লীনা যে স্কুলে পড়ায় তার নাম–লিটল ফ্লাওয়ার্স। ইংরেজি স্কুল। খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি। নানান কায়দা কানুন। সপ্তাহে সপ্তাহে পরীক্ষা। মাসে একবার আউটিং।

আজ সেই আউটিংয়ের দিন। লীনাকে ক্লাস ওয়ানের ছেলেমেয়েদের নিয়ে যেতে হবে সাভার স্মৃতিসৌধে। একটা মাইক্রোবাস জোগাড় করা হয়েছে। লীনার সঙ্গে যাচ্ছে অতসী দি। গেম টিচার। মাইক্রোবাসে ওঠবার ঠিক আগ মুহূর্তে লীনা অতসীকে বলল, আমার না শরীরটা খুব খারাপ লাগছে অতসী দি।

অতসী বলল, যেতে চাও না?

না। শরীরটা খুবই খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে ফেইন্ট হয়ে যাব।

অতসী বলল, তুমি কি কনসিভ করেছ নাকি?

লীনা জবাব দিল না। এসব নিয়ে কথা বলতে ভাল লাগে না। অথচ বিবাহিত মেয়েরা কত স্বাভাবিক ভাবেই না। এসব নিয়ে আলাপ করে। লীনার মাঝে মাঝে মনে হয়–তার মধ্যে কিছুটা অস্বাভাবিকা আছে।

তুমি এখন না গেলে বড়। আপা খুব রাগ করবেন।

শরীরটা খুব খারাপ লাগছে অতসী দি।

তোমাকে দেখেই বুঝতে পারছি। দাঁড়াও, আপার সঙ্গে আলাপ করে আসি। লীনা ছায়ায দাঁড়িয়ে রইল। বাচ্চাগুলি মাইক্রোবাসে উঠে বসে আছে। কোনো সাড়াশব্দ করছে না, যেন একদল রোবট। ট্রেনিং দিয়ে দিয়ে এদের রোবট বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। হুঁকুম ছাড়া এরা মুখ খুলবে না। এর কোনো মানে হয়। শিশুরা থাকবে শিশুদের মত। হৈচৈ করবে, মারামারি করবে, কাদবে, হাসবে। অতসী ফিরে এসে বলল, ব্যাপার সুবিধার না লীনা। বড় আপা খুব রেগে গেছে। তুমি যাও শুনে আস।

প্রিন্সিপ্যাল জোবেদা আমিন সত্যি সত্যি রেগেছেন। লীনাকে ঢুকতে দেখে তিনি শুকনো গলায় বললেন, বোস। বলেই টেলিফোন নিয়ে বাস্ত হয়ে পড়লেন।

হ্যালো, প্রিন্সিপ্যাল জোবেদা আমিন বলছি…

এইসব কেজি স্কুলগুলির প্রধানরা বিচিত্র কারণে প্রিন্সিপ্যাল পদবি নেন। কেজি স্কুলগুলিতে কোনো হেড মিসট্রেস নেই। সব প্রিন্সিপ্যাল। এরা কথাবার্তায় সত্ত্বর ভাগ ইংরেজি বলেন। অদ্ভুত ধরনের ইংরেজি।

লীনা।

জি আপা।

আপনি এসব কি শুরু করেছেন বলুন তো?

তেমন কিছু তো শুরু করিনি। আপা। শরীরটা ভাল না, এটাই বলছি।

একটা এ্যারেঞ্জমেন্ট সম্পূর্ণ হবার পর আপনারা বলবেন শরীর খারাপ, তাহলে কি করে হবে বলুন? আৰু এই শরীর খারাপ ব্যাপারটাও তো নতুন না। দু’দিন পর পর শুনছি শরীর খারাপ। এ ভাবে তো আপনি মাস্টারি করতে পারবেন না। আপনি বরং অন্য কোনো প্রফেসন খুঁজে বের করুন যেখানে তেমন কাজকর্ম নেই।

লীলা উঠে দাঁড়াল।

জোবেদা আমিন ঝাঁঝালো গলায় বললেন, যাচ্ছেন কোথায?

বাসায় জলে যাব। শরীরটা ভাল লাগছে না।

জোবেদা আমিন কঠিন চোখে তাকিয়ে আছেন। লীনার খুব ইচ্ছা করছে বলে, আপনি কি আপা কখনো লক্ষ্য করেছেন যে আপনার গোঁফ আছে? গায়ের রঙ কালো বলে তেমন বোঝা যাচ্ছে না।  ফর্সা হলে রোজ-শেভ করতে হত।

কথাটা বলা হল না। লীনা বাসায় চলে এল। বাসায় এসেই শারীর খারাপ ভাবটা কেন জানি কেটে গেল। সে রেণুর সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্প করল। খুকিকে গামলায় পানি নিয়ে গোসল করিয়ে দিল।

দুপুরে দরজা জানালা বন্ধ করে খানিকক্ষণ ঘুমুল। ঘুম ভাঙার পর মনে হল আসিফ থাকলে বেশ হত। দু’জন বিকেলে কোথাও বেড়াতে যাওয়া যেত। মীরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন কিংবা বলধা গার্ডেন।

আসিফকে আজকাল কাছেই পাওয়া যায় না। বেচার চাকরির জন্যে ব্যস্ত হয়ে সারাদিন ঘোরে। কোথায় কোথায় ঘোরে, কার কাছে যায় কে জানে!

আজ অবশ্যি আসিফ চাকরির সন্ধ্যানে ঘুরছিল না। সে চুপচাপ টেলিভিশন রিহার্সেল রুমে বসেছিল। শেষ পর্যন্ত ঋণপ্রার্থী লোকটির ক্ষুদ্র ভূমিকা নিতে সে রাজি হয়েছে। কৌতূহল থেকেই রাজি হয়েছে। দেখাই যাক না টিভি অভিনয় ব্যাপারটা কি? টেলিভিশন এখন অতি শক্তিশালী একটি মাধ্যম। একে উপেক্ষা করার প্রশ্নই ওঠে না।

অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সবাই এসে গেছেন। আসিফ এদের কাউকে চিনতে পারছে না। তার ঘরে টিভি নেই। টিভি তারকারী তার কাছে অপরিচিত।

প্রযোজক এলেন পাঁচটার দিকে। মধ্যবয়স্ক একজন ভদ্রলোক। হাসি-খুশি ধরনের মানুষ। ঘরে ঢুকেই কি একটা রসিকতা করলেন। কেউ হাসল না। আসিফ কি করবে বুঝতে পারল না। এই ভদ্রলোক এখন মনে হচ্ছে তাকে চিনতে পারছেন না। একবার চোখে চোখ পড়ল, তিনি চোখ সরিয়ে নিলেন।

সবাইকে স্ক্রিপ্ট দিয়ে দেয়া হয়েছে। আসিফ কোনো স্ক্রিপ্ট পেল না। ছোট রোলের আর্টিস্টদের হয়ত স্ক্রিপ্টট দেয়া হয় না। কিন্তু সংলাপগুলি তো জানতে হবে।

আসিফ উঠে দাঁড়াল; বেশ খানিকটা দ্বিধা নিয়ে এগিয়ে গেল প্রযোজকের দিকে। প্রযোজক তাকে এইবার মনে হল চিনতে পারলেন। হাসি মুখে বললেন, ভেরি সরি ভাই, একটা সমস্যা হয়েছে।

আসিফ বলল, কি সমস্যা?

লাস্ট মোমেন্টে নাটকে কিছু কাট-ছাট করা হয়েছে। ষাট মিনিটের বেশি হয়ে যাচ্ছিল, কাজেই বাধ্য হয়ে… আপনি ভাই কিছু মনে করবেন না। নেক্সট নাটকে দেখব। আপনাকে একটা রোল দেয়া যায় কি না।

আসিফের কান ঝাঁ ঝা করছে। সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে। সবার চোখে মুখে সহানুভূতির ছায়া। আসিফ বলল, আমি তাহলে যাই?

প্রযোজক বললেন, বসুন না, চা খেয়ে যান। একটা রিডিং হবার পরই চা আসবে।

আসিফ নিজের জায়গায় এসে বসল। এরকম একটা পরিস্থিতিতে চট করে চলে যাওয়া যেমন মুশকিল, আবার বসে থাকাও মুশকিল।

রিহার্সেল শুরু হয়েছে। রিহার্সেলের ধরনটা অদ্ভুত। সবাই নিজের নিজের জায়গায় বসে রিডিং পড়ে যাচ্ছে। একেক জনের পড়া হয়ে যাওয়া মাত্র সে পাশের জনের সঙ্গে গল্প করছে। মনে হচ্ছে পুরো নাটকটিার ব্যাপারে কারো কোনো আগ্রহ নেই। নিজের অংশটা হয়ে গেলেই যেন দায়িত্ব শেষ।

একজন অভিনেতা পড়ার মাঝখানেই উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি তো ভাই আর থাকতে পারছি না। জরুরি এ্যাপিয়েন্টমেন্ট। প্রযোজক তাকে রাখতে চেষ্টা করছেন। তিনি রাজি হচ্ছেন না। আসিফ মনে মনে ভাবল অতটা অনাগ্রহ নিয়ে এরা নাটক কেন করে? তার মনটাই খারাপ হয়ে গেল।

 

বজলু ভাই রাগী গলায় বললেন, এসব তুমি কি বলছি লীনা আসবে না মানে? এর মানেটা কি?

আসিফ বলল, লীনার শরীরটা ভাল না। ক’দিন ধরেই শরীর খারাপ যাচ্ছে।

কালই তো দেখলাম ভাল।

বাইরে থেকে ভাল মনে হয়েছে। আসলে ভাল না।

সবাই যদি এ রকম অসুখ-বিসুখ বাঁধিয়ে বসে থাকে তাহলে নাটক চলবে কিভাবে? নাটকফাটক বন্ধ করে চল বাসায় চলে যাই।

প্রক্সি দিয়ে কোনো মতে চালিয়ে নিন।

প্রক্সি দিয়ে এইসব হয়? প্রত্যেকের তার নিজের রোল আছে, প্রক্সিটা দেবে কে? মুভমেন্ট সিনক্রোনাইজ করতে হবে না?

বজলু ভাই, আপনার সঙ্গে একটু আড়ালে কথা বলা দরকার। আসুন বাইরে যাই।

আমার সঙ্গে আবার আড়ালে কথা কি? ফিসফিসানি, গুজগুজানি এর মধ্যে আমি নেই। চল কোথায় যাবে।

দু’জন রাস্তায় চলে এল। বজলু সিগারেট ধরালেন। তার প্রেসার আছে। অল্পতেই প্রেসার বেড়ে যায়। সামান্যতম টেনশন সহ্য করতে পারেন না। এখন তার টেনশান খুব বেড়েছে। আসিফ কি বলবে কে জানে।

একটা সমস্যা হয়েছে বজলু ভাই।

কি সমস্যা?

লীন অভিনয় করতে পারবে বলে মনে হয় না।

কি বলছ তুমি এসব!

ওর শরীরটা খারাপ।

শরীর খারাপ, শরীর ঠিক হবে। চিরজীবন কারোর শরীর খারাপ থাকে? আজ রাতটা রেস্ট নিক। দরকার হলে আগামীকালও রেস্ট নেবে। আজ রিহার্সেলের পর আমি তোমার সঙ্গে গিয়ে দেখে আসব।

ওর বাচ্চা হবে বজলু ভাই। আপনি তো ওর অবস্থাটা জানেন। এর আগে দুটো বাচ্চা মারা গেছে। জন্মের কিছু দিনের মধ্যেই বাচ্চাগুলি মরে মায়। ডাক্তাররা বলছে– পুরো রেস্টে থাকতে।

তুমি তো ভয়াবহ খবর দিলে আসিফ। আমার তো মনে হচ্ছে হার্ট এ্যাটাক হয়ে যাচ্ছে। শো পিছিয়ে দিতে হবে। এ তো মাথায় বাড়ি।

শো পেছানোর দরকার নেই। অন্য কাউকে এই রোলটা দিন। এটা তো খুব কমপ্লিকেটেড রোল নয়। যে কেউ পারবে।

এটা কি সাপ-লুডু খেলা যে, যে কেউ পারবে। ফালতু কথা আমার সঙ্গে বলবে না তো। যে কেউ পারবে। যে কেউ পারলে তো কাজই হত।

ঐ দিন যে মেয়েটি এসেছিল–পুষ্প, ও পারবে, ওকে…

মাথাটা তোমার কি খারাপ হয়ে গেল নাকি? অভিনয়ের অ জানে না যে মেয়ে, গলা দিয়ে স্বর বের হয় না…।

আমি ওকে শিখিয়ে পড়িয়ে ঠিক ঠাক করে দিতে পারব।

আমার কাছ থেকে একটা জিনিস শিখে রাখা ছবি আঁকা, গান গাওয়া আর অভিনয়, এই তিন জিনিস শেখানো যায় না–ভেতরে থাকতে হয়।

ঐ মেয়ের মধ্যে অভিনয় আছে। খুব সহজে মেয়েটা ইনভল্যুভড হতে পারে। অভিনয় দেখতে দেখতে মেয়েটা কাঁদছিল।

অভিনয় দেখেই যে কেঁদে ফেলে, সে আবার অভিনয় করবে কি?

কে অভিনয় পারবে, কে পারবে না, এটা আমি বুঝি বজলু ভাই। লীনাকে আমি অভিনয়ে নিয়ে এসেছিলাম। লীনা কিন্তু আগে কোনোদিন করেনি।

মেয়েটা রাজি হবে কি না কে জানে। যেতে বলছ?

হ্যাঁ বলছি।

এখনই চলে যাই মীনাকে সাথে নিয়ে যাই। ও-ই প্রথম দিন মেয়েটিকে এনেছিল। তুমি বরং থার্ড সিন শুরু করে দাও।

বজলু আরেকটা সিগারেট ধরালেন। তার টেনশান যেমন দ্রুত আসে তেমনি দ্রুতই চলে যায। এখন টেনশান একেবারেই নেই।

আসিফ, শো কি সময় মত যাবে?

অবশ্যই যাবে।

টেনশান ফিল করছি।

টেনশনের কিছু নেই।

জাতীয় উৎসব, বড় বড় দল আসবে। কলকাতা থেকেও নাকি দু’টি টিম আসছে।

আসুক না।

তোমাকে সত্যি কথা বলি আসিফ, নাটককটা আমার কাছে বেশি সুবিধার মনে হচ্ছে না। কোনো কনফ্রিকট নেই। রিলিফ নেই। ক্লাইমেক্স নেই।

জিনিস কিন্তু ভাল।

ভালর তুমি কি দেখলে?

প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত স্বপ্ন স্বপ্ন ব্যাপার আছে। কঠিন কিছু কথা খুব নরম করে বলা।

নরম করে বললে এই দেশে কিছু হয় না। শক্ত করে বলতে হয়। পাছায় লাথি দিতে হয়।

সবাই তো পাছায় লাথি দেয়া নাটক নিয়ে যাবে। আমরা না হয় একটা নরম নাটক নিয়ে যাই। নরম হলেও এটা খুব নামকরা নাটক বজলু ভাই। কবি এমিলি জোহানের কাব্যনাটক। বাংলায় ভাবানুবাদ করা। সত্যি করে বলুন তো আপনার ভাল লাগে না?

আর আমার ভাল লাগা। তোমাকে আরেকটা সত্যি কথা বলি আসিফ, আজ পর্যন্ত কাউৰে বলিনি। তোমাকে বলছি নাটক ভাল না মন্দ এটা আমি বুঝি না। আমি শুধু বুঝি–অভিনয় ঠিকমত হচ্ছে কি না।

আপনি সবই বোঝেন। শুধু বোঝেন বললে কম বলা হবে, খুব ভালই বোঝেন। দেখুন বজলু ভাই, আমি মানুষটা খুব অহংকারী, আমি অভিনয় ভাল করি। নিজে সেটা জানি–অভিনয়ের ব্যাপারে। আমি কারোর কোনো উপদেশ শুনি না, কিন্তু আপনার কথা আমি শুনি। বজলু ভাই, দেরি হয়ে যাচ্ছে, আপনি চলে যান।

রিহার্সেল শুরু হতে খানিকটা দেরি হল। প্রণব বাবুর বড় মেয়ে বৃত্তি পেয়েছে সেই উপলক্ষে তিনি প্রচুর খাবার দাবার এনেছেন। হৈ হৈ করে খাওয়াদাওয়া হচ্ছে। গ্রুপের মেয়েরা কেউ নেই সবাই বজলু সাহেবের সঙ্গে পুষ্প মেয়েটির কাছে গেছে। এই সুযোগে জলিল সাহেব আদিরসের দুটো গল্প বলে ফেললেন। দুটোর মধ্যে একটা হিট করল। কারোর হাসি আর থামতেই চাচ্ছে না। এই দলটিকে দেখলে কে বলবে এদের জীবনে কোনো দুঃখ কষ্ট আছে? এদের দেখে মনে হচ্ছে গভীর আনন্দে এদের হৃদয় পরিপূর্ণ। রিহার্সেলের ঘরে এরা যখন ঢোকে জীবনের সমস্ত হতাশা ও বঞ্চনা পেছনে ফেলে ঢোকে। নাটক তাদের দ্বিতীয় জীবন। এই জীবনটাই তারা আঁকড়ে ধরে। দ্বিতীয় জীবনই এক এক সময় প্রধান হয়ে দাঁড়ায়।

 

তৃতীয় দৃশ্য শুরু হল। এটিও রাতের দৃশ্য। লেখক শোবার ঘরে। বিছানায় বসে আছেন। পাশেই তাঁর স্ত্রী কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। লেখক লিখে যাচ্ছেন। হঠাৎ একটা শব্দ হল। লেখক চমকে তাকালেন ঘরের মধ্যে কে যেন দাঁড়িয়ে। যে দাঁড়িয়ে, তার চোহোরা ভাল না। সে কঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোখের দৃষ্টি নিম্প্রভ। তার নাম ছলিমুদ্দিন। ছলিমুদিনের ভূমিকায় অভিনয় করছেন প্রণব বাবু।

লেখক অবাক হয়ে ছলিমুদ্দিনকে দেখছেন। চিনতে পারছেন না। এই গভীর রাতে শোবার ঘরে লোকটা কোথেকে এল বুঝতে পারছেন না। তিনি খানিকটা ভীত।

লেখক : কে কে কে?

ছলিমুদিন : আস্তে। চেঁচাবেন না। আপনার স্ত্রী জেগে উঠতে পারেন।

লেখক : কে কে? আপনি কে?

ছলিমুদিন : চিনতে পারছেন না? কি অদ্ভুত কথা। নিজের সৃষ্টি করা চরিত্র নিজেই চিনতে পারছেন না। ভাল করে তাকিয়ে দেখুন, জীবন যুদ্ধে পরাজিত, ক্লান্ত শ্ৰান্ত একজন মানুষ, আজ সারাদিন যার খাওয়া হয়নি। যার প্রেমিকা অন্য এক পুরুষের হাত ধরে…

লেখক : ও আচ্ছা, আপনি ছলিমুদ্দিন।

ছলিমুদিন : হ্যাঁ ছলিমুদ্দিন। আপনি আমার জন্যে একটা ভাল নাম পর্যন্ত খুঁজে পাননি। নাম দিয়েছেন ছলিমুদ্দিন। সুন্দর, শোভন, আনন্দদায়ক কিছুই আপনি আমার জন্যে রাখেননি। একটি ভাল নাম কি আমার হতে পারত না?

লেখক : না, পারত না। আপনার জন্ম হয়েছে কৃষক পরিবারে। আপনার বাবা একজন বর্গাদার। সে তার পুত্রদের এ রকম নামই রাখবে। একজন কৃষক তার পুত্রের নাম নিশ্চয়ই আবরার চৌধুরী রাখবে না।

ছলিমুদিন : আপনি ইচ্ছা করলে সবই সম্ভব। কলম আপনার হাতে। আপনি ইচ্ছা করলেই কোর্টে এফিডেভিট করে আমি আমার নাম পাল্টে আবরার চৌধুরী করতে পারি। আপনি ইচ্ছা! করলেই বিদেশী কোনো কোম্পানিতে আমার চমৎকার একটা চাকরি হতে পারে। ছলিমুদ্দিন নামটা যদি আপনার এতই প্রিয় হয়, বেশ তো আপনার ড্রাইভারের ঐ নাম দিয়ে দিন।

লেখক : তা সম্ভব নয়।

ছলিমুদ্দিন; কেন সম্ভব নয়? একের পর এক আপনার কারণে আমি জীবন যুদ্ধে পরাজিত হচ্ছি। কেন আপনি এ রকম করছেন?

লেখক : এ রকম করছি কারণ, তোমার মাধ্যমে আমি সমাজকে তুলে আনছি। তুমি আলাদা কেউ নও। তুমি এই সমাজেরই একজন প্রতিনিধি। তোমাকে দেখে পাঠক চমকে উঠবে। ঘা খাবে।

ছলিমুদিন : আপনি আমাকে তুমি করে বলছেন কেন? নিজের লেখা পড়ে দেখুন, বয়সে আমি আপনার চেয়ে বড়। এ জীবনে তো আপনি আমাকে কিছুই দেননি। সামান্য সম্মানটুকু অন্তত দিন।

লেখক : আমার ভুল হয়েছে। ক্ষমা করবেন। এখন থেকে আপনি করে বলব।

ছলিমুদিন : ধন্যবাদ, আপনাকে যতটা হৃদয়হীন মনে করেছিলাম তত হৃদয়হীন আপনি নন। এটাই যখন করলেন তখন আরেকটু করুন। আমার প্রেমিকাকে আপনি ফিরিয়ে দিন। অর্থ বিত্ত, কিছুই চাই না। আমি পথে পথে না খেয়ে ঘুরতে রাজি আছি। আপনি শুধু আমার প্রেমিকাকে ফেরত দিন।

লেখক : তা হয় না।

ছলিমুদিন : অবশ্যই হয়। আপনি নিজে তো আপনার স্ত্রীকে পাশে নিয়ে আরাম করে বসে আছেন। আমি কেন বসব না? সমাজ দোষ করতে পারে, রাষ্ট্র দোষ করতে পারে–আমি তো কোনো দোষ করিনি। আমি কেন শাস্তি পাব?

লেখক : এই পচা সমাজে নির্দোষ যারা, তারাই শাস্তি পায়।

ছলিমুদিন : সমাজ করুক। আপনি কেন করবেন? আপনি মানবপ্রেমিক একজন লেখক। আপনি আমার প্রতি করুণা করুন। আপনি শেষের কুড়িটা পাতা ছিঁড়ে ফেলুন। আবার নতুন করে লিখুন। এর মধ্যে আমি আপনার জন্যে চা বানিয়ে নিয়ে আসছি।

লেখক : আপনাকে হাত জোড় করে অনুরোধ করছি, আপনি এ ঘর থেকে যান।

ছলিমুদিন : না, আমি যাব না।

লেখক : যাবেন না মানে?

ছলিমুদিন; মানে হচ্ছে, যাব না। প্রয়োজন হলে আপনাকে খুন করব।

লেখক : খুন করবেন?

ছলিমুদ্দিন; হ্যাঁ অস্ত্র নিয়ে এসেছি।–এই দেখুন। এগারো ইঞ্চি ছোরা। এটা সোজা আপনার পেটে বসিয়ে দেব। আমি কেন আত্মহত্যা করব? আমার কি দায় পড়েছে?

লেখক : (ভয় পেয়ে) জরী, জরী একটু ওঠ তো। এই জরী।

 

নাটক এক পর্যায়ে থেমে গেল। বজলু সাহেব ফিরে এসেছেন। পুষ্প তার সঙ্গে আছে। পুষ্পের চোখ-মুখ আনন্দে ঝলমল করছে। বজলু সাহেব অতিরিক্ত গম্ভীর। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, এই মজনু, চা দে। আসিফ স্টেজ থেকে নেমে এল। বজলু তাকে নিয়ে বাইরের বারান্দায় চলে গেলেন। তিক্ত গলায় বললেন, অপমানের চূড়ান্ত হয়েছি। শালার নাটক-ফাটক ছেড়ে দেব।

আসিফ বলল, মেয়েকে তো নিয়েই এসেছেন দেখতে পাচ্ছি।

ভেতরের ঘটনা জানলে এটা বলতে না। আমি নাটকের কথাটা বলতেই বাড়িতে আগুন ধরে গেল। সবাই এমন ভাব করতে লাগল, যেন আমি একজন মেয়ের দালাল। বুড়োমত এক লোক, সম্ভবত মেয়ের চাচা-টাচা কিছু হবে, সরু গলায় বলছে, এটা ভদ্রলোকের বাড়ি। এটা ভদ্রলোকের বাড়ি। রাগে আমার গা জ্বলে গেল। ব্যাটা বলে কী? আমি কি অভদ্রলোক নাকি?

রাজি করালেন কিভাবে?

আমাকে কিছু করতে হয়নি, মেয়ে নিজেই উল্টে গেল। সে নাটক করবেই। কান্নাকাটি করে বিশ্ৰী এক কাণ্ড এমন অবস্থা যে চলেও আসতে পারি না। বসেও থাকতে পারি না। ব্যাঙের সাপ গেলার মত অবস্থা। এরকম সুপার ইমোশনাল মেয়ে নিয়ে কাজ করা যাবে না। শুধু শুধু পরিশ্রম।

আসিফ বলল, আমি মেয়েটার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলি। তারপর ছ নম্বর দৃশ্যটা হোক। বাড়তি লোক চলে যেতে বলুন। মেয়েটা পারবে কি পারবে না। আজই বোঝা যাবে।

তোমার মনে হয় পারবে?

হ্যাঁ পারবে। ভালই পারবে।

আসিফ পুষ্পকে বলল, এস আমরা ঐ কোণার দিকে গিয়ে বসে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করি। গল্পগুজব করলে টেনশান কমবে। অভিনয় করা সহজ হবে।

আমার মধ্যে কোনো টেনশান নেই।

আছে। যথেষ্ট আছে। টেনশনের সময় মানুষ খুব উঁচু পর্দায় কথা বলে; তুমিও তাই বলছি। এস আমার সঙ্গে।

পুষ্প এগিয়ে গেল। আসিফ বলল, চা খাবে?

পুষ্প বলল, না।

একটু খাও। চা খাবার সময় মানুষ একটা কাজের মধ্যে থাকে। কাজের মধ্যে থাকলে আপনাআপনি মানুষ খানিকটা ফ্রি হয়ে যায়। তখন কথাবার্তা সহজ হয়।

এত কিছু আপনি জানেন কিভাবে!

রাত-দিন তো এটা নিয়েই ভাবি। কাজেই কিছু কিছু জানি।

পুষ্প চায়ের কাঁপে চুমুক দিয়ে বলল, আপনার কী মনে হয় আমি পারব?

অবশ্যই পারবে। যারা অভিনয় করে না, তারা মনে করে অভিনয় ব্যাপারটা বুঝি খুবই কঠিন। আসলে তা না। অভিনয় খুবই সহজ।

আপনি আমাকে সাহস দেয়ার জন্যে এটা বলছেন।

মোটেই না। তোমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি। মনে কর তুমি একজনের চরিত্রে অভিনয় করছি। অভিনয়ের অংশটা হচ্ছে প্রিয়জনের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর তোমার রিএ্যাকশান। এখন দেখ এই অভিনয়ের কোনো সেট প্যাটার্ন নেই। পৃথিবীতে অসংখ্য ধরনের মানুষ। একেকজন মানুষ মৃত্যুর খবর একেকভাবে নেবে। এর যে কোনো একটা করলেই হল। তুমি গড়াগড়ি করে কাঁদলেও ঠিক আছে, আবার স্তব্ধ হয়ে গেলেও ঠিক আছে।

এত সোজা?

হ্যাঁ, এই অংশটা সোজা। তবে সবচে কঠিন কাজ হচ্ছে, একবার একটা প্যাটার্ন নিয়ে নিলে গোটা নাটকে তা বজায় রাখতে হবে। বুঝতে পারছ?

পারছি।

এই নাটকে তুমি বালিকা বধূর চরিত্রে অভিনয় করছি। ঐ চরিত্রের একটা প্যাটার্ন তোমাকে তৈরি করতে হবে। কোনটা তুমি নেবে? সবচে সহজটা নাও, যেটা তুমি জানো।

কোনটা আমি জানি?

তোমার নিজের চরিত্র তুমি জানো। ঐ চরিত্রটাই তুমি স্টেজে নিয়ে আসবে। মঞ্চে তুমি দেখবে তোমার স্বামীকে। এই স্বামী। কিন্তু মিথ্যা স্বামী না। মঞ্চে সে তোমার সত্যিকার স্বামী। এটা যখন তোমার মনে হবে তখনই তুমি পাস করে গেলে।

আমার ভয় ভয় লাগছে।

কোনো ভয় নেই। তুমি সংলাপগুলি একটু দেখে নিয়ে মঞ্চে যাও, আমি তোমার ভয় কাটিয়ে দিচ্ছি।

জি আচ্ছা।

পুষ্প, আরেকটা কথা তোমাকে বলি শোন, এটাও খুব জরুরি। রিহার্সেলে রোজ বালিকা বধুর মতো সেজে আসবে। এতে সাহায্য হয়। ঘরোয়া ধরনের শাড়ি পরবে, চুলগুলি খোলা রাখবে। একটু পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে ফেলবে। কাচের চুড়ি আছে না তোমার? হাতে বেশ কিছু কাচের চুড়ি পরে নিও। কথা বলার সময় হাত নাড়বে; চুড়ির ঝনঝন শব্দ হবে এতে খুব সাহায্য হবে।

জি আচ্ছা।

এখন যাও নাটকটা একটু পড়। ছোট্ট দৃশ্য। দুতিনবার পড়লেই মনে এসে যাবে। তোমার ভয়টা একটু কমেছে, না ভয় এখনো আছে?

এখনো আছে।

থাকবে না।

 

দৃশ্যটা আসলেই ছোট। এই দৃশ্যও লেখকের স্ত্রী লেখকের সঙ্গে রসিকতা করতে থাকে। লেখক ক্রমেই রেগে যেতে থাকে। এক সময় রাগ অসম্ভব বেড়ে যায়। সে তার স্ত্রীর গালে একটা চড় বসিয়ে দেয়। ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে যে লেখক হতভম্ব হয়ে যান। গভীর বিস্ময় ও গভীর বেদনা নিয়ে লেখকের স্ত্রী লেখকের দিকে তাকান। লেখক এসে জড়িয়ে ধরেন তার স্ত্রীকে। দুহাতে স্ত্রী মুখ তুলে চুমু খান তাঁর ঠোঁটে। পুষ্পের কেমন জানি লাগছে। সত্যি কি চুমু খাবে? সত্যি জড়িয়ে ধরবে? পুষ্পের গা কাঁপছে, খুব অস্থির লাগছে। তার ইচ্ছা করছে সে চেঁচিয়ে বলে,–আমি এই দৃশ্য করব না। আবার করতেও ইচ্ছা করছে। স্বামীর প্রতি তার খুব রাগ লাগছে, আবার খুব মমতাও লাগছে। এ রকম একজন লেখক স্বামী যদি তার হত তাহলে বেশ হত। তার ভাগ্যে কি আর এ রকম কেউ আসবে? হয়ত এলেবেলে ধরনের কারো সঙ্গে বিয়ে হবে। রাত জেগে গল্প করার বদলে সে হয়ত ভোস ভোঁস করে ঘুমুবে। ঘুমের ঘোরে ভারী একটা পা তুলে দেবে তার গায়ে।

আসিফ মঞ্চে এসে দাঁড়াল। সহজ স্বরে বলল, এস শুরু করা যাক। বলেই সে বদলে গেল। পুষ্প মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখল। এই লোকটা নিমিষের মধ্যে কি করে যেন বদলে গিয়ে লেখক হয়ে গেল। লেখক এবং তার স্বামী। খুবই নিকটের কেউ।

 

লেখক : অসাধারণ একটা আইডিয়া মাথায় এসেছে জরী। অসাধারণ উপন্যাসের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় এটা শুরু হবে। একটা শহর। মনে করা যাক এই ঢাকা শহর। এর উপর ঝড় আসছে, প্লাবন আসছে, মহামারী আসছে। শুধু মৃত্যু আর মৃত্যু। কেমন হবে বল তো?

জরী : খুব ভাল হবে।

লেখক : একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রথমে ঝড়, তারপর বন্যা, তারপর…

জরী : একটা ভূমিকম্প দিয়ে দাও।

লেখক : রাইট, ভূমিকম্প। ভূমিকম্পের কথাটা ভুলেই গিয়েছিলাম।

জরী : বিরাট একটা ভূমিকম্প হোক। সেই ভূমিকম্পে পুরো ঢাকা শহর তলিয়ে যাক।

লেখক : ঠাট্টা করছ? জরী : না, ঠাট্টা করছি না। এক’দিন দেখা যাবে যেখানে ঢাকা শহর ছিল, সেখানে বিরাট একটা হ্রদ।

লেখক : কি বলছ তুমি!

জরী : আমরা সেই হ্রদের পাশে ছোট্ট একটা কঁড়ে ঘর বানাব। আমাদের একটা নৌকা থাকবে। নৌকায় করে আমরা হিদের ঘুরব।

[লেখক প্রচণ্ড রাগে স্ত্রীর গালে চড় বসিয়ে দিলেন। পরমুহুর্তেই স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বলছেন।] লেখক : প্লিজ, জারী প্লিজ। আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি ভুল করে ফেলেছি।

 

অভিনয় শেষ হয়েছে। আসিফ এখনো পুষ্পকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। হাতের বাঁধন এতটুকুও আলগা না করে সে বলল, মজনু গ্লাসে করে পানি আন তো, মেয়েটা ফেইন্ট হয়ে গেছে।

আসিফ খুব সাবধানে পুষ্পকে টেবিলে শুইয়ে দিয়ে সহজ গলায় বলল, বজলু ভাই, খুব বড় মাপের একজন অভিনেত্রী পেয়ে গেলেন। আপনার উচিত আমাকে মিষ্টি খাওয়ানো।

বজলু ভাই মানিব্যাগ বের করে সত্যি সত্যি একশ টাকার একটা নোট বের করলেন মিষ্টির জন্যে।

পুষ্প টেবিলে উঠে বসে ঘোর লাগা চোখে চারদিকে তাকাচ্ছে। আসিফের দিকে চোখ পড়তেই আসিফ বলল, তুমি যে কত ভাল করেছ তুমি নিজেও জান না।

পুষ্প কিছু বুঝতে পারছে না। সব কিছু তার কেমন জানি এলোমেলো হয়ে গেছে। এই জায়গাটা কি? তাদের বাসা? নাকি অন্য কোনো জায়গা?

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ