হাশমত আলি বিকেলে বাজার করে ফিরেছে। সস্তায় পেয়েছে দুটো বিশাল সাইজের ইলিশ। বৈশাখ মাসের শুরু। ইলিশ মাছে স্বাদ এসে গেছে। এই সময়ে এত সস্তায় ইলিশ পাওয়ার কথা না। ভাগ্যক্রমে পাওয়া গেছে।

বারান্দায় মাছ কাটা হচ্ছে। বটিটা বেশ ধারালো কচ কিচ করে কেটে যাচ্ছে। দেখতে ভাল লাগছে। খুকিকে কোলে নিয়ে হাশমত আলি মুগ্ধ চোখে মাছ কোটা দেখছে। তার জীবনের এটা একটা আনন্দঘন মুহূর্ত।

লীনা চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। হাশমত বলল, ভাবী মাছ দেখলেন? পেটটা কেমন গোল। এর স্বাদই অন্য রকম। রাতে আমাদের সঙ্গে খাবেন ভাবী, মনে থাকে যেন।

লীনা বলল, আমি তো খেতে পারব না। আপনার ভাইকে খাইয়ে দেবেন। আমি একটু মার বাসায় যাচ্ছি।

তাহলে এমনি এমনি এক টুকরা মাছ খান। বেনু ভেজে দেবে।

না ভাই থাক।

এক মিনিট লাগবে। ইলিশ মাছ ভাজা হতে এক মিনিটের বেশি লাগে না।

আমার ইচ্ছা করছে না। শরীরটা ভাল না। ফ্রিজে থাকুক। একসময় খাব।

ফ্রেস জিনিস তো আর পাচ্ছেন না ভাবী।

ফ্রেস জিনিস তো সব সময়ই আপনার কাছ থেকে পাচ্ছি, তাই না হাশমত সাহেব?

জি ভাবী।

আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল। আপনি কী একটু বসার ঘরে আসবেন। বেনুর সামনে বলতে কেমন জানি সংকোচ বোধ করছি।

বেনু বিস্মিত হয়ে তাকাল। হাশমত আলি নিঃশব্দে উঠে এল বসার ঘরে। অবাক হয়ে বলল, কি ব্যাপার ভাবী?

এ মাসের বাড়ি ভাড়াটা কী আপনি দিয়ে দেবেন? একটু সমস্যা হচ্ছে। আমি দিন দশেকের মধ্যে–

এটা কোনো ব্যাপারই না ভাবী। এটা নিয়ে আপনি চিন্তাই করবেন না। এই মাস কেন? দরকার হলে ছমাসের ভাড়া দিয়ে রাখব। আপনি আমাকে ভাবেন কী?

লীনা খুব কৃতজ্ঞ বোধ করছে। হাশমত আলিকে এই কথাটা কি করে বলবে এটা ভাবতে তার মাথা ধরে গিয়েছিল। এখন মাথা ধরাটা নিমিষের মধ্যে চলে গেছে।

হাশমত আলি বলল, কথাটা বেনুর সামনে না বলে ভাল করছেন। টাকা-পয়সার কোনো কথায় মেয়েছেলে থাকা উচিত না।

লীনা হেসে বলল, আমি নিজেও তো মেয়েছেলে।

কি যে বলেন ভাবী, কোথায় আপনি আর কোথায় বেনু। আকাশ আর পাতাল ফারাক।

লীনা বলল, আপনার ভাই এলে বলবেন আমি মার কাছে গিয়েছি। রাতই ফিরব। সে যেন খেয়ে নেয়।

জি আচ্ছা বলব। আপনি একটা ছাতা নিয়ে যান ভাবী! দিনের অবস্থা ভাল না। ঝড়-বৃষ্টি হতে পারে।

ছাতা লাগবে না।

লাগবে না বলছেন কি? অবশ্যই লাগবে। লেডিস ছাতা ঘরে আছে। ব্রান্ড নিউ। জাপানি।

হাশমত নিজেই লেডিস ছাতা বের করে আনল।

 

লীনার বাবা ওয়াদুদুর রহমান সাহেব চাকরি থেকে রিটায়ার করার পর বাড়ি তৈরিতে হাত দিয়েছিলেন। ঝিকাতলায় তার জমি কেনা ছিল। রিটায়ার করবার সঙ্গে সঙ্গে যুবকের উৎসাহে ঝাপিয়ে পড়লেন। তার সাৰ্ব্বক্ষণিক ধ্যান জ্ঞান হচ্ছে বাড়ি। চমৎকার দখিনদুয়ারি বাড়ি। ইস্টার্ন রীতি অনুযায়ী বিরাট বারান্দা থাকবে, আবার ওয়েস্টার্ন ধরনে প্রতিটি ঘরে থাকবে বিল্ট ইন কাবার্ড। লোকজন বাথরুম বানানোয় কিপটেমী করে, তিনি করবেন না। বাথরুমে ঢুকেই যেন খোলামেলা ভাব হয়। প্রতিটি বাথরুমে থাকবে ঝকঝকে বাথটাব। দরজা-জানালা হবে সিজন করা বাৰ্মা টিকের। আজকাল কি সব কাঠ দিয়ে দরজা-জানালা করে, গরম কালে ক্যাচর্ক্যাচ শব্দ হয়। ওয়াদুদুর রহমান সাহেব প্রতিটি জিনিস নিজে পছন্দ করে কিনলেন। মিস্তিরিরা সিমেন্ট বালি মিশিয়ে মশলা তৈরি করে, তিনি পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। ইট বিছিয়ে দেয়াল তৈরি হয় তিনি আগ্রহে দেখেন, মাঝে মাঝে দিৰ্দেশ দেন ঐ ইটটা বদলে দাও বসির মিয়া। ইটটা বঁকা।

বসির মিয়া বদলাতে চায় না। তিনি বড়ই বিরক্ত হন।

আহা বদলাতে বললাম না? ইটের কি অভাব হয়েছে যে একটা ক্রিপলড ইট দিতে হবে। চেঞ্জ ইট।

রিটায়ার করার পরও হয়ত ওয়াদুদুর রহমান সাহেবের কুড়ি বছরের মতো আয়ু ছিল, সেই আয়ু বাড়ি তৈরি করতে গিয়ে তিনি খরচ করে ফেললেন। ছাদ ঢালাইয়ের পর দিন স্ট্রোকে মারা গেলেন।

কারো জন্যেই কিছু থেমে থাকে না। যথাসময় বাড়ি শেষ হল। দোতলা করা গেল না। একতলা বানাতেই সঞ্চিত প্রতিটি পয়সা শেষ হয়ে গেল। লীনার মা সুলতানা বেগম একতলা বাড়ির দুটো ঘর নিয়ে থাকেন। বাকিটা ভাড়া দিয়েছেন, তার ডাক্তার জামাইকে। এই ডাক্তার জামাই বাড়িটাকে মোটামুটি একটা হাসপাতাল বানিয়ে ফেলেছে। রোজ বিকাল চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত এখানে রুগী দেখা হয়। ভদ্রলোকের ভাল পসার হয়েছে। রুগীতে সারাক্ষণ বাড়ি ভর্তি থাকে। সুলতানার গা শিরশির করে, কিন্তু জামাইকে কিছু বলতে পারেন না।

আজ শুক্রবার। ডা. জামান শুক্রবারে রুগী দেখেন না, তবু দু-তিন জন রুগী বাইরের বারান্দায় বসে আছে। ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে দেখা না করে তারা কিছুতেই যাবে না। লীনাকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে তাকেই ধরল, আপা ডাক্তার সাহেবকে একটু বলে দেন। খুব বিপদে পড়েছি।

লীনা মার শোবার ঘরে ঢুকতেই একসঙ্গে সবাই হৈচৈ করে উঠল। লীনার বড় বোন দীনা বলল, ঝড় বৃষ্টির মধ্যে রিকশা নিয়ে চলে এলি? তোকে আনতে গাড়ি গেছে। সবচে ছোট বোন নীনা বলল, একটা লেটেস্ট মডেল গাড়িতে চড়া মিস করলে আপা। দুলাভাই নতুন গাড়ি কিনেছে। বড় আপাদের এখন দুটো গাড়ি। সুলতানা বললেন, জামাইকে আনলি না কেন? আমরা নাটক করি না বলে বুঝি আমাদের বাড়িতে আসা যাবে না।

নাটকের একটা খোঁচা না দিয়ে সুলতানা মেজো জামাই সম্পর্কে কিছু বলতে পারেন না। আজও পারলেন না। লীনার মনটা খারাপ হয়ে গেলেও সহজ স্বরে বলল, ওর কাজ আছে মা, রাত দশটার আগে ছাড়া পাবে না।

সুলতানা তিক্ত গলায় বললেন, আমার তিন জামাইয়ের মধ্যে মেজোটাই সবচে কাজের হয়েছে। রাত দশটা-এগারোটার আগে কোনোদিন ছাড়া পায় না।

লীনা বলল, জামাই প্রসঙ্গ থাক মা! সবাই তো আর এক রকম হয় না। কেউ কাজের হয়, কেউ হয় অকাজের কি আর করা। কি জন্যে ডেকেছ বল? কারো জন্মদিন-টিন নাকি? আমি তো কিছু মনে করতে পালাম না। ফুল নিয়ে এসেছি। যার জন্মদিন সে নিয়ে নিক।

নীনা ছুটে এসে ফুল নিয়ে নিল। নীনার কাছ থেকে ফুল নেবার জন্যে বড় জামাই ঝাপিয়ে পড়ল। নীনা তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, প্লিজ আমার ফুলগুলি সেভ কর। বলেই সে ফুলের তোড়া ক্রিকেট বলের মত ছুড়ে মারল স্বামীর দিকে। সুলতানা কপট বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে বললেন, এরা সব সময় কি যে যন্ত্রণা করে। এই তোরা চা খাবি না কফি খাবি? যেটাই খাবি একটা। দু-তিন পদের জিনিস বানাতে পারব না।

দীনা ও দীনার স্বামী জামান সাহেব বললেন, কফি।

নীনা বলল, চা।

নীনার স্বামী লুৎফুল হক চেঁচিয়ে বলল, সরবত।

চারদিকে তুমুল হাসি শুরু হল। লীনা মনে মনে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। এই সব চমৎকার হাসিখুশির মুহূর্তগুলিতে আসিফ কখনো অংশ নিতে পারে না। মাঝে মাঝে সে যে উপস্থিত থাকে না তা নয়। থাকে, কিন্তু বড়োই বিব্রত বোধ করে। দেখে মনে হয় তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। সবাইকে একত্র করার উদ্দেশ্য ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। জামান সাহেব বললেন, রাতে খাওয়াদাওয়ার পর অফিসিয়ালি সেটা বলা হবে। টপ সিক্রেট। এখন আমি আমার নতুন গাড়িতে সবাইকে নিয়ে একটা চক্কর দেব। এখান থেকে সাভার যাব সাভার থেকে ফিরে আসব। টাটকা হাওয়ায় খিদেটা জাগবে। আমাকে বিশ মিনিটের জনো ক্ষমা করতে হবে। আমার কয়েকটা রুগী বসে আছে। বিদেয় করে আসি।

লুৎফুল বলল, ছুটির দিনেও রুগী দেখোন! এত টাকা দিয়ে করবেন কি দুলাভাই? লোকজন ব্লাড প্রেসারে মারা যায়… আপনি দেখি টাকার প্রেসারে মারা যাবেন।

জামান সাহেব ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলেন। সুখী মানুষের হাসি। সুখী মানুষ অতি তুচ্ছ রসি চতায় হেসে ভেঙে পড়তে পারে।

নিমন্ত্রণের রহস্য জানা গেল রাতের খাবারের পর। জামান সাহেব ছোটখাটো একটা বক্তৃতা দিলেন। তিনি সবাইকে নিয়ে কাশ্মির যেতে চান। শুধু কাশ্মির না আগ্রা। জয়পুর এবং কাশ্মির। থাকা খাওয়ার যাবতীয় খরচ তার। দুই শ্যালিকা এবং শাশুড়ির টিকিটও উনি কাটবেন। অন্য কেউ যেতে চাইলে তাদের টিকিট তাদের কাটতে হবে। এই ভ্রমণে বাচারা কেউ যাবে না।

লুৎফুল বলল, আমার টিকিট কাটবেন না, এর মানেটা কি দুলাভাই?

আমার কর্তব্য হচ্ছে শ্যালিকা পর্যন্ত, এর বাইরে না।

নীনা বলল, আপনি কি সত্যি মিন করছেন দুলাভাই?

তোমার সন্দেহ আছে নাকি?

হ্যাঁ আছে। আপনার মধ্যে যে একজন হাতেমতাই লুকিয়ে আছে সেটা জানা ছিল না।

এখন জানলে?

তা জানলাম। যাচ্ছি কবে আমরা?

সামনের মাসের এগারো তারিখে, ফিরব বাইশ তারিখ। দীনা, তুমি ওদের টিকিট ওদের দিয়ে দাও।

নীলা বিস্মিত হয়ে বলল, টিকিটও কেটে ফেলেছেন!

অফকোর্স। আমি কাঁচা কাজ করি না। ঢাকা-দিল্লি-ঢাকা রিটার্ন টিকিট।

লীনা কিছুই বলল না। চুপচাপ বসে রইল। জামান সাহেব বললেন, আমার মেজো শালীকে দেখে মনে হচ্ছে তার ফাঁসির হুঁকুম হয়েছে। লীনা তুমি এমন মুখ কালো করে বসে আছ কেন?

আমার শরীরটা ভাল না দুলাভাই।

তুমি যাচ্ছ তো।

না দুলাভাই। না কেন? তোমার বরকে ছেড়ে এই দশটা দিন তুমি থাকতে পারবে না?

তা না।

তাহলে অসুবিধাটা কোথায়।

অসুবিধা কিছু নেই।

জামান সাহেব নিজেই লীনাকে গাড়ি করে পৌঁছে দিলেন। কোমল গলায় বললেন, তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তুমি যেতে চাচ্ছ না।

লীনা বলল, আপনি ঠিকই বুঝেছেন।

কর্তাকে ছাড়া যেতে মন চাচ্ছে না?

লীনা চুপ করে রইল। জামান সাহেব বললেন, লীনা তোমাকে আমি খোলাখুলি কিছু কথা বলি। কিছু কিছু কথা সরাসরি হওয়াই ভাল। দেখ লীনা, তোমাদের আর্থিক অবস্থার কথা আমি ভালভাবেই জানি। সেটা জেনে তোমার কর্তার জন্যে একটা টিকিট আমার কেন উচিত। কিনতেও আমার কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু মুশকিল কি জানো? তোমাদের আত্মসম্মান বোধ অনেক বেশি। তোমরা আহত বোধ করবে। ভাল করতে গিয়ে মন্দ করা হবে। আমি সত্যি চাই তুমি যাও আমাদের সঙ্গে। তোমার শরীর খারাপ। বেশ খারাপ। বাইরে একটু ঘুরে-টুরে এলে ভাল লাগবে।

লীনা কিছুই বলল না।

জামান সাহেব বললেন, আসিফকে নিয়ে গেলে আরেকটা বাস্তব সমস্যা আছে, সেটাও তোমাকে খোলাখুলি বলি। তোমার মা, আই মিন আমার শাশুড়ি আসিফকে তেমন পছন্দ করেন না। এগারো দিন এক সঙ্গে থাকতে হবে। এর মধ্যে তিনি অনেকবার আসিফকে নিয়ে অনেক অপ্রিয় প্রসঙ্গ তুলবেন। তোমার খুব খারাপ লাগবে।

লীনা বলল, আপনিইবা হঠাৎ দল বেঁধে বাইরে যাবার ব্যাপারে এত উৎসাহী হলেন কেন?

খুব ক্লান্ত লাগছে। টাকা বানানোর একটা মেশিন হয়ে পড়েছি। সারাদিন হাসপাতালে থাকি। বাসায় ফিরে বিশ্রামের বদলে রাত দশটা এগারোটা পর্যন্ত রুগী দেখি। জীবনটা মানুষের রোগশোকের মধ্যে আটকা পড়ে আছে। মুক্তি চাচ্ছি। কিছু সময়ের জন্যে হলেও মুক্তি। মাঝে মাঝে তোমাদেরকে আমার বেশ হিংসাই হয়। মনে হয় বেশ সুখেই তো তোমরা আছ।

আপনি কী অসুখে আছেন?

হ্যাঁ অসুখেই আছি। উত্তরায় বাড়ি করছি। কত রকম প্ল্যানিং কত পরিকল্পনা। ফলের গাছ কি কি থাকবে, ফুলের গাছ কি কি থাকবে। অথচ আমি নিজে ডাক্তার, আমি খুব ভাল করে জানি আমরা যে বেঁচে আছি। এইটাই পরম আশ্চর্যের ব্যাপার। দীর্ঘ পরিকল্পনা অর্থহীন।

ফিলাসফার হয়ে যাচ্ছেন দুলাভাই। এটা তো ভাল লক্ষণ না।

ফিলাসফার হতে পারলে তো কাজই হত। হাইলি মেটেরিয়েলিস্টিক মানুষ হয়ে জন্মেছি। এ ভাবেই মরব। আমার মত সাকসেসফুল ডাক্তারদের এটাই হচ্ছে ডেসটিনি।

 

অনেক রাতে আসিফের ঘুম ভেঙে গেল। ঘর অন্ধকার, বাইরে ঝুপ কুপ করে বৃষ্টি পড়েছে। খোলা জানালায় বৃষ্টির ছাট আসছে। হাওয়ায় মশারি উড়ে উড়ে যাচ্ছে। আসিফ বিছানায় উঠে বসল। লীনা

পাশে নেই এটা নতুন কিছু না প্রায় রাতেই ঘুম ভাঙলে লীনাকে পাশে দেখা যায় না। সে একাকী বারান্দার বেতের চেয়ারটায় বসে বাড়ির সামনের বাকড়া কাঁঠাল গাছের দিকে তাকিয়ে থাকে। আজও নিশ্চয়ই তাই আছে।

আসিফ বাতি জ্বালাল না। নিঃশব্দে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। লীনা তার দিকে তাকিয়ে হাসল। যেন সে জানত এই মুহুর্তে আসিফ এসে তার পাশে বসবে।

কি করছ লীলা?

কিছু না। বৃষ্টি দেখছি।

ঘুম আসছে না?

উঁহু।

ডাক্তার দেখাচ্ছ না কেন?

দেখাব। বস আমার পাশে। বৃষ্টি দেখতে দেখতে খানিকক্ষণ গল্প করি।

আসিফ বসতে বসতে মৃদু স্বরে বলল, একা একা বসে তুমি কি ভাব বল তো?

সাধারণত কিছু ভাবি না, আজ অবশ্যি ভাবছিলাম … কাশ্মির জায়গাটা দেখতে কেমন হবে। নিশ্চয়ই খুব সুন্দর, তাই না?

সুন্দর তো বটেই।

সব সুন্দর সুন্দর জায়গাগুলি ইন্ডিয়াতে পড়ে গেল। রাগ লাগে না তোমার?

লাগে।

কাশ্মির জায়গাটা কেমন হবে ভাবতে ভাবতে কি ঠিক করলাম জানো? ঠিক করলাম আমি দুলাভাইয়ের সঙ্গে ঘুরেই আসব।

খুব ভাল, যাও ঘুরে আসা। তোমার কাছে যাদি ভাল লাগে তাহলে পরে আমরা দু’জন আবার যাব। হাউস বোট ভাড়া করে থাকব।

কাশির দেখার জন্যে আমি যাচ্ছি না। কিন্তু আমি যাচ্ছি। অন্য কারণে।

অন্য কারণটা কি?

আমি আজমীর যাব। আজমীর শরীফে গিয়ে যা চাওয়া যায়। তাই নাকি পাওয়া যায়। আমি ঐ জন্যেই যাব। যেন আমাদের এই বারের বাচ্চাটা বেঁচে থাকে।

ওর বয়স কত হল লীনা?

তিন মাস। তুমি বিশ্বাস করবে না, আমি কিন্তু ওর হার্টবিট বুঝতে পারি।

সত্যি।

হ্যাঁ সত্যি। তবে সব সময় না। গভীর রাতে যখন একা একা বসে থাকি তখন।

এই জন্যেই কি তুমি রাত জাগ?

হুঁ।

আসিফ সিগারেট ধরাল। তার পাশে বসে থাকা এই মেয়েটি তার কত দিনের চেনা, অথচ গভীর রাতে সে যখন একা একা বসে থাকে তখন কেমন অচেনা হয়ে যায়।

লীনা বলল, অনেক’দিন তোমাদের রিহার্সেলে যাই না। রিহার্সেল কেমন হচ্ছে?

বেশি ভাল হচ্ছে না। শো পিছিয়ে দিয়েছে, সব কেমন ঢ়িলা ঢালা হয়ে গেছে।

পুষ্প মেয়েটা কেমন করছে?

ভাল করছে।

আমার চেয়েও ভাল?

হ্যাঁ, তোমার চেয়েও ভাল।

আমাকে যেমন অভিনয়ের আগে একটা বক্তৃতা দিয়েছিলে, ওকেও কি দিয়েছিলে?

হুঁ।

আচ্ছা ষষ্ঠ দৃশ্যে তুমি যখন পুষ্পকে জড়িয়ে ধর, তখন তোমার কেমন লাগে?

আসিফ অবাক হয়ে বলল, এই প্রশ্ন করছ কেন?

এমনি করছি, কিছু মনে করো না।

বৃষ্টির বেগ আরো বাড়ছে। ঝড়ের মত হচ্ছে।

জামগাছের পাতায় শো শো শব্দ। ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়েছে। সমস্ত শহর অন্ধকারে ডুবে গেছে। আসিফ বলল, চল শুয়ে পড়ি। লীনা বিনাবাক্যব্যয়ে উঠে এল। দুজনের কেউই বাকি রাত মুক্ত পুরুদা। আসিফ জেগে জেগে ওনাল বৃষ্টির শব্দ, লীনা শুনতে চেষ্টা করল অনাগত শিশুটির হৃৎপিণ্ডের শব্দ।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ