গত চার দিন ধরে সাজ্জাদ ভূতের গলির এক বাসায় আছে। এই চার দিন দাড়ি-গোঁফ কামায়নি। তার মুখ ভর্তি খোচা খোচা দাড়ি। ব্রাশের অভাবে মাজা হয় নি বলে–হলুদ দীত। ঘুম মোটেই ভাল হচ্ছে না। ঘুমের অভাবে চোখের নিচে কালি পড়েছে।

তিন কামরার এই বাড়িটি হাফ বিলিডিং ছাদ টিনের। দিনের বেলা এই ছাদ তেতে আগুন হয়ে থাকে। টিনের বাড়িগুলির উত্তাপ রাতে কমার কথা। এখানে কমছে না, বরং বাড়ছে। শোবার ঘরে কয়েকটা জানালা। জানালায় তারের জালি দেয়া। মশা-মাছি আটকানোর জন্য তারের জালি–মশা-মাছির তাতে অসুবিধা হচ্ছে না। আটকে যাচ্ছে বাতাস। একফোটা বাতাস নেই।

বাড়ির মূল মালিক মোসাদ্দেক হোসেনের তাতে কোন অসুবিধা হয় না। ভদ্রলোকের নির্বিকার থাকার ক্ষমতা দেখে সাজ্জাদ বিস্মিত ও অভিভূত।

মোসাদ্দেক সাহেবের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। তার স্বাস্থ্য অসম্ভব ভাল। গাট্টাগোট্টা ধরনের চেহারা। অতি অস্পভাষী। তবে হাস্যমুখ। সারাক্ষণ মুখে হাসি লেগে আছে। চুলটানা স্বভাব আছে। এক হাতে সারাক্ষণ মাথার চুল টানছেন। গায়ের রঙ ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। এরকম কালো মানুষ সচরাচর চোখে পড়ে না।

ভদ্রলোক ঢাকা আট কলেজ থেকে পাশ করা প্রথম ব্যাচের ছাত্র। শিল্পীর শোবার ঘরের দেয়ালে ছবি-টবি থাকার কথা। মোসাদ্দেক সাহেবের বাড়ির দেয়াল বলতে গেলে খালি। দেয়ালে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের দু বছর আগের একটা ক্যালেন্ডার আছে। ক্যালেন্ডারের পাশে দামী ফ্রেমে বাঁধাই করা একটা চিঠি। চিঠিটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ চিঠিটি লিখেছেন শিম্পাচার্য জয়নুল আবেদীন। স্পেনের মাদ্রিদের এক হোটেলের প্যাডে গুটি গুটি হরফে লেখা চিঠি।

মোসাদ্দেক,
আমি আমার জীবনে অনেক অপদাৰ্থ দেখেছি–তোমার মত কাউকে দেখি নাই। অকর্মন্যতা, অলসতা এবং স্থবিরতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হওয়া উচিত। আমাদের দুর্ভাগ্য, তা হয়নি। ক্ষেত্রবিশেষে আকর্মন্যতা ও অলসতাকে গ্লোরিফাই করা হয়।

তোমার আকর্মন্যতা আমাকে সত্যত পীড়া দেয়। মনে রাখবে, অব্যবহারে ইস্পাতের তৈরি অতি ধারালো যন্ত্রেও মরিচা ধরে।

বিশেষ আর কি। কিছুদিন যাবৎ শরীর ভাল যাচ্ছে না। দুর্বল পরিপাক যন্ত্রের ক্রিয়ায় কষ্ট পাচ্ছি।

ভাল থাক এবং গা ঝাড়া দিয়ে উঠা। ইতি–

বিষয়বস্তু ছাড়াও চিঠিটির আর একটি গুরুত্ব আছে–চিঠির শেষে ফাঁকা জায়গাটা শিলপাচার্য ফাঁকা রাখেননি। যে কলমে চিঠি লেখা হচ্ছিল সেই কলমের কয়েক টানে রাস্তার একটা স্কেচ করে দিয়েছেন।

মোসাদ্দেক সাহেব চিঠি বাঁধিয়ে রেখেছেন স্কেচটির জন্যে। তাঁর ধারণা, জয়নুল আবেদীনের অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজের মধ্যে এটি একটি। সৃষ্টিশীল মানুষ তার অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি কখনো খুব ভেবেচিন্তে করেন না। সেই সব কাজ হঠাৎ করে তৈরি হয়। কাজের শুরুতে তাঁরা নিজেরাও বুঝতে পারেন না। মাদ্রিদের যে রাস্তার ছবিটি আঁকা হয়েছে সেই রাস্তাটা প্রায় ফাঁকা। দুজন তরুণী মেয়ে রাস্তা ধরে এগুচ্ছে। শিল্পী তাদের পিছনটা এঁকেছেন। একটি মেয়ে মুখ ফিরিয়ে তার বান্ধবীর সঙ্গে গল্প করছে বলে তার মুখের কিছু অংশ ধরা পড়েছে।

মোসাদ্দেক সাহেব মাথার চুল টানতে টানতে ছবিটির দিকে তাকান এবং বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেন, বড় মাপের একজন শিল্পী সামান্য জায়গায় কি অসাধারণ কাজ করতে পারেন। সামান্য কয়েকটি টানে শহরের রাজপথে প্রাণ সঞ্চার করতে পারেন। দুটি তরুণী মেয়ে হাসতে হাসতে, গল্প করতে করতে যাচ্ছে–মনে হচ্ছে তাদের সঙ্গে রাস্তাটাও হাসতে হাসতে এগুচ্ছে। রাস্তা যেন রাস্তা না, বহমান নদী। মোসাদ্দেক সাহেবের ইচ্ছা আছে–টাকা পয়সা হলে কোন একদিন মাদ্রিদে গিয়ে রাস্তাটা দেখে আসবেন। সেই সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ।

মোসাদ্দেক সাহেবের স্থায়ী কোন রোজগার নেই। রোজগারের চেষ্টাও নেই। বর্তমানে তাঁর সৃষ্টিশীল প্রতিভা তিনি রিকশা এবং বেবীটেক্সীর পেছনে চিত্রকলা নির্মাণে ব্যয় করছেন। কাজগুলি তিনি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে করেন। এবং তঁকে প্রচুর মেধাও ব্যয় করতে হয়। ছবিগুলি এমন হতে হবে যেন ছবি দেখে কেউ বুঝতে না পারে একজন অত্যন্ত প্ৰতিভাবান এবং সম্ভাবনাময় শিল্পী ছবি এঁকেছেন। আনাড়ি কাঁচা হাতের শিল্পীর মত করে ছবি আঁকা খুব সহজ ব্যাপার নয়। মোসাদ্দেক সাহেব দুরূহ কাজটি তৃপ্তির সঙ্গে করেন। ছবি আঁকা শেষ হলে ইংরেজিতে লিখে দেন–Art by M. Hossain. মাঝে মাঝে by-এর জায়গায় লেখেন dy. b এবং d-এর মধ্যে মূর্খ শিল্পী যে ভুল করেন তাকেও তাই করতে হয়। ছবির সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে কথাবার্তা লিখতে হয়। বেশির ভাগ বেবীটেক্সীতে লিখতে হয়–মায়ের দোয়া। বেবীটেক্সীওয়ালারা রিকশাওয়ালাদের তুলনায় বেশি মাতৃভক্ত। রিকশায় লিখতে হয় টিভি এবং সিনেমার চালু সংলাপ, যেমন–শান্তি নাই, থামলে ভাল লাগে, বিষয়টা কি?। মোসাদ্দেক সাহেব টিভি-সিনেমা কোনটাই দেখেন না। সংলাপ লেখার সময় বুঝতে পারেন বাজারে এখন কি চলছে। তিনি মাঝে মাঝে কিছু রসিকতাও করেন। যেমন এক টেম্পোত ছাদে উঠা নিষেধ লিখে দেয়ার কথা, তিনি লিখে দিলেন চাঁদে ওঠা নিষেধ।

এইসব কাজ ছাড়াও তিনি অর্ডার পেলে ন্যুড ছবি এঁকে দেন। নব্য ধনীদের জন্যে এইসব আঁকা হয়। ন্যুড মেয়েদের মুখ নব্য ধনীদের পছন্দসই কোন মুখের মত হতে হয়। ফিগারের জন্য তিনি মডেল ব্যবহার করেন। তাঁর পরিচিত তিন-চারজন মডেল আছে। খবর দিলে তারা আসে। ঘন্টা হিসাবে সিটিং দেয়। প্রতি ঘণ্টা পঁচিশ টাকা। খাওয়ার সময় খাওয়া-দাওয়া।

সাজ্জাদ মডেল দেখে ছবি আঁকার প্রক্রিয়াটা দেখার জন্যে মোসাদ্দেক সাহেবের কাছে এসে আটকা পড়ে গেল। গত চার রাত গরমে সিদ্ধ হয়ে সে মোসাদ্দেক সাহেবের সঙ্গে এক খাটে ঘুমিয়েছে। রাতে দোকান থেকে শিক কাবাব এবং নানরুটি এনে খেয়েছে।

মোসাদ্দেক সাহেব সারাদিনে একবেলা খান। সাজ্জাদকে তিনি বলেছেন, আমি কুকুর স্বভাবের মানুষ। কুকুর সারাদিনে একবার খায়–আমিও একবার খাই। তুমি আমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারবে না–তুমি দুপুরে খেয়ে এসো। বিসমিল্লাহ হোটেলে গিয়ে বলবে–মনা মিয়া পাঠিয়েছে। তাহলে পয়সা দিতে হবে না। আমার খাতা আছে, খাতায় নাম তুলে রাখবে।

সাজ্জাদ হোটেলে যায়নি। চিনি—দুধবিহীন কাপের পর কাপ কড়া চা খেয়ে খিদে নষ্ট করেছে। প্রায় কুকুরের মতই হুমহাম শব্দ করে শিক কাবাব নানরুটি খেয়েছে। জীবনটাকে তার অনেক দিন পর অর্থবহ মনে হয়েছে।

মোসাদ্দেক সাহেবকে তার যেমন মনে ধরেছে–মোসাদ্দেক সাহেবের মডেলকেও মনে ধরেছে। মডেল মেয়েটির নাম কণা। মেয়েটির বছরখানেক আগে বিয়ে হয়েছে। স্বামী একটা ফার্মেসীতে সেলসম্যান। মাসে পনেরশ টাকা পায়। এক কামরার যে ঘরে তারা দুইজন বাস করে তার ভাড়া নাশ টাকা। বাকি ছয় শ টাকায় সংসার চলে না। কণাকে বাড়তি রোজগারের চেষ্টা করতে হয়।

মেয়েটি দেখতে সুন্দর। কথাবার্তা অতি মার্জিত। মোসাদ্দেক সাহেবকে সে বড় ভাইজান বলে ডাকে। সাজ্জাদ লক্ষ্য করল নুড সিটিং দেয়ার ব্যাপারে মেয়েটির ভিতরে কোনরকম লজ্জা বা সংকোচ নেই। সাজ্জাদ একজন অপরিচিত মানুষ। অপরিচিতের সামনে নিজেকে নগ্ন করার স্বাভাবিক লজ্জাও কণার ভেতরে পুরোপুরি অনুপস্থিত।

এক ঘণ্টার মত সিটিং-এর পর পাঁচ—দশ মিনিটের জন্যে বিশ্রাম দেয়া হয়। মোসাদ্দেক সাহেব এই সময়ে চা খান, সিগারেট খান। কণা তখন অতি দ্রুত শাড়ি নিজের গায়ে জড়িয়ে স্বাভাবিক গলায় গল্প করে। সাজ্জাদ মেয়েটির খাপ খাইয়ে নেয়ার শক্তি দেখে মোহিত হল। মেয়েটি তাকে সাজ্জাদ ভাই বলছে এবং এমনভাবে তার সঙ্গে কথা বলছে যেন আসলেই সাজ্জাদ তার ভাই।

বুঝলেন সাজ্জাদ ভাই, ঢাকা শহরে কত কিছু দেখলাম। আসল জিনিস দেখা হয় নাই।

আসল জিনিস কি?

চিড়িয়াখানা। আমি প্রতি সপ্তাহে একবার করে ওকে বলি–চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাও। সে খালি বলে, আচ্ছা আচ্ছা।

তোমার স্বামী পশু-পাখি পছন্দ করে না?

তার পছন্দ-অপছন্দ নাই। তার হল আলসি।

আলসি?

গ্রাম্য ভাষা বললাম। অলস, সে বড়ই অলস।

শব্দটা সুন্দর–আলিসি। যাই হোক, একদিন তোমাকে আর তোমার আলসী স্বামীকে চিড়িয়াখানা দেখিয়ে নিয়ে আসব।

সত্যি দেখাবেন?

মনে থাকলে দেখাব। আমার আবার কিছুই মনে থাকে না। যাদের কিছুই মনে থাকে না গ্ৰাম্য ভাষায় তাদের কি বলে?

বেভুইল্যা।

বেভুইল্যা?

হুঁ।

কণা হাসছে। সুন্দর করে হাসছে। সাজ্জাদ বলল, তুমি যে মডেল হয়ে সিটিং দাও তোমার স্বামী জানে?

জানিবে না কেন? সেই তো জোগাড় করল।

সে জোগাড় করে দিয়েছে?

হুঁ। তার ফার্মেসীর পাশে ছবি বিক্রির একটা বড় দোকান আছে–ঋতু গ্যালারী। ওদের সাথে কথাবার্তা বলে একদিন আমারে বলল, কাজ করবা?

আমি বললাম, হুঁ করব।

সে রাগী গলায় বলল, কি কাজ না শুনেই বললা–করব? আগে শোনা কি কাজ।

আমি বললাম, কাজ হল কাজ। কাজের আবার শোনা শুনি কি?

সাজ্জাদ বলল, কাজটা কি তোমার পছন্দ হয়েছে?

কণা হাসতে হাসতে বলল, না। পছন্দ না হইলেও তো করনের কিছু নাই। মানুষের পছন্দ-অপছন্দে দুনিয়া চলে না। দুনিয়া চলে তার নিজের পছন্দে। সেই পছন্দ ভাল লাগলে ভাল। ভাল না লাগলে নাই।

মোসাদ্দেক চোখের ইশারা করলেন। কণা তৎক্ষণাৎ গায়ের কাপড় খুলে টুলে গিয়ে বসল। তার মধ্যে কোন রকম বিকার, কোন রকম অস্বাভাবিকতা দেখা গেল না।

সাজ্জাদ মোসাদ্দেকের দিকে তাকিয়ে বলল, মোসাদ্দেক ভাই, আমি চললাম।

মোসাদ্দেক হ্যাঁ-না কিছুই বললেন না। তাঁর চোখ কণার দিকে। তাঁর হাতে পেনসিল এবং ব্লেড। কণার দিকে তাকিয়েই তিনি পেনসিলের মাথা কাটছেন। কোন রকম অসুবিধা হচ্ছে না।

 

রাস্তায় নেমে সাজ্জাদের মনে হল–ভুল হয়েছে, আরো কিছুক্ষণ মোসাদ্দেক সাহেবের সঙ্গে থাকলে হত। আলসি স্বামীর স্ত্রীটির সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগছিল। আজকাল তার কি যে হয়েছে, কারো সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগে না। কথা বলে আরাম পাওয়ার একটা ব্যাপার আছে–সেটা হচ্ছে না।

তিনটার মত বাজে। বয়া বঁটা রোদ। বেশিক্ষণ এই রোদে হাঁটলে সানস্ট্রোক হবার কথা। সাজ্জাদের মাথা ঝিম ঝিম করছে। তার গায়ে কালো রঙের বুশ শার্ট। শার্টটা বাইরের সব উত্তাপ শূষে নিচ্ছে। তার গা দিয়ে রীতিমত ভাপ বেরুচ্ছে। সে অবশ্যি হাঁটছে মোটামুটি নির্বিকার ভঙ্গিতে। তাকে দেখে মনে হওয়া অস্বাভাবিক না যে, সে হেঁটে আনন্দ পাচ্ছে। দুদিকে কৌতূহলী চোখ ফেলে ফেলে সে এগুচ্ছে। দেখার মত দৃশ্য দুদিকে প্রচুর আছে।

সে ফার্মগেট ছাড়িয়ে চলে এসেছে। এখন রাস্তার দুপাশেই কৃষ্ণচূড়া গাছ। রোদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফুল ফুটেছে। রোদের আগুন ফুল হয়ে ফুটেছে এরকম ভাবা যেতে পারে। কৃষ্ণচূড়া ফুল দেখতে দেখেতে চোখ যখন ধাঁধিয়ে যাচ্ছে তখন চোখ পড়ছে জারুল গাছে। গাছ ভৰ্তি থোকা থোকা নীল ফুল। কৃষ্ণচূড়া ফুল যদি আগুনের ফুল হয় তাহলে জারুল ফুলে হল জোছনার ফুল। এই দুই ফুল পাশাপাশি যেতে পারে না। নগর যারা পরিকল্পনা করেন তাদের অফিসে বেতনভুক কিছু কবি থাকা দরকার। কবিরা ঠিক করবেন কোথায় কোন গাছ হবে।

বড় নগরীর পরিকল্পনা করা হবে ঋতুর দিকে তাকিয়ে। নগরীর একটা অংশের নাম হবে বর্ষা নগর। সেই অংশে থাকবে শুধুই কদম গাছ। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ কদম গাছ। বর্ষার প্রথম জলধারায় ফুটবে সোনালী ফুল–। আহা, কি দর্শনীয় হবে সেই নগর! সেই নগরে ছাতা নিষিদ্ধ। বৃষ্টির সময় ভিজে ভিজে সবাইকে যাতায়াত করতে হবে।

নগরীর একটা অংশের নাম হবে গ্ৰীষ্ম। সেই অংশে থাকবে শুধুই কৃষ্ণচূড়া। বৈশাখ মাসে মনে হবে নগরীতে আগুন ধরে গেছে।

সাজ্জাদের পানির পিপাসা পেয়ে গেল। পিপাসার ধরনটা ভাল না। সাধারণত পানির পিপাসা বুকের ভেতরে হয়–তাঁর পিপাসা সারা শরীরে হচ্ছে। কৃষ্ণচূড়া, কদম, জারুল কোন গাছই এখন তাকে আকর্ষণ করছে না। তার চোখে এখন একটা বাথটাবের ছবি ভাসছে। তার নিজের ঘরের বাথটাব। কানায় কানায় টলটলে পানিতে ভর্তি। তার উপর বরফের কুঁচি ছিটিয়ে দেয়া হয়েছে। বরফ ভাসছে। বাথটাবের পাশে ছোট্ট একটা টেবিল যার টপটা মার্বেল পাথরের। সেই টেবিলে পাশাপাশি দুটা পানির গ্লাস। বাথটাবের মত পানির গ্লাস দুটিও কানায় কানায় ভর্তি। বরফ চিনির দানার মত গুড়ো করে গ্লাসে দেয়া হয়েছে। গ্লাসের গায়ে বিন্দু বিন্দু পানি জমেছে।

সাজ্জাদ এখন আর হীটছে না। দাঁড়িয়ে আছে। কোন খালি রিকশা দেখলেই লাফিয়ে উঠে পড়তে হবে। খালি রিকশা দেখা যাচ্ছে না। হুস হুস করে কয়েকটা বেবীটেক্সি গেল। সবকটা যাত্রী বোঝাই। গীষ্মের প্রচণ্ড দাবীদাহের দিনে খালি রিক্সা খালি বেবীটেক্সি চলাচল করে না। প্রাইভেট গাড়ি, মাইক্রোবাস প্রচুর যাতায়াত করছে। হাত তুললে এরা কেউ কি থামবো? মনে হয় না। সাজ্জাদের মাথা এখন ফাঁকা ফাঁকা লাগতে শুরু করেছে। এটা সানস্ট্রোকের আগের ধাপ কিনা সে বুঝতে পারছে না। মাথার ভেতর বিজ বিজ করে কে যেন আবার কথাও বলছে–কবিতার লাইন।

সন্ন্যাসী উপগুপ্ত
মথুরাপুরীর প্রাচীরের তলে
একদা দিলেন সুপ্ত।

ক্লাস সিক্সে বাৎসরিক পুরস্কার বিতরণীর দিন আবৃত্তি করার জন্যে এই দীর্ঘ কবিতাটি সে মুখস্থ করেছিল। উৎসবের দিন প্রথম তিন লাইন বলার পর কবিতা আর মনে পড়ে না। শত শত মানুষ তাকিয়ে আছে তার দিকে। উইংসের আড়াল থেকে বাংলা স্যার চাপা গলায় বললেন–কি হল! এই গাধা! সে তখন আবার গোড়া থেকে শুরু করল। তিন লাইন বলার পর আবার আটকে গেল। দর্শকদের ভেতর থেকে চাপা হাসি শুরু হল। বাংলা স্যার ক্রুদ্ধ গলায় বললেন,–এই গাধার বাচ্চা, চলে আয়। সে চলে না। এসে আবারো গোড়া থেকে শুরু করল। আবারো তিন লাইনে আটকে গেল। শুরু হল প্রচণ্ড হাসোহাসি। বাংলা স্যার উইংসের আড়াল থেকে এসে হাত ধরে হ্যাঁচকাটান মেরে ভেতরে নিয়ে গেলেন। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পুরো কবিতাটা তার মনে পড়ল। এখনো যে কোন দুঃসময়ে ফাট করে কবিতাটা মাথার ভেতর চলে আসে। মাথার ভেতরে বসে কেউ একজন গভীর এবং ভারি গলায় পুরো কবিতা আবৃত্তি করেন।

এখনো আবৃত্তি শুরু হয়েছে। পুরো কবিতাটা শেষ না হলে তা বন্ধ হবে না। সাজ্জাদ দাঁড়িয়ে আছে। অসহায় মুখ করে কবিতা শুনছে–রোদ মনে হয় আরো বাড়ছে–রাস্তার পিচ গলে যাচ্ছে–

নগরীর দীপ নিবেছে পবনে,
দুয়ার রুদ্ধ পৌর ভবনে,
নিশীথের তারা শ্ৰাবণ গগনে
ঘন মেঘে অবলুপ্ত।

কাহার নুপুরশিঞ্জিত পদ
সহসা বাজিল বক্ষে…

সাজ্জাদ বাসায় এসে পোছল সাড়ে তিনটার দিকে। তার সারা শরীর বেয়ে ঘাম ঝরছে। মুখ শুকিয়ে এতটুক হয়ে গেছে। নীতু বলল, ভাইয়া, এ কি অবস্থা! সাজ্জাদ হাসিমুখে বলল, অবস্থা খুবই খারাপ। মনে হয় কিছুক্ষণের মধ্যে ইন্তেকাল করব। চার মাইল দূর থেকে হেঁটে হেঁটে এসেছি।

আগামীকাল তোমার ইন্টারভিউ, মনে আছে?

আগামীকালেরটা আগামীকাল দেখা যাবে। তিন বোতল ঠাণ্ডা পানি নিয়ে আয়।

গতকাল তোমার জন্যে থানায় জিডি এন্ট্রি করা হয়েছে। বাবার ধারণা তোমাকে গুম খুন করা হয়েছে। বাবা খাওয়া-দাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন।

কথা বলে সময় নষ্ট করিস না নীতু। ঘরে কি বার্নল আছে?

বার্নল কি জন্যে?

গায়ে মাখব। সারা শরীরে ফোসফা পড়ে গেছে।

তুমি এই কদিন কোথায় ছিলে?

ব্যানানা গার্ডেন।

সেটা কোথায়?

সেটা হচ্ছে কলাবাগান। নীতু, দাঁড়িয়ে বকবক করিস না–পানি, জল, অম্বু…

তুমি যতই পানি পানি করে চেঁচাও তোমাকে এখন পানি দেব না। তুমি একটু নরম্যাল হও। ফ্যানের নিচে চুপ করে দাঁড়াও। এখন পানি খেলেই তোমার অসুখ করবে।

অসুখ করলে করবে। অসুখের চিকিৎসা আছে। মরে গেলে চিকিৎসার বাইরে চলে যাব রে নীতু।

সাজ্জাদ সোফায় গা এলিয়ে বসল। নীতু ট্রেতে করে পানির বোতল এবং গ্লাস এনে দেখে সাজ্জাদ ঘুমুচ্ছে। গভীর ঘুম। তাকে দেখে মনে হচ্ছে গত পাঁচ দিন সে ঘুমায়নি।

ভাইয়া, পানি এনেছি। পানি খেয়ে বিছানায় গিয়ে ঘুমাও।

সাজ্জাদ চোখ মেলে নীতুকে দেখল, পানির বোতল-গ্লাস দেখল, আবার চোখ বন্ধ করে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। তার ঘুম ভাঙল সন্ধ্যায়–ঝড়ের শব্দে। তখন বাড়ির সবাই ছোটাছুটি করে দরজা-জানালা বন্ধ করছে। শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে বাইরে। তাদের বাড়ির সামনের দীর্ঘদিনের পুরানো আম গাছ সশব্দে ভেঙে তাদের বাড়ির উপর পড়ল। জানালার ভাঙা কাচে নীতুর হাত কেটে গলগল করে রক্ত পড়তে লাগল। রান্নাঘরে কাজের বুয়া আটকা পড়ে গেল। ঝড় রান্নাঘরের দরজা চেপে ধরেছে। কাজের বুয়া প্রাণপণ চেষ্টা করেও সেই দরজা এক ইঞ্চিও খুলতে পারল না। সে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল–আফা গো! ও আফা! মইরা গেলাম গো আফা! হোসেন সাহেব অল্প সময়ের মধ্যে এতগুলি উত্তেজনার দৃশ্য সহ্য করতে পারলেন না, ঝড়ের পরবর্তী ধাক্কাটার সঙ্গে সঙ্গে তিনিও মাথা ঘুরে মেঝেতে পড়ে গেলেন।

বৈশাখের ঝড়ের স্থায়িত্ব কম। ঝড় আসে, ছোট্ট একটা অঞ্চল। লণ্ডভণ্ড করে চলে যায়। সেদিনের ঝড় ঢাকা শহরের তেমন কোন ক্ষতি করল না— শুধু হোসেন সাহেবের বাড়িতে প্রবল একটা ছোেবল বসাল।

হোসেন সাহেবের স্থান হল সোহরাওয়ার্দি হাসপাতালে। তার বিছানার পাশে সাজ্জাদ বসে আছে। সাজ্জাদের মুখ হাসি হাসি। তিনি ভুরু কুঁচকে ছেলের দিকে তাকালেন। সাজ্জাদ বলল, আরাম করে একটা লম্বা ঘুম দাও তো বাবা।

তিনি ক্ষীণ স্বরে বললেন, আমার কি হয়েছে?

তোমার মায়োকাডিয়াল ইনফ্রাকশন হয়েছে। ঝড় দেখে ভয়ে তোমার পিলে চমকে গেছে। সেখান থেকে হার্ট এ্যাটাক।

ছেলে রসিকতা করছে কি-না। তিনি বুঝতে পারছেন না। হট এ্যাটাক কোন আনন্দজনক ব্যাপার না যে হাসিমুখে সংবাদটা দিতে হবে।

এটা কোন হাসপাতাল?

সোহরাওয়ার্দি হাসপাতাল। তোমাকে জায়গামতই এনে ফেলেছি। ভয় পাচ্ছ?

না।

ভেরী গুড। তোমার এ্যাটাকটা মাইলন্ড টাইপের–ভালমন্দ কিছু হবার কথাও না। ঘুমের অষুধ দেয়া হয়েছে। টানা একটা ঘুম দাও। সকালে এসে তোমাকে বাড়িতে নিয়ে যাব।

আমি এখানে একা থাকব?

এক কোথায়? শত শত রোগী আছে তোমার সঙ্গে।

আমাকে ফেলে চলে যাবি?

বাড়তি লোক থাকার কোন ব্যবস্থা নেই বাবা। তোমাকে কেবিন দেয়া হয়নি। কেবিন দিলে মেঝেতে চাদর বিছিয়ে শুয়ে থাকতাম।

কেবিন দেয়নি?

না।

তুই আমার পরিচয় দিস নাই?

পরিচয় দেব না কেন? তোমার নাম বলেছি, বাড়ির ঠিকানা বলেছি।

বিস্ময়ে হোসেন সাহেবের বাক রুদ্ধ হয়ে গেল। কি বলছে এই ছেলে! নাম আর বাড়ির ঠিকানা। এর বাইরে তার নাকি আর বলার কিছু নেই? তার এই গাধা ছেলে কি জানে না তার হার্ট এ্যাটাক হয়েছে এই খবরটা প্রচার হলে আধঘণ্টার মধ্যে খুব কম করে হলেও তিনজন মন্ত্রী ফ্ল্যাগ গাড়ি নিয়ে চলে আসবেন? প্রধানমন্ত্রী নিজে টেলিফোনে তাঁর স্বাস্থ্যের খোঁজ নেবেন। দেশের প্রতিটি প্রধান দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় ছবিসহ তার সংবাদ ছাপা হবে। গাধা ছেলে কি পত্রিকায় খবর দিয়েছে? মনে হয় না। যে ছেলে মনে করে শুধু নাম আর ঠিকানাতেই তার পরিচয়, তার কাছ থেকে এরচে বেশি কি আশা করা যায়?

তিনি চারদিকে তাকালেন–হলঘরের মত একটা ঘরে তাকে ফেলে রেখেছে। চারপাশে গিজ গিজ করছে রোগী। এতদিন তার মনে একটা ভ্ৰান্ত ধারণা ছিল–হাটের ব্যামো শুধু বিত্তবানদেরই হয়–। এই ধারণা তার এখন ভেঙেছে। তার চারপাশে আজেবাজে টাইপের লোক। একজন তাঁর চোখের সামনে নাকের সর্দি ঝাড়ল। সর্দি মাখা আঙ্গুল নির্বিকার ভঙ্গিতে নিজের শাটে মুছে ফেলল। এখন সে আবার পানের কৌটা খুলে সর্দি ভেজা নোংরা হাতে পান বানাচ্ছে। ওই গড! একটা টেলিফোন করা দরকার। খুবই দরকার। এই ওয়ার্ডে কি কোন ডাক্তার নেই? ডাক্তারকে বলে একটা টেলিফোন করানো যায় না?

পাশের বেড থেকে এক বৃদ্ধ বলল, কি খুঁজেন চাচা মিয়া?

হোসেন সাহেব জবাব দিলেন না। এরা কথা বলার মত কেউ না। তিনি ভেবে পেলেন। না–রাস্তার সব ফকির ধরে এরা হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে কি-না। কেউ এক আসেনি। সবার সঙ্গে একজন-দুজন করে আত্মীয় আছে। এরা রোগীর পাশে জায়গা করে দিব্যি গুটিশুটি মেরে ঘুমুবার আয়োজন করছে। একজন আবার চার-পাঁচ বছরের বাচ্চা নিয়ে এসেছে। বাচ্চাটা পুরোপরি উদোম। কোমরে শুধু কালো ঘুনশি। বাচ্চাটার হাতে পাউরুটি। সে পাউরুটির টুকরা কামড় দিয়ে ছিড়ছে এবং থু করে মেঝেতে ফেলছে। একজন আবার সঙ্গে সঙ্গে মেঝে থেকে সেই টুকরা তুলে বিছানায় জমা করছে। এক সময় নিশ্চয়ই এই টুকরাগুলি খাওয়া হবে। হোসেন সাহেব। আবার বিড় বিড় করে বললেন, ওহ গড!

হোসেন সাহেব বিছানায় উঠে বসলেন। ঘরের এক মাথায় চেয়ার-টেবিল পেতে দুজন তরুণ-তরুণী বসে আছে। তরুণীর গায়ে এপ্রন দেখে মনে হচ্ছে সে ডাক্তার। হোসেন সাহেব হাত নেড়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেন। মেয়েটি তা দেখেও উঠে এল না। সে হাত নেড়ে নেড়ে গল্প করেই যেতে লাগল।

পাশের বেডের বুড়ো আবার বলল, আপনের কিছু লাগব চাচা মিয়া? আমারে কন দেহি। আমার লোক আছে। সংগ্ৰহ কইরা দিব।

সবারই লোক আছে। রাস্তার ভিক্ষুকের মত দেখতে বুড়োও বলছে তার লোক আছে–অথচ তার কেউ নেই। তার ছেলে তাকে ভর্তি করিয়ে দিয়ে চলে গেছে। পরিচয় হিসেবে শুধু নাম আর বাড়ির ঠিকানা দিয়ে গেছে। কাউকে বোধহয় টেলিফোন করেও খবর দেয়নি। খবর দিলে এতক্ষণে ভিজিটাররা আসতে শুরু করতো। হাসপাতালের টনক নড়ে যেত।

তরুণী ডাক্তারনি এতক্ষণে র্তাকে দেখল। সে উঠে আসছে। বিরক্ত মুখে উঠে আসছে। এত বিরক্ত হবার কি আছে? হোসেন সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন।

কি হয়েছেআপনার?

একটা টেলিফোন করব।

টেলিফোন করবেন কেন? কোন সমস্যা হচ্ছে?

জ্বি না।

সমস্যা না হলে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। রেস্ট নিন। বসে থাকবেন না। শুয়ে পড়ুন।

হোসেন সাহেব শুয়ে পড়লেন। মেয়েটি তার লোহার খাটের পায়ের কাছ থেকে একটা কার্ড নিয়ে ভুরু কুঁচকে খানিকক্ষণ দেখল। তারপর যে রকম বিরক্ত ভঙ্গিতে এসেছিল। সে রকম বিরক্ত ভঙ্গিতে চলে গেল। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একজন নার্স হাতে একটা ট্যাবলেট এবং পানির গ্লাস নিয়ে উপস্থিত হল। ঘুমের অষুধা। ডাক্তার মেয়েটি বোধহয় পাঠিয়েছে।

তিনি অষুধ খেয়ে নিলেন। এখনো ঘুম আসছে না। আসবে বলেও মনে হচ্ছে না। না আসাই ভাল। ভিজিটাররা আসবে সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত। সাজ্জাদ কাউকে কিছু না জানালেও নীতু জানাবে। একজন কেউ জানলেই সেটা ছড়িয়ে পড়বে। খবরের কাগজ থেকেও লোকজন আসতে পারে। তাদের সঙ্গে দু-একটা হালকা এবং মজার ধরনের কথা বলতে হবে। সে কথাগুলি আগে গুছিয়ে রাখলে ভাল হয়। হাট বিষয়ক ইন্টারেস্টিং কোন কথা।

মানুষ তার আবেগ, ভালবাসা, ঘৃণার জন্ম ও অবস্থানের জন্যে যে স্থান নির্ধারিত করেছে সেটা হল হৃদপিণ্ড। হাট। প্রাচীনকাল থেকে মানুষের ধারণা–যাবতীয় ইমোশনের জন্ম-মৃত্যু হৃদপিণ্ডে। এর কারণ কি জানেন? এর কারণ হল–মানুষের শরীরের এই একটি অংশই দিবারাত্রি স্পন্দিত হয়। এই স্পন্দন কখনো থামে না।

হার্ট সম্পর্কে আরো কিছু বলতে পারলে ভাল হত। মনে পড়ছে না। এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকাটা হাতের কাছে থাকলে দেখে নেয়া যেত। টেলিফোন করতে পারলে নীতুকে বলে দিতেন ড্রাইভারকে দিয়ে এনসাইক্লোপিডিয়াটা পাঠিয়ে দিতে। আর ফ্লাস্ৰেক করে ঠাণ্ডা পানি। এখনো তার পানির পিপাসা হয়নি। তবে হবে। যদি হয় এখানকার পানি তিনি মরলেও খেতে পারবেন না।

হোসেন সাহেব আবার উঠে বসলেন। ডাক্তার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হাত ইশারা করলেন। টেলিফোন করা তাঁর অসম্ভব জরুরী। সাজ্জাদের কাল ইন্টারভ্যু আছে। ব্যবস্থা সবই নেয়া হয়েছে। সাজ্জাদ শুধু উপস্থিত হলেই হবে। প্রধানমন্ত্রী এই ব্যাপারে টেলিফোন করবেন কি-না তার সন্দেহ ছিল। তবে তিনি খবর পেয়েছেন–প্রধানমন্ত্রী টেলিফোন করেছেন। এখন গাধামার্কা ছেলে–বোর্ডের সামনেই হয়ত উপস্থিত হবে না।

ডাক্তার মেয়েটি উঠে আসছে। এবার সে একা আসছে না–সঙ্গে ছেলেটিও আসছে।

আপনার কি ব্যাপার বলুন তো?

একটা টেলিফোন করার দরকার ছিল।

আপনার যা দরকার তার নাম ঘুম। টেলিফোন না। কাকে টেলিফোন করতে চান?

হোসেন সাহেব দ্রুত ভাবছেন–কাকে টেলিফোন করার কথা শুনলে এরা ভড়কে যাবে? ডাক্তাররা কোন মন্ত্রণালয়ের অধীনে? সমাজ কল্যাণ না-কি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েরই হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এখন কে? মোবারক না? উহুঁ, মোবারক আছে যুব অধিদপ্তরে…

ডাক্তার ছেলেটি বলল, বুড়ামিয়া ঘুমানোর চেষ্টা করুন। শুয়ে পরুন তো। শুয়ে শুয়ে পাঁঠার সংখ্যা গুণতে থাকুন। হাজারখানিক পাঁঠা গুণতেই ঘুম চলে আসবে।

হোসেন সাহেব ছেলেটির অভদ্রতায় হতভম্বর হয়ে গেলেন। এই ছেলেটিকে কঠিন কোন শিক্ষা দেয়া দরকার। ছেলেটার ডিউটি কতক্ষণ কে জানে। ডিউটিতে থাকতে থাকতেই তার ভিজিটাররা চলে এলে মাইলড় একটা শিক্ষা হবে। যদিও যে অভদ্রতা সে করেছে তাতে মাইলড ধরনের শিক্ষা দিলে চলবে না।

তার ভিজিটাররা এখনো আসছে না কেন? এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে আর বাসা থেকে কাউকে খবর দেয়া হয়নি, বিশ্বাস করা কঠিন। ছেলেটা গাধা, মেয়েটা তো গাধা না।

শুনুন বুড়োমিয়া। চোখ বন্ধ করে থাকুন। ঘুমের অষুধ আপনাকে দেয়া হয়েছে। অষুধকে কাজ করার সুযোগ দিন। চোখ বন্ধ করে থাকুন।

হোসেন সাহেবের নিজেকে চোখ বন্ধ করতে হল না। আপনাতেই চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। তিনি অসহায় বোধ করছেন। ভিজিটাররা আসবে, তিনি ঘুমিয়ে থাকবেন–কে আসবে কে যাবে বুঝতেই পারবেন না। এর কি কোন মানে হয়। ওরা ফুল টুল নিয়ে আসবে। ফুল রাখারই বা জায়গা কোথায়? কেবিন হলে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা যেত।

ভিজিটার কেউ আসছে না। এও একদিক দিয়ে ভাল। তারা এসে দেখতো। তিনি একদল ফকির মিসকিনের সঙ্গে পড়ে আছেন। লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার মত অবস্থা হত। এই নরক থেকে উদ্ধার না পাওয়া পর্যন্ত টেলিফোন করা যাবে না। কবে উদ্ধার পাওয়া যাবে? সাজ্জাদ কি যেন বলে গেছে। সকালে? সকালে এলেই ইন্টারভ্যুর কথাটা মনে করিয়ে দিতে হবে। কে জানে তাঁর নিজেরই হয়ত মনে থাকবে না।

হাট এ্যাটাকের পর স্মৃতি শক্তি কমে যায়। ঠিকমত রক্ত না পাওয়ায় মস্তিক্ষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারটা অবশ্য মাইলন্ড এ্যাটাক। হয়ত তার মস্তিক্ষক ক্ষতিগ্রস্ত হয় নি। ওয়া ওঁয়া শব্দে কে কাঁদছে। আশ্চর্য কাণ্ড, নবজাত শিশুর কান্না আসছে কোত্থেকে? এটাতো মেটানিটি ওয়ার্ড না। হোসেন সাহেব প্রাণপণ চেষ্টা করলেন চোখ মেলতে। মেলতে পারছেন না। ওঁয়া ওঁয়া কান্না শুনতে শুনতে তিনি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ