই যে বাবু সাহেব,

আসসালামু আলায়কুম। এবার আপনি এত দেরী করে ঢাকায় ফিরলেন কেন? আমার খুবই মেজাজ খারাপ হচ্ছে। আপনি কি জানেন যখন আমার আপনাকে দরকার হয় তখনি আপনি ঢাকায় থাকেন না। এবং আপনার মধ্যে আছে রাক্ষস স্বভাব। যখন আপনি বলেন দুদিনের জন্যে ঢাকার বাইরে যাচ্ছি তখন আপনি এক সপ্তাহ পার করে আসেন।

বাবু সাহেব আপনি কি জানেন আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে মোটামুটি ঠিক। পুরো ব্যবস্থাটা যিনি করেছেন তিনি আমার মামা। মামা এমন মানুষ যার মুখের উপর কারোরই কিছু বলার ক্ষমতা নেই। যাই হোক পুরো ঘটনাটা—অর্থাৎ মামা কিভাবে আমার পক্ষে চলে এল সেটা বলি। আমার পুরো ঘটনাটা বলতে ইচ্ছে করছে। মন দিয়ে শোনও সরি মন দিয়ে পড়।

মামা বাসায় এসে পৌঁছলেন সন্ধ্যাবেলা। তাঁর যেদিন আসার কথা ছিল তার একদিন আগে চলে এলেন কাজেই আমরা যে তাকে হৈ চৈ করে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে আসব তা আর করা গেল না। তিনি বাসায় পা দিতেই চারদিকে আনন্দের বন্যা শুরু হয়ে গেল। মা ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করলেন সে কান্নাও আনন্দের কান্না। এই কাঁদছেন এই হাসছেন—মোটামুটি হিস্টিরিয়ার মত অবস্থা। আমরা উপহার নিয়ে টানাটানি করছি। মামা স্যুটকেস খুলে বলেছেন—যার যেটা পছন্দ বেছে নে। এতেই সমস্যা হয়েছে। কাড়াকাড়ি পরে গেছে। সারারাত আমরা কাটালাম গল্প করে। ঘুমে যখন মামার চোখ জড়িয়ে আসে তখন কফি বানিয়ে আমরা মামার ঘুম ভাঙ্গাই। এমন অবস্থা।

সকালবেলা মামার সঙ্গে দেখা করার জন্যে এক ভদ্রলোক এসে উপস্থিত। ভদ্রলোকের নাম আনিস। চব্বিশ পঁচিশ বছর বয়স। লাজুক ধরনের মানুষ। গায়ের রঙ ময়লা হলেও অতি সুদর্শন। মেয়েদের মত টানা টানা চোখ। ভদ্রলোককে বসার ঘরে বসিয়ে মামাকে খবর দিতে গেলাম। মামা বললেন, ও আচ্ছা আনিস। ওকে বসতে বল। চা-টা খাওয়া। তোরা দুই বোন গল্প কর। আমি ঘন্টা দুএক না ঘুমিয়ে উঠতে পারব না। তোরা কোম্পানী দে। নিশা বলল, ভদ্রলোক কি করেন মামা?

মামা হাই তুলতে তুলতে বললেন, জাহাজে কাজ করে। খালাসি ফালাসি হবে।

খালাসি বলেতো মনে হচ্ছে না।

মামা বিরক্ত গলায় বললেন, মানুষের কাপড় চোপড় দেখে কখনোই বিভ্রান্ত হবি না। চেহারা দেখেও হবি না। শেখ সাদীর বিখ্যাত গল্প মনে রাখবি।

মামা ঘুমুতে গেলেন। আমি খালাসি ভদ্রলোককে চা দিতে গিয়ে জানলাম ভদ্রলোক মোটেই খালাসি না। জাহাজের সেকেণ্ড ক্যাপটেন। মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। আমি যখন ভদ্রলোককে বললাম—মামা বলেছেন আপনি জাহাজের খালাসি। উনি মজা পেয়ে খুব হাসলেন। আমি বললাম, জাহাজের গল্প বলুন। তিনি বললেন, জাহাজের কোন গল্প নেই। পৃথিবীর সবচে বিরক্তিকর এবং ক্লান্তিকর জিনিস হচ্ছে জাহাজের চারপাশের সমুদ্রের পানি। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এই জিনিস দেখলে যে কোন সুস্থ মানুষই অসুস্থ হয়ে পরে।

আমি বললাম, হ্যাঁ। এখন আমার চিকিৎসা চলছে।

কী চিকিৎসা?

তিনি হাসতে হাসতে বললেন, স্থল চিকিৎসা। স্থলে সময় কাটাচ্ছি এতেই কাজ হচ্ছে।

মামা দুপুর পর্যন্ত ঘুমুলেন। আনিস সাহেব চলে যেতে চাচ্ছিলেন। নিশা তাকে ধরে রেখে দিল। দুপুরের মধ্যে এই ভদ্রলোক ঘরের মানুষ হয়ে গেলেন। মার সঙ্গে গল্প করলেন, বাবার সঙ্গে গল্প করলেন। এবং দুপুরের খাবারের আগে বাবার একটা লুঙ্গি পরে বাথরুমে গোসল করতে গেলেন। তিনি আবার গোসল না করে খেতে পারেন না।

রাতে মামা চা খেতে খেতে আমার আর নিশার সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ করে বললেন—এই আসমানী আনিস ছেলেটা কেমন?

আমি বললাম, খুব ভাল। ছেলেরা যতটা ভাল হয় তারচে একটু বেশি ভাল। আরেকটু কম ভাল হলেও ক্ষতি ছিল না।

সে যে অহংকারী কিন্তু এটা বুঝতে পেরেছিস?

না।

বেশ অহংকারী ছেলে। তবে দোষের অহংকার না। ওর দোষের মধ্যে একটাই মদ্যপান করে। জাহাজে চাকরি করলে যা হয়। কিছু করার নাই—তাই মদ খাওয়া। তুই অভ্যাসটা ছাড়িয়ে দিবি।

আমি অবাক হয়ে বললাম, আমি অভ্যাস ছাড়াব কেন?

মামা বললেন, তুই না ছাড়ালে কে ছাড়াবে? স্বামীর ভালমন্দ দেখার দায়িত্ব স্ত্রীর না?

তুমি কি বলছ মামা?

আনিসের সঙ্গে তোর বিয়ে দেব। এই জন্যেই ছেলেকে আসতে বলেছি। আনিস যাবার সময় বলে গেছে তোকে তার খুবই পছন্দ হয়েছে। আর আমার ধারণা তোরও ছেলে পছন্দ হয়েছে। ব্যাস আমার দায়িত্ব শেষ। এখন যা করার করবেন কাজি সাহেব।

মামার কথা শেষ হওয়া মাত্র আমি শুরু করলাম কান্না। আমি যেমন হাসতে পারি, তেমন কাঁদতেও পারি। তুমিতো আমাকে কাঁদতে দেখনি। কাঁদতে দেখলে তোমার খবর হয়ে যেত।

কান্নার চোটে আমার হেঁচকি উঠে গেল। নিঃশ্বাস বন্ধ হবার জোগার হল। মামা নিশাকে জিজ্ঞেস করলেন—নিশা! ও এরকম করছে কেন? নিশা বলল, আপার একজন পছন্দের মানুষ আছে বলে এ রকম করছে।

মামা বিরক্ত হয়ে বললেন, পছন্দের মানুষ থাকলে সে পছন্দের মানুষকে বিয়ে করবে। আমি কি তাকে জোড় করে বিয়ে দিচ্ছি না-কি? হাত পা ছড়িয়ে কাঁদার কি হল। এমন বিশ্রী কান্না সে কোথায় শিখল?

তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন কান্না বন্ধ করে বল কাকে বিয়ে করতে চাস। যা তাকে ধরে নিয়ে আয়। যা আজ রাতেই বিয়ে দেব।

এই হচ্ছে ঘটনা।

বুঝলেন বাবু সাহেব? চিঠি পড়তে পড়তে আপনার কি আনিস নামের ছেলেটার প্রতি হিংসা হচ্ছিল? হিংসা যাতে হয় এই জন্যেই তার সম্পর্কে বাড়িয়ে বাড়িয়ে অনেক কিছু লিখেছি। ভদ্রলোকের চেহারা আসলেই খালাসির মত।

একটা সত্যি কথা বলি? তোমাকে ছাড়া পৃথিবীর সব ছেলেকেই আমার কাছে খালাসির মত মনে হয়। কি এখন খুশীতো?

ইতি–

তোমার আ

 

দুপুর বারটায় মেইন রোডে গাড়ি রেখে ফরহাদ অফিসে গেল। কান্ট্রি। রিপ্রেজেনটেটিভ অশোক বাবুকে বলবে মফস্বলের আজেবাজে হোটেলে খেয়ে তার ফুড পয়জনিং-এর মত হয়েছে। আজ আর কাল এই দুদিনের ছুটি দরকার। অশোক বাবু ভাল মানুষ ধরনের। তিনি না করবেন না। তাছাড়া সে ছুটিছাটা তেমন নেয় না।

অশোক বাবুকে তার বিয়ের কথাটা বলতে হবে। অনেক দিনতো সে মফস্বলে মফস্বলে ঘুরল এখন যদি তাকে হেড অফিসে ট্রান্সফার করা হয়। এতে অবশ্যি তার রোজগার কমে যাবে। টিএ বিল পাবে না। না পাওয়া গেলে নাই। আসমানীর সঙ্গে থাকা এটাই কম কি?

অশোক বাবু ফরহাদের কথা শুনলেন। বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনে বললেন—কনগ্রাচুলেশন। ঐ মেয়েটির সঙ্গেই কি বিয়ে হচ্ছে যে মাঝে মধ্যে আমার টেলিফোনে টেলিফোন করে আপনাকে চাইতো?

ফরহাদ লজ্জিত গলায় বলল, জ্বি স্যার।

তাকে একদিন আমি একটু ধমকের মত দিয়েছিলাম। আমাকে ক্ষমা করে দিতে বলবেন।

স্যার এটা কোন ব্যাপারই না। আমি আপনার কাছে হাত জোড় করছি—আমাকে ঢাকায় আনার ব্যাপারটা আপনি একটু দেখবেন।

অশোক বাবু চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে অস্বস্থির সঙ্গে বললেন ফরহাদ সাহেব আপনি বড় সাহেবের সঙ্গে কথা বলেন।

ফরহাদ বলল, এইসব নিয়ে বড় সাহেবের সঙ্গে কথা বলার সাহস আমার নেই। যা করবার আপনি করবেন।

অশোক বাবু শুকনো মুখে বললেন—আপনার চাকরি নিয়েই একটা সমস্যা হয়েছে। আপনার যে কজন—আউট অব টাউন রিপ্রেজেনটেটিভ ছিলেন তাদের সবাইকেই টার্মিনেট করা হয়েছে। আউট অব টাউন সার্ভিসই কোম্পানী উঠিয়ে দিচ্ছে।

সেকি!

আপনি বড় সাহেবের সঙ্গে কথা বলেন। অন্যরা সবাই কথা বলেছে। বড় সাহেব অফিসে আছেন।

ফরহাদ ঘড়ি দেখল। সে আসমানীকে পাঁচ মিনিটের কথা বলে এসেছিল। দশ মিনিট হয়ে গেছে। বড় সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে গেলে আরো আধ ঘন্টা লাগবে।

অশোক বাবু বললেন, কথা বলে অবশ্যি কোন লাভ হবে না। ডিসিসান অনেক আগের। যাই হোক চেষ্টা করতেতো ক্ষতি নেই। আপনাদের মধ্যে যারা সিনিয়ার তাদের অন্য জায়গায় নেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।

ফরহাদ সিনিয়ারদের মধ্যে পড়ে না। সে সম্ভবত সবচে জুনিয়ার। সে বড় সাহেবের ঘরের সামনে গেল। বাইরে লালবাতি জ্বলছে। কাজেই এখন যাওয়া যাবে না। সে মাইক্রোবাসের দিকে ফিরে গেল। আসমানী তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ইশারায় হাতের ঘড়ি দেখাল। দূর থেকেই বুঝিয়ে দেয়া দেরী হয়েছে।

আসমানী হাসি মুখে বলল, পাঁচ মিনিটের কথা বলে এগারো মিনিট ত্রিশ সেকেন্ড সময় নিয়েছ।

ফরহাদ কিছু বলল না। আসমানী বলল, মুখ এমন করে রেখেছ কেন? বড় সাহেবের বকা খেয়েছ?

ফরহাদ বলল, অফিসের বড় সাহেবরা বকা দেন খুব কম। বকা দিয়ে তারা এনার্জি নষ্ট করেন না। তাদের কাজ কর্ম লেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ। বকা দেয়ার বদলে—এই প্রতিষ্ঠানে তোমার সার্ভিসের আর প্রয়োজন নেই লিখে নিচে নাম সই করে দেন।

তোমার তাই হয়েছে নাকি?

ফরহাদ কিছু বলল না। আসমানীকে বাড়ি পাঠিয়ে তার উচিত আবার অফিসে ফিরে আসা। ব্যাপারটা কি খোঁজ নেয়া। নান্টু ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা। তার চাকরি গেলে নান্টু ভাইয়েরও গেছে। সেটা সহজ হবে না। নান্টু ভাই সহজ পাত্র না। অতি ঘঘাড়েল লোক। নান্টু ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা অতি সহজ। তাঁর একটা মোবাইল টেলিফোন আছে। সবাইকে বলে দিয়েছেন—ভয়াবহ ইমার্জেন্সি হলে তবেই তাকে টেলিফোন করা যাবে। ইনকামিং কলের চার্জ দেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব না। খেজুরে আলাপ করার জন্যে যদি কেউ টেলিফোন করে মিনিট হিসেব করে তাকেই বিল দিতে হবে।

এই তুমি মুখ ভোতা করে বসে আছ কেন? ঠিক করে বলতে, অফিসে কি কোন ঝামেলা হয়েছে?

না।

তাহলে গল্প কর, No মুখ ভোতা বিজনেস।

তুমি গল্প কর আমি শুনি।

আসমানী উজ্বল মুখে বলল, আচ্ছা তোমাকে একটা সহজ ধাঁধা জিজ্ঞেস করি। তুমি যদি ধাঁধাটার জবাব দিতে পার তাহলে আজ সারাদিনে তুমি যা বলবে আমি তাই শুনব। আর তুমি যদি না পার তাহলে আমি যা বলব তাই তোমাকে শুনতে হবে। রাজি?

আমি আসলে ধাঁধা একেবারেই পারি না। এটা খুবই সহজ ধাঁধা। বলতো মানুষের দাঁত কটা থাকে?

বত্রিশটা।

হয় নি। মানুষের দাঁত থাকে ৫২টা। ছোটবেলায় যে দাঁতগুলি থাকে সেগুলি তুমি হিসাবে ধরছ না কেন? সেগুলিও তো দাঁত। কাজেই বাজিতে তুমি হেরে গেলে। এখন থেকে আমি যা বলব তাই তোমাকে শুনতে হবে।

আচ্ছা। আজকের দিনে আমার সব ইচ্ছা তুমি পূর্ণ করবে। আচ্ছা।

বিয়ের রাতে আমি তোমাকে পাঁচটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করব। পাঁচটা ধাঁধার যে কোন একটাও যদি তুমি পার তাহলে বাকি জীবন আমি তোমার কথা শুনব। পাঁচটা ধাঁধাই সহজ। খুবই সহজ। কিন্তু কেউই পারে না।

সহজ হলে পারে না কেন?

সবাই চিন্তা করে জটিল ভাবে তাই পারে না। যাই হোক আজ আমি বাজি জিতে গেছি কাজেই বাজির শর্ত অনুসারে আমার প্রতিটি ইচ্ছা তুমি পূর্ণ করবে। আমার প্রথম ইচ্ছা হল—তুমি আমাকে একটা সার্টের দোকানে নিয়ে যাবে। আমি তোমার জন্যে সাতটা সাত রঙের সার্ট কিনব। একেক দিন একেক রঙের সার্ট পরবে। যেমন রোববারে পরবে মেরুন রঙের সার্ট, শুক্রবার পরবে সাদা রঙের সার্ট। যেন তোমার গায়ের সার্ট দেখে আমি বলে দিতে পারি আজ কি বার।

ফরহাদ ক্লান্ত গলায় বলল, চল যাই। শুধু কিছুক্ষণের জন্যে আমাকে ছাড়তে হবে আমি কার্ডফোন থেকে একটা ফোন করব।

কাকে ফোন করবে?

নান্টু নামের এক ভদ্রলোককে। আমার সঙ্গে কাজ করেন। আমার সিনিয়ার ভাই।

টেলিফোন করতেই হবে? খুবই জরুরী?

হুঁ।

বেশতো আমাকে কোন একটা সার্টের দোকানে ঢুকিয়ে তুমি টেলিফোন করে আস। গুলশানের দিকে চল।

গুলশানের দিকে না গেলে? ঐদিকের দোকানগুলি খুব এক্সপেনসিভ হয়।

হোক এক্সপেনসিভ। আমি তোমাকে একটা উপহার দেব। সস্তা উপহার দেব না-কি? ড্রাইভার সাহেব গুলশানের দিকে যানতো। আর আপনার মাইক্রোবাসে যদি গান শোনার ব্যবস্থা থাকে তাহলে গান বাজান।

হিন্দী গান আছে আপা।

হিন্দী গুজরাটি কোন সমস্যা নেই।

আসমানী ফরহাদের দিকে আরেকটু ঝুঁকে এসে নিচু গলায় বলল, আমার ডান হাতের আঙ্গুলগুলি একটু পরীক্ষা করে দেখতো। আঙ্গুল কি পাঁচটাই আছে না, দু একটা বেড়েছে। আমার দ্বিতীয় ইচ্ছা যা তুমি পুরন করবে তা হল যতক্ষণ গাড়িতে থাকবে আমার হাত ধরে বসে থাকবে। মনে থাকে যেন।

 

মোবাইল টেলিফোনে কাউকে পাওয়া বেশ কঠিন। টেলিফোন করলেই কিছুক্ষণ কট কট, কট কট শব্দ হয়। তারপর খুব মিষ্টি গলায় একটা মেয়ে বলে, সকল চ্যানেল ব্যস্ত। আপনি আবার চেষ্টা করুন। মোবাইল টেলিফোনে নাম্বাররা থাকে এক গাদা। টিপতে টিপতে আংগুল ব্যথা।

অবশ্যি আজ নান্টু ভাইকে প্রথম বারেই পাওয়া গেল। নান্টু ভাই ধমকের গলায় বললেন কে?

ফরহাদ বলল, নান্টু ভাই আমি।

তুই কোথায়?

গুলশানে। গু

লশানে কি করছিস এক্ষুণি চলে আয়।

কোথায় আসব?

অফিসে চলে আয়। কথা নাই, বার্তা নাই পাঁচটা লোকের চাকরি খেয়ে ফেলবে—আর আমরা তাদের বুড়া আংগুল চুষব। পেয়েছে কি? গজব করে দেব না। আমার নাম নান্টু পাগলা।

বড় সাহেবের সঙ্গে আপনার কথা হয়েছে?

এক দফা হয়েছে। বড় সাহেব দেখা গেল আমাকে চিনে না। আইন দেখায়। আমাদের চাকরির শর্ত না-কি এই দিন যেকোন দিন যে কোন কারণ ছাড়াই চাকরি বাতিল হতে পারে। শালা আমাকে আইন দেখায়। আইন আমি তার গুহ্যদ্বার দিয়ে ঢুকায়ে দিব।

নান্টু ভাই আপনার আশে পাশে কেউ নাই?

থাকুক। তুই চলে আয় মারাত্মক প্ল্যান করেছি।

কি প্ল্যান?

অফিসের সামনে আমরণ অনশন। স্ত্রী পুত্র পরিবার সহ। আমি আমার বউ আর তিন বাচ্চা নিয়ে আসব। বাচ্চা তিনটার মধ্যে একটা দুধের শিশু। সে সারাক্ষণ কেউ কেউ করে কাঁদবে।

তিন বাচ্চা আপনি পাবেন কোথায়? আপনারতো একটাই ছেলে।

বৌ বাচ্চা সব ভাড়া করব। তুই এক কাজ কর তোর খালাতো বোন, মামাতো বোন কাউকে রাজি করিয়ে নিয়ে আয় বউ এর প্রক্সি দেবে।

ফরহাদ হাসল। নান্টু টেলিফোনেই ধমক দিল, হাসি বন্ধ। নো লাফিং। চাকরি ফেরত না পাওয়া পর্যন্ত আমরা কেউ হাসব না। দাড়ি গোফ কামাব না। পত্রিকার অফিসে খবর দিয়ে আসব। প্রয়োজনে পত্রিকাওয়ালাদের মাল খাওয়াব। মন্ত্রী মিনিষ্টার চেনা জানা আছে?

না।

এমন কাউকে খুঁজে বের কর যাদের মন্ত্রী মিনিষ্টারের সঙ্গে কানেকশান আছে। সবচে ভাল হয় মন্ত্রীর স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় আছে এমন কাউকে যদি পাওয়া যায়। আমরা স্ট্রেইট ম্যাডামের পা ধরে বসে থাকব। বাঙ্গালীমেয়ের পা একবার ধরতে পারলে সর্ব মুশকিল আসান। পা ধরতে পারাটাই কঠিন। তুই কথা বলে সময় নষ্ট করছিস কেন? চলে আয়।

আসছি।

আসছি না-এক্ষুণি লাফ দিয়ে বেবীটেক্সীতে ওঠ।

ফরহাদ লাফ দিয়ে বেবীটেক্সিতে উঠল না। উঠা সম্ভব না। তাকে সারাদিন আসমানীর সঙ্গে কাটাতে হবে। এক ফাঁকে জাহানারার মেয়ের জন্যে আংটি কিনতে হবে। জাহানারার মেয়ের আজ আকীকা। আংটি পৌঁছে দিতে হবে। সন্ধ্যাবেলা মার সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেই হবে। মা সস্তার আংটি দেখে রাগ করবেন। রাগ করলেও কিছু করার নেই।

আসমানী সাতটা সার্ট কিনল রঙগুলি হল—কমলা, গাঢ় নীল, হালকা নীল, হালকা সবুজ, সাদা, ছাই, কাল।

চাইনীজ খেতে বসে কাগজ কলম নিয়ে লিষ্ট করল কোন রঙের সার্ট কখন পরা হবে।

রবিবার : (আনন্দের রঙ) কমলা

সোমবার : (আনন্দের পরই বিষাদ) কাল

মঙ্গলবার : (বিষাদ একটু কম) ছাই রঙ

বুধবার : (আবার আনন্দ ফিরে আসছে) হালকা সবুজ

বৃহস্পতিবার : (আনন্দ বাড়ছে) হালকা নীল

শুক্রবার : (পবিত্রতার রঙ) সাদা

শনিবার : (আর মাত্র একদিন পর রবিবার। খুব আনন্দ) গাঢ় নীল।

আসমানী নিজের জন্যে সাতটা শাড়ি কিনেছে। সবই লাল রঙের। বিয়ের পরের এক মাস সে লাল শাড়ি ছাড়া কিছুই পরবে না। আরেকটা খুব সুন্দর শাড়ি কিনল কণার জন্যে। কণা তার স্কুল জীবনের বান্ধবী।

ফরহাদ বলল, তোমার মধ্যে ভালই পাগলামী আছে।

আসমানী বলল, তা আছে। আচ্ছা শোন তুমি এখনো মুখ এমন আমশি করে রেখেছ কেন? তোমার কি কোন কিছু নিয়ে খুব দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে?

ফরহাদ ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। কিছু বলল না। তার দুঃশ্চিন্তা অবশ্যই হচ্ছে। এই মুহূর্তে দুঃশ্চিন্তার কথা বলে আসমানীর মন খারাপ করিয়ে দেবার কোন মানে হয় না।

দুশ্চিন্তা হল পোকার মত। পোকাটা মাথার ভেতরে মগজে জন্ম। জন্মেই মগজ খাওয়া শুরু করে। মগজ খায় আর আয়তনে বাড়ে। ফরহাদ সেই পোকাটাকে এখন অনুভব করতে পারছে। কুটকুট করে কামড়ে মগজ খাচ্ছে–সেই কুটকুট শব্দও শুনতে পাচ্ছে। আসমানীর হাসি মুখ, তার আনন্দ কোন কিছুই ভাল লাগছে না।

আসমানী বলল, এই একটা ইন্টারেস্টিং জায়গায় যাবে?

কোথায়?

এয়ারপোর্টের কাছে একটা রেস্টুরেন্ট আছে। পানির মধ্যে রেস্টুরেন্ট। নৌকায় করে যেতে হয়।

এত দূরে যাব?

দূরে সমস্যা কি? আমাদের সঙ্গে গাড়ি আছে। গাড়ি ভর্তি তেল। আমরা ইচ্ছ করলে কুমিল্লা চলে যেতে পারি। কুমিল্লা যাবে? চল কুমিল্লা চলে যাই।

কুমিল্লা?

এখন রাস্তা ভাল। যাব আর চলে আসব। রাত হয়ও যদি কেউ কিছু বলবে না।

কুমিল্লা যেতে ইচ্ছা করছে না, চল এয়ারপোর্টের কাছেই চল। নৌকা চালাই।

আসমানী উজ্জ্বল মুখ করে বলল, এক কাজ করলে কেমন হয়। চল আমরা রেস্টুরেন্টে গিয়ে নৌকায় চড়ি। তারপর নৌকাটা মাঝখানে নিয়ে ড়ুবিয়ে দিয়ে সঁতরে পাড়ে আসি। তুমি নিশ্চয়ই সাঁতার জান?

ফরহাদ বিস্মিত হয়ে বলল, তাতে লাভ কি?

আসমানী হাসি মুখে বলল, যারা রেস্টুরেন্টে মজা করতে এসেছিল তারা বাড়তি মজা পাবে। বাসায় ফিরে গল্প করতে পারবে। রেস্টুরেন্টওয়ালাদেরও উচিত শিক্ষা হবে। পানির নিচ থেকে নৌকা তুলতে হবে। তারা হয়ত এর পর নৌকা ব্যবসা ছেড়ে দেবে। হি হি হি।

আসমানী হেসেই যাচ্ছে। ফরহাদ তাকিয়ে আছে। সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। আসমানী এত হাসছে কেন?

এই শোন চলতো কিছু ক্যাসেটের দোকান থেকে ভাল ভাল ক্যাসেট কিনি। মাইক্রোবাসওয়ালার হিন্দী গান শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা।

চল কিনি।

তুমি অংক স্যারদের মত মুখ করে আছ কেন?

শরীর ভাল লাগছে না। পেট ব্যথা করছে।

পুপু?

পুপু মানে?

পুপু মানে হাগু। হি হি হি। এ রকম অবাক হয়ে তাকাচ্ছ কেন? আমি তোমার বউ, আমি যা ইচ্ছা বলতে পারি। হাগু খুবই ভদ্র শব্দ। আমি এরচে অনেক ভয়ংকর ভয়ংকর শব্দ জানি। যথাসময়ে বলব। রাগ করলেও লাভ নেই।

রাগ করব না।

পেটে ব্যথা কি বেশী?

পেট ব্যথা ছাড়াও তুমি অন্য কোন কিছু নিয়ে খুব দুঃশ্চিন্তা করছ। সেটা কি বলতো?

ফরহাদ ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। চাকরির সমস্যার কথাটা আসমানীকে বলা কি ঠিক হবে? ফরহাদ বুঝতে পারছে না। মেয়েটা এত আনন্দে আছে তার আনন্দ নষ্ট করা খুবই অনুচিত হবে। ব্যাপারটা গোপন করে যাওয়াও ঠিক হবে না। সরাসরি না বলে অন্য ভাবে হলেও বলা দরকার। বিয়েটা পিছাতে হবে।

আসমানী!

বল।

ভাবছি চাকরিটা ছেড়ে দেব।

কেন?

ঘোরাঘুরির চাকরি ভাল লাগে না। আজ রংপুর তো কাল চাঁদপুর। বেতনও এমন কিছু না। আমি থাকব মফস্বলে, তুমি থাকবে ঢাকায়।

আমি ঢাকায় থাকব তোমাকে কে বলেছে? আমি তোমার সঙ্গে সঙ্গে থাকব। তুমি যেখানে আমিও সেখানে।

পাগল হয়েছ। আমি যে সব হোটেলে থাকি তুমি সে সব হোটেলে ঢুকবেই না। সব সময় যে হোটেলে থাকি তাও না। মাঝে মাঝে ইস্টিশনের বেঞ্চিতে শুয়ে রাত কাটিয়ে দেই।

সেতো আরো একসাইটিং। দুজন স্টেশনের বেঞ্চিতে বসে গুটুর গুটুর করে গল্প করব। তুমি স্টেশনের টি স্টল থেকে এক কাপ চা নিয়ে আসবে। আমরা দুজন সেই চা ভাগাভাগি করে খাব।

চিন্তা করতে তোমার কাছে যত ইন্টারেস্টিং লাগছে, বাস্তব কিন্তু তেমন ইন্টারেস্টিং না।

ইন্টারেস্টিং ভাবলেই ইন্টারেস্টিং। আর বোরিং ভাবলে বোরিং।

ও।

এ রকম বিশ্রি ভাবে ও বললে কেন?

বিশ্রী ভাবে বলেছি?

খুবই বিশ্রী ভাবে বলেছ। তোমার ও বলা শুনে মনে হয়েছে তোমার পেটের ব্যথা শেষ পর্যায়ে গিয়েছে এবং তুমি প্যান্টে পুপু দিয়েছ। হি হি হি।

ফরহাদ তাকিয়ে আছে। আসমানী হাসি থামিয়ে বলল, অনেক ফাজলামী করেছি আর করব না। চল সুন্দর দেখে কিছু ক্যাসেট কিনি। সর্বশেষ অস্বস্তিকর জিজ্ঞাসা–পেটের ব্যথা কমেছে?

হুঁ।

আচ্ছা আজ আমার এত আনন্দ লাগছে কেন বলতো? আমার ঠিক এই মুহূর্তে কি ইচ্ছা করছে জান?

না। কি ইচ্ছা করছে?

ইচ্ছা করছে মাইকের দোকান থেকে একটা মাইক ভাড়া করতে। সেই মাইকটা পিকনিক পার্টির বাসে যেমন করে বাসের ছাদে ফিট করে, তেমন করে আমাদের মাইক্রোবাসের ছাদে ফিট করব। আমাদের মাইক্রোবাস চলবে। আমাদের পছন্দের গানগুলি আমরা বাজাব। মাঝে মাঝে আমি একটা ঘোষণা দেব। আমি বলব—

ঢাকা নগরবাসি। আমার নাম আসমানী।
আমার পাশে যে যুবকটি বসে আছে তার নাম ফরহাদ।
আমরা আগামী শুক্রবার বিয়ে করছি।
আমাদের বিয়েতে আপনাদের সবার নিমন্ত্রণ। কোন গিফট আনতে
হবে না। তবে খালি হাতে যেহেতু আসতে আপনাদের লজ্জা লাগবে
আপনারা ইচ্ছা করলে একটা করে বেলী ফুলের মালা আনতে পারেন।
বেলী আমার খুব পছন্দের ফুল।

 

ফরহাদ অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। আসমানীর এই রূপের সঙ্গে তার পরিচয় ছিল না। সে হাসি খুশি ধরনের মেয়ে। মজা করে কথা বলতে পছন্দ করে। আবেগ উচ্ছাস সবই পরিমিতির মধ্যে এতদিন পর্যন্ত এ রকম ধারণা ছিল। আজ ধারণা পাল্টে যাচ্ছে। একটা মানুষের ভিতর তিন চারটা মানুষ বাস করে। বিচিত্র পরিবেশে বিভিন্ন জন বের হয়ে আসে। আসমানীর ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। আসমানীর ভেতর থেকে অন্য এক আসমানী বের হয়ে আসছে। যাকে ফরহাদ চেনে না।

আসমানী বলল, তুমি দয়া করে আমার কপালে হাত দিয়ে দেখতে আমার জ্বর কি-না।

কপালে হাত দিয়ে ফরহাদ চমকে উঠল অনেক জ্বর।

আসমানী ক্লান্ত গলায় বলল, জ্বরটা অনেকক্ষণ ধরে টের পাচ্ছিলাম। যতক্ষণ পেরেছি অগ্রাহ্য করেছি। এখন আর পারছি না। চল বাসায় চলে যাই।

চল।

আসমানী ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল—তোমাকে একটা ট্রিকস শিখিয়ে দিচ্ছি। তুমি যখনই দেখবে আমি হড়বড় করে কথা বলছি তখন বুঝবে আমার জ্বর আসছে।

তোমার কি প্রায়ই জ্বর আসে?

হু। একবারতো ডাক্তাররা সন্দেহ করল ব্লাড ক্যান্সার। নানান টেস্ট ফেস্ট করল। তারপর দেখা গেল-ব্লাড ক্যান্সার না। আমার মনটা খুবই খারাপ হল।

কেন?

ব্লাড ক্যান্সার হলে সবাইকে বড় গলায় বলতে পারতাম। তখন সবাই আমার সঙ্গে অন্য রকম করে কথা বলতো। সবাই ভাবতো—আহারে মেয়েটা মাত্র অল্প কিছু দিন বাঁচবে।

মরবিড ধরনের কথা বন্ধ করতো।

ওকে বন্ধ করলাম। আচ্ছা আমার একটা প্রশ্নের সত্যি উত্তর দাও তোমার কি অফিসে চাকরি নিয়ে কোন সমস্যা হয়েছে?

হঠাৎ এই কথা জিজ্ঞেস করছ কেন?

আসমানী বলল, তুমি পাঁচ মিনিটের কথা বলে অফিসে গেলে। এগারো মিনিট ত্রিশ সেকেন্ড পরে ফিরে আসলে। তোমার মুখ ছাই বর্ণ। এর পর থেকে লক্ষ্য করছি তুমি কিছুতেই মন বসাতে পারছ না। তারপর কথা নেই, বার্তা নেই বললে এই চাকরিটা তুমি ছেড়ে দিতে চাচ্ছ। দুই এবং দুই মিলিয়ে আমি চার করেছি। আমার অনেক বুদ্ধি।

তাইতো দেখছি।

তোমার যে চাকরি চলে গেছে এই খবরটা ভুলেও আমাদের বাসার কাউকে জানাবে না। তাহলে আমাকে মামা জাহাজীর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেবে। তোমার সঙ্গে বিয়েটা আগে হয়ে যাক তারপর যা ইচ্ছা থোক। কপালে হাত দিয়ে দেখতো–আমার জ্বর মনে হয় আরো বেড়েছে।

হ্যাঁ বেড়েছে।

মাইক্রোবাসে উঠেই আমি কিন্তু তোমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ব। তোমার দায়িত্ব হচ্ছে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়া। পারবে না?

পারব।

একটা গাছ দশটা পাখি। তিনটা উড়ে গেল। কটা থাকল?

সাতটা। কেন?

এম্নি জিজ্ঞেস করলাম।

এটা কি কোন ধাঁধা?

না কোন ধাঁধা না।

ফরহাদ লক্ষ্য করল আসমানী ঠিকমত হাঁটতেও পারছে না। এলোমেলো ভঙ্গিতে পা ফেলছে। জ্বরের আভায় তার মুখ লালচে হয়ে আছে। ফরহাদের মনে হচ্ছে আসমানীর হাত ধরা মাত্র সে এলিয়ে তার কাঁধে পড়ে যাবে। তাদেরকে বেশ অনেক খানি পথ হাঁটতে হবে। মাইক্রোবাস অনেক দূরে অপেক্ষা করছে।

আসমানী শরীরটা কি খুব বেশী খারাপ লাগছে?

উঁহু।

হাঁটতে পারছ?

পারছি। কিন্তু আমার ফিলিং হচ্ছে আমি ভাসতে ভাসতে যাচ্ছি।

এসো আমার হাত ধর।

হাত ধরব না। হাত ধরলে ভেসে যাবার ফিলিংসটা থাকবে না। আমার মনে হয় তোমাকে কিছুক্ষণের মধ্যে একটা বিপদে ফেলব।

কি বিপদ?

মনে হয় অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাব। নিউমার্কেটে একবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। মিনিটের মধ্যে শত শত লোক জমে গিয়েছিল। একটা সুন্দরী এবং তরুণী মেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে বিরাট ব্যাপার না? খুব পানির পিপাসা পেয়েছে। আমি আর হাঁটতে পারছি না—আমার হাত ধর। যদি অজ্ঞান হয়ে যাই—মেঝেতে শোয়বে না। কোলে করে গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যাবে। মেঝেতে শোয়ালেই শত শত লোক জমে যাবে, তুমি আর আমাকে ভীড় ঠেলে বের করতে পারবে না। বুঝতে পারছ?

পারছি।

আমাকে কোলে করে গাড়ি পর্যন্ত নিতে পারবেতো? আমার ওজন বেশী না। এইটি নাইন পাউন্ডস। খুবই পানির পিপাসা পেয়েছে। তুমি গাড়িতে উঠেই ঠাণ্ডা এক বোতল পানি কিনে আনবে। বড় বোতল আনবে না। ছোট বোতল আনবে। যাতে আমি একাই পুরো বোতল শেষ করতে পারি।

এত কথা বলছ কেন?

যাতে অজ্ঞান হয়ে না যাই এইজন্যই এত কথা বলছি। অজ্ঞান না হবার অনেক কৌশল আছে। একটা কৌশল হল প্রচুর কথা বলা এবং কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে বড় বড় করে নিঃশ্বাস নেয়া যাতে ব্রেইনে অক্সিজেন সাপ্লাই বেশী থাকে।

ফরহাদ আসমানীর একটা হাত নিজের কাঁধে তুলে দিয়েছে। কোমর ধরেছে শক্ত করে। তোক তাকিয়ে দেখছে। দেখুক।

এই শুনছ? তোমাকে একটু হিন্টস দেব?

দরকার নেই।

খুব সহজ ধাঁধা। পানির মত সহজ। এই শোন আমার প্রচণ্ড পানির পিপাসা হচ্ছে।

পানির ব্যবস্থা করছি।

আচ্ছা এই প্রশ্নটা পারবে? চেয়ারের বাংলা হল কেদারা। টেবিলের বাংলা কি?

জানি না।

কেউ বলতে পারে না। শুধু কণা পেরেছিল। কণাকে চিনেছ—আমার বান্ধবী। তুমি তাকে দেখনি। অতি ভাল মেয়ে। তুমি টেবিলের বাংলা সত্যি জান না?

না।

টেবিলের বাংলা হল—মেজ। ম একের, জ। মেজ। মনে থাকবে?

থাকবে।

এই একটা মজার কথা শুনবে?

হ্যাঁ শুনব।

তুমি যখন সোনার দোকানে আংটি কিনতে ঢুকলে তখন আমি ভেবেছিলাম আমার জন্যে কিনবে। তারপর যখন ছোট্ট একটা আংটি কিনলে তখন কি ভাবলাম জান?

না।

বলতে খুবই লজ্জা লাগছে, কিন্তু বলেই ফেলি—তখন ভাবলাম আমাদের তো একটা বাবু হবে কোন একদিন। জম্নের পর পর তার মুখ দেখার জন্যে তুমি আংটি কিনেছ।

আমার ভাগ্নির আকীকা। তার জন্যে কিনেছি। তুমি যদি চাও তোমার মেয়ের আংটি আমি আগে ভাগে কিনে রাখব।

আমি চাই। অবশ্যই চাই।

আসমানী খুব ঘামছে। তার জ্বর কি কমে যাচ্ছে? না-কি শরীর ঘামা অন্য কোন কিছুর লক্ষণ। ফরহাদ ভয়ে অস্থির হয়ে গেল।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ