রশীদ সাহেব বললেন, তুই যাচ্ছিস কোথায়?

বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আতাহার সত্যি সত্যি ভুলে গেল সে কোথায় যাচ্ছে। কিছুতেই মনে করতে পারল না–অথচ সে একটা বিশেষ কাজেই বেরুচ্ছিল। কাজটা কি তা বাবাকে দেখার আগ পর্যন্ত মনে ছিল–এখন আর মনে নেই। একটা বিশেষ বয়সের পর বাবা-ছেলের সম্পর্ক বন্ধুর মত হবার কথা–তাদের হচ্ছে না। যতই দিন যাচ্ছে ততই তাদের দূরত্ব বাড়ছে। এক সময় তার বাবা ঘোড়া সেজেছেন এবং সে তার বাবার পিঠে বসেছে এটা ভাবতেও এখন গা শির শির করে। তবে ঘটনা সত্যি। ঘোড়া সাজা রশীদ সাহেবের ছবি আছে। বেশ যত্নে আছে। ছবিটা বঁধানো এবং রশীদ সাহেবের শোবার ঘরে বাকাভাবে টানানো।

কি রে, কথা বলছিস না কেন? যাচ্ছিস কোথায়?

পলিটিক্যাল লোক। আমাকে জাপানে নিয়ে যাবেন বলেছেন।

মানুষের মুখের কথায় বিভ্রান্ত হবি না। মিষ্টি কথায় ভুলবি না। তার কি দায় পড়েছে তোকে জাপানে নেয়ার?

উনি এর জন্যে টাকা নেন।

আদম ব্যবসা?

প্রায় সে রকমই।

জাপানে গিয়ে কি করবি? ঝাড়ুদার হবি? তোকে এম. এ. পাশ করিয়েছি ঝাড়ুদার হবার জন্যে?

আতাহার একবার ভাবল বলে–কোন কাজকে ছোট ভাবা ঠিক না। ক্লাস নাইনে মুখস্থ করা রচনা আছে না। শুমের মর্যাদা। যে জাতি শ্রমের মর্যাদা দিতে জানে না সেই জাতির সামনে ভয়াবহ দিন–উদাহরণ বাংলাদেশ। কিছুই বলা হল না। আতাহার মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। রশীদ সাহেব বললেন, ঐ লোককে কত টাকা দিতে হবে?

দুই লাখ টাকা।

বলিস কি? এত টাকা! এইসব চিন্তা মাথা থেকে দূর করা। যার দেশে কিছু হয় না তার বিদেশেও হয় না। বুঝলি?

জ্বি।

এখন একটা কাজ কর–পত্রিকার অফিসে যা–একটা বিজ্ঞাপন দিয়ে আয়। মনিকা ফ্ল্যাট বিক্রি করতে চায়। বিক্রি করে ঝামেলা চুকিয়ে দেই। উল্টাপাল্টা কথা তোর মাকে লিখেছে–ওর ফ্ল্যাটের ভাড়া না-কি খেয়ে ফেলেছি। নিজের বাবা প্রসঙ্গে এই বক্তব্য। ধরে চাবাকানো দরকার।

বিজ্ঞাপনটা কি লেখা আছে?

হ্যাঁ, লেখা আছে। আমার টেবিলের উপর আছে।

বিজ্ঞাপন ছাপাতে বাবা টাকা লাগবে।

টাকা তো লাগবেই। তোর মুখ দেখে তো আর বিজ্ঞাপন ছাপবে না। আয় টাকা নিয়ে যা।

আতাহার টাকা নেয়ার জন্যে বাবার পেছনে পেছনে গেল। রশীদ পাঁচটা একশ টাকার নোট দিলেন। বিরস মুখে বললেন, যা লাগবে দিয়ে বাকিটা আমাকে ফেরত দিবি।

জ্বি আচ্ছা।

পত্রিকা অফিস থেকে ফেরার পথে নাখালপাড়া হয়ে ফিরবি।

নাখালপাড়ায় কি?

আমার এক পুরানো ছাত্রী, ফরিদা নাম, তাকে এই চিঠিটা দিবি। তার হাতেই দিবি–অন্য কারো হাতে না। খামের উপরে ঠিকানা লেখা আছে।

জ্বি আচ্ছা।

আতাহার ঘর থেকে বের হয়ে মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মুক্তির আনন্দ পুরোপুরি পাওয়ার জন্যে চায়ের সঙ্গে বিদেশী একটা সিগারেট খাওয়া দরকার। পকেটে টাকা আছে। খাওয়া যেতে পারে। আতাহারের বাধা চায়ের দোকান আছে। দোকানের মালিক ফরিদ আলির সঙ্গে তার বেশ ভাল খাতির। শুধু চা খাওয়া বাবদ ফরিদ আলি পঁচিশ টাকার মত পায়, এই নিয়ে আতাহারকে সে কখনো কিছু বলেনি। ভবিষ্যতেও কিছু বলবে মনে হয় না।

ফরিদ আলি আতাহারকে দেখে ক্যাশব্যাক্স ছেড়ে উঠে এল। আতাহারের সামনে বসতে বসতে বলল, খবরটা শুনে মনে বড় ব্যথা পেয়েছি আতাহার ভাই। আতাহার

আপনার ছোট ভাই নাকি পরীক্ষা দিতে পারে নাই। মাথা ঘুরে হলের মধ্যে পড়ে গেছে। ঘটনা কি সত্য?

ঘটনা সত্য তো বটেই। প্রশ্ন খুব সহজ ছিল। সহজ প্রশ্ন দেখে মাথা ঘুরে পড়ে গেছে।

ফরিদ গম্ভীর গলায় বলল, হাসেন কেন ভাইজান? এটা তো হাসির কোন বিষয় না।

আতাহার বিরক্ত গলায় বলল, সহজ প্রশ্ন দেখে মাথা ঘুরে পড়ে গেছে এই ঘটনা যদি হাসিয়া না হয় তাহলে হাসির ঘটনা কোনটা? যাই হোক, আপনি আমার এখানে বসে প্যাঁচাল পারবেন না। আপনি ক্যাশবাক্সে গিয়ে বসুন। আর আমাকে চা দিতে বলুন। পিচ্চি পাঠিয়ে সিগারেট আনিয়ে দিন। বেনসন।

আপনি না-কি জাপান চলে যাচ্ছেন আতাহার ভাই?

হুঁ।

জাপানে গিয়ে কি করবেন?

ওদের ফুটপাত ঝাড় দিব। ঝাড়ুদার হব। আর কি করব?

জাপানের ফুটপাত ঝাড় দেয়ার মধ্যেও আনন্দ আছে ভাইসব। এইগুলা হল সোনার দেশ। ভাইজান, আমারেও সাথে করে নিয়ে যান। দোকান দিয়ে পুষে না। লোকসানের উপরে লোকসান।

অনেক পাঁচ্যাল পেরেছেন। এখন যান তো–আমাকে আরাম করে চা খেতে দিন।

এক কাপ চায়ে মেজাজটা ঠিক আসে না। প্রথম কাপ খেতে হয় সিগারেট ছাড়া। দ্বিতীয় কাপে সিগারেট ধরাতে হয়। আতাহার দেয়াশলাইয়ের জন্যে পকেটে হাত দিল। খামের চিঠিটায় হাত পড়ল। ইংরেজিতে সুন্দর করে নাম লেখা–Farida Hoque. বাবার হাতের লেখা সুবিধার না–এই নামটা বোধহয় যত্ন করে লেখা। কারণ কি কে জানে?

পুরানো ছাত্রীর সঙ্গে বাবার ব্যাপারটা কি আতাহারের মাথায় আসছে না। সাহস থাকলে চিঠিটা খুলে পড়ে ফেলা যেত। আতাহারের এত সাহস নেই।

পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়ার ব্যাপারেও ঘুষের ব্যাপার আছে। বিজ্ঞাপন ম্যানেজার বললেন, সাড়ে তিনশ টাকা লাগবে। বিজ্ঞাপন যেতে দেরি হবে, হেভী বুকিং। তবে ইয়ে, এক্সট্রা কিছু দিন–দেখি ইমিডিয়েট কিছু করা যায়। কিনা। আতাহার বলল, এক্সট্রা কত?

শখানিক দিন।

আতাহার বলল, পঞ্চাশ দিলে হয় না?

ঘুষের ব্যাপারে দরদাম করার দস্তুর আছে। দরদাম করে ঘুষ দিলে যিনি ঘুষ নেন তিনি ভাল বোধ করেন। ঘুষ নেয়ার লজ্জাটা কমে যায়।

পঞ্চাশ টকা ঘুষ দিয়ে আতাহার হৃষ্টচিত্তে রিকশায় উঠল। নাখালপাড়ায় যেতে হবে পিতার ছাত্রীর সন্ধানে। রিকশায় চড়ায় একটা রাজকীয় ব্যাপার আছে। মাথা সামান্য উঁচু করলেই আকাশ দেখতে দেখতে যাওয়া যায়। গাড়ির যাত্রীরা এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত। আকাশ দেখতে হলে তাদের অনেক ঝামেলা করে জানালার ফাঁক দিয়ে তাকাতে হয়।

আকাশ বা ঝাঁঝাঁ করছে। চোখের দৃষ্টি পিছলে আসছে। এক-আধ টুকরা শাদা মেঘ হলে তাকিয়ে আরাম পাওয়া যেত। আতাহার তারপরেও দৃষ্টি নামালো না। ভাল না। লাণুক, তারপরেও চোখ থাকবে আকাশে। তার চোখ তো আর সাধারণ মানুষের চোখ না–কবির চোখ। এই চোখে সারাক্ষণ ছায়া পড়বে আকাশের।

রিকশায় ট্রেনের মত দুলুনি থাকলে কবিদের জন্যে ভাল হত। ছন্দ চলে আসত। আতাহার সিগারেট ধরানোর জন্যে দেয়াশলাই হাতে নিল। চলন্ত রিকশায় সিগারেট ধরানোরও আলাদা মজা আছে। বিরুদ্ধ বাতাসে আগুন জ্বালানো সহজ ব্যাপার না। একের পর এক দেয়াশলাইয়ের কাঠি নিভে যাবে। দেয়াশলাইয়ের কাঠির সংখ্যা দ্রুত কমতে থাকবে। মনের ভেতর তৈরি হবে টেনশান–শেষ পর্যন্ত ধরানো যাবে তো? টেনশনেরও মজা আছে। আতাহারকে কোন টেনশনের ভেতর দিয়ে যেতে হল না—প্রথমবারেই সিগারেট জ্বলে উঠল। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই মাথায় কবিতার লাইন চলে এল।

যতই আমি দূরে যেতে চাই ততই আসি কাছে
আমার গায়ে তাহার গায়ের গন্ধ লেগে আছে।

না, ভাল লাগছে না। মনে হচ্ছে কলেজ ম্যাগাজিনের কবিতা। তা ছাড়া গায়ে কখনো গন্ধ লেগে থাকে না। লাক্স সাবান দিয়ে গোসল করলেই গন্ধ ধুয়ে চলে যায়— গন্ধ যদি লেগে থাকার হয় তাহলে লেগে থাকে–মনে। কাজেই এই বিষয়টি থাক, বাবার ছাত্রীকে নিয়ে বরং একটা কিছু লেখা যাক।

আমি যাচ্ছি নাখালপাড়ায়।
আমার বৃদ্ধ পিতা আমাকে পাঠাচ্ছেন তাঁর
প্রথম প্রেমিকার কাছে।
আমার প্যান্টের পকেটে শাদা খামে মোড়া বাবার লেখা দীর্ঘ পত্র।
খুব যত্নে খামের উপর তিনি তার প্রণয়িনীর নাম লিখেছেন।
কে জানে চিঠিতে কি লেখা–?
তার শরীরের সাম্প্রতিক অবস্থার বিস্তারিত বর্ণনা?
রাতে ঘুম হচ্ছে না, রক্তে সুগার বেড়ে গেছে
কষ্ট পাচ্ছেন হাঁপানিতে–এইসব হাবিজাবি। প্রেমিকার কাছে
লেখা চিঠি বয়সের ভারে প্রসঙ্গ পালটায়
অন্য রকম হয়ে যায়।
সেখানে জোছনার কথা থাকে না,
সাম্প্রতিক শ্বাসকষ্ট বড় হয়ে ওঠে।
প্রেমিকাও একটা নিদিষ্ট বয়সের পর
রোগভুগের কথা পড়তে ভালবাসেন।
চিঠি পড়তে পড়তে দরদে গলিত হন—
আহা, বেচারা ইদানীং বড্ড কষ্ট পাচ্ছে তো…

মা-মা চেহারার এক মহিলা দরজা খুলে আশ্চর্য রকম মিষ্টি গলায় বললেন, কে? আতাহার হকচকিয়ে গেল। ফরিদা হক নামের একজন মহিলার যে ছবি মাথায় নিয়ে সে এসেছে–এই মহিলার সঙ্গে তার কোন মিল নেই। দরজা খুলেছেন মাথায় কাপড় দেয়া রোগা শ্যামলা একজন মহিলা, যার চোখ আশ্চর্য সুন্দর, গলার স্বর অদ্ভুত মিষ্টি। নিশ্চয়ই এই মহিলা ফরিদা হক না, অন্য কেউ। ফরিদা হকের দূর সম্পর্কের কোন আত্মীয়।

মহিলা আবার বললেন, কে?

জি, আমার নাম আতাহার। বাবা আমাকে পাঠিয়েছেন। আমার বাবার নাম রশীদ আলি।

ও, তুমি রশীদ স্যারের ছেলে। তোমার যখন তিন-চার বৎসর বয়স তখন তোমাকে দেখেছি। তোমার চেহারা তো একদম পালেট গেছে।

আতাহার বলল, জ্বি, তখন আমার দাড়ি ছিল না।

মহিলা খিলখিল করে হেসে ফেললেন। গলার স্বরের মত এই মহিলার হাসিও মিষ্টি।

এসো বাবা, ভেতরে এসো।

জ্বি না, আমি চলে যাব। আমার খুব জরুরী একটা কাজ আছে। বাবা আপনাকে একটা চিঠি দিয়েছেন।

তুমি ভেতরে আস তো।

আতাহার ঘরে ঢুকল। সুন্দর ছিমছাম একটা বসার ঘর। বেতের চেয়ার। চেয়ারের কুশনগুলি ধবধবে পরিষ্কার। মেঝেতে কাপেট নেই। তবে মেঝে ঝকঝকি করছে। মনে হচ্ছে খালি গায়ে এই মেঝেতে শুয়ে বই পড়লে খুব আরাম হবে–

বাবা, তুমি ফ্যানের নিচে এই চেয়ারটায় বস তো। ঘোমে একেবারে নেয়ে গেছ। সরবত বানিয়ে দেই–সরবত খাবে?

জ্বি না, আমি সরবত খাই না।

আজকালকার ছেলেরা চা ছাড়া আর কিছু খেতে চায় না–অথচ গরমের মধ্যে তেতুলের সরবতের মত ভাল জিনিস আর কিছু নেই। একটু তেতুলের সরবত করে দেই? তেতুল ভিজানো আছে।

আমি টকা খাই না। আমার পেটে আলসার আছে।

তাহলে ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি খাও। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে খুব তৃষ্ণা পেয়েছে। ইশ, কি ঘামা ঘেমেছ!

ভদ্রমহিলা পানি আনতে গেলেন। আতাহারের আগে তৃষ্ণা পায়নি–কিন্তু চিঠির জন্যে পকেটে হাত দিয়ে তৃষ্ণা পেয়ে গেল। পকেটে চিঠি নেই। পকেট থেকে দেয়াশলাই বের করার সময় নির্ঘৎ পড়ে গেছে। কি সর্বনাশের কথা! আতাহার এক চুমুকে পানির গ্লাস শেষ করে নিচু গলায় বলল, বাবার চিঠিটা হারিয়ে ফেলেছি। প্যান্টের পকেটে ছিল–মনে হয়। রাস্তায় কোথাও পড়ে গেছে।

ভদ্রমহিলা বললেন, হারিয়ে গেলে তো করার কিছু নেই। তুমি এত ঘাবড়ে যাচ্ছ কেন? হারিয়ে গেছে শুনলে স্যার রাগ করবেন।

জ্বি।

চট করে রেগে যাবার ব্যাপারটা অবশ্যি স্যারের মধ্যে আছে–যাই হোক, উনাকে বলার দরকার নেই যে তুমি চিঠি হারিয়ে ফেলেছ। বলবে আমাকে চিঠি দিয়েছ।

জ্বি আচ্ছা। আমি তাহলে যাই।

আরেকটু বসে যাও। গায়ের ঘামটা মরুক।

আতাহার গায়ের ঘাম মরার জন্যে অপেক্ষা করল না। জীবিত ঘাম নিয়েই বের হয়ে পড়ল। সাজ্জাদের খোঁজ বের করতে হবে। কোথায় সে ড়ুব মেরেছে কে জানে। সাজ্জাদকে সঙ্গে নিয়ে কয়েক দিনের জন্যে ঢাকার বাইরে যেতে ইচ্ছা করছে। শহর আর ভাল লাগছে না।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ