সিরাজ সাহেব প্রচুর লোক দাওয়াত করেছেন। আজ তাঁর মায়ের মৃত্যু বার্ষিকী। মিলাদ পড়ানো হয়েছে। মিলাদের পর খাবার ব্যবস্থা। আয়োজনও প্রচুর। বড় মাছ, মাংস পোলাও, দৈ মিষ্টি। দৈ এসেছে টাঙ্গাইল থেকে। সিরাজ সাহেব নিজেই অতিথিদের পাতে দৈ উঠিয়ে দিচ্ছেন। ময়মনসিংহ থেকে ভিসি এবং এসপি এসেছেন। তারাও খেতে বসেছেন। মন্ত্রী স্বয়ং তাঁদের পাতে দৈ তুলে দিচ্ছেন। এই দৃশ্যে তারা বড়ই বিব্রত। এসপি সাহেবের গলায় খাবার আটকে যাবার মত অবস্থা।

স্যার আপনি কেন?

সিরাজ সাহেব বললেন, কেন আমি কি দৈ দিতে পারি না? না-কি আপনার সন্দেহ আমি পরিমাণে আপনাকে কম দেব?

সবাই হেসে উঠল। হাসি থামতেই চায় না। সিরাজ সাহেব ক্রমাগত রসিকতা করে যাচ্ছেন–সবাই হেসে যাচ্ছে।

ঢাকা থেকে পত্রিকার এক সাংবাদিকও এসেছেন। সিরাজ সাহেব তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, যতদূর জানি আপনি সাহিত্যের ছাত্র। আপনি আমাকে বলুন মাথায় ঘোল ঢেলে দেয়ার বাগধারা শোনা যায়। দৈ ঢেলে দেয়া শোনা যায় না কেন?

সাংবাদিক কিছু বলার আগেই সবাই হাসতে শুরু করল। ফজলুল করিম সাহেবের পুরো ব্যাপারটা ভাল লাগছে না। মায়ের মৃত্যু বার্ষিকীতে এত হাসাহাসি কেন? এ তো কোন আনন্দময় উৎসব নয়।

খাওয়া শেষ হতে হতে দশটা বেজে গেল। সিরাজ সাহেব বললেন, আপনারা কেউ যাবেন না, একটা জরুরী ঘোষণা আছে। আজ একটা বিশেষ দিন। আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম বিশেষ দিনে একটা জরুরী ঘোষণা দেব। তাছাড়া ইচ্ছা করলেও আপনারা কেউ যেতে পারবেন বলে মনে হয় না, যে বৃষ্টি নেমেছে। রাস্তায় এক হাঁটু পানি

সবাই আবারো হাসতে শুরু করলো। রাস্তায় এক হাঁটু পানি এই খবরে হাসার কি আছে ফজলুল করিম সাহেব বুঝতে পারছেন না। না-কি মন্ত্রীদের প্রতিটি কথায় হাসতে হয়, এটাই নিয়ম।

সিরাজ সাহেব বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতেই ঘোষণা দিলেন। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। মাথায় টুপি পরে বিসমিল্লাহ হির রহমানির রাহিম বলে শুরু করলেন

আজ আমি যদিও আপনাদের সবার সঙ্গে খুব হাসাহাসি করছি তবু আপনারা নিশ্চয়ই শুনেছেন আজ আমার মার মৃত্যু দিবস। মা নয় বছর আগে এই বাড়িতে মারা গেছেন। আমি আমার মার কু পুত্র। র জন্যে। কিছুই করতে পারিনি। কাজেই ঠিক করেছি, মার স্মৃতির রক্ষার জন্যে এই অঞ্চলে একটা স্কুল দেব। তবে লোকজন যেমন নাম দিয়ে স্কুল দেয় সে রকম কিছু না, স্কুলের নাম হবে নীলগঞ্জ হাই স্কুল। আমার মায়ের নাম স্কুলের সঙ্গে যুক্ত রাখব না। এটা আমার কাছে অরুচিকর মনে হয়। তাছাড়া আপনারা অনেকেই জানেন আমার মা ছিলেন অত্যন্ত পর্দানশীন মহিলা। তাঁর নাম। সবাই মুখে নেবে এটা তার ভাল লাগার কথা না।

প্রচণ্ড হাততালিতে সিরাজ সাহেবের কথা চাপা পড়ে গেল। তিনটা হ্যাজাক বাতির একটা দপ দপ করছে, এতেও তাঁর বক্তৃতা বাধা পাচ্ছিল। হ্যাজাক ঠিক করার পর রমিজ সাহেব আবার শুরু করলেন,

আমি আমাদের পৈত্রিক বসত বাটি সেই সঙ্গে দশ একর জমি এবং নগদ পাঁচ লাখ টাকা স্কুলের নামে লিখে পড়ে দিয়েছি। কাগজপত্র রেজিষ্ট্রি হয়েছে। কাগজপত্র ফাইলে রাখা হয়েছে–আপনারা ইচ্ছে করলে দেখতে পারেন।

মন্ত্রীরা ক্ষমতা অপব্যবহার করে অনেক আজেবাজে কাজ করেন-আমিও একটু করেছি। সরকারি স্যাংশন করিয়ে ফেলেছি। এতে আমার যদি অধর্ম হয়ে থাকে ক্ষমা করবেন।

আমাদের এই নীলগঞ্জ স্কুলের ছাত্ররা ইনশাল্লাহ্ এই সেশানের পরের সেশান থেকেই এসএসসি পরীক্ষা দেবে। এখন আমি যা চাই সেটা হলআপনাদের সাহায্য। এটা আমার মার স্কুল না, এটা আপনাদেরই স্কুল। আমি কিছু করছি না, যা করছেন আপনারাই করছেন।

ফজলুল করিম সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন–স্যার এখানে তো একটা স্কুল আছে। অনেক দিনের পুরানো স্কুল।

সিরাজ সাহেব বললেন, মার কাছে মামার বাড়ির গল্প কেন করছেন হেডমাষ্টার সাহেবঃ জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুল যে এখানে আছে সেটা আমি জানব না? আমি সেই স্কুলের ছাত্র না?

সবাই আবারো হো হো করে হাসছে। ফজলুল করিম সাহেব সেই হাসি অগ্রাহ্য করে বললেন, দুটো স্কুল চলার মত অবস্থা স্যার নীলগঞ্জের নাই।

এখন নেই–পরে হবে। শিক্ষার হার জিওমেট্রি প্রগ্রেসানে বাড়বে। দুটা স্কুলে আমাদের চলবে না। তিনটা চারটা স্কুল লাগবে।

ফজলুল করিম সাহেব ক্ষীণ স্বরে বললেন, এতো পুরানো দিনের স্কুল উঠে যাবে এটা কি ঠিক হবে? স্যার আপনিই বলুন–আপনি সাহায্য করতে চান। সাহায্য করুন, আমাদের স্কুলকে করুন

আপনার স্কুলের সাহায্য লাগবে কেন? আপনার মত হেডমাস্টার থাকতে স্কুলের কি চিন্তা? তাছাড়া দুটো স্কুল থাকলে কম্পিটিশন হবে। কম্পিটিশনের ফল সব সময় শুভ হয়। সাহায্যের কথা বলছেন না হয় আপনাদেরও সাহায্য করব, শর্ত একটাই আপনারা আমার স্কুল দাড়া করিয়ে দেবেন।

ফজলুল করিম সাহেব আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, মাহবুব সাহেব তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, স্যার আমরা যা করার ইনশাআল্লাহ্ করব। এই বিষয়ে আপনি কোন দুশ্চিন্তা করবেন না। আল্লাহ হাফেজ।

সিরাজ সাহেব বললেন, চায়ের ব্যবস্থা আছে। চা না খেয়ে কেউ যাবেন। বৃষ্টি কিন্তু এখনো পড়ছে। আপনাদের জন্যে নৌকার ব্যবস্থা করেছিনৌকা দিয়ে আপনাদের পৌঁছে দেয়া হবে। হা-হা-হা।

আবারো হাসি শুরু হল।

ফজলুল করিম সাহেব বাসায় ফিরলেন মাঝরাতে। বাইরের বারান্দার উঠোনে হারিকেন জ্বালিয়ে রেশমী বসে আছে। কি সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। রেশমী উদ্বিগ্ন গলায় বলল, কই ছিলেন?

দাওয়াত ছিল রেশমী।

আমারে কিছু বলে যাবেন না। না-কি আমি কোন মানুষ না?

রেশমী কেঁদে ফেলল। সহজ কান্না না-হাউ মাউ করে কান্না। ফজলুল করিম সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন। কি করবেন, কি বলবেন বুঝতে পারছেন না। রেশমী ফোপাতে ফেঁপাতে বলল, আমি আপনার কে? আমি আপনার কেউ না।

এই প্রথম ফজলুল করিম সাহেবের নিজেকেই নিজের পায়ে পানি টলিতে হল। ঘরে ঢুকে দেখেন রেশমী তার নিজের ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল।

ফজলুল করিম সাহেব বিছানায় শুয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। তার মন বলছে এক সময় রেশমীর রাগ ভাঙ্গবে। সে দরজা খুলে বের হয়ে এলে তাকে বলবেন, দুকাপ চা কর রেশমী, আমার মনটা খুব খারাপ। কি জন্যে খারাপ তোমাকে বলি।

রেশমী দরজা খুলল না। অপেক্ষা করতে করতে ফজলুল করিম সাহেব ঘুমিয়ে পড়লেন। এক সময় তার ঘুম ভাঙ্গলো–তিনি দেখলেন তার মশারী ফেলা। গায়ের উপর চাদর দেয়া। বাইরে মুষল বৃষ্টি। বৃষ্টির শব্দ শুনেই তার মন ভার হচ্ছে? নিজেকে একা লাগছে? কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। রেশমীকে কি তিনি ডেকে তুলবেন? সেটা কি ঠিক হবে। নিশিরাতে তিনি রেশমীকে ডেকে তুলছেন কথা বলার জন্যে। ডেকে তোলার জন্যে কোন অজুহাত থাকলে ভাল হত। চায়ের পিপাসা হচ্ছে। এই অজুহাতে কি ডাকা যায় না?

ফজলুল করিম  সাহেব মশারীর ভেতর থেকে বের হলেন। খাটের পাশে  রাখা চেয়ারের সঙ্গে ধাক্কা লেগে শব্দ হয়। ভালই হল শব্দ উব্দ শুনে যদি রেশমীর ঘুম ভাঙ্গে। তিনি হাত দিয়ে চেয়ার টানলেন আরো শব্দ হল। দরজার সিটকিনি খুললেন। বারান্দায় বেশ খানিকক্ষণ বসে থাকবেন, বৃষ্টির শব্দ শুনবেন।

বৃষ্টির ছাটে বারান্দায় রাখা ইজিচেয়ারের কাপড় ভিজে গেছে। ভেজা কাপড়ের উপরই বসে থাকতে হবে। ব্যাঙ ডাকছে। আচ্ছা ব্যাঙের ডাকের ইংরেজী কি? শব্দটা মনে পড়ছে না কেন? ফজলুল করিম সাহেব ভুরু কুঁচকে বসে আছেন। ইংরেজীটা যদি মনে পড়ে। বয়সের সমস্যা শুরু হয়েছে। স্মৃতি নষ্ট হচ্ছে।

ফজলুল করিম সাহেব অপেক্ষা করছেন। ব্যাঙের ডাকের ইংরেজী মনে পড়ার অপেক্ষা এবং সেই সঙ্গে রেশমীর জন্যে অপেক্ষা। তাঁর মন বলছে রেশমী ঘুমায় নি। ঘুমুলেও সাড়া শব্দে ঘুম ভেঙ্গেছে। রেশমী উঠে আসবে।

বৃষ্টির ছাটে বসে থাকার জন্যে রাগারাগি করবে। তখন তিনি রেশমীকে চা করতে বলবেন। চা খেতে খেতে গল্প করবেন। বয়সের অনেক লক্ষণের। একটি হল-~-ঘুম কমে যায়। মাঝ রাতে কারো সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছে করে।

তিনি বসেই রইলেন। রেশমী এল না। বৃষ্টির বেগ কখনো কমছে, কখনো বাড়ছে। ব্যাঙের ডাকের কোন উঠা নামা নেই। ফজলুল করিম সাহেব–জবুথবু হয়ে বসে আছেন। ব্যাঙের ডাকের ইংরেজী কি ভাবতে ভাবতে বৃষ্টি দেখছেন।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ