কেনাকাটা করতে নীলু কখনো একা একা আসে না। তার সঙ্গে থাকে শাহানা কিংবা রফিক। আজ সে এসেছে একা। এবং আসার সময় সারা পথেই মনে হয়েছে গিয়ে দেখবে নিউ মার্কেট বন্ধ। সে লক্ষ করেছে, যেদিনই কোনো একটা বিশেষ কিছু কেনাকাটার থাকে, সেদিনই নিউমার্কেট থাকে বন্ধ। হয় সোমবার পড়ে যায়, কিংবা মঙ্গলবার। আজ অবশ্যি বুধবার। কে জানে এখন হয়তো নিউ মার্কেট বুধবারেই বন্ধ থাকে। অনেক দিন এদিকে আসা হয় না।

নিউ মার্কেট খোলাই ছিল। দুপুরবেলার দিকে শুধু বয়স্ক মহিলারাই বাজার করতে আসে নাকি? নীলু লক্ষ করল, তার চারদিকে খালাম্মা শ্রেণীর মহিলা। দরদাম করছে, কেনাকাটা বিশেষ করছে না। সময় কাটাবার জন্যেই আসে বোধহয়।

এক জন চকমকে শাড়ি পরা মহিলা সবকিছুর দাম জানতে জানতে এগুচ্ছে। নীলুর বেশ মজা লাগল। সে তার পেছনে পেছনে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে লাগল। অনেক দিন পর সে ঘর থেকে বের হয়েছে। ভালোই লাগছে। তার। সেও অন্যদের মতো দরদম শুরু করল। একটা ট্রাইসাইকেলের দাম করল।

কত টাকা?

তের শ টাকা।

এত দাম। বলেন কি!

বিদেশি জিনিস।–আমেরিকান। দেশিট দেখবেন আপা?

আচ্ছা দেখান।

দোকানি খুব আগ্রহ নিয়ে দেখাতে লাগল। নীলুর মায়াই লাগল। সে কিছু কিনবে না। শুধু শুধু বেচারাকে কষ্ট দিচ্ছে। এত টাকা দিয়ে বাবুর জন্যে ট্রাইসাইকেল কেনার প্রশ্নই ওঠে না।

জাপানি সাইকেল দেখবেন আপা? মিডিয়াম দামের মধ্যে পাবেন।

দেখান দেখি কেমন।

নীলু ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। একটা সাইকেল কিনতে পারলে ভালোই হত। বলে দেখবে নাকি শফিককে? না, বলাটা ঠিক হবে না। শফিক কিনে দিতে পারবে না। শেষে কষ্ট পাবে। কাউকে কষ্ট দিতে তার ভালো লাগে না।

এই, নীলু না? এখানে কী করছিস?

নীলু। তাকিয়ে রইল, মেয়েটিকে চিনতে পারল না।

এমন করে তাকাচ্ছিস কেন? চিনতে পারছিস না নাকি? চিনতে না-পারলে চড় খাবি।

বন্যা না?

বন্যা এত লোকজনের মধ্যেও ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল। প্রায় ন বছর পর দেখা। স্কুলজীবনের তার সবচে প্রিয় বন্ধু। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় দু জনে এক বার প্রতিজ্ঞা করেছিল, সারা জীবন তারা বিয়ে করবে না। কোনো পুরুষের অধীনে থাকবে না। স্বাধীনভাবে বেঁচে থেকে দেখিয়ে দেবে, মেয়েরাও ইচ্ছা করলে একা একা থাকতে পারে। করবার পর কী ভেবে যেন দু জন খানিকক্ষণ কেঁদেছিল।

বন্যা, নীলুকে জড়িয়ে ধরে কল, বিয়ে করেছিস, তাই না?

হুঁ। তুই?

আমিও করেছি। এখন বল, আমাকে চিনতে পারিস নি কেন?

বন্যা আগের মতোই আছে, তবুও কেমন যেন অন্য রকম লাগছে। কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু পরিবর্তনটা ধরা যাচ্ছে না। বন্যা বলল, কী, কথা বলছিস না কেন? আমার মধ্যে কোনো চেঞ্জ দেখছিস?

না, তেমন কিছু দেখছি না।

বলিস কি! ববকাট করেছি। গাদাখানিক চুল কেটে ফেলে দিয়েছি। তোর চোখেই পড়ল না! তোর হয়েছেটা কী বল তো?

তাই তো! পিঠভর্তি চুল ছিল বন্যার। চুলে নজর লাগবে বলে বন্যার মা কী একটা তাবিজও তার গলায় দিয়ে রেখেছিলেন। এই নিয়ে ক্লাসে কত হাসাহাসি।

চুল কেটে ফেললি কেন?

হাসবেণ্ডের সঙ্গে ঝগড়া করে কেটে ফেলেছি।

বলিস কি!

হ্যাঁ। আমার জিনিস আমি কাটব, ওর বলার কী?

তুই এখনো আগের মতোই পাগল আছিস।

আর তুই আছিস আগের মতোই বোকা। চল যাই, চা খাব।

কোথায় চা খাবি?

কোথায় আবার, রেস্টুরেন্টে।

একা একা চা খাব নাকি আমরা?

বন্যা বিরক্ত মুখে বলল, দুটা মেয়ে যাচ্ছি। আমরা, একা বলছিস কেন? আজ তুই সারা দিন থাকবি আমার সঙ্গে। ম্যাটিনিতে ছবি দেখবি?

নীলু হকচকিয়ে গেল। বন্যা বলল, নাকি স্বামীর অনুমতি ছাড়া মুভি দেখা যাবে না?

তা না। ঘরে বাচ্চা আছে।

এর মধ্যে বাচ্চাও বাধিয়ে ফেলেছিস? এমন গাধা কেন তুই?

বন্যা তাকে নিয়ে অসঙ্কোচে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে পুরুষদের ভঙ্গিতে ডাকল, এই বয়, আমাদের দু কাপ চা দাও। নীলু মৃদুস্বরে বলল, এত পুরুষদের মধ্যে বসে চা খেতে তোর অস্বস্তি লাগবে না?

অস্বস্তির কী আছে? ওরা কি আমাদের খেয়ে ফেলবে নাকি?

কেমন তাকাচ্ছে আমাদের দিকে।

তাকাক না।

তুই আগের চেয়ে অনেক স্মার্ট হয়েছিস।

স্মার্ট হতে হয়েছে। চাকরি করি তো। নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়।

চাকরি করিস?

করব না? তোর মতো ঘরে বসে বছরে বছরে বাচ্চা দেব নাকি?

নীলুর এই কথাটা ভালো লাগল না। বন্যা এমনভাবে বলছে, যেন বাচ্চা হওয়াটা একটা অপরাধ। কিন্তু বন্যাকে বড়ো ভালো লাগছে। আগের চেয়েও সুন্দর হয়েছে।

কোথায় চাকরি করছিস?

ইরানিয়ান এম্বেসিতে। রিসিপশনিষ্ট।

নীলু একবার ভাবল জিগ্যেস করে বেতন কত, কিন্তু জিগ্যেস করল না। বন্যা বলল, বেতন কত জিগ্যেস কয়লি না? নাকি জিগ্যেস করতে লজ্জা व्लনা?

বেতন কত?

তিন হাজার টাকা। যাতায়াতের একটা এ্যালাউন্স পাই। মেডিকেল এ্যালাউন্স আছে। সব মিলিয়ে চার হাজার টাকার মতো।

বলিস কি!

বেতন ভালোই। নিজের টাকা খরচ করি। ওর কাছে চাইতে হয় না। আগে ভাইয়ের বাড়িতে যাবার জন্যে পাঁচ টাকা রিকশা ভাড়া পর্যন্ত চাইতে হত। আর সে দিত এমনভাবে, যেন দয়া করছে, ভিক্ষা দিচ্ছে! এখন সে মাসের শেষে আমার কাছে ধার চায়।

বন্যা আশেপাশের টেবিলের সবাইকে সচকিত করে হেসে উঠল। নীলুর অস্বস্তি লাগতে লাগল। লোকগুলি কী ভাবছে, কে জানে। নীলু বলল, আজ তোর অফিস নেই?

না। আজ ইরানের কী এখাটা জাতীয় উৎসব। নওরোজ নাকি কি যেন বলে। চল যাই সিনেমা দেখি।

না রে, সিনেমা দেখব না।

না দেখলে না দেখবি। আমি একাই যাব।

বন্যা উঠে গেল বিল দিতে। নীলু দুঃখিত হয়ে লক্ষ করল, বন্যা এক বারও জিজ্ঞেস করল না।–তোর ছেলেমেয়ে কটি, ওদের নাম কী? নীলু বলল, বন্যা, তুই এক বার আমার বাসায় আসিস। আমার বাবুকে দেখে যাবি।

যাব। ঠিকানাটা বল, লিখে নিই।

বন্যা ঠিকানাটা লিখে নিল নিরুৎসাহ ভঙ্গিতে। যেন নোহায়েত লেখার জন্যেই লেখা। বন্যা বলল, তুই এখন কী করবি? বাসায় যাবি?

একটা জিনিস কিনব, তারপর বাসায় যাব।

কী জিনিস?

আগামীকাল ওর জন্মদিন, সেই উপলক্ষে ওর জন্যে কিছু একটা কিনব।

ও ও করছিস কেন? নাম ধরে ডাকিস না? তুই এমন গ্ৰাম্য মেয়েদের মতো করছিস কেন? পড়াশোনা করে এই লাভ হল তোর? কোন পর্যন্ত পড়েছিস?

বি. এ. পাশ করেছি। এম. এ. ভর্তি হয়েছিলাম, তারপর বিয়ে হয়ে গেল।

আর সঙ্গে সঙ্গে সংসারে ঢুকে পড়লি? পড়াশোনা মাথায় উঠল।

নীলু কিছু বলল না। বন্যা বলল, জন্মদিনের জন্যে কিছু কেনার দরকার নেই, ওতে বেশি লাই দেওয়া হয়। তাছাড়া উপহারটা তুই তোর হাসবেন্ডের টাকাতেই কিনছিস। তুই নিজের টাকায় তো দিতে পারছিস না।

নিজের টাকা পাব কোথায়?

চাকরি করলেই পাবি।

চাকরি আমাকে কে দেবো?

চেষ্টা না করেই বলছিস কে দেবে! চেষ্টা করেছিস কখনো?

নীলু কিছু বলল না। হাঁটতে লাগল বন্যার সঙ্গে সঙ্গে। বন্যা বলল, সব অফিসেই এখন মেয়েদের কোটা আছে। চেষ্টা করলেই পাওয়া যায়। ছেলেদের চাকরি পাওয়া সমস্যা, মেয়েদের চাকরি সমস্যা নয়। তুই সত্যি সত্যি চাইলে আমি চেষ্টা করতে পারি। চাস নাকি?

নীলু কিছু বলল না। বন্যা চলে গেল মুভি দেখতে। ঘরে তার এখন ফিরতে ভালো লাগছে না।

নীলু একা একা ঘুরতে লাগল। তার হাতে টাকা আছে মাত্র দু শ। দু, শ টাকায় পছন্দসই কিছু পাওয়া যায় না। হালকা বাদামী রঙের একটা শার্ট পাওয়া গেল। খুব পছন্দ হল নীলুর, দাম চাইল তিন শ টাকা। এর নিচে নাকি এক পয়সাও নামা যাবে না। নীলু মন খারাপ করে শেষ পর্যন্ত একটা লাইটার কিনল এক শ পাঁচোত্ত্বর টাকায়। শার্টটা কেনা হল না, এইজন্যে মনে একটা আফসোস বিধে রইল। ওকে শার্টটায় খুব মানাত!

 

শফিক লাইটার দেখে গম্ভীর হয়ে গেল। নীলু বলল, পছন্দ না হলে ওরা ফেরত নেবে। পছন্দ হয় নি?

পছন্দ হয়েছে।

তাহলে এমন মুখ কালো করে আছ কেন? নাও, একটা সিগারেট মুখে নাও, আমি ধরিয়ে দিচ্ছি।

শফিক একটা সিগারেট বের করে মান গলায় বলল, টাকা পয়সার এমন টানাটানি, এর মধ্যে এতগুলি টাকা বাজে খরচ করার কোনো মানে হয় না।

নীলুর খুব মন খারাপ হয়ে গেল। চোখ ভিজে উঠতে শুরু করল। শফিক বলল, এইসব জিনিস খুব হারায়। এক সপ্তাহের মধ্যেই দেখবে হারিয়ে ফেলেছি। কই, ধরিয়ে দাও।

নীলু সিগারেট ধরিয়ে দিল। এবং কিছুক্ষণ পরই বারান্দায় গিয়ে চোখ মুছে এল। অকারণে অন্যকে চোখের জল দেখানোর কোনো মানে হয় না।

বাবু জেগে উঠেছে। কাঁদছে ট্যা-ট্যা করে। নীলুঘরে ঢুকে বাবুকে কোলে তুলে নিল। ওর গা একটু গরম। কোলে উঠেও কানা থামছে না। হাত মুঠ করে কেঁদে কেঁদে উঠছে। শফিক বলল, ওকে অন্য ঘরে নিয়ে যাও, বড়ো বিরক্ত করছে।

নীলু বসার ঘরে চলে এল। শাহানা পড়ছে বসার ঘরে। সে পড়া বন্ধ করে উঠে এল… আমার কোলে দাও ভাবী। আমি কান্না থামিয়ে দিচ্ছি। এক মিনিট লাগবে।

তুমি পড়াশোনা কর, কান্না থামাতে হবে না।

আহা ভাবী, দাও না। প্লিজ।

শাহানা সত্যি সত্যি কান্না থামিয়ে দিল। চিন্তিত মুখে বলল, ওর গা বেশ গরম, ভাবী।

হুঁ। একটু গরম।

বাবাকে শুনিও না। বাবা শুনলেই বেলাডোনা–ফোন খাইয়ে দেবে। শাহানা খিলখিল করে হেসে উঠল। নীলু হাসল না।

এত গম্ভীর হয়ে আছ কেন ভাবী?

এমনি। কারণ নেই কোনো।

মন খারাপ নাকি?

না।

আজ শুনলাম পোলাও রান্না হচ্ছে। ব্যাপার কী ভাবী? মা খুব চেঁচামেচি করছিল, মাসের শেষে এত খরচ।

চেঁচামেচি কখন করলেন?

তুমি বাইরে ছিলে–নিউ মার্কেটে আজ কি কোনো বিশেষ দিন ভাবী?

বিশেষ দিন আর কি, তোমার ভাইয়ের জন্মদিন।

শাহানা মুখ টিপে হাসতে লাগল। নীলু বলল, হাসছ কেন?

এমনি হাসছি। ভাবী, তুমি ভাইয়াকে খুব ভালবাস, তাই না?

নীলু লজ্জিত হয়ে পড়ল। বাবু ঘুমিয়ে পড়েছে। নীলু বলল, ওকে শুইয়ে দাও শাহানা, ঘুমুচ্ছে।

থাকুক না একটু। কী আরাম করে ঘুমাচ্ছে, দেখ না।

পড়াশোনা করশাহানা। বাবুকে নিয়ে ঘুরতে দেখলে মা রেগে যাবেন।

রাগুক, আমি কেয়ার করি না।

নীলুরান্নাঘরে উঁকি দিল। মনোয়ারা বিরক্ত মুখে কী যেন জ্বাল দিচ্ছিলেন। নীলুকে দেখেই রেগে উঠলেন, হঠাৎ করে তোমার এমন পোলাও খাবার শখ হল কেন বল তো?

নীলু বড়ো লজ্জা পেল।

সংসারের এই অবস্থা। এর মধ্যে হুঁটহাট করে এত বাজার করা ঠিক না। সবাই অবুঝ হলে চলে? বাড়িওয়ালা বাড়িভাড়া বাড়িয়েছে।

আবার?

হ্যাঁ। এক শ টাকা বাড়িয়েছে। আর কি মিষ্টি মিষ্টি কথা! আমাকে ডাকছে বড়ো আপা। ইচ্ছা করছিল এক চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিই।

নীলু হাসতে গিয়েও হাসল না। মনোয়ারা নিজের মনে গজগজ করতে লাগলেন, ঢাকা শহরে চাকরিবাকরি করতে হলে নিজের বাড়ি থাকতে হয়। ভাড়াবাড়িতে থেকে ঢাকা শহরে চাকরি করা যায় না।

নীলু অস্পষ্ট স্বরে বলল, এক দিন হয়তো বাড়ি হবে।

মনোয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, হবেটা কী ভাবে? আকাশ থেকে টুপ করে একটা পড়বে নাকি? না তোমরা আলাউদ্দিনের চেরাগটেরাগ পেয়েছি? যাও, তোমার শ্বশুরকে জিজ্ঞেস করে এস তো, তিনি এখন দয়া করে। ভাত খাবেন। কিনা। না খেলে কখন ওনার মার্জি হবে?

মনোয়ারা আজ বিকাল থেকে হোসেন সাহেবের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন। এ রকম তিনি প্রায়ই করেন এবং হোসেন সাহেব বড়োই কাবু হয়ে পড়েন। স্ত্রীর রাগ ভাঙানোর জন্যে সম্ভব-অসম্ভব নানা রকম কায়দা করেন। আজ কিছুই করছেন না। সন্ধ্যা থেকে চাদর গায়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন। ঘর অন্ধকার; বাতি জ্বালানো হয়নি।

নীলু মৃদুস্বরে ডাকল, বাবা।

হোসেন সাহেব উঠে বসলেন।

মা জিজ্ঞেস করেছেন, ভাত খাবেন কিনা।

খাব। বলে আসা, খাব।

মার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ নাকি?

হুঁ।

কী নিয়ে ঝগড়া হয়েছে?

তেমন কিছু না। পেনশন তুলতে গিয়েছিলাম, তুলতে পারি নি। তাতেই তোমার মা গেছে ক্ষেপে। বললাম, কাল তুলব। এই ভিড়ের মধ্যে আমি বুড়ো মানুষ ধাক্কা-ধাব্ধি করতে পারি নাকি?

তা তো ঠিকই।

এই জিনিসটা তোমার শাশুড়িকে বোঝাব কীভাবে? অন্যদেরও যে শ্লেটো প্রবলেম হতে পারে, এটা সে বুঝবে না। কী মুশকিল বল তো দেখি।

হোসেন সাহেব চাদর গায়ে দিলেন। বাতি জ্বালিয়ে ঘড়ি দেখলেন। তাঁর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, তিনি কিছু বলবেন। নীলু তার শ্বশুরের এই ইতস্তত ভঙ্গিটি খুব ভালো চেনে।

কিছু বলবেন বাবা?

হুঁ। ছাদে চল তো মা আমার সঙ্গে। তোমার শাশুড়ি যেন আবার না দেখে। বড়ো সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত মহিলা, তিলকে তাল করবে।

তারা নিঃশব্দে ছাদে উঠে এল। হোসেন সাহেব নির্জন ছাদেও গলা নিচু করে তাঁর সমস্যার কথা বললেন। সেই সমস্যার কথা শুনে নীলুর মাথায় বাড়ি পড়ল।

হোসেন সাহেব পেনশন না তুলে ফিরে এসেছেন কথাটা ঠিক না। পেনশনের সাত শ এগারো টাকা তেত্রিশ পয়সা যথারীতি তুলেছেন। এবং একটা রিক্সা নিয়ে গিয়েছিলেন বায়তুল মুকাররমে এক পাউণ্ডের একটা ফুট কেক কেনবার জন্যে। ফুট কেকও ঠিকই কিনেছেন, দাম দিতে গিয়ে দেখেন পকেট ফাঁকা–একটা পয়সাও নেই। নীলু শুকনো গলায় বলল, ভালো করে পকেট দেখেছেন?

খুব কম হলেও দশ বার করে প্রতিটি পকেট দেখলাম। পকেটে টাকা না থাকলে টাকা পাওয়া যাবে না। এক বার খোঁজাও যা, এক শ বার খোঁজাও তা।

তা ঠিক।

এখন কী করি, তুমি বল বৌমা। কাল তো তোমার শাশুড়ি ঠেলোঁঠুলে আমাকে আবার পাঠাবে। পাঠাবে না?

হুঁ, পাঠাবেন।

চিন্তায় আমার খাওয়াদাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। কী করব, একটা বুদ্ধি দাও মা।

নীলু ক্ষীণস্বরে বলল, সত্যি কথাটা বললে কেমন হয় বাবা?

হোসেন সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, সত্যি কথা বললে উপায় আছে?

আমাকে টিকতে দেবে এ বাড়িতে? তুমি তোমার শাশুড়িকে কতটুকু চেন? আমি চিনি চল্লিশ বছর ধরে।

নীলু চুপ করে রইল। হোসেন সাহেব বললেন, তুমি বরং শফিককে আজ রাতে কথাটা বল। সে কাল সাত শ টাকা জোগাড় করে রাখুক। আমি তার অফিস থেকে নিয়ে আসব।

ঠিক আছে, বলব।

এইটাই হচ্ছে একমাত্র সমাধান। এর আর দ্বিতীয় কোনো সমাধান নেই।

হোসেন সাহেব হৃষ্টচিত্তে নিচে নেমে এলেন। তাঁর মনের মেঘ কেটে গেছে। খেতে বসে রান্নার খুব প্রশংসা করলেন। তাঁর কলেজ জীবনের দুএকটা মজার মজার গল্প বললেন। খাওয়াদাওয়ার পর বাড়িওয়ালার বাসায় রওনা হলেন। খানিকক্ষণ টিভি দেখবেন।

মনোয়ারা বিরক্ত হয়ে বললেন, লজ্জা লাগে না পরের বাড়িতে বসে টিভি দেখতে?

এর মধ্যে লজ্জার কী আছে?

রোজ রোজ অন্যের বাড়িতে গিয়ে বসে থাকার মধ্যে লজ্জার কিছু 6নাाग्ने?

না, কিছুই নেই। তাছাড়া ওরা আমাকে পছন্দ করে। বাড়িওয়ালার মেয়েটা আমাকে চাচাজান ডাকে। রশীদ সাহেবও আমাকে খুব খাতির করে।

বাজে বকবক করবে না। দুনিয়াসুদ্ধ লোক;তোমাকে খাতির করে। যা মনে আসে বলেই খালাস। আজ কোথাও যেতে পারবে না, বসে থাক q夺忆可!

বসে থেকে করবটা কী?

যা ইচ্ছা কর।

হোসেন সাহেব দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন, তবে খুব একটা বিচলিত হলেন না। মনোয়ারা কথা বলা শুরু করেছেন, এটা একটা সুলক্ষণ। তিনি তাঁর হোমিওপ্যাথি বই নিয়ে বসলেন। গভীর মনোযোগের সঙ্গে পড়তে শুরু করলেন। এক ফাঁকে নীলুর কাছ থেকে সিগারেট নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে টেনে এলেন। তাঁকে দেখে মনে হল তিনি একজন সুখী পরিতৃপ্ত মানুষ। তাঁর কোনো দুঃখ-কষ্ট নেই। এই পৃথিবীতে বাস করতে পেরে তিনি আনন্দিত।

শাহানা লক্ষ করল, বই পড়তে পড়তে হোসেন সাহেব গুনগুন করে গান গাইছেন। গানের কথাগুলো বোঝা যাচ্ছে না, তবে না গো না গো এই শব্দগুলি আছে। শাহানার বড়ো মজা লাগল। বাবার মনে এত ফুর্তি কেন কে জানে; মাঝে মাঝেই তাঁর মধ্যে এমন ফুর্তির ভাব আসে। শাহানা বলল, তোমাকে এত খুশি-খুশি লাগছে কেন বাবা? হোসেন সাহেব জবাব না। দিয়ে পা নাচাতে লাগলেন।

 

নীলু পেনশনের ব্যাপারটা কী করে বলবে বুঝতে পারছে না। আজকের দিনটিতে শফিককে কোনো খারাপ খবর দিতে ইচ্ছা করছে না। হঠাৎ করে বেচারা এক দিনের মধ্যে সাত শ টাকা জোগাড় করবে। কী ভাবে?

শফিক ঘুমুবার আয়োজন করছে। শেষ সিগারেটটি ধরিয়েছে। এখন সে খানিকক্ষণ পায়চারি করবে। নীলু হালকা গলায় বলল, আজ আমার এক বান্ধবীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল——বন্যা নাম। শফিক কিছু বলল না। নীলু বলল, তোমাকে তো তার কথা বলেছিলাম, এক পুলিশ ইন্সপেকটরেব মেয়ে। খুব ছটফট করত। সারাক্ষণ কথা বলত। ক্লাসে ওর নাম ছিল ফর ফরানি! প্ৰায় ন বছর পর ওর সঙ্গে দেখা। অবিকল আগের মতোই আছে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। সারাক্ষণ বকবক করেছে ও আবার চাকরিও করে–চার হাজার টাকার মতো পায়।

শফিক কিছু বলল না। মশারি তুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল। সহজ স্বরে বলল, বাতি নিভিয়ে দাও নীলু তোমার ঘুমুতে দেরি আছে নাকি?

না, আমিও শোব।

নীলু বাতি নিভিয়ে শফিকের গা ঘেঁষে ঘুমুতে গেল। শফিক হেসে বলল, কী ব্যাপার, আজ আমার সঙ্গে কেন? নীলু, লজ্জিত স্বরে বলল, কেন, তোমার সঙ্গে আমি ঘুমাই না? তুমিই তো টুনিকে রেখে দাও মাঝখানে!

শফিক হাত বাড়িয়ে নীলুকে আকর্ষণ করল। পুরুষদের এই আকর্ষণের অর্থ পৃথিবীর সব নারীদেরই জানা। নীলু জড়িয়ে ধরল শফিককে। চারদিক অন্য রকম হতে শুরু করল। শারীরিক ভালবাসাও এক ধরনের ভালবাসা। এ ভালবাসাও নীলুর ভালো লাগে। এই সময়টাতেই শফিক তরল ভঙ্গিতে কিছু কথাবার্তা বলে। প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে জবাব দেয়। হাসির কথা বললে হাসে।

আমার এই বন্ধু কী বলছিল, জান?

কী বলছিল?

আমাকে বলছিল একটা চাকরি-টা করি জোগাড় করতে। চেষ্টা করলেই নাকি পাওয়া যায়।

তুমি কী বললে?

আমি আবার কী বলব? কিছুই বলি নি।

নীলু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, চাকরি একটা পেলে মন্দ হয় না, কী বল?

ভালোই হয়। সংসারের টানাটানি দূর হয়।

চেষ্টা করে দেখব নাকি?

শফিক তরল স্বরে বলল, তুমি কি চাকরি করতে পারবো? পারব না কেন?

চাকরি করার মেয়ে অন্য রকম হয়। তুমি সেই টাইপ না। তুমি গৃহী টাইপ মেয়ে।

আমি ঠিকই পারব। গৃহী টাইপ হই আর যাই হই।

আচ্ছা, দেখা যাবে।

শফিক এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল। নীলু জেগে রইল অনেক রাত পর্যন্ত। নানা রকম স্বপ্ন দেখতে লাগল। মন্দ হয় না একটা চাকরি পেলে। সংসারের কষ্ট দূর হয়। মাসে মাসে মাকে কিছু টাকা পাঠানো যায়। একটা টেলিভিশন কেনা যায়। টিভি দেখার জন্যে বাবাকে তাহলে আর রোজ রোজ অন্যের বাড়ি যেতে হয় না। রফিকের হঠাৎ আসা আব্দার মেটানো যায়। শাহানাকে গলার একটা চেইন বানিয়ে দেওয়া যায়। এত বড়ো মেয়ে, অথচ কানে দুটি ছোট্ট ফুল ছাড়া কোনো সোনার গয়না নেই। গয়না দূরের কথা, একটা ভালো শাড়ি পর্যন্ত নেই। গত ঈদে সে লাজুক ভঙ্গিতে বলেছিল, ভাবী, আমাকে একটা কমলা রঙের রাজশাহী সিস্কের শাড়ি কিনে দেবো?

নীলু বলেছে, হ্যাঁ, দেব। নিশ্চয়ই দেব।

আমাদের ক্লাসের অরুণার এ-রকম একটা শাড়ি আছে। অবিকল সে-রকম একটা শাড়ি চাই।

ঠিক আছে।

তোমাকে আমি প্রিন্টটা দেখিয়ে দেব।

শাহানা প্রিন্ট দেখিয়েও দিল, কিন্তু সেই শাড়ি কেনা হল না। হল না বলা ঠিক না, বলা উচিত কিনে দেওয়া গেল না। শাহানা কিছুই বলল না। শুধু নীলু লজ্জায় এবং দুঃখে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে ঈদের দিন ভোরবেলায় দীর্ঘ সময় কেঁদেছিল। কত রকমের দুঃখই না আছে মানুষের!

এক দিন শাহানার হয়তো খুব বড়ো লোকের ঘরে বিয়ে হবে। ভাইয়ের বাড়ির ছোটখাট দুঃখ-কষ্টম নাই থাকবে না। কিন্তু নীলুর মনে তো এই দুঃখ থাকবেই। প্রতিটি ঈদের দিনে ভোরবেলা মনে পড়বে।

নীলু সাবধানে বিছানা ছেড়ে উঠল। একটা বেজেছে। বাবুর জেগে ওঠার সময় হয়েছে। এক্ষুণি দুধ খাওয়ার জন্যে কাঁদতে শুরু করবে। দুধ বানিয়ে রাখাই ভালো।

বসার ঘরে শাহানা পড়ছে। খুব খাটাখাটনি করছে। নিশ্চয়ই ভালো করবে পরীক্ষায়। নীলু দরজা খুলে বেরুতেই শাহানা বলল, তুমি এখনো জেগে আছ?

হুঁ! পড়াশোনায় দারুণ উৎসাহ দেখি।

তুমি কি চাও, আমি ফেল করি?

না, তা চাই না। পড়তে পড়তে মাথা খারাপ করে ফেল, তাও চাই না!

শাহানা বই বন্ধ করে উঠে এল।

ভাবী, একটা কথা বলব?

বল।

বাবা তোমাকে ছাদে নিয়ে কী বলল?

তেমন কিছুনা।

না ভাবী, বল। তোমার পায়ে পড়ি।

নীলু অল্প হেসে বলল, তোমার বিয়ের ব্যাপারে কথা বললাম।

সব সময় ঠাট্টা ভালো লাগে না ভাবী।

ঠাট্টা কোথায়, সত্যি কথা বললাম।

না ভাবী, বল কী ব্যাপোর?

বললাম তো, একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছে, তাই নিয়ে কথা হচ্ছিল। ছেলে বিলেতে ডাক্তারি পড়ে। দেখতে খুব সুন্দর। ছবি আছে আমার কাছে, তুমি চাইলে ছবি দেখাতে পারি।

কসম বল।

কসম।

তিন কসম!

তিন কসম আবার কী।

শাহানার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হল। সে ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছে না। আবার অবিশ্বাসও করতে পারছে না। তার মুখ কাঁদো-কাঁদো হয়ে গেল। নীলু হাসতে হাসতে বলল, ঠাট্টা করছিলাম। মনে হয় তোমার আশাভঙ্গ হয়েছে?

শাহানা ছুটে এসে নীলুর চুল টেনে দিল, কেন তুমি এমন আজেবাজে ঠাট্টা কর! আমি প্ৰায় বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম। দেখ, এখনো আমার গা কাঁপছে। নীলু শাহানাকে জড়িয়ে ধরল।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ