খুব ভোরে লীনার ঘুম ভাঙল। এই ভোরগুলিকেই বোধ হয় কাকভোর বলে। তারস্বরে কাক ডাকছে। ঘরের ভেতর আঁধার ও আলো। সেই আলো-অন্ধকারে মিশে পৃথিবীটাকে অন্যরকম করে রেখেছে। শহরের ভোরে পাখির ডাক শোনা যায় না। কর্কশ। কাক ডাকে। কাককে তো আর কেউ পাখি ভাবে না।

আসিফ পাশ ফিরে ঘুমুচ্ছে। একটা হাত মুখের উপর ফেলে রাখার মুখ দেখা যাচ্ছে না। লীনার একবার ইচ্ছা করল, আসিফকে ডেকে তোলে। এত আরাম করে সে ঘুমুচ্ছে যে ডাকতে ইচ্ছা করল না। লীনা দরজা খুলে বাইরে এল। রান্নাঘরে খুটাখুটি শব্দ হচ্ছে। বেনু তার বাচ্চার জন্যে দুধ গরম করছে। লীনা রান্নাঘরের ঢুকাল। চায়ের পানি চড়াবে। অনেক’দিন বেড-টি খাওয়া হয় না।

বেনু মুখ তুলে লীনাকে দেখল। কিছু বলল না। বেনুর মুখ অস্বাভাবিক গষ্ঠীর। লীনা বলল, বাচ্চা জেগে গেছে?

জি।

চা খাবে বেনু? আমি চা করছি।

চা খাব না। আজ আপনি চলে যাবেন, তাই না?

হ্যাঁ।

মন খারাপ লাগে?

একটু লাগে। তোমারও কী মন খারাপ? কেমন যেন লাগছে। ঝগড়া-টগড়া হয়েছে?

বেনু খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার মনটা খুব খারাপ। খুঁকির বাবা কাল রাতে আমাকে চড় দিয়েছে। নিজের বাবা-মা কোনোদিন আমার গায়ে হাত তুলে নাই। আর ও কি না…।

বেনুর বাচ্চা কাঁদছে। সে দুধ নিয়ে চলে গেল। লীনাকে সুন্দর ভোরবেলায় অসুন্দর একটি ছবির মুখোমুখি হতে হল। বেচারা বেনু। আজ সারাদিন খুব মন খারাপ করে থাকবে।

আগামীকাল বা পরশুও এরকম যাবে। তারপর আস্তে আস্তে সব ভুলে যাবে। স্বামীর সঙ্গে হাসবে, গল্প করবে। স্বামীর প্রয়োজনে লাজুক ভঙ্গিতে ব্লাউজের হুঁক খুলবে। তারপর আবার এক’দিন এ রকম একটা কাণ্ড ঘটবে। স্বামী চড় বসাবে কিংবা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে মেঝেতে।

লীনা দুকাপ চা বানিয়ে শোবার ঘরে ঢুকল। আসিফ একটা চাদর টেনে গলা পর্যন্ত ঢেকে নিয়েছে। বেচারার বোধ হয় শীত করছিল। ডেকে তুলে চা খেতে বলবে? না থাক, বেচারা ঘুমুক। যদিও ডেকে তুললেই ভাল হত। আজ লীনা চলে যাবে। যাবার দিনটায় যত বেশি পারা যায় গল্প করা উচিত।

লীনা আসিফের পাশে বসে চা খাচ্ছে। চা খেতে খেতে হঠাৎ তার মনে হল— তাদের দুজনের সম্পর্কে একটা অস্বাভাবিকতা আছে। আসিফ কখনো কোনো কারণেই তার সঙ্গে রাগ করেনি। চড়া গলায় কথা বলেনি। লীনা নিজে কোনো মহামানবী নয়। আসিফের রাগ করার মত এই দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে অনেক কিছুই সে করেছে। অথচ সে সব যেন আসিফকে স্পৰ্শই করেনি। এর কারণটা কী? এও কী এক ধরনের অভিনয় নয়?

একজন বড়ো মাপের অভিনেতা কি সব সময়ই অভিনয় করে না? একজন দক্ষ, শুধু দক্ষ নয়–অসাধারণ প্রতিভাবান অভিনেতা নিজেকে সব সময় দখলে রাখেন। সারাক্ষণ অভিনয় করে যান।

অভিনয় সব মানুষই করে। যে স্ত্রীকে অসহ্য বোধ হয়, তার সঙ্গেও সে হাসি মুখে কথা বলে। অভিনেতা সেই জিনিসটাকেই অনেক দূর পর্যন্ত নিয়ে যান।

লীনা অস্বস্তি বোধ করছে। আসিফ সম্পর্কে এ রকম ধারণা তার শুধু আজ না, অনেকবারই হয়েছে। বিয়ের দ্বিতীয় বছরে সন্দেহটা তার প্রথম হল। সে লক্ষ্য করল ভালবাসাবাসির সময় আসিফ একেক সময় একেক রকম আচরণ করে। যেন সে ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করছে। একজন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করতে পারে, কিন্তু তার মূল সুরটি কিছুতেই কাটবে না। মূল সুর অবশ্যই বজায় থাকবে। আসিফের বেলায় তা থাকে না। পুরো ব্যাপারটাই তার বেলায় বদলে যায়। অভিনয় ছাড়া এ জিনিস সম্ভব নয়।

লীনা চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে একটা হাত আসিফের গায়ে রাখল। মৃদু স্বরে ডাকল, এ্যাই।

আসিফ সঙ্গে সঙ্গে জেগে উঠল। লীনা বলল, হাত-মুখ ধুয়ে আস, চা গরম করে আনছি।

আরেকটু ঘুমুতে ইচ্ছা করছে যে।

তাহলে ঘুমাও।

লীনা আবার বারান্দায় চলে এল। যদিও সে জানে, আসিফ ঘুমুবে না, উঠে আসবে। সে ঠিক তাই করবে যা একজন আদর্শ স্বামীর করা উচিত। এর বাইরে সে একচুলও যাবে না।

আসিফ সত্যি সত্যি উঠে এল। বাথরুম থেকে হাত-মুখ ধুয়ে এসে পাশে দাঁড়াল। হাসিমুখে বলল, এ তো মনে হচ্ছে একেবারে প্রত্যুষ লগ্ন।

লীনা বলল, তুমি কি বেরুবে নাকি আজ?

হ্যাঁ।

কোথায় যাবে?

ব্রিটিশ কাউন্সিলে যাব। এগারটার সময় একটা ছোটখাটো ওয়ার্কশপের মত হবে। ব্রিটিশ একজন মহিলা নাটকের বিশেষজ্ঞ এসেছেন। নাটক নিয়ে কথা বলবেন, শুনে আসি। তুমি যাবে?

না।

তোমার প্লেন তো রাতে। চল না। যাই।

লীনা জবাব না দিয়ে চা আনতে গেল।

পাশের ঘরে উঁচু গলায় হাশমত আলি চিৎকার করছে, তুই পেয়েছিস কী? তুই ভাবস কী? তুই কী ইয়ার্কি করস? তুই আমারে চিনস না? .

গ্ৰাম্য ভাষা, কুৎসিত ভঙ্গির চেঁচামেচি। বেনুর গলা পাওয়া যাচ্ছে না। তবে সে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। লীনা লক্ষ্য করল, আসিফ খুব আগ্রহ নিয়ে ঝগড়ার কথাবার্তা শোনার চেষ্টা করছে। এই আগ্রহ অশোভন। অন্যদের কুৎসিত চেঁচামেচি সে এত আগ্রহ নিয়ে শুনবে কেন? লীনা রাগ করতে গিয়েও করতে পারল না। তার মনে হল–ঝগড়াটা আসিফের শোনা উচিত। একজন অভিনেতাকে চারপাশ থেকে শিখতে হবে। ক্যারেক্টর এ্যানালাইসিস করতে হবে। ঝগড়ার সময় কোন পর্দায় চেচাবে, কোন ভঙ্গিতে কথা বলবে, মুখের কোন মাংসপেশী ফুলে ফুলে উঠবে, ভ্রূ কোচকাবে কি কোচকাবে না, এসব লক্ষ্য না করতে পারলে বড় হবার পথ কোথায়?

লীনা চা এনে দিল। আসিফ চায়ে চুমুক দিয়ে একটা তৃপ্তির ভঙ্গি করল। লীনা বলল, হাশমত সাহেবের চোঁচামেচি শুনতে কেমন লাগছে?

ইন্টারেস্টিং! একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম।–ঝগড়ার সময় বা প্রচণ্ড রাগের সময় মানুষের গলায় কোনো রকম ভেরিয়েশন থাকে না। এক স্কেলে সে কথা বলে, এবং বলে অতি দ্রুত। আমার ধারণা, তার কথা বলার স্পিড তখন তিনগুণ বেড়ে যায়।

লীনা ক্লান্ত গলায় বলল, তুমি দয়া করে হাশমত সাহেবকে বল তো চুপ করার জন্যে। এই ভোরবেলায় উনি কি শুরু করেছেন? খুব খারাপ লাগছে।

আসিফ সঙ্গে সঙ্গে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে উঠে চলে গেল। ভারী এবং গম্ভীর গলায় ডাকল, হাশমত সাহেব, এই যে হাশমত সাহেব।

জি।

একটু বাইরে আসুন তো ভাই।

কেন?

আসুন। আমার সঙ্গে একটা সিগারেট খান।

হাশমত সাহেব বিরক্ত মুখে বের হয়ে এলেন, ঝাঁঝাল গলায় বললেন, অসহ্য, বুঝলেন ভাই। অসহ্য, কানের কাছে রাতদিন ঘ্যানঘ্যান, ঘ্যানঘ্যান। লাইফ হেল করে দিয়েছে।

তাই বুঝি?

আর বলেন কেন ভাই। আমার মাথায় রক্ত উঠে গেছে।

মাঝে মাঝে মাথায় রক্ত ওঠা ভাল। এত ব্রেইন পরিষ্কার থাকে। বলতে বলতে আসিফ হাশমিত সাহেবের কাধে হাত রেখে হাসল। লীনা দূর থেকে লক্ষ্য করল, এই হাসি শুধু হাসি নয়, এর মধ্যে অনেকখানি অভিনয় মিশে আছে। এই হাসি দিয়েই আসিফ অনেক কিছু বলতে চাচ্ছে। বুঝিয়ে দিচ্ছে সংসারে অবুঝ মেয়েরা থাকে। তারা অনেক অন্যায় করে। এইসব অন্যায় দেখতে হয় ক্ষমা ও প্রশ্রয়ের চোখে। সব কিছু ধরতে নেই।

নিন হাশমত সাহেব। একটি সিগারেট ধরান, তারপর এই চমৎকার সকালটা একটু দেখুন। আর ভাই সকাল। রাতে ঘুমাতে দেয় নাই। খালি ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ।

আসিফ আবার হাসল। নিজেই সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে বলল, আরেক কাপ চা খেতে ইচ্ছে করছে। ভাবীকে ডেকে বলুন তো, আমাদের দু’জনকে দুকাপ চা দিতে। এরকম ভোরবেলায় রাগারগি করা ঠিক হচ্ছে না। রাগারগিটা রাতের জন্য মুলতবি থাক। রাতে আবার নতুন উদ্যমে শুরু করবেন।

হাশমত আলি সত্যি সত্যি খুবই সহজ এবং স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, ও বেনু, দেখি আমাদের চা দাও তো। নোনতা বিসকিট কিছু আছে কিনা দেখ। আমার আবার খালি পেটে চা সহ্য হয় না।

বেনু চোখ মুছে চা বানাতে গেল।

আসিফ বলল, বুঝলেন হাশমত সাহেব, অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছি ভোর নিয়ে একটা কবিতা মনে করতে। মনে করতে পারছি না। বাঙালি কবিরা ভোর নিয়ে বেশি কবিতা লেখেননি বলে মনে হচ্ছে।

লিখবে কোথেকে বলেন? কয়টা কবি ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠে? এরা রাত দুটো-তিনটে পর্যন্ত জাগে, ওঠে সকাল দশটার পর।

আসিফ শব্দ করে হেসে উঠল।

হাসি ভয়াবহ সংক্রামক ব্যাধির চেয়েও সংক্রামক। হাশমত আলিও হাসতে শুরু করলেন। হাসতে হাসতে বললেন, ভোরের একটা কবিতা মনে পড়ছে রে ভাই–ভোর হল দোর খোল… হা হা হা।

বেনু চা নিয়ে এসেছে। হাশমত বলল, বেনু আসিফ ভাইকে বলেছ যে ক’দিন ভাবী থাকবে না। দুবেলা আমাদের সঙ্গে খাবে। না খেলে আমরা খুবই মাইন্ড করব। ভাল করে বলে त९3।

ভাইজান কি আমার কথা শুনব?

অফকোর্স শুনবে। আমরা থাকতে বাইরে খাবে, এটা কি কথা। ভাইসাবের উপলক্ষে ভালমন্দ কিছু খাব। বেনু, জিরা বাটা দিয়ে তুমি যে গোশত রাঁধ, এইটা রাঁধবে মনে করে।

আসিফের বড় ভাল লাগছে। কিছুক্ষণ আগে কি কুৎসিত চেঁচামেচি হচ্ছিল। এখন কি চমৎকার করেই না দু’জন কথা বলছে। এরা দু’জন ভোরের আনন্দ অনেক গুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।

 

লীনা কাপড় গোছাচ্ছে। ঠিক হয়েছে, আসিফ ব্রিটিশ কাউন্সিলে যাবার পথে লীনার মার বাড়িতে তাকে রেখে আসবে।

লীনা বলল, তুমি আবার এয়ারপোর্টে উপস্থিত হয়ে না।

কেন?

তুমি একা থাকবে, আমি চলে যাব–ভাবতেই খারাপ লাগছে। শেষে কেঁদে-টেনে ফেলব। দুলাভাই এটা নিয়ে সারাজীবন ঠাট্টা করবেন। কেউ তোমাকে নিয়ে ঠাট্টা করলে আমার ভাল লাগে না।

আসিফ বলল, তোমার প্লেন তো সেই রাতে। সারাদিন তোমার মার বাসায় কি করবে? তার চেয়ে চল, ঐ ব্রিটিশ মহিলা কি বলেন শুনি। অনেক শেখার ব্যাপার থাকতে পারে।

শেখার ব্যাপার থাকলে তুমি শেখ। আমার আর কিছু শিখতে ইচ্ছা করছে না।

আসিফ ইতস্তত করে বলল, তোমার সঙ্গে টাকা-পয়সা বিশেষ কিছু দিতে পারলাম না। কিছু মনে কর না লীনা। যা দরকার লাগে, তুমি তোমার দুলাভাইয়ের কাছ থেকে নিও, আমি পরে ব্যবস্থা করব।

লীনা বলল, সঙ্গে যা আছে, যথেষ্টই আছে। ঐ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তোমার জন্যে কি আনব বল।

একটা কাজ করা পাঞ্জাবি আর জয়পুরী স্যান্ডেল।

আর কিছু?

আর কিছু না।

নাটকের ওপর বইপত্র যদি কিছু পাই, আনব না?

অবশ্যই আনবে।

লীনা অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসতে লাগল। আসিফ বলল, হাসছ কেন?

এমনি হাসছি। এটা যদি অভিনয়ের দৃশ্য হত, তাহলে বোধহয় হাসাটা ঠিক হত না। তাই না?

কি বলছ তুমি বুঝতে পারছি না।

আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। আজ ভোর থেকে মাথার মধ্যে শুধু আবোল-তবোেল চিন্তা ঢুকছে। দেশের বাইরে যাচ্ছি, সে জন্যেই বোধ হয়। দেশের বাইরে তো কখনো যাইনি।

তোমার শরীর ঠিক আছে তো?

শরীর ঠিক আছে?

তুমি কেন জানি আজ অতিরিক্ত রকমের গম্ভীর হয়ে আছে। কী ব্যাপার লীনা?

লীনা বলল, একটু অপেক্ষা কর। ব্যাগটা গুছিয়ে নিই, তারপর হাসি মুখে তোমার সঙ্গে গল্প করব। তুমি চাইলে জানালা বন্ধ করে, দরজার পর্দা ফেলে ঘর একটু আঁধার করে নেব। তারপর দুজনে মুখোমুখি, গভীর দুঃখে দুঃখি, আঁধারে ঢাকিয়া গেছে আর সব।

আসিফ তাকিয়ে আছে। লীনা হাসছে তরল ভঙ্গিতে।

 

ব্রিটিশ মহিলার বক্তৃতা আসিফের মোটেই ভাল লাগল না। প্রথমত কথা বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে প্রতিটি শব্দ তিনি খানিকক্ষণ চিবিয়ে ছোবড়া বানিয়ে বলছেন। যা বলছেন, তার সঙ্গে অভিনয়ের যোগ তেমন নেই বলেই আসিফের ধারণা। ভদ্রমহিলা বলছেন সেন্টজের ব্যাকগ্রাউন্ডের আলো এবং ব্যাকগ্রাউন্ডে মিউজিকের সমন্বয় বিষয়ে। সবটাই মনে হচ্ছে কচকচানি থিওরি। সিমিট্রি রেখে কি করে সিমিট্রি ভাঙতে হবে, এই সব বিষয়। ডায়নামিক ড্রামা এবং স্ট্যাটিক ড্রামার সঙ্গে আলো এবং শব্দের সম্পর্ক। এক পর্যায়ে ভদ্রমহিলা ব্ল্যাকবোর্ডে হাবিজাবি ইকোয়েশন লিখতে শুরু করলেন।

আসিফের পাশে লিটল ঢাকা গ্রুপের মন্তাজ, সাহেব বসেছিলেন। তিনি নিতান্ত বিরক্ত হয়ে এক পর্যায়ে বললেন, এই হারামজাদী তো মনে হচ্ছে বিরাট ফাজিল। এ তো দেখি অংক করছে!

আসিফের কাছেও সমস্ত ব্যাপারটা বোগাস বলেই মনে হচ্ছে। উঠে চলে যেতে ইচ্ছা করছে। সে বসেছে মাঝামাঝি জায়গায়, এখান থেকে চলে যাওয়া মুশকিল। একজন উঠে দাঁড়িয়েছিল, ভদ্রমহিলা তার দিকে তাকিয়ে খড়খড়ে গলায় বললেন, আমি কী আমার কথায় আপনাকে আকৃষ্ট করতে পারছি না? কথায় না পারলেও রূপে তো আপনাকে আটকে ফেলার কথা। আমি কি যথেষ্ট রূপবতী নই?

চারদিকে তুমুল হাসির মধ্যে ভদ্রলোককে মুখ কাচুমাচু করে বসে পড়তে হল। এ রকম অবস্থায় হলঘর ছেড়ে উঠে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ভদ্রমহিলার বক্তৃতার প্রথম পর্ব শেষ হল এক ঘণ্টা পর। আসিফের কাছে মনে হল, সে অনন্তকাল ধরে এই চেয়ারে বসে আছে। বক্তৃতার দ্বিতীয় পৰ্ব শোনার মত মনের জোর পাচ্ছে না।

কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, দ্বিতীয় পর্ব হল অসাধারণ। ভদ্রমহিলা কিছু ছবি বানিয়ে নিয়ে এসেছেন। অভিনয় অংশ প্রতিটিতেই এক। হুঁবহু এক, কিন্তু আলো এবং শব্দের মিশ্রণ একেকটা একেক রকম। শুধু এই কারণে কেমন বদলে যাচ্ছে–অর্থ অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। এই ব্যাপারটা ছবি দেখাতে দেখাতে ভদ্রমহিলা ব্যাখ্যা করছেন।

দেখুন, নাটক শুরু হয় গীর্জায়। ধর্মযাজকরা গীর্জায় নাটকের মাধ্যমে লোকদের ধর্ম শিক্ষা দিতেন। তার মানে এই নয় যে, নাটক ব্যাপারটায় ঐশ্বরিক কিছু আছে। কিছুই নেই। নাটকের মাধ্যমে আমরা মানুষের মনে আবেগ তৈরি করি। নাটকের গবেষকরা এখন কাজ করছেন আবেগ তৈরির মেকানিজম নিয়ে। নাটক তার রহস্যময়ত হারাতে বসেছে। এখন আমরা আবেগের ব্যাপারটা বিজ্ঞানের চোখে দেখতে শুরু করেছি। বিজ্ঞানের কাছে হৃদয় কিন্তু একটা রক্ত পাম্প করার যন্ত্র ছাড়া কিছুই নয়।

আসিফ মুগ্ধ হয়ে গেল। বারবার মনে হল, লীনা পাশে থাকলে চমৎকার হত। একটা চমৎকার জিনিস বেচারি মিস করল। আসিফের খুব ইচ্ছা করছিল ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করে … আধুনিক কালের নাটকে কী অভিনেতা-অভিনেত্রীর গুরুত্ব কমে আসবে?

গুছিয়ে ইংরেজিটা তৈরি করতে পারল না বলে জিজ্ঞেস করতে পারল না। লিটল ঢাকার মন্তাজ সাহেব বলতে বাধ্য হলেন, শালী জানে ভালই! শেষ দৃশ্যে এসে শালী জমিয়ে দিয়েছে। কি বলেন আসিফ সাহেব?

আসিফ কিছু বলল না। তার মনে এক ধরনের মুগ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। কথা বলে এই মুগ্ধতা সে নষ্ট করতে চায় না।

সারাদিনেও তার মুগ্ধতা কাটল না। কানে বাজতে লাগল রূপবতী মহিলার চমৎকার ব্যাখ্যা। একের পর এক যুক্তির ইট বিছিয়ে বিশাল ইমারত তৈরি করা।

অবশ্যি মাঝে মাঝে এইসব যুক্তিতে ভুল-থাকে। ভুল যুক্তির ইটে বিশাল ইমরাতও তৈরি হয়। এক সময় সেই ভুল ধরা পড়ে। সুবিশাল প্রাসাদ মুহূর্তে ধসে যায়।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ