রফিকের মনে ক্ষীণ আশা ছিল, শারমিনের আচার-আচরণে একটি পরিবর্তন লক্ষ করবে। বড়ো ধরনের কিছু না হলেও চোখে পড়বার মতো। পরিচিত ভঙ্গিতে একটু হাসবে কিংবা করিডোরে দেখা হয়ে গেলে বলবে।–কী, কেমন আছেন?

অথচ শারমিন আগে যেমন ছিল এখনো তেমন। গম্ভীর হয়ে ক্লাসে আসে। লেকচার শেষ হওয়ামাত্রই বিদায়। রফিকের আশা ছিল, ডিপার্টমেন্টাল পিকনিকে সে যাবে, তখন এক ফাঁকে কিছু কথাবার্তা বলা যাবে। কী ধরনের কথাবার্তা বলবে, তাও সে ভেবে রেখেছে। যেমন,

জন্মদিন কেমন হল?

ভালোই। কবিতার বইটির জন্যে ধন্যবাদ। আমি ভাবতেই পারি নি আপনি আমার জন্মদিন কবে সেটা জানেন।

অনেক ঝামেলা করে বের করেছি। গরাজটা যখন আমার।

আপনার গরজ, তার মানে?

মানে কিছু নেই।

ভেবে রাখা কথা কিছুই বলা হয় নি। শারমিন যায় নি পিকনিকে, অথচ এক শ টাকা চাঁদা দিয়েছে। চাঁদা দিয়ে না যাওয়া হচ্ছে একটা বড়লোকী দেখানো। রাগে গা জ্বলে গেছে রফিকের। পিকনিকের সমস্ত আয়োজনটা তার করা। টাকাটা ফেরত দিয়ে অপমান করে দু-একটা কড়া কড়া কথা বলা যায়। খুব ঠাণ্ডা গলায় বলা যেতে পারে, আপনার টাকা আছে জানি। কিন্তু টাকার খেলাটা এভাবে না দেখালেও পারতেন। টাকার খেলা আর যাকে দেখান, দেখান–আমাদের দেখাবেননা।

রফিক ভেবে পেল না, কথাটা ইউনিভার্সিটিতে বললে ভালো হবে, না বাড়িতে গিয়ে বলবে। অনেক ভেবেচিন্তে সে বাড়িতে যাওয়াই ঠিক করল। তো যাচ্ছে না, একটা কাজে যাচ্ছে। ইতস্তত বোধ করার কিছুই নেই।

কিন্তু রফিক ইতস্তত করতে লাগল। গেটের কাছে এসেও মনে হল কাজটা ঠিক হচ্ছে না, ফিরে যাওয়াই ভালো। আবার ফিরে যেতেও ইচ্ছা করছে না। এত দূর এসে ফিরে যাবার মানে হয় না।

রহমান সাহেবের মেয়ে বাসায় আছে?

জ্বি, আছেন। যান, কুকুর কিছু করবে না। আপনি সোজা চলে যান। কলিং বেল টিপ দেন।

দারোয়ান তাকে চিনতে পারছে না; তার চেহারা কি এতই সাধারণ যে মাত্র দু সপ্তাহ আগে দেখাও গুবলেট করে ফেলেছে। দারোয়ান একা নয়, কুকুরটা পর্যন্ত তাকে চিনতে পারছে না। অথচ নিম্নশ্রেণীর পশুদের নাকি স্মৃতিশক্তি খুব ভালো। এক বার কোনো একটি জিনিসের ঘাণ নিলে একটা কুকুর নাকি সারা জীবন সেটা মনে রাখে। এই কুকুরটার সেদিন সর্দি ছিল বোধ হয়। সেদিন যেমন শুকতে শুকতে আসছিল, আজিও তাই আসছে।

গতবার বেল টিপতেই দরজা খুলে দিয়েছিল শারমিন। আজও তাই হবে নাকি?

না, সে-রকম হল না। বয়স্ক এক জন মহিলা দরজা খুলল! কাজের মেয়ে, না আত্মীয়স্বজনদের কেউ? আত্মীয়স্বজনদের কেউ হলে সালাম দেয়া দরকার। রফিক নরম স্বরে বলল, শারমিন আছে?

জ্বি, আছে।

একটু বলেন, রফিক এসেছে।

বসেন। খবর দেই।

রফিক এন্ট্রিরুমে বসে রইল। তারা মনে হতে লাগল।–যেসব কড়া কড়া কথা সে ভেবে রেখেছে সেসব বলাটা বোধহয় ঠিক হবে না! কারো বাড়িতে এসে অভদ্র হওয়া যায় না। তাছাড়া পিকনিকে না-যাবার তার নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। অসুখবিসুখ হতে পারে। জরুরী কাজকর্ম থাকতে পারে, না-জেনে হাউ হাউ করা ঠিক না। রফিক বেশ অনেকক্ষণ বসে রইল।

যে-মহিলাটি বসতে বলেছে সে এল না, অল্পবয়েসী একটি মেয়ে এসে বলল, আপামনি বাসায় নাই।

তার মানে?

রফিকের বিস্ময়ের সীমা রইল না। সে কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। মেয়েটি দ্বিতীয় বার বলল, আপামনি বাসায় নাই। রফিক উঠে দাঁড়াল। কিছু একটা বলা উচিত। কিন্তু কিছুই মনে আসছে না।

তোমার আপাকে বলবে, মিথ্যা কথা বলবার কোনো দরকার ছিল না। দেখা করবে না বললেই চলে যেতাম।

রফিকের ইচ্ছা করছে ছুটে পালিয়ে যেতে, কিন্তু তা সম্ভব নয়। তাকে হেঁটে হেঁটে গেট পর্যন্ত যেতে হবে। এই বিশাল বাড়ির কম্পাউণ্ড থেকে বেরুতেও সময় লাগবে।

রফিক, তোমার শরীর খারাপ হয়েছে নাকি?

 

সারাদিন শুয়ে আছে। ব্যাপার কি?

না।

সারাদিন শুয়ে আছ। ব্যাপার কি?

ব্যাপার কিছু না।

আমার তো মনে হয় তোমার জ্বরটির কিছু হয়েছে। চোখ লাল।

তোমার মনে হলেই তো হবে না ভাবী। আমারো মনে হতে হবে। আমার মনে হচ্ছে শরীর ঠিকই আছে।

তুমি উঠে আস, তোমাকে ডাকছেন।

কে ডাকছেন?

কবির মামা। ঘণ্টাখানিক আগে এসেছেন। কী, আসবে না?

কবির মামা তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। এসেছেন যখন, ইনশাআল্লাহ মাসখানিক থাকবেন। ধীরেসুস্থে আসছি।

রফিক তার পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল?

কবির মামার বয়স প্রায় ষাট। ছোটখাট মানুষ। থুতনিতে অল্প কিছু দাড়ি আছে; মাথার চুল, দাড়ি-সমস্তটাই ধবধবে সাদা। স্বাস্থ্য বয়সের তুলনায় অনেক ভালো, এবং যতটা-না ভালো, তিনি নিজে মনে করেন তার চেয়েও ভালো–যার জন্যে মাঝে মাঝে গুরুতর ঝামেলার সৃষ্টি হয়।

আজও এ-রকম একটা ঝামেলা বাধিয়েছেন। ছটা ঝুনা নারিকেল নিয়ে কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে কল্যাণপুর পায়ে হেঁটে চলে এসেছেন। এ-রকম একটা কাণ্ড করার পেছনে একমাত্র যুক্তি হচ্ছে, কোনো বাস কণ্ডাকটার নারিকেল হাতে বাসে উঠতে দিতে রাজি হয় নি। এক জন রাজি হয়েছিল, কিন্তু সে নারিকেলের জন্যে আলাদা ভাড়া দাবি করায় কবির মামা রেগে আগুন হয়ে যান এবং হাঁটতে শুরু করেন। কল্যাণপুর এসে পৌঁছতে তার পৌনে চার ঘণ্টা সময় লাগে।

বাসায় ঢুকেই তিনি সোফায় লম্বা হয়ে পড়েছেন। উঠে দাঁড়াতে পারছেন না। কোমরের একটা পুরানো ব্যথা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।

মনোয়ারা বললেন, পিঠে তেল মালিশ করে দেবো?

দিক। বৌমাকে বল তেল গরম করতে। হোসেন কোথায়?

পেনশনের টাকা তুলতে গেছে। এসে পড়বে।

আসুক, তার সঙ্গে আমার বোঝাপড়া আছে।

চা করে দিক?

চা না। লেবু দিয়ে এক গ্লাস সরবত করে আনতে বল!

নীলু পিঠে তেল মালিশ করতে বসল। কবির মামা ক্ষীণ স্বরে বললেন, মানুষের সেবা। আমি নিই না, লজ্জা লাগে। মা, তোমার সেবা নিতে লজ্জা লাগে না। মনে হয় এই সেবাটাতে আমার অধিকার আছে।

অধিকার তো আছেই।

না গো মা,অধিকার নেই। দুই মাস আগে তোমার একটা মেয়ে হল। আমাকে কেউ একটা খবর দেয় নি। এখানে এসে জানলাম মেয়ে হবার খবর।

নীলু খুব লজ্জা পেল। মনোয়ারা সরে গেলেন। কবির মামা গম্ভীর গলায় বললেন, বুঝলে বৌমা, সত্যিকার আত্মীয়তা সম্পর্ক নেই তো, সে জন্যেই এই অবস্থা। যখন উপস্থিত হই, তখন আমার কথা মনে হয়। শফিকের বিয়ের কার্ড পাই বিয়ের এক সপ্তাহ পর।

নীলু চুপ করে রইল।

বিয়ের পর হঠাৎ মনে পড়েছে–আরে, কবির মামাকে তো বলা হয় নি–তখন একটা কার্ড পাঠিয়ে দিয়েছে।

নীলুদৃঢ়ম্বরে বলল, আর এ-রকম ভুল হবে না মামা!

না হওয়াই উচিত। ভালোবাসার জবাব ভালোবাসা দিয়েই দিতে হয়। রফিক আসছে না কেন? এই রফিক, রফিক।

রফিক উঁকি দিল।

আছ কেমন মামা?

ভালোই আছি!

কোমর ভেঙে ফেলেছি নাকি?

কবির মামা জবাব দিলেন না।

দেখি, পাটা দাও, সালাম করি। নয়তো পরে ক্যাটক্যাট করবে।

তোর অসুখবিসুখ নাকি?

না।

এ-রকম গম্ভীর হয়ে আছিস কেন? মনে হয় বিরক্ত।

বিরক্ত না হয়ে উপায় আছে? তুমি এসেছ, ঘরটা ছেড়ে দিতে হবে তোমাকে। সোফায় আমি ঘুমাতে পারি না।

আয়েশী হয়ে গেছিস মনে হয়? পরীক্ষা কবে?

এপ্রিল মাসে।

প্রিপারেশন কেমন?

সেকেণ্ড ক্লাস টাইপ। আমি তো মামা লাইফ লং সেকেণ্ড ক্লাস ছাত্র।

পড়াশোনা ছাড়া অন্য কোনো বিষয় নিয়ে আলাপ করতে চাইলে কর।

পড়াশোনার আলাপ করতে ভালো লাগে না?

না।

যা আমার সামনে থেকে।

রফিক খুশি মনেই বের হয়ে গেল। কবির মামা বহু কষ্টে উঠে বসলেন। ব্যথা অনেকখানি কমেছে। এখন আর একে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। এসব জিনিস প্রশ্রয় দিলেই বাড়ে।

এবার তোমার কন্যাকে নিয়ে এসে গো ম।

নীলু তার মেয়েকে নিয়ে এল।

চশমাটা দাও। চশমা ছাড়া ভালো দেখি না।

বাবুকে দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে গেলেন। বারবার বলতে লাগলেন-—তোমার এই মেয়ে শাহানার মতো রূপসী হবে। বড়ো সুন্দর। গোলাপ ফুলের মতো লাগছে।

আপনি মামা দোয়া করবেন।

এই যুগে মা, দোয়াতে কাজ হয় না। কোনো যুগেই হয় না। কাজ হয় কর্মে। কর্ম ঠিক রাখবে, তাহলেই হবে। নাম কী রেখেছ মেয়ের?

এখনো রাখা হয় নি। বাবা রেখেছেন টুনি।

টুনি ফুনি আবার কী রকম নাম?

আপনি একটা নাম রাখেন মামা।

আমার নাম কি আর পছন্দ হবে?

পছন্দ হবে, আপনি রাখেন।

কবির মামা কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, ভোজল্লি! ভোজল্লি রাখ। এর মানে হচ্ছে আল্লাহর জ্যোতি।

নীলুর মুখ শুকিয়ে গেল। ঠিক তোজলি পূরনের নাম সে আশা করে নি।

নাম পছন্দ হয়েছে তো মা?

জ্বি, হয়েছে।

তাহলে ভোজল্লিই রাখা!

তিনি ফতুয়ার পকেট থেকে একটা এক শ টাকার নোট বের করে মেয়ের মুখ দেখলেন। এই এক শ টাকাই ছিল তাঁর সঙ্গে।

রাতে কবির মামার জ্বর এসে গেল। বেশ ভালো জ্বর। হোসেন সাহেব বললেন, এক ডোজ আনিকা খাবে? ব্যথা সেরে যাবে।

তিনি বিরক্ত স্বরে বললেন, কয়েকটা জিনিসে আমার বিশ্বাস নেই, হোমিওপ্যাথি তার মধ্যে একটা!

তাহলে ডাক্তার ডেকে আনুক।

এই দুপুর রাতে ডাক্তার ডাকতে হবে না। তোমরা ঘুমাতে যাও!

রাতে তিনি কিছু খেলেন না। নীলু এক গ্লাস দুধ নিয়ে গিয়েছিল। তিনি ছুঁয়েও দেখলেন না।

দুধ শিশুদের খাবার, মা। দেশে দুধের অভাব। আমরা বুড়োরাই যদি সব দুধ খেয়ে ফেলি, ওরা খাবে কী?

রফিক বিরক্ত হয়ে বলল, তুমি এক গ্লাস দুধ খেলে ওদের কম পড়বে না?

এক গ্লাস এক গ্লাস করেই লক্ষ গ্লাস হয়। ঠাণ্ডা মাথায় সব কিছু বিচার করতে হয়। একটা রাত উপোস দিলে শরীর ঝরঝরে হয়ে যাবে। উপোসের মতো বড়ো অষুধ কিছু নেই।

কবির মামার ঢাকা আসার উদ্দেশ্য দ্বিতীয় দিনে জানা গেল। তাঁর মাথায় বিরাট একটা পরিকল্পনা এসেছে। তিনি নীলগঞ্জকে সুখী নীলগঞ্জ বানাতে চান। নীলগঞ্জের সব মানুষকে তিনি সুখী দেখতে চান। সেখানে কোনো দুঃখ থাকবে না। সবাই দু বেলা ভাত খাবে। সবটাই তিনি করবেন স্বেচ্ছাশ্রমের বিনিময়ে। তাঁর পুরানো ছাত্রদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে। মনোয়ারা বললেন, আপনার তো ভাইজান এখন বিশ্রামের সময়। রিটায়ার করেছেন, এখন বিশ্রাম করবেন।

শুয়ে থাকলেই বুঝি বিশ্রাম হয়? বিশ্রাম হচ্ছে কাজে। একটা ভালো কাজ করার মধ্যে বিশ্রাম আছে। শফিক, কী বলিস?

শফিক কিছু বলল না।

হোসেন, তোমার কি মত?

ভালোই তো।

ভালোই তো বলছি কেন? আইডিয়া পছন্দ হচ্ছে না? মরবার আগে যদি এটা করে যেতে পারি তাহলে কাজের মতো কাজ হয়। কিছুই তো করলাম না জীবনে।

কিছুই কর নি-কথাটা তো ঠিক বললে না। হাজার হাজার ছাত্র তৈরি করেছি। এটা তো কম না।

নীলগঞ্জের এই কাজটাও করতে চাই। আমাকে দেখে অন্যরা উৎসাহী হবে। বাংলাদেশে হাজার হাজার নীলগঞ্জ হবে। দেশ নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যাবে। ঠিক কিনা বল।

ঠিক।

একটা বড়ো জাবদা খাতা কিনেছি। ছাত্রদের সব নাম-ঠিকানা বের করে করে লিখছি। এদের সবার কাছে চিঠি দেব, তারপর দেখা করব। কাজে নেমে পড়তে হবে। কত দিন বাঁচি তার ঠিক নেই কোনো।

তিনি সবার সঙ্গেই মহা উৎসাহে নীলগঞ্জ নিয়ে আলাপ করলেন। রফিক শুধু বাদ পড়ল। রফিকের সঙ্গেও তুলতে চেয়েছিলেন, রফিক হাই তুলে বলল, এইসব বোগাস আদর্শবাদী স্বপ্নের কথা শুনতে আমার ভালো লাগে না, মামা।

বোগাস।

বোগাস তো বটেই। এক জন রিটায়ার্ড স্কুলমাস্টার বাংলাদেশের চেহারা পাল্টে ফেলবো?

বাংলাদেশের কথা তো বলছি না। নীলগঞ্জের কথা বলছি।

তোমাকে দিয়ে এসব হবে না মামা। এই বয়সে খামোক দৌড়াদৌড়ি করে শরীর নষ্ট করবে। এমনিতেই কোমর ভেঙে কাত হয়ে আছে।

কবির মামা দুদিন ঢাকা থাকলেন। ফিরে যাবার ভাড়া ছিল না। শফিকের কাছ থেকে ত্ৰিশ টাকা ধার করলেন।

ধারের টাকা সাত দিনের মধ্যে ফেরত এল। মনি অর্ডারের কুপনে তোজল্লি নামের আরবি বানান, বুৎপত্তিগত অর্থ বিশদভাবে লেখা। সেই সঙ্গে লেখা–আমার পুরনো কোনো ছাত্রের সঙ্গে দেখা হলে অবশ্যই তার নাম-ঠিকানা লিখে রাখবে। ভুল হয় না যেন।

 

সব মানুষের মধ্যেই কিছু রহস্য থাকে।

অমীমাংসিত রহস্য। কবির মামার মধ্যে সেই রহস্যের পরিমাণ কিছু বেশি। তাঁর বাড়ি চৰ্বিশ পরগণার বারাসাতে। বারাসাত থেকে এগার মাইল র বনগ্রামের এক স্কুলে মাস্টারি করতেন। ভাদ্র মাসের এক ভোরবেলায় হঠাৎ তাঁর মধ্যে বৈরাগ্য এসে গেল। ক্যান্বিসের ব্যাগ এবং একটি ছাতা নিয়ে গৃহত্যাগ করলেন। কাউকে কিছু বলে গেলেন না।

পথে বিধু মল্লিকের সঙ্গে দেখা। বিধু মল্লিক বলল, সাত সকালে কোথায় যান? মাস্টার তার জবাবে ফ্যাকাসেভাবে হাসলেন। পরিষ্কার কিছু বললেন না। বিধু মল্লিক বলল, হাবড়া যান নাকি?

হুঁ।

রাতে ফিরবেন না?

হুঁ, ফিরব।

কিন্তু তিনি ফিরলেন না। সেটা বাংলা তেরশ বাহান্ন সন। ভারতবর্ষের ক্রান্তিকাল। দীর্ঘদিন তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না।

প্রায় এক যুগ পর ইংরেজি উনিশ শ চুয়ান্ন সনে তাঁকে দেখা গোল ময়মনসিংহের নীলগঞ্জে। মাইনর স্কুলের প্রধান শিক্ষক। মুখভর্তি দাড়িগোঁফ। অত্যন্ত রাশভারি প্রকৃতির মানুষ, কাজকর্মে খুব উৎসাহা। ছ মাসের মধ্যে স্কুলের চেহারা পাল্টে ফেললেন। কোদাল দিয়ে মাটি কুপিয়ে স্কুল কম্পাউণ্ডের সামনে চমৎকার একটা ফুলের বাগান করলেন। গ্রামের সুকুমান বলাবাল করতে লাগল–তোলসমাতি কাণ্ড। করছে কী পাগলা মাস্টার?

সেবার শীতে ময়মনসিংহ থেকে স্কুল ইন্সপেক্টর জমীর আলি সাহেব স্কুল ইন্সপেকশনে এলেন। বাগান দেখে অবাক হয়ে বললেন, এই বাগান আপনার করা?

জি, স্যার।

নিজের হাতেই করেছেন?

ছাত্ররা সাহায্য করেছে। নিজেও করেছি।

জমীর আলি সাহেব ফিরে গিয়ে স্কুলের সরকারী সাহায্য বাড়িয়ে দিলেন। শুধু তাই না, ময়মনসিংহ জেলার সব কটি মাইনর স্কুলের হেড মাস্টারকে ব্যক্তিগত চিঠি পাঠালেন। যার সারমর্ম হচ্ছে–ছাত্রদের মানসিক বিকাশ সাধনের জন্যে প্রতিটি স্কুলে ফুলের বাগান থাকা বাঞ্ছনীয়। ফুল ছাত্রদের মনোজগতের উন্নতি ও সৌন্দর্যস্পৃহা বৃদ্ধির সহায়ক ইত্যাদি।

অজ পাড়াগাঁর একটি দরিদ্র দীনহীন স্কুলে রকমারি ফুলের সমারোহ জমীর আলি সাহেবকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করেছিল, যার জন্যে তিনি পরের বছরই আবার স্কুল ইন্সপেকশনে এলেন এবং স্তম্ভিত হয়ে দেখলেন ফুলের কোনো চিহ্নই কোথাও নেই। সে জায়গায় নানা ধরনের সবজির চাষ করা হয়েছে। জমীর আলি থমথমে গলায় বললেন, কী ব্যাপার? কবির মাস্টার গম্ভীর হয়ে বললেন, দরিদ্র দেশে ফুলের বিলাসিতা ঠিক না। শাক-সবজি বিক্রি করে কিছু পয়সা হয়। সেই পয়সা ছাত্রদের পিছনে খরচ করা হয়। সবাই এখানে খুব দরিদ্র।

জমীর আলি রাগী গলায় বললেন, দরিদ্রদের সৌন্দর্যবোধ থাকবে না?

জ্বি-না। আগে পেটে ভাত, তারপর অন্য কিছু। এখানে আমার অনেক ছাত্র আছে, যারা আজ স্কুলে না–খেয়ে এসেছে।

জমীর আলি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ফুলগাছগুলি আপনি কি নিজের হাতেই নষ্ট করেছেন?

জ্বি স্যার।

আপনার কষ্ট হয় নি?

জ্বি—না।

পাগল নাকি আপনি! আমি কত জায়গায় আপনার ফুলের বাগানের প্রশংসা করেছি, আর আপনি কিনা সব উপড়ে লাউ, কুমড়া লাগিয়েছেন, আবার বলছেন কষ্ট হয় নি। আপনাকে বোঝা মুশকিল। ইউ আর এ ভেরি স্ট্রেঞ্জ ম্যান।

নীলগঞ্জের লোকেরাও বোধহয় তাঁকে বিচিত্র মানুষ হিসেবেই জানে। জীবন প্ৰায় পার করে দিয়েছেন। এখানে। এখানকার সবাই তাঁকে চেনে, পাগলা মাস্টার হিসেবে। দেখে একটু অন্য রকম চোখে। শ্রদ্ধা-ভালোবাসার সঙ্গে তাদের সেই দৃষ্টিতে কিছু ভয়ও হয়তো থাকে।

গ্রাম্য বড়ো বড়ো সালিসিগুলিতে তাঁকে থাকতে হয়। সমস্যার যখন কোনো রকম মীমাংসা খুঁজে পাওয়া যায় না, তখন এক জন কেউ বলে–মাস্টার সাব যা বলেন, তা-ই কবির মাস্টারকে তখন কিছু একটা বলতে হয়। এবং তাঁর কথাই হয় সালিসির শেষ কথা। তাঁর মীমাংসা যাদের পছন্দ হয় না, তারাও চুপ করে থাকে। শুকনো মুখে বলে, আচ্ছা ঠিক আছে, মাস্টার সাব বলছেন, এর উপর আর কথা কী? মাস্টার সাবের কথার একটা ইজ্জত আছে না? এক জন মানুষের জন্যে এটা হয়তো তেমন বড়ো কোনো সম্মান নয়, আবার হয়তো ঠিক তুচ্ছ করবার মতোও কিছু নয়।

ভাটি অঞ্চলের মেয়ে বিয়ে করে এনেছে নীলগঞ্জের একজন কেউ। শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে তার বিবাদ। স্ত্রীকে নাইয়ার যেতে দিচ্ছে না। দু বছর হয়ে গেল বাপের বাড়ি যেতে পারছে না মেয়েটি। কোনো উপায় না-দেখে এক সময় সে মাস্টার সাহেবের কাছে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়াবে।

মাস্টার সাহেব বলবেন, কার বাড়ির বৌ তুমি? কোনো দিন তো দেখি নি। বৌটি ক্ষীণস্বরে বলবে, মিয়াবাড়ির।

ও, আচ্ছা–সোলায়মানের বৌ। বাটিতে করে কী এনেছ গো মা?

মাছের সালুন।

ভালো, খুব ভালো। রাত্রে আরাম করে খাব। রেখে দাও।

বৌটি তরকারির বাটি রেখে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

আর কিছু বলতে চাও নাকি? বলে ফেল, মা। ছেলের কাছে লজ্জার কিছু নেই।

বৌটি তার সমস্যার কথা বলে। মাস্টার সাহেব গম্ভীর হয়ে বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে, রাত্রে যাব এক বার তোমাদের বাড়ি। চারটা ডাল-ভাত খাব তোমাদের ওখানে।

মাস্টার সাহেব যান রাতের বেলা। সোলায়মানকে ডেকে প্রচণ্ড একটা ধমক দেন, চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেব। বাচ্চা মেয়ে আটকে রেখে খুব বাহাদুরি দেখাচ্ছে। কাল ভোরেই যেন নৌকা ঠিক হয়।

ঠিক হয় ভোরবেলাতেই। আনন্দে কাঁদতে কাঁদতে দীর্ঘদিন পর বৌটি রওনা হয় বাপের বাড়ি।

এক জন ভিনদেশী মাস্টারের এই ক্ষমতাও তো তুচ্ছ করার মতো নয়। এ ধরনের ক্ষমতা হঠাৎ করে আসে না, অর্জন করতে হয়। কবির মাস্টার তা করেছেন।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ