আসিফের সারাদিন কিছুই করার ছিল না। অনেক দিন পর দুপুরে টানা ঘুম দিল। ঘুম থেকে জেগে৷ উঠে মনে হল। লীনার সঙ্গে শেষবারের মত দেখা করে এলে কেমন হয়। এই চিন্তাও দীর্ঘস্থায়ী হল না। লীনার কাছে যাওয়া মানেই এমন অনেকের সঙ্গে দেখা হওয়া, যাদের সঙ্গে তার ভাল লাগে না। তারচে লীনা নেই, এই ধরনের বিরহ ভাল লাগছে।

বেনু যত্নের চূড়ান্ত করছে। দুপুরে সাত-আট পদের রান্না করেছে। এর মধ্যে জিরা-মাংসও ছিল। খেতে মোটেই ভাল হয়নি, তবু আসিফ যখন বলল, বাহ, এরকম কখনো খাইনি তো! এতেই বেনুর চোখে পানি এসে গেল। বড় ভাল লাগল আসিফের।

ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসবার আগেই বেনু এসে উপস্থিত। ট্রেতে করে চা-লুচি হালুয়া নিয়ে এসেছে। তার মুখ হাসি হাসি। তাকে দেখে কে বলবে এই মেয়ে সকালে কেঁদে কেটে কি কাণ্ড করেছে।

চায়ে চিনি মেশাতে মেশাতে বেনু বলল, এইবার আপনাদের নাটক দেখব ভাইজান।

অবশ্যই দেখবেন। আমি নিয়ে যাব।

আপনাকে কতবার বলছি ভাইজান, আমারে তুমি করে বলবেন। আপনারে আমি বড় ভাইয়ের মত দেখি।

আচ্ছা বলব। তোমাদের ঝগড়া মিটে গেছে?

বেনু জবাব দিল না। লজ্জিত মুখে হাসল।

লুচিটা গরম গরম ভাঁজছি ভাইজান। একটু খান।

পেটে একদম জায়গা নেই।

কিছু হবে না ভাইজান, খান। একটা খান। একটা লুচিতে কি হয়? কিছু হয় না। সন্ধ্যা মেলাবার পরপরই আসিফ রিহার্সেলে উপস্থিত হল। আজ একটা ফুল রিহার্সেল হবার কথা। কাটায় কাটায় সাতটায় রিহার্সেল শুরু হবে, এর রকম কথা।

আসিফ দেখল। সবাই প্রায় এসে গেছে। সবার মুখই বেশ গম্ভীর। বজলু বললেন, বিরাট প্রবলেম হয়েছে আসিফ।

কি প্রবলেম?

ঐ মেয়েকে নিয়ে প্রবলেম। পুষ্প।

কি প্রবলেম?

মেয়ে জানিয়েছে অভিনয় করবে না।

সে কি!

এইসব চেংড়ি-ফেংড়ি নিয়ে এখন তো দেখছি গভীর সমুদ্রে পড়লাম। কি করা যায় বল তো?

অভিনয় করবে না কেন?

তাও তো জানি না। মীনা ফিরে আসার পর আমি নিজেই গেলাম, বুঝলে–আমরা যেমন অবাক, ওদের বাসার লোকজনও অবাক। আমার প্রায় কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা, বুঝলে। আমার অবস্থা দেখে পুষ্পের বাবা নিজেই বললেন, শেষ সময়ে তুমি তাদের অসুবিধায় ফেলছি, এটা তো ঠিক না। অন্যায়। খুবই অন্যায়।

পুষ্প কি বলল?

কিছুই বলে না। মাথাটা বাঁকা করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বললেই বলে–না। আমার ইচ্ছা! করছিল চড় দিয়ে বাঁদীর নখরামী ঘুচিয়ে দিই।

বজলু রাগে চিড়বিড় করতে লাগলেন। থমথমে গলায় বললেন, তুমি একটু আমার সঙ্গে বারান্দায় আসতো। আড়ালে তোমার সঙ্গে দু’একটা কথা বলব।

আসিফ বারান্দায় গেল। বজলুসাহেব তিক্ত গলায় বললেন, তুমি একবার যাও। তুমি গেলে আসবে।

আমি গেলে আসবে কেন?

তুমি গেলে সে কেন আসবে সেটা তুমি নিজেও জানো, আমিও জানি। খামোখা কথা বাড়িয়ে লাভ আছে? তুমি তাকে নিয়ে আস–তারপর এই শোটাি পার হলে মেয়েটাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলেই হবে। এই যন্ত্রণাটা পার হোক। যাও, জলিলের গাড়ি আছে। গাড়ি নিয়ে যাও।

আজি থাক। আরেক দিন যাব।

আজই যাও। এটা ফেলে রাখার ব্যাপার না। তুমি এক্ষুণি যাও।

যাওয়াটা কী ঠিক হবে?

ঠিক হবে না বেঠিক হবে এটা নিয়ে পরে বিচার-বিবেচনা করা যাবে। তুমি কথা বাড়িও না, যাও।

 

পুষ্পের বাবা আসিফকে বললেন, আপনি বসুন, আমি দেখি মেয়েকে আনা যায় কি না। সে দরজা বন্ধ করে বসে আছে। মেয়েকে অভিনয় করতে পাঠিয়েও এক যন্ত্রণার মধ্যে পড়লাম।

আসিফ বলল, আমি খুব লজ্জিত, আপনাদের অসুবিধায় ফেলালম। অবস্থা এমন যে, পুষ্প না এলে আমাদের নাটক বন্ধ করে দিতে হবে। চালিয়ে নিতে পারে, এ রকম দ্বিতীয় কেউ নেই।

বসুন চা খান। দেখি কি করা যায়।

চিনি দিয়ে সরবত করে ফেলা এক কাপ ঠাণ্ডা। চা আসিফ শেষ করল। পুষ্পোপর দেখা নেই। এক সময় পুষ্পের বাবা এসে শুকনো গলায় বললেন; কিছু মনে করবেন না, মেয়ে দরজাই খুলছে না।

আসিফ খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, আমি কী একবার বলে দেখব? যদি আপনাদের আপত্তি না থাকে।

পুষ্পের বাবা বললেন, যান বলে দেখুন। রুমি, ওনাকে দোতলায় নিয়ে যা।

বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আসিফ বলল, পুষ্প, দরজা খোল।

পুষ্প সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে বলল, আপনি এসেছেন? আপনি নিজে এসেছেন? কি আশ্চর্য, আমাকে তো কেউ বলেনি। আপনি এসেছেন!

তুমি অভিনয় করবে না পুষ্প?

পুষ্প ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, আপনি যা করতে বলবেন, আমি তা-ই করব।

তাহলে মুখটা ধুয়ে নাও! চল আমার সঙ্গে।

গাড়িতে পুষ্প সারাক্ষণই কাঁদল। একবার শুধু ক্ষীণ স্বরে বলল, আমি কী আপনার একটু ধরব?

আসিফ বলল, অবশ্যই। কেন ধরবে না?

রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত রিহার্সেল হল। ফুল রিহার্সেল, প্রথম দৃশ্য থেকে শেষ দৃশ্য। বজলু সাহেব হৃষ্ট চিত্তে বললেন, জিনিস মনে হচ্ছে দাঁড়িয়ে গেছে। তোমাদের কি ধারণা?

প্রণব বাবু বললেন, শেষ দৃশ্য আমার কাছে একটু লাউড মনে হয়েছে।

লাউড তো বটেই। এটার প্রয়োজন আছে। আর কারো কোনো কথা আছে? থাকলে বল। ফ্রি ডিসকাশন হোক। আমার মন বলছে, একটা ভাল জিনিস দাঁড়া হয়েছে। তবে আমার ধারণা, থার্ড সিন স্নো হয়েছে।

থার্ড সিন তো স্নোই হবে। এতটা হবে না। ডেলিভারিতে এতটা সময় খাওয়ার কিছু নেই। একজন স্নো করবে, একজন করবে। ফাস্ট। দু’জনই স্লো করলে হবে না। ভেরিয়েশন দরকার।

আমার মতে থার্ড সিন ঠিকই আছে।

অন্য সবারও কি তাই মত? যদি তাই হয়, তাহলে দয়া করে এখনই বলেন। আমি কোনো রকম খুঁত রাখতে চাই না।

মজনু চা নিয়ে এল। চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বজলু সাহেব বললেন, জিনিস দাঁড়িয়েছে কেমন, বল তো মজনু।

মজনু দাঁত বের করে বলল, ফাটাফাটি জিনিস হইছে।

সত্যি বলছিস?

সত্যি না বললে আমি বাপের ঘরের না।

বজলুসাহেব আরামের একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। যেন মজনুর কথায় তিনি খুব ভরসা পেলেন।

 

আসিফের বাসায় ফিরতে রাত এগারটা বেজে গেল। দরজার বেল টিপতেই লীনা এসে দরজা খুলে দিল।

আসিফ হতভম্ব হয়ে বলল, কি ব্যাপার?

লীন হাসি মুখে বলল, কোনো ব্যাপার না। যেতে ইচ্ছা করল না।

যেতে ইচ্ছা করল না। মানে? ওরা চলে গেছেন?

হ্যাঁ। মা, দুলাভাই খুব রাগার।াগি করছিল।

যাওনি কেন?

ঘরে আস, তারপর বলি।

আসিফ ঘরে ঢুকল। তার বিস্ময় এখনো পুরোপুরি কাটেনি। লীনা বলল, আমাকে দেখে খুশি হয়েছ?

তুমি যাওনি কেন সেটা আগে শুনি।

এয়ারপোর্টে যাবার পর হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেল। মনে হল একা একা বাসায় ফিরবে। একা একা শুয়ে থাকোব। মনে হতেই চোখে পানি এসে গেল। তারপর চলে এলাম।

এইসব কি পাগলামী লীনা!

তুমি কী আমাকে দেখে খুশি হওনি?

হয়েছি।

কতটুকু খুশি হয়েছ?

অনেকখানি।

তাহলে তুমি এখনো আমাকে জড়িয়ে ধরছ না কেন?

আসিফ গভীর আবেগে তার স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরল।

লীনা গাঢ় স্বরে বলল, আজ সারাদিন আমার কি মনে হচ্ছিল জান? মনে হচ্ছিল তুমি আমাকে ভালবাস না। তোমার ভালবাসার মধ্যে অনেকখানি অভিনয় আছে।

এখনো কী সে রকম মনে হচ্ছে?

না।

সারারাত দু’জন জেগে রইল। কত অর্থহীন কথা, কত অর্থহীন হাসি। বারবার লীনার চোখে পানি আসছে, সেই পানি মুছে সে হাসছে।

আসিফ বলল, একটা গান কর না লীনা। লীনা শব্দ করে হাসল। হাসতে হাসতে বলল, আমার গান হয় নাকি?

এক সময় তো গুনগুন করতে। এখনো না হয় করে।

মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানো?

কি মনে হয়?

মনে হয় অভিনয় না করে গান করলে পারতাম। গানের দিকে আমার ঝোঁক ছিল। তোমার জন্যে অভিনয়ে চলে এলাম।

তোমার কি মনে হয় ভুল করেছ?

লীনা তার জবাব না দিয়ে বলল, সত্যি গান শুনতে চাও, গাইব?

গাও।

মাত্র চার লাইন কিন্তু।

গান চার লাইনেই ভাল।

লীন মৃদুস্বরে গাইল চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে। চার লাইন পর্যন্ত যেতেই পারল না। কেঁদো-কেটে অস্থির হল। আসিফ বলল, কাদছ কেন?

জানি না কেন? আমার প্রায়ই কাঁদতে ইচ্ছে করে। তোমার করে না?

আসিফ জবাব দেবার আগেই লীনা হঠাৎ করে বলল, আমি না যাওয়ায় তুমি খুশি হয়েছ তো?

একবার তো বললাম, খুশি হয়েছি।

আরেকবার বল।

খুশি হয়েছি। খুব খুশি হয়েছি।

না যাবার আরেকটা কারণও আছে। এটা তোমাকে বলিনি, কারণ তোমার মনটা খারাপ হবে।

মন খারাপ হবে না। তুমি বল।

এ মাসের সতের তারিখে আমাদের বড় মেয়ের মৃত্যুদিন। এই দিনে আমরা দু’জন দুজায়গায় থাকব তা কি করে হয়!

না, তা হয় না।

এ দিন আমার দু’জন হাত ধরাধরি করে সারাক্ষণ পাশাপাশি বসে থাকব।

লীনা চোখের পানি মুছে ক্ষীণ স্বরে বলল, আমার মাঝে মাঝে কী মনে হয় জানো? আমরা যদি আমাদের জীবনের সবচে প্ৰিয় জিনিস ছেড়ে দিই, তাহলে হয়ত আমাদের এবারের বাচ্চাটা বেঁচে যাবে। এক ধরনের সেক্রিাফাইস। আমার এই কথায় তুমি কি কিছু মনে করলে?

দীর্ঘ সময় চুপচাপ থেকে আসিফ বলল, না, কিছু মনে করিনি।

এটা একটা কথার কথা।

কথার কথা কেন হবে? তোমার মনের মধ্যে এটা আছে। অাছে না?। লীনা চুপ করে রইল।

আসিফ বলল, বড় তৃষ্ণা পেয়েছে। এক গ্লাস পানি খাওয়াবে?

লীনা বিছানা থেকে নেমে বাতি জ্বালাল। আর তখনি ওয়ারড্রোবের মাথায় রাখা ছবির ফ্রেম দু’টির দিকে আসিফের চোখ পড়ল। লোপা এবং ত্রিপার বাঁধান ছবি। ট্রাঙ্কে তালাবদ্ধ থাকে। কখনো বের করা হয় না। আজ বের করা হয়েছে।

লীনা ছবি দু’টির দিকে তাকিয়ে বলল, সতের তারিখের পর আবার লুকিয়ে ফেলব।

আসিফ বলল, লুকিয়ে ফেলার দরকার কি, থাকুক। তুমি যাও, পানি নিয়ে এস।

আসিফ তাকিয়ে রইল। ছবি দু’টির দিকে। আহ, কি সুন্দর দুই মা-মণি! একজন আবার রাগ করে ঠোঁট উল্টে আছে। অন্যজন কেমন চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছে। যেন পৃথিবীর রহস্য দেখে তার বিস্ময়ের সীমা নেই।

আসিফের বুক জ্বালা করতে লাগল। ছবি দু’টির দিকে তাকালেই তার অসহ্য কষ্ট হয়। সে ক্ষীণ স্বরে বলল, ত্রপা, ত্ৰিপা মামণি। কেমন আছ গো?

ত্রপা জবাব দিল না, জবাব দিল লীনা। সে স্নিগ্ধ গলায় বলল, পানি নাও।

আসিফ এক চুমুকে পানি শেষ করে সহজ গলায় বলল, আমি আর অভিনয় করব না। লীনা তোমাকে কথা দিচ্ছি। বাতি নিভিয়ে দাও, চোখে আলো লাগছে।

তুমি কি আমার ওপর রাগ করলে?

না লীনা। রাগ করিনি।

আমি একটা কথার কথা বললাম।

বাতি নিভিয়ে দাও লীনা। বাতি নিভিয়ে দাও।

নীলা বাতি নিভিয়ে দিল।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ