স্কুলের ঘণ্টা এরকম করে বাজছে কেন? শব্দটা ঠিক মত আসছে না। ঝনঝন শব্দ না চাপা শব্দ। ব্যাপার কি? ফজলুল করিম সাহেবের ভুরু কুঁচকে গেল। হরিপদকে ডাকা দরকার। এই মুহুর্তে ডাকলে সে ঘণ্টা পেটা বন্ধ করে ছুটে আসবে। কাজেই পাঁচটা ঘণ্টা পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বয়সের কারণে হরিপদের সমস্যা হচ্ছে। গত সপ্তাহেই ফোর্থ পিরিয়ড শুরু হচ্ছে সে পাঁচটা ঘণ্টা বাজিয়ে বসে আছে। এইসব অপরাধ ক্ষমার যোগ্য না। তিনি দুটাকা ফাইন করেছেন। বেতন থেকে কাটা যাবে। যার প্রধান কাজই ঘণ্টা পেটানো। সে যদি তাতেই ভুল করে বসে তাহলে হবে কিভাবে?

দুটাকা ফাইন করে তার নিজেরও মন খারাপ হয়েছে। দুটাকার মূল্য হরিপদের কাছে অনেক। তারপরেও স্কুলের শৃঙ্খলার ব্যাপার আছে। ক্লাসে ক্লাসে ছেলেরা কান খাড়া করে আছে ঘণ্টা শোনার জন্য। চারটার জায়গায় পাঁচটা ঘণ্টা শুনলে ওদের কেমন লাগবে?

ফজলুল করিম সাহেব টিচারদের রোস্টারের দিকে তাকিয়ে আছেন। মমতাজ সাহেব আজও এবসেন্ট। মাহবুব সাহেব এসেছেন ফার্স্ট পিরিয়ডের পর। শিক্ষকদেরও ফাইন করার ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন ছিল। নিয়ম সবার জন্যেই এক হওয়া উচিত। কারো জন্যে কঠিন নিয়ম। কারো জন্যে সহজ, অ হয় না।

হরিপদ।

আজ্ঞে।

ঘণ্টা নিয়ে ভেতরে আস।

হরিপদ স্কুল-ঘণ্টা বগলদাবা করে ভয়ে ভয়ে ঢুকল। বিনয়ে নিচু হয়ে পড়ল। এখন অবশ্যি বিনয় ছাড়াই তার শরীর নুয়ে পড়েছে। কোমর বেঁকে গেছে। বয়স মানুষকে বাকা করে ফেলে।

স্কুলের ঘণ্টার আওয়াজ ঠিকমত শোনা যাচ্ছে না ব্যাপার কি?

হরিপদ আরো নিচু হয়ে গেল। মাথা প্রায় মাটির সঙ্গে যাচ্ছে।

দেখি ঘণ্টা দেখি। ঘণ্টা ঠিক আছে।

হরিপদ ঘণ্টাটা টেবিলের ওপর রাখল। ঘণ্টা ঠিক আছে। ফেটে যায়নি। এই স্কুলের সবচে মূল্যবান সম্পত্তি হল–ঘণ্টাটা। জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুল শুরু হয় এই ঘণ্টা দিয়ে। ফজলুল করিম সাহেব তখন ছিলেন না–কত আগের কথা। তবে তিনি শুনছেন–স্কুল শুরু হবার প্রথম ঘণ্টা জীবনকৃষ্ণ বাবু নিজে বাজিয়েছিলেন। ঘণ্টা বাজিয়ে তিনি কিছুক্ষণ কেঁদেছিলেন। কি জন্যে কেঁদেছিলেন? মনের আনন্দে?

হরিপদ?

আজ্ঞে?

ঘণ্টাতো ঠিকই আছে। শব্দ এরকম হয় কেন?

হাতুড়ি চুরি গেছে স্যার। এই জন্যে শব্দ কম হয়।

ফজলুল করিম সাহেব বিস্মিত চোখে তাকালেন। কি ভয়ংকর কথা। হাতুড়ি চুরি গেছে। আজ হাতুড়ি গেলে, কাল যাবে ঘণ্টা।

কখন চুরি গেছে?

কাইল থাইক্যা পাই না।

তুমি তো অসম্ভব কথা বলছ হরিপদ। স্কুলের প্রাণ হল তার ঘণ্টা। ঘণ্টা হাতুড়ি থাকে তোমার দায়িত্বে। সেই হাতুড়ি চলে গেল তুমি খবর পর্যন্ত দিলে না। তুমি ঘোরর অন্যায় করেছ। তোমাকে আরো দুটাকা ফাইন করা হল। ঘণ্টার হাতুড়ি চুরি হবার মত কোন বস্তু না। নিশ্চয়ই কোথাও আছে। খুঁজে বের কর।

জ্বে আজ্ঞে।

মাহবুব সাহেব গম্ভীর ভঙ্গিতে ঢুকলেন। মনে হচ্ছে তাকে ডেকে আনায় তিনি বিরক্ত। তিনি হেডমাস্টার সাহেবের সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, ডেকেছেন?

মাহবুব সাহেব আজকের ফাস্ট পিরিয়ড মিস করেছেন।

কাজ ছিল।

কাজ থাকলে আগে ভাগে ছুটি নেবেন যাতে আমরা বিকল্প ব্যবস্থা রাখতে পারি।

হঠাৎ কাজ পড়ে গেল, আগে জানানো সম্ভব ছিল না। ময়মনসিংহ-এর ডিসি সাহেব হঠাৎ চলে এসেছেন। উঠেছেন ডাকবাংলায়…… সকালে তাঁর সঙ্গে চা খেতে বললেন। তাকে তো আর বলতে পারি না–চা খাব না।

সেটা কেন বলবেন? চা খেতে ডেকেছে চা খাবেন। আবার আপনার জন্যে ছাত্ররা যাতে অসুবিধায় না পড়ে সেই দিকেও লক্ষ্য রাখবেন। ডিসি সাহেবের সঙ্গে চায়ের চেয়ে ছাত্রদের ক্লাশ অনেক জরুরী। আপনি শিক্ষক মানুষ। এই ব্যাপারটা আপনি ছাড়া কে বুঝবে?

মাহবুব সাহেব চোখ মুখ কঠিন করে বসে রইলেন। ফজলুল করিম সাহেব বললেন, আচ্ছা যান, এইটা বলার জন্যই ডেকেছিলাম। শুধু যে আজই আপনি ক্লাস মিস করেছেন তাই না। গতকালও স্কুলে এসেছেন টিফিন টাইমের পরে।

গতকাল স্কুলের কাজেই বাইরে ছিলাম। বাজার কমিটির সাথে একটা সভা ছিল। বাজার কমিটির চাদা ছাড়া তো স্কুল চলবে না। না-কি চলবে?

বাজার কমিটির টাকা আমাদের অবশ্যই দরকার। কিন্তু এদের মিটিং এমনভাবে ফেলতে হবে যেন স্কুল এফেকটেড না হয়। ছুটির দিনে মিটিং করবেন কিংবা সন্ধ্যাবেলা করবেন।

মাহবুব সাহেবের মুখে খুব কঠিন কিছু কথা এসে গিয়েছিল সেই সব কথা তিনি সামলে নিলেন। কঠিন কথা বলার সময় পাওয়া যাবে। প্রচন্ড রাগ নিয়ে কঠিন কথা ঠিক না। কঠিন কথা বলতে হয় ঠাণ্ডা মাথায়। খুব ঠাণ্ডা মাথায়।

মাহবুব সাহেব।

জ্বি স্যার।

আমাদের স্কুলের সায়েন্স টিচার আসবেন পরশু সন্ধ্যায়। বিদেশী মানুষ, তাঁর থাকা খাওয়ার একটা ব্যবস্থা তো করতে হয়…।

দেখি, একটা ব্যবস্থা করব।

কি ব্যবস্থা করবেন আমাকে জানাবেন। ষ্টেশনে কাউকে পাঠাতেও হবে উনাকে আনার জন্যে। আমি নিজেই যেতাম। আমার শরীরটা খারাপ রাতে ভাল ঘুম হচ্ছে না। শরীর ভাল লাগলে নিজেই যাব।

মাহবুব সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়াতে দাঁড়াতে বললেন সার আমি তাহলে উঠি?

আচ্ছা। মাহবুব সাহেব!

জ্বি স্যার।

অনেক কঠিন কথা বলে ফেললাম। কিছু মনে করবেন না। মেজাজও খুব খারাপ, হাতুড়ি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কি রকম অব্যবস্থা–স্কুলের হাতুড়ি চুরি গেছে। ডাষ্টার দিয়ে ঘণ্টা পিটাচ্ছে…। আচ্ছা যান। আপনার ক্লাসের সময় হয়ে গেল।

ফিফথ পিরিয়ড শুরু হচ্ছে। ফজলুল করিম সাহেব ঘণ্টার শব্দ শুনছেন। হাতুড়ি পাওয়া যায় নি। ঘণ্টার শব্দ থেকেই বোঝা যাচ্ছে হাতুড়ি পাওয়া যায়নি। ফজলুল করিম সাহেব স্কুলের প্যান্ডে হরিপদের জরিমানা সংক্রান্ত নোটিশ লিখতে শুরু করলেন। সব কিছুর রেকর্ড থাকা দরকার। ফজলুল করিম সাহেব লিখলেন বিষয়ঃ কর্তব্য কার্যে গুরুতর অবহেলা।

সন্ধ্যাবেলা হরিপদ এসে জানালো হাতুড়ি খুঁজে পাওয়া যায় নি। হেডমাস্টার সাহেব তাকে জরিমানার চিঠি ধরিয়ে দিলেন। হরিপদ বিনয়ে নিচু হয়ে রইল। কিছু বলল না।

ফজলুল করিম সাহেব বললেন, শেক্সপিয়ারের একটা কথা আছে আই হ্যাভ টু বি ক্রুয়েল ওনলি টু বি কাইন্ড। অর্থাৎ তোমার প্রতি নিষ্ঠুর হচ্ছি, তৈমাকে করুণী প্রদর্শনের জন্যেই। বুঝছি

জ্বে আজ্ঞে।

আচ্ছা যাও। আমি আরো কিছুক্ষণ থাকব। রাতে এক জায়গায় দাওয়াত আছে। কাজেই রাত আটটা পর্যন্ত স্কুলে থাকব। তোমার থাকার কোন দরকার নেই। তুমি চলে যাও।

জ্বে আজ্ঞে।

যাবার আগে হারিকেনে তেল ভরে দিয়ে ঠিকঠাক করে দিয়ে যেও।

তেল কিনতে হবে স্যার। তেল নাই।

ফজলুল করিম সাহেব দশটাকার একটা নোট বের করে দিলেন।

বোতল নিয়ে যাও ছটাকার কেরোসিন আনবে।

জ্বে আজ্ঞে।

হেডমাস্টার সাহেব ঠিক করে রেখেছেন যে চারটাকা ফেরত আসবে সেই টাকাটা তিনি রাখবেন না এতে দুটাকা দুটাকা করে যে চার টাকা ফাইন হয়েছিল সেটা হরিপদ সামলে ফেলতে পারবে। বোকা মানুষ বলে সে ব্যাপারটা বুঝতে পারবে না।

ফজলুল করিম সাহেবের ঘরে হারিকেন জ্বলছে। হরিপদ বারান্দায় জবুথবু হয়ে বসে আছে। হেড স্যারকে ফেলে সে যেতে পারে না। এটা সম্ভব না।

আজো বৃষ্টি পড়ছে। কাল যেমন বৃষ্টি পড়ছিল আজ তারচেয়েও বেগে বৃষ্টি নেমেছে। এইবার বন্যা না হয়েই যায় না। লাইব্রেরী ঘরের দিকে খটখট শব্দ হচ্ছে। শব্দ শুনে মনে হয় কারা যেন চেয়ার টেবিল টানাটানি করছে। হরিপদের গা সামান্য ছমছম করতে লাগল। স্কুলে একটা গুজব প্রচলিত আছে লাইব্রেরী ঘরে স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা জীবন বাবুকে মাঝে মধ্যে দেখা যায়। ব্যাপারটা পুরোপুরি গুজবও নয়। হরিপদ নিজেও একবার দেখেছে। তিন বছর আগের কথা। শীতকাল, সে স্কুল লাইব্রেরী বারান্দা দিয়ে যাচ্ছিল–হঠাৎ শুনে খটমট শব্দ। লাইব্রেরী দরজা তালা দেয়া, সে ঘুলঘুলি ফাঁক করে তাকিয়েই চমকে উঠল। চেয়ারে জীবন বাবু বসে আছেন। খালি গা-ধবধবে ফর্সা শরীর, মোটা একটা বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছেন। হরিপদকে তাকাতে দেখে তিনি চোখ তুললেন। কি কঠিন সেই চোখের দৃষ্টি। হরিপদের বুক হিম হয়ে গেল। জীবন বাবু ধমকে উঠলেন–কি চাও? হরিপদ ছুটে চলে এল। এই ঘটনার কথা সে কাউকে বলেনি। এইসব ব্যাপার বলতে নেই।

লাইব্রেরী ঘরে শব্দ হচ্ছে, হরিপদের বুক কাপছে। ভরসার কথা এই যে শুধু যে হেডমাস্টার সাহেব আছেন তাই না, মওলানা সাহেবও আছেন। মওলানা সাহেব টিচার্স কমনরুমে নামাজ পড়ছেন।

শুধু যে হরিপদ হেডমাস্টার সাহেবের জন্যে অপেক্ষা করে তাই না। মওলানা সাহেবও অপেক্ষা করেন। এই এক দিকে দুজনের মিল আছে।

নামাজ শেষ করে মওলানা সাহেব ফজলুল করিম সাহেবের ঘরে উঁকি দিলেন।

স্যার যাবেন কখন?

একটু দেরী হবে। সিরাজ সাহেবের ওখানে রাতের খাওয়ার দাওয়াত। নটার সময় যেতে বলেছেন।

নটা বাজতে তো অনেক দেরী, এতক্ষণ বসে থাকবেন?

বসে নেই তো কাজ করছি। এইবার যে কজন ছেলে মেয়ে এসএসসি দিবে ওদের খুব স্পেশাল কোচিং-এর কি ব্যবস্থা করা যায় সেটা নিয়ে ভাবছি। পরিকল্পনা করছি।

আপনি বসুন পরিকল্পনাটা নিয়ে আপনার সঙ্গে ডিসকাস করি।

মওলানা সাহেব বসতে বসতে বললেন–যে বৃষ্টি নেমেছে–চা খেলে কেমন হয় স্যার?

চা খাবেন কিভাবে?

হরিপদ আছে। ওকে ফ্লাক্স দিয়ে পাঠিয়ে দেই।

চা খেতে পারলে মন্দ হয় না অবশ্যি। ফ্লাক্স কোথায় পাবেন?

আমার একটা আছে।

তাহলে তো ভালই হয়। আপনি এখনো যাননি, স্কুলে পড়ে আছেন ব্যাপারটা কি?

একা মানুষ গিয়েই বা কি করব? আপনি আছেন দেখে আমিও থেকে গেলাম।

ভাল করেছেন। আপনার সঙ্গে আমার পরিকল্পনাটা নিয়ে আলাপ করি। বিরাট পরিকল্পনা নিয়েছি।

বলুন শুনি আপনার পরিকল্পনা।

যারা এবার এসএসসি দেবে তারা থাকবে দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা কোচিং-এর আওতায়। লাইব্রেরী ঘরের জিনিসপত্র খালি করে ঐখানে টানা বিছানা করে দেব। সার্বক্ষণিক শিক্ষক থাকবেন। শিক্ষকদের ডিউটি ভাগ করে দেয়া হবে। ব্যবস্থাটা কেমন মনে হচ্ছে?

খুব ভাল মনে হচ্ছে না। সম্ভব না। সম্ভব না কেন?

এইবার চল্লিশজন ছেলে পরীক্ষা দিচ্ছে। ঊনত্রিশটা ছেলে, এগারোটা মেয়ে এদের আপনি কোথায় রাখবেন? এদের খাওয়ার খরচ কে দিবে? শিক্ষকরাই বা বাড়তি ঝামেলা কেন করবেন?

স্কুলের দিকে তাকিয়ে শিক্ষকরা বাড়তি ঝামেলাটা করবেন। এইটা ছাড়া এখন আমাদের উপায় নেই। শহরের স্কুলগুলির সঙ্গে গ্রামের স্কুলগুলি পারছে না। এসএসসির রেজাল্ট হলে আপনি কখনো শুনবেন না গ্রামের কোন স্কুল থেকে একটা ছেলে ফার্স্ট হয়েছে… এমন তো না যে আমাদের ছাত্র খারাপ……

না ছাত্র খারাপ না।

দুটো ছেলে এবার আমাদের ভাল আছে। খুবই ভাল। এদের ঠিক মত তৈরি করতে পারলে……

তাহলে স্যার এই দুজনকে নিয়েই কাজ করুন।

এটাও মন্দ না। আমার নিজের বাড়িতেই রেখে দিতে পারি…. পরের বন্ধুর স্কুলের হোষ্টেল যখন হয়ে যাবে তখন বাধ্যতামুলকভাবে এসএসসির সব ছাত্রকে হোস্টেলে থাকতে হবে….. কি বলেন?

তা করা যাবে।

জোরে সোরে নামতে হবে বুঝলেন মওলানা সাহেব। শহরের স্কুল আমাদের টেক্কা দিয়ে চলে যাবে তা হয় না।

হেডমাস্টার সাহেবের চোখ চকচক করতে লাগল।

 

তাঁরা স্কুল থেকে বেরুলেন সাড়ে আটটায়। বৃষ্টি থেমে গেছে। রাস্তায় পঁাচ প্যাচ কাদা। সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। পোস্টাপিস পর্যন্ত দুজন এক সঙ্গে এলেন। এখান থেকে দুজন দুদিকে যাবেন! ফজলুল করিম সাহেব বললেন, মওলানা সাহেব যাই।

জ্বি আচ্ছা স্যার।

আপনার কথাটাই রাখব ঠিক করেছি, দুটা ছেলেকেই চব্বিশ ঘণ্টা তত্ত্বাবধানে রাখব। সব টিচারদের ডিউটি ভাগ করে দেব……

ইনশাআল্লাহ্।

মওলানা রওনা হতে গিয়েও হলেন না। দাঁড়িয়ে রইলেন। ফজলুল করিম সাহেব বললেন, আপনি কি কিছু বলবেন?

জি না।

আপনার ভাব ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে কিছু বলতে চান।

যদি কিছু মনে না করেন, স্যার।

কিছুই মনে করব না। বলুন কি ব্যাপার।

আপনার বাসায় কাজের যে মেয়েটা আছে কি যেন নাম?

রেশমী।

হ্যাঁ। রেশমী প্রসঙ্গে একটা কথা।

ওর প্রসঙ্গে কি কথা।

মেয়েটার একটা বিয়ের ব্যবস্থা করলে কেমন হয়?

হঠাৎ বিয়ের কথা উঠছে কেন?

মওলানা ইতস্তত করে বললেন–যুবতী মেয়ে বিয়ে হয়ে যাওয়া উচিত। তাছাড়া……

তাছাড়া কি?

আপনি বিপত্নীক মানুষ–তরুণী এক মেয়েকে নিয়ে বাস করছেন। আমাদের মন তো ছোট, হঠাৎ কেউ কিছু বলা শুরু করলে…… সবাই বিশ্বাস করা শুরু করবে…… সত্য আমরা বিশ্বাস করতে চাই না। অসত্য বিশ্বাস করি, কারণ অসত্য বিশ্বাস করানোর জন্য শয়তান আমাদের সব সময় প্ররোচিত করছে।

ফজলুল করিম সাহেব তীব্র গলায় বললেন, কেউ কি আপনাকে কিছু বলেছে? মওলানা জবাব দিলেন না। ফজলুল করিম সাহেব বললেন, মেয়েটা ছোট থেকে আমার সঙ্গে আছে। আমার স্ত্রীর দেশের মেয়ে। সে দেশ থেকে নিয়ে এসেছিল। আমাকে খালু ডাকে।

জানি। সবই জানি–কথা হলো কি, বিয়ে হলে মেয়েটার জন্যেও ভাল। দরিদ্র মেয়ে বিয়ে হলে জীবনের গতি হয়। আমার হাতে একটা ছেলে আছে। মোটর মেকানিক। ভাল রোজগার করে। সংসারে শুধু মা আছে, আর কেউ নেই। যদি বলেন তো কথা বলে দেখি। বলব?

ফজলুল করিম সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, বলুন। বলে দেখুন। বিয়ের যাবতীয় খরচ দেব। আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব করব। মেয়েটা আমার অতি প্রিয়। তার ভাল বিয়ে হলে আমার চেয়ে খুশি আর কেউ হবে না।

মওলানা চুপ করে রইলেন। ফজলুল করিম সাহেব প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, পরও আমাদের নতুন টিচার আসছে শুনেছেন বোধ হয়। সায়েন্স টিচার।

জ্বি, শুনেছি।

তার থাকার ব্যবস্থা করতে হয়। মাহবুব সাহেবকে অবশ্যি বলেছি।

আমার সঙ্গে রাখতে পারি। আমার ঘরে দুটা খাট আছে। উনি একটাতে থাকতে পারেন। থাকতে রাজি হবেন কি-না কে জানে।

রাজি হবেন না কেন?

মওলানা টাইপ কারো সঙ্গে লোকজন রাত্রিযাপন করতে চায় না।

এই জাতীয় অদ্ভুত কথা কেন বলছেন?

অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। মওলানার প্রয়োজন পড়ে মিলাদ পড়াবার সময়, কিংবা কেউ মারা গেলে। অন্য সময় তাদের দরকার নেই। আপনি লক্ষ্য করেছেন কিনা জানি না কেউ কোন মওলানাকে কখনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ দেয় না।

কি যে অদ্ভুত কথা আপনি বলেন।

আপনি নিজেই দেন না। স্কুলের অনেক ঝামেলার কাজ আপনি নিজে করেছেন কিংবা অন্যকে দিয়ে করিয়েছেন আমাকে কখনো দেন নি।

ফজলুল করিম সাহেব চুপ করে রইলেন। মওলানা সত্যি কথাই বলছেন। তিনি ব্যাপারটাকে এ ভাবে কখনো দেখেন নি।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ