মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে টেলিফোন এসেছে। টেলিফোন করেছে তার বড় ছেলে ইমতিয়াজ। ইমতিয়াজের গলার স্বর চাপা। ভীত ভাবও আছে।

বাবা!

হুঁ।

ভাল আছ বাবা?

হুঁ।

আমার বিষয়ে কেউ কি তোমাকে টেলিফোন করেছে?

না। তুই কি নতুন কোনো ঝামেলা পাকিয়েছিস?

উঁহুঁ। বাবা তোমরা কি মজা করছ? গানের দলটা কেমন?

জানিনা কেমন। গান শুরু হয় নি।

আচ্ছা বাবা শোন, আমি ছোট্ট একটা ঝামেলায় পড়েছি।

কি ঝামেলা?

কিছু দুষ্ট লোক আমাকে ফলস একুইজিশান দিচ্ছে। আমি নাকি একটা মেয়েকে রেপ করেছি। অথচ ঘটনা যখন ঘটে তখন আমি নারায়নগঞ্জে আমার এক বন্ধুর বাসায়। তুমি বিখ্যাত মানুষ হওয়ায় সবাই লেগেছে আমার পেছনে। আমাকে দিয়ে তারা তোমার ক্যারিয়ার নষ্ট করতে চায়।

মেয়েটা এখন আছে কোথায়? হা

সপাতালে।

পুলিশ কেইস হয়েছে?

ওরা কেইস করতে গিয়েছিল। ওসি সাহেব কেইস নেননি। উনি খুবই ভদ্রলোক। আমাকে টেলিফোন করে বলেছেন, চিন্তা না করতে।

পত্রিকায় জানাজানি হয়েছে?

এখনো হয়নি। পত্রিকা চেক দেয়ার ব্যবস্থা করেছি।

কি ভাবে?

টাকা পয়সা দিয়ে। তৌহিদ আছে আমার ফ্রেন্ড। সে এইসব ব্যাপারে ওস্তাদ।

টেলিফোনের লাইন কেটে গেল। আবুল খায়ের খান সাহেব কপালের ঘাম মুছলেন। তার ছেলে এখনো মন্ত্রীত্ব যাবার খরবটা জানে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই জেনে ফেলবে। তখন কি হবে? মন্ত্রীত্ব চলে যাওয়া পিতার পুত্ররা ভয়াবহ অবস্থায় পড়বে এটাতো জানা কথা। ইমতিয়াজ এ্যারেস্ট হবে আজ রাতেই। কোর্টে চালান করা মাত্র কোর্ট তিন দিনের রিমান্ড দিয়ে দেবে।

আবুল খায়ের খান সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। মন্ত্রী থাকতে থাকতে ছেলের বিয়ে দিতে পারলেন না। দিতে পারলে উপহার দিয়ে ঘর ভরতি করে ফেলতে পারতেন। গাড়ি পাওয়া যেত কম করে হলেও দুটা। নিউ টেক্সটাইলের মালিক মজিদ সাহেবতো বলেই রেখেছেন, ছেলের বিয়ের অন্তত ছমাস আগে আমাকে খবর দিবেন। আমি জাপান থেকে ব্রান্ড নিউ গাড়ি আনিয়ে দেব। আপনার ছেলে তার চাচার কাছ থেকে একটা নতুন গাড়ি পাবে না তো কে পাবে?

সুরমা নিজেই গ্লাসে করে দুধ এনেছেন। তিনি স্বামীকে আদুরে গলায় বললেন, এক চুমুকে খেয়ে ফেলতো। এই নাও এন্টাসিড। দুধ খাওয়ার পর একটা ট্যাবলেট খাবে।

খায়ের সাহেব দুধের গ্লাসে চুমুক দিলেন। সত্যিই বুক জ্বালাপোড়া করছে।

সুরমা বললেন, এই শোনো, ইমতিয়াজ এই মাত্র টেলিফোন করেছে। শত্রুতা করে কে না-কি তাকে ফাসাতে চেষ্টা করছে। ধানমন্ডি থানার ওসি সাহেবকে একটু বলে দিও। না-কি আমি বলব?

তোমার বলার দরকার নেই।

আমি বলতে পারি। আমাকে উনি খুবই সম্মান করেন।

খায়ের সাহেব বললেন, বললাম তো তোমাকে টেলিফোন করতে হবে। কথা যা বলার আমি বলব।

বাবুর্চি জিজ্ঞেস করছিল ডিনার কখন দিবে। ঠিক দশটার সময় দিতে বলব?

বল।

দুধের গ্লাস হাতে নিয়ে বসে আছ কেন। খাও।

তুমি তোমার কাজে যাও। আমি সময় মতো খেয়ে নেব।

সুরমা বললেন, তুমি একা একা আছ কেন? এসো সবাই গল্প করি।

খায়ের সাহেব বিরক্ত ভঙ্গিতে বললেন, আমাকে কিছুক্ষণ একা থাকতে দাও।

তোমার সমস্যা কি? দশটা না পনেরোটা না—একটা মাত্র শালী। আয়োজন করে বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছ, একটা কথা বলছ না। ওরা কি মনে করবে? যমুনার হাসবেন্ড কি যে ভালো জোক বলতে পারে। শুনলে হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাবে। এসো জোক শুনে যাও।

একটা জরুরি টেলিফোন করে আসি। পাঁচটা মিনিট দাও।

মনে থাকে যেন পাঁচ মিনিট—আমি কিন্তু ঘড়ি দেখব। পাঁচ মিনিটের মধ্যে না এলে যমুনা এসে তোমাকে এ্যারেস্ট করে নিয়ে যাবে।

সুরমা দ্রুত কেবিনের দিকে রওনা হলেন, তখনই ছোট্ট অঘটন ঘটল। সেলুন কারের একজন এটেনডেন্টের সঙ্গে তাঁর ধাক্কা লেগে গেল। এটেনডেন্টের হাতে ট্রে। ট্রে-তে তিনটা টমেটো জুসের গ্লাস। একটা গ্লাস গড়িয়ে পড়ল সুরমার শাড়িতে। সুরমা কঠিন গলায় বললেন, এই স্টুপিড। তুমি কি অন্ধ। জবাব দাও, তুমি কি অন্ধ? এই শাড়ির দাম জান?

এটেনডেন্ট বেচারা গেল হকচকিয়ে। এইবার তার হাতের ট্রে পড়ে গেল। দ্বিতীয় গ্লাসটাও গড়িয়ে পড়ল। সুরমা চেঁচিয়ে বললেন, এই স্টুপিডটাকে এখানে কে এনেছে? এই ব্যাটা বদমাশ কানে ধর। কানে ধর বললাম।

খায়ের সাহেব বললেন, সুরমা বাদ দাও তো।

সুরমা কঠিন গলায় বললেন, আমার এডমিনস্ট্রেশনে তুমি নাক গলাবে না। এদের শাস্তি না দিলে এরা ঠিক হবে না। হাদার মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? কানে ধর। কানে ধর বললাম। গুড! এখন উঠবোস কর। আমি না বলা পর্যন্ত থামবে না।

সেলুন কারের যাত্রীরা বের হয়ে এসেছে। নতুন বিয়ে হওয়া মেয়েরা স্বামী আশে পাশে থাকলে আহ্লাদ করতে পছন্দ করে। যমুনা সেই কারণেই হয়ত বলল, ভিডিও ম্যান কোথায়? এই ভিডিও ম্যান! দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ভিডিও করুন না। এমন একটা ইন্টারেস্টিং ইভেন্ট! আপনি ক্যামেরা নিয়ে হা করে আছেন।

ভিডিও ম্যান ভিডিও স্টার্ট করল। যমুনা বলল, আপা দেখ, ক্রিমিন্যাল মুখ বাঁকা করে আছে। কাদার চেষ্টা করছে। কাঁদতে পারছে না। হ্যালো ভিডিও ম্যান! আপনি ওর ফেসটা ক্লোজে ধরুন। বিগ ক্লোজ।

আবুল খায়ের সাহেব এই পর্যায়ে স্ত্রীর পাশে দাঁড়ালেন। তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বললেন, খুব জরুরি কথা, ঐদিকে চল। এক্ষুনি এসো। রাইট নাউ। সুরমা অনিচ্ছায় এগিয়ে গেলেন। কানে ধরে উঠবোসের দৃশ্য ভিডিও হচ্ছে। দেখতে তাঁর মজা লাগছে।

সুরমা বললেন, কি বলতে চাও?

আবুল খায়ের বললেন, আমার মন্ত্রীত্ব নেই।

কি বললে?

এক ঘণ্টা আগে খবর পেয়েছি। তোমরা আপসেট হবে বলে তোমাদের বলি নি।

সুরমা হতভম্ব গলায় বললেন, সর্বনাশ!

সর্বনাশ মানে, মহাসর্বনাশ। যাকে শাস্তি দিচ্ছ কিছুক্ষণের মধ্যে সেও জানবে আমি আর মন্ত্রী না। তখন কি হবে বুঝতে পারছ? যাও এক্ষুনি শাস্তি বন্ধ কর। যমুনা আর তার স্বামীকে এখনি কিছু বলার দরকার নেই। তাদেরকে পরে জানালেও হবে।

সুরমা কানে ধরে উঠবোস করা দৃশ্যের কাছে এগিয়ে গেলেন। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, হয়েছে হয়েছে আর লাগবে না। একসিডেন্ট সবারই হয়। আমি নিজে কতবার হাত থেকে গ্লাস ফেলেছি। আমার নিজের মেজাজ অন্য একটা কারণে খারাপ ছিল। ওভার রি-এক্ট করেছি। এই তোমার নাম কি?

সবুর।

সুরমা হ্যান্ড ব্যাগ খুলতে খুলতে বললেন, একশটা টাকা রাখো। চা নাশতা খেও।

সবুর টাকা নিল না। মেঝেতে পড়ে থাকা গ্লাস নিয়ে সেলুন কার থেকে বের হয়ে গেল।

যমুনা বলল, কত বড় বেয়াদব দেখেছ আপা। থাপড়ায়ে এর দাঁত ফেলে দেয়া উচিত ছিল। তুমি আবার মহিলা হাজী মোহাম্মদ মহসীন হয়ে গেলে— একশ টাকা বখশিস।

 

মাওলানা আজিজুর রহমান স্ত্রীর হাত ধরে বসে আছেন। ভয়ে এবং আতংকে তিনি অস্থির। নিজের মনের ভয় কমানোর জন্যে তিনি ইয়া আহাদু একশবার পড়েছেন। মনের ভয় কমছে না। সত্যি সত্যি ট্রেনে কিছু হয়ে গেলে মহা বিপদ হবে। ট্রেনের এটেনডেন্ট বসিরকে কানে কানে বলেছেন একজন লেডি ডাক্তার আছে কি-না এই খোঁজ করতে। ব্যাটা খোঁজ করবে কি-না কে জানে। তিনি নিজেই প্রতিটি বগিতে গিয়ে ডাক্তার খুঁজতে পারেন। স্ত্রীকে ফেলে যেতে ইচ্ছা করছে না। তিনি মহাবিপদের দোয়া একমনে পড়ে যাচ্ছেন। দোয়া ইউনুস।

ব্যাথার একেকটা প্রবল ঝাপ্টা আসছে আফিয়া স্বামীকে খামচি দিয়ে ধরছে এবং ব্যাকুল গলায় বলছে আমার আম্মু কই। ও আম্মু আম্মু।

মাওলানা বললেন, আল্লা-খোদাকে ডাক। আম্মা আম্মা করছ কেন?

আফিয়া বলল, আল্লাহপাকরে তো আপনি ডাকতেছেন। আমি আম্মুরে ডাকি। ও আম্মু। আম্মু।

মাওলানা বললেন, সমস্যা তুমি তৈরি করেছ। আম্মার কাছে যাব। আম্মার কাছে যাব। এখন দেখেছ অবস্থা। তোমার মার কাছে যাবার জন্যে রওনা না দিলে এই বিপদ হত না।

আফিয়া বলল, চুপ করে বসে থাকেন। কথা বন্ধ। কথা বললে কানে ঝন ঝন করে।

মাওলানা চুপ করে গেলেন। তিনি মনে মনে দুরুদে-শেফা পাঠ করা শুরু করেছেন।

 

বসির আরেক দফা বরফ এনেছে। রশীদ সাহেব তার হাত ধরে বললেন—

You are a good boy
You will get a toy.
তবে এখন খেলার সময় নয়।
একটা খবর যে জোগাড় করতে হয়।

বসির বলল, স্যার! কি খবর জোগাড় করব?

রশীদ সাহেব বললেন, যে মৃত ব্যক্তিটি আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে তার পরিচয় আমার জানা দরকার। জটিল গবেষণার মধ্যে পড়ে গেছি। মৃত ব্যক্তির নাম এবং আমাদের মন্ত্রী মহোদয়ের জন্ম তারিখ জানা অতি জরুরী।

বসির বলল, মরা মানুষ তো কেউ যাচ্ছে না।

তুমি তো খবর দিলে একটা ডেড বডি যাচ্ছে।

বসির লজ্জিত গলায় বলল, ভুল খবর দিয়েছিলাম স্যার। চাদর দিয়ে ঢেকে কামরায় তুলেছে তখন ভেবেছি লাশ।

এখন সে লাশ না?

জি-না। চা-কফি খেয়েছে।

ছেলে না মেয়ে?

ছেলে।

বয়স কত?

ত্রিশ পঁয়ত্রিশ।

নাম জিজ্ঞেস করেছ?

নাম জিজ্ঞেস করি নাই।

চাদর দিয়ে ঢেকে তাকে তুলেছে কেন?

জানি না।

রশীদ সাহেব বললেন, মিথ্যা কথা বলছ কেন বসির? হঠাৎ তোমার মিথ্যা বলার প্রয়োজন পড়ল কেন? আমি ঐ কামরায় গিয়েছিলাম। মৃত ছেলেটির মার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তারা ডেড বডি কফিনে করে নিয়ে যাচ্ছে। কফিনে প্রচুর বরফ এবং প্রচুর চা পাতা দেয়া হয়েছে। ঠিক বলছি না?

বসির কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, জি স্যার।

বসির জবাব দিল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। রশীদ সাহেব বললেন,

You are a naughty boy
You will not get a toy.

আমার সামনে থেকে দূর হবার হয়েছে সময়।

সামনে থেকে যাও।

বসির দ্রুত বের হতে গিয়ে দরজায় বাড়ি খেল। রশীদ সাহেব ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ছেলেটা মিথ্যা কথা কেন বলল?

আশহাব বলল, বুঝতে পারছি না। কারণ ছাড়াই হয়ত বলেছে।

রশীদ সাহেব বললেন, কারণ ছাড়া কেউ মিথ্যা বলে না। তবে প্যাথলজিক্যাল লায়াররা বলে। সমগ্র মানব গোষ্ঠীর অতি ক্ষুদ্র অংশই প্যাথলজিক্যাল লায়ার। বসির নামের এই ছেলের মিথ্যা বলার পেছনে অবশ্যই কারণ আছে। কারণটা বের করতে হবে।

আশহাব বলল, আপনি সব সময় কিছু না কিছু নিয়ে চিন্তা করেন।

রশীদ সাহেব বললেন, আমি একা না, তুমি নিজেও সব সময় কিছু না কিছু নিয়ে চিন্তা কর। ডাক্তার হিসেবে তুমি এই তথ্য নিশ্চয়ই জান যে মানুষের হার্ট এবং ব্রেইন কখনো বিশ্রাম নেয় না। হার্ট এবং ব্রেইনের বিশ্রাম নেয়ার অর্থ মৃত্যু। ঘুমের মধ্যে হার্ট যেমন কাজ করে ব্রেইনও কাজ করে। ভাল কথা, এই মাত্র তোমার ম্যাজিকের কৌশলটা আমি ধরে ফেলেছি।

সত্যি?

আমাকে কয়েনটা দাও আমি দেখাচ্ছি। ট্রেনে যাত্রীদের নিয়ে আমি যখন কনশাসলি চিন্তা করছিলাম তখন আমার ব্রেইন নিজের উদ্যোগে চিন্তা ভাবনা করে কৌশলটা বের করেছে।

আশহাব একটা কয়েন দিল। রশীদ সাহেব বললেন, তোমাকে ম্যাজিকটা দেখালে তুমি মজা পাবে না। কারণ তুমি কৌশলটা জান। এক কাজ কর ঐ মেয়েটাকে ডেকে আন। সে মজা পাবে।

দশটা মিনিট পরে যাই স্যার?

দশ মিনিট পরে যাবে কেন?

আশহাব বিব্রত গলায় বলল, আমার মা আমার উপর বিশেষ একটি কারণে খুবই রেগে আছেন। তার রাগ পড়ার সময় দিচ্ছি। আধাঘণ্টা থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যে সাধারণত তার রাগ পড়ে যায়।

তুমি হিসেব করে বের করেছ?

না। আমার বাবা হিসেব করে বের করেছেন। মা বেশির ভাগ রাগ বাবার সঙ্গে করতেন। বাবার সারভাইবেলের জন্যে হিসাবটা দরকার ছিল।

উনি কি করতেন?

ব্যাংকার।

গুড আমরা পনেরো মিনিট অপেক্ষা করব।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ