বাবু জীবনকৃষ্ণ রায় ময়মনসিংহ জজকোর্টের পেশকার ছিলেন। ঘোৱ বিষয়ী মানুষ। পেশকারী আয় ছাড়াও পাটের ব্যবসা, ধানের ব্যবসা করে ফুলে ফেঁপে একাকার হয়ে গেলেন। ইংরেজি ১৯৪০ সালে কেন্দুয়ায় রায় বাজারে নিজ বসত বাটিতে লাখের প্রদীপ জ্বালেন। লাখ টাকা ঘরে থাকলে লাখের প্রদীপ জ্বালাবার নিয়ম। লম্বা একটা বাঁশের মাথায় হারিকেন। হারিকেনের চিমনী লাল রঙ করা। এই হল লাখের বাতি।

জীবনকৃষ্ণ রায় লাখের বাতি জ্বালালেন, অষ্টপ্রহর নামগানের আয়োজন করলেন, কাঙ্গালী ভোজ করালেন। তার হাতির খুব শখ। সেই রাতেই দুহাজার টাকা দিয়ে লোক পাঠালেন সুসং দুর্গাপুরে একটা মাদী হাতি কেনার জন্যে। লাখের বাতি জ্বালাবার মহা আনন্দ নিয়ে ঘুমুতে গেলেন। তখন একটা কিছু হল। কি হল তা পরিস্কার না। হয়ত কোন স্বপ্ন দেখলেন–কিংবা অন্য কিছু। সকালবেলা জীবনকৃষ্ণ বাবুকে দেখা গেল, তাঁর ঘরের উঠোনে জলচৌকির উপর পা তুলে বসে আছেন। তাঁর চোখ লাল উদভ্রান্ত চেহারা। তাঁর বড় ছেলের স্ত্রী সরজুবালা তার কাছে এসে ভয়ে ভয়ে বলল, বাবা আপনার কি হয়েছে? তিনি সহজ গলায় বললেন, কিছু হয় নাই।

তাঁকে সকালের নাশতা দেয়া হল। কাসার জামবাটিতে এক বাটি কালি-পেঁপে। আরেকটা ছোট বাটিতে সুন্দরবনের খাটি মধু। সকালের নাশতা হিসেবে তিনি পেঁপে, মধু এবং সবশেষে বিশাল এক গ্লাস কুসুম গরম পানি খান। কবিরাজের এই ব্যবস্থা।

জীবনকৃষ্ণ রায় দুটুকরো পেঁপে খেয়ে জামবাটি সরিয়ে দিয়ে বললেন, সরকার মশাইকে খবর দাও।

সরজুবালা আবার বললেন, আপনার কি হয়েছে বাবা?

তিনি বললেন, আমার মন কিঞ্চিত বিক্ষিপ্ত। এক্ষুণি সব ঠিক হয়ে যাৰে। তোমরা চিন্তিত হয়ো না। আমারে দিং (বিরক্ত) করবা না।

সবাইকে গভীর চিন্তায় রেখে তিনি জলচৌকিতে বসে সরকার বাবুর জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন।

 

সরকার বাবু মোকদ্দমার কাজে কেন্দুয়া গিয়েছিলেন, সেখান থেকে আসতে আসতে দুপুর হয়ে গেল। দুপুর পর্যন্ত জীবনকৃষ্ণ বাবু জলচৌকিতেই বসে রইলেন। সরকার বাবু আসার পর তাঁর সঙ্গে তিনি কিছু কথাবার্তা বললেন যা পরিবারের অন্য কেউ শুনল না।

তিনি বললেন–নিতাই, অমিার মন অস্থির হয়েছে। অস্থিরতা দূর করতে চাই।

নিতাই কিছুই বলল না, তাকিয়ে রইল। জীবন বাবু বললেন, আমি এ জীবনে যত অর্থ উপার্জন করেছি তার সবটাই সৎ কাজে ব্যয় করতে চাই।

নিতাই শুকনো গলায় বলল, এটা তো খুবই উত্তম কথা।

উত্তম কথা না অধম কথা আমি জানি না। আমার মনের ইচ্ছা তোমাকে বললাম। সেই মত ব্যবস্থা কর।

ব্যবস্থা করছি। আপনি খাওয়া দাওয়া করে বিশ্রাম করুন।

আমার বিশ্রাম নিয়ে ব্যস্ত হয়ো না। তোমার যা করতে বলছি কর।

সময় সাপেক্ষ ব্যাপার, বললেই তো ব্যবস্থা হয় না। সৎ কাজে অর্থ কিভাবে খরচ করতে চান তাও জানা দরকার। কালি মন্দির বানাবেন? এই অঞ্চলে মন্দির নাই। আপনারা কালির উপাসক…..

মন্দির না। মানুষের সরাসরি কল্যাণ হয় এই ধরনের কোন ব্যবস্থা। রাস্তা ঘাট করতে পারো–ভূমিহীন চাষিদের জমিজমা দিতে পারো। স্কুল করতে পার।

স্কুল দিয়ে তো লাভ হবে না। ছাত্র কোথায়? স্কুল চলবে কিভাবে?

স্কুল হোক, তারপর দেখবে ছাত্র হবে।

জীবনকৃষ্ণ বাবু সৎ কাজে অর্থ ব্যয় শুরু করলেন। তার বিপুল বিত্ত অতি দ্রুত ফুরিয়ে আসতে লাগল। তার পরিবারের লোকজন শুরুতে ধারণা করেছিলেন–মাথায় গন্ডােগোল হয়েছে। ঝাড়-ফুক, গোপন তন্ত্র মন্ত্র সবই করানো হয়েছিল। তাঁর বড় ছেলে বাবার মাথা খারাপ হয়ে গেছে এই মর্মে কোর্টে আর্জিও জারি করিয়েছিল যাতে জীবনকৃষ্ণ বাবু সম্পত্তিতে হাত দিতে না পারেন। কোর্ট সেই আবেদন গ্রাহ্য করেনি। জীবনকৃষ্ণ বাবু দুবছরের মধ্যে নিঃস্ব হয়ে গেলেন। সেবার শীতের শুরুতে তিনি অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে গেলেন। ময়মনসিংহ থেকে বড় চিকিৎসক এনে চিকিৎসা করার সঙ্গতি তাঁর ছিল না। এক সময় রোগ গুরুতর আকার ধারণ করল। শ্বাস কষ্ট শুরু হল। মৃত্যু অশুচি। ঘরে মৃত্যু হলে ঘর অশুচি হবে, কাজেই তাকে ঘরের বাইরে নিয়ে যাওয়া হল। তিনি ক্ষীণ স্বরে তাঁর দীর্ঘদিনের সঙ্গী নিতাইকে বললেন–নিঃস্ব অবস্থায় পৃথিবীতে এসেছিলাম। নিঃস্ব অবস্থায় ফিরে যেতে চাই।

নিতাই বিষণ্ণ গলায় বলল, তাই তো যাচ্ছেন।

তিনি আঙুলের ইশারায় তার বসতবাটি দেখালেন। নিতাই ইঙ্গিত বুঝল। বিরক্ত গলায় বলল, আপনার পুত্র এবং পুত্রবধুদের প্রতি আপনার কিছু দায়িত্ব আছে। এরা থাকবে কোথায়?

জীবনকৃষ্ণ বাবুর পুত্রবধু সরজুবালা বললেন, সবই তো দানে চলে গেছে। সামান্য বসতবাটি দিয়ে কি হবে। বাবার ইচ্ছা পূর্ণ হোক। তাঁকে শান্তি মতো যেতে দিন।

বাড়ির উঠোনে খাটিয়াতে শুয়ে শুয়ে জীবনবাবু তার বসতবাটি মৌখিকভাবে দান করে গেলেন। তিনি নিঃস্ব হয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন, নিঃস্ব হয়েই পৃথিবী থেকে ফেরত গেলেন। এমন অসাধারণ ভাগ্য নিয়ে খুব কম মানুষই পৃথিবীতে আসেন।

 

জীবনকৃষ্ণু বাবুর চেহারা কেমন ছিল তার একটা নমুনা স্কুলের লাইব্রেরী ঘরে আছে। তিন ফুট বাই চার ফুটের বিশাল এক তৈলচিত্র লাইব্রেরীতে টানানো আছে। যেখানে খালি গায়ে খানিকটা কুঁজো হয়ে এক লোক জলচৌকিতে বসা। ছোট ছোট চোখ। কপালও ছোট। ছোট কপাল ও ছোট ছোট চোখের জন্যে তৈলচিত্রের মানুষটাকে ক্রুর ধরনের একজন বলে মনে হত। ঠোঁটের নিচে বিশাল গোঁফের কারণে সেই ক্রুরতার সঙ্গে মিশেছিল নিষ্ঠুরতা। ছবি দেখে লাঠিয়াল বাহিনীর নেতা ছাড়া ভাঁকে আর কিছু মনে করার কোন কারণ ছিল না।

একাত্তরে পাকিস্তানী মিলিটারী এসে ক্যাম্প করল জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুলে। বর্তমান মন্ত্রী সিরাজ সাহেবের বাবা মফিজ সাহেব তখন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান এবং স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর প্রধান।

মিলিটারী ক্যাপ্টেন এজাজ মফিজ সাহেবকে বিরক্ত হয়ে বলল, আপনার মত মানুষ থাকতে হিন্দুর নামে স্কুল, এ ৰ্মেন কথা?

মফিজ সাহেব হাত কচলে বললেন, স্যার, আপনি একটা নাম দিয়ে যান। সুন্দর একটা ইসলামী নাম।

ক্যাপ্টেন এজাজ বললেন, স্কুল কলেজ এইসবের নাম হবে বিশিষ্ট দেশপ্রেমী মানুষের নামে।

মফিজ সাহেব বললেন, অবশ্যই অবশ্যই।

স্কুলের নাম দিন কায়দে মিল্লাত লিয়াকত আলী খান স্কুল।

আলহামদুলিল্লাহ, বড় সুন্দর নাম। ময়মনসিংহ থেকে সাইন বোর্ড লিখায়ে এনে আপনার হাতে টানায়ে দিব।

নতুন সাইন বোর্ড টানানো হল–ক্যাপ্টেন এজাজ নিজের হাতেই নতুন সাইন বোর্ড টানতে গেলেন। ফজলুল করিম সাহেব তখন বললেন–স্যার, এইটা আপনি করতে পারেন না। জীবনকৃষ্ণ বাৰু এই অঞ্চলের অতি বিশিষ্ট একজন মানুষ। অতি শ্রদ্ধায় তার নাম স্মরণ করা হয়……

এজাজ বিস্মিত হয়ে বললেন, তুমি কে?

আমি এই স্কুলের একজন শিক্ষক।

তুমি বলতে চাও একজন হিন্দু এই অঞ্চলের একজন বিশিষ্ট মানুষ। সে কি কায়দে মিল্লাত লিয়াকত আলী খানের চেয়েও বড়?

স্যার, উনার নিজের জমিতে উনার টাকায় স্কুল হয়েছে।

প্রশ্নের জবাব দাও। উনি কি কায়দে মিল্লাতের চেয়েও বড়?

ফজলুল করিম সাহেব ইতস্তত করতে লাগলেন। ক্যাপ্টেন এজাজ বললেন, কায়দে মিল্লাত শব্দের অর্থ জানেন?

জ্বি স্যার জানি। সমস্যাটা হল–স্কুল বোর্ডের অনুমতি ছাড়া আপনি নাম পাল্টাতে পারেন না।

আচ্ছা, ঠিক আছে, স্কুল বোর্ডের সভা ডাকা হোক।

সেই দিন বিকেলেই স্কুল বোর্ডের সভা হল। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হল–স্কুলের নাম পাল্টানো হবে।

সভা শেষে ক্যাপ্টেন এজাজ হুকুম দিলেন ফজলুল করিম নামের শিক্ষককে নেংটা করে এই স্কুলের চারিদিকে যেন পঞ্চাশবার চক্কর দেয়া হয়।

মফিজ সাহেবের ক্ষীণ আপত্তি সত্ত্বেও মিলিটারী হুকুম যথাযথভাবে পালন করা হয়। ফজলুল করিম সাহেবের স্ত্রী তখন পাঁচ মাসের গর্ভবতী। খবর শুনে মাথা ঘুরে উঠোনে পড়ে যান। তাঁর মৃত্যু হয় পরদিন ভোরবেলা।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ