হাঞ্চ ব্যাক অব মীরপুর পিঠ সোজা করে মতিঝিলের ট্রাভেল এজেন্সি সুরমা ট্রাভেলস-এ ঢুকলেন। তাঁর সঙ্গে আসিফ। বিশাল অফিস। দু’জন স্টেনো বা রিসিপশনিস্ট ধরনের মেয়ে বসা। একজনের দিকে তাকানো যায় না। মৈনাক পর্বত। তবে অন্য জন রূপবতী। মৈনাক পর্বত মধুর গলায় বলল, আপনাদের জন্যে কি করতে পারি?

বজলু সাহেব বললেন, কেরামত আছে?

জি আছেন। এখন একটু ব্যস্ত।

আমিও ব্যস্ত। আপনি দয়া করে বলুন, ভৈরবের বজলু।

মৈনাক পর্বত বিরক্ত ভঙ্গিতে ভেতরে চলে গেল। বজলু আসিফকে নিচু গলায় বললেন, তুমি এখানেই বসে থাক। আমি এক যাই। দরকার হলে তোমাকে ডাকব।

আসিফ বলল, দরকার হবে বলে মনে করছেন?

অবশ্যই হবে। কেরামত আমার কথা ফেলবে না। ওর সেই ক্ষমতাও নেই। এসএম হলে লিটারেলি আমিই ওকে ফেলেছি।

পুরনো কথা কেউ মনে রাখে না বজলু ভাই।

দেখা যাক। আগেই ডিসাহার্টেড হচ্ছে কেন?

বজলু এসেছেন আসিফের চাকরির ব্যাপারে। এসেছেন। খুবই উৎসাহ নিয়ে। তার ধারণা এই মুহূর্তেই একটা কিছু হবে। আসতে আসতে বলেছিলেন, তোমার চাকরি কোনো ব্যাপারই না। যে কোনো অফিসের একজন বসকে ধরে এনে নাটক একটা দেখিয়ে দিলেই ব্যাটেল ইজ ও না।

আসিফ কোনো প্রতিবাদ করেনি। যদিও বলতে চেয়েছিল নাটকের ক্ষেত্রে এটা কখনো হয় না। খেলোয়াড়দের ব্যাপারে হয়। ভাল ফুটবল প্লেয়ার, ক্রিকটে প্লেয়ারদের ডেকে ডেকে চাকরি দেয়। এরা অফিসের শোভা। কিন্তু নাটক করা লোককে কে রাখবে?

মৈনাক পর্বত বজলু সাহেবকে ডেকে নিয়ে গেল। আসিফ বসে রইল। সুন্দরী মেয়েটি বলল, আপনি চা খাবেন?

জি খাব।

মেয়েটি কেমন যেন আগ্রহ নিয়ে তাকাচ্ছে। কোনো একটা নাটক কী সে দেখেছে? অসম্ভব কিছু তো নয়। দেখতেও তো পারে। সুন্দরী মেয়েটি নিজেই চায়ের কাপ নিয়ে এগিয়ে এল। মিষ্টি গলায় বলল, আপনি কী মাধবীর ভাই?

জি না।

মেয়েটির সব আগ্রহ শেষ। সে ফিরে গেল নিজের জায়গায়। ব্যস্ত হয়ে পড়ল টেলিফোন নিয়ে। সম্ভবত চা এনে দেয়ায় নিজের ওপরই সে এখন রাগ করছে।

কেরামত যতটা আন্তরিকতা দেখাবে বলে বজলু ভেবেছিলেন, সে তার চেয়েও বেশি দেখাল।–জড়িয়ে ধরে নাচানাচি করল খানিকক্ষণ; গদগদ গলায় বলল, ভৈরবের বজলু যে তুমি তা বুঝতে পারিনি দোস্ত। বিশ্বাস কর। এই টাকা জুয়ে বলছি। ব্যবসায়ী কখনো টাকা ছুঁয়ে মিথ্যা কথা বলে না।

ব্যবসা কেমন চলছে?

টুকটাক। ফাজিলের দেশ। ফাজিলের দেশে ব্যবসা করে সুখ নেই।

তুই তো মনে হচ্ছে সুখে আছিস।

টাকা আছে। মনে শান্তি নাই রে দোস্ত। কি জন্যে এসিছিস বল।

চাকরি দিতে হবে একটা।

এটা ছাড়া আর কিছু বলার থাকলে বল।

আর কিছু বলার নেই।

কেরামত গম্ভীর হয়ে গেল। বজলু সিগারেট ধরালেন। এই ঘরের এয়ার কন্ডিশনার অনেক নিচে সেট করা। বেশ ঠাণ্ডা লাগছে। মনে হচ্ছে ফ্রিজের ভেতর তিনি বসে আছেন। কেরামত বলল, চাকরি। কার?

আমার গ্রুপের একজন।

তোর আবার কিসের গ্রুপ।

নাটকের গ্রুপ।

ও আচ্ছা, এখনো নাটক নিয়ে আছিস? ভাল শিল্প সাহিত্যের কোনো খবর রাখি না। আমার বউ বলছিল মহিলা সমিতিতে ভাল ভাল নাটক হয়। সে এক’দিন দেখে আসল কমেডি ধরনের কিছু হবে। রাতে ঘুমুতে গিয়েও একটু পর পর হেসে ওঠে।

বজলু বললেন, আসল কথা থেকে দূরে সরে যাচ্ছিস।

তোর ক্যান্ডিডেটের যোগ্যতা কি? মানে নাটক ছাড়া আর কি জানে?

বি এ পাস। শুরুতে ব্যাংকে চাকরি করত, তারপর ইস্টার্ন ট্রান্সপোর্টে কিছু দিন ছিল। জীবন বীমাতে কিছুদিন কাজ করেছে।

অচল মাল গছাতে চাচ্ছিস।

বজলু সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, আসিফের মত ছেলেকে চাকরির জন্য মানুষের দরজায় দরজায় ঘুরতে হচ্ছে এইটাই হচ্ছে আফসোসের ব্যাপার। বিলেত আমেরিকা হলে এই ছেলে টাকার ওপর শুয়ে থাকত।

কেরামত বলল, কষ্ট করে কিছু টাকা পয়সা জোগাড় করে এই ছেলেকে বিলেত আমেরিকা পাঠিয়ে দিলেই হয়।

বজলু গম্ভীর হয়ে গেলেন।

কেরামত বলল, ঠাট্টা করলাম রে দোস্ত। তোকে সত্যি কথা বলি বিজনেসের অবস্থা খুবই টাইট। তবু তুই এসেছিস এই খাতিরে আমি যা করতে পারি সেটা হচ্ছে টাইপিস্টের একটা চাকরি দিতে পারি। তবে টাইপ জানতে হবে।

বজলু উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তবু বললেন, তোব এখানে হবে না বুঝলাম। উঠি।

কেরামত বলল, রাগ করে উঠে যাচ্ছিস তা বুঝতে পারছি। উপায় নেই দোস্ত। আমার জায়গায় তুই থাকলে তুইও ঠিক এই কথাই বলতি। পুরনো দিনের খাতিরে এক কাপ চা অন্তত খেয়ে যা। আমি মানুষটা খারাপ হতে পারি। আমার অফিসের চা কিন্তু ভাল।

বজলু চা খেলেন না। অফিস থেকে বের হবামাত্র তার পিঠ আবাবা কুজো হয়ে গেল। তবে বেশ শক্ত গলায় বললেন, তুমি কোনো চিন্তা করবে না। আমি একটা ব্যবস্থা করব। অবশ্যই করব। চল কোথাও বসে চা-টা কিছু খাওয়া যাক।

আসিফ বলল, আমি একটু পুরানা পল্টনের দিকে যাব। এগারোটার মধ্যে না গেলে কাজ হবে না। চা থাক।

চাকরি সংক্রান্ত ব্যাপার?

জি।

আচ্ছা যাও। তবে শোন, বিকেলে রিহার্সেলে আসার সময় অনেক কপি বায়োডাটা নিয়ে আসবে।

দেয়ার মতো বায়োডাটা তো কিছু নেই।

যা আছে তাই আনো না। আমার এক খালু আছেন খুবই হাই লেভেলের লোক। মন্ত্রী লেভেলের লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ। তাকে দিয়েই কাৰ্য উদ্ধার করতে হবে। তুমি একেবারেই চিন্তা করবে না।

জি আচ্ছা।

লীনার শরীর এখন কেমন?

ভাল।

ভেরি গুড। আমি দেখতে যাব। আজই যাব; রিহার্সেলের পর চলে যাব। রাতে খাব তোমার সাথে।

জি আচ্ছা।

শোন আসিফ, টাকা পয়সা কিছু লাগবে?

এই মুহূর্তে না।

কোনোরকম সংকোচ করবে না। তোমার মত মানুষকে এটা জিজ্ঞেস করতে হচ্ছে—কি আফসোস বল তো।

আসিফ হেসে ফেলল।

হাসবে না, বুঝলে? এটা হাসির কোনো ব্যাপার না। এটা হচ্ছে একটা গ্রেট ট্র্যাজেডি। আসিফের তেমন কোথাও যাবার কথা ছিল না। বজলু সাহেবের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়াই তার প্রথম উদ্দেশ্য। বজলু কাউকে ধরলে সহজে ছাড়েন না। আসিফ এখন কি করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। বাসায় ফিরে যাওয়া যায়। খালি বাসায় ফিরে গিয়েই বা কী হবে? লীনা আছে স্কুলে। আজ আবার স্কুলে কিসের যেন পরীক্ষা। ছুটি হবে বিকেল পাঁচটায়। ছুটির জন্যে দরখাস্ত করেছিল–নামঞ্জর হয়েছে। স্কুলের চাকরিটা লীনার ছেড়েই দিতে হবে। ভয়ানক দিন সামনে। আসিফ হাঁটতে হাটতে ভাবছে। এইসব নিয়ে গুছিয়ে একটা নাটক লিখতে পারলে বেশ হত। তবে এই নাটক দর্শক নিত না। নাটকের বক্তব্য যাই হোক, তার মধ্যে বিনোদন থাকতে হবে। রিলিফ থাকতে হবে। ফিকাসোর যে ছবি, তারও বিনোদনের একটি দিক আছে।

সবচে কঠিন বক্তব্যের নাটকেও আছে রিলিফের ব্যবস্থা। কুইনাইন সরাসরি গেলা যায় না। মিষ্টি চিনির প্রলেপ দিয়ে দিতে হয়।

দুপুর দেড়টার দিকে আসিফ উপস্থিত হল তার বড় দুলাভাইয়ের অফিসে। নিকট আত্মীয়দের মধ্যে অল্প যে কজনের সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে ফরহাদ সাহেব হচ্ছেন তাদের একজন। এক সময় সরকারি চাকুরে ছিলেন। রোডস এন্ড হাইওয়েজের ইঞ্জিনিয়ার। চাকরি ছেড়ে দিয়ে এখন কনসট্রাকশান ফার্ম দিয়েছেন। সাধারণত ইঞ্জিনিয়াররা ব্যবসা শুরু করলে দ্রুত বড়লোক হয়ে যায়। এর বেলায় ব্যতিক্রম হয়েছে। আগে যা ছিলেন এখন তাই আছেন। কাজকর্ম নাকি তেমন জোগাড় করতে পারেন না। আসিফ যখন তার কাছে আসে, দেখে–তিনি চেয়ারে পা তুলে বসেছেন। হাতে ম্যাগাজিন। দেশী-বিদেশী অসংখ্য ম্যাগাজিন তার টেবিলে থাকে। তিনি সব ম্যাগাজিন গভীর আগ্রহে পড়েন।

ফরহাদ সাহেব মানুষটা ছোটখাটো। বেমানান বিশাল গোঁফ আছে। গোফের আড়ালে ঠোঁট ঢাকা বলে কখন হাসছেন তা বোঝা যায় না, মনে হয়। সারাক্ষণই রেগে আছেন। আসিফকে ঢুকতে দেখে হাতের ম্যগাজিন না নামিয়ে এবং আসিফের দিকে না তাকিয়েই বললেন, টাকা ধার চাইতে এসেছ?

আসিফ বলল, হ্যাঁ।

কত?

লাখ খানিক।

বস। আসিফ বসল। ফরহাদ ম্যাগাজিন নামিয়ে রাখলেন, গোফের আড়ালে হাসলেন। পর মুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে বললেন, কিছু হয়নি এখনো?

না।

হবে বলে কি মনে হচ্ছে?

না হচ্ছে না।

হতাশ?

জি হতাশ। খুব হতাশ?

হ্যাঁ।

দুপুরে খাওয়া হয়েছে?

জি না। চল কোথাও গিয়ে খাই। পেটে খুব ক্ষুধা থাকলে হতাশ ভাবটা বেশি থাকে। জাতি হিসেবেই আমরা হতাশ কেন জানো? হতাশ, কারণ বেশির ভাগ মানুষ ক্ষুধার্তা! বুঝলে?

বুঝলাম।

না বোঝনি। এটাই সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যেখানে ক্ষুধাকে খুব সম্মানের চোখে দেখা হয়। এই দেশের কবি লেখেন, হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছ মহান। দারিদ্র্য মানুষকে মহান করে না, পঙ্গু করে ফেলে।

খুবই ফিলসফিক কথাবার্তা বলছেন দুলাভাই।

বলছি, কারণ আমার অবস্থা কাহিল। তোমার বোন সেই খবরটা এখনো জানে না। সে সুখে আছে।

ব্যবসা পাতি খারাপ যাচ্ছে?

ইয়েস। কি পরিমাণ খারাপ, তুমি চিন্তা করতে পারবে না। মোটা এমাউন্টের টাকা ঘুষ দিয়ে একটা কনট্রাক্ট দেই। কাজ শুরু মাত্র সবাই হাঁ করে ফেলে,–প্রতিটি মানুষকে টাকা খাওয়াতে হয়।

যে রাস্তায় ছইঞ্চি বিটুমিন দেওয়ার কথা সেখানে দিই এক ইঞ্চি। প্রথম সেই বিটুমিন ধুয়ে মুছে যায়। আবার টেন্ডার হয়। আবার টাকা খাওয়াখাওয়ি। তুমি করাংলাদেশে কোথাও কোন সৎ মানুষ নেই। সৎ মানুষ এখন আছে কোথায় জানো? গল্প, উপন্যাস এবং তোমাদের নাটকে।

ফরহাদ সাহেব আসিফকে নিয়ে দামি একটা রেস্টুরেন্টে গেলেন। নতুন রেস্টুরেন্ট, বিদেশীরাই বেশির ভাগ ভিড় করছে। রেস্টুরেন্টের বিশেষত্ব হচ্ছে সঙ্গে বার আছে। ফরহাদ সাহেব খাবারের অর্ডার দিয়ে পর পর ছপেগ হুঁইস্কি খেয়ে চোখ লাল করে ফেললেন। আসিফ অবাক হল। ফরহাদ সাহেবের এই ব্যাপারটা তার জানা ছিল না। ভাল মানুষ ধরনের লোক ছিলেন। তার ব্যবহার এবং স্বভাব চরিত্রের সঙ্গে দুপুরবেলায় মদ্যপানটা ঠিক মানাচ্ছে না।

ফরহাদ সাহেব বললেন, আসিফ তোমরা নাটক কেন কর?

আসিফ কিছু বলল না। ফরহাদ সাহেব মুখ খানিকটা এগিয়ে এনে উত্তেজিত গলায় বললেন, পত্রিকা ওল্টাতেই দেখি গ্রুপ নাটকের মটো হচ্ছে–আমরা নাটক করি সমাজ বদলাবার জন্যে। এইসব ফালতু কথা তোমরা কেন বল? মহিলা সমিতির ফ্যানের নিচে দেড় ঘণ্টার একটা নাটক করে তোমরা সমাজ বদলে ফেলবে? সমাজ কোথায় আছে তোমরা জানো?

আসিফ হাসল। ফরহাদ সাহেব থমথমে গলায় বললেন, হেসে ফেললে? আমি কি খুব হাস্যকর কিছু বলেছি? আমার দৃঢ় বিশ্বাস সমাজ কোথায় আছে তোমরা জানো না।

আপনি জানেন? কিছুটা জানি। মাঝে মাঝে প্রচুর মদ্যপান যখন করি তখন কিছুটা ইনসাইট ডেভেলপ করে। ফরহাদ সাহেব আরো এক পেগের অর্ডার দিলেন। আসিফ একবার ভাবল বলবে–দুলাভাই বেশি হয়ে যাচ্ছে।

কিছু বলল না। ফরহাদ সাহেব গলা নিচু করে বললেন, থিয়েটার-ফিয়েটার করা। তোমার সন্ধানে সতেরো-আঠারো বছরের কচি মেয়ে আছে? যে সাতান্ন আটান্ন বছরের একজন বুড়োর সঙ্গে কোনো একটা ভালো হোটেলে এক রাত থাকবে? আছে এরকম কিছু তোমার সন্ধানে?

দুলাভাই, আপনি কি বলছেন, কিছু বুঝতে পারছি না।

বুঝতে পারবে না জানি। বুঝিয়ে দিচ্ছি। আমার আঠারো লাখ টাকার, একটা বিল আটকে আছে। আটকেছে মাত্র এক জায়গায়। যেখানে আটকেছে সেখানে যিনি আছেন তার বয়স সাতান্নআটান্ন। তিনি আমাকে ডেকে বলেছেন, লাইফ খুব ডাল হয়ে যাচ্ছে–এটাকে ইন্টারেস্টিং করার একটা ব্যবস্থা করতে পারেন?

আমি বললাম, নিশ্চয়ই পারি।

উনি বললেন, আমাকে বলতে একটু ইয়ে লাগছে…

আমি বললাম, আপনি কোনোরকম সংকোচ করবেন না। স্যার। তখন উনি বললেন, আজকাল শুনতে পাই ভেরি ইয়াং গার্লস, অনেক এ্যাডভেঞ্চারের লোভে হোটেলে হোটেলে রাত কাটাচ্ছে…বুঝতে পারছেন কি মিন করছি?

আমি বললাম, পারছি।

তিনি বললেন, জাস্ট একটা এক্সপেরিয়েন্সের জন্যে। পারা যাবে? আমি বললাম, অবশ্যই এটা কোনো ব্যাপারই না।

আসিফ বলল, আপনি কি কোনো ব্যবস্থা করলেন?

ফরহাদ সাহেব বললেন, আমি কি করলাম শোন, অফিসে এসে দরজা বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইলাম। আমার মেঝ মেয়ে সুমি.ওর বয়স সতেরো। চোখের সামনে একটা ছবি ভেসে উঠল, যেন সুমি এই লোকটার কোমর জড়িয়ে হোটেলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। মাথায় আগুন লেগে গেল। কি করলাম জানো?

কি করলেন?

ভদ্রলোকের স্ত্রীকে টেলিফোন সমস্ত ব্যাপারটা বললাম।

তারপর?

তারপরের কথা কিছু জানি না।

আপনার বিল? আপনার বিলের কি হল?

ঐসব এখন জানতে চাওয়া কী অর্থহীন না?

ফরহাদ সাহেব খাবার মুখে দিচ্ছেন। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তিনি ঘাস চিবুচ্ছেন। অনেক কষ্টে কুৎসিত কিছু গিলে ফেলার চেষ্টা করছেন। খানিক্ষণ পর পর পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে গলা ভিজিয়ে নিচ্ছেন।

আসিফ।

জি।

মনটা খুব অস্থির। কোনো কিছুই ভাল লাগে না। অফিসে বসে সারাদিন শুধু ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাই। নাটক-ফাটক দেখলে মনটা ভাল হবে নাকি বল তো? ভাল কিছু কি হচ্ছে?

আসিফ জবাব দিল না।

ফরহাদ সাহেব বললেন, রিয়েল ওয়ার্লড থেকে আনরিলে ওয়ার্লডে খানিক্ষণের জন্যে হলেও ঢুকতে ইচ্ছে করে। টিপু সুলতান, সিরাজদ্দৌলা এইসব নাটক কি আজকাল হয়, আসিফ?

মফস্বলের দিকে হয়।

তোমরা কর না কেন? ফ্যান্টাসি ধরনের জিনিস দেখতে ইচ্ছা করে। মশিয়ে লালী, নানা ফারনাবিশ, ভেরি ইন্টারেস্টিং, তাই না? তারপর একটা মেয়ে ছিল না? যে বলল–আমার বাপুজী জৌতিষ চর্চা করেন। টিপু সুলতান বলল, কে তোমার বাপুজী, কি তার পরিচয়? মেয়েটি বলল, বাপুজীকে আপনার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন তার গণনায়।

আসিফ বলল, দুলাভাই আপনার মনে হয় খানিকটা নেশা হয়ে গেছে।

ফরহাদ সাহেব সঙ্গে সঙ্গে বললেন, হ্যাঁ হয়েছে। আমি নিজেই বুঝতে পারছি। অভ্যাস নেই। তার ওপর গরমটাও পড়েছে প্রচণ্ড। অল্পতেই …চল উঠে পড়ি।

আপনি তো কিছুই খেলেন না।

ইচ্ছা করছে না। টেস্টলেস সব খাবার। মনে হচ্ছে মানুষের বমি খাচ্ছি। ভাল কথা, বমির ইংরেজি কি জানো না কি? কয়েক’দিন ধরেই ভাবছি কাউকে জিজ্ঞেস করব।–মনে থাকে না।

গাড়িতে উঠে ফরহাদ সাহেব আরো ঝিম মেরে গেলেন। আসিফ বলল, দুলাভাই আপনি কি গাড়ি চালাবেন?

ইয়েস। ভয় নেই, এক্সিডেন্ট করব না। স্টিয়ারিং হুইল ধরামাত্র আমি সোবার হয়ে যাই। তাছাড়া ধর এক্সিডেন্ট যদি করেই ফেলি, তেমন কী আর হবে?

গাড়িতে উঠে ফরহাদ সাহেব সত্যি সত্যি সোবার হয়ে গেলেন। সহজভাবে গাড়ি চালাতে লাগলেন। হাসিমুখে বললেন, ভয় কমেছে?

কমেছে।

আসিফ, তোমার জন্যে আমি একটা ব্যবস্থা করে দেব। চিন্তা করবে না। আমাকে খানিকটা সময় দাও–ধর মাস খানিক।

থ্যাংকস দুলাভাই।

কোথায় যাবে বল, তোমাকে নামিয়ে দিই।

যে কোনো এক জায়গায় নামিয়ে দিলেই হবে। আমার বিশেষ কোথাও যাবার প্রোগ্রাম নেই।

ফরহাদ সাহেব গাড়ি পার্ক করলেন। আসিফ নেমে পড়ল। ফরহাদ সাহেব বললেন, এক সেকেন্ডের জন্যে দাঁড়াও। তোমার সঙ্গে কিছু মিথ্যা কথা বলা হয়েছে। সত্যি কথাটা বলে ফেলি।

কোন বিষয়ে?

আমি ঐ লোকের স্ত্রীকে টেলিফোন করিনি। ভদ্রলোক যেমন চেয়েছেন সেই মতো ব্যবস্থা হয়েছে। গত পরশু আমি বিল পেয়েছি। যাই, কেমন?

ফরহাদ সাহেব গাড়ি নিয়ে ছুটে বের হয়ে গেলেন। রাস্তায় যানবাহনের জটলা, কিন্তু তার গাড়ি দ্রুত চলছে। আসিফ লাল রঙের গাড়িটির দিকে তাকিয়ে রইল।

একজন মানুষের সঙ্গে অন্য একজন মানুষের সম্পর্কের ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। আসিফ নিজের আত্মীয়-স্বজন কারের সঙ্গেই কেমন যেন সহজ হতে পারে না। অদৃশ্য একটা পর্দা থেকেই যায়। অথচ এই মানুষটিকে খুবই আপন মনে হয়। যদিও আসিফের বোনের সঙ্গে এই লোকটির তেমন অন্তরঙ্গতা বিয়ের এত বছরেও তৈরি হয়নি। কুৎসিত সব ঝগড়া।

অন্য বোনদের সঙ্গে তাদের স্বামীদের ভাব-টাব কেমন আসিফ জানে না। অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই বললেই হয়। মা বেঁচে থাকতে খানিকটা যোগাযোগ ছিল। মা পালা করে একেক মেয়ের বাসায় থাকতেন। ঈদ উপলক্ষে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে বোনদের সঙ্গে দেখা হত। বোনরা কড়া কড়া কথা শোনোত, যার মূল ভাব একটিই. আসিফ ভয়াবহ একটা চরিত্র। আসিফের মেজো বোন একটি কথা প্রায় সরাসরি বলে, বাবা এত সকাল মরে গেল। শুধু আসিফের কারণে। আসিফ বাবাকে কষ্ট দেয়ার জন্যেই ইচ্ছা করেই পড়াশোনা ছেড়ে দিল। নয়ত যে ছেলে ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষায় ডিসট্রিক্ট ফাস্ট হয়, সে কি করে মেট্রিক প্রথমবারে ফেল করে দ্বিতীয়বারে থার্ড ডিভিশনে পাস করে, আইএ তে কম্পার্টমেন্টাল পায়! বাবা মরে গেল। এই দুঃখে।

যে কোনো কথাই অনেকবার শুনলে সেটাকে সত্যি মনে হয়। রেসকোর্সের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এই মুহূর্তে আসিফের মনে হচ্ছে মেজো। আপার কথা সত্যি হলেও হতে পারে। বৈশাখ মাসের দুপুরে হাঁটতে হাঁটতে সে খানিকটা বিষন্ন বোধ করল। তার মনে হল সব মানুষের অন্তত একবার করে হলেও জীবন গোড়া থেকে শুরু করবার সুযোগ থাকলে ভালো হত। বড় ধরনের ভুলগুলির একটি অন্তত শোধরানো যেত।

তার সবচেয়ে বড়ো ভুল কোনটা? নাটক? আর লীনা? লীনাও কি তার মত বড়ো কোনো ভুল করেছে? একবার তাকে জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়?

আসিফ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। প্রচণ্ড পানির পিপাসা হচ্ছে। আশপাশে পানি খাবার কোনো ব্যবস্থা নেই। ঢাকা শহরের নানান জায়গায় এখন চমৎকার ফোয়ারা। এই সব ফোয়ারার পানি কি খাওয়া যায়? প্রেসক্লাবের কাছের ফোয়ারার পানি একবার এক তৃষ্ণার্তা খুব আগ্রহ করে খেতে দেখেছিল। বৃদ্ধের চেহারা বেশ সম্রােন্ত। হাতে মেডিকেল রি.ে তাঁর লোকদের মত চামড়ার ব্যাগ। সেই এই ব্যাগ রেখে ফোয়ারার পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে বেশ আয়োজন করে পানি খেল। দৃশ্যটা আসিফের এতই মজা লাগল যে এগিয়ে গেল। বৃদ্ধ খুব আন্তরিক ভঙ্গিতে আসিফকে বললেন, সরকার পানি খাওনের ভাল ব্যবস্থা করেছে। খুবই উত্তম ব্যবস্থা!

আসিফের ইচ্ছা করছে এই রকম কোনো একটা ফোয়ারার কাছে গিয়ে ঐ বৃদ্ধের মত হাতমুখ ধুয়ে খুব আয়োজন করে খানিকটা পানি খায়। লোকজন পাগল ভাববে নিশ্চয়ই। ভাবুক। মাঝে মাঝে পাগল হতে ইচ্ছা করে।

সে সত্যি সত্যি হেঁটে হেঁটে প্রেসক্লাবের কাছের ফোয়ারাটার কাছে এল। ফোয়ারা বন্ধ। শুকিয়ে খট খট করছে। কিছু জিজ্ঞেস না করতেই একজন বলল, সন্ধ্যার সময় লাল নীল বাতি জ্বালাইয়া ছাড়ে। সন্ধ্যা পর্যন্ত সে কী অপেক্ষা করবে? অপেক্ষা করলে কেমন হয়?

আসিফ নিজের পাগলামীতে নিজেই হেসে ফেলল।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ